সিজানো পরব

সিজানো পরব

কলমে – বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল
ষষ্ঠী কথার কথক – শীতলা দেবী (মা)
গদীবেড়ো, রঘুনাথপুর, পুরুলিয়া

পুরুলিয়া জেলার ঘরে ঘরে আজ সরস্বতী পূজোর পরের দিন হয় সিজানো খাওয়ার বিশেষ অনুষ্ঠান। অন্যান্য জেলাতে হাওড়া, হুগলি, মেদনীপুর, বর্ধমান ” গটা সেদ্ধ ” বলে প্রচলন আছে।পান্তা ভাত /বাশি ভাত বা সিজানো খাওয়ার পর কোন কোন স্থানে একবেলার ছোট্ট মেলাও বসে।

রঘুনাথ পুরে জয়চণ্ডী পাহাড়ের ওপরে ” পাহাড় পরব ” ও শাঁকার ” সুয়াড্ডির হাট ” আমার দেখা।

মূলত ষষ্ঠী দেবীর পূজো করা হয়। সরস্বতী পূজোর দিন যথেষ্ট পরিমানে বিভিন্ন সব্জী তৈরি, ভাজা, চাটনী করে রাখা হয়, যারা মাছ খান তারা মাছ ভাজা করে রাখেন। সব কিছু শুদ্ধাচারে করা হয়। বিভিন্ন কলাই সকালে মাটির খলাতে ভেজে রাখা হয়। সর্বশেষ হয় কলাই সেদ্ধ। তিল – নারকেল নাড়ু, কলাই ভাজাও ষষ্ঠীকে খাওয়ানো ও নিজেদের খাওয়ার জন্য তৈরী হয়। রাত্রি বেলা সমস্ত রান্না সমাপ্ত হলে আগের থেকে পরিস্কার করে রাখা বাটনা বাটির শিল, নোড়া কে ষষ্ঠী রূপে নূতন কাপড়ে ঢেকে রেখে মায়েরা পূজো দেয়। সমস্ত খাবার ঠিক ঠাক করে ঢেকে রাখা হয়।

প্রত্যেকটি পদ ষষ্ঠী মায়ের জন্য আলাদা করে তুলে রাখার নিয়ম। সিজানোর দিন মাকে এগুলো নৈবদ্য রূপে দেখানো হয়। পূজো দেওয়ার পর বাড়ির সকলকে পান্তা /বাশি ভাত বা সিজানো খাওয়ানো হয়। ঐ দিন চুলা বা কোন উনুন জ্বালানোর নিয়ম নেই ” অরন্ধন দিবস ” হিসেবে পালন করা হয়। তবে বর্তমানে গরম চা তৈরি করে খাওয়া হচ্ছে।

খাওয়া দাওয়ার পর বামুন বাড়ির বয়স্কা মহিলা সকল মহিলা দের নিয়ে ষষ্ঠী কথা বা কাহিনী শুনাতে আসেন।( আমাদের গদীবেড়ো গ্রামের নূতন পাড়ার রবি ঠাকুরের মা এই ষষ্ঠী কথা বলতেন, তিনি মারা যাওয়ার পর এখন এই কাজটা বন্ধ হয়ে গিছে। ) দক্ষিণা ও চাল ভজ্জি তার প্রাপ্য হয়। ষষ্ঠী কথা বা গল্প একটাই প্রতিবৎসর মুখে মুখে শোনার চল। কোন পুস্তক বা খাতায় লেখা থাকে না।

আগের থেকে গ্রামের পাশা পাশি বাড়িতে ও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে সিজানো খাওয়ার নিমন্ত্রণ বা ডাক পাঠানো হয়। কারণ অনেকের এই অনুষ্ঠান বাড়িতে করতে নেই। তারা অন্যের বাড়িতে খেতে আসে। ঐ দিন পান্তা ভাতের সাথে গরম জিলিপি খাওয়ার চল আছে।

বাড়ির মায়েরা ব্রতী থাকেন । উপবাস থেকে রীতি গুলো পালন করেন। তাঁরা পরেরদিন টাটকা জলও পান করেন না সেদিন বাশি জল পান করেন। ষষ্ঠী ঠাকুর হিসাবে শিল – নোড়া কে রাত্রে নূতন কাপড়ে ঢেকে দিয়ে পূজো করে রাখা হয়। সকালে জল ও শাল দাঁতন দেওয়া হয় মুখ ধোয়ার জন্য।

বেশ্যাম বা দশটার দিকে কাঁচা চিড়া, আদা, তিল ও নারকেল নাড়ু, ছোলা বা বুট, মটর ভাজা দেওয়া হয়।
দুপুরে সকল খাবার তুলে রেখে সেগুলো খেতে দেওয়ার পর বাড়ির অন্যদের খাওয়ানোর নিয়ম। পূজায় লাগে দুর্বাঘাস, সিঁদুর, চন্দন, ধুপ প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয়।

সেদ্ধ যে কলাই গুলো সাধারণ নয়ের বেশি লাগে অড়হর বা রাহেড় বা টংগর , মুগ, জারা, রমা বা রাজমা , বুট বা ছোলা, মটর, কুথ্থী সাথে থাকে কাঁটা ছোট বেগুন, আলু, শিম, কচু, পুঁই, বোথা, কুল, সজনা ফুল ইত্যাদি সঙ্গে মেশানো হয় গরম মশলা, ঘি,হলুদ, লবন, লঙ্কা, ধন্যা, জিরা বাঁটা মশলা।

সব্জী হয় বাঁধা কপি, ফুলকপি, লাউ, আলু পোস্ত ও অন্যান্য ।

ভাজা হয় শাক, বড়ি, আলু, বেগুন, শিম ও মাছ
বেসন ছাঁকা হয় বেগুনী, আলুর বড়া।

মাটির কলসিতে আগের দিনে বড় পুকুর থেকে জল এনে কাঠের আগুনে সর্বশেষ পদ সিজানো কলাই সেদ্ধ করা হোত অনেক সময় ধরে।

ষষ্ঠী কথা বা কাহিনী
– – – – – – – – – – – – – – – –
পুরাকালে কোন এক নিঃসন্তান রাজা ছিলেন। তাঁদের যথেষ্ট বয়স হলেও কোন সন্তান না হওয়ায় রানী মা ষষ্ঠী দেবীর নিকট মানত করেন, তাঁর বরে যদি ছেলে বা মেয়ে হয় তো তাঁকে মান্য করবেন। তাঁর কৃপায় যদি ছেলে বা মেয়ে হয় তাহলে তার নামও রাখবে ” ষষ্ঠি ” বা ” ষাটু “।

সেই মানত পূরন হয়েছে এক কন্যা সন্তান হল। যার নাম রাখে ষাটু। ষাটু দিনে দিনে বড় হলে তাঁর বিয়ে দেন ধুম ধামের সঙ্গে এক সদাগরের ছেলের সঙ্গে। ষাটু কে সাত মাস অন্তস্বতায় সিতারো, আট মাসে ভাজা ও নবম মাসে নমাসী বা লমাসী প্রথা অনুযায়ী খাওয়োনো হোল। দশ মাসে গর্ভ নিয়ে একদিন ষাটু বাঁশ বাগানের দিকে ঘুরতে যায় ও ওখানে ব্যাথা অনুভব করলে একটা জল ভরা থৈলা প্রস্বব করে ও মনঃদুখে বাড়ি ফিরে আসে। ষাটুর শ্বাশুড়ি মার নজর পড়ে তার গর্ভের দিকে। যাবার সময় বেশ বড় ছিল, ফিরে আসে একদম স্বাভাবিক পেটে এর কারণ কি? উত্তরে ষাটু জানায় বাঁশ বাগানে জলের থৈলার মতো কি একটা বের হয়েছে। ওখানে তা পড়ে আছে।

শ্বাশুড়ি বৌমাকে নিয়ে সেই স্থানে গেলে দেখে শঙ্খচিলে ঠোকর দিয়ে থৈলা ছিঁড়ে দিয়েছে। ঐ থৈলাতে অনেকগুলি ছোট্ট শিশুর মতো কিলবিল করছে। তুলে নিয়ে দেখে মোট ষাটটি বাচ্চা প্রসব হয়েছে। সেগুলি বৌমা ও শ্বাশুড়ি মিলে মানুষ করতে লাগল।বৌমার কথা মতো ষাটটি আঁতুড় ঘরে, নারাত বা লরাত দিনে ষাট জন নাপিত নখ কাটে, ষাট নাপিত বৌ পায়ে আলতা পরায় ।

তার শ্বশুর বৌমার কথা মতো যে ষাটটি আঁতুড় ঘর করে ছিলেন তাতে ষাটটি ছেলের সাথে ষাটটি একই রকম দেখতে বৌমা দেখে হতবাক হয়ে যান। এ থেকে বুঝতে পারেন তাদের বৌমা মনুষ্যরূপে কোন দেবতা নিশ্চিত।

দিনে দিনে ষাটুর ষাটটি ছেলে বড় হয়ে ওঠে। তাদের একটাই দুঃখ ষাটটি ছেলের মতো এক মায়ের একই বয়সের ষাটটি মেয়ে কোথায় পাবে। যার সাথে ষাটটি নাতির বিয়ে দেবেন।

একদিন শ্বাশুড়ি মা পুকুরে চান করাতে যাওয়ার পথে একজন মহিলা ও তার কাজের মেয়ে ষাটটি কন্যা সন্তান নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে দেখতে পান। তখন কাজের মেয়ের কাছে জানেন তাদের ষাটটি মেয়ে হওয়ায় খুব দুঃখ। ষাটটি ছেলে পাচ্ছেন না যে বিয়ে দেবে।

যোগাযোগ করে তাদের ষাট ছেলের বৌমা ঘরে আনেন খুব ধুমধাম করে।

একদিন ষাটুর শ্বাশুড়ি মনে মনে বলে ফেলেন কাল – – – নাতি – নাত বৌ মিলে খুব আনন্দ করে গরম গরম মাগুর মাছের ঝোলের সঙ্গে গরম ভাত খাবে।

তার পরদিন ছিল ষষ্ঠীর দিন তারা জানতো না। সেদিন সকালে দেখে ষাট ঘরে ষাট ছেলের ঘরের দরজা বন্ধ ছিল। হাতি শালে গিয়ে দেখে সব হাতি ও ঘোড়া শালে সব ঘোড়া রহস্যজনক ভাবে মারা গিয়েছে ।

কর্মকার মিস্ত্রি. এনে ষাট ঘরের দরজা খোলানো হয়। দেখে ষাট নাতি ও ষাট নাতির বৌমা মারা গেছে।

কারণ খুঁজে ষাটুর শ্বাশুড়ি বলে – – –
” মা আমি বললাম মনে আর তুমি জানলে বনে। ”

তখন শ্বাশুড়ি মা বনের ভিতর যেতে লাগলো কি উপায়ে নাতি নাতবৌদের বাঁচানো যায়।

বনের পথে যেতে যেতে এক বট গাছের তলায় একটা বুড়ি বসে আছে তাকে সমস্ত বৃত্তান্ত বললে বলে ব্যাঙ্গ করে বললেন – – –

” যা গরম গরম মাগুর মাছের ঝোল রেঁধে আনন্দ করে ভাত খা গা “।

তবে আমি কিছু করতে পারবো না। ইনি ছিলেন আরুণী, দিদির কাছে যা।

আরো কিছু দূর গিয়ে বট তলায় আরেক বুড়িকে বসে দেখে তার পায়ে পড়ে ছেলে বৌ মা দের বাঁচানোর কথায় রেগে গিয়ে সেও বলে – – –

” ষষ্ঠীর দিন গরম ভাতের সঙ্গে গরম গরম মাগুর মাছের ঝোল রেঁধে খা গা “।

আমি কিছু করতে পারব না। বড় দিদির কাছে যা। এ ছিল শীতলা।

তারপর আরো কিছু দূরে গিয়ে এক সারা গা ভর্তি খোস, পাঁচড়া হওয়া বুড়ির দেখা পায়।যার গা রক্ত পুঁজে ভরে রয়েছে। তাকে সব বৃত্তান্ত বলললে বলে – – –
” আর ষষ্ঠীর দিন আলতা পরবি ? গরম ভাত খাবি ? মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে আর আনন্দ করবি ষাট নাতি- নাতবৌদের নিয়ে ” ।

মাগো আমায় ক্ষমা করো।

” আমি বললাম মনে আর তুঁই জানলি বনে ” ।

তুমি যা শাস্তি দেবে তাই মেনে নেব শুধু নাতি নাতবৌদের বাঁচিয়ে দাও। তখন বলল যা কাঁচা হলুদ বেঁটে, দৈ এর সাথে মিশিয়ে নিয়ে আয়। আমার খোস পাঁচড়ায় মাখা। আর জিভ দিয়ে সমস্ত রক্ত, পুঁজ চেটে চেটে তুলে একটা বাটিতে ভরা। সেই দই বাটি নিয়ে গিয়ে মৃত সকলের গায়ে ছিটালে নাতি নাত বৌ সহ সব প্রানী বেঁচে ওঠবে।

আর কোন দিনও মাকুড়ী ষষ্ঠীর দিন ভুলেও গরম রান্না খাবার খাবি না। আগের দিন শ্রী পঞ্চমীর দিন রান্না করা সমস্ত বাশি খাবি। আর আমার মাহাত্ম্য প্রচার করবি। সেই থেকে ঘরে ঘরে আজকের দিনে বাশি খাওয়ার পরব চলে আসছে।

বর্তমান সময়ে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পদ, জল, স্থান কাল ভেদে নিয়ম কানুন ও রেয়াজে নানা পরিবর্তন এসেছে।
ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।

20230127_115503-1.jpg 20230127_110655-0.jpg

বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *