………দীপ্তর হঠাৎ করে এমনভাবে ফিরে আসাটা রঞ্জুর কাছে সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল। মায়ের অসুস্থতা, সংসারের দায়িত্ব সবকিছু যেন রঞ্জুকে দীপ্তর থেকে অনেক বেশী দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পর প্রথম প্রথম খুব মনে পড়ত দীপ্তর কথা। সময়ের সাথে সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় আস্তে আস্তে দীপ্তও মুছে গিয়েছিল তার মন থেকে। কিন্তু আজ তাঁর যেন মনে সেই সব ফেলে আসা দিনগুলো তাঁর চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। প্রচন্ড গরমের মধ্যে, লো ভোল্টেজে ফ্যান না ঘোরার অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যেও সে কোন এক ভাল লাগার আবেশে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারে নি। চারিদিকের শাঁখ বাজার আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে।
কতদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন ভাবে ঘুমায়নি সে। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে সন্ধ্যা দিতে গেল সে। কিন্তু হঠাৎ তাঁর মা তার নাম ধরে ডাকলেন। “রঞ্জু … কি রে? কি হয়েছে তোর? এমন ভুল ত তোর হয় না? শরীর খারাপ না কি? “
রঞ্জু অবাক হল মায়ের প্রশ্ন শুনে। সন্ধ্যা দেওয়া ভুলে গিয়ে ভাবতে শুরু করল….. “মা তো কোনদিন সন্ধ্যা দেওয়ার সময় বা অন্য কোন সময়েই এমন কথা বলেন না। আজ হঠাৎ কেন বললেন? আমার কি ভুল হল আজ? “
রঞ্জুকে ওভাবে দাঁডিয়ে থাকতে দেখে তাঁর মা খুব অবাক হলেন। বললেন… “কি রে কিছু বলছিস না কেন? কি হয়েছে তোর?”
রঞ্জু বেশ অবাকই হল নিজের এই পরিবর্তন দেখে। তবু নিজের মনের চঞ্চলতার অবস্থা মাকে বুঝতে না দিয়ে বলল…. ” কেন কি হবে আমার? আর কি ভুল করলাম আমি? আমি তো বুঝতে পারছি না। সন্ধ্যা দিতেই তো যাচ্ছিলাম, তুমিই ত ডাকলে। বল কি বলবে? কি ভুল করেছি আমি? “
রঞ্জুর মা বেশ অবাক হলেন এবং বুঝতেও পারলেন যে তাঁর মেয়ের সত্যিই আজ কিছু একটা হয়েছে। না হলে তিনি বলার পরেও রঞ্জু বুঝতে পারল না যে কাপড় না ছেড়েই সন্ধ্যা দিতে যাচ্ছে। তিনি নিজের ভাবনাটা গোপন করে বললেন — “তোর যে কিছু একটা হয়েছে সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি, না হলে তুই দুপুরের খাওয়া কাপড় পড়ে সন্ধ্যা দিতে যাচ্ছিস? এমনটা আগে কোনদিন হয়েছে আগে? “
মায়ের কথা শুনে কি বলবে ভেবে পেল না রঞ্জু। নিজের পরিধেয় কাপড়ের দিকে তাকিয়ে অবাক হল সে। সে সন্ধ্যা দিতে এসেছে কাপড় না ছেড়েই। কলেজে পড়া আধুনিক মনস্ক হলেও এসব ক্ষেত্রে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া সংস্কার গুলো সে মানে। কথা ঘোরাতে বলল …” দেখেছ! আজ এত ঘুমিয়েছি যে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা কখন হয়েছে বুঝতেই পারিনি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কাপড় ছাড়তেই ভুলে গেছি একদম।”
রঞ্জুর মাও ভাবলেন হয়ত সে ঠিকই বলেছে। তিনি হয়ত একটু বেশীই ভাবেন ওর কথা। আর না ভেবেও বা কি করবেন? দেখতে দেখতে মেয়ের বয়স ত্রিলোক কাছাকাছি হয়ে গেল। এখনও তাকে পাত্রস্হ করতে পারলেন না। নিজে যখন সুস্হ ছিলেন তখন বাড়ির সব কাজ নিজেই করতেন। অসুস্থ হওয়ার মেয়েটা সেই যে সংসারের দায়িত্ব ঘাড় পেতে নিল, আর নামাতে পাড়ল না।
একটু পরেই রঞ্জু এল চায়ের কাপ দুটো নিয়ে। প্রতিদিন সন্ধ্যা দেওয়ার পর মা- মেয়ে একসাথে বসে চা খাওয়াটা তাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই কয়েক বছর। চায়ের প্লেট দুটো মায়ের খাটের উপরে রেখে মায়ের মুখোমুখি বসল সে। আজ সন্ধ্যায় যা কান্ড ঘটিয়েছে সে সেই কারণে মায়ের মুখের দিকে তাকাতেই পারছে না। মা ছোটবেলা থেকেই তাঁর মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারেন। তাঁর আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট সব ঠিক বুঝে যান মা। আজও কি মা কিছু বুঝতে পেরেছেন কিনা কে জানে?
দুপুরে দীপ্তর সাথে মেসেজ আদান-প্রদান হওয়ার পর থেকেই তাঁর মধ্যে যে একটা অদ্ভুত অস্হিরতার ঝড় উঠেছে এটা সে ভালই উপলব্ধি করতে পারছে।
“কি রে? চা টা দে! ঠাণ্ডা জল হয়ে গেল তো!”
চমকে উঠল রঞ্জু। কাঁপা কাঁপা হাতে মায়ের দিকে চায়ের প্লেট টা এগিয়ে দিল সে। মা যেন তাঁর দিকে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সে তাকাতে পারছে না মায়ের চোখের দিকে। তাঁর মা চায়ের প্লেটটা নিলেন। কিন্তু চায়ে চুমুক দিতেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
“তুই আমার চায়ে চিনি দিয়েছিস্! কি রে?”
আবার চমকে উঠল রঞ্জু।
“সত্যি করে বলত তোর আজ কি হয়েছে? কিছু যে একটা হয়েছে সেটা তো বুঝতে পারছি কিন্তু কি হয়েছে বল!”
রঞ্জু যেন নিজেকে মেলাতে পারছে না আজ। সত্যিই সে যেন খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে আজ। কিন্তু সে মাকে কি করে সত্যিটা বলবে? কি করে মাকে বলবে যে দীপ্ত আবার ফিরে এসেছে তাঁর জীবনে হঠাৎ করে। আর তার জন্যই তাঁর এত চিত্ত ব্যাকুলতা। সব কিছু ওলটপালট হয়ে চলেছে দুপুরের পর থেকে। দীপ্তর ফিরে আসাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত তাঁর নিজের কাছে যে সে এখনও সেই মুহূর্তটা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারেনি। তাই প্রতিটা কাজে তাঁর এমন অস্বাভাবিকতা মায়ের সামনে ফুটে উঠছে।
কিছু হয় নি তো! যেন স্বগতোক্তি করে উঠল সে। তারপর দ্রুত চা টা খেয়ে মায়ের সামনে থেকে উঠে পালাল সে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে!…..