Albert Camus

প্রবন্ধ

শংকর ব্রহ্ম

প্রথম_পর্ব

         আলবের কাম্যু  ছিলেন একজন ফরাসী দার্শনিক, লেখক এবং সাংবাদিক। 

       আলবের কাম্যু ১৯১৩ সালের ৭ই নভেম্বর ফরাসী অধিকৃত আলজেরিয়ার (বর্তমান ড্রিয়ান) মন্ডোভিতে এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মা, ক্যাথারিন হেলেন কাম্যু জাতিতে ছিলেন একজন ফরাসী, যদিও পৈতৃক সূত্রে তিনি স্প্যানিশ-বালেয়ারিক। তাঁর বাবা, লুসিয়েন কাম্যু, ছিলেন একজন দরিদ্র কৃষিজীবী, ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্নের যুদ্ধে তিনি মারা যান। কাম্যু তাঁর বাবাকে কোনোদিনও দেখেননি। তাঁর ছোটবেলায় কাম্যু, তাঁর মা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনরা অনেক ন্যুনতম উপকরণ ছাড়াই আলজিয়ারের বেলকোর্ট অঞ্চলে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তিনি আলজেরিয়ার দ্বিতীয় প্রজন্মের ফরাসি ছিলেন, আলজেরিয়া ১৮৩০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ফরাসিদের দখলে ছিল।

তাঁর নাগরিকত্ব ছিল ফ্রান্সের।
তাঁর ঠাকুরদাদা এবং তাঁর প্রজন্মের অনেকেই উনিশ শতকের প্রথম দশকের সময় ভালোভাবে জীবন কাটাবার জন্য আলজেরিয়াতে চলে আসেন। তাই তাঁকে বলা হত পাইড-নোয়া, ‘কালো পায়ের পাতা’ – এটা একটা ইতর শব্দ যা দ্বারা সেইসকল ফরাসিদের বোঝানো হত যারা আলজেরিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিল – আর তাঁর পরিচয় এবং দরিদ্র অবস্থা তাঁর পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তৎসত্ত্বেও, কাম্যু ছিলেন একজন ফরাসি নাগরিক, আলজেরিয়ার আরব বা বর্বর অধিবাসীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা যাদের আইনগত অবস্থানটাই নীচু ছিল। কাম্যুর ছোটবেলায় ফুটবল এবং সাঁতারের প্রতি আগ্রহ ছিল।

              ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা যখন ফ্রান্স দখন করেছিল তিনি তখন প্যারিসে ছিলেন। কাম্যু পালাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষে তিনি ফ্রেঞ্চ রেসিস্ট্যান্স দলে যোগদান করেন এবং সেখানে কোঁবা (Combat "লড়াই") নামে একটি বেআইনি সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদকের ভূমিকা পালন করেন। যুদ্ধ-পরবর্তীকালে, তিনি একজন খ্যাতিমান ব্যক্তি হয়ে ওঠেন এবং পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় তিনি ভাষণ দিতে থাকেন। তিনি দু'বার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন এবং তাঁর একাধিক বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কও ছিল। কাম্যু সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। তিনি বামপন্থীদের একটা অংশের সাথে যুক্ত ছিলেন যারা সর্বনিয়ন্ত্রণবাদী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধীতা করত। কাম্যু ছিলেন একজন নীতিবাদী এবং তিনি কিছুটা ট্রেড ইউনিয়ন ভিত্তিক নৈরাষ্ট্রবাদের দিকে ঝুঁকেছিলেন। ইউরোপের সংহতিকরণের পক্ষে থাকা অনেক সংস্থার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছলেন। আলজেরিয় যুদ্ধের সময় (১৯৫৪ সাল থেকে – ১৯৬২ সাল পর্যন্ত), তিনি নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছিলেন, আলজেরিয়ার বহুসংস্কৃতি ও বহুত্ববাদের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন যা বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং বেশিরভাগ দলই কাম্যুর এই বক্তব্য মেনে নেয়নি।

    দার্শনিকতার দিক থেকে কাম্যুর চিন্তাভাবনা অ্যাবসার্ডিজম নামক দর্শনের অবদান রেখেছিল যা ছিল নৈরাষ্ট্রবাদী (নিহিলিজম্‌) দর্শনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা এক উত্থানের আন্দোলন। তাঁকে একজন অস্তিত্ববাদী হিসেবেও গণ্য করা হয়, যদিও তিনি নিজে সারাজীবন ধরে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

       জঁ-পল সার্ত্র, অগাস্টিন, কার্ল মার্ক্স, ম্যাক্স স্টার্নার, ফ্রেডেরিক নিটশে, ফিওডোর দস্তয়েভস্কি, ফ্রান্স কাফকা, সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, সিমোন ওয়েল, জ্যঁ গ্রেনিয়ের, আর্থার শোপেনহাওয়ার প্রমুখদের তিনি ভাবশিষ্য ছিলেন।
                    তাঁর শিক্ষক লুই জার্মেইনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাম্যু ১৯২৪ সালে বৃত্তি লাভ করেন এবং আলজিয়ার্সের কাছে একটি প্রথিতযশা লাইসিয়ামে (উচ্চশিক্ষার স্কুল) পড়াশুনো শুরু করেন। ১৯৩০ সালে তাঁর যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে। রোগটি সংক্রামক হওয়ার কারণে তিনি বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন এবং তাঁর কাকা গুস্তাভ আকল্টের কাছে তিনি বাস করেন।   
    কাকা পেশায় ছিলেন একজন কসাই। তরুণ আলবের কাম্যুকে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন। এই সময় কাম্যু তাঁর দর্শনের শিক্ষক জ্যঁ গ্রেনিয়ারের সংস্রবে এসে দর্শনের দিকে আকৃষ্ট হন। তিনি প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক এবং ফ্রেডারিক নিটশের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই সময় তিনি পড়াশুনোর জন্য কেবলমাত্র কিছু সময় ব্যয় করতে পারতেন। অর্থ রোজগারের জন্য, তিনি নানা ধরনের পেশা অবলম্বন করেন। ব্যক্তিগত শিক্ষক, গাড়ির সরঞ্জামের করণিক, এবং আবহাওয়া সংস্থার সহকারী হিসেবেও তিনি কাজ করেছিলেন।
 ১৯৩৩ সালে কাম্যু আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩৬ সালে তাঁর লাইসেন্স ডি ফিলোসফি (বি.এ) ডিগ্রী লাভ করেন। প্লোটিনাসের ওপর তত্ত্ব রচনা করে। খ্রীষ্টান দার্শনিকদের প্রতি কাম্যুর একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, কিন্তু নিটশে এবং আর্থার শোপেনহাওয়ারের প্রভাবে তিনি নৈরাশ্যবাদ এবং নাস্তিকতার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি স্তাঁদাল, হেরম্যান মেলভিল, ফিওডোর দস্তয়েভস্কি, এবং ফ্রান্ৎস কাফকা প্রভৃতি ঔপন্যাসিক-দার্শনিকের লেখা পাঠ করেন।

১৯৩৩ সালে, সিমোন হাইয়ের সঙ্গে পরিচিত হন যিনি কাম্যুর এক বন্ধুর সঙ্গীনি ছিলেন। পরে সিমোন কাম্যুর প্রথম স্ত্রী হন।

   ১৯২৮ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত কাম্যু রেসিং ইউনিভার্সেটেয়ার ডি’আলজেরের গোলরক্ষক ছিলেন। খেলার টিম-স্পিরিট, ভ্রাতৃত্ববোধ, এবং উদ্দেশ্যগত ঐক্যবোধ কাম্যুকে অত্যন্ত নাড়া দিয়েছিল। খেলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গভীর আবেগ এবং সাহসিকতার সাথে খেলার জন্য তিনি প্রায়ই প্রশংসিত হতেন। সতেরো বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে তাঁর ফুটবলের প্রতি সমস্ত আশাই চলে যায়। কাম্যু ফুটবল, মানব-অস্তিত্ব, নৈতিকতা এবং ব্যক্তিগত পরিচয়ের মধ্যে সমান্তরাল সম্পর্ক এঁকেছেন। তাঁর কাছে, ফুটবলের সরল নৈতিকতা এবং গীর্জা ও রাষ্ট্রের মত কর্তৃপক্ষের দ্বারা আরোপিত জটিল নৈতিকতার মধ্যে একটা বিরোধ বর্তমান।

   ১৯৩৪ সালে কুড়ি বছর বয়সে কাম্যু সিমোন হাইয়ের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ হন। সিমোন মরফিনে আসক্ত ছিলেন। ঋতুকালীন বেদনা প্রশমনের জন্য সিমোন এই ড্রাগ ব্যবহার করতেন। কাকা গুস্তাভ এই সম্পর্ক মেনে না নিলেও আসক্তি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করার জন্য কাম্যু হাইকে বিয়ে করেন। এরপরেই তিনি আবিষ্কার করেন সিমোন ইতিমধ্যেই তাঁর ডাক্তারের সাথে সম্পর্কে আবদ্ধ এবং এর ফলে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। কাম্যু সারাজীবন ধরে একজন নারীলোলুপ মানুষ ছিলেন।

(ক্রমশঃ)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *