Abdur Rofik Khan

আব্দুর রফিক খান

যে কবি কালোর গভীরে

লুকিয়ে রাখেন আলোর অভীপ্সা

🍁

তৈমুর খান

🍁

১৯৪৪ সালে জন্মেছেন আব্দুর রফিক খান। প্রায় ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য চর্চা করে আসছেন। দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেছেন ‘রাহিলা’ পত্রিকাও। ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশেই তাঁর জনপ্রিয়তা। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬১ টি। একাধারে তিনি কবি,গীতিকার এবং গবেষক। বর্তমানেও লেখায় তাঁর ছেদ পড়েনি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘পরাগ পরশে হাসে প্রেম'(প্রথম প্রকাশ: ভাষাদিবস ২০২২) কাব্যখানি বাংলা কবিতা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। আর এই দৃষ্টি আকর্ষণের অনেকগুলি কারণও আছে।

আব্দুর রফিক খানের কবিতায় বরাবরই এক সহজ সরল অনাড়ম্বর প্রেমের সহজিয়া আবেদন আমাদের মুগ্ধ করে। ঝকঝকে শানিত শব্দ, ক্রিয়ার সঙ্গে কবির ব্যক্তিসত্তার যোগ, অতিকথন বর্জিত কবিতার নির্মেদ শরীর এবং গতিময় যাপনের অভিব্যক্তি পাঠকের মরমে সহজেই প্রবেশ করে। কবিতার ভাষা খুবই স্পর্শাতুর, ছলনাহীন এবং কষ্টকল্পিত মস্তিষ্কজাত নয় বলেই তা মর্মসঞ্চারী সৌজন্যদীপ্ত স্বয়ংক্রিয়তায় নম্রভাষী মেদুর হয়ে ওঠে। এই কাব্যখানিও উক্ত বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রমী নয়। যে বসন্তকে আমরা শুধু বাহিরে নিরীক্ষণ করি, সেই বসন্তকে তিনি দেহ ও মনের অন্তরালে নিরীক্ষণ করেছেন। জীবনের গতিময়তায় তার অব্যর্থ পুলক জেগে উঠেছে। স্ফুরিত হয়েছে সংরাগের রক্তিম আভাষও। কাব্যের নাম কবিতার শেষ দুই পংক্তিতে তিনি লিখেছেন:

“শংকিত মৌ-বনে

পরাগ পরশে হাসে প্রেম।”

তখন এই মৌ-বনকে দেহের মধ্যেই আবিষ্কার করি। তার পরাগ অর্থাৎ পুলকে হেসে উঠতে দেখি। বয়সের ভার কবিকে ন্যূব্জ করলেও, মনকে প্রফুল্ল যৌবনের উদ্দাম আমেজে রাঙিয়ে রেখেছে তা বলাই বাহুল্য।

তবুও কবিতাগুলিতে শরীরী উচ্ছলতায় কামের ধুলো লাগেনি। প্রেমকে পবিত্র প্রাকৃতিক শক্তির সম্মোহন হিসেবেই উপলব্ধি করেছেন। ‘স্মৃতি’ কবিতায় খোলসা করেই লিখেছেন:

“হৃদয়-উঠোনে নাচে স্বপ্ন সাধ।

জীবন পবিত্র হয়

সুরে আর তানে,

মনে পড়ে সুখের বাসর।”

পবিত্র জীবনের কথা এবং সেই সঙ্গে সুর ও তানের উল্লেখে স্মৃতিময় রোমান্সের দরজা খুলেছেন। মাত্র কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি পংক্তিতেই নির্মেদ কবিতাগুলি দার্শনিক বাণীর প্রত্যয় নিয়ে সকালের শিশিরে স্নাত হয়ে ঝিলমিল করে উঠেছে। বোধের রোদ্দুরে তাদের উজ্জ্বলতা বেড়েছে। যুগের অন্ধকার বাড়লেও কবি বলে দিয়েছেন:”অন্ধকার শেষকথা নয়।” তার মানে অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো, সেই তো আমার আলো।

এই আলো খুঁজতে কবিকে বাইরে যেতে হয়নি। হৃদয় গভীরে ডুব দিতে হয়েছে যা একজন মরমিয়া সাধকের কাজ:

“অন্ধকারে থেকে থেকে অন্ধকার দেখি,

মনের গভীরে খুঁজি

আলোর হদিশ;”

অন্ধকার যে আলোর উৎস তা সকলেরই জানা। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছেন:

“Darkness cannot drive out darkness: only light can do that. Hate cannot drive out hate: only love can do that.”

(Martin Luther King Jr., A Testament of Hope: The Essential Writings and Speeches)

অর্থাৎ অন্ধকার অন্ধকার দূর করতে পারে না: কেবল আলোই তা করতে পারে। ঘৃণা ঘৃণাকে তাড়িয়ে দিতে পারে না: শুধুমাত্র ভালবাসা তা করতে পারে।

কবিরও কালোর গভীরে আলোর অভীপ্সা। কেননা কবি সভ্যতার আলোক শিশু হয়ে মানুষের কাছে ভালোবাসাই বিলি করতে চান। এই ভালবাসাকে ব্যর্থ হতে দিতে চান না। তাই ক্ষত সহ্য করেও, ভাঙা মন নিয়েও, চোখে অশ্রুনদী লালন করেও অগ্রসর হতে চান। স্বপ্নবীজ বুনে বুনে মানবিক ফসলের প্রেম প্রত্যাশাকে পূর্ণ করতে চান। ‘প্রত্যাশায়’ কবিতায় উল্লেখ করেন:

“প্রণয়ের আরশিতে দেখি স্মৃতি মুখ,

দুঃখ সব ভুলে যাব, পাব নব সুখ।”

কাব্যের মোট অষ্টআশিটি কবিতায় জীবনের অনবদ্য এই সংরাগকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকেও জীবনের নানা বাঁক, আলো-আঁধারির পর্যায়গুলি চিনিয়ে দিয়েছেন। কবিতাগুলিকে তারুণ্যের দীপ্তি থেকে দার্শনিকের প্রজ্ঞার সিদ্ধিতে উত্তরণ ঘটিয়েছেন। যদিও জীবনযাপনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উজাড় করে দিয়েছেন। ঘনীভূত জীবনরসের দ্রবণে তা অকৃত্রিম শিল্প হয়ে উঠেছে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেই আশ্রয় করে ভাবনার ব্রততীগুলি উপলব্ধির পরাগমোচন করেছে। কোথাও জীবনের দিন ক্ষয়ে গেলে এক অপার্থিব প্রেমের আশ্বাসই তাঁর শক্তির প্রাচুর্য দান করেছে। ছলনার অন্ধকার সভ্যতার সংকট ডেকে আনলেও হৃদয় আয়নায় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন ছন্দময় স্বপ্নগুলি ফুল হয়ে ফুটেছে বেদনার আবরণ ভেদ করে, আর তখনই তৈরি হয়েছে প্রেমের মুহূর্ত:

“তোমাকে দেখতে পেলেই

হাত বাড়াই

কাছে পাই না।

চলে গেলেই তাকাই

শুধুই তাকাই….”

এই তাকানোটাই গভীর ব্যঞ্জনাময় একটা বহুমুখী ক্রিয়া। তাকানোর মধ্যেই অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ যেমন বিরাজ করে, তেমনি জগৎ-জীবন, ব্যক্তি ও নৈব্যক্তিকতার সীমানাও বাড়িয়ে চলে। প্রেম-প্রত্যাশার ভেতর এই আত্মদর্শন সীমাহীন আবেদন রেখে দেয়।

মেস্টার একহার্ট , ইংরেজিতে মাস্টার একহার্ট, আসল নাম জোহানেস একহার্ট, যাকে একহার্ট ভন হোচেইমও বলা হয়, সেই

ডোমিনিকান ধর্মতত্ত্ববিদ এবং লেখক যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ জার্মান অনুমানকারী রহস্যবাদী তাঁর উপদেশে বলেছিলেন:

“The eye through which I see God is the same eye through which God sees me; my eye and God’s eye are one eye, one seeing, one knowing, one love.”

(Meister Eckhart, Sermons of Meister Eckhart)

অর্থাৎ যে চোখ দিয়ে আমি ভগবানকে দেখি, সেই চোখই যে চোখ দিয়ে তিনি আমাকে দেখেন; আমার চোখ এবং ঈশ্বরের চোখ এক চোখ, এক দেখা, এক জানা, এক প্রেম।

এই চোখ দিয়ে কবিও দেখেছেন। তাকিয়ে থেকেছেন। প্রকৃতি সৌন্দর্য, প্রেম ও নারী তাঁর কাছেও ঈশ্বর হয়ে উঠেছে। তাঁর দেখাই ঈশ্বরের দেখা, তাঁর চোখই ঈশ্বরের চোখ।সেই চোখে আছে উদারতা, স্বচ্ছতা, করুণা, বিনয় অথবা আকুতি। তাই আর একটি কবিতায় বলেছেন:

“চোখে প্রেমালোক—বুকে গোলাপ

ভালোবাসার ডালি সাজিয়ে

অজানা শেকড়ে বসে মানকুমার।”

অথবা,

“চৈত্র মাসের সাঁঝবেলাতে

দেখতে গিয়ে চাঁদ

তোমায় পেলাম মেঘের মেলায়

মেঘের সাথে রঙের খেলায়

পাতলে তুমি ফাঁদ—

দেখতে পেলাম মেঘের খেলা,

দেখলাম নাকো ফাঁদ।”

কবির দেখা প্রকৃতি, সৌন্দর্য যেমন সত্য হয়ে উঠেছে, তেমনি তার উপলব্ধির জগৎও মহীয়ান হয়ে উঠেছে। শত অন্তরায়ের মধ্যেও এক মিস্টিক চেতনার জগৎ তিনি দেখতে পেয়েছেন। তাই দুঃখও সুখের, শূন্যতাও পূর্ণতার পরশ দিয়ে যায়। ‘কবির শ্রেষ্ঠ সময়’ কবিতায় লিখেছেন :

“দুঃখে যখন হৃদয় ভরে

ঝরে সদাই আঁখি,

সেই তো আমার শ্রেষ্ঠ সময়

দুঃখের কাব্য লিখি।”

এই দুঃখের কাব্যই প্রকৃত কাব্য, বাল্মীকিও তাই লিখেছিলেন, মুকুন্দরামও তাই লিখেছিলেন, কাজী নজরুল ইসলামও এবং জীবনানন্দ দাশও তাই লিখেছিলেন। স্রষ্টার কাছে দুঃখই তো মূল বিভাব। সুখ তো সৌখিন বিলাস মাত্র।

🍁

পরাগ পরশে হাসে প্রেম: আব্দুর রফিক খান,প্রকাশক:আদিত আয়মান

খান, কবিপল্লী, কলেজ রোড, সালার, মুর্শিদাবাদ-৭৪২৪০১,রাহিলা সংস্কৃতি

সংঘ, প্রচ্ছদ : অভিজিৎ রায়, মূল্য ৩০০ টাকা (ভারত), ৩৫০ টাকা

(বাংলাদেশ)

আব্দুর রফিক খান
https://bangla-sahitya.com/post/

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *