নিশিকন্যা
আবু সাইদ কামাল
আব্দুল আজিজ সন্ধার পরপরই অফিস থেকে বেরিয়েছে। তারপর গিয়েছিল ছোটবাজারের প্রেসপাড়ায়। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে নটা বেজে গেছে। প্রায় দিনই অফিস থেকে বের হতে এমন দেরী হয়। অফিসে কাজের চাপ বেশি। অফিস থেকে বেরিয়ে নানা প্রয়োজনে শহরের এখানে সেখানে যেতে হয়। কিংবা কখনো নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে এমন রাত হয়। গাঙ্গিনার পাড় থেকে হেঁটে নির্ভার মনে ছোটবাজারের দিকে যাচ্ছে। বিকেলে হালকা কাল বোশেখি একটা ঝড় বয়েছে। সবে বোশেখের শুরু। তাই এমন ঝড় হওয়াটা স্বাভাবিক। সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঝড় হয়েছে বলে শহরের লোকজন আগেভাগে বাড়ি চলে গেছে। মনে হয় এ কারণে রাত ন’টার দিকে মফস্বলের শহরের রাস্তাাগুলো অনেকটা ফাঁকা। যানবাহও কম। আব্দুল আজিজ আনমনে হাঁটছে। গাঙ্গিনার পাড় ট্রাফিক মোড় থেকে হেঁটে বিদ্যাময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের আঙিনা পার হয়ে যখন নতুন বাজার এলাকায় ঢুকছে, তখনি বোরকা পরিহিতা এক ললনার সংশয়াকীর্ণ ক্ষীণ স্বর বেজে ওঠে। ফাঁকা রাস্তায় যেনো কার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। অদূরে একটি বন্ধ বিপণীর বারান্দায় মোটর বাইকের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়ানো এক যুবক। আব্দুল আজিজ মেয়েটির ডাক শুনে পিছন ফিরে তাকায়, কিন্তু থামে না। তার ধারণা এমন রাতে নিশি কন্যা ছাড়া কোনো ভদ্র মহিলার তো দাঁড়িয়ে থাকার কথা না। আজিজ ফের দৃষ্টি সামনে এনে অগের মতো হাঁটে। কিন্তু ফের পিছন থেকে ময়েলী কণ্ঠের ডাক, আপনি আজিজ স্যার না!
কথাটা কানে আসা মাত্র ফের পিছন ফিরে তাকায়। মেয়েটিও দ্বিধাজড়ানো পায়ে হেঁটে আজিজের দিকে ক্ষানিকটা এগোয়। কিন্তু, ততক্ষণে আজিজ যেন একটা রহস্যে আচ্ছাদিত হয়। মনে মনে ভয় পায়। ভাবে, অদূরে মোটর বাইকে যুবক, নাগালে নিশিকন্যা। এ কোনো অপরাধ প্রবণতার ফাঁদ নয় তো! কিন্তু মেয়েটিই বা তার নাম জানলো কী করে? তা ছাড়া নিশি কন্যার ডাকে সাড়া দেবার মত পাত্রও তো সে নয়। কিংবা তেমন বয়সও নেই তার। একজন প্রৌঢ়কে নিশি কন্যারও তো এভাবে ডাকার কথা না। চকিত দৃষ্টিতে নেকাবে ঢাকা দুটি চোখ আর মুখের যতটুকু দেখেছে, তাতে কোনো পরিচিত মুখ বলে মনে হয়নি। তাই উটকু ঝামেলা এড়ানোর জন্য মেয়েটির ডাকে সাড়া না দিয়ে বরং আরও দ্রুত হেঁটে চলে গেলো নতুন বাজারে। কনফেকশনারী দোকান থেকে রুটি -বিস্কুট কিনে সে রিকশা নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। রিকশায় বসে ভাবে, রহস্যময়ী এ নিশি কন্যা কে ?
প্রশ্নটি তাকে এক গভীর ভাবনার ফেলে। রিকশা ছুটতে থাকে। আজিজ তার চেয়ে দ্রুত গতিতে নিজের ভুবন জুড়ে খুঁজে ফেরে রহস্যময়ী এ নিশিকন্যাকে। মনে মনে বলে, কে হতে পারে মেয়েটি?
তাকে চিনে ডাক দিয়েছে ঠিকই। তবে সে ডাকে কেনো যেনো জড়তা ছিল। ছিল সঙ্কোচ আর আত্মবিশ্বাসের অভাব। সে জন্য ডেকে সামান্য এগিয়েও থমকে দাঁড়িয়েছে কেনো?
নিজেকে প্রশ্ন করে, কে সে ললনা? নিকট অতীতের কেই তো সে নয়।
অতীত খুঁড়ে চলে আজিজ। তন্নতন্ন করে খুঁজে ফেরে অতীত। কিন্তু কোথাও কারও হদিস মিলে না। অনেক ভাবনার পর আজিজ সম্ভবনার একটা দ্বারে গিয়ে কড়া নাড়ে।
দুই
গত তিন বছর আগে এ অফিসে ফের বদলী হয়ে আসার পর আজিজের পুরানো প্রেমিকার কনিষ্ঠতম বোনের সাথে নতুন করে পরিচয় হয়। মায়ের সাথে পেনশন তুলতে এসে প্রায় সতের-ষোল বছর পর হয় এ পরিচয়। তিথি ছিল তখন ছিল পাঁচ বছরের শিশু কন্যা। এখন চোখ ধাঁধানো তরুণী। বিয়ে হয়নি এখনো। নতুন পরিচয়ে বাড়ে ঘনিষ্ঠতা। তার কাছেই তাদের পরিবারের খোঁজ-খবর জানতে পারে। বাইশ বছর আগে বড় বোন বীথির সাথে একটা সম্পর্ক গড়েছিল আজিজের। এক বছর প্রেম প্রেম খেলার পর বীথি বলেছিল, আপনার সাথে এতদিন আমি দুষ্টুমি করেছি।
-এই তোমার শেষ কথা?
-হ্যাঁ।
-কেনো একজনের জীবন নিয়ে এমন খেলা খেলতে গেলে?
-জানি না।
আজিজ বুঝতে পেরেছিল, হয়তো বা পারিবারিক চাপে বীথি এমনটি বলেছিল। কারণ, তখনও বীথির বড় বোন বিয়ের বাকি। আজিজ ঐ পরিবারে বীথির ছোট ভাইকে পড়াতো। বীথির বড় বোনকে আজিজের সাথে বিয়ে দেবে- এমন একটা পারিবারিক সিন্ধান্ত তাদের ছিল। বীথির অভিভাবকদের ধারণা হয়েছিল যে, বীথিই সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সে জন্যই তার ওপর যখন পারিবারিক চাপ বাড়ে, তখন সে আজিজের প্রণয় বাগান থেকে সরে দাঁড়ায়। বীথির পিঠাপিঠি বোনের নাম ছিল রীতি। তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। ওপরের ঠোঁটে ছিল তার শ্বেতীরোগের শাদা কয়েকটা রেখা।
ঐ ঘটনার পর থেকে বীথিদের সাথে আজিজের সম্পর্কের চির ধরে। শুধু তাই না, চাকুরির সুবাদে চলে যায় দূর-কর্মস্থলে। তিথির সাথে সতের বছর পর ফের পরিচয় হলে-আলাপ প্রসঙ্গে রীতির কথা এলো, তখন আজিজ জিজ্ঞেস করে, রীতির বিয়ে হয়েছে কোথায়?
জবাবে তিথি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চেয়েও প্রকৃত সত্যের একাংশ উল্লেখ করে বলে, তার এখনো বিয়ে হয়নি।
-কেনো?
-সে আর বিয়ে করবে না।
-কারণ?
-পাশের বাসার একটা ছেলের সাথে তার প্রণয় হয়েছিল। ছেলেটা ছিল অনেকটা বখাটে প্রকৃতির। ঐ ছেলের সাথে একদিন বেরিয়ে গেলো।
-তারপর?
-ছেলেকে তার মা-বাবা আশ্রয় দেয়নি। রীতি আপাও আর বাসায় আসতে পারেনি।
-ঐ ছেলেটা তাকে বিয়ে করেনি?
-না। তার মা-বাবা অন্যত্র বিয়ে দিয়েছে ছেলেটাকে।
-হায় হায়! তাহলে রীতি এখন কোথায় ?
-এক খালাম্মার বাসায় থাকে। কিছুটা উৎশৃঙ্খল জীবন-যাপন করে বলে আমাদের বাসায় তাঁকে ঠাঁই দেওয়া হয় না।
তিন
আজিজ দ্রুত ধাবমান রিকশায় ছুটে আর ভাবে, তাহলে কি নিশি কন্যাটি তার সেই পুরোনো প্রণয়ীর ছোটবোন রীতি! সে-ই তো তার নামটা জানে। শুধু নামই জানে না। সতের-আঠার বছরের ব্যবধানে আজিজের মুখের মানচিত্র পাল্টালেও নাকের ওপর যে কাটা দাগ আছে, তা দেখেও চিনতে কষ্ট হবার কথা নয়। আজিজ ভাবে, রীতি কী এতটা নিচে নামবে! পারিবারিক ঐতিহ্য, মা-বাবার সুনাম ওসব কিছু দলিত-মথিত করে কিনা…
আজিজের সংশয়ের জট খুলতে চায় না। ততক্ষণে রিকশাটা এসে তাদের বাসার গেটের সামনে থামে।