দোগাছিয়া রায়চৌধুরী পরিবার ও দোল উৎসব
বারিদ বরন গুপ্ত
ওই দেখা যায়
আলো- আঁধারে
কর বাবুদের বাজরা ভেসে যায়
দোগাছিয়ার যমুনা তীরে —-
হারিয়ে গেছে কবে
হিংস্র শার্দুলের গর্জন—”
সত্যিই তাই দোগাছিয়ার কর বাবুদের ইতিহাস অনেকটাই আলো-আঁধারি ছায়ায় ঘুরছে! যেন মধ্যযুগের ইতিহাসের কয়েকটা পাতা আলোআঁধারিতে ঘুরপাক খাচ্ছে! যেন তৃষ্ণার্থ পথিককে মরুভূমির মরীচিকা যেন ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে, দৌড় দৌড় দৌড়—, কে জানে হয়তো মিলে যেতে পারে কোন ওয়েসিস! কিন্তু ইট কাঠ পাথরের ধ্বংসস্তূপ লুকিয়ে রেখেছে অন্তঃসলিলা যমুনা! বারে বারে উঁকি মারে, ছুটে যায় তার তীরে, হারিয়ে গেছে কবে হিংস্র শার্দুলের গর্জন।
আজ সারাদিন কেটে গেল দোগাছিয়ায় কর বাবুদের অন্দরমহলে। কয়েক ঘন্টার ঝটিকা সফর, গোপীনাথ রাধানাথ রাধারাণী আর মদন মোহন হোলিকা দহনের বিজয় উল্লাসে দোল মঞ্চে এসে একে একে দোল খাচ্ছে! নয়নাভিরাম দৃশ্য যেমন সুদৃশ্য পঞ্চরত্ন দোল মন্দির, সম্মুখ ঘাটের কাছে, প্রায় মাটি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে এই সদৃশ্য দোল মঞ্চ তৈরি করেছেন রায়চৌধুরীর পরিবার! শুনলাম এক সময় নায়েব গোমস্তা সহ সংশ্লিষ্ট জমিদার, উজির, নীলকর সাহেবদের আমন্ত্রণ জানানো হতো এই অনুষ্ঠানের জন্য! তাছাড়া সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের প্রজারা এসে হাজির হত! সকলে যাতে দোল-পর্ব দেখতে পায়, তার জন্য হয়তো এই ব্যবস্থা নিয়েছিলেন ঐতিহ্যবাহী রায় চৌধুরী পরিবার!
শোনা যায় এই দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে রায় চৌধুরী পরিবার একসময় এলাহীখাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করত! সঙ্গে থাকতো রাম যাত্রা, কেষ্ট যাত্রা সাঁওতালি নাচ সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান! অনুষ্ঠান শেষে মিষ্টিমুখ ছিল এই দোল যাত্রার অন্যতম দিক! একসময় রায়চৌধুরী পরিবারের বিশাল ভিয়েন বসত! সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হতো! সেই জমিদারি আজ আর নেই, কিন্তু আছে ঐতিহ্যবাহী মেলা, রায়চৌধুরী পরিবারের সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছি এলাহী ‘মিষ্টির মেলা’ ! অন্যান্য জমিদারদের মুখেও শুনেছি দোগেছিয়া রায় চৌধুরী পরিবারের অতিথি আপ্যায়নের প্রসঙ্গটি! এরা আগাগোড়া দ্বিজ দেবে এবং অতিথিদের যথাযোগ্য সম্মান দিয়েছেন! ব্রাহ্মণদের ব্রহ্মত্বর জমি দান করেছেন, প্রজা পালনে যেমন কোনরকম কুন্ঠিত করেন নেই, তেমনি কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এরা আপোষও করেননি! গৌড়ের সুলতানি মুঘল বা মুর্শিদাবাদের নবাবদের ওদ্ধত্য ও সহ্য করেননি ! এই নিয়ে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠেছিল মেড়তলা পর্বে! এই নিয়ে আলোচনা থাকবে আমার গ্ৰন্থ খড়িনদীর তীরে এবং জমিদারি অন্দরমহলে!
যাই হোক আজ দোল মঞ্চের সামনে এসে এক মনে দাঁড়িয়ে আছি! আজকেই ভোর বেলায় দোল মঞ্চে রাধানাথকে নিয়ে এসেছেন রায়চৌধুরী বংশের কুলো পুরোহিত ভটচাজ মশাই! লোভ সামলাতে পারলাম না, কাঠের সিঁড়ি বেঁয়ে উঠে গেলাম উপরে দেখলাম ভটচাজ মশাই আপন মনে হোম পরিচালনা করছেন! আর রাধানাথ আপন মনে দোল খাচ্ছেন! অপূর্ব দৃশ্য পাঠ, রায়চৌধুরী পরিবারের পূর্বসূরীদের দূরদর্শিতাকে কুর্নিশ জানাই! দশমা গোপীনাথ রাধানাথ রাধারাণীর জন্য যে বন্দোবস্ত করে গেছেন তার জন্য চিরজীবী হয়ে থাকবেন, আর চিরজীবী হয়ে থাকবে এই দোগাছিয়ার ঐতিহ্যবাহী রায় চৌধুরী পরিবার!
দোলমাঞ্চের সামনে ই একটা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে! শুনলাম দোলের চার দিনই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও যাত্রাপালা হবে! এটাও রায় চৌধুরী পরিবারের এক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান! উনবিংশ শতক জুড়ে এক সময় এই মঞ্চ কাঁপিয়েছেন হরি নারায়ণ রায়চৌধুরী এবং মতিলাল রায়রা! সে এক দীর্ঘ ইতিহাস! আজকে চলি, আবার আগামীকাল এই দোলমঞ্চে আসছি, সঙ্গে থাকবে আরও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, আপনারাও সঙ্গে থাকুন! নমস্কার!!
Barid Baran Gupta