১
‘প্রশান্তি নিলয়’ নামের সুন্দর নজরকাড়া তিনতলা বাড়িটির তিনতলার ঝুলবারান্দায় আরামকেদারাটিতে বসে হাতে সকালের দ্বিতীয় চায়ের কাপ নিয়ে আজকের খবরের কাগজখানায় চোখ বুলোচ্ছেন সুখময় বন্দোপাধ্যায়।রোজ সকালের প্রায় দু’আড়াই ঘন্টা সময় এখানে বসেই কেটে যায় তাঁর।এ জায়গাটি সুখময়ের বড্ড প্রিয় জায়গা।এখান থেকে বাড়ির সামনের বেশ বড় কেয়ারি করা ফুলের বাগানখানির প্রায় পুরোটাই দৃষ্টিগোচর হয়।ডালিয়া,ছন্দ্রমল্লিকা থেকে শুরু করে নানান জাতের সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ রয়েছে বাগানে।সবচেয়ে চোখ টানে গোলাপের ভ্যারাইটিগুলি।বাগানের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে ফুটে রয়েছে রঙবেরঙের গোলাপ।তার মধ্যে বেশ কয়েকটি কালো গোলাপের গাছও রয়েছে।সুখময়ের বড্ড প্রিয় এই কালো গোলাপ।একবার মিরিক বেড়াতে গিয়ে সেখান থেকে নিয়ে এসেছিলেন এই কালো গোলাপের চারা।
সুখময়দের এই বাড়িটির বয়েস বছর খানেক মাত্র।বছর আড়াই হলো চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন সুখময়।রিটায়ার করবার পর যা টাকা-পয়সা হাতে পেয়েছিলেন,পাছে তা অন্য কোনও খাতে খরচ হয়ে যায়,তাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তা দিয়ে বাড়ির কাজে হাত দেবার কথা মনে পড়েছিল তাঁর ।তারপর তাঁরা তিন ভাই মিলে পুরোনো বাড়িটি ভেঙে এই নতুন বাড়িটি তৈরি করান।বাড়ির নামটি সুখময়ের দেওয়া।একটি ঘটনা জড়িয়ে আছে এই নামকরণের সঙ্গে।একবার সুখময় তাঁর এক বন্ধুর হার্টের চিকিৎসার জন্য বেঙ্গালুরুর কাছে ‘হোয়াইট ফিল্ড’-এ প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু সাঁইবাবা পরিচালিত সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে গিয়ে সেখানকার বিশাল কর্মযজ্ঞ দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন।তিনি দেখেছিলেন, সাইবাবার হাজার হাজার ভক্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে গিয়ে সেখানে রোজ অক্লান্তভাবে দেশ-বিদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য আগত শত শত রোগার্ত নর-নারীকে নিরন্তর সাহায্য এবং সেবা করে চলেছে।কিন্তু এর বিনিময়ে সাহায্যপ্রার্থী বা কৃপাপ্রার্থী মানুষের কাছ থেকে একটি টাকাও নেবার অধিকার নেই তাদের।হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এমনই কড়া নির্দেশ।প্রত্যেকদিন কোটি কোটি টাকার চিকিৎসা হয় সেই হাসপাতালে।অথচ রোগীদের কাছ থেকে একটি পয়সাও নেওয়া হয়না। শোনা যায়, এদের আয়ের উৎস হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিরাট বিরাট সংগঠন তথা বিশ্ববিখ্যাত শিল্পপতিরা।সুখময়ের সেই বন্ধুর হার্টের একটি জটিল সার্জারি হয়েছিল সেখানে।এবং সম্পূর্ণ বিনেপয়সায়।খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিল,কলকাতায় এই অপারেশনের জন্য খরচ হতো পাঁচ থেকে সাত লক্ষ টাকা এবং ভেলোরে তিন থেকে পাঁচ লক্ষ।সব দেখে শুনে সুখময়ের মনে হয়েছিল,টাকা কোথা থেকে আসছে সেটা বড় কথা নয়,বড় কথা হলো,প্রতিদিন শত শত অসহায় রোগগ্রস্ত সাধারণ মানুষ এই যুগে,অন্যান্য সব বড় বড় হাসপাতালে যেখানে শুধু টাকার খেলা,সম্পূর্ণ নিখরচায় দেশ-বিদেশের বিখ্যাত বিখ্যাত সব ডাক্তারদের কাছ থেকে সুচিকিৎসা পাচ্ছে।আর যিনি আড়াল থেকে এই বিশাল জনসেবামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন,সেই শ্রদ্ধেয় শ্রী সত্য সাইবাবা হলেন সত্যিকারের ভগবান।আমরা দেওয়ালে ছবি টাঙিয়ে কিংবা আসনে মূর্তি বসিয়ে দেব-দেবী জ্ঞানে যাঁদের পুজো করি তাঁরা অধিকাংশই কাল্পনিক ভগবান,অলীক এবং অস্তিত্বহীন।কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ,রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব,শ্রী সত্য সাইবাবা,এঁরাই হলেন প্রকৃত ভগবান।
হোয়াইট ফিল্ডে সুখময়রা ছিলেন প্রায় কুড়ি দিন। তার মধ্যে একদিন,সেদিনটা ছিল পঁচিশে ডিসেম্বর,সুখময়রা তিন-চারজন মিলে একটা গাড়ি ভাড়া করে বেড়াতে গিয়েছিলেন ‘পুট্টাপর্থি নামে অন্ধ্রপ্রদেশের অনন্তপুর জেলার এক ছোট্ট শহরে,যেখানে রয়েছে সাইবাবার এক বিরাট আশ্রম।আর রয়েছে আশ্রম সংলগ্ন আরেকখানি বিশাল সুপার স্পেশ্যালিটি হসপিটাল,যেখানে মূলত হার্ট।কিডনি এবং চোখের কঠিন চিকিৎসা হয় সম্পূর্ণ নিখরচায়।হোয়াইট ফিল্ডের মতন এখানেও চলেছে বিশাল কর্মকাণ্ড।কিন্তু যা দেখে সবচেয়ে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়েছিলেন সুখময়,তা হলো,সাঁইবাবার আশ্রমে বড়দিনের উৎসব পালন।ভিড়ে ঠাসা বিরাট প্রেক্ষাগৃহে স্বয়ং সাইবাবার উপস্থিতিতে যিশুখ্রিস্টের বিরাট প্রতিকৃতির সামনে পালিত হলো সেই উৎসব।অসুস্থ সাইবাবাকে ধরাধরি করে অনুষ্ঠান মঞ্চে নিয়ে আসা হয়েছিল।বেশ কয়েকজন খ্রিস্টান ধর্মযাজকও উপস্থিত ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে।সুখময়ের যে ব্যাপারটা দেখে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল তা হলো,এক হিন্দু ধর্মগুরুর আশ্রমে আড়ম্বরের সঙ্গে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন পালন।মহাত্মা গান্ধী,স্বামী বিবেকানন্দের পরধর্মসহিষ্ণুতা এবং একেশ্বরবাদের পথ,যা আমাদের সনাতন ভারতবর্ষের ঐতিহ্য,সেই অনুষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছিল।
যাই হোক,এর পর থেকে এভাবেই সুখময় শ্রী সত্য সাইবাবার একজন পরম ভক্ত হয়ে পড়েন।তাঁর শোবার ঘরের দেওয়ালে সাইবাবার বেশ বড় একখানা বাঁধানো ছবি টাঙানো রয়েছে।এবং শুধু তাই নয়, সুখময় জেলা স্তরের সাঁই সমিতির একজন সম্মাননীয় কর্মকর্তাও বটে।চিকিৎসার প্রয়োজনে হোয়াইট ফিল্ড বা পুট্টাপর্থি যাবার ব্যাপারে সাঁই সমিতি নানাভাবে সহায়তা করে।নতুন বাড়ি তৈরি হবার পর সুখময় পুট্টাপর্থির সাইবাবার আশ্রমের নামে বাড়ির নাম রাখেন ‘প্রশান্তি নিলয়’। সেই আশ্রমটির নাম ‘প্রশান্থি নিলয়ম’।
বাড়ির সামনের সুন্দর বাগানখানিও সুখময়ের উদ্যোগেই তৈরি হয়েছে।বাগানখানি গড়ে তোলবার পেছনে সুখময়ের অক্লান্ত শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম গিয়েছে।বাগানের মাটি তৈরি,সার প্রয়োগ ইত্যাদি কাজকর্ম তিনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করেছেন।অদূর,সুদূরের নানা জায়গায় নিজে গিয়ে বিভিন্ন নার্সারি থেকে ফুল গাছের চারা-বীজ সংগ্রহ করে এনেছেন।রোজ সকালে দু’জন মালি এসে সারাদিন থেকে বাগানের পরিচর্যা করে।
কর্মজীবনে রাজ্যসরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বহু বছর কচিকাঁচাদের পড়িয়েছেন সুখময়।একার রোজগারে দুই ছেলে-মেয়েকে মোটামুটি সুশিক্ষিত করে বড় করেছেন।ছেলে শৌভিক উত্তর বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে জুলজি নিয়ে মাস্টার্স করছে। সে ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে থাকে,সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে।আর মেয়ে উজ্জয়িনীর এবার কেমিস্ট্রিতে বি এস সি ফাইনাল ইয়ার।উজ্জয়িনী দেখতে অপরূপা হয়েছে,কোনও ছেলে একবার তার দিকে তাকালে দ্বিতীয়বার না তাকিয়ে উপায় নেই।তাদের মা সুরঙ্গমাও যুবতী বয়েসে যথেষ্ট রূপসী ছিলেন,সবাই বলে মেয়ে মায়ের রূপ পেয়েছে।কখনও কখনও মনে হয়,মেয়ে যেন মায়ের চেয়েও সুন্দরী হয়েছে।
সুতরাং কর্মজীবনের সঞ্চয় বলতে তেমন কিছুই নেই সুখময়ের,আর রিটায়ার করবার পর যা হাতে পেয়েছিলেন,তার সবটাই উদার হাতে ঢেলে দিয়েছেন বাড়ি তৈরিতে।সুখময়ের পরের দুই ভাই স্বপ্নময় এবং মনোময়ের বেশ বড় ব্যবসা।দুজনেরই অঢেল উপার্জন।স্বপ্নময় প্রোমোটারি করে।তার একটাই সন্তান,শমীক,কলেজের ছাত্র।আর মনোময় বাড়ি তৈরির সরঞ্জামের ব্যবসায়ী।তারও একটাই সন্তান,সুস্মিতা।সেও কলেজে পড়ে।বোঝাই যায়,ব্যবসায়িক দিক থেকে স্বপ্নময় ও মনোময়ের মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং দু’জনেই টাকার কুমির।কিন্তু আর্থিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে দূর্বল সুখময়কে ছোট দুই ভাই বাড়িসুদ্ধ সকলের অভিভাবক বলে মান্য করে এবং সুখময়ের অনুমতি ব্যতিরেকে কিংবা তাঁর অমতে এ বাড়িতে একটি গাছের পাতাকেও নড়ানো হয়না।পারিবারিক শৃঙ্খলার দেশের এই প্রাচীন ধারাটি এ বাড়িতে আজও বজায় রয়েছে।বাড়ির সব ছেলে-মেয়েরাও সুখময়ের অনুমতি ছাড়া কোনও কাজ করতে সাহস পায় না।সুখময় হলেন এ বাড়ির সকলের মাথার ওপর বটগাছের মতন।বলা চলে দন্ডমুন্ডের কর্তা।
পূর্বে এ বাড়িতে অনেকগুলি ঘর ছিল।সিমেন্টের দেওয়াল,টিনের ছাদ।ফুল-ফলের বাগান সমেত প্রায় দু’বিঘে জমি নিয়ে ছিল বাড়ি।চার দিকে ইটের পাঁচিল।সেটা ছিল সুখময়দের পৈতৃক বাড়ি।সুখময়ের বাবা তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ থেকে এসে এই জমিটিতে বসত গড়েছিলেন।জমিটি কেনবার কোনও প্রশ্ন ছিলনা। কারণ, জমিটি ছিল হাটের জমি,কারো নামে রেজিস্টার্ড নয়।কেবলমাত্র পঞ্চায়েত ট্যাক্স দিতে হতো প্রতি বছর।প্রথমে বিরাট জমিখানি পাঁচিল দিয়ে ঘিরে সুখময়ের বাবা এবং দুই কাকা আলাদা ঘর তুলে নিয়েছিলেন।সুখময়ের কাকারা বহু বছর বাস করেন এই বাড়িতে।তারপর পরবর্তীকালে তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বেশ বড় হয়ে যাবার পর তাঁরা বিভিন্ন কারণে এ বাড়ি ছেড়ে দূরবর্তী স্থানে জায়গা কিনে বাড়ি তৈরি করে নিয়েছেন।।পুরোনো বাড়িতে সুখময়দের একেক ভাইয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল দু’খানা করে শোবার ঘর,সঙ্গে দু’টো করে স্নানাগার এবং টয়লেট।সারা বাড়িতে একখানি রান্নাঘর ছিল মস্ত বড়।তার ছিল লম্বা টানা বিরাট বারান্দা।সুখময়দের একমাত্র ছোট বোন তনিমা,বাবার জীবদ্দশাতেই যার অসমে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল,তার জন্যও বরাদ্দ ছিল বাথরুম-টয়লেট সমেত দু’খানা বড় ঘর।মাঝে সাঝে কখনও বাপের বাড়ি বেড়াতে এলে সে যাতে স্বামী-সন্তান নিয়ে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে।
বাবার আমলে সুখময়দের ছিল একান্নবর্তী পরিবার।মস্ত বড় রান্নাঘরের বিরাট লম্বা টানা বারান্দায় পিঁড়ি বা আসন পেতে দু’বেলা পঙক্তি ভোজনে বসত বাড়ির প্রায় সবাই।পরিবেশনের দায়িত্ব ছিল মা এবং ছোট বোনের ওপর।বাকি সকলের খাওয়া হয়ে গেলে কাজের লোকেদের খেতে দিয়ে মা আর বোন খেতে বসতেন।অন্যান্য কাজ করবার জন্য জনা দুয়েক ঝি-চাকর থাকলেও দু’বেলার রান্না মা বরাবর নিজের হাতে করতেন। হেঁসেলের ভার তিনি কোনওদিন কারো হাতে দিতে ভরসা করেননি।বাড়িতে নানা পুজো-আচ্চার সময় নিজের হাতে খিচুড়ি-পায়েস রেঁধে সারা পাড়ার লোককে প্রসাদ খাবার নেমন্তন্ন করতেন।একদিকে বেশ সুন্দরী,অন্যদিকে খুবই কর্মঠ ছিলেন সুখময়ের মা।
বাবা মারা যাবার পর একান্নবর্তী পরিবারটি পৃথগন্ন হয়ে গেলেও আজও বাড়ি একটাই রয়ে গিয়েছে,আলাদা হয়নি।এটা ছিল সুখময়ের বাবার শেষ নির্দেশ।ত্যিনি বলে গিয়েছিলেন, বাঙালি পরিবারের এই সনাতন ধারা, এই একান্নবর্তী পরিবারের প্রথা আমি আমার মৃত্যু অবধি যেভাবেই হোক রক্ষা করে যাব।কিন্তু আমি জানি,আমি চলে যাবার পর এই ধারা তোরা রক্ষা করতে পারবিনা।তোদের কাছে আমার একটাই শেষ নির্দেশ বা অনুরোধ,এটা রক্ষা করবার চেষ্টা করিস,হাঁড়ি আলাদা করলেও বাড়িটা ভাগ করে আলাদা করিস না।তাই আজও এ বাড়ি অবিভক্তই রয়ে গিয়েছে।এবং এই ব্যবস্থায় বাড়ির কোনও সদস্যেরই কোনওরকম অসুবিধে নেই।এই ছোট্ট শহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই এই বাড়িটিকে ব্যানার্জী বাড়ি নামে চেনে।
‘প্রশান্তি নিলয়’-এর তিনতলায় পাঁচ খানা শোবার ঘর,প্রতিটি ঘরের সংলগ্ন বাথরুম-টয়লেট।তিনখানা ঘর সুখময়ের পরিবারের দখলে,দু’খানা স্বপ্নময়ের।দু’দিকে দু’খানা ঝুলবারান্দা।দোতলায় মোট চারখানা একই ধরনের বড় শোবার ঘর,দু’খানা মনোময়ের ,আর বাকি দু’খানা অধিকাংশ সময় খালিই পড়ে থাকে,তনিমারা এলে সেগুলো ব্যবহৃত হয়। দোতলাতেও দুখানা বারান্দা।আর একতলার পুরোটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে তিনজন দোকানদারকে।তিনটি দোকানের ভাড়ার পরিমাণ একই,তিন ভাই সেটা ভাগ করে নেয়।
খবরের কাগজ পড়া শেষ হয়ে গিয়েছে সুখময়ের,দ্বিতীয় চায়ের কাপও শেষ হয়ে গিয়েছিল।উঠব উঠব করছিলেন তিনি,এমন সময় সুরঙ্গমা এসে বললেন,দাদা এসেছে।বসতে বলব?
সুখময় একটু নির্লিপ্তভাবে বললেন,কেন,এখানেই পাঠিয়ে দাও।আঙুল তুলে কয়েক হাত দূরে রাখা একটি কাঠের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ওটা একটু এখানে টেনে দাও,আর রঘুকে বলো দু’কাপ চা পাঠিয়ে দিতে।
সুরঙ্গমা বললেন,রঘুকে একটু বাজারে পাঠিয়েছি,চা আমি নিয়ে আসছি—–।
ভেতরে যাবার আগে চেয়ারখানা টেনে সুখময়ের পাশে রেখে দিয়ে গেলেন সুরঙ্গমা।একটু বাদে সুখময়ের কাছাকাছি বয়েসের এক ভদ্রলোক এসে পাশের চেয়ারটায় বসে খুব মৃদু গলায় সুখময়কে জিজ্ঞেস করলেন,কী খবর বল।
সুখময় খুব ভালো করেই জানেন,কী খবর জানতে চাইছেন ভদ্রলোক।তিনি একটু উদাস নিচু গলায় বললেন,বাইরে থেকে যতটুকু বোঝা যায়,খবর তো একইরকম মনে হচ্ছে—–খিটখিটে মেজাজ হয়ে গেছে—–ভালো করে কারোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না—–ভালো করে খেতে চাইছে না—-।
ভদ্রলোক একই রকম গলায় বললেন, দাড়া,আমি দেখছি।
ভদ্রলোক আস্তে করে উঠে ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।ভদ্রলোকের নাম শশধর সেনগুপ্ত,ইনি সুরঙ্গমার একমাত্র দাদা,এ ছাড়াও তাঁর আরেকটি পরিচয় আছে, তিনি সুখময়ের স্কুলজীবন থেকে বন্ধু। সুতরাং এ বাড়িতে স্বভাবতই তাঁর জন্য অবারিত দ্বার।শশধর ভেতরে উজ্জয়িনীর ঘরের সামনে গিয়ে নির্দ্বিধায় পরদা সরিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন,উজ্জয়িনী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বই পড়ছে।তিনি একটু গলা তুলে আলতো করে জিজ্ঞেস করলেন, কীরে মা,কেমন আছিস?
উজ্জয়িনী শুয়ে শুয়েই মুখ ফিরিয়ে বলল,ভালো আছি কাকু,আপনি ভালো তো?বলেই উঠে বসে আবার বলল,আসুন না কাকু,বসুন এখানে–বলে বালিশের পাশটা হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল।শশধর আসলে উজ্জয়িনীর একমাত্র মামা।কিন্তু বড় হয়ে সে কোনও দিন তাঁকে মামা বলে ডাকে নি,এ সম্পর্কটা হয়তো সে অস্বীকার করতে চায়,সে শশধরকে বাবার বন্ধু হিসেবে কাকু বলে ডাকে।এ ব্যাপারে কেউ কখনও কোনওরকম আপত্তি করে নি।শুধু একদিন সুরঙ্গমা শশধরকে কাকু বলে ডাকবার কারণ জিজ্ঞেস করায় উজ্জয়িনী উত্তর দিয়েছিল, ওঁকে কাকু বলে ডাকতেই আমার ভালো লাগে।
শশধর বললেন, নারে মা,এখন বসব না।তুই কেমন আছিস,একটু দেখতে এলাম।অনেক দিন তোর সঙ্গে তো কোনও কথা হয় না!তুই পড়াশুনো কর,আমি তোর বাবার সঙ্গে একটু কথা বলেই চলে যাব।বাড়িতে কাজ আছে—।
আবার সুখময়ের পাশের চেয়ারে ফিরে এলেন শশধর।সুখময় এখনও বসে রয়েছেন আরামকেদারায়।।দৃষ্টি সামনের বাগানের দিকে।কিন্তু তাঁকে দেখলেই বোঝা যায়, তিনি বাগান দেখছেন না।শূন্য দৃষ্টিতে উদাসভাবে অনেক দূরের দিকে চেয়ে রয়েছেন।
সুখময়ের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তাঁর মনোভাব স্পষ্ট বুঝতে পেরেই যেন শশধর ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে বললেন,দ্যাখ সুখু,শুধু শুধু চিন্তা করে শরীর খারাপ করে ক্ষতি ছাড়া কোনও লাভ নেই।ওরা দু’জনেই এখন পূর্ণ যুবক-যুবতী,ওদের বাধা দেবার ক্ষমতা আমাদের নেই।জোর করে এসব ব্যাপারে কিছু করা যায় না।চুপচাপ দেখে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই—-।সুখময় স্বগতোক্তির মতন উদাসভাবে বললেন,সে তো বটেই।
ব্যাপারটা হয়েছে কী,শশধরের ছেলে সৌরভ আর উজ্জয়িনীর মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে যা সামাজিকভাবে বৈধ নয়,কারণ ওদের মধ্যে মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোনের সম্পর্ক রয়েছে।সুখময় বা শশধর কারো পক্ষেই এ সম্পর্ক মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।এদিকে সৌরভ এবং উজ্জয়িনী দু’জনেই নিজ নিজ বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছে যে,তারা একে অপরকে ছাড়া জীবন কাটাতে পারবে না।তাদের দু’জনের বিয়ে না দেওয়া হলেও তারা দু’জনে একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতন সারা জীবন কাটাবে।অন্যান্য দেশে তো বটেই,এমনকি আমাদের দেশের বড় বড় শহরেও আজকাল এমন ঘটনা আকছার ঘটছে।
তুতো ভাই-বোন হওয়ার সুবাদে উজ্জয়িনী এবং সৌরভের অবাধ মেলামেশায় দুই পরিবারের কেউ কোনওদিন কোনওরকম অন্যায় বা দোষ দেখতে পায় নি।যখন তখন দু’জনে একে অপরের বাড়ি গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে আসে।মামার বাড়ি কিংবা পিসির বাড়িতে যখন তখন যাওয়ার মধ্যে কোনও দোষ নেই।তাছাড়া দিনকাল অনেক বদলে গিয়েছে।আপন ভাই-বোনেরাও আজকাল এমনভাবে মেলামেশা করে,দেখে অনেক সময় মনে হয় যেন দুই বন্ধু।আর এরা তো মামাতো-পিসতুতো ভাই-বোন।আগেকার দিনে আপন ভাই-বোনের মধ্যে
আজকালকার মতন এরকম খোলামেলা সম্পর্ক দেখা যেত না।বিশেষত, আপন দাদা এবং ছোটবোনের মধ্যে সর্বদা একটা দূরত্ব বজায় থাকত,যে দূরত্বের সেতু আপনা আপনি তৈরি হয়ে যেত কিছুটা সমীহ,কিছুটা ভয়,কিছুটা সংকোচের মিশ্রণে।
প্রথম সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল একদিন একটা দৃশ্য সুরঙ্গমার চোখে পড়ে যাবার পর।সেদিন সকালবেলা সৌরভ তাঁদের বাড়িতে এসেছিল। তাঁদের বাড়িতে এলে সৌরভ অধিকাংশ সময় উজ্জয়িনীর ঘরেই কাটাত।পূর্ণবয়স্ক আধুনিক মনস্ক একটি যুবক পিসিমা-পিসেমশাইয়ের সঙ্গে কত গল্প করতে পারে!সেদিনও অনেকক্ষণ ধরে উজ্জয়িনীর সঙ্গে তার ঘরে ছিল সৌরভ।একসময় সুরঙ্গমা উজ্জয়িনীকে কী একটা কথা বলতে গিয়ে তার ঘরের পরদা সরাতেই দেখতে পান,সৌরভ উজ্জয়িনীর কোলে মাথা দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে,আর উজ্জয়িনী সৌরভের মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।অন্তরঙ্গ এই দৃশ্যখানি চোখে পড়তেই সুরঙ্গমা লজ্জিতভাবে সঙ্গে সঙ্গে পরদা ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে তাড়াতাড়ি সরে এসেছিলেন।তিনি লক্ষ্য করেছিলেন,দৃশ্যটা তাঁর চোখে পড়তেই সৌরভ সঙ্গে সঙ্গে ঝট করে অপ্রস্তুতভাবে উজ্জয়িনীর কোল থেকে মাথা তুলে নিয়ে উঠে বসেছিল।এরপর দৃশ্যটা বেশ কিছুটা সময় ধরে গভীরভাবে ভাবিয়েছিল সুরঙ্গমাকে। কিছুতেই তিনি দৃশ্যটা ভুলতে পারছিলেন না।নিজের মনকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন,এমন তো হতেই পারে,দুই ভাই-বোনের মধ্যে এরকম ঘনিষ্ঠতা অস্বাভাবিক নয়।আবার পরক্ষণেই ভেবেছিলেন,ব্যাপারটা যদি অস্বাভাবিক নাই হয়,তাহলে সৌরভ তাঁকে দেখেই অমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসল কেন।সে তো ওভাবেই উজ্জয়িনীর কোলে শুয়ে থাকতে পারত।
সন্দেহ এমন একটা ব্যাপার,যা কোনও কারণে একবার মনের মধ্যে দানা বাঁধলেই ধীরে ধীরে মাকড়সার মতন সেটা জাল বিস্তার করতে থাকে।এরপর থেকে সৌরভকে একটু অন্যরকম চোখে দেখতে শুরু করলেন সুরঙ্গমা,এবং একদিন কথায় কথায় তিনি সুখময়কে বলেই ফেললেন,মেয়েটা বড় হয়েছে,এখন থেকে ওর জন্য একটা ভালো পাত্রের খোঁজ শুরু করলে হয় না?
সুখময় বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন কথাটা শুনে। তিনি বিস্মিত গলায় বলেছিলেন,আগে ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও সুরো,বিয়ের কথা ভাববার অনেক সময় আছে।আজকালকার দিনে মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয় না।আমাদের যুগ আর নেই—আজকাল মেয়েরা পড়াশুনো করবে যতদূর খুশি,তারপর ইচ্ছে হলে চাকরি করবে,স্বাবলম্বী হবে—তারপর ইচ্ছে হলে বিয়ে করবে……।
সুরঙ্গমা একটু চিন্তিত গলায় বললেন, কিন্তু মেয়ে দেখতে সুন্দরী হয়েছে—-ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে—-দিনকাল ভাল নয়,কাগজে নানারকম খবর বেরোয়—আমার বাপু সবসময় কেমন যেন চিন্তা হয়—।
সুখময় স্ত্রীকে শান্ত করবার জন্য বললেন,অহেতুক দুশ্চিন্তা করে শরীর-মন খারাপ করবার কোনও মানে হয় না সুরো,আমাদের খুকি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং রুচিশীলা মেয়ে।ও যা করবার,ভালো করে ভেবেচিন্তেই করবে–।.
—– ক্রমশ———