প্রাক ব্রিটিশ ভারতে শিবরাত্রির প্রচলন হয়
বারিদ বরন গুপ্ত
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজে মানুষজন শিবচতুর্দশীতে অর্থাৎ শিবরাত্রিতে সারা সারা রাত জাগত, উদ্দেশ্য একটাই সর্বত্যাগী ভোলানাথের আশীর্বাদ লাভ করে জীবনের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ! এর পেছনে কাজ করেছিল শিব কাহিনী, শিবের মাহাত্ম্য বা বিভিন্ন গল্প গাথা, শিবের আশীর্বাদ প্রাপ্ত সেই ব্যাধের গল্প, একদিন বনে শিকারে গিয়ে সন্ধ্যায় অন্ধকারে সে পথ হারায়, বন্য পশুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে একটা বেল গাছে, তার শরীর এবং হাতের ছোঁয়ায় এক একটা বেল পাতা পড়ে গাছের নিচে রক্ষিত শিব স্তম্ভে, সেদিন ছিল শিব চতুর্দশী, শিবের সৃষ্টির সময় পর্ব,শূধু তাই নয় শিবের আরাধনা ও আশীর্বাদ লাভের প্রকৃষ্ঠ সময়! তারপরের দিন সকালে সে বাড়ি গিয়ে এক অতিথি কে যৎসামান্য ফলাহার করায়! এতে শিব সন্তুষ্ট হয়, ফলে সে মুক্তির আশীর্বাদ লাভ করে, পরে তার মৃত্যু হলে যমের দূত তাকে যমালয়ে নিয়ে যেতে চায়, ফলে স্বাভাবিকভাবে শিবের অনুচরদের সাথে তাদের লড়াই এবং অনুচরদের জয়লাভ, যার ফলে শিবের দর্শন পেয়ে তার মুক্তি ঘটে! এই ধরনের শিবের মাহাত্ম্য বা গল্প কাহিনী গ্রাম সমাজকে একসময় আলোকিত করেছিল! শুরু হয়েছিল শিবচতুর্দশী পালন অর্থাৎ শিবরাত্রি, শিবের মাহাত্ম্য লাভের জন্য রাত্রি জাগরণ।
কবে থেকে শিবরাত্রি চালু হল তার সঠিক সময় পর্ব হয়তো জানা সম্ভব নয়, কারণ প্রাচীন বাংলার প্রেক্ষাপটে শিবের আগে ধর্ম, চন্ডী বা মনসার আরাধনার প্রচলন বেশি ছিল! শিব আদপে অনার্য সংস্কৃতির দেবতা, শিবের সাথে ধর্মের আচরণ পদ্ধতির খুব একটা অমিল নেই, বরং মিল টাই বেশি! অনেকে মনে করেন কৃষিভিত্তিক সভ্যতার একটু উন্নত পর্যায়ে এসে ধর্ম শিবে পরিণত হয়েছিল!
হরপ্পা সংস্কৃতিতে আমরা আদি শিবের পরিচয় পাই, বিভিন্ন শিলমোহর, বা টুকরো লিঙ্গ ধরনের পাথরগুলোকে দেখে মনে হয় হরপ্পা সংস্কৃতিতে লিঙ্গ অর্থাৎ শিব পূজার প্রচলন ছিল! বৈদিক যুগে আবার আমরা রুদ্র দেবের পরিচয় পাই, পরবর্তী বৈদিক যুগে অর্থাৎ আর্য সংস্কৃতির প্রসার পর্বে এই রুদ্র দেব আবার শিব রূপ লাভ করে! গোটা ভারত এমনকি ভারত উপমহাদেশে এই রুদ্র দেবের পূজার প্রচলন হয় বলে মনে করা হয়, এভাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে উদ্ভব হয় দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের!
রাঢের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এখানে আর্যীকরণ ঘটেছে অনেক পরে, খুব সম্ভবত সেন পরবর্তী যুগে আর্যীকরন সম্পন্ন হয়! তবে পাল যুগের শেষ পর্বে এবং সেন যুগে বহু সামন্ত রাজারা সামাজিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে শিবের আরাধনা করতো বা শিব মন্দির নির্মাণ করেছিল, সেইসব শিব মন্দিরের ভগ্ন স্তূপ অনেক জায়গায় এখনও দেখা যায়! তবে তখনও আর্যীকরন সমাজের সমভাবে হয়নি! অনার্যদের কিছু অংশ সেই সময় পর্বে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির মধ্যে এসে যায়, বিদ্যা চর্চার অগ্রগতি ক্ষেত্রে এরা এগিয়ে যায়, ফলে বঙ্গে সুলতানি বা মোগল শাসকদের নেক নজর আসে, জমিদারি বা জায়গীরদারী লাভ করে, শিব মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করে! খুব ধুম ধাম করে শিব চতুর্দশী পালন করে! স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজে শিবের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে! শিবের আরাধনা পর্ব খুব সহজ সরল, সামান্য গঙ্গাজল বিল্ল পত্রে তিনি তুষ্ট, শিবায়ন সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা গ্রাম বাংলার গৃহী জনগণের খুব কাছের বলে মনে হয়! স্বাভাবিক ভাবে জমিদারি অন্দরমহল থেকে শিব সাধারণ গ্রাম সমাজে প্রবেশ করে! ব্রিটিশ ভারতে এর প্রচার এবং প্রসার আরো অনেক বেড়ে যায়, পত্তনীদার বা ছোটখাট জমিদাররা ও শিব মন্দির প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে পড়ে! এভাবেই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সমাজে শুরু হয় শিবচতুর্দশী বা শিব জাগরণ, শিবরাত্রি!
তবে একটা কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই যে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর মানুষদের কাছে তখনো ধর্ম চন্ডী বা মনসাই ছিল প্রধান দেবতা, এইসব দেবদেবী গুলো ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির কব্জায় এসেছে অনেক অনেক পরে, তবে শুরুটা হয়েছিল প্রাক চৈতন্য পর্বের এক সামাজিক অস্থিরতার টানাপোড়েনে ! তবুও প্রাক ব্রিটিশ বা বৃটিশ ভারতে এইসব নিম্ন শ্রেনীর মানুষের কাছে শিব আরাধনার অধিকার ও ততটা ছিল না। যাই হোক স্বাধীন ভারতের সমাজ সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে! তাই শিবচতুর্দশী বা শিবরাত্রি সমাজ সংস্কৃতির আঙ্গিনায় আরো অনেক গুন প্রসারিত হয়েছে, শিব চতুর্দশী বা শিবরাত্রির আচার অনুষ্ঠানের ও পরিবর্তন ঘটছে! ভবিষ্যতে আরো কতটা পরিবর্তন ঘটবে হয়তো ভবিষ্যৎই বলবে!
Barid Baran Gupta