ঢাকা থেকে ভোর চারটায় ট্রেন। রাজেন্দ্রপুর,সাতখামাইর কিংবা শ্রীপুর গিয়ে নামতে হতো দ্রুতযান,ঝটিকা এক্সপ্রেসে বেলা এগারটা নাগাদ।দুদিন আগে থেকেই তার প্রস্তুতি। কিভাবে , কখন, কোন গাড়ি ধরতে হবে,কটায় পৌছুবে—সিরাজ মামা, আর আব্বা রাতভর তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন।শ্রীপুর,গসিঙ্গা গিয়ে কখনো লঞ্চে দরদরিয়া যাবার পরিকল্গনাও থাকতো।তবে ট্রেনটা ছিলো বেটার।
তারপর কাঠবডি, চোখামাথাঅলা বাস।বাতের রোগীর মতো কঁকাতে কঁকাতে বাস এগুতে থাকে।কাপাশিয়া পৌঁছুতে আরো ঘণ্টা দুয়েক।
কাপাশিয়া বাজারে আমিত্তি,মুড়ি,ঝোলাগুড়ে জলযোগ। তারপর শীতলক্ষ্যার গুদারা(নৌকা পারাপার)।
শান্ত স্থির ঢেউ।নীলচে জল।আব্বা সেই পানিতে হাতমুখ ধুয়ে এক ঢোক খেয়ে ফেললেন।
আমাদের সাথে সালাম মামা এ-দৃশ্য দেখে বিরক্তি নিয়ে বললেন,আরে দুলাভাই নদীর পানি খাওয়া ধরছুইন কিয়ের লাইগগা গো?
আরে একদম ফ্রেস।শীতলক্ষ্যার পানি সুপেয়।ব্রহ্মপুত্রের লগে যোগ আছে।ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি স্থল হিমালয়ের মানসসরোবর। এই পানি খাওয়া যায়।একটু পরেই মানুষের বর্জ্যগুলো দেখে সবার বিরক্তি লাগলেও আব্বা স্বাভাবিক।
নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে হাঁটা।কদাচিৎ গরুগাড়ি মিলতো।বসে থাকতে থাকতে গায়ে ব্যথা ধরে যেতো।কাঁচা মাটির রাস্তা।
হুঁতির খাল পর্যন্ত। তারপর এক পল্লা বাঁশের সাঁকো।গজারির খুঁটির ওপর থেকে প্রায় ত্রিশফুট নীচে খালের লালচে পানিতে হাবুডুবু খেয়ে সাঁতরাচ্ছে শিশুরা।নীচে তাকালে মাথা ঘোরাতো।চৌকোনা জাল পাতা।
আরো প্রায় এক কিলো পথ।উঁচু নীচু টিলা,খায়েদের বাড়ি, ফরদার টেক,ঠুঁডা পেরিয়ে নানার বাড়ির দক্ষিণের ঠুডা(টিলার সরু বর্ধিত অংশ, যা বিলের দিকে নেমে গেছে), লাল মাটির ঘর,তালপাতার বেড়া, সারি সারি ঝাঁকড়া চুল ওয়ালা বাউলের মতো তালগাছ গুলো চোখে পড়ামাত্র সারাদিনের নেতানো শরীরের ক্লান্তিকর দুঃখ পালাতো।আমাদের আগমনী সংবাদ তারা পেয়েছেন একমাস আগে,আম্মা চিঠি লিখেছিলেন তরুণ, বেপারী বাড়ি হারেছ মেম্বরের ঠিকানায়।
দক্ষিণের ঠুঁডার বরাবর খালা,মামারা,নানীরা উৎসাহ নিয়ে সারিবেঁধে অপেক্ষমাণ।উঠোনে পৌঁছেছি, তখন মাগরেব।তক্ষক ডেকে উঠেছে। ঘরে ঘরে পিতলের কুপি, গাছা পৌছে গেছে।চারদিকে অপূর্ব নিরব সন্ধ্যার আমেজ।নানার খালি গলার আজানটার সুর এখনো কপি করে আম্মাকে শুনাই।
নানা,নানীরা সবাই এখন শান্তিতে লাল মাটির বিছানায় ঘুমাচ্ছেন।
এখন বাড়ি পর্যন্ত প্রাইভেট কার যায়।ঘরে ঘরে সৌরবিদ্যুত।হঁঁতির খালে ব্রীজ হয়েছে।পদ্ম শাপলার বিলে আর পদ্ম শাপলা নেই।তবে মাছের খামার হয়েছে অনেক। আশ্বিনের হাত(দলবদ্ধভাবে মাছ ধরা)নামেনা।গজারি গাছগুলো কেটে সাফ।লাল মাটির ঘর,তালপাতার ছাউনিতোলা ঘর নেই।লোকজন সব শহরে চলে গেছে।
ঢাকা কিংবা ময়মনসিংহ থেকে ওখানে দেড়-দু ঘণ্টার পথ। তবুও গত চার বছরে একটি বারও সময় করা হয়ে উঠলো না।