বর্ধমানের ঐতিহ্যবাহী দোল উৎসবে রাজ পরিবারের ছোঁয়া
বারিদ বরন গুপ্ত
বর্ধমান শহরের কথা মনে পড়লে অবধারিতভাবে বর্ধমান মহারাজাদের নাম উঠে আসবেই, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না! বর্ধমান শহরের প্রাচীনত্ব নিয়ে যেমন কোনো কথা হবে না, তেমনি এই শহরকে ঘিরে বর্ধমান মহারাজাদের কর্মকাণ্ডের কথা, স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যের কথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেন। আজ বর্ধমান মহারাজারা নেই কিন্তু বর্ধমানের যেদিকেই তাকাই না কেন, বর্ধমান মহারাজাদের সৃষ্টি ঐতিহ্য চোখ এড়াতে পারবেনা! যেন মনে হয় মহারাজারা তাদেরই সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে, ঐতিহ্যবাহী প্রথার মাধ্যমে, এখনো বেঁচে আছেন, হয়তো বেঁচে থাকবেন চিরকাল!
ইতিহাস মানুষক বাঁচিয়ে রাখে চিরকাল, সে সুখ্যাতি জন্যই হোক আর অখ্যাতিই হোক, বর্ধমান মহারাজারা হাজার শিল্প সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যবাহী প্রথার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন! শুধুমাত্র বর্ধমান শহর নয়, গোটা বর্ধমান জেলা জুড়ে বিভিন্ন লৌকিক দেব-দেবী প্রতিষ্ঠার সাথে এই রাজ পরিবার অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন, যেমন ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা, মন্তেশ্বরের চামুন্ডা, তারা শুশনার তারিক্ষা, মন্ডল গ্রামের জগৎ গৌরি, এরকম অজস্র লৌকিক দেবীর প্রতিষ্ঠার সাথে তারা জড়িয়ে ছিলেন, আজও তাদের নামে পূজা উৎসর্গ এবং বলি উৎসর্গ হয় ! এমনই একটা ঐতিহ্যবাহী প্রথা হলো বর্ধমানের দোল উৎসব! গোটা ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেখানে দোলের দিন সকলে রঙের খেলায় মেতে ওঠে, সেখানে বর্ধমানের দোল উৎসব পালিত হয় ঠিক পরের দিন! এক কথায় হোলির দিন! এর পিছনে আছে সাবেকি ইতিহাসের পাতা, যার সাথে জড়িয়ে আছে রাজপরিবারের কূল দেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের দোল আরাধনা!
উল্লেখ করা যায় যে বর্ধমান রাজারা একসময় ভাগ্যান্বেষণে, ব্যবসায়িক সূত্রে বর্ধমানে আসেন ! শোনা যায় এই রাজপরিবারের জনৈক পূর্ব পুরুষ সঙ্গম রাই সপ্তদশ শতকের শুরুতেই লাহোরের কোটলি মহল্লা থেকে বর্ধমানের উপকণ্ঠ বৈকুণ্ঠপুর বসতি স্থাপন করেন! এরপর তার পৌত্র আবুরাই এর হাত ধরে ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমানের রাজপরিবারের যাত্রাপথ শুরু হয়, এরপর প্রায় ৩০০ বছর নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বর্ধমান রাজারা বর্ধমানের সুখ দুঃখের সাথে জড়িয়ে ছিলেন! আবুরাই তখন বর্ধমানের কোতোয়াল ও চৌধুরী পদ পান। শোন রায় তিনিই পূর্বপুরুষের কূলদেবতা লক্ষীনারায়ন কে বৈকুন্ঠপুর থেকে বর্ধমানে এনে প্রতিষ্ঠা করেন! এরপর কৃষ্ণ রাম রায় তাকে মন্দিরে এনে প্রতিষ্ঠা করেন! এরপর চলেছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত! বলতে গেলে বর্ধমান মহারাজাদের এক সংকটময় মুহূর্ত!
বর্ধমান মহারাজা রাজা তিলক চাঁদের আমল থেকেই বর্ধমানের জমিদারি প্রসার ঘটতে থাকে, তিনি দিল্লীশ্বর দ্বিতীয় শাহ আলম এর কাছ থেকে মহারাজাধিরাজ উপাধি লাভ করেন, শোনা যায় খাজনা আদায়ের জন্য দিল্লি দরবারে বর্ধমান রাজাদের একটা সুনাম ছিল! রাজা তিলক চাঁদের আমল থেকেই বর্ধমান রাজারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ উদ্যোগী হন! তবে এর সার্বিক বিকাশ ঘটে মহারাজ তেজ চন্দ্রের আমলে! জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন মন্দির! তাছাড়া বর্ধমান মহারাজা তেজচাঁদ বিভিন্ন লৌকিক দেব দেবীর মন্দির নির্মাণেও উদ্যোগী হয়েছিলেন! এই উপলক্ষে তিনি অনেক জমি ও দান করেন বলে জানতে পারা যায়! এই লক্ষী নারায়ন জিউ মন্দির এবং রাধামাধব মন্দির মহারাজ তেজচন্দ্রের আমলেই গড়ে উঠেছিল বলেই মনে করা হয় । এরপর প্রতাপচাঁদ ,মহাতাব চাঁদ আফতাব চাঁদ, বিজয় চাঁদ হয়ে উদয় চাঁদ পর্যন্ত এই দোল উৎসবের মেজাজ এতটুকু কমেনি, বরং দিন দিন মেজাজ চড়েছে বলা যায়! আজকে বর্ধমানের দলের সেই সাবেকি ঐতিহ্য হয়তো নেই, যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে ঐতিহ্যেরও পরিবর্তন ঘটে, আজকে জেলার চতুর্দিকে দেখছি বর্তমান প্রজন্ম বক্স বাজিয়ে উদ্দাম নৃত্যে দোল উৎসব পালন করছে, কিছু করার নাই বর্ধমান প্রযুক্তির যুগে দেশীয় সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে, এগুলো সব তারই ফলশ্রুতি!
পন্ডিতদের মতে বর্ধমান মহারাজাদের দোল উৎসবের সূচনাপর্ব ঘটে উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে, তারপর যতদিন গেছে এই উৎসবের জৌলুস বেড়েছে! শোনা যায় তখনকার দিনে দোল উৎসব কে কেন্দ্র করে লক্ষী নারায়ন জিউ মন্দির এবং রাধামাধব মন্দির সেজে উঠতো, রাজ পরিবার সহ রাজ এস্টেটের পদস্থ কর্মচারী, রাজ পন্ডিতরা এই উৎসব উপলক্ষে মন্দিরে জড়ো হতেন, দোল উৎসব উপলক্ষে বেনারস থেকে আসতো বস্তা বস্তা ভেষজ রঙ এবং আবির, শুধু তাই নয় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে থাকত খাবারে এলাহী আয়োজন, আমন্ত্রণ জানানো হতো স্থানীয় জমিদার সহ জেলার গন্যমান্য ব্যাক্তিদের, এক কথায় এই দোল উৎসব কে কেন্দ্র করে রাজা এবং প্রজাদের মধ্যে এক মিলনমেলা অনুষ্ঠিত হতো, মিলতো নানা উপহার এবং উপঢৌকন! শুধু তাই নয় এই উৎসবকে কেন্দ্র করে তিন-চারদিন নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেমন কীর্তন, রাম যাত্রা, কেষ্ট যাত্রা সহ নানা অনুষ্ঠান হতো বলে জানতে পারা যায়! বর্ধমান মহারাজারা শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন! এসব উৎসব অনুষ্ঠানে জেলার বিভিন্ন শিল্পীদের ডাক পড়তো! এভাবে জেলায় বিভিন্ন শিল্প সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে!
বর্ধমান মহারাজাদের সাবেকি প্রথা অনুযায়ী প্রথম দিন হলো দেবতাদের দোল! এই দিনে কৃষ্ণ রাধার শ্রী চরণে যথাক্রমে লাল এবং হলুদ রঙের আবির সমর্পণ করা হতো, পড়ানো হতো বাসন্তী রঙের বস্ত্র! বর্ধমান মহারাজারা লক্ষীনারায়নের শ্রী চরণে আবির নিবেদন করতেন, তারপর চলত পূজা-আর্চা এবং নাম সংকীর্তন! এসব অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় বেলা গড়িয়ে যেতে! তাই সাধারণ মানুষের রঙের উৎসব শুরু হতো দোলের পরের দিন! আবার অনেক পন্ডিত মনে করেন বর্ধমান মহারাজারা যেহেতু অবাঙালি ছিলেন তাই রং খেলতেন হোলির দিন, সেই থেকেই নাকি বর্ধমানের এই ঐতিহ্যবাহী দোল উৎসব দোলের পরদিন অর্থাৎ হোলির দিন! তবে যাই হোক বর্ধমানের এই ঐতিহ্যবাহী দোল উৎসব মহারাজাদের সময় থেকেই দ্বিতীয় দিনেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে,!
পরিশেষে বলি বর্ধমান মহারাজাদের এই দোল উৎসব বর্ধমানের শেষ রাজা উদয়চাঁদের আমল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছিল! আজও বর্ধমান মহারাজাদের বংশধররা এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে! সেই ঐতিহ্যবাহী সাবেকি প্রথা বর্ধমানের মানুষজন আজাও পালন করে চলেছে, ভবিষ্যতেও এর কোন হেরফের হবে না! তাই আমরা বলতে পারি বর্ধমান মহারাজারা আজ না থেকেও আছেন এইসব সাবেকি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান বা প্রথার মধ্য দিয়েই! তাই আজও বর্ধমানের এই ঐতিহ্যবাহী দোল উৎসবে লেগে আছে বর্ধমান রাজপরিবারের ছোঁয়া!
**** লেখক সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখিতে যুক্ত!
Barid Baran Gupta