স্মৃতির সরণি বেয়ে // ১ // সুব্রত মজুমদার

জন্ম নিয়েছিলাম প্রকৃতির কোলে শ্যামল ছায়াঘেরা এক পল্লীগ্রামে। সভ্যতার বিষবাস্প তখনও স্পর্শ করেনি গ্রাম্য জীবনকে। গ্রামটার নাম চন্দ্রপুর। কয়েকঘর চাষা, লোহার আর সাহাদের বাস। গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা আদিবাসী পাড়া, – পাড়ার বাসিন্দারা জাতিতে মহুলি। এদের বংশগত জীবিকা হল বাঁশের ঝুড়ি পেছে কুলো ইত্যাদি তৈরি করা। এরাও ভাষা আর নৃতাত্ত্বিকভাবে সাঁওতালদের একটা গোষ্ঠী।

মহুলিপাড়া আর লোহারপাড়ার মাঝে কয়েক ঘর ব্রাহ্মণের বাস। এরা কণৌজ সামবেদীয় ব্রাহ্মণ ।পদবী বন্দোপাধ্যায়। এই বাঁড়ুজ্জেরাই হল আমার মাতুল বংশ। এরা চাকরির পরোয়া করত না। চাষবাস আর পূজা পার্বনে দিন গুজরান হয়ে যেত। যদিও আমার বড়মামা পুলিশে চাকরি করতেন।

সময়টা ১৮৪০ সালের আশেপাশে, রাজা উমাচরণ রায় ছিলেন সারেন্দা সহ আশেপাশের বিরাট এলাকার দন্ডমুণ্ডের কর্তা। তারা তিন ভাই – উমাচরণ, শ্যামাচরণ ও বামাচরণ। ঘোড়াশালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি ধন ধান্য কিছুরই অভাব নেই। কিন্তু ভগবান সবকিছু উজাড় করে দিলেও সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত করলেন তিন ভাইকেই। আর সেজন্যই রাজা উমাচরণ রায় সিদ্ধান্ত নিলেন দত্তক গ্রহণের। দূরবর্তী কুলিয়া গ্রামের এক ব্রাহ্মণ বালককে রাজা দত্তক নেন। এই বালকই বন্দোপাধ্যায় বংশের আদিপুরুষ।

এরপর অনেকগুলো বছর কেটে গেল, এল ১৮৫৫ সাল। চারদিকে সাঁওতাল বিদ্রোহের দামামা বেজে উঠেছে। সিধু আর কানু ওদের নেতা। লক্ষ্য একটাই জমিদার মহাজন আর সাহেবদের হাত হতে ‘দামিন-ই-কো’ কে উদ্ধার করা।

মহাজনদের অত্যাচার আর শোষণে সাঁওতালেরা নিজেদের বাসভূমি হতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছিল। ধান মাপার সময় মহাজনের লোক রাম, দুই, দুই, দুই করেই চলত তিন আসত দশটিন ধান মাপার পর। এভাবে একশো টিন ধান মহাজনের মাপে হত বিশ পঁচিশ টিন। দুধ মাপার পাত্রে ফুটো করা থাকত। আরো নানান ভাবে চলত অত্যাচার। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল মিশনারিদের অত্যাচার। সবেমিলে রুখে না দাঁড়ালে আর চলছিল না।

বিদ্রোহী সাঁওতালদের দল বর্তমান ঝাড়খণ্ড হয়ে মুরালপুরের রাস্তা ধরে আসছিল সারেন্দা অভিমুখে, – লক্ষ্য সিউরির ব্রিটিশ রেসিডেন্স। বীরভূম জেলার আয়তনও ছিল তখন বিশাল। মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া ও বর্ধমানের কিছু অংশ এবং ঝাড়খণ্ডের দেওঘর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বীরভূম জেলা। সিউড়ি ছিল কালেক্টরেট। সাঁওতালেরা আসছে শুনে রাজা মা দ্বারবাসিনীর স্মরণাপন্ন হন। মা তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, ” তুই আমার কাছে ছাতার নিচে বসে থাক। তোর কিচ্ছু হবে না।”

মা দ্বারবাসিনীর তখন মন্দির ছিল না। মা সাঁওতালদের তৈরি বাঁশের ছাতা ঢাকা থাকতেন। যাইহোক মা দ্বারবাসিনীর কথায় রাজার বিশ্বাস হল না। মা তখন রাজাকে ধানের গোলার ভেতরে লুকোতে বলেন। রাজা সে কথাতেও বিশ্বাস করলেন না। তিনি আগেই তার দত্তক পুত্র-পুত্র বধূকে দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবার নিজে রাহাখরচ বাবদ একঘটি মোহর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পথে সাঁওতালদের হাতে আক্রান্ত হন ও নিহত হন।

মা দ্বারবাসিনীর কথায় ভুল ছিল না। সাঁওতালেরা সোজা রাস্তা বরাবর গিয়েছিল, কোথাও বেঁকেনি। সেই হিসাবে মায়ের কাছে বা ধানের গোলা নিরাপদ আশ্রয় ছিল। এদিকে সাঁওতালেরা রাস্তায় যাকে পায় তাকেই মারে। নিরীহ গোয়ালিনীও বাদ যায় না।

বিদ্রোহীদের দল জাতীয় সড়ক ধরে
ময়ূরাক্ষীর তীরে পৌঁছাল। দুপুরে রান্না হয়েছে শাক আর ভাত। দলের অনেকে স্নান করতে নামল জলে। অপর পাড়ে ব্রিটিশ সৈন্য প্রস্তুত ছিল। তারা একটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করল। সাঁওতালদের নেতা, কপালে সিঁদুরের তিলক মাথায় ঝাঁকড়া চুল আর পরনে জোলাদের বোনা খাটো ধুতি, সে বলে উঠল, “ভূয়” অর্থাৎ ফাঁকা। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ধেয়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। সাঁওতালরাও পাল্টা তীর চালাল। কিন্তু বন্দুকের সাথে পেরে উঠল না। ব্রিটিশরা ছিল সঠিক পজিশনে আর সাঁওতালরা ছিল নদীর জলে প্রকাশ্যে। অনেক বিদ্রোহী মারা গেল বাকিরা গেল পালিয়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহকে নির্মমভাবে দমন করল ইংরেজ সরকার।

এর বহুবছর পর আমার মাতামহীর বাবা সারেন্দা হতে চন্দ্রপুর আসেন। সম্বল কিছু ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি আর সংস্কৃতে পণ্ডিত্য। উনার স্ত্রী ছিলেন অর্ধোন্মাদ। এখনকার দিন হলে ডিভোর্স দিতে সময় লাগত না। কিন্তু তখনকার মানুষেরা ছিলেন সহজ ও সরল। প্রমাতামহী রান্না করে ঘরের বাইরে গেলে তার জায়েরা রান্নায় লবণ মিশিয়ে দিতেন। খাবার সময় প্রমাতামহ লবণে পোড়া খাবার খেতে পারতেন না, কিন্তু প্রমাতামহীকে কোন গালাগালি করতেন না। সব জানতে পেরে একটু শান্তির আশায় চন্দ্রপুরে চলে আসেন।

আমার মাতামহকে আমি দেখিনি, কিন্তু তার অনেক কথা আমি শুনেছি। আমার মাতামহের নেশা ছিল চা খাওয়া আর দাবা খেলা। দাবা খেলতে পাশের গ্রাম সারেন্দায় যেতেন। অনেক রাতে আসার সময় বহুবার ভুতের কবলে পড়েছিলেন। এখনকার দিনে ভুতের বিশ্বাস অনেকেরই নেই। আমিও ব্যক্তিগত জীবনে ভুতে বিশ্বাসী নই। তবুও ঘটনাগুলো খুবই রোমাঞ্চকর। পরের কোন পর্বে এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে।

….. চলবে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *