( ২ )
শশধর সেনগুপ্তকে এই শহরের একজন বিজনেস ম্যাগনেট বলা যায়।হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করবার পর বেশ কয়েক বছর ঘোরাঘুরি,চেষ্টা-চরিত্র করেও কোনও চাকরি-বাকরি জোটাতে না পেরে দিনের পর দিন দাদার সংসারে বৌদির ট্যারা-বেঁকা কথা সইতে সইতে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়ে অবশেষে শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট দেখিয়ে ব্যাংক থেকে পঁচিশ হাজার টাকার লোন তুলে একখানি টি ভি-রেডিও সারাই এবং বিক্রির দোকান খুলেছিলেন তিনি।তার আগে রেডিও-টিভি সারাইয়ের এক বছরের ট্রেইনিং কোর্স শেষ করেছিলেন।
সেই ‘মডার্ন ইলেকট্রনিক্স’ ধীরে ধীরে কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে আজ বিশাল আকার নিয়েছে।টি ভি,ফ্রিজ,ওয়াশিং মেশিন,ওয়াটার ফিল্টার,এয়ার কুলার,এ সি,স্টিল ফার্নিচার,প্লাস্টিকের ফার্নিচার,কী পাওয়া যায় না সেখানে! আজ এই দোকানের বার্ষিক টার্ন ওভার প্রায় দু’কোটি টাকা।বর্তমানে শহরের প্রথম তিনজন ধনকুবেরের মধ্যে তিনি অন্যতম।
এক ছেলে এবং এক মেয়ে শশধরের।মেয়ে শর্মিষ্ঠা কলেজ থেকে বেরোবার বছরেই এক সুদর্শন মুসলিম প্রফেসরকে বিয়ে করে এখন সুখে ঘরকন্না করছে।ছেলে সৌরভ শিলিগুড়ির এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি টেক সম্পূর্ণ করে বছর দুয়েক বেকার বসে থাকবার পর একটি ইন্টারন্যাশনাল কন্সট্রাকশন কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছে সম্প্রতি।চেন্নাইয়ে পোস্টিং,আগামী মাসে জয়েন করবে।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার যেদিন হাতে পায় সৌরভ,সারা বাড়িতে সেদিন স্বভাবতই একটা হালকা ফুরফুরে আনন্দের বাতাস বইছিল।রাত্তিরবেলা খাবার টেবিলে বাড়ির সকলের উপস্থিতিতে সৌরভের মা বনানী ছেলেকে হালকা গলায় বলেছিলেন,যাক,আর তো কোনও বাধা রইল না!যেটার জন্য এতদিন অপেক্ষা করছিলি,সেটা এবার হয়ে গেল।তারপরই তিনি শশধরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন,এবার তাহলে তোমার সেই বন্ধু,বিনায়ক না কী যেন নাম,তাঁকে খবর দাও,তিনি অপেক্ষা করে থাকবেন বলেছিলেন,আর তাঁর মেয়েটিও নাকি সব দিক থেকে খুব ভালো—
বনানীর কথা শেষ হবার আগেই সৌরভ বলে উঠেছিল,এখন কারোকে কোনও খবর দেবার দরকার নেই,মা।আর তা ছাড়া এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে—।
তারপর শোবার আগে মাকে খোলাখুলি জানিয়ে দিয়েছিল সৌরভ যে, উজ্জয়িনী ছাড়া তার পক্ষে অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।আর যেহেতু উজ্জয়িনীর সঙ্গে তার বিয়ে সামাজিকভাবে সম্ভব নয়,তাই এ জীবনে তার বিয়ে করা হবে না।এ ব্যাপারে এটাই তার শেষ কথা।
বনানী তাকে অনেকভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু সৌরভ কোনও কথাই শুনতে চায়নি।বার বার সে একই কথা বলে চলেছিল,আমি তো বলেই দিয়েছি মা,এ ব্যাপারে এটাই আমার শেষ কথা।কোনও অবস্থাতেই আমার এ সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হবে না—।
বনানীর মুখ দিয়ে স্বগতোক্তির মতন বেরিয়ে এসেছিল,কিন্তু এটা কী করে সম্ভব!
দেরি না করে পরদিনই সকালবেলা বনানী সুরঙ্গমাকে ফোনে সব খুলে বলেছিলেন।তারপর কথাটা সুখময়ের কানে তোলবার আগে সুরঙ্গমা কিছুক্ষণ বাদেই মেয়েকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,কীরে খুকি,সৌরভ তোকে জড়িয়ে কী সব বলেছে ওর মাকে—তুই কিছু জানিস এ ব্যাপারে?
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে উজ্জয়িনী নিজের ঘরের বিছানায় বসে পড়াশুনো করছিল।পড়ার টেবিল-চেয়ার ঘরে মজুত থাকলেও সে বেশিরভাগ সময় বিছানায় বসেই পড়াশুনো করে। সামনেই তার ফাইনাল পরীক্ষা।কলেজ ছুটি।পড়াশুনোর জন্য স্টাডি লিভ দিয়েছে কুড়ি দিনের।তাই আজকাল সে সারাদিন বাড়ি থেকে বেরোয়না,নিজের ঘরে বসে পড়াশুনো করে। সুরঙ্গমা উজ্জয়িনীর ঘরে ঢুকে তার পড়ার টেবিলের সামনে পাতা কাঠের চেয়ারে বসেছেন।মেয়ের সঙ্গে এখনই তাঁকে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। মায়ের এখন অসময়ে হঠাৎ ওর ঘরে এসে বসা দেখে উজ্জয়িনী একটু অবাক হলেও চোখে-মুখে তার কোনও ভাব প্রকাশ করল না।কিন্তু তারপরই মায়ের মুখে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রশ্নটা শুনে উজ্জয়িনী এক মুহূর্তের জন্য একটু হকচকিয়ে গেল,সুরঙ্গমা সেটা লক্ষ্য করলেন।কিন্তু পরমুহূর্তেই উজ্জয়িনী নিজেকে সম্পূর্ণ সামলে নিয়ে চোখ-মুখ একেবারে স্বাভাবিক করে বলল,কী ব্যাপারে—মানে কী বলেছে—ও,বুঝতে পেরেছি—যাক,ভালোই হয়েছে,শোনো মা—আমি তোমা্য বলব বলব করছিলাম, ও যা বলেছে,ঠিকই বলেছে।আমারও একই কথা,মা—ওকে ছাড়া আর কারোকে বিয়ে করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে—।
সুরঙ্গমার দুই ভুরু উঠে গেল কপালে,এসব তুই কী বলছিস খুকি!এটা কী করে সম্ভব? ওর সঙ্গে তোর কী সম্পর্ক,তুই জানিস না? খুব ছোটবেলা থেকে এক মায়ের পেটের ভাই-বোনের মতন বড় হয়েছিস তোরা!
_________ সত্যি কথা বলতে কী,কী করে যে এসব হয়ে গেল,সেটা আমিও বুঝতে পারিনি মা,ব্যাপারটা যেন আমার হাতেই ছিল না—
_________ তোর কথা তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না,কোনও সভ্য সমাজে এরকম হয় বলে তো শুনিনি—-
_________ হয় মা, হয়।তোমরা জানো না—-ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে,এমনকি আমাদের দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও আকছার হচ্ছে—।
________ দ্যখ,খুকি,এটা ইউরোপ-আমেরিকা নয়,দিল্লি-মুম্বইও নয়—-এটা প্রায় গ্রাম-বাংলার মতনই একটা ছোট্ট শহর,একানকার সমাজ আলাদা।
________ তোমরা আলাদা সমাজ নিয়ে কূপমণ্ডূক হয়েই বসে থাকো মা।দিনকাল অনেক বদলে গেছে,তোমরা তার কোনও খবরই রাখো না।পৃথিবীর সব কিছু দ্রুত পরিবর্তনশীল,আর তোমরা সেই সেকেলে বস্তাপচা ধ্যানধারণা নিয়েই বসে আছো—-।
________ কিন্তু নীতিবোধ,মূল্যবোধ,এসব নিশ্চয় বদলে যায়নি!
__________ কে বলেছে,বদলে যায়নি! এগুলোও সব বদলে যাচ্ছে—যাকগে মা,এ ব্যাপারে আমার আর বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না—তোমরা তোমাদের ধ্যান-ধারণা,নীতিবোধ-মূল্যবোধ এসব নিয়ে থাকো,আমাকে নিজের মতন জীবন কাটাতে দাও।জীবন একটাই হয়,মা।
সুরঙ্গমা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে আশ্চর্য হলেন, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা বলবার সময় মুখের একটা রেখাও কাঁপছে না উজ্জয়িনীর।অথচ তাঁদের আমলে উজ্জয়িনীর বয়েসি কোনও মেয়ের সামনে প্রেম,বিয়ে এসব নিয়ে কথা তুললে সেই মেয়ে চোখ-মুখ লজ্জায় রাঙা করে মাথা নিচু করে ফেলত।আধুনিক,বেপরোয়া,নব্য,পরিবর্তিত সমাজের প্রতিনিধি বোধহয় এই উজ্জয়িনীরাই!
সুরঙ্গমা এবারে মরিয়া হয়ে শেষ চেষ্টা করবার জন্য বললেন,তোর বাবার কথাটাও একবার ভাববি না!এই বয়েসে এত বড় একটা আঘাত যদি সহ্য করতে না পারে—– তার ধারণা, তুই একটা বুদ্ধিমতী,সুশিক্ষিতা,রুচিশীলা মেয়ে—তুই জীবনে এরকম কোনও ভুল কখনও করতে পারিস না।আর তা ছাড়া আত্মীয়স্বজন—বাইরের লোকেই বা কী বলবে—–লোকজনের কাছে আমরা মুখ দেখাবো কী করে!এখনও সময় আছে খুকি,ওসব ভুলে গিয়ে পড়াশুনো করে ভালো রেজাল্ট করবার চেষ্টা কর।নিজের কেরিয়ারটা আগে তৈরি কর,নিজের দাদাকে দেখছিস না!বাড়ি আসা বন্ধ করে দিয়ে হোস্টেলের মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে বলে,নিজের কেরিয়ারই ওর কাছে সবচেয়ে বড়।
উজ্জয়িনী শান্ত এবং সম্পূর্ণ স্বাভাবিক গলায় বলল,সবাই কি আর সমান হয় মা!তোমরা ব্যাপারটাকে বেশি বড় করে দেখছ,আসলে এটা এমন কিছু বড় ঘটনা নয়,খুঁজে দ্যাখো,এরকম ঘটনা তোমাদের আমলেও হয়তো দুই-একটা ঘটেছে,কিন্তু সেটা নিয়ে হয়তো তেমন লোক জানাজানি হয়নি—পরে ধীরে ধীরে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে। একটু থেমে সে আবার যোগ করল,আর এ ব্যাপারটা এখন আমার হাতের বাইরে চলে গেছে,মা।হাজার চেষ্টা করলেও আর আমি এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না। তা ছাড়া,আমাকে নিয়ে এত ভাবছ কেন!আমি তো তোমাদের এই সমাজে থাকছিই না!ও বলেছে,চাকরিতে জয়েন করে ভাড়াঘর ঠিক করে একটু গুছিয়ে নিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে,তারপর তো তোমাদের সঙ্গে আর দেখাই হবে না মা,তাহলে সমাজ,আত্মীয়স্বজন নিয়ে এত ভাবছ কেন?ইন্ডিয়ার বাইরেও ওদের কোম্পানির অফিস আছে,ও বলেছে,বাইরে পোস্টিং নেবার চেষ্টা করবে।একবার ক্যানাডা কিংবা হল্যান্ড উড়ে যেতে পারলে আর তো কোনও কথাই নেই,কোনওদিনই আর তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে না।আস্তে আস্তে আমাকে তোমরা ভুলে যাবারই চেষ্টা করো মা—
সুরঙ্গমার বুকের ভেররটা হু হু করে উঠল।গলাটাও যেন একটু ধরে এল,তুই এত সহজে এসব কথা কী করে বলতে পারছিস,খুকি,আমি তো অবাক হয়ে যাচ্ছি—এত সহজে তুই পৃথিবীর সব কিছু ত্যাগ করতে চাইছিস শুধু একটা ছেলের জন্য!এটাই কি তোদের উন্নত একবিংশ শতাব্দীর নব্য আধুনিকতা!
উজ্জয়িনী এ কথার কোনও উত্তর দিল না,সে মাথা নিচু করে পড়াশুনোয় মন দেবার চেষ্টা করল,আর সুরঙ্গমা বাধ্য হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে উজ্জয়িনীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
এরপর সুরঙ্গমা একটা গভীর দুশ্চিন্তায় পড়লেন,কীভাবে তিনি সুখময়কে ব্যাপারটা খুলে বলবেন।কিন্তু কিছুক্ষণ চিন্তা করবার পর তাঁর মনে হলো,অবিলম্বে তাঁর উচিত,সুখময়কে সব কিছু খুলে বলা।যে ভাবেই হোক।তাতে যাই হোক সুখময়ের প্রতিক্রিয়া।কোনও সন্দেহ নেই,এক বিরাট মানসিক আঘাত পাবেন সুখময়।জ্ঞান হবার পর থেকে উজ্জয়িনী মায়ের চেয়ে বাবারই ন্যাওটা ছিল বেশি।আজও মনের যে কোনও কথা বাবাকেই আগে বলতে অভ্যস্ত উজ্জয়িনী।সুরঙ্গমা স্পষ্ট বুঝতে পারেন,মায়ের চেয়ে বাবাকেই উজ্জয়িনী ভালোবাসে বেশি।খুব ছেলেবেলা থেকেই তার সব আবদার,বায়না বাবার কাছে।এখনও মাঝে মধ্যে সুখময়কে শুনতে হয় স্ত্রীর কাছ থেকে,মেয়েদের অত আশকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলতে হয় না,পরের ঘরে গিয়ে পরে কষ্ট পেতে হবে—-।সুরঙ্গমা জানেন,দু’একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব মেয়েরাই বাবার ভক্ত হয়,বাবাকে বেশি ভালোবাসে।আর ছেলেরা মাকে।বিপরীত লিঙ্গ কিংবা মেরু যেমন পস্পরকে আকর্ষণ করে।আর স্বভাবতই ছেলে শৌভিক হয়েছে মা অন্ত প্রাণ।মনের যত কথা সব তার মায়ের কাছে,ছেলেবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে তার একটা দূরত্ব বজায় রয়েছে।ছেলেবেলা থেকে আজও শৌভিকের টাকা-পয়সা কিংবা অন্য কোনও কিছুর দরকার হলে প্রথমে মাকে জানায়,তারপর মা বাবার কানে সেই বার্তা পৌঁছে দেয়।বরাবর এরকমই চলে আসছে।শৌভিক ইউনিভার্সিটি হোস্টেলে থাকে,টাকা-পয়সা বা অন্য কোনও কিছুর দরকার হলে সে আগে ফোনে মাকে জানায়,তারপর সুরঙ্গমা সুখময়কে জানিয়ে দেন।সুরঙ্গমার মনে হয়,যাদের দু’টি সন্তান, এক ছেলে এবং এক মেয়ে,তাদের ক্ষেত্রেই বোধহয় এমনটা হয়।পুত্র সন্তান মনের দিক থেকে মায়ের কাছাকাছি চলে যায়,আর কন্যা সন্তান হয়ে যায় বাবার সবচেয়ে কাছের মানুষ। এ ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অপত্য স্নেহও বোধহয় দু’টি বিপরীত দিকে বাহিত হয়। ঠিক যেন আকর্ষণ-বিকর্ষণের মতন।আর যাদের একটিই মাত্র সন্তান, ছেলে কিংবা মেয়ে,সেক্ষেত্রেও কন্যাসন্তান পিতার প্রতি আকৃষ্ট হয় বেশি,তেমনই পুত্রসন্তান মায়ের প্রতি,কিন্তু এক্ষেত্রে পিতা-মাতার অপত্যস্নেহ একমাত্র সন্তানের ওপরই সমানভাবে বর্ষিত হয় এবং অন্ধের যষ্টির মতন পিতা-মাতা দু’জনেই একমাত্র সন্তানকে সারা জীবন আঁকড়ে ধরে থাকে।কিন্তু যাদের দুই ছেলে কিংবা দুই মেয়ে,তাদের ক্ষেত্রে বোধহয় কোনও বাঁধা ধরা রীতি নেই।তবে এ ক্ষেত্রেও বোধহয় পিতা-মাতার সন্তানের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা দুই সন্তানের প্রতি সমান হয় না।পক্ষপাতিত্ব থেকেই যায়।
পড়ন্ত বিকেল।সূর্যদেব অস্তাচলগামী।আকাশ লাল রঙের আবিরে রাঙিয়ে আছে।সুখময় ঝুলবারান্দার সেই আরাম কেদারাটিতে বসে রয়েছেন। একটা ফিনফিনে শরীর-মন জুড়োনো হাওয়া দিচ্ছে।রোজ বিকেলবেলাতেও সকালবেলার মতনই পর পর দু’কাপ চা খাওয়া অভ্যেস তাঁর।আজ বিকেলের প্রথম কাপ শেষ হয়ে গিয়েছে।দ্বিতীয় কাপ হাতে একসময় সুরঙ্গমা এসে তাঁর পাশের চেয়ারটিতে বসলেন।তারপর দুই-এক মুহূর্ত বাদে, খুব স্বাভাবিক,শান্ত ভাবে,যেন তেমন কিছুই ঘটেনি এমন নিরুদ্বিগ্ন নিম্নস্বরে বললেন,একটা জরুরি কথা ছিল তোমার সঙ্গে,তবে মাঝখানে কোনও কথা বললে চলবে না,চুপচাপ সব শুনে যাবে,তারপর যা বলবার বলবে।সুখময় ঈষৎ বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন স্ত্রীর দিকে।
সুরঙ্গমা স্বাভাবিক,ঠান্ডা গলায় সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে উজ্জয়িনীর সমস্ত ঘটনা থেমে থেমে বলতে শুরু করলেন সুখময়ের দু’চোখে নিজের দু’চোখ রেখে।সুরঙ্গমার শর্ত অনুসারে সুখময় কথার মাঝপথে কোনও মন্তব্য করবার চেষ্টা করলেন না।শান্তভাবে মন দিয়ে সমস্তটা শুনে গেলেন। তবে তাঁর ঘন ঘন কপালে ভাঁজ পড়া সুরঙ্গমার নজর এড়াচ্ছিল না।
পুরোটা বলা শেষ হয়ে গেলে সুরঙ্গমা সুখময়ের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে কয়েক পলক সামনের বাগানের দিকে চেয়ে রইলেন।তারপর আবার সুখময়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,এবার বলো,আমরা কী করতে পারি এ ব্যাপারে।
সুখময় যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন,সুরঙ্গমার প্রশ্নের উত্তরে অন্যমনস্কতার ঘোর কাটিয়ে উঠে বললেন,আমার মাথায় এই মুহূর্তে কিছুই আসছে না সুরো,আমায় একটু ভাবতে দাও।এতদিন আমি অন্যদের সব জটিল সমস্যা কাটাতে তাদের সান্ত্বনা কিংবা পরামর্শ দিয়ে এসেছি।কিন্তু আজ আমাদের এই সমস্যায় আমার মাথায় কোনও বুদ্ধিই আসছে না—-।
কয়েক মুহূর্ত থেমে রইলেন সুখময়,আবার যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। তারপর বললেন,তবে একটা ব্যাপারে আমি বোধহয় নিশ্চিত সুরো— তিনি এক মুহূর্ত থামতেই সুরঙ্গমা অনেকটা চাতক পাখির মতন দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে।
এরপর বাক্যটি শেষ করলেন সুখময়, আমাদের বোধহয় এ ব্যাপারে আর কিছুই করবার নেই।সুরঙ্গমা অসহায় ফ্যালফেলে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সুখময়ের দিকে।
সুরঙ্গমা চলে গিয়েছেন ভেতরে বেশ কিছুক্ষণ হলো।সুখময় এখনও বসে রয়েছেন আরাম কেদারায়।সন্ধে গড়াচ্ছে রাত্রের দিকে।খুব সম্ভবত শুক্লপক্ষ।বেশ ফটফটে জ্যোৎস্না উঠেছে।সামনের বাগানটিকে এই সোনালি জ্যোৎস্নায় যেন একটি স্বর্গীয় উদ্যানের মতন দেখাচ্ছে।ফিনফিনে হাওয়াটা বেশ জোরালো হয়েছে এখন।কিন্তু চোখের সামনের এই সুন্দর চাঁদের আলোয় ধোওয়া বাগান,শিরশিরে শরীর-মন জুড়োনো বাতাস সুখময়ের মনকে এই মুহূর্তে শান্ত করতে পারছে না।সুরঙ্গমা ভেতরে চলে যাবার পর থেকে তাঁর মনের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে চলেছে।মন শান্তও হচ্ছে না,আবার তিনি মন অন্য দিকে ফেরাতেও পারছেন না।
খুব ছেলেবেলা থেকেই উজ্জয়িনী তার মনের কথা সব বাবাকেই খুলে বলে।তার যত আবদার,বায়না,ঝুলোঝুলি সব বাবার কাছে।পড়াশুনোর ব্যাপারেও কোন কলেজে ভরতি হবে,কী কী সাবজেক্ট নেবে, সব আলোচনা-পরামর্শ তার বাবার সঙ্গে।আজও কলেজে কিংবা অন্য কোথাও জমা দেবার জন্য ইংরিজিতে কোনও দরখাস্ত লিখতে হলে সে প্রথমে নিজে লিখে তারপর সুখময়কে দেখিয়ে,দরকার হলে সংশোধন করিয়ে নেয়।আর আজ হঠাৎ করে সে এত বড় হয়ে গেল যে,জীবনের এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নেবার আগে সে বাবাকে একবার জানালো না পর্যন্ত!শুধুমাত্র একটা ছেলের জন্য সারা জীবনের রক্তের সম্পর্ক,স্নেহ-ভালোবাসা,পিতৃ-মাতৃ স্নেহ সব মিথ্যে হয়ে গেল ওর কাছে!ছেলেবেলায় যে মেয়ে সুখময় দু’বেলা খাইয়ে না দিলে খেত না,কোথাও বেড়াতে যাবার সময় সুখময় ছাড়া অন্য কারো কোলে উঠতে চাইত না,যার রাজ্যের বায়না,আবদার ছিল কেবল সুখময়ের কাছে,সেই মেয়ে কী করে এত সহজে একটি ছেলের জন্য চিরদিনের মতন সুখময়কে ত্যাগ করে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল!সন্তান এত নির্দয়,নির্মম,নিষ্ঠুর হয় কী করে!
আজ খুব ঘন ঘন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন সুখময়।আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন তিনি।সংবিৎ ফিরে এল তাঁদের সর্বক্ষণের চাকর রঘুর ডাকে,কী হইল দাদাবাবু,রাত যে হইয়ে গেল,এখনও বাইরে বসে আছেন!ভেতরে যাবেননা?
একটু অবাক হয়ে সুখময় জিজ্ঞেস করলেন,রাত হয়ে গেল!ক’টা বাজে এখন বলতো।রঘু দৌড়ে ভেতরে গিয়ে ঘরের দেওয়াল ঘড়ি দেখে এসে বলল,সাড়ে সাতটা বাজে,এখন বই পড়বেন না?রঘু জানে এই সময় রোজ ঘরে বসে বই পড়েন তিনি।কোনও কোনওদিন তার আগে একটু বেরিয়ে হাঁটাহাঁটি করে আসেন।
সুখময় রঘুকে বললেন,রঘু,একটু দোকানে যেতে হবে রে!দিদিমণির কাছ থেকে আমার প্রেসক্রিপশনটা নিয়ে গিয়ে ওষুধের দোকান থেকে গোটা চারেক ঘুমের ওষুধ নিয়ে আসবি।এখনই যা বাবা,নাহলে দোকান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
সুখময়ের শরীরে এমনিতে ব্লাড প্রেশার,সুগার বা অন্য কোনও সমস্যা নেই এখনও।তবে হাইপারটেনশনের জন্য ডাক্তার একটা খুব মৃদু পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ লিখে দিয়ে বলেছে্, দরকার হলে খেতে,সুখময়ের মনে হচ্ছে,আজ ওষুধ না খেলে তাঁর ঘুম হবে না।
রঘু খুব সৎ এবং বিশ্বাসী ছেলে।ওকে একদিন রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিলেন সুখময়।প্রাতর্ভ্রমণ বরাবরের অভ্যেস সুখময়ের।পনেরো ষোলো বছর আগেকার কথা।প্রাতর্ভ্রমণ সেরে ফিরছেন সুখময় বড় রাস্তা ধরে,হঠাৎ চোখ পড়ল রাস্তার পাশে। একটি আট-ন’বছরের বাচ্চা ছেলে,ময়লা, ছেঁড়া হাফ প্যান্ট পরা,খালি গা,তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলছে,বাবু,দশ রুপিয়া দেন না!রুটি খাব।কাল রাতে কিছু খাই নাই,দিনমে থোড়া মুড়ি আর পানি পিয়েছি—-।
সুখময়ের খুব মায়া হয়েছিল ছেলেটির ওপর,আর মনে হয়েছিল,ছেলেটি সত্যি কথাই বলছে,না হলে ও বলতে পারত,কাল সারাদিন কিছু খাইনি,বেশির ভাগ ভিখিরিরা এমনই বলে।কাল দিনের বেলা মুড়ি খাবার কথা স্বীকার করছে ছেলেটা।সে সময় শৌভিকের বয়েস নয়-দশ আর উজ্জয়িনীর ছয়-সাত। তাঁদের ঘরে এই বয়েসের ছেলেরা কত আদর-যত্নে থাকে!আর এই ছেলেটি পথে ঘাটে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে।ভাগ্যের কী পরিহাস!
সুখময় ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,দশ রুপিয়া দেনে সে কেয়া হোগা?আজ খায়েগা,লেকিন কাল কেয়া খায়েগা?
ছেলেটি কিছু চিন্তা না করেই বলে উঠেছিল,আজ আপ দেঙ্গে,কাল আউর কোই দেগা।ছেলেটিকে কেন যেন পছন্দ হয়ে গিয়েছিল সুখময়ের,তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, অ্যায়সে কিতনা দিন চলেগা!মেরে ঘর কাম করেগা?খানা,কাপড়া, রুপিয়া সব মিলেগা—মেরা লড়কা জ্যায়সা রহেনা পড়েগা— ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গিয়ে বলেছিল,করেগা,মুঝে রুপিয়া নেহি চাহিয়ে,রোজ খানা-কাপড়া দেনেসে হি চলেগা,মেরা আউর কোই নেহি হ্যায়।আউর আপ মেরে সাথ বাংলা ভি বোল সকতে হ্যায়,ম্যায় কিশানগঞ্জ কা বিহারি।বাংলা মালুম হ্যায়।ছেলেটির কেউ নেই শুনে মায়া আরও বেড়ে গিয়েছিল সুখময়ের।
সেই থেকে এ বাড়িতে সর্বক্ষণের কাজের লোক হিসেবে রয়ে গিয়েছে রঘুরাম যাদব।সুখময় আর সুরঙ্গমার এক মুহূর্তও রঘু ছাড়া চলে না।জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ পর্যন্ত সব রঘু।আরেকজন ঠিকে ঝি আছে বাসনপত্তর মাজা,ঘর মোছার জন্য।
ক্রমশ