মাকে নিয়ে আল-আমিন শিবলীর ৭ কবিতা
১.
মায়ের গন্ধ
আল-আমিন শিবলী.
ছেলেবেলা নিয়ে ধ্যানে পড়েছি—হারিয়েছি লোবানমাখা গল্প,
মায়ের হাতের সেই ভাঁজা ঢেঁকির শাক ভাগ্যে ছিলো খুব অল্প!
বিনিধানের সেই লাথার ঘ্রাণ আজও নাকের ডোগায় ভাসে,
—ক্ষুধার্ত সন্তানের ভরলে পেট, সকল দুঃখিনী মা-ই হাসে।।
ন্যাপথালিনের গন্ধের চেয়েও আমার মায়ের শাড়ীর গন্ধ দামী,
ঘামে ভেজা সেই ছেঁড়া আচঁল—আবারও মা, দাও পেতে তুমি।
আজ কথার পিঠে কথারা নাচে, তোমার লাখো কথার স্মৃতি,
তোমার কাছে বড্ড আদরের ছিলাম, ছিল ভীষণ মায়াপ্রীতি।।
সেই মায়াপ্রীতি, গন্ধ-স্মৃতি তোমার চুলের নারকেল তেলের গন্ধ;
কোথায় আজ হারিয়েছি ভাঁপা পিঠা, পাটিসাপটা খাওয়ার ছন্দ?
সুঁতায় কবরী গেঁথে মালা রোজ তোমার গলায় দিতাম পড়িয়ে—
ছুটে যেতাম তেপান্তরে, ফিরে আসতাম তোমায় মায়ায় জড়িয়ে।।
২.
ক্ষমা করো মা
আল-আমিন শিবলী
আমার এই কবিতা দিলাম মাগো তোমার চরণে
শত কষ্ট হয়েছিল আমাকে তোমার গর্ভে ধারণে।
ভেসে উঠে অশ্রু নয়নে সেসব স্মৃতির মালা;-
না জানি মা, তোমাকে দিয়েছি কত কষ্ট জ্বালা॥
জীবন্ত মানুষের ভিড়ে তোমায় রেখেছিলাম অর্ধমৃত করে
প্রসব বেদনায় তোমার দু’চোখ ছিলো জমাট অশ্রু ভরে
ব্যথায় কেঁদেও ক্লান্ত হওনি মমতায় রেখেছ আপন করে॥
অনুক্ষণের সেই নিষ্ঠুরতার কথা ভেবে
মাগো, আজ আমি মরি বিহনে বিহনে।
এমন প্রীতিমাখা আঁধার রাত্রিও;—
ঘুম আসে না আমার শান্ত দু’নয়নে॥
মাগো এই বিরহে রাত্রি বেলা;—
আজ কেনো আমার মন হয় উতলা?
ক্ষমা চাই মাগো তোমার দু’ চরণে
হাত ভুলিয়ে দাওগো মা, রাখি যেনো চিরস্মরণে॥
৩.
দরদী মা
আল-আমিন শিবলী.
মা দরদী—জনম দরদী অপরাজিতা সাজে;
দুঃখিনী মা হয় না ক্লান্ত হেরে গিয়েও কাজে।
চোট খেয়েও মা দেয়নি ফেলে, ভীষণ সমব্যথী
অযথা মাকে দিচ্ছি গালি, তবু ভালবাসে অতি॥
এই মা’ই আবার দুহাত তুলে জায়নামাজে
সামগ্রী সুখ বিলিয়ে দিতে সন্তানের মাঝে।
সন্তানটা যেন জান্নাতি হয়, জগৎ করে আলো
বাহুডোরে শক্তি দাও—দূর করে দাও কালো॥
ঘোর আকাশে জোনাক ভাসে মায়ের দোয়া’ই ফলে
মাটির প্রদীপ নিভে গেলেও দেখি—ধ্রুবতারা জ্বলে।
মা’ই শুধু বিলাপ করে সন্তানের বিপদে;—
স্রষ্টার কাছে প্রার্থনারত অঝরে সে কাঁদে॥
৪.
মায়ের সাথে শৈশব
আল-আমিন শিবলী
উঠান পাড়ার খেলা ফেলে যেতাম মায়ের ডাকে ছুটি
আবার কিছু একটুকু কম হলে’ই খেতাম লুটোপুটি।
কেঁদে কেঁদে মায়ের কোলে যখন নিশি করতাম যাপন
ঠিক তখনি বুঝতাম এ নশ্বর পৃথিবীতে মা’ই বড় আপন।
শৈশবে জমানো সেই স্মৃতিগুলো এখন বয়সের ভাঁজে
একটুখানি মেরেই মা আবার টেনে নিতেন হৃদয় মাঝে।
স্নান দুপুরে পুকুরঘাটে পা ধুলিয়ে করতাম যখন খেলা
মা বলতেন আর জ্বালাইস না বাবা, যাচ্ছে পুরো বেলা।
মাঠ মাতিয়ে, পাড়া মাতিয়ে যেতাম যখন মায়ের নীড়ে
কবিতা আর ছড়া পাঠে রাখতেন আমায় ব্যস্ত নিবিড়ে।
রোজ প্রভাতে ঘুম ভাঙিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে মুছে দিতো
ঘ্যাড়ত্যাড়ামি হলেই লাঠি দেখিয়ে মক্তবে পাঠাতো!
ইসকুল-মক্তব ফাঁকি দিয়ে ডানডা, লাটিম খেলতাম
মা’র বকার ভয়ে চুপিসারে আবার জঙ্গলে পালাতাম।
হাডুডু আর কাদা বৃষ্টিতে শৈশবে হাজার রকম খেলা
একটুখানি জ্বর বা ব্যথা হলেই মা কাঁদতেন সারাবেলা।
বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, শ্রাবণ মাসে কতো গিয়েছিলাম বেড়াতে
সেই সব স্মৃতি এখন নষ্ট হয়েছে ভাদ্রে শুকাতে শুকাতে।
স্নিগ্ধ হরিণী মা আমার ঝলক মেখে গায়ে পড়তেন শাড়ী
মায়ের হাত ধরে ছুটে যেতাম মামা—খালার বাড়ী॥
৫.
স্বর্গীয় মা
আল-আমিন শিবলী
আমার ক্ষুদ্রগৃহে আছে স্বর্গীয় শান্তি
মায়ের আঁচল তলে নেই কোন ভ্রান্তি।
অপার্থিব সূর্য আলো বিলায় আমারই ঘরে
—জান্নাতি রহমত দেখি মায়ের সঙ্গে ঘুরে॥
মায়ের দোয়া সঙ্গে নিয়ে দুঃখ—কষ্টহীন থাকি
পরশ মাখা আদর পেয়ে সভ্যতার স্বপ্ন আঁকি।
কুটিবিহীন খোলা আকাশে যেভাবে চাঁদ থাকে বুঝি
জীর্ণ-শীর্ণ ব্যথাহীন আমি, মা আমার একমাত্র পুঁজি॥
অসুস্থ মাকে করলে সেবা—হাসতে দেখি আলো
পাপের খাতায় পূণ্য দেখি— জীবন চলে ভালো।
এমন স্বর্গীয় মায়ের আদর থেকে চাই না হতে বঞ্চিত
অসাধ্যকে সাধন করেও মাকে রাখতে চাই সঞ্চিত॥
৬.
ছন্দের মা
আল-আমিন শিবলী।
মা-ই আমার ছন্দ
সারাক্ষণের ভালো-মন্দ
দূর আকাশের ধ্রুবতারা
মা বিহীন আমার ছন্দ দিশেহারা।
মম ইচ্ছে ছন্দের তালে;
মায়ের সেবা করে গেলে
দুঃখ-কষ্টকে জয় করে,
সুখ হবে স্বর্গ ও নীড়ে।।
ভূমি থেকে যদিও উড়ি স্বর্গপানে—
মায়ের সঙ্গে বলব কথা সদাচরণে।
৭.
আমি ঋণী হয়ে যাই
আল-আমিন শিবলী.
জন্মের কথা মনে পড়লে’ই
মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই।
সবকিছুর জন্য মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই
আনন্দ আর দুঃখেও মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই
ঘুম, জাগরণেও মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই।
আমি ঋণী হয়ে যাই
মায়ের প্রসববেদনার কথা ভেবে,
—চিরঋণী হয়ে যাই।
আমি সবকিছুর জন্য মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই
সাহস আর ভয়েও মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই—
ঋণী হয়ে যাই, বিপদ-আঘাত সর্দি জ্বরের ডেরায়
মায়ের অপত্য স্নেহের শীতল হাতের স্পর্শ মায়ায়।
আমি ঋণী হয়ে যাই
সেই অভাবী মায়ের ক্ষুধার জ্বালার সাথে
নাড়ি ছেঁড়ে যাওয়া মা, না খেয়েও
তাঁর সব খাবারটুকু তুলে দিয়েছিলেন আমার পাতে।
ঋণী হয়ে যাই, রোগাক্রান্ত সেই হতভাগিনী মায়েরই কাছে
কাতরাচ্ছিলেন মা, তবুও বিষ দাঁতে চুষছি তাঁর দুই কুচে।
আমি ঋণী হয়ে যাই
মায়ের হাসি-উল্লাসে, আবাহন কিংবা নিশ্চেতনে
আমার সকল পথ চলায়, সাফল্য সমৃদ্ধি র্অজনে।
আমি চিরঋণী হয়ে যাই।
আমি সবকিছুর জন্য মায়ের কাছে ঋণী হয়ে যাই।