#সেমসেম
#শম্পাসাহা
আয়নার সামনে বসে অনেকক্ষণ ধরেই নিজেকে দেখছিল রাধিকা।অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিল নিজের চোখ ,মুখ,বুক,চোখের চামড়া এং নিজের মাথা।
টুকটুকে ফর্সা রং,এক ঢাল কালো চুল,টিকোলো নাক,একটু মোটার দিকে গরণ,বেশ গোলগাল।শাশুড়ি আর শ্রীজিৎ ওই রূপ দেখেই তো বৌ করে এনেছিল ওকে।
মনে মনে রূপের অহংকার না থাকলেও সচেতনতা ছিল বেশ।তাই রাধিকাও সব সময় নিজেকে সুন্দর করে রাখতে চেষ্টা করতো।মুখে কতটুকু রূপটান দিলে বাড়াবাড়ি মনে হবে না অথচ সুন্দর লাগবে সেটা ও ভালোই বুঝতো।নিজেকে কি ভাবে সবার সামনে উপস্থিত করতে হয় তাও ওর ভালোই জানা।
সুন্দর পরিমিতি বোধ ওকে এক অন্য মাত্রা এনে দিত।যখন শ্রীজিৎ এর সঙ্গে কোনো বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়িতে যেত তখন শ্রীজিৎ এর চোখে মুখে ওকে নিয়ে চাপা গর্বটা বেশ ভালোই উপভোগ করতো রাধিকা।তাই নিজের সৌন্দর্য সব সময়ে পরিপাটি , প্রেসেন্টেবল রাখতে ও নিজেও বেশ তৎপর ছিল।
সাধারণত চওড়া পাড় তাঁতের শাড়ি আর এলো খোঁপা ঘাড়ের কাছে,সঙ্গে একটা ভেলভেটের খয়েরী মানানসই আকারের টিপ ,হাল্কা লিপস্টিক আর চোখে কাজল।উফ্!দুর্ধষ ! এই কথাই বলতো শ্রীজিৎ এর বন্ধুরা।
এমনকি শাশুড়ির পর্যন্ত বৌমার রূপ নিয়ে বেশ গর্ব।শাশুড়ি রাধিকার সামনে না বললেও পেছনে আত্মীয় স্বজনদের বলতেন,”আমার বৌমার মত সুন্দরী এ বংশে আর নেই কেউ হবেও না!”
সেই রাধিকা আজ আয়নার সামনে,চোখের নিচে কালি, চামড়া হলদেটে, সেই গোলগাল চেহারার বদলে যেন এক প্রেত,মাথায় চুল নেই বললেই চলে।কেমো শুরু হবার পর থেকেই ঝরতে শুরু করেছে।এখন প্রায় শূণ্য।সেই ভরাট বুকের একটা নেই, অন্যটাতেও থাবা বসিয়েছে মারণ রোগ।
আর কাঁদে না রাধিকা, সব জল শুকিয়ে গেছে যেন।অভিযোগ ও করে না ঈশ্বরের বিরুদ্ধ, অভিযোগ করতে করতে আজ ও ক্লান্ত।শরীরের সব পরিবর্তন ও মোটামুটি মেনে নিয়েছে কারণ রাহুল হবার পর ও নানা শারীরিক অসুবিধার কারণে ওর চেহারার বেশ খারাপ হয়েছিল কিন্তু ওর ন্যাড়া মাথাটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
এখন শুধু একটাই প্রার্থনা, কত তাড়াতাড়ি সব শেষ হবে।ও নিজেও মুক্তি পাবে,সঙ্গে সঙ্গে ওর বাড়ির লোকজনও! ওকে ও নিজেই যখন সহ্য করতে পারে না তাহলে রাহুল বা শ্রীজিৎ কি ভাবে নেয়? শাশুড়ি মা কিছু বলেন না, তবে হা হুতাশ করে যেভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন তাতে যে প্রচ্ছন্ন দোষারোপ থাকে তা ও ভালোই বোঝে।
কেন রাহুল কে বেশিদিন দুধ খাওয়ায়নি,কেন সব সময় ব্রা পরে থাকতো,কেন সব সময় আঁটোসাঁটো ব্লাউজ পরতো, সব, সব এখন ওর দোষ! যে ফিটফাট থাকাটা এক সময় প্রশংসার বিষয় ছিল এখন সেটাই ওর দোষ হয়ে দাঁড়িয়েছে!
রাধিকা কি বলবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না, এমনকি কান্নাও না!যেন ওর এই অবস্থা ওর চেয়ে বাকিদেরই বেশি কষ্ট দিচ্ছে! হয়তো হবে? মানুষের মন আর বুঝতে চায় না রাধিকা, লাভটাই বা কি? যে যাবে, তার অত ভাবনা চিন্তায় কাজ কি?
তবে শ্রীজিৎ কিন্তু সব সময় ওর পাশে।প্রতিটা দিন,প্রতিটা রাত সব যন্ত্রণা সব কষ্টের মুহুর্তগুলোতে ও চেষ্টা করেছে পাশে থাকার।এমনকি সব সময় ওর মানসিক অবস্থান কে বোঝার চেষ্টা করেছে।এমনকি কাউন্সেলিংও করিয়েছে।
শাশুড়ি মাঝে মাঝে কাঁদেন,”আমার ছেলেটার জীবনটাও শেষ হয়ে গেল।ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না”! সত্যি আশ্চর্য মানুষ! তবে মা তো ! সন্তানের চিন্তাই আগে আসে।রাধিকা নিজেও তো মা।ও সব নিজের নিয়তি হিসেবে মেনে নিলেও, মাত্র পাঁচ বছরের রাহুলের কথা ভাবলেই ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে,কোনো যুক্তি, বুদ্ধি কাজ করে না।রাগ হয় সবার ওপর,সব কিছুর ওপর ।রাগ হয়,যারা সহানুভূতি দেখাতে আসে তাদের ওপর ও !যেন ওর কুৎসিত চেহারা, ন্যাড়া মাথা দেখে সবাই সহানুভূতির নামে ঠাট্টা করছে মনে মনে বলছে,”বেশ হয়েছে,খুব রূপের দেমাক ছিল না? ভালো হয়েছে।”
রাধিকা এখন ডাক্তার দেখানো ছাড়া বাড়ির বাইরে যায় না, কারো সঙ্গে দেখা করে না, এমনকি শ্রীজিৎ এর সামনেও আসতে চায় না।ওর মনে হয় সবাই ওকে হয় ঠাট্টা করে, না হয় দয়া, করুণা।ওর কিচ্ছু দরকার নেই কিচ্ছু না!
আবারও চোখ বেইমানি করে,আবারও জল বের হয়,আবারও নিজের অজান্তেই মুখ শব্দ করে কেঁদে ফেলে।
“রাধিকা, রাধিকা, রাধা,এই অসময়ে দরজা বন্ধ কেন?খোলো! রাহুল তোমার কাছে যেতে চাইছে!”বেশ খানিকক্ষণ পরে দরজা খোলে।রাধিকা দরজার আড়াল থেকেই রাহুলকে উদ্দেশ্য করে হাত বাড়ায় ,”আয় বাবা!”
শ্রীজিৎ ওর ঘরে ঢুকে পরে,”তুমি আবার কান্নাকাটি করছিলে? জানোনা, তাতে তোমার শরীর আরো খারাপ হবে?”রাধিকা তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে নিজের মাথা ঢাকতে যায়,কিন্তু ফাঁকা মাথা, আঁচলটা পড়ে যেতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে ও,”কেন এসেছো এ ঘরে?কেন?কেন?”
“আমি তোমার কাছে আসতে পারি না?”,”না,না,আমার কাছে কাউকে আসতে হবে না, কাউকে না।আর তো কটা দিন তারপর তোমাদের সবার মুক্তি, সব্বার”।রাধিকা শ্রীজিৎ এর বাড়ানো হাতের নাগাল পেরিয়ে দূরে!
“তোমার এত রাগ কেন রাধা?”,অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে।কত লোকের ই তো হয়।তুমি এতো অস্থির।হচ্ছ কেন?”শ্রীজিৎ আবারো রাধিকা কে বুকে টানতে যায়।
কিন্তু রাধিকা মুখ ঘুরিয়ে থাকে,”আমি নিজেকেই ঘেন্না করি!আমার এই কুৎসিৎ চেহারা কে ঘেন্না করি,চুল ছাড়া মাথাটাকে ঘেন্না করি।যাও যাও তোমরা সবচেয়ে চলে যাও এখান থেকে, যাও!”চিৎকার করতে থাকে রাধিকা।
শ্রীজিৎ চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সেদিন আর রাধিকার কাছে যায় না, শুধু দূর থেকে ওর খাবারটা দিয়ে যায় শুধু।সে খাবার না ছোঁয়াই পরে থাকে খাটের নিচে, আর রাধিকা রাতজাগা চোখে খাটের ওপর।
অনেক রাতে কখন যেন একটু চোখ লেগে এসেছিল,হঠাৎ রাহুলের কচি হাতের ঠ্যালায় ঘুম ভাঙে।রাতো বোধহয় দরজা বন্ধ করতে ভুলে গেছিল।শাশুড়ি আজকাল রাহুলকে রাধিকা র সঙ্গে ঘুমোতে দেন না,রাতে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া, ঘুম পাড়ানো বড্ড হ্যাপা,রাধিকা পারবে না!আসলে হয়তো ভাবেন রাহুলেরও যদি অসুখটা হয়ে যায়! রাহুল যে ওনার নাতি! আর রাধিকার?
চোখ খুলে দুটো অচেনা মুখ দেখে ধরফর করে উঠতে যায় রাধিকা। সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে একটু বুঝতে অসুবিধা হয়।”একি,তোমরা ন্যাড়া হয়েছ কেন?”অবাক রাধিকা।
শ্রীজিৎ রাধিকার গালে আদর করে হাতটা বুলিয়ে দেয়।রাহুল গালে চুমু খেয়ে বলে,”মাম্মামের চুল নেই,আমার আর বাবাই এরও চুল নেই, আমরা সবাই সেম সেম।”!
রাধিকা শ্রীজিৎ এর দিকে তাকিয়ে দেখে শ্রীজিৎ ওর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে।সকাল সকালই রাধিকা বুঝতে পারে চোখটা আবার বেইমানি করতে যাচ্ছে,কিন্তু এবার ও আর শ্রীজিৎ এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না।
©®
শম্পা সাহা