স্নেহের ঠিকানা

অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে বসেছিল দীপক। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা বই নিয়ে বসেছিল। একা ঘরে বসে বই পড়তে পড়তে কখন যেন চোখটা একটু লেগে গেছিল। তন্দ্রাভাবটা কেটে গেল তার বন্ধ চোখের উপর দুটো ছোটো ছোটো নরম হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায়। আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা মিষ্টি হাসির রেখা দেখা দিল দীপকের ঠোঁটে।
‘এই তো আমার মাম এসে গেছে।’ বলে সেই হাত দুটো ধরে নিয়ে হাতের মালিককে তার সামনে নিয়ে এল দীপক। একটি বছর নয়েকের বাচ্চা মেয়ে তার সামনে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে দীপকের মেয়ে আকাঙ্খা, তার আদরের মাম।
মাম হাসিমুখে একটা সার্টিফিকেট আর একটা কালার পেন্সিল কিট ব্যাগ থেকে বের করে দীপকের হাতে দিল। দীপকের হাসিটা আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সার্টিফিকেটে আকাঙ্খা রায়ের নামের পাশে উল্লেখ রয়েছে সে ছবি আঁকা কম্পিটিশনে প্রথম স্থানাধিকারী।
ভীষন আনন্দিত হয়ে দীপক জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে। কপালে এঁকে দিলো গর্বিত পিতার স্নেহচুম্বন।

**************************
মাম অনেকক্ষণ হল ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু, দীপকের চোখে ঘুম নেই। বারবার তার মন ফিরে যাচ্ছিল নয় বছর আগের একটা দিনে।
মামকে জন্ম দিয়েই তার মা মারা যায়। একা হয়ে পড়ে দীপক। কিন্তু সেই মূহূর্তে সে কাউকে তার পাশে পায় না। এমনকী তার নিজের পরিবারকেও নয়। তারা কখনো মেয়ে চাননি। আর শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্মানো একটা মেয়ে তো কখনোই নয়।
জন্ম থেকেই মামের একটি পায়ের গঠনগত ত্রুটি আছে। আর সেই অপরাধেই হয়তো তার পরিবারের কেউ তার মুখ পর্যন্ত দেখতে চায়নি। অনেক চেষ্টা করেও দীপক হেরে যায়। একটা সরল, নিষ্পাপ শিশুর প্রতি এই অবহেলা বাবা হয়ে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে নতুন ঠিকানায়। সেদিন তার সম্বল ছিল ওই একরত্তি শিশুটির সরলতা মাখা হাসি আর এক পিতৃহৃদয়ের উজাড় করা স্নেহ ভালোবাসা।
সময় আবারো কঠিন পরীক্ষা নেয়‌। দীপক জানতে পারে তার মেয়ে কখনোই কথা বলতে পারবেনা। কিন্তু, এবার সে আর ভেঙে পড়ে না। আর তার একমাত্র কারণ মাম, তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। শারীরিক প্রতিকূলতা পেরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে সে সবসময় তৎপর। যদিও দীপকের কখনোই তাকে’অস্বাভাবিক’মনে হয় না, তার কাছে তার মেয়েই সেরা। পেন্সিল তুলির টানে মাম যে সব ছবি ফুটিয়ে তোলে, দেখলে ও সত্যিই অবাক হয়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের হাত ধরে তার মাম আজ অনেক এগিয়েছে। হয়তো কোনো একদিন সত্যিই সে তার বাবাকে ‘বাবা’ ডাকে চমকে দেবে। স্বপ্নগুলো একে একে ভিড় করে আসে দীপকের চোখের পাতায়। ঘুমন্ত মামকে জড়িয়ে দীপক ডুবে যায় ঘুমের দেশে।
——————————
# ইচ্ছেডানায় মৌ

মৌমিতা দাস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *