শিবশক্তি এবং বৈষ্ণব একই স্রোতে প্রবাহিত
বারিদ বরন গুপ্ত
পৃথিবী সৃষ্টির মূলেই আছে প্রকৃতি এবং পুরুষের সম্মিলিত শক্তি , পরবর্তীকালে সভ্যতা সৃষ্টিতে এর বাস্তব প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়, তাই কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছা করে–
“এই পৃথিবীর যা কিছু চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী
অর্ধেক তার নর!”
ভারতের প্রাচীন সভ্যতা, হরপ্পা সভ্যতায় প্রোটো শিব এবং উর্বরা শক্তির আঁধার রূপে বিভিন্ন মাতৃ দেবীর আরাধনা করা হতো, শুধু তাই নয় কৃষিভিত্তিক জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে নব্য প্রস্তর যুগ থেকেই নারী বা প্রকৃতিকে উর্বরা শক্তির আঁধার রূপে কল্পনা করা হয়েছে, বিবর্তনের পথে তা আদ্যাশক্তি মহামায়ায় রূপান্তরিত হয়েছে, পরবর্তীকালে শিবশক্তির মিলিত রূপ বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনায় দেখতে পাওয়া যায়।
শিবশক্তির আরাধনার পাশাপাশি বর্ধমান জেলার সেই প্রাচীনকাল থেকেই অর্থাৎ গুপ্ত যুগের পরবর্তীকাল থেকেই বলা যায় বিষ্ণুর আরাধনা প্রসার লাভ করে, বর্ধমান জেলার বিভিন্ন জায়গায় লোকেস্বর বিষ্ণুর মূর্তি পাওয়া গেছে, যেমন মন্তেশ্বর ব্লকের সিজনে গ্রামে, মেমারী ব্লকের উন্তিয়া গ্রামে, পূর্বস্থলী ব্লকে নিমদে গ্রামে মন্তেশ্বর ব্লকের দেনুড় পাতুন সহ খড়ি এবং অজয় নদীর তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রচুর বিষ্ণু মূর্তি উদ্ধার করা হয়েছে, এখনো পাওয়া যাচ্ছে! এ থেকে প্রমাণিত হয় অতীতে বর্ধমান জেলায় ধর্ম, চন্ডী ইত্যাদির পাশাপাশি বিষ্ণুদেবের ও আরাধনা করা হতো! তাই শিব শক্তি এবং বৈষ্ণব আরাধনা সেই প্রাচীনকাল থেকেই এক স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে!
পাল যুগে বৌদ্ধধর্ম প্রসার লাভ করলেও হিন্দু দেবদেবীর আরাধনা কিন্তু যথেষ্ট চালু ছিল। পাল যুগের শেষের দিকে বৌদ্ধধর্ম হীনবল হয়ে পড়ে! ফলে বহু বৌদ্ধ দেবদেবী হিন্দু ধর্মের মধ্যে এসে যায়, যেমন তারা, জাঙ্গুলী, প্রভৃতি! তাছাড়া পাল যুগের শেষ পর্ব থেকেই মহিষমর্দিনী সিংহবাহিনী, দ্বিভূজা চতুর্ভূজা, অষ্ট পূজা, দশভূজা প্রকৃতির দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটে, সেন যুগের শেষ দিকে তান্ত্রিক হিন্দুধর্ম বিকশিত হয়! তবে তুর্কি আক্রমনের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে এক
অস্থিরতা নেমে আসে, ধর্ম কর্মে তার প্রভাব ও লক্ষ্য করা যায়! ধর্ম, চন্ডী, মনসা প্রভুতি দেব-দেবী মধ্যযুগে প্রসার লাভ করে ! সেই বার্তা আমরা পাই দেন্দুড় নিবাসী চৈতন্য ভাগবত প্রনেতা বৃন্দাবন দাসের কলম থেকে-
:”ধর্ম কর্ম লোকে এইমাত্র জানে!
মঙ্গলচন্ডীর গীত করে জাগরণে!!”
যাই হোক প্রাক চৈতন্য পর্বে বাংলার সমাজ জীবনের এবং ধর্মীয় ভাবধারার যে একটা অস্থিরতার ভাব এসেছিল তা কিন্তু পরিষ্কার!
তবে চৈতন্য মহাপ্রভু অর্বিভাবের পরবর্তীকালে সেই অস্থিরতা ভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকে, বৈষ্ণব ভাবধারা আবার স্বমহিমায় ফিরে আসে! ধর্ম আচরণের ক্ষেত্রে শিব- শক্তি- বৈষ্ণব ভাবধারা স্বমহিমায় এক স্রোতে বিরাজ করতে থাকে!
আজ কাটোয়া থানা এবং মন্তেশ্বর থানার মিলন কেন্দ্র সেই পাল বাবুর বিচরণ ক্ষেত্রের পাশে, অর্থাৎ ওকি দত্তপুর ধ্বংসস্তূপের কাছেই শিবশক্তি আশ্রমে সেই সন্মিলিত ভাবধারার চিত্রপট আমার সামনে ফুটে উঠেছে! দেখলাম এখানে রাধা কৃষ্ণ শিব কালী একই মঞ্চে পাশাপাশি বিরাজ করছেন, দুদিকে রয়েছেন চৈতন্য মহাপ্রভু এবং নিত্যানন্দ প্রভু! মনে হল প্রাচীন, মধ্য এবং আধুনিক যুগকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলা হয়েছে। মনোরম দৃশ্যপট ধর্মীয় জীবনধারার মাপ কাঠিতে সমাজ জীবনকে যেমন বোঝা যায় তেমনি বিবর্তনের ইতিহাসটাও অনেকটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।
উল্লেখ্য যে পাল বাবুর ধ্বংসস্তূপের কাছেই এই আশ্রমটি তৈরি করেন অমল আশ্রম মহারাজ! তার আদি নিবাস ছিল কিশোরগঞ্জে, নবদ্বীপ কলেজে পড়া সমর্পণ করে তিনি চলে যান দক্ষিণ ভারতে, আদিগুরু শংকরাচার্যের ‘আশ্রম’ সম্প্রদায়ের কাছে তিনি দীক্ষা গ্রহণ করেন, এবং ‘দন্ডি’ সন্ন্যাস রূপে পরিচিত হন, তিনি দীর্ঘদিন উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন আশ্রমে দিন কাটিয়েছেন! সমসপুরের জনৈক ঘোষ সম্প্রদায়ের আমন্ত্রণে তিনি ওকি দত্তপুরে এসে আশ্রম তৈরি করেন! তার আশ্রমের নাম শিবশক্তি আশ্রম! এছাড়া পাটুলি এবং কৃষ্ণনগর অঞ্চলগুলোতে তাঁর অনেক
আশ্রম রয়েছে বলে জানা গেছে!জামালপুরের অনতি দূরে এই আশ্রম, সত্যিই সেই দেবাদিদেব শিব এবং শক্তিরূপিনী আদ্যাশক্তি মহামায়ার যুগলবন্দী, সৃষ্টি স্থিতি লয় অনাদি অনন্ত ব্রহ্ম, তার পাশে রাধা কৃষ্ণ গৌর নিত্যানন্দ! আজকে ওনার কাছে অনেক কিছু জানা গেল! যাই হোক সেই প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ধর্ম সংস্কৃতির একটা দিক তিনি এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে প্রতিষ্ঠা করেছেন! ওনার শিবশক্তি আশ্রম যেন তিনটি যুগকে একসাথে বেঁধে ফেলেছে।
Mode:: Field study on second January 2023
Source:: Amol Ashram Maharaj, Ananda Bharati, Dasarath Brahmachari ! Somospur Monteswar East Burdwan !!
Barid Baran Gupta