সাহিত্যে‌ রাজনীতি: একটি নিরীক্ষা – সৌম্য ঘোষ

শিল্প-সাহিত্য সৃজন হয় বিশেষ কোন লক্ষ্যে ধাবিত হয়ে। রাজনৈতিক দর্শন সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর উপায়। বিশেষ করে সাহিত্যকর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করে দেখানোর জন্য নানা ধরনের চেষ্টা চলতে থাকে। এই চেষ্টায় কে কতটা সফল হলেন—তারও খতিয়ান তৈরি করা যেতে পারে।

যে কারণে সাহিত্যের সঙ্গে রাজনীতির সম্বন্ধ-বিচার বিরল বিষয় নয়। নানা সময় সাহিত্যে কিংবা রাজনীতিতে এই ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ দেখা গেছে। লেনিন– মাও সেতুঙের মতো রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরাও সাহিত্য বিষয়ে কথা বলেছেন। সমাজের বৈচিত্র্যময় চিত্র সাহিত্যে লীন। এ থেকে উঠে আসা প্রকার-প্রকরণ রাজনীতির জন্য খুবই মূল্যবান। একই সঙ্গে সাহিত্যিককে দেখা যায়, রাজনীতির গতিপ্রবাহ নিয়ে নানা ধরনের চেতনায় মগ্ন।
অস্থির সমকালে বাস করে কবি এক ধ্যানী মহাকালের বাসিন্দা; কবিতাকে আঁড়বাঁশির মতোই বাজিয়ে চলেন তিনি। সেই সুরের মূর্ছনায় মত্ত হয়ে ওঠে পাঠ ও পাঠক।

সাহিত্য ও রাজনীতি দুটোই জীবনের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। রাজনীতি জাতীয় জীবনকে প্রভাবিত করে এবং সে প্রভাব ব্যক্তিজীবনকেও আলোড়িত করে। রাজনীতি কখনো ব্যক্তিজীবনকে সমৃদ্ধ করে, কখনো ব্যক্তিজীবনকে সংকটাপন্নও করে। ব্যক্তিজীবনের সুখ, সমৃদ্ধি ও সংকট পরিহার করে চলতে পারে না সাহিত্যও। তাই সাহিত্য ও রাজনীতি দুটোই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তবে রাজনীতি ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিধিবদ্ধভাবে।

এই বিধি যখন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তখন সাহিত্য ব্যক্তির পক্ষে দাঁড়ায়। ফলে সাহিত্য ও রাজনীতি পরস্পর প্রতিপক্ষও হয়। যুগে যুগে রাজশক্তি নান্দনিক সাহিত্যকে লালন করেছে। সাহিত্যিকের কলম দিয়ে রাজবন্দনার সাহিত্য রচনা করে নিয়েছে বিশেষ কৌশলে। কিন্তু যখনই সাহিত্য রাজশক্তিকে কটাক্ষ করে গণমানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে তখন সাহিত্য রাজরোষে পতিত হয়েছে।


ফরাসি বিপ্লবকালে ফ্রান্সের সাহিত্য রাজশক্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল। কারণ রাজশক্তি তখন ফ্রান্সের জনগণের সকল মানবিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। রাজশক্তি ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ মিলে সাধারণ মানুষের চিন্তার স্বাধীনতাকেও হরণ করেছিল। একই চিত্র ছিল বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায়। রুশবিপ্লবেও তাই সাহিত্য দাঁড়িয়েছিল গণমানুষের পক্ষে। রাজশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর শক্তি তখন শুধু সাহিত্যেরই ছিল। সে সময় থেকেই সাহিত্য বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ হতে থাকে। কবি চেসোয়াভ মিউশ। আজন্ম প্রতিবাদী এই কবি পোল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেননি, কিন্তু নিজেকে পোলিশ কবি বলতেন। কিছু সংখ্যক ফরাসি প্রতীকীবাদী কবিদের মত তিনি ‘বিশুদ্ধ কবিতার রাজ্যে’ পালিয়ে যাননি। প্রথাগত নন্দনবোধ ও শিল্পভাবনার বাইরে তিনি তৈরি করলেন প্রতিবাদী দ্বন্দ্বের স্বর।


প্রতিবাদী কবিতা মানেই তাকে রাজনৈতিক হতে হবে এমন কোনও নির্ধারিত কিছু নেই। প্রতিবাদের উৎস হতে পারে মানুষ। বিশেষ করে নিপীড়িত, প্রতারিত ও শোষিত অবহেলিত যারা। এমনই এক কবি ছিলেন ল্যাংস্টন হিউজ।
রাজতন্ত্র এবং বুর্জোয়া ব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়েছে, রাস্তাঘাটে সোচ্চার মানুষ। তখন কবিতার পুরনো ধ্যানধারণাকে ভেঙে চুরমার করে কবিতায় তিনি আনলেন এক আশ্চর্য প্রতিবাদ —–
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না”

তিনি নবারুণ ভট্টাচার্য।

রাওয়ালপিণ্ডির কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, ফ্রান্সের লুই আরাগঁ, এক নিগ্রো ক্রীতদাসী ফিলিস হুইটলি, তুরস্কের নাজিম হিকমত, বাংলার বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় —- উঠে আসে এমন হাজার হাজার প্রতিবাদী কবিমুখ, যারা কালোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃজন করেছেন রাজনৈতিক দর্শন ও চেতনায়; কিন্তু তাঁদের রচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল নিপীড়িত জনগণ ও মানবিকতা।
মূলত তখন থেকেই সাহিত্যের দুটি ধারা সমৃদ্ধ হতে থাকে। একটি বিশুদ্ধ নান্দনিক ধারা, অন্যটি বিপ্লবী ধারা। বিপ্লবী ধারার সাহিত্য যুগে যুগে রাজনীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু রাজনীতির চরিত্রই হলো কারো মাধ্যমে প্রভাবিত না হওয়া। সকলের ওপর প্রভাব বিস্তার করাই রাজনীতির ধর্ম। সাহিত্যের ধর্মও তাই। ফলে বিপ্লবী সাহিত্য রাজনীতির প্রতিপক্ষ হয়েই টিকে আছে। বিপ্লবী সাহিত্য গণমানুষের পক্ষে— এ কথার সাথে এটাও বলা যায় যে সকল সাহিত্যই মানুষের পক্ষে। এই মানুষ অবশ্যই ব্যক্তিমানুষ। ধর্মনিয়ন্ত্রিত সমাজ কিংবা সমাজ নিয়ন্ত্রিত ধর্ম— যেটাই বলি না কেন, ধর্ম ও সমাজ মিলে চালু করেছিল সতীদাহ প্রথা। সমাজ ও ধর্মের এই প্রথা রাষ্ট্র নীরবে সতীদাহ মেনে নিয়েছিল। কারণ রাষ্ট্র ছিল সমাজ ও ধর্মের পক্ষে।

কিন্তু ভারতপথিক রামমোহন রায় দাঁড়ালেন সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তির পক্ষে। যখন বাল্যবিবাহের পক্ষে ও বিধবাবিবাহের বিপক্ষে দাঁড়ালো ধর্ম ও সমাজ তখন বিদ্যাসাগর দাঁড়ালেন বাল্যবিবাহের বিপক্ষে ও বিধবাবিবাহের পক্ষে। ব্যক্তির এই বেঁচে থাকা ও সম্মানজনক জীবনের অধিকার শেষে রাষ্ট্রও মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
রাজনীতি সব সময়ই ব্যক্তিস্বাধীনতার বিপক্ষে। যদিও কৌশলগতভাবে রাজনীতি সব সময়ই ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা বলে! হালে রাজনীতি হয়েছে কৌশল ক্রিয়ার সমার্থক শব্দ। সাহিত্য কোন কৌশল নয়, সাহিত্য সরাসরি জীবনের সাথে সম্পর্কিত। সাহিত্যচর্চা মানে জীবনচর্চা। জীবনের সকল দিক প্রতিফলিত হয়ে থাকে সাহিত্যে।

মানুষের স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত বলে স্বাধীনতা ও অধিকারের কথা বলতে গেলে একজন সাহিত্যিককে রাজনীতির ভাষা ব্যবহার করতে হয়। তখনই সাহিত্যে রাজনীতির কথা ওঠে আসে। রাজনীতিও তখন সাহিত্যকে দমিয়ে রাখতে চায়। নিষিদ্ধ করে সাহিত্য ও দণ্ড বিধান করে সাহিত্যিকের। শাসক শ্রেণি স্বাধীনতা ভোগ করলেও তারা শাসিত শ্রেণির স্বাধীনতা মানতে চান না। জনগণের স্বাধীনতাকে শাসক শ্রেণি স্বেচ্ছাচারিতা হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। শাসক শ্রেণির জন্য দরকার জনগণের অধীনতা। জনগণ অধীন হলেই শাসকের মহিমা অক্ষুণ্ণ থাকে।

ক্ষমতার রাজনীতি মানুষকে অধীন করতে চাইলেও সাহিত্য অন্যসুরে গর্জে ওঠে : ‘’স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়/ দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে কে পরিবে পায়” [রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’]। বাংলা সাহিত্যে এই রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মীর মোশাররফ হোসেন প্রমুখ সাহিত্য প্রতিভা সাহিত্যকে রাজনীতির সমান্তরালে চালিত করেন। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্কের একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন। সাহিত্য ও রাজনীতি- দুটোকেই রবীন্দ্রনাথ আত্মজাগরণের উপায় বলে মনে করেছেন।

বঙ্গভঙ্গপর্বে রচিত রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতায় দেশাত্মবোধের পাশাপাশি আত্মজাগরণের চেতনাও প্রতিফলিত হয়েছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ‘নাইট’ উপাধি বর্জন এবং ব্রিটিশরাজের বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত বিপ্লবী কবি নজরুল ইসলামকে অনশন ভঙ্গের আহবান ও কারাবন্দী অবস্থায়ই কবি নজরুলকে ‘বসন্ত নাটক’ উৎসর্গ করার বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ রাজনীতির নমুনা বলা চলে। ব্রিটিশবিরোধী রাজনীতি ছিল নজরুল সাহিত্যের মৌলিক চেতনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নজরুল যখন নিয়মিতভাবে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন তখন বিশ্বের ৭০ ভাগ রাষ্ট্র ছিল উপনিবেশ এবং ৭২ ভাগ মানুষ ছিল পরাধীন। ভারতবর্ষও ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ এবং ভারতবাসী ছিল পরাধীন।

নজরুল সাহিত্য তখন পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং স্বাধীনতা ও সাম্যের কথা বলে। ব্রিটিশ রাজনীতিতে ভারতবাসী ছিল পরাধীন ও বৈষম্যের শিকার। এই রাজনীতির বিরুদ্ধে তৎকালে সাহিত্য হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের হাতিয়ার। সকল সর্বভারতীয় নেতা যখন ব্রিটিশ সরকারের নিকট থেকে সীমিত আকারে স্বায়ত্বশাসন কিংবা স্বরাজের দাবি আদায় করা নিয়ে ব্যস্ত তখন একা নজরুল ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লিখলেন “স্বরাজ টরাজ বুঝি না…। ধূমকেতু সর্বপ্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।’’ এটা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় রাজনীতি। সাহিত্য রাজনীতির জ্বালানি সরবরাহ করেছে যুগে যুগে।

তাই রাজনীতিকে সাহিত্যের কাছে যেতে হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠ নন্দিত সাহিত্য, আনন্দমঠকে নন্দিত রাজনীতির গ্রন্থও বলা যাবে। বলতে হবে। একই বিবেচনায় রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে, চার অধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী, শরৎচন্দ্রের পথের দাবী নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা রাজনীতির জ্বালানি সরবরাহকারী সাহিত্য। মানবিক রাজনৈতিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করা সাহিত্যের একটি কাজ। তবে এটি খুব বেশি বড় কাজ নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের মূল দর্শনকে যুগে যুগে মানুষের চেতনায় বহমান রাখাই সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কাজ।

ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটেছে প্রায় সাড়ে সাত দশক আগে, কিন্তু আজও ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী সাহিত্য, ভাষা আন্দোলনের চেতনাবাহী সাহিত্য, গণঅভ্যুত্থানের সাহিত্য, চেতনাবাহী সাহিত্য ও গণআন্দোলনকেন্দ্রিক সাহিত্য মানুষের চেতনায় বহমান। বহমান থাকবে যুগে যুগে। সাহিত্যের সাথে রাজনীতির এই মেলবন্ধন চিরন্তন।


সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতি যখন সমাজের সর্বস্তরে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে তখন এই রাজনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছে সাহিত্য। অপরাজনীতি বা অযাচিত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যখন ব্যক্তির যাপিত জীবনকেও দুর্বিষহ করে তোলে তখন সাহিত্যকে স্বাভাবিকভাবেই দাঁড়াতে হয় ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে। রাজনীতি মূলত আপোষমুখি। বিশেষ স্বার্থে রাজনীতি কখনো কখনো আপোষহীন রূপ ধারণ করে। কিন্তু সাহিত্য পুরোপুরি আপোষহীন। একমাত্র সাহিত্য ও সংস্কৃতিই সঠিক সময়ে দাঁড়িয়ে যায় সকল অন্যায়-অনিয়ম আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে।

মানভূমির ভাষা আন্দোলন, বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন — এক একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও তা শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে সংঘটিত রাজনৈতিক আন্দোলনকেও প্রভাবিত করেছিলো। আর এই প্রভাব সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন সাহিত্য। যেভাবে ভাষা-সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে শাণিত করা হয়েছে সাহিত্যে তাতে তৎকালীন রাজনীতিই প্রতিফলিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় নির্মিত সাহিত্য যে বৈষম্যমূলক রাজনীতির মুখোশ উন্মোচন করে তা সাহিত্য ও রাজনীতির এই সহাবস্থান এবং সমান্তরাল পথচলার অন্তহীন পথ।


সাহিত্যের সাথে রাজনীতির এই সম্পর্ককে কেউ কেউ নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চান। কখনো কখনো নেতিবাচক হয়ও বটে। সাহিত্যের সৌন্দর্য তখনই নষ্ট হয় যখন রাজনীতি সাহিত্যকে গ্রাস করে। নির্বিচারে সাহিত্য যখন রাজনীতির ক্রীড়ানক হয়ে ওঠে এবং রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে নিজের স্বকীয়তা নষ্ট করে তখন শুধু সাহিত্যের সৌন্দর্য নয়, সাহিত্যের মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয়। রাজনীতি প্রভাবিত সাহিত্য তার সঠিক গতিপথ হারায়। সাহিত্যিকের নিরপেক্ষ ব্যক্তিচিন্তার প্রতিফলন ঘটলেই সাহিত্য স্বরূপে প্রকাশ পায়। সাহিত্যে যেকোন রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রকাশ ঘটতে পারে।

রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা সাহিত্যকে বিভিন্নমুখী করতে পারে। তবে মতাদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সাহিত্যকে সতত যে মূল উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত থাকতে হয় তা হলো মানবকল্যাণ। মানবকল্যাণের আবার দুটি দিক আছে। একটি হলো বস্তুগত মানবকল্যাণ; অন্যটি হলো মনোজাগতিক মানবকল্যাণ। বস্তুগত কল্যাণ বা উন্নয়ন রাজনীতির মূললক্ষ্য।

অন্যদিকে মনোজাগতিক কল্যাণ বা উন্নয়ন সাহিত্যের মূললক্ষ্য। এই দিক বিবেচনায় সাহিত্য ও রাজনীতির ক্ষেত্র ভিন্ন। মানুষের যাপিত জীবনে জাগতিক ও মনোজাগতিক উভয় ক্ষেত্রেই উৎকর্ষ সাধিত হওয়া প্রয়োজন। অপরাজনীতি যখন গণমানুষের অধিকার হরন করে তখন সাহিত্য গণমানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করার শিক্ষা দেয়। অবশ্য সাহিত্য অনেক সময় এ শিক্ষা দিতে ব্যর্থও হয়। তখন সাহিত্যের ওপর আস্থা হারায় মানুষ। মানুষের প্রতি সাহিত্যের দায় অনেক। বর্তমান সাহিত্যের একটি বড় অংশ সেই দায় মাথায় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফলে নান্দনিকতার চর্চা কখনো কখনো গৌণ হতে দেখা যাচ্ছে। তাই সাহিত্যে এখন নদীর সৌন্দর্যের বদলে নদী দূষণের চিত্র ফুটে ওঠে।

পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রকৃতির অনাবিল রূপের বদলে পরিবেশ দূষণের চিত্র ফুটে ওঠে। ফুল-পাখি-প্রজাপতির বদলে জীববৈচিত্র্য রক্ষার আকুতি ফুটে ওঠে। প্রেম-প্রণয়ের বদলে সমস্যা-সংকট বড় হয়ে দেখা দেয়। সময়বাস্তবতার নিরিখে সাহিত্য এভাবেই বদলে যায় এবং চলমান রাজনীতি ও রাজনীতির অবক্ষয়কে প্রতিফলিত করে। তাই মানবকল্যাণের স্বার্থেই চলমান রাজনীতির সাথে সাহিত্যের ইতিবাচক সম্পর্ক জরুরি।
=========================

লেখক ••• সৌম্য ঘোষ। পোঃ চুঁচুড়া। জেলা: হুগলী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *