গল্প
——-
ছেঁড়া তমসুক
———————-
অমিতাভ মুখোপাধ্যায়
মনোজ বাবুর মন আজ ভালো নেই. গত বছর এই দিনই ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল একমাত্র ছেলে অতুলের. বিয়ের আগে থেকেই এই বিয়ে নিয়ে ছেলের সঙ্গে মতবিরোধ হয়েছিল মনোজ বাবু ও স্ত্রী ললিতার. কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে ছাত্র হিসেবে বরাবরই ভালো ছিল. কিন্তু ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর পোস্টিং হয় কৃষ্ণনগরে. সেখানেই পেয়িং গেস্ট হিসেবে উঠেছিল মানসীদের বাড়িতে. আগুনের পাশে ঘি গলতে সময় নেয় নি. মানসীর বাবা ভাড়া সহ খাওয়ার টাকা নেওয়ার সময় প্রায়ই ভনিতা করে বলতেন, ‘আরে তুমি তো আমাদের ঘরের ছেলের মতো. এসবের আর প্রয়োজন নেই’. মানসী আড়ালে দাঁড়িয়ে হাসতো. কিন্তু অতুলের তো বদলির চাকরি. মানসী জানতো, পি ও হিসেবে প্রথম পোস্টিং. এরা বেশিদিন এক জায়গায় থাকে না. তাই আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার দরকার.
অতুল সন্ধ্যা বেলায় বাড়ি ফিরতেই সে চা -জলখাবার নিয়ে হাজির হয়ে যেত. পরদিন কোন জামা প্যান্ট পরে সে অফিসে যাবে তা বার করে দিত. গল্পের ছলে জেনে নিতে শুরু করলো অতুলের বাবা -মায়ের কথা. বাড়ির হাল হকিকতের কথা. দিনে দিনে অতুল নির্বোধের মতো প্রায় সব কথাই আলোচনা করতে লাগলো মানসীর সঙ্গে. যেন বহু দিনের সম্পর্ক. মানসীর দেহের সুগন্ধ, আচার আচরণ অতুলকে মুগ্দ্ধ করে দিত. পাশে বসে গল্প করার সময় মানসী অতুলকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করলো. প্রায়ই কাছে টেনে নিত.
এসব বিষয় একান্ত গোপন রইলো দুজনের মধ্যে.
ইতি মধ্যে অতুলের বদলির অর্ডার এসে গেলো. শ্রীরামপুর. অতএব এবার কৃষ্ণনগরের সঙ্গে সম্পর্ক গোটাতেই হলো. অতুলদের বাড়ি মগরায়. কিন্তু মানসী?
অতুলের জীবনে মানসীই প্রথম নারী. সে সত্যিই ভালো বেসে ফেলে ছিল মানসীকে. আসার দিন কথা দিয়ে এলো -‘রোজ রাতে ফোন করবে. বিয়ের ব্যাপারে বাবা -মাকে ঠিক রাজী করাবে. ‘
এদিকে মনোজ বাবু তাঁদের পছন্দ মতো এক সুশ্রী, শিক্ষিকা মেয়ে ছেলের জন্য দেখে রেখে ছিলেন. অতুলের মামার বাড়ির এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়’র মেয়ে হয় সে. ছেলে যেহেতু এখন বাড়ি থেকেই যাতায়াত করে অতএব অতুলের কাছে একসময় মনোজ ও ললিতা বিয়ের প্রসঙ্গটি তুললেন.
অতুল প্রথমেই বিরোধীতা করে বাবা -মাকে জানিয়ে দিল মানসীর কথা.এও জানালো, ‘মানসীর বাবা এক ছুটির দিনে আসতে পারে.বিয়ের ব্যাপারে পাকা কথা বলতে’.
স্বপ্ন ভঙ্গ হলো মনোজ বাবু ও ললিতার. দুজনে একান্তে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এলেন -অতুলের মুখ চেয়ে তাঁদের সম্মতি দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই. জল অনেক দূর গড়িয়ে গেছে মনে হচ্ছে.
মানসীর বাবা -মা এক রবিবারে হাজির হলেন. মনোজ বাবুদের মেয়ে দেখতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন. অতুলের মা ললিতা একবার শেষ চেষ্টা করার জন্য ছেলের ঘরে এলেন. কিন্তু কোন যুক্তিই কাজে এলো না.
অগত্যা কৃষ্ণনগরের মেয়ে মানসীর সঙ্গে ঠিক এক বছর আগে আজকের দিনেই বিয়ে হয়েছিল অতুলের.
এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল. কিন্তু বিয়ের এক মাস যেতে না যেতেই মানসী ললিতার সঙ্গে অকারণে বিবাদে জড়িয়ে পড়লো. রান্নার মহিলাকে নানা রকম পরামর্শ দিতে শুরু করলো. এ সংসারে তার দখলদারি দেখাতে লাগলো. কিছু দিন নীরব থাকার পর ললিতা সাধের বৌমাকে বোঝাতে গিয়ে অপমানিত হলেন.মানসী দুজনের রাতের খাবার নিয়ে ওপরে যেতে শুরু করলো. রান্নার সমালোচনা করার কথা মনোজ -ললিতার কানেও এলো. অতুল বৌয়ের কথাতেই সায় দিয়ে মায়ের সঙ্গে প্রায়ই উচ্চ স্বরে কথা বলতে লাগলো.
মনোজ বাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো. নিতান্ত অভিমানে একদিন বলেই ফেললেন, ‘তুই এতটা বদলে গেলি? বৌয়ের কথায় প্ররোচিত হয়ে গর্ভধারিণী মাকে অপমান করছিস? তুই কী হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলি? ‘
অতুল জানালো, ‘তোমরা জন্ম দিয়েছো বলে চিরকাল মাথা নীচু করে থাকতে হবে? আমাদের ভালো -মন্দ এবার থেকে আমরাই বুঝে নেবো’.
-তাহলে আর একসঙ্গে থাকা কেন? এতো টাকা খরচ করে তোকে শিক্ষা দিলাম, বড় করলাম. মনের মতো করে গড়ে তুললাম, এসবের কোন মূল্য নেই?
বিক্ষুব্ধ অতুল উত্তেজিত হয়ে জানালো, ‘
সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব বাবা মায়েরই’.
ললিতা বললেন, ‘এই তার প্রতিদান? ‘
‘হ্যাঁ ধরো তাই’ -অতুল বললো.
মনোজ বাবু বললেন,’ তুই এখন সাবালক হয়ে গেছিস. তবে এবাড়িতে আমাদের কথাই শেষ কথা. রোজ রোজ অশান্তি ভালো লাগে না. তুই আলাদা থাকার ব্যবস্থা কর. ‘
অতুল কথা না বাড়িয়ে ওপরে উঠে গেলো. কিছুক্ষণ পরে বৌমা’র গলার উচ্চ আওয়াজ শোনা গেলো.
‘আমার হাতে একটা অস্ত্র আছে. ‘
-অতুল জিজ্ঞাসা করলো, কী? ‘
মানসী বললো, ‘498এ. বধূ নির্যাতনের মামলা’.
অতুল বললো, ‘ওসব পরে হবে.’
মনোজ বাবু এসব শোনা মাত্রই ললিতাকে বললেন, ‘তৈরী হয়ে নাও. এখনই বেরুতে হবে.’
মনোজ, ললিতা প্রথমে গ্রাম প্রধানএর কাছে গেলেন. তিনিই পরামর্শ দিলেন মগরা থানায় বিষয়টি জানিয়ে রাখার জন্য.
মনোজ বাবুর প্রিয় বন্ধুরাও একই পরামর্শ দিলেন.
পরদিন সকালে সস্ত্রীক মনোজ বাবু থানায় হাজির হলেন. হাতে একটা আবেদন পত্র.
থানার ও সি বিজন বাবু সেটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘মাস্টার মশাই, আমাকে একটা দিন সময় দিন. আমি দেখছি আপনাদের জন্য কী করতে পারি. তবে আপনারা কোন বিতর্কে জড়াবেন না. গ্রাম প্রধান কাল রাতে আমায় ফোনে সব বলেছেন.’
পরদিন সকালেই এক পুলিশ অফিসার হাজির হলেন বাড়িতে. অতুল কে ডেকে পাঠালেন.
অতুল সস্ত্রীক নীচে নেমে এলো.
অফিসার বললেন, আপনাদের চার জনকেই এখনই থানায় যেতে হবে, বড় বাবু ডেকে পাঠিয়েছেন.
অতুল জানতে চাইলো, ‘ অভিযোগটা কী? ‘
অফিসার বললেন, থানায় গিয়েই জানবেন. পুলিশের জিপে চারজনই উঠে বসলেন. সকলেই নীরব. প্রতিবেশীরা রাস্তায় এসে দাঁড়ালো.আওয়াজ উঠলো, ‘মাস্টারমশাই-এর বাড়িতে পুলিশ? উনি তো সাতে -পাঁচে থাকেন না.’
থানায় পৌঁছাতেই ও সি’র ঘরে ওদের বসতে বলা হলো.
একসময় ও সি বিজন বাবু এলেন. প্রথমেই
মনোজ বাবুর আবেদনপত্রটি তিনি পড়ে শোনালেন. তারপর অতুল ও মানসীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের কিছু বলার আছে? -থাকলে বলুন. ‘
অতুল পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে কথা বাড়ালো না.
এবার মানসীকে বিজন বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কিছু বলবেন?
মানসী বললো, ‘স্যার, ‘আমি শাশুড়ী-মা’র দ্বারা প্রায়ই অপমানিত হই. উনি খুন্তি নিয়ে আমাকে একদিন মারতেও এসেছিলেন.’
-কোন প্রমাণ? ও সি দেখতে চাইলেন.
-আপনি সেইদিনই কেন থানায় আসেন নি? -হাসপাতালের কোন রেকর্ড আছে আপনার কাছে? বিজন বাবু জানতে চাইলেন.
মানসী বললো,’ না ‘.
অতুল মনোজ ও ললিতার কাছে গিয়ে মাথা নীচু করে বললো, ‘আমাদের মাপ করে দাও.’
মুহূর্তে থানায় একটা নাটকীয় পরিবেশ তৈরী হয়ে গেলো. যে যেখানে ছিল উঁকি মারতে লাগলো——-
মনোজ বাবু আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না. ললিতাও আঁচলে মুখ ঢাকলেন.
ও সি বিজন বাবু অতুলকে বললেন, ‘দেখুন আপনার বাবা -মার দিকে. কতটা আঘাত দিয়েছেন আপনারা. ‘এর পরেও —-‘
মানসী বললো, ‘ আমি আর কোনদিন উনাদের সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করবো না স্যার.’
বিজন বাবু বললেন, ‘বাড়ি ললিতা দেবীর নামে. মার্জনা তিনি করতে পারেন. আমরা নই. অশান্তি করলে আইন অনুযায়ী তিনি আপনাদের দুজনকে বাড়ি থেকে বারও করে দিতে পারেন. ব্যক্তি স্বাধীনতা সকলেরই সমান. অধিকার এক তরফা নয়. পাশাপাশি কর্তব্যও করতে হয় ‘.
মনোজ বাবু বললেন, ‘আমরা বাকী দিনগুলো স্যার শান্তিতে থাকতে চাই.’
অতুল বললো, আমি চন্দননগরে একটা ফ্ল্যাট বুক করেছি স্যার. কয়েক মাসের মধ্যেই চলে যাবো. ‘
-আপনার এই সিদ্ধান্ত বাবা -মাকে একবারও জানিয়ে ছিলেন?
‘না স্যার ‘.
ও সি বললেন, ‘চলেই যখন যাবেন -তাহলে জন্মদাতা বাবা -মার সঙ্গে কেন এই দুর্ব্যবহার করতে গেলেন? যা করেছেন ভুল করেছেন ‘.
সত্যিই দুমাসের মধ্যেই অতুলরা বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো.
আর যোগাযোগ রাখে নি——
মনোজ বাবু ও ললিতার কাছে এই চূড়ান্ত পরিণতি অভিপ্রেত ছিলো না. এতো যত্ন করে মানুষ করা একটা ছেলে যে বিয়ের পর -এতটা বদলে যাবে তা তাঁরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি.
প্রতি রবিবার মনোজ বাবু মাঝে মাঝেই বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ান.যদি ছেলে- বৌ একবার আসে.
-না অতুল আর ফিরে আসে নি.
ললিতা ঘরে বসে প্রায় দিনই নীরবে চোখের জল ফেলেন.নিজের নামে বাড়ির দলিলটাকে এখন ছেঁড়া তমসুক মনে হয়.
মনোজ বাবু এখন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেন, ‘নাড়ির টানের মর্যাদা এখনকার ছেলে-মেয়েরা বোঝে না– না কী সত্যিই বুঝতে চায় না ? ‘
উত্তর একটাই- ‘না ‘.
———————–