পানিহাটি থেকে রায় দোগাছিয়া এক দীর্ঘ ইতিহাস: দশমা ও গোপীনাথ
বারিদ বরন গুপ্ত
পূর্বস্থলীর ইতিহাস যেমনি অতি প্রাচীন, তেমনি প্রাচীন রায় দোগাছির রায়চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস! অজস্র খাল বিল নদী নালার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় এই পূর্বস্থলীতে! ভূতত্ত্ববিদদের অনুমান আজ থেকে প্রায় ১৫০০ বছর আগে বর্ধমান ভুক্তির পূর্বাংশ থেকেই সমুদ্রের অস্তিত্ব ছিল, কে জানে সমুদ্রগড় নামকরণের মধ্যেই হয়তো তার অস্তিত্ব লুকিয়ে ছিল! কালক্রমে পলি সঞ্চয় হতে হতে ভরাট হতে থাকে। জাগে থাকে চর বা দ্বীপ, এই ভাবেই হয়তো একদিন জেগে উঠেছিল পূর্ব থল বা পার্থেলিস, অপভ্রংশে পূর্বস্থলী! Pleeny এর বিবৃতিতে পারথেলিস জনপদের কথা জানতে পারা যায়, অনেকের মতে প্রাচীন গঙ্গারিডির রাজধানী ছিল এই পারথেলিস! মেগাস্থিনিস প্লুটার্ক প্রমুখদের বিবৃতিতে এখানকার যোদ্ধা জাতির কথা উঠে আসে, যার কারনেই হয়তো আলেকজান্ডার এ দেশ আক্রমণ না করে পিছু হটেছেন? যাইহোক রহস্য এবং রোমাঞ্চে ভরা এই পূর্বস্থলী! তেমনি রহস্যাবৃত পূর্বস্থলী রায় চৌধুরী পরিবারের ইতিহাস,!
পূর্বস্থলী রায়চৌধুরী পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল অবিভক্ত 24 পরগনা জেলার পানিহাটিতে! এবং এই বংশের আদি পুরুষ অনন্তরাম কর। রাঢীয় ও সৈকালিন কায়স্থ এবং ভরদ্বাজ গোত্রীয় এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারটি তৎকালীন সময়ে শিক্ষা-দীক্ষায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল বলে জানতে পারা যায়, যার ফলে নজর কাড়ে গৌড়ের সুলতানদের! গৌড়ের সুলতানিতে এরা রাজস্ব সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং খাঁ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন! এই ঐতিহ্যবাহ রাঢীয় সৌকালীন কায়স্থ পরিবারের প্রথম খাঁ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন অনন্তরাম করের পুত্র ঈশান চন্দ্র কর,
তারপরে তার পুত্র দক্ষিণারঞ্জন কর ও খাঁ উপাধি প্রাপ্ত হয়ে ভাগীরথীর সন্নিকটে মেড়তলার জমিদারি প্রাপ্ত হন এবং বসতি গড়ে তোলেন! তবে মেড়তলায় রায় চৌধুরী বংশের জমিদারি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি , খুব সম্ভবত রাজস্ব সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে বিবাদের পরিপেক্ষিতে জমিদারি অনেকাংশ চলে যায়, ফলে স্বাভাবিকভাবে তারা বসবাস উঠিয়ে চলে আসে প্রাচীন গঙ্গা তীরবর্তী কুকশিমলা সন্নিকটে গোবিন্দপুরে! তবে এখানেও তাদের স্থায়িত্ব বেশিদিন হয়নি, হয়তো গঙ্গার তীরবর্তী নিম্নভূমি অঞ্চলের বসবাসের অনুপযুক্ত হেতু উত্তম উচ্চভূমি খোঁজে তারা উঠে আসে অরণ্য ঘেরা বাঘ্র সংকুল প্রাচীন দামোদর খাতের সন্নিকটে দোগাছিয়ায়, দুটো অতি প্রাচীন অশ্বথ গাছ যেন গোটা অঞ্চলটিকে ছায়া দিত, এই রায় চৌধুরী বংশের এক সদস্য জয়ন্ত দে সরকার আমায় জানালেন গাছের সর্বোচ্চ উপরে পাখি বসে থাকলেও তার ঠিকমতো বোঝা যেত না! পরবর্তীকালে গাছটা কাঁটা হলে বেশ কয়েকটি লরি লেগেছিল বহন করার জন্য, কিন্তু তার গুড়িটা তোলার ক্ষমতা কারো হয়নি! একটা গাছ ছিল বর্তমানে সন্মুখ পুকুরের একেবারে পাড়ে
অপরটি দশমা মন্দিরের একেবারে সম্মুখে, শোনা যায় নাকি এই দুটো গাছের সমারহ থেকেই এই জনপদের নাম হয়েছে দোগাছি, অপভ্রংশে দোগাছিয়া!
রায়চৌধুরী পরিবারের ন মেড়তলা পর্ব খুব সুখকর না হলেও একেবারে নিরস ছিল না! এখানেও তারা উন্নয়নের যথেষ্ট ধারা বজায় রেখেছিলেন! এখনো রায়চৌধুরী পরিবারের সৃষ্টি শিব মন্দির মেড়তলায় বিরাজ করছে, শোনা যায় নাকি? শ্রীধর কর গঙ্গার তীরবর্তী স্থানে একটা সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী মন্দির ও তৈরি করেছিলেন, পরবর্তীকালে গঙ্গার দিক পরিবর্তনের তা বিলীন হয়ে যায়। শিবশক্তির এক বিচিত্র সমারহ তার মধ্যে দেখা গিয়েছিল! শোনা যায় গঙ্গায় স্নান করে তিনি প্রত্যহ সকাল এবং সন্ধ্যায় মায়ের আরাধনা করতেন! তার এই আরাধনা পর্বের সাথে কোন নবাব বা সুলতানের বজারার গুন কাঁটার এক কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে, সেই কাহিনী কথাটা সত্য বা মিথ্যা তা হয়তো অনুমান সাপেক্ষ, তবে সুলতানদের সাথে তিক্ততার সূত্রপাত যে হয়েছিল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই!
দোগাছিয়া রায় চৌধুরী পরিবারের প্রথম রায়চৌধুরী উপাধি প্রাপ্ত হন রূপনারায়ন কর! খুব সম্ভবত মুঘল জামানায়! দোগাছিয়া রায় চৌধুরী পরিবারের প্রথম স্থাপত্য নিদর্শন কিন্তু সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনী দশমা মন্দির ! এটি তৈরি হয় সপ্তদশ শতকে একেবারে প্রথমার্ধে , অষ্টধাতুর তৈরি দশভূজা মূর্তি অনুপম শিল্প সৌন্দর্যের নিদর্শন ছিল, দুর্ভাগ্য যে দশভূজা এবং রাধানাথ মূর্তি দুটি চুরি হয়ে যায়! পরবর্তীকাল আবার দশমা মূর্তী তৈরি করা হয়! দীর্ঘকাল এই দশমা মন্দিরে খুব ধুম ধামের সাথে মহামায়া আরাধনা করা হতো! হোম যজ্ঞ কোন কিছুই বাকি ছিল না! পরবর্তীকালে রায় চৌধুরী পরিবার ৬ টি অংশে ভাগ হয়ে যায়! ফলে পৃথক পৃথক মহামায়া আরাধনা চলতে থাকে, কিন্তু সব আরাধনার কেন্দ্রীয় করণ কিন্তু দশমা!
** আগামীকাল গোপীনাথ মন্দির এবং দোল উৎসব, সঙ্গে থাকুন! নমস্কার!
Barid Baran Gupta