
উপস্থাপনা:
মানুষের জীবনযাপন আচার আচরণ সমাজ পরিচালনা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দৈনন্দিন যে কাজকর্ম তার প্রতিফলন ঘটে তার মনোজগতে। সৃষ্টি হয় মানুষের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির একটা অংগ সাহিত্য। গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের মাধ্যমে সংস্কৃতির অংগ হিসেবে সাহিত্যকে উপস্থিত করা হয় তার নিজস্ব আঙিনায় আমরা যাকে সাহিত্যের আঙিনা বলছি। অনেকে অবশ্য বলেন কোন একটা সামাজিক ধরণের ওপর নির্ভর করে কিভাবে মানুষের কার্যকলাপ তার মনোজগতে প্রতিভাত হয় তা। এক এক ধরণের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় তা এক এক ভাবে প্রতিফলিত হয়। সেই দিকটাকে অনুসরণ করে বলা হয় যে অর্থনীতির উপরিকাঠামো হল রাজনীতি আর সংস্কৃতি। সাহিত্য সংস্কৃতির অংগ। তাই আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা নিরপেক্ষে সাহিত্য তার দিশা পায় না। আমরা এই বিতর্কে এখানে যাচ্ছি না। সাহিত্যের অংগ হিসেবে গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের সাহিত্যের আঙিনায় অনুপ্রবেশই আমাদের বইয়ের বিষয়বস্তু। সেই অনুযায়ী বইয়ের নাম দিয়েছি সাহিত্যের আঙিনা।
সাহিত্যের আঙিনায় কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস, রম্য রচনা যে যার বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। সাহিত্য যেন একটা সমুদ্র মোহনা, একটা ফুলের বাগান। নানা বর্ণ গন্ধের এক সমাহার। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্রোতে বয়ে চলা এক একটি স্রোতস্বিনী নদী। বিভিন্ন স্রোতস্বিনী নদী এসে মেলে এই মোহনায়। আমরা আমাদের আলোচনায় সাহিত্যের বিভিন্ন অংশকে কিভাবে দেখি সেটা তুলে ধরব। উল্লেখযোগ্য যে আমার সাহিত্য চর্চা সাম্প্রতিক ঘটনা, বলা চলে ঘটনা চক্র। আমি ব্যাকরণ ধরে সাহিত্য চর্চা করি নি। সে পান্ডিত্য আমার নেই। সেই অর্থে সাহিত্যিক নই। জীবন থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ধরে আমার লেখার জীবন। মেঠো সাহিত্যিকের মেঠো সাহিত্য। যেভাবে জীবনকে দেখেছি পেতে চেয়েছি তা নিয়ে ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যাবে আমার সাহিত্য চর্চায়। এ নিয়ে আমি যেভাবে সাহিত্যকে তার বিভিন্ন রূপে দেখি সেটা তুলে ধরার স্পর্ধা দেখালাম ।
সাহিত্যিকের কাজ হলো সময়টাকে ধরা তাকে উপলব্ধি করা। সময় যদি বিশেষ বার্তাবাহক হয় তবে সাহিত্যের মাধ্যমে সেই বার্তা সাধারণের কাছে গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরার সামাজিক দায়িত্ব সাহিত্যিক অস্বীকার করতে পারেন না। ২০২০ এমনি একটা সময়কাল যা করোনা আর অর্থনৈতিক সংকটের দ্বিমুখী আক্রমণে আমাদের সমাজ জীবনকে বিশ্ব জুড়ে তছনছ করে দিয়েছে। এই বিষয়টা আজ আমাদের মনোজগতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। তার প্রতিফলন আংশিক ভাবে হলেও দেখা যাবে এই বইতে।
এই শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুর বছরটা শেষ হতে চলেছে। কি দেখলাম কেমন থাকলাম কি করলাম এ বছরটায়? প্রশ্ন উঠবেই কারণ অন্য বছরগুলো থেকে এ বছরের থাকা খাওয়া পরা করা দেখা সবই আলাদা। সারাবছরই কোন একটা ঘরে বন্দী থাকলাম একান্তে নিভৃতে। বুকে নিয়ে একরাশ নিরাশা। বিচ্ছিন্ন একা একা মুখোশ পরে সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বলা চলে কারাগারের কোন এক সেলে। ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কের মধ্যে। আপাতদৃষ্টিতে এক বিশাল শূন্যতা অনিশ্চয়তা। জানতে পারি মানুষ করোনা ১৯ নামে মারণরোগে আক্রান্ত অথবা আতংকগ্রস্থ, কখন তাকে ধরে। অর্থনীতি সংকটে, বাজারে চাকুরী নেই, আজ যাদের আছে কাল থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ। বাচ্চাদের খেলাধুলো বন্ধ। বছরটা করোনা বছর বলে চিহ্নিত। সমাজজীবন ভেঙে তছনছ। বাচ্চা বুড়ো সবাই ঘর বন্দী। একজন আরেকজনকে সন্দেহ। বোধ হয় করোনা ভাইরাস নিয়ে এসেছে। কাছে এলেই ছুলেই সংক্রমণ। তাই না আসাই ভালো। করোনা আতঙ্কের সঙ্গে জুটেছে চিকিৎসা আতংক। সত্যি করোনা হয়েছে কিনা, হলেও এর চিকিৎসা কি কত টাকার দায়, সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়, মরলে শব দাহ কিভাবে হবে কে করবে এসব নিয়ে প্রশ্ন। আর এরই মধ্যে করোনাকে সামনে রেখে রাষ্ট্র একের পর এক তথাকথিত সংস্কার নীতি অবলম্বন করে চলেছে যা কর্পোরেট রাজের ভীত শক্ত করে।
এই সবের মধ্যে আমিও পড়ি। তবে আমার বয়স ৭৫ এর ওপর। আমার বাইরের জগৎ ছোট হতে হতে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে গেছে। এমনিতেই নিরূপদ্রোপ একাকিত্বের জীবন। খাওয়া পরা ঘুম। জীবনের রূপ রস বর্ণ গন্ধ বিলীন হতে চলেছে। মোবাইল বা কিছুটা লেখালিখি নিয়ে সময় কাটে। স্কুল কলেজ নেই খেলাধুলো নেই, পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। কোন কাজে যাবার তাড়া নেই। তাই জীবনটা শূন্যে দোদুল্যমান। অপেক্ষারত। কিন্তু যাদের জীবনে এখনও প্রানের স্পন্দন তাদের অবস্থাটা কি? ভাবা যায় না। অবশ্য ঘরে দাদু দিদা বাবা মা ছেলে মেয়ে নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার। একজন আরেকজনকে আরো সময় দিতে পারছে যদিও বিধান আছে ‘সামাজিক দূরত্ব‘ বজায় রাখার। এই একাকিত্বের মধ্যে থেকেও মানুষ ভাবে, আশা নিয়ে বাঁচে।
আমারও এইভাবে কাটে বছরটা। এই নৈরাশ্যের মধ্যেও শিখলাম জানলাম অনেক কিছু। জানলাম সমাজজীবনে কোন ধরণের সরকারের প্রয়োজন কেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা গবেষণার ওপর সরকারের খরচ বাড়ান দরকার কেন। উগ্র শিল্পায়নে পরিবেশ ধ্বংস কতটা ক্ষতিকর। কিভাবে এই সংকটকালেও মুনাফাবাজরা ফায়দা তোলে, ভোগবাদ কতটা অসাড়, যুদ্ধবাজরা যুদ্ধের মহড়া দেয়। জানলাম সমাজটাকে ঢেলে সাজাবার প্রয়োজন কেন। এর থেকে প্রতিভাত হওয়া মনন নিয়ে বছরটা ধরে কালি কলম নিয়ে কাটালাম। এই করোনা কালে মানব সমাজের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে যা নিয়ে কলম ধরতে হয়েছে। আর এরই ফসল এই বই। এটাই এই সংকটকালে আমার প্রাপ্তি। এতদিনকার চলমান জীবন ছেড়ে এই অন্ধকারের থিতু জীবনের মধ্যে আলো। বইতে ২০২০ র সংকটকালটা তুলে ধরার যেমন চেষ্টা হয়েছে তেমনি এর থেকে প্রাপ্য শিক্ষা জায়গা পেয়েছে । আর আছে এই কালের আগের কিছু লেখা। আজ এই করোনা সংকটের সময়কালে যা আরও তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজ দুনিয়াজুড়ে সব দেশ যখন করোনা ১৯ আর অর্থনৈতিক সংকটের দ্বৈত আক্রমের মুখে মানব সমাজে তখন আবার সমাজ পুনর্গঠনের দাবি উঠে আসছে পৃথিবী জুড়ে।। করোনা আমাদের কাছে সেই বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছে। সাহিত্যের মাধ্যমে সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেন তাঁদের ওপর বর্তায়।।
চেতনার জগতে সাহিত্যের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার সারসংকলন ঘটে। তাই সৃষ্টিশীল হতে গেলে সাহিত্যকে জীবনমুখী হতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কল্পনা। কল্পনার প্রচ্ছদে সাহিত্যিক ভবিষ্যতের ছবি আঁকেন । আমার এই বইয়ে তাই জায়গা পেয়েছে একই সঙ্গে গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা। আমার জীবনবীক্ষা অনুসরণ করে যে সব গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা ছড়া লিখেছি তার অনেকগুলোর সাহায্যে আমি আমার জীবনবোধকে বহুমাত্রিক করে তুলতে চেয়েছি। মেলাতে চেয়েছি তাদের সাহিত্যের মোহনায়।
গল্প প্রবন্ধ বা কবিতা কোনটাই আমার মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। এর জন্ম আমার কল্পনায় নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আশ্রয় করে লেখা প্রবন্ধ গল্প কবিতার মেলবন্ধন ঘটাতে চেষ্টা করেছি। আজকের এই ঘটে যাওয়া ঘটনা হলো অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা ১৯ এর সংযোজন যা পৃথিবীতে মানব সভ্যতার জন্য এক অভাবনীয় সংকট নামিয়ে এনেছে। চলতি আর্থ সামাজিক ব্যাবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের আদর্শের প্রেক্ষাপটে গল্প কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে তাকে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজ বদলের দাবিকে সোচ্চার করে তুলেছে। ভবিষ্যতের কাঙ্খিত সমাজ গঠনে আমাদের সাহিত্য চর্চাকে এই প্রচেষ্টায় কাজে লাগাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কাঙ্খিত সমাজ যেহেতু এখনও বাস্তবায়িত হয়নি তাই তা এখনও কল্পনায় বিরাজ করে। কল্পনায় বিরাজমান সেই সমাজের উপাদান আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন প্রবন্ধ গল্প কবিতায় থাকলেও তাদের একটা সমন্বিত সামগ্রিক রূপ পাওয়া যেতে পারে এই গ্রন্থে। খন্ড সত্যকে অখন্ড সত্যে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে এই সামগ্রিক রচনা। বিভিন্ন বিষয়ের পরস্পরের মধ্যে আন্তঃ:সম্পর্ক, তাদের মধ্যে মিল অমিল, ঐক্য বিরোধ, সহযোগ অসহযোগের একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যেতে পারে।
গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গ। কেউ স্নায়ু জগতে খেলা করে, কারও বাস হৃদয় প্রান্তরে, সে একান্তে নিজেকে খুঁজে ফেরে। আবার কেউ মুখের স্বাদ পেটের খিদে মেটায়। সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। সকলেই জীবনের কথা বলে জীবনের ছবি আঁকে। জীবনকে সম্পূর্ণতা দিতে চেষ্টা করে। কাউকে বাদ দিয়ে সাহিত্য সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এককথায় গল্প কবিতা প্রবন্ধ সকলে মিলে মিশে সাহিত্যের বৈঠকখানায় আড্ডা মারে। কেউ কল্পনায় সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে আবার কেউ উঁকি মারে পাশের বাড়ির গৃহস্থের ঘরে আবার কেউ প্রকৃতি প্রেমের উপাসক। কেউ জীবন যুদ্ধে সৈনিক। প্রত্যেকেই নিজ ছন্দে নিজ তালে লয়ে যেন নেচে চলে। সাহিত্য যেন সমুদ্র মোহনা। গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধ হল প্রবাহিত নদী যারা এসে মেলে সমুদ্র মোহনায়। আমি আমার গল্প কবিতা প্রবন্ধের সেই মিলন মেলায় মিলতে চেয়েছি। গল্প কবিতা প্রবন্ধ কোনটাকে ভিন্ন জাতের বলে একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করে রাখি নি। আমার গল্পে প্রবন্ধে কবিতা এসে মিলেছে। আবার কোন কোন কবিতাকে গল্পের আঙ্গিকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। চেষ্টা করেছি সবাইকে একতারায় বাঁধতে। সাহিত্যকে তার সমগ্রতায় বিভিন্ন অঙ্গের মিলনে পরিপূর্ণতায় পেতে চেয়েছি।
সাহিত্যে গল্প:
সাহিত্যের জগতে উপন্যাস যেখানে বহুমাত্রিক গল্প সেখানে এক মাত্রিক। কোন একটা মূল ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় গল্প। গল্পে চমক থাকে। খুব সহজভাবে কোন ঘটনাকে উপস্থাপন তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা চমকটাকে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত না করে ইঙ্গিতে তাকে পরিবেশন করার শিল্পগুন গল্প লেখকের বৈশিষ্ট্য। সীমিত বহরে রেখে সুক্ষভাবে বিষয়টাকে প্রকাশ করা হয় গল্পে। গল্প বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হয়। এক একটা গল্প এক একটা বিষয় মুখী হয়। যেমন প্রেমের গল্প শিকারের গল্প খেলার গল্প অভিযানের গল্প মানুষের গল্প পশুর গল্প প্রভৃতি। একটা বিষয় নিয়ে একটা গল্প হয়। গল্পে চরিত্র উপস্থাপিত হয় কিন্তু উপন্যাসের মত বেশি চরিত্র একটা গল্পে স্থান পায় না। গল্পের লেখকের কল্পনা বিস্তারের সুযোগ থাকে। বাস্তবে ঘটে না তার কল্পনায় আশ্রয় করে এমন বিষয় নিয়ে লেখক গল্প বানাতে পারে। আবার বাস্তবে ঘটে যাওয়ার বিষয়কে নিজের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তাকে পরিবেশন করতে পারে। গল্পে প্রবন্ধের মত যুক্তি তর্কের বিন্যাস তেমন গুরুত্ব পায় না। তাও প্রতিটি গল্পে তার নিজের একটা যুক্তি থাকে। তবে গল্পটা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার বিষয় ততটা গুরুত্বপূর্ন নয়, তার রস সিঞ্চন করে তাকে উপভোগ করার বিষয়টাই প্রধান। আনন্দ উপভোগ হতে পারে বেদনার রেশ থেকে যেতে পারে গল্পে যা যুক্তি থেকে আবেগকে তাড়িত করে বেশি। গল্পে কবিতার মত ছন্দের খেলা না থাকলেও প্রতিটি গল্পের নিজের একটা ছন্দ থাকে। সেই ছন্দটা কেটে গেলে গল্পের রস আস্বাদন করা যায় না। গল্প আবার ছোট গল্প হতে পারে আবার বড় গল্প হতে পারে। ছোট গল্প স্বাভাবিক ভাবে ছোট মাপের। কিন্তু কেবল মাপ দিয়ে এ পার্থক্য বিচার হয় না। বড় গল্প যেন হাটে পরিবেশিত হয় যেখানে গল্পের উপাদান অনেক বিস্তৃত। অন্তর্নিহিত বেশি কিছু অবলা থাকে না। তার আঙ্গিক বড় হয়ে তাকে উন্মোচিত করে দেওয়া হয় বেশি করে। ছোট গল্প যেন পরিবেশিত হয় খেতে খেতে অল্প সময়ে যেন ঘরের মধ্যে আড্ডার আসরে। ছোট গল্পে অল্প কথায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়। অনুন্ন্মোচিত থাকে অনেকটাই। চমকটা রেখে দেওয়া হয়। সেই জন্যই রবি ঠাকুরের ভাষায়:
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
গল্প নিয়ে একটা প্রবাদ চালু আছে। বলা হয় যে গল্পের গরু গাছে ওঠে। অর্থাৎ খুশি মত অবাস্তব যা কিছু নিয়ে গল্প লেখা যায় যার সঙ্গে বাস্তবতার যোগ নেই, যা লেখকের কল্পনার খামারে উৎপাদিত হয়। বলা হয় গল্পে কোন মূল্যবোধ না থাকলেও চলে। গল্প নিয়ে এ ধরণের ভাবনার আমরা বিরোধী। সাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে গল্প মানুষের সেবায় কাজ করে। মানুষের সুস্থ চিন্তা ভাবনার বিকাশে সহায়ক যদিও গল্পে লেখকের কল্পনার বিশেষ ভূমিকা থাকে। কিন্তু সে কল্পনায় এমন গল্প না রচনা করাই বাঞ্ছনীয় যাতে গরু গাছে ওঠে। সুস্থ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য এটা কাম্য নয়।
কয়েকটি গল্প
একই সূত্রে
১
শহরের উপকণ্ঠে একটা ছিমছাম পল্লী। তারই একপ্রান্তে একটা ছোট অর্ধ সমাপ্ত বাড়ি। বাড়িটাতে অভাবের ক্লেদ যেমন চোখে পড়ে না তেমনি প্রাচুর্যের আতিশয্য নেই। এ বাড়িতে গত প্রায় পনেরো বছর ধরে থাকেন এক মহিলা তাঁর চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে। মহিলার বয়েস যা অনুমান করতে পারি আর ছেলের বয়সের হিসেব থেকে বলা যায় মহিলা একটু দেরীতে বিয়ে করেছেন বোধ হয়। অবশ্য ধরে নিই যে ওনার এই একই ছেলে। আর সেটা প্রতিবেশীদের ধরে নেওয়ার কারণ আছে বৈকি। কারণ গত পনের বছরে এ বাড়িতে এমন কাউকে আসতে দেখা যায় নি যাকে দেখলে তাঁর বড় ছেলে বা বড় মেয়ে বলে মনে হতে পারে। এসব অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে ওনার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ বছর। আরেকটা বিষয় হল যে এ বাড়ীতে এমন কোন প্রবীণ পুরুষ দেখা যায় নি যাকে ওঁর স্বামী বলে মনে হতে পারে। তবে পাড়ার অনুসন্ধিৎসু অনেকের মতে ওনার স্বামী ওনাকে ছেড়ে গেছেন । ছেড়ে গেছেন বললে ভুল হবে। ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকলেই সমালোচকদের ওনার সম্পর্কে অনুমানগুলো সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ভেবে তারা তৃপ্তি পান। সম্ভবনা নয় কেউ কেউ নিশ্চিত যে ওনাদের বিবাহ বিচ্ছেদই হয়েছে। এনারা কারণটাও জানেন। সেটা রসিয়ে কষিয়ে আড্ডায় বলেন। ঊষাদেবীর স্বামী নাকি খুব বেচারা মানুষ। নেহাতই ভালোমানুষ। আর ঊষাদেবী দাম্ভিক, অহংকারে পা পড়ে না। স্বামী এত ভালোমানুষ হলে কি চলে? পৌরুষ কোথায়? তাই মানানো চলে না। বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্তত ঊষাদেবীর তরফ থেকে।ওদের মতে আজ এর জন্য ঊষাদেবীকে ভুগতে হচ্ছে। এত ভালো রোজগেরে দেবতুল্য মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার ফল। বিচ্ছেদের গল্পে তাদের আলোচনার বিষয় বেশি প্রাণ পায় বলে তাদের ধারণা।এক এক জনের মুখে এক এক গল্প। আবার কেউ কেউ বলেন উনি মারা গেছেন। তবে হলপ করে কেউ কিছু বলতে পারেন না। নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করলেও কেউ কোনদিন সামনাসামনি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পায় নি। কারণ মহিলা পাড়ায় বেশি মেশেন না। যেন একটু এড়িয়ে চলেন। দুচারজন যাদের সঙ্গে ওঁর আলাপ আছে, পথে দোকানে বাজারে দেখা হয়, দুচার কথা হয় তারাও কিন্তু ওনাকে কেন জানি না এসব কথা জিজ্ঞাসা করেন না। বা করতে ভরসা পান না। অবশ্য আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় ঊষাদেবীর চেহারায় এমন একটা ব্যক্তিত্ব বা বিশেষ কিছু আছে যা তাঁকে অন্যেদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সব মিলিয়ে যেন একটা রহস্য না হোক অস্বাভিকতা জড়িয়ে আছে। পাড়ার সবাই এ নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও কৌতূহলী মানুষের তো বঙ্গ সমাজে অভাব নেই। তাই অনেকের কাছে কবির ‘সাল বনের এই দুরত্ব’ একটা আলোচনার বিষয় তো নিশ্চয়। তবে সবার কাছে যেটা বিশেষ ভাবে কৌতূহলের সেটা হল বাড়িতে বসে ঊষাদেবী নিয়মিত গানের রেওয়াজ করেন। ছেলে সঙ্গে সঙ্গত করে। আর এটা তিনি খুব নিষ্ঠাভরেই করেন।বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলে তাঁর গানের গলায় আকৃষ্ট হতেই হয়। তিনি সন্ধ্যার দিকে নিয়ম করে বের হন। সঙ্গে প্রায়ই ছেলে থাকে। আবার ছেলেকে নিয়ে ফেরেন। আমরা অনেকেই ভাবি ছেলেকে হয় তো পড়াতে নিয়ে যান। কিন্তু ওই যে কৌতূহলী মানুষেরা! তারা রোজই উনি কোথায় যান তা নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণার ফল প্রকাশ করেন ঠিক আজের কভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন এর মত। তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। তবে এই অনুসন্ধানে যে ফলরসের উদ্ভব হয় তাতে নেশার উপাদান আছে অস্বীকার করা যায় না। আড্ডায় সে ‘সোম’ রসের নেশা থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।
মায়ের পরিচয় পেলেন। এবার ছেলের পরিচয় না পেলে ওই দুজনের খুদে সংসারের সামগ্রিক পরিচয়টা পাওয়া যায় না। দুজনে যে দুজনের পরিপূরক। ছেলেটি ছিমছিমে রোগা লম্বা। চোখ মুখে একটা উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে। চোখের ইশারায় যেন নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলে। চোখে অজস্র প্রশ্ন জড়িত কোনোটারই যেন ও উত্তর পায় না। এমনিতে মিশুকে হলেও ঘরে মায়ের সাথে সময় কাটে। ক্লাস টেনে পড়ে অর্থাৎ সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবে তা নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা আছে তা মনে হয় না। বন্ধু বান্ধব ইতস্তত থাকলেও তারা খুব একটা বাড়ি আসে না। পাড়ার ক্লাবে মধ্যে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতে যায়। বন্ধুবান্ধব যারা আছে তারাও ছেলেটির বাবা বা তাদের আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। ছেলেটি এ ব্যাপারে যেন উদাসীন। মায়ের সঙ্গেই তার জীবন। তবে ওর এক মেয়ে বন্ধুকে মাঝে মাঝে বাড়ি আসতে দেখা যায়। মেয়েটি অতি সাধারণ দেখতে। বোঝা যায় দুজন দুজনের খুব বন্ধু। ঊষা দেবী অর্থাৎ ছেলেটির মা ওকে খুব ভালোবাসে।ওদের বন্ধুত্বকে যেন একটু বেশি মদত করে যেটা আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব স্বাভাবিক নয়। এ নিয়েও পাড়ায় কৌতূহলিদের মধ্যে কানাকানি শ্লেষা শ্লেষি।
ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গে পরবর্তী কালে পরিবারটির ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে । আমি আঞ্চলিক একটা বিদ্যালয়ে মাস্টারি করতাম বলে এলাকায় বুড়ো বাচ্চা সবারই পরিচিত। আর প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাড়ার চায়ের দোকানে আমাদের একটা আড্ডা আছে। একদিন দেখি ছেলেটি পাড়ার কিছু আড্ডাবাজ ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে ছেলেগুলো টিটকিরি মারছে উত্তেজিত করছে। ওকে সাধারণত মাথা তুলে জোরে কথা বলতে দেখা যায় না। আজ সে ব্যতিক্রমটা দেখি। ব্যাপারটা এতদূর এগোয় যে ওকে এবার মারধর খেতে না হয়! আমি এগিয়ে যাই। ছেলেগুলোকে নিরস্ত করি। আর ব্যাপারটা বাড়ে না। জানতে পারি ছেলেটি ও তার মায়ের ব্যাপারে ছেলেগুলো কিছু প্রশ্ন করে যেগুলো ওদের অধিকার বহির্ভূত বলে ছেলেটি মনে করে আর সেটা ওদের মুখের ওপর বলে। তাই নিয়ে বিবাদ। ছেলেটির সাথে কথা বলে মনে হলো ওর আত্মসম্মান বোধ তীব্র। সেখানে আঘাত লাগলে ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, ভয় পায় না। এটা আমার ভালো লাগে। ওকে নিয়ে আমি ওর বাড়ির দিকে এগোই। বাড়ির সামনে এসে ও আমাকে প্রায় জোর করে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। আমিও নিজের মধ্যে চাপা ঔৎসুক্যটার বশবর্তী হয়ে আলাপে একটু বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। আলাপের মাধ্যমে যদি পরিবারের রহস্য কিছু থেকে থাকে সেটা যদি ভেদ করতে পারি। আর আমাদের সবার জীবনের অন্দরে রহস্য ভেদের জন্য একজন ফেলুদা আছে সেটা তো অস্বীকার করতে পারি না। ওর মায়ের সাথে কথায় কথায় জানি ছেলেটিকে পড়াবার জন্য ওরা একজন ইংরেজি শিক্ষক খুঁজছে। ঘটনা চক্রে ওটা আমার বিষয়। তাই স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব নিই। তবে আমার তাগিদটা শিক্ষক হিসেবে যতটা তার থেকে গোয়েন্দা হিসেবে বেশি।
আমি খুব অল্পদিনের মধ্যে নিজের অজান্তেই যেন রন্টুদের পরিবারের একজন হয়ে পড়ি। বলা হয়নি ছেলেটির নাম রন্টু। আমাকে এখন মামা বলে ডাকে। আমার যেমন এ বাড়িতে অবাধ প্রবেশ ওরাও আমার বাড়ি যায়। ঊষা দেবী আমার স্ত্রীর বান্ধবী হয়ে উঠেছেন। আগে যেমন ওনাকে কোন এক ধোঁয়ার আড়ালে দেখতাম এখন সেটা অনেকটা দূর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোক রশ্মি ওনার চোখে মুখে দেখি। ওনারা যেখানে যান আমাকে নিয়ে যান। এমন কি বিকেলের সেই রহস্যের অন্তরালে। আমার কাছেও যেন ফুলের প্রস্ফুটন। একটা একটা করে পাপড়ি খোলে। তবে ঊষাদেবীর স্বামীর অন্তরীণ হওয়ার রহস্য এখনও আমার অজানা। অবশ্য নিশ্চিত হয়েছি যে উনি বেঁচে আছেন। তবে কোথায় কেন জানি না। ঊষাদেবী একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত। বোধ হয় সেইজন্য নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখেন। আর নিজেকে দূরে রেখে স্বামীকেও যেন অন্তরীণ রাখতে সাহায্য করেন।
কোন কোন দিন যেমন ওদের সঙ্গে যাই তেমনি সেদিনও গেছি। একটা গানের আসর। আসর বসিয়েছেন কিছু গণ্য মান্য ব্যক্তি। বলা চলে এক মজলিস। বোঝা যায় যে এ ধরণের মজলিসে ঊষাদেবীকে আসতে হয় তার জীবিকার জন্য। যারা পাড়ায় এ ধরণের একটা সন্দেহ প্রকাশ করেন সেই ফেলুদারা আমার আগেই রহস্য ভেদ করেছেন সন্দেহ নেই। সেখানে ঊষাদেবী গায়িকা। আজ তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করবে তার ছেলে। যে নিয়মিত তবলায় সঙ্গত করে সে আজ আসতে পারবে না। ছেলের বান্ধবীও আজ সঙ্গে এসেছে।
মজলিস শুরু হয়েছে। আজ ঊষাদেবীর শরীর ভালো নেই। তাও পেটের তাগিদে আসতে হয়। গান ধরেছেন ঊষাদেবী। উপস্থিত অতিথিরা গুছিয়ে মেজাজে বসেছেন। ঊষাদেবীর গলা তাদের আমেজটা ফিরিয়ে আনে। একটা মাদকতার পরিবেশ তৈরি হয়। ছেলে সুন্দর সঙ্গত করছেন। সঙ্গে একটা বাদ্য যন্ত্র। মধ্যে মধ্যে মায়ের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। সে এই সংগীতের পরিবেশে অভ্যস্ত বোঝা যাচ্ছে। শ্রোতাদের মধ্যে কয়েকজন মদ মাতাল আছে যারা উচ্ছসিত প্রশংসায় আসর জমিয়ে তুলছে। দু তিনটে গান হয়েছে। আসর এখনও সে উচ্চতায় উঠতে বাকি। শ্রোতাদের পয়সা ছোড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন উচ্চে আসর উঠবে। হঠাৎ ঊষাদেবীর কাশি ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারেন না। পুরোণ রোগটার আক্রমণ। গলা স্তব্ধ হয়ে আসে। ছেলেও বোঝে। বাজনা ছেড়ে মাকে এসে ধরে তোলে। ঊষা দেবী উঠতে থাকেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন। সংগঠক বিড়ম্বনায় পড়েন। তিনি এসে ঊষাদেবীকে মনের জোর দেন, আবার গানে বসতে বলেন। ছেলে আমাকে মঞ্চ থেকে ইশারা করায় আমি আর বান্ধবী মেয়েটি এগিয়ে যাই। ঊষাদেবীকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে মাইক্রোফোন নিয়ে গান শুরু করে মা যেখানে শেষ করেন সেখান থেকে। প্রথমে বিরক্ত হলেও এই অল্প বয়স্ক ছেলের গান আর তার সঙ্গে নাচ মাদকতার পরিবেশটা ফিরিয়ে আনে। ঊষাদেবী আমাদের সঙ্গে এসে বসেন। উনার পাশে এক ভদ্রলোক শ্রোতা। ঊষাদেবীকে জল খাইয়ে একটু সুস্থ হতে সাহায্য করেন। ছেলের গান জমে ওঠে । মায়ের জায়গা পূরণ হয়। আবার মেতে ওঠেন শ্রোতারা। বৃষ্টির মত পয়সা পড়তে থাকে। সংগঠক ভদ্রলোক সেগুলো কুড়িয়ে তোলে। তাই দেখে ছেলে বিরক্ত হয়। গানের মাঝে সেও পয়সা কিছু কুড়িয়ে নেয়। এভাবে চলতে চলতে অনুষ্ঠান শেষ হয়। উঠে জায়গায় ফিরতেই সংগঠক ভদ্রলোক এসে রন্টুর কুড়িয়ে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বলেন। তার মজুরি যেটা প্রাপ্য সেটা সে পাবে বলে আশ্বস্ত করেন। রন্টু মানে না। সে বলে ওই টাকা মায়ের আর তার শ্রমের পয়সা সেটা তাদের প্রাপ্য। সংগঠক হিসেবে ওনার যা প্রাপ্য সেটা ওরা ওনাকে দেবে। ঊষাদেবী ছেলেকে টাকা দিয়ে দিতে বলেন। ছেলে সেটা না দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালায়। ঊষাদেবী সংগঠককে বলেন উনি টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। সংগঠক সেই প্রতিশ্রুতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আমি এতক্ষন খেয়াল করি নি। যে ভদ্রলোক ঊষাদেবীর শুশ্রূষা করছিলেন উনি তখনও দাঁড়িয়ে। ঊষাদেবী আমার সঙ্গে উনার পরিচয় করিয়ে দেন স্বামী বলে। এতক্ষন আমি উনার দিকে তাকাই নি। এবার তাকালাম। দেখি আরে এ তো আমার সেই কলেজের বন্ধু। শুনেছি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পুলিশ ওকে খুঁজে পায় নি। ও আমাকে চিনতে পারে। দুজনেই আবেগ তাড়িত হলেও সংযত থাকি। বুঝি এটা আবেগ প্রকাশের জায়গা নয়। এটা ঊষাদেবীর যেমন জীবিকার জায়গা তেমনি গোপনে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ। একটু এদিক ওদিক হলে বিপত্তি। উনি বেরিয়ে যান। আমরাও বাড়ির দিকে এগোই। আমি বুঝি এ লড়াইটা ওদের তিনজনের, গোটা পরিবারের। পরিবারে কেউ হারিয়ে যায় নি। একই সূত্রে বাঁধা।
২
বেরিয়ে এসে দেখি রন্টু দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি ওর অধিকারের লড়াইটা যে সমর্থন করি তা ও বোঝে। ও এসে মায়ের দায়িত্ব নেয়। সবাই মিলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা ফিরে আসি। ওদের বাড়িতে নামিয়ে আমি নিজের বাড়িতে। আমার অতীতও যেন আমার সঙ্গে ফিরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ার সময় সুহাস বিপ্লবী দলে ঢুকে যায়। আমিও ওদের সমর্থক ফেউ হয়ে ওদের সাথে ঘুরতাম। ওরা তখন ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনের কথা বলত। বিশ্বাস করত যে ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পায় নি। আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে সমাজতন্ত্র গঠনের লড়াই এর সংহতি সাধন করা দরকার বলে মনে করত। তাই ওরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিল। সুহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হওয়ার আগেই সব ছেড়ে চলে যায়। আমি মধ্যে মধ্যে ইতস্তত খবর পেলেও সব খবর পেতাম না। শুনেছিলাম বিয়ে করেছে।
স্ত্রী খাওয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু আমি যেন আমার অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা করছি। নানা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছি। যেন কোন অঙ্ক মেলাতে আমি মশগুল। খাবার ইচ্ছে নেই। স্ত্রীকে পাশে বসাই। ওকে সব বলি। ও সুহাসকে না চিনলেও আমার কাছে ওর কথা শুনেছে। আর তখনকার বিপ্লবী রাজনীতির কথা ও জানে। দূর থেকে সুহাসের ওপর একটা শ্রদ্ধা ওর মনে। বোধ হয় আমাদের সমাজে সব মেয়েদের ক্ষত্রেই এটা সত্যি। ওদের মুক্তির ইচ্ছের মধ্যে ওরা বোধ হয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের খুঁজে পায়। ওকে সব বলে আমিও কিছুটা হালকা হই। তারপর খেতে যাই। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি।
শুয়ে শুয়ে ভাবি ঊষাদেবীর ছেলেকে নিয়ে বর্তমান এই কঠিন জীবন। পর্দার আড়ালে থেকে এক আত্মবলিদান। আর্থিক অনটন তার ওপর এই অসুস্থতা। ছেলেকে এক হাতে বড় করা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। স্রোতে গা ভাসানো নেই। আছে খালি অধীর প্রতীক্ষা। আর প্রত্যয়। অথচ এই মহিলাকে নিয়ে কত অকথা কুকথা। যারা সুহাসকে চেনে না তারা এই মহিলাকে নিচে নামাবার জন্য সুহাসকে বেচারি বানায়।প্রচুর রোজগেরে বলে প্রচার করে। অথচ সুহাস ছিল ডান পিটে। শিক্ষকদের সঙ্গেও তর্ক করত। রোজগার কোনদিন করেছে বলে জানি না। সব ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবের কাজে। একেবারেই বেচারি নয়। আসলে আমাদের মধ্যে জন্মের পর থেকে যে নারী বিদ্বেষ গড়ে ওঠে এই সমাজে তাই কালক্রমে বিষবৃক্ষ হয়ে এই ফলই ফলায়। সেটাই পুরুষ প্রধান সমাজের নিয়ম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে আবার দৈনন্দিন জীবন। আমি অনেক দিন হল অবসরজীবী। সকাল বিকেল আড্ডা আর পড়ানো যখন যেমন থাকে। যতটা বাড়ির কাজ না করলে চলে না ততটুকু করা। বাকিটা স্ত্রী করে। এর সঙ্গে রন্টুকে পড়াতে যাওয়া। অন্য ছাত্ররা আমার বাড়িতে এসে পড়লেও রন্টুকে আমি পড়াতে যাই। কেন সেটা আগেই বলেছি। গোয়েন্দা গিরির জন্য। সেটা আর সেদিনের পর থেকে দরকার নেই তাও আমি যাই। বলতে দ্বিধা নেই এখন যাই ঊষার আকর্ষণে। ওরা যেন আত্মীয় সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এখন রন্টুকে পড়ানোর আগে পরে ঊষার সঙ্গেও কথা হয়।
ঊষাদেবী বাড়ি এসে বিছানা নেয়। পুরনো রোগটা ভালোই মাথা চাড়া দেয়। এরই মধ্যে গেলে পরে ওনার সঙ্গে দেখা হয়। আমি যতটা সম্ভব উনার খবরাখবর নিই। একদিন আমি পড়াতে গেছি। রন্টু বাড়ি নেই। ঊষার সঙ্গে কথা শুরু হয়। এটা ওটা কথার পর সুহাসের কথা ওঠে। ওরা নিজেরা বিয়ে করেছে জানায় ঊষা। তাও যেন অনেক কিছু অবলা রয়ে যায়। আমি বলি ঊষাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। তবে কার সঙ্গে ওর মিল পাই। ঊষা হেসে ওঠে। ওকে আমি এই প্রথম মন খুলে হাসতে দেখলাম। মনে হল ও যেন নিজেকে মেলে দিতে চায়। এ যেন খাঁচায় বন্দি এক পাখি খাঁচার বাইরে ডানা মেলেছে। ও আমাকে বলে, “ আমি আগেই আপনাকে চিনেছি। কিন্তু তাও অচেনাই রয়ে গেছি। জানান দিই নি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন কতক দেখা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে। আপনি একই রকম আছেন বদলান নি। বয়স হলেও চিনতে অসুবিধে হয় না”।
“তবে তুমিই কাজল!” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
আমার শুধু সুহাসের কথা মনে পড়ে। আর ওকে জড়িয়ে সেই মেয়েটির কথা যাকে আমি দুচারবার দেখেছি। আবছা যে চেহারাটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের ওই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয় তার সঙ্গে ঊষাদেবীর চেহারার যে খুব মিল পাচ্ছি তা না। ও পরিচয় দেবার পর আজকে সব মিলিয়ে একটা মিল পাই। আমার স্মৃতিতে আবছা হলেও ফিরে আসে কাজল।
তখন মেয়েটি সুহাসদের বিপ্লবী কাজকর্মে যোগাযোগের বাহন ছিল। তবে আমার চেনার সুযোগ খুব হয় নি। আপাত শান্ত ওই মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী ছিল। খুব ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করত। সুহাস ওর খুব গুণগ্রাহী ছিল। আমি অবশ্য এর বেশি কিছু জানতাম না। কৌতূহলী হওয়াটাও আমাদের কারও নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও বারণ ছিল। আত্মনির্ধারিত বারণ।আজ জানলাম ওই মেয়েটিই আজকের ঊষাদেবী।
৩
ঊষাদেবী বেশ কিছুদিন ভোগেন। রন্টুর বান্ধবী উনার সেবা যত্ন করে। দরকারে এ বাড়িতে থেকে যায়। ওর বাবা মা প্রায়ই আসেন। মেয়েটির বাবা সুহাস বাবুর বন্ধু ওই পরিবারের হিতাকাঙ্খী। ঊষাদেবীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন । বাড়িতে থেকেই এই রোগের চিকিৎসা। যক্ষায় আক্রান্তদের চিকিৎসা হল খাওয়া দাওয়া আর নিয়মিত ওষুধ। মেয়েটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে ঊষাদেবীর দেখাশোনা করে। এই ব্যাপারটাও পাড়ার কৌতূহলী জনতার চোখ এড়ায় না। তারা রন্টুর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নির্ভুল সহজ যোগের অঙ্ক কষেন। মুখে মুখেই একে একে দুইয়ের অংকের ফল ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের মধ্যে ভবিষ্যৎ পরিবারের অঙ্কুর এনারা দেখতে পান। সেটা দুই অর্বাচীন পরিবারের আদিখ্যেতা বলে মনে করেন। এত অল্প বয়সে এই সম্পর্ক নিয়ে বাবামায়ের প্রশ্রয়কে আর যাই হোক অভিভাবক সুলভ নয় বলে মত দেয়। অবশ্য এতে ঊষাদেবীর কিছু আসে যায় না। আর মেয়ের বাবামাকেও আমি নির্বিকার দেখি। এরই মধ্যে মেয়ের বাবামায়ের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে সুহাসের সংগে আমার আর বিপিন মানে মেয়ের বাবার একআক্ষিক সম্পর্কের দৌলতে। দুজনেই সুহাস সম্পর্কে উদগ্রীব তাই দুজনের মধ্যে আলোচনার দরজা খোলাই থাকে। বিপিনবাবুর মেয়ের নাম রীতা। বিপিন বাবু একটা জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেন। আর্থিক অবস্থা ভালো। কলকাতায় বালিগঞ্জে একটা এপার্টমেন্টে থাকেন। ওনারা আমার বাড়ি আসেন আমরাও ওনার বাড়ি যাই। আমাদের সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার মেয়ের সাথে রন্টু ও রীতারও ভাব হয়। তবে ওদের দুজনের সম্পর্ককে আমার মেয়ে ও তার মা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এ ব্যাপারে আমারও যে রক্ষণশীলতা কাজ করে না তা নয়। তবে আমি মানিয়ে চলি। সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখার চেষ্টা করি।
মাস ছয় ভোগার পর ঊষাদেবী ভালো হয়ে উঠেছেন। আগের জীবনের ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। এদিকে ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেছে। সেই নিয়ে উনি ব্যস্ত। জীবিকার প্রয়োজনে গানটা ধরে রাখতে হয়েছে। আমি রন্টুর পড়াশুনার দেখভাল করি। ছেলেটি পড়াশুনায় খারাপ নয়। তবে খুব ভালো নম্বর পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। নম্বর পাবার কৌশলটা সেরকম রপ্ত করে নি।সেই অর্থে ভালো ছাত্রের দলে পড়ে না। তবে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ে। বিশেষ করে গল্পের বই। এটা বোধ হয় বাবা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আমার কাজ এই ক‘মাসে ভালো নম্বর পাবার কায়দাটা যতটা পারা যায় শিখিয়ে দেওয়া। আজকাল প্রশ্নের যা ধরণ বিশ্লেষণ পদ্ধতি নয় ওপর ওপর জানার প্রয়োজনটা বেশি। এক আধ কথায় বা টিক মেরে যা চাওয়া হয় তার জানান দেওয়া। নিজের জ্ঞান উজাড় করে দেওয়ার দরকার নেই।
আমার বিপিন বাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ঊষাদেবী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা হয়ে যায় যার কিছুই জানতাম না। বিপিনবাবু সুহাসের পাড়ার বন্ধু ছোটবেলা থেকে। বিপিনবাবু সুহাসবাবুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে গভীরে কিছু না জানলেও ওঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন যেটা আবার আমি জানি না। সুহাসের বাড়ির সঙ্গে পাড়ার সূত্রে ওদের বাড়িরও যোগাযোগ। সুহাসের এক ভাইয়ের সাথে বিপিনের এখনও যোগাযোগ আছে। বোঝা যায় সুহাসের প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা আছে আর তাকে কেন্দ্র করে আকর্ষণ। আর ঊষাদেবী নিজের গুনেই ওদের খুব কাছের মানুষ। সুহাস ঊষাদেবীর বিয়ে থেকে পরবর্তীকালের অনেক খবরই বিপিনবাবু আর বিপিনবাবুর স্ত্রী মিনাদেবী রাখেন। উনাদের কাছ থেকেই জানতে পারি ওদের বিয়ের খবর। বিয়ের পর ঊষাদেবীর গ্রামের স্কুলে পড়াবার খবর। ওখানে স্কুলে চাকরিটা চলে যাওয়ার পর ঊষাদেবী এখনকার বর্তমান বাসস্থানে ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন।
বিপিনবাবুর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ছোট সংসার। মা ও মেয়ের জীবন খুবই সাধারণ ছিম ছাম। সেই তুলনায় বিপিনবাবু একটু সৌখিন মনে হয়। তবে সংস্কার মুক্ত খোলা মনের মানুষ। চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল স্ত্রীকে উনি অত্যন্ত সন্মান করেন। মেয়ে বাবা পাগল। পড়াশুনায় মোটামুটি। একটু আবেগপ্রবণ। ভালো কবিতা গল্প লেখে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়লেও বাংলায় আসক্তি। বাংলায় সাহিত্য চর্চ্চা। রন্টুর প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ। যেন এক অধিকার বোধ। রন্টু যেন একান্তই ওর এমন একটা ভাব। অথচ দুজনে সব সময় যে গায়ে গায়ে তা নয়। এক এক সময় দুজনের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক এমন কি হাতাহাতিও হয়। রীতা যেন রন্টুর অভিভাবক বিপিনবাবু আর তাঁর স্ত্রী সেটা যেন উপভোগ করেন। আর দুজনেরই ঊষাদেবীর ওপর অগাধ আস্থা।
আমার এখন জীবন ঊষাদেবী আর বিপিনবাবুর সন্নিধ্যেই কাটে। স্ত্রীও সঙ্গে থাকে। তিনটে পরিবারকে নিয়ে যেন একটা ত্রিভুজ। আর এই ত্রিভুজের অতিভূজ যেন সুহাস-ঊষাদেবীর পরিবার। সুহাসের অনুপস্থিতিই অতিভুজের বাহুর বাড়তিটুকু যোগ করেছে। সুহাসের প্রতি আমাদের আকর্ষণই তৃতীয় বাহুর বাড়তি অংশটুকু। এখন আর আমার পড়ানোর জীবন নেই। রন্টুর পরীক্ষা হয়ে গেছে বছর দুই হয়ে গেল। এখন ও বারো ক্লাসে পড়ে আমার মেয়ের সাথেই। বিপিনের মেয়েও বিএ ক্লাসে পড়ছে। ও রন্টুর থেকে বড় বলে জানলাম। ও নিয়ে আর আজকাল আমি ভাবি না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে যদিও ওদের সম্পর্কটা মানতে চান না। ঊষাদেবীও আজ আমাদের মধ্যে একজন। আজকাল ওনার গানের প্রোগ্রাম তেমন থাকে না। আর্থিক টানাটানি চলছে।
দেখতে দেখতে আরও বছর তিনেক কেটে গেল। রন্টু বারো ক্লাস পাশ করে একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছে। রীতা বাংলা নিয়ে এমএ পড়ে। লেখালেখিতে একটু পরিচিতি হয়েছে। ও এখন যেন রন্টুর অভিভাবক। রন্টু এর পর কি করবে না করবে সব ব্যাপারেই ওর কর্তৃত্ব। রন্টুর সঙ্গে সম্পর্কে যেন নতুন মোড় নিচ্ছে। কর্তৃত্বটা বাড়ছে কিন্তু বাহ্যিক আবেগটা কমছে। আজকাল রীতার এক সহপাঠীর সঙ্গে রীতাকে প্রায়ই দেখা যায়। রন্টুর সাথে ওর খুব ভাব। রন্টুরও ভয় ওর কাছ থেকে সাধন যদি রন্টুকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু রন্টু যে সাধনকে হিংসে করে তা নয়। বরং সাধনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারে। রীতাকে নিয়ে খেপায়। আমি ঠিক বুঝি না। আমার বোঝার কথা নয়। আর বুঝেই বা কি করব। বিপিনবাবুরাই তো আছেন। এ ব্যাপারে উনাদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। ঊষা দেবীও নির্লিপ্ত। আমার এখানে মাথা ঘামানোর দরকার কি। তাও আমার স্ত্রী মেয়ে মাথা ঘামায়। আমাকে প্রশ্নে জর্জরিত করে যার উত্তর আমার জানা নেই। এ আমার এক বিড়ম্বনা। তাই আমি আজকাল যথাসম্ভব ওদের এড়িয়ে বিপিনবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখি।
আজকাল আমার বিপিনের ওখানে বেশি যাওয়া হয় না। শরীরটা খারাপ। আর একটু অলস হয়ে পড়েছি। বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে না। তবে ঊষার বাড়ি যাই। সুহাসের খবর নিই। রন্টু মধ্যে মধ্যে আসে। ফোনে বিপিনের সঙ্গে কথা হয়। একদিন বিপিনের সঙ্গে কথা হলো ও আসবে। আমি সময় ঠিক করলাম। ওরা বিকেলে আসবে। রাতে খেয়ে যাবে।
বিপিন দিনক্ষণ ঠিক রেখে এল। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম । আজ অনেকদিন পর চুটিয়ে আড্ডা হবে। ঊষা আর রন্টুকেও রাতে খেতে বলেছি। আমি আর বিপিন বসার ঘরে বসেছি। ওরা শোবার ঘরে। বিপিনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলার পর ও পকেট থেকে একটা নেমন্তন্ন পত্র বার করল। রীতার বিয়ে। জানতে পেরে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। পাত্র কে? তবে কি রন্টুর সঙ্গে ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেল। রন্টু হলে তো আমি এ বাড়ির থেকে জানতে পারতাম যদিও এ ব্যাপারে ঊষা কোনোদিন মুখ খোলে নি আমিও প্রশ্ন করি নি। আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারি নি। বিপিনকে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম। বিপিন জানাল সাধন পাত্র। তখন ওকে আমি বলেই বসি যে আমরা তো সবাই জানি রন্টু পাত্র। পাড়ার সবাই তাই জানে। বিপিন হো হো করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে:
“সে কি তুমি জানো না! বাইরের কারো জানার কথা নয় অবশ্য। তবে আমি ভেবেছি যে ঊষা তোমাকে বলেছে। তুমি জান। তাই আমি বলি নি।”
আমি জানাই যে না এ ব্যাপারে আমিও কিছু জানতে চাই নি ঊষাও বলে নি। তবে ওদের মেলা মেশা দেখে সবাই আন্দাজ করেছি এই মাত্র। বিপিন তখন বলে,
“ শোন তোমার সব জানা দরকার। পেছনের অনেক কিছু জানার আছে। ঊষা যখন স্কুলে পড়ায় তখন অন্তঃসত্তাকালীন সুহাসের সঙ্গে ধরা পড়ে। জেলে থাকাকালীন ওর মেয়ে হয়। রীতাই সে মেয়ে। ওই অবস্থায় খুব অসুবিধেতে পড়ে। সে মেয়েকে আমরা বড় করার দায়িত্ব নিই। বছর খানেক পরে ওরা ছাড়া পায়। ঊষার আর স্কুলের চাকরিটা থাকে না। কিছুদিন পরে ওদের ছেলে হয়।ওই রন্টু। আমরা আমাদের কাছে রেখেই রীতাকে বড় করি আর ঊষা ছেলেকে নিয়ে তোমাদের পাড়ায় ও বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গানকে পুঁজি করে জীবন চালাতে থাকে। আর সুহাস তো যথারীতি অন্তরীণ। ও ওর কাজ করে যায়। রীতা একটু বড় হলে ব্যাপারটা জানতে পারে । আমিই ওকে জানাই। তখন থেকে ও ভাইকে আগলে রাখে। ঊষার ওখানে ওর দ্বিতীয় বাসস্থান। বাইরের লোকেদের কাছে অন্যরমম লাগে। এই নিয়ে আমি বা ঊষা কেউ মাথা ঘামাই না।” আমি স্তম্ভিত। ঊষাকে আরও ভালোভাবে চিনলাম। আর চিনলাম এই বিপিনকে।
৪
রীতার বিয়ের পর অনেকদিন কেটে গেছে। রীতা এখন সাংবাদিকতার কাজ করে। সঙ্গে সাহিত্যচর্চা আছে। সাংবাদিকতার জগতে স্পষ্ট বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। তার সঙ্গে সে স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ ও কিছু স্বার্থগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছে। আজের বাজারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে সরকারবিরোধী কথা বলতে স্পর্ধার দরকার হয়। সেটা নিজের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে। আর রাষ্ট্রের চোখে বাবা যখন এক রাষ্ট্রবিরোধী তখন সেটা জানাজানি হলে ও ক্ষমতাগোষ্ঠীর সুনজরে থাকতে পারে না সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত জীবনে ওর একটা অঘটন ঘটে। সাধনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ। ওর শিশুসন্তানকে নিয়ে ও বাবা মানে বিপিনের সঙ্গে থাকে। ইতিমধ্যে ওর মা মারা যায় একটা কঠিন অসুখে। বিপিন এখন অনেকটাই মেয়ে নির্ভর। সর্বক্ষণের সঙ্গী নাতনী। এদিকে রন্টু এখন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। বিয়ে করেছে। গান নিয়েই আছে। গানই ওর জীবিকা। আজ এখানে কাল সেখানে গানের জন্য ডাক আসে। তাতে যা রোজগার চলে যায়। বাড়িতে একটা গানের স্কুলও চালায়। ঊষা আজকাল তার মা মারা যাওয়ার পর নাকি ভাইয়ের ওখানে গিয়ে নিয়মিত থাকে। পাড়ায় বেশি দেখা যায় না। আমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় নি। যা খবর পাই রন্টুর কাছ থেকে । রন্টু মাঝে মাঝে আসে। আমার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে আমরা দুজন। বাইরে জগতের সঙ্গে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তবে বিপিনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ফোনেই বেশি কথা হয়। কখনও ও আসে। আমিও যাই। আমার আর বিপিনের মধ্যে এখনও অনুপস্থিত অন্তরিনে থাকা সুহাস। জেনেছি ও দীর্ঘদিন জেলবাসের পর এখন বাইরে। তবে মূল স্রোতে নয়। কানাঘুষোয় ওর সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়। বিপিন কিভাবে জেনেছে যে ও বাইরে কোন এক প্রদেশে জঙ্গল অঞ্চলে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে। ও নাকি এক আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে থাকে। বিয়ে করেছে কি না ঠিক জানা নেই। তবে কোনোটাই অসম্ভব নয়। আমাদের মত ছা পোষা মানুষের কাছে বিষয়টা অকাম্য হলেও এটা অসম্ভব কিছু না। জীবনের নিয়মে এটা ঘটে থাকে বিশেষ করে ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে। তবে ঊষাদেবীর জন্য খারাপ লাগে। ও নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নেয় নি। ওর সঙ্গে দেখা হয় না বিশেষ তাই এ ব্যাপারে ওর প্রতিক্রিয়া আন্দাজই শুধু করতে হয়। আর সেজন্যই বোধ হয় নিজের সংসার থেকে দূরে ভাইয়ের ওখানে থাকে। আর ভাই নাকি বিয়ে করেনি। দুজনের পক্ষেই তাই সেটাই বেশি সুবিধেজনক। যাই হোক জীবনে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয় তাই ঊষাও বোধ হয় মানিয়ে নিয়েছে। আমাদের দিন চলে যাচ্ছে। বিপিনেরও আমার মত অবস্থা। আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। এর মধ্যে পৃথিবীতে নতুন এক দুর্যোগ। করোনা দুর্যোগ। সব কিছু থমকে গেছে। চিন্তা ভাবনা বাজার হাট একের সঙ্গে ওপরের যোগাযোগ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নতুন ধরনের জীবনের বিধান। সব কিছুই ওলট পালট। এর মধ্যে সচল কেবল এক ভীতি। হার হীম হওয়া ভয়। কি জানি কখন করোনা ধরে। আর এ নিয়ে নানা গবেষণা। আমাদের মত বয়স্ক লোকেরা আসতে আসতে একা সব কিছু থেকে দূরত্বে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। সময় সবই কেড়ে নেয়। নিচ্ছিলও। কিন্তু অল্প বয়স্কদের এ কি জীবন। বাচ্চাদের মোবাইল কম্পিউটার হাতে শিক্ষা বন্ধুত্ব খেলাধুলো সব। ছেলেমেয়েদের অফিস বাজার সবেতেই অন লাইন। কতদিন চলবে জানা নেই। অনেকে বলেন এটাই নতুন সভ্যতা। ডিজিটাল সভ্যতা। মেনে নিতে হয়। কেউ একে বিজ্ঞান দিয়ে আবার কেউ ধর্ম দিয়ে বোঝে । আমাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই। ওই যে বললাম আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। না পারি বিশ্বাস করতে না পারি অবিশ্বাস করে ছুড়ে ফেলে দিতে। অনিশ্চয়তার ভয়টা আমাদেরও গ্রাস করে। ঊষার অনেকদিন খবর নেই। মধ্যে মধ্যে ফোন করত। সুহাসের শেষ খবর পাওয়ার পর ওর ওপর দুর্বলতা যেন বেড়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই কাজলের মুখটা ভেসে ওঠে। একটা সহানুভূতির ছোঁয়া যেন নিজের অজান্তেই ছুঁয়ে যায়। আজ সেটার তীব্রতা কেন যেন বেড়েছে। একটু বেলা হতে বেরিয়ে রন্টুর কাছে যাই। এটা ওটা কথার পর ঊষার কথা জিজ্ঞাসা করি। ও জানায় মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই আসতে পারে না। ওই নাকি প্রায়ই যায়। মাকে আসতে বললেও আসতে চায় না। মামার ওখানেই থাকে। তবে চিন্তার নেই। তাও রন্টুকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখলাম। বোধ হয় মায়ের শরীর নিয়ে চিন্তা। আর ঊষার সাবেকি অসুখটা তো ভালো নয়। ওটা নিয়ে চিন্তা তো হবেই। তা ছাড়া ওর জীবনে যে ঝড় বয়ে গেল। শেষ জীবনে একটা ধাক্কা খেল। আর ধাক্কাটা আর কারও কাছ থেকে নয়, সুহাসের কাছ থেকে যার জন্য ও জীবনটাকে বলতে গেলে উৎসর্গ করেছে। জীবনে কিছু পায় নি। আশাও করে নি। আমি মনে মনে ভাবি।
দিনকতক পরে রীতার ফোন পাই। রীতা এবার ওর বাবার জন্মদিন পালন করবে। এখনকার ছেলেমেয়ের মধ্যে এই উৎসাহটা খুব দেখা যায়। আমরা কোনদিন ঘটা করে জন্মদিন পালন হতে দেখি নি। আজ ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের ছেলেমেয়ে নয় বাবা মায়ের জন্মদিন পালনেও উৎসাহী। ব্যাপারটা মন্দ লাগে না। ছেলেমেয়েরা আজ বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠ নয় বলে যে অভিযোগটা করা হয় তা সর্বতোভাবে সত্যি নয়। আসলে কর্মজীবনের তাগিদে ওদের জীবনধারণে বদল এসেছে। কাজের স্বার্থে অন্য কোথাও থাকতে হয়। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে ওদের আচার আচরণে পার্থক্য আছে। আর আমাদের যে রক্ষণশীল জীবন তা সবটা ঠিক তা নয়। তাই নানা কারণে একটা দূরত্ব এসেছে। এর জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী। যাই হোক রীতার নেমন্তন্নে মন ভরে ওঠে। আজ এই করনার বাজারে হোটেল রেষ্টুরেন্ট করা যাবে না। বেশি লোকের সমাবেশ বারণ। তাই আমরা দুচারজন ওদের বাড়িতেই মিলব সেই শুভ জন্মদিনে, সেটাই ঠিক হয়। আমি আর স্ত্রী নিমন্ত্রিত।
আমরা বিপিনবাবুর জন্মদিনে ওদের বাড়ি যাই। রাস্তাঘাটের যানবাহনের অবস্থা খারাপ ভেবে বিপিন তার ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সাধারণত বিপিন গাড়ি বিশেষ ব্যবহার করে না। । গাড়ি থাকলেও খুব দরকার ছাড়া গাড়ি চড়ে না। আর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওর গাড়ির ব্যবহারটা কমে গেছে। এখন ওটা রীতাই বেশি ব্যবহার করে। মনে হয় রীতা আমাদের অসুবিধের কথা ভেবে গাড়ির ব্যবস্থা করে। বিপিনের ঘরে ঢুকে দেখি বিপিন আর এক ভদ্রলোক বসে। এই গোঁফওয়ালা ভদ্রলোককে আমি চিনি না। অবাঙালি বলে মনে হল। বিপিন ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। বিপিনের মামাতো ভাই। দিল্লিতে থাকে। ব্যবসা করে। কথায় হিন্দি টান । বাঙালি হলেও বাঙালি বলে মনে হয় না। নানা বিষয়ে আলোচনা হতে থাকে। আর আজ আলোচনায় করনাই প্রাধান্য পায়। রোগটা কি কতটা সংক্রমক কতটা প্রাণঘাতি এসব মিশিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। দিল্লিতে সংক্রমণ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলেও এখনও মারাত্মক রূপ ধারণ করে নি। তবে আতংকিত সবাই। এরই মধ্যে এ নিয়ে আতংক সৃষ্টি করা প্রচারের বাহুল্যতা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। আলোচনার মধ্যে রীতা চা নিয়ে আসে। চায়ের পর্ব শেষ হলে কেক কাটার আয়োজন। সবাই বেশ কৌতুক বোধ করি। আমাদের জীবনে এটা তো কৌতুক বটেই। ছোটবেলায় জন্মদিনে মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার মধ্যেই মজাটা থাকত। বাকিটা আদিখ্যেতা বলে ভাবা হত। এর মধ্যে রীতা এসে বসে। ওর সাংবাদিকতা নিয়ে নানা কথা ওঠে। ওর সংবাদে যে সংবাদ পরিবেশিত হয় তা নিয়ে ও যে অসুবিধের মধ্যে পরে তাও ও বলে। বেশ কিছুদিন আগে একটা আদিবাসী অঞ্চলে পুলিশের সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ব্যাপারটা ও তুলে ধরে। ওখানকার এক নেতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেই নিয়ে রীতাকে কম ভুগতে হয় নি। ওকে গ্রেপ্তার করার কথাও ওঠে। এ নিয়ে বিপিন যথেষ্ট উদ্বেগে। এই আলোচনায় সুমিতবাবু অর্থাৎ নতুন পরিচিত ভদ্রলোকও যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে। এরপর কেক কাটার পালা। উৎসাহের সঙ্গে সেটা পালন হয়। রীতার ছোট্ট মেয়ে কেক কেটে গান গেয়ে অনুষ্ঠানকে উৎসব মুখর করে তোলে।
কেক পর্ব শেষ হলে আবার আমরা গপ্পো করতে বসি। জানতাম না যে আমার জন্য এরকম একটা রহস্যের উপাদান সংগ্রহ করে রেখেছে বিপিন। আলোচনার মধ্যে হঠাৎ আগুন্তুক ভদ্রলোক গোফ খুলে ফেলে। মাথা থেকে একটা কৃত্রিম চুলের গোছা খুলে একধারে রাখে।আমি অবাক হয়ে দেখি সুহাস সামনে বসে যাকে আমি বেশ কিছুদিন আগে ঊষার গানের মজলিসে দেখি। আমি আবেগ প্রবণ হয়ে উঠে আসি ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য। ও বলে থাক সামাজিক দূরত্বটা বজায় থাক। আবেগ চেপে নিজের জায়গায় বসি। রীতা জানায় কিছুদিন আগে উনার সঙ্গে বসেই ও ইন্টারভিউ নেয়। সেদিন ওনাকে চিনতে পারে নি। ও জানত না বাবার সংগে উনার ভাব আছে। আর উনি অন্য কেউ নন সুহাসবাবু, রীতার বাবা, যার সম্পর্কে সে বিপিনবাবুর কাছেই জানতে পারে।
তারপর আমাদের মধ্যে নানা কথাবার্তা শুরু হয়। সেই কলেজের কথা। ইউনয়ন গঠন সুহাসের রাজনীতি এসব। কাজলের কথাও। কাজলের কথার সঙ্গে ঊষাদেবী উঠে আসেন। আমি বা বিপিন যে কথার জন্য উদগ্রীব সেটা তোলার সুযোগ পাই। জানতে চাই এখন সুহাস কেমন আছে এখন কি করছে। ওর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি। সুহাস কিছুই গোপন করে না। ওর জেল জীবন তারপরের জীবনের কথা বলে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে না। আমি সেটা উস্কে দেবার জন্য ঊষার কথা রন্টুর কথা বার বার তুলি। কিন্তু আমরা ওর বর্তমান জীবনের কথা যা শুনেছি তা জানতে পারি না । আমাদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমি তখন ঊষার ওর ভাইয়ের সঙ্গে থাকার কথা ওর অসুস্থতার কথা বলি। সুহাস কোথায় কার সঙ্গে থাকে তা জানতে চাই। এবার সুহাস মুখ খোলে। ও জানায় রাজনীতিগত ভাবে দলের সঙ্গে ওর মত বিরোধ হয়েছে। ও মনে করে পূরণ ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে দলের কাজে। তবে এখন অনেকেই সেটা মানছে না।এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধ করলে দলে ভাঙ্গন ধরতে পারে। তাই সুহাস চুপ করে সরে আছে। ওর আশা দল যখন ভুল বুঝবে তখন আপনা থেকে দূরত্ব কমবে। এ বিষয় গুলো নিয়ে আমাদের উৎসাহ থাকলেও ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমরা বেশি উৎসাহী। আমি আবার জানতে চাই ঊষাদেবীর খবর কি? উনার চিকিৎসার কি হচ্ছে? সুহাস বলে:
“ কেন তোমরা জান না? ও মারা গেছে”
আমরা আকাশ থেকে পড়ি। আমি বলি:
“ রন্টু বলল যে ওর মা মামার ওখানে থাকে। ও অসুস্থ”। সুহাস বলে:
“ ওটা রন্টু বলে কারণ ওকে সেটাই বলতে বলা হয়েছিল। ঊষা বেশ কিছুদিন হল আমার ওখানে গিয়েই থাকত। সবাই জানত ও একজন আদিবাসী মহিলা আমার সঙ্গে থাকে । দলের নির্দ্দেশে ও ওখানে মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বে ছিল। সেই সূত্রে ওদের মধ্যে রাজনীতির কাজও করত। বছর তিনেক আগে ও যে গ্রামে কাজ করত সেখানে ম্যালেরিয়া হানা দেয়। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ওখানে মারাত্মক। তাতে মৃত্যুর হার আজ কবিড থেকে কম নয়। আর সেটা প্রধানত গরিব মানুষের ঘরেই হানা দেয়। তাতে কাজল মানে তোমাদের উষা মারা যায়। এটা খবরের কাগজে বের হয়। তবে ঊষা অন্য নামে ছিল। ওখানকার বাইরের জগৎ ঊষা নামে কেউ মারা গেছে বলে জানে না। পুলিশ সাংবাদিক কেউ না। এটা বোধ হয় আমার ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পার্টির স্বার্থে বিপ্লবের স্বার্থে আমাকে মেনে নিতেই হয়। ওর আত্মত্যাগ অমর হয়ে থাকবে “
আমি আর বিপিন পরস্পর মুখের দিকে তাকাই। এটাই তবে সুহাসের আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে বসবাসের গল্প।
৫
উনাকে কেউ সরেসদা আবার কেউ সরেসবাবু বলে ডাকেন। সুরেশ বসু নাম হলেও ওনাকে কেউ সুরেশ বাবু বা সুরেশদা বলেন না। ওই নামটা যে উনার সেটাই আমরা কয়েকজন কাছের লোক ছাড়া অন্যেরা জানেন না। অনেকে সত্যিকারের নামটা ভুলেই গেছেন।শহরের ক্লান্তিকর পরিবেশ থেকে দূরে কল্যানীর একপ্রান্তে সরেসবাবুর ছোট্ট বাড়ি। সরকারি অফিস থেকে অবসরের পর এই বাড়ি করে তিনি এখানের নিজ বাড়ির পাকা বাসিন্দা হয়েছেন। তবে কলকাতার পরিচিত মহল ওনাকে এখনও টানে। প্রতিসপ্তাহেই সেখানে কফি হাউসে আড্ডায় এখনো যান। কখনো কখনো দাদার বাড়ি বা বন্ধুর বাড়িতে কলকাতায় থাকেন। এখানে স্ত্রী আর উনি একা। স্ত্রী আছেন। একা বলি কি করে! যদিও বাঙালি হিন্দু পরিবারে একে একে এক। আজ আমরা মনে করি দুজনে দুটো সত্তা। তাই একা নন দোকা। আজকাল আমিও ওখানে থাকি।কার্যত এটাই আমার পৈতৃক ভিটে।
সরেসবাবুদের ছেলে মেয়ে দুজনেই ভিন প্রদেশে। ছেলে ও ছেলের বউ দুজনেই চাকরিরত আর সেই সূত্রে ভিনপ্রদেশ বেঙ্গালোরে । আর মেয়ে জামাইয়ের চাকরির দৌলতে তার সঙ্গে বোম্বেতে। সেই সূত্রে বছরে কিছু সময় ধরে সরেসবাবু ঘর ছাড়া। ছেলে মেয়ের সঙ্গে কাটে। বয়স হয়েছে। শারীরিক কারণে পরনির্ভরশীলতা বেড়েছে। তাই ছেলে মেয়ে এখানকার বাস উঠিয়ে ওখানে ওদের কারও একজনের সঙ্গে বা পালা করে দুজনের ওখানে থাকার কথা বললে সেটা সরেসবাবু অস্বীকার করতে পারেন না । হয়তো ভবিষ্যতে সেটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু এখনই সরেসবাবু সেটা চান না নিজের জীবন সবটা বর্জন করে। যদিও স্ত্রীর এতে আপত্তি নেই। ওনার মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে বেশ কাটে। কিন্তু সরেসবাবু সেটায় এখনই রাজি নন বলে স্ত্রী এ ব্যাপারে চুপ। আর তাঁর চুপ থাকাটাই সরেসবাবুর পক্ষে বিড়ম্বনা। মনে হয় উনি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চুপ থাকেন। বরং নিজের মত প্রকাশ করলে ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানালে একটু অশান্তি হয় তো হতো কিন্তু এই বিড়ম্বনাটা থাকত না। যে সব মেয়েরা আমাদের সমাজে নিজের ইচ্ছেকে দমন করে থাকে তাদের নিয়ে এই সমস্যাটা দেখা যায়। এছাড়া একটা ব্যাপার আছে। ছেলে মেয়েদের জীবন ধারণ আর আগের যুগের পুরনো ধাঁচের মানুষের জীবনধারণ ভাবনা চিন্তার মধ্যে একটা সংঘাত আছে। সেটাকে এড়িয়ে চলতে গেলে যতদিন সম্ভব আলাদা থাকাই ভালো। সরেস বাবুর এই যুক্তিটাকে স্ত্রী সুব্রতা অস্বীকার করতে পারেন না। এটা অল্প বিস্তর হলেও ওনার পক্ষেও সত্যি। আর কলকাতায় ভাই বোন পরিচিত সবাই যাদের সঙ্গে একই ভাষায় গল্প গুজব করা যায়। তাই একটা পেছন টান ওনারও আছে।
সরেস বাবু মিশুকে প্রাণবন্ত সরেস মানুষ। তিনি তাঁর জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে অন্তত এই সরেস ডাকটার প্রতি সুবিচার করে গেছেন। জনপ্রিয় ওই নামটা ছাড়া ওনার নামডাক খুব একটা নেই। পরিচিতির ছোট গন্ডির মধ্যে সরেসবাবু যথেষ্ট জনপ্রিয়। আলাপে প্রলাপে দক্ষ। নিজের বয়স হলেও অল্প বয়স্কদের মধ্যে উনি এখনও যুবক। হাসি ঠাট্টা টিকা টিপ্পনীতে উনি সত্যি এক রসিক পুরুষ। কিন্তু আপাত এই হালকা চালের মানুষটার গভীরে এক সত্যনিষ্ঠ গম্ভীর মানুষ যেন লুকিয়ে থাকে। যেটা উনি বিশ্বাস করেন সেটা বললে কেউ ক্ষুন্ন হবে ভেবে তিন পিছিয়ে থাকেন না। এই নিয়ে ঘরে বাইরে তার বিবাদ। সক্রিয় ভাবে এখন আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও কোন আন্দোলন মিটিং মিছিলে এখনও পা মেলাতে চেষ্টা করেন। সে সূত্র ধরে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ।
এখন বয়স হয়েছে। আগে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সরেস বাবু।লেখালেখি নিয়ে থাকেন। সাবেকি সমাজ আন্দোলনের ভাবনার সঙ্গে এখন বৃদ্ধদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর সমাজ ভাবনা। তাঁদের সুস্থ থাকা, অসুস্থ হলে যথারীতি চিকিৎসার ব্যবস্থা এসব নিয়ে তাঁর ভাবনা। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা। এর সঙ্গে একটা বিষয় তাঁকে বিশেষ ভাবে ভাবায়। এ নিয়ে পরিচিত অপরিচিত মহলে বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। অবশ্য কাউকে কাউকে তিনি সহমতে পেয়ে যান। বিষয়টা হল বার্ধক্যে অসুস্থ থাকাকালীন যখন শরীর আর নিতে পারে না তখন পরিণতির অনিবার্যতা। অথচ তাকে পরিবারের সবার মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে পরিবারকে সর্বশান্ত করে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার প্রথাগত চেষ্টার তিনি বিরোধী। এই অবস্থায় তিনি ইচ্ছামৃত্যুকে অধিকার বলে সরকারের মেনে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন। উনি উদাহরণ তুলে বলেন কি দুরবস্থা ও মানসিক কষ্টের মধ্যে মা বিছানায় অসুস্থ ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আদালতে ছেলের স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দাবি করতে বাধ্য হয়। আদালত তা মেনে না নেওয়াকে অমানবিক বলে মনে করেন সরেসবাবু। এই নিয়ে যুক্তি তর্কে বসলে অনেকে বলেন সম্পত্তির লোভে এই সুযোগ নিয়ে ছেলে মেয়েরা বাবা বা মায়ের হত্যা মৃত্যুকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলে চালাবে তাই এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই মতের সঙ্গে সরেসবাবুর একমত নন। তাঁর মতে এমন কোন নিয়ম দেশে আছে কি যার অপব্যবহার হয় না? এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হিসেবে একটা দুটো অঘটন ঘটলেও পরপ্রজন্মের প্রতি এ ধরণের অবিশ্বাস উনার মতে ঠিক নয়। তাহলে কোন নিয়মই চালু করা চলে না। আবার অনেকের মতে জন্ম মৃত্যুতে মানুষের হাত নেই। দুটোই ওপরওয়ালার হাতে। সেখানে উনার মতে তাহলেতো জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করা চলে না। জন্মনিরোধক ওষুধ ব্যবহার করা অপরাধ। আমরা জানি অনাকাঙ্খিত সন্তান সম্ভাবনা দেখা দিলে ভ্রূণ হত্যা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা নিয়মিত ওপরওয়ালার বিধান ভাঙ্গি। অথচ একজন কষ্টরত বৃদ্ধ যার প্রয়ান আজ বা কাল অনিবার্য তাকে বিছানায় কষ্ট দিয়ে পরিবারকে সর্বশান্ত করে সবার নিরানন্দের কারণ হয়ে বাঁচিয়ে রেখে কোন উপরওয়ালার বিধান মানা হয় সেটা সরেসবাবুর তা বোধগম্য হয় না। তিনি ইচ্ছামৃত্যুকে একটা অধিকার বলেই মনে করেন। আরও ভাবেন যে এই নিয়ম চালু হলে মানুষও এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে প্রাথমিক পর্যায়ে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হলেও। এ নিয়ে সরেসবাবু আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে। কারো কারোকে সঙ্গে পেলেও এ নিয়ে তিনি তেমন সাড়া পান না। আন্দোলন গড়ে ওঠে না। একে উনি মানুষের পিছিয়ে থাকা চিন্তার ফল বলে মনে করেন। ভাবেন আজকের সমাজজীবনে বৃদ্ধদের অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে করোনার মতো ভাইরাস একে যেমন সংকটাকীর্ন করে তুলছে তাতে আগামীদিন এই দাবিটা উঠতে বাধ্য।
এখন সরেসবাবুর ছেলে বদলি হয়ে কলকাতায়। সঙ্গে বৌমাও। সরেসবাবুর সঙ্গে থাকে। নাতি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছেলে ছেলের বউ নাতি স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দে আছেন। স্ত্রী নাতির পড়াশুনা দেখেন। একসঙ্গে টিভি দেখা কেরাম খেলা নিয়ে নাতির সঙ্গে ভালই কাটে। এই আনন্দের সংসারে যেন যতদিন পারা যায় কাটিয়ে যাওয়া। বার্ধক্যে সবাইকে নিয়ে এই চলার আনন্দ ভোগ করার জন্যই সরেসবাবুর বেঁচে থাকা। শরীরটা ভেঙে পড়লেও এখনো সম্পূর্ণ অচল হয় নি। এরই মধ্যে বেরন।তবে বুঝতে পারছেন যখন তখন বসে যেতে পারেন। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস। আর বয়সজনিত সমস্যাতো আছেই। তবে সরেসবাবু দমতে রাজি না। এর মধ্যেই নিজের লেখাপড়া। তবে ছেলে মেয়ের এখনকার জীবন যাপন তাদের ব্যক্তি ভবিষ্যত নিয়ে ধারণা এসব নিয়ে ছেলের সঙ্গে বিরোধ দেখা যায়। স্ত্রী চুপ করতে বলে। মেয়ে ফোনে ছেলের পক্ষ নে। এ নিয়ে বিরোধ যেন বেড়ে চলেছে। আজকাল স্ত্রীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা।আর এসব বিরোধ ঘরে বন্দি থাকে না। বাইরে সাতকানে পৌঁছায় যে না তা নয়। তবে তাতে সরেস বাবুর কিছু আসে যায় না। সরেস বাবু জানে সব সংসারে এসব থাকে। তবে তিনি এটাও জানেন যে অন্যান্য অনেকের থেকে উনি ভালো আছেন। আর ছেলে বা মেযে সব সময় তার সঙ্গে আপদে বিপদে। আর বউ মাকে নিয়ে কোন সমস্যাই নেই। স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনদিন অভিযোগ ছিল না আজও নেই। তবে মতবিরোধ যখন হয় তখন তা তুঙ্গে। এছাড়া ভাই বোনদের সঙ্গে সরেস বাবুর মোটামুটি সুসম্পর্ক। এখনো পূরণ যৌথ পরিবারের রেশটা এ বাড়িতে আনাচে কানাচে উঁকি মারে।
আজকাল পাড়ায় আড্ডায় বিশেষ কেউ আসে না। বাজার যাতায়াতের পথ অনুসরণ করে যে কজন বের হন তাদের সস্নিদ্ধ চোখ খুঁজে ফেরে । যদি কাউকে পাওয়া যায় জমে থাকা মনের কথা বলার জন্য। সরেসাবুর তেমন খবর নেই। মিশুকে সবার প্রিয় আড্ডার মধ্যমণি মানুষটা যেন হারিয়ে গেছে। করোনা র দৌলতে কেউ কারো বাড়ি তেমন যায় না তাই খবর পাওয়া যায় না। আমরা জানি কোমরে একটা চোট লাগায় সরেসবাবু আজকাল একেবারেই বেরোতে পারেন না। আজ বাজারে শোনা গেল উনার কভিড হোয়েছে। খবরটা শুনে সকলের মন খারাপ। খবরটা কতটা সত্যি জানা দরকার। হঠাৎ বিশু বাবুর সঙ্গে আমার দেখা । উনাকে জিজ্ঞাসা করেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। দুজনে ঠিক করলাম সরেস বাবুর বাড়ি গিয়ে খবর নেব। পরের দিন রবিবার সরেস বাবুর বাড়িতে আমি আর বিশুবাবু। বাড়িতে সবাই আছে। সরেস বাবু বিছানায়। আমাদের দেখে স্বভাবসুলভ হাসি উনার মুখে উপচে পড়ল। কেমন আছেন জানতে চাইলে কোমরের ব্যাথার কথা বললেন। আমরা করোনার কথা জানতে ইচ্ছুক থাকলেও সেটা জানতে চাইতে পারছি না। সংকোচে একটু বেশি দুরত্ব রেখে চলছি। এমনিতেই ভাবনার জগতে একটা অস্পৃশ্যতার রোগের ছোঁয়া। অস্বীকার করা যায় না। এই রোগটা আজ সবাইকে আক্রমণ করেছে। সরেস বাবু বুদ্ধিমান লোক। আমাদের অস্বস্তির দিকটা বোঝেন। নিজে থেকেই বলেন:
‘‘ছেলে বলল বাজারে রটেছে আমার নাকি করোনা হয়েছে। আজ এটা খুব স্বাভাবিক। যদি সত্যি সত্যি করোনা হয় তবে অবাক হবার কিছু নয়। শরীরে ব্যাথা ঠান্ডা লাগা সব নিয়ে আমিও ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আর আমার ভয়টা শুধু করোনা নিয়ে নয়। করোনা চিকিৎসা নিয়ে। তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে। কিছু হলে যন্ত্রণা সবার। বাড়িতে এতগুলো লোক। আমার জন্য ওদের সারাজীবন বিপন্ন। শুধু রোগ নয়। বেসামাল অর্থ খরচ। কে সামলাবে বলুন? সেজন্যই আমার বরাবরের স্বেচ্ছা মৃত্যুর দাবি।”
আমরা তখনও বুঝি নি উনার করোনা হয়ছে কি না। ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে। উনার স্ত্রী চা করতে গেছেন। ছেলের কথায় আমরা আশ্বস্ত হলাম। ছেলে জানাল:
‘‘দেখুন না কাকু, বাবার সেই চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়েছে। স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকার। করোনার ভয় সেটাকে জিগিয়ে তুলেছে। যাই হোক করোনা টেষ্ট করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায় নি। কোমরের চোট টাও তেমন কিছু নয় বলে ডাক্তার জানিয়েছেন। উনার ভয় যদি করোনা হয় যদি বিছানায় পড়েন তবে আমাদের কি হবে। বোঝাতে পারছি না বয়স হলে এগুলো সঙ্গী।” সরেসবাবুর লেখা একটা চিরকুট ছেলে তুলে ধরে তাতে লেখা :
“ যদি আমার কভিড হয় আর আমাকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ গ্রহণ করতে হয় তবে আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। এটা আমার স্বেচ্ছা মৃত্যু। যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তবে তা হল রাষ্ট্রের স্বেচ্ছামৃত্যুর দাবিকে অস্বীকার।যদি এই দাবি মান্যতা পেত তবে আমার ইচ্ছা অনুযায়ী আমি আরও কিছুদিন এই পৃথিবীতে থাকতে পারতাম। প্রিয়জনদের ছেড়ে আমি চলে যেতে চাই না। তাও এটা যে অনিবার্যতা আজ হোক কাল। আমি এও চাই না যে অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে প্রিয়জনের স্বাভাবিক সুন্দর জীবন বিপন্ন করে তুলি, চিকিৎসা ব্যবসার খপ্পরে পড়ে তারা নিঃস্ব হোক। তাই কিছুটা আগেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। পরে অসুস্থ অবস্থায় হয়তো সেটা সম্ভব হবে না। পড়ে থাকতে হবে মৃত্যু শয্যায়। সেটা এড়াতে আমার এই স্বেচ্ছামৃত্যু। স্বেচ্ছামৃত্যুর সোচ্চার দাবি।”
আমরা পড়ে হাসি।তবে কি উনি করোনা ধরে নিয়ে ভয়ে এরকম একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু উনিত এত দুর্বল মনের লোকতো নন। আমরা জানতে চাই। উনি বলেন:
‘‘ হ্যাঁ ভয়ে । তবে করোনার ভয়ে নয়। চিকিৎসার ভয়ে, বিছানায় অক্ষম হতে পড়ে থাকার ভয়ে, অন্যদের কি হবে সেই ভয়ে আর সর্বোপরি আমার অধিকারের দাবিতে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে।‘‘
ছেলে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে।
যাই হোক আমরা বিরম্বনা মুক্ত। করোনার ভয়টা কাটে। এরপর সরেস বাবু তার স্বমূর্তিতে। চুটিয়ে অনেকদিন পর আড্ডা। নানা কথা। আজ মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। করোনার আবহে ছাঁটাই হয়ে চলেছে, ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ। এরই মধ্যে নিরবে নতুন শ্রম আইন কৃষি আইন । একটার পর একটা সংস্কার। চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা। সরকার লেজে গোবরে। পৃথিবীজুড়ে করোনা আর আর্থিক সংকটের দ্বৈত আক্রমণ আলোচনায় উঠে আসে। আলোচনা শেষে সবাই তৃপ্ত। অন্তত এই দুঘন্টা আমাদের মুক্ত মন। করোনা আতংক পালায়। আমরা বুঝি সরেস বাবু সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা আবার ছন্দে ফিরব। বেলা হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। করোনা আপদ থাকলেও সে অনেকটা মানুষের শরীরের নিরাপদ আশ্রয়ে। যদিও কখনও কখনো কারো কারো শরীরে মারাত্মক বিবাদী হয়ে ওঠে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে আবার সেরে উঠছে। আমরা বুঝে গেছি এ নিয়েই বাঁচতে হবে। সবাই বের হচ্ছে। কাজ কর্ম শুরু হয়েছে। তবে দেশে ব্যাপক কর্মহীনতা। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার দূর অস্ত। পরিবেশ দূষণ যুদ্ধের আবহ মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে। নতুন কৃষি নীতির দৌলতে জমি অকৃষি সম্প্রদায়ের হাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কৃষি কাজের সুযোগ কমছে।এর ফলে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। মানুষের প্রতিবাদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ ভেঙে চুরমার। বিচারবিভাগ তার নিজস্ব স্বত্বা হারাতে বসেছে। এদিকে লক ডাউন উঠে গেছে। রাষ্ট্র আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ আর ঘরে বসে থাকছে না যদিও করোনার ভয়ে যে সামাজিক বন্ধনটা আলগা হোয়ছে তার রেশটা থেকে গেছে। আমাদের আড্ডার বহর ছোট আকারে হলেও আবার জমে উঠেছে। আর সরেস বাবু এলে তো কথাই নেই। তবে উনি মধ্যে মধ্যে উধাও হয়ে যান। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করেন এমন উনার কিছু বন্ধু আছে তাদের কাছে চলে যান। তাদের সঙ্গে পাহাড়ে জঙ্গলে সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়ার নেশাটা আবার পেয়ে বসেছে। এক একটা এলাকা ঘুরে এসে সেখানকার মানুষ সেখানকার পরিবেশ নিয়ে উনার রসালো আলাপ আড্ডাকে নতুন মাত্রা দেয়। আমাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে।
আজ মানুষের মধ্যেকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভ যেন একটা মোহনায় মিলতে চলেছে। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের ডাকে সামিল হয়ে শ্রমজীবি মানুষ তাদের অধিকারের কথাও বলছে। আবার শ্রমিকদের আন্দোলনে পরিবেশবিদরাও যুক্ত হচ্ছে। করোনাই বোধ হয় একে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করছে। মানুষের শ্রম সময় বাড়িয়ে তাকে কম্পিউটারমুখী করে মানুষের স্বাস্থ্যের যে বারোটা বাঝছে সেটা দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। একটা মনোরোগ সমাজকে গ্রাস করছে। আর জমি অকৃষি সম্প্রদায়ের হাতে গিয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার বাধ্যমে যে পরিবেশ দূষণ বাড়াবে সেটা মানুষ বুঝতে পারছে। খনির অধিকার কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যে আজকের কৃষি সংস্কার কাজ করবে সেটা পরিষ্কার হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য বেনিয়া মাফিয়াদের হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অগ্নিগর্ভ অবস্থা যা রাষ্ট্র বলের প্রয়োগ করে ছাই চাপা দিয়ে রাখছে। আপাতভাবে অবস্থা শান্ত। রাষ্ট্র নিশ্চিন্ত। কিন্তু মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের দাবি দানা বাঁধছে। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ জানান না দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে।
হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে পাড়ায় সবাই স্তম্ভিত উদ্বিগ্ন। ঝাড়খন্ড ছত্তিশগড় বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল ধরে মানুষ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার। বিরাট জমায়েত। রাষ্ট্র জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু মানুষ উত্তাল। পরিবেশবিদরা পরিবেশ রক্ষার দাবিতে, মানুষ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের অধিকারের দাবিতে রুটি রোজগারের দাবিতে কৃষি জমি অকৃষিবিভাগে স্থানান্তরিত হতে না দেওয়ার দাবিতে বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ। তা সামলাতে পুলিশ গুলি চালায়, ব্যাপক গ্রেপ্তার করে। জনা কুড়ি মানুষ গুলিতে মারা যায়। মারা যাওয়ার তালিকায় সুরেশ বোসের নাম দেখা যায় যার বাড়ি পশ্চিম বঙ্গে। আমাদের সরেস বাবুর নাম। আমরা জানি উনি উনার পরিবেশবিদ বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়েছেন। নামটা দেখে আমাদের সংশয় হয়। আর আমি আরেকটা নাম পাই যিনি ধরা পড়েন। একজন মহিলা সাংবাদিক যাঁর নাম রীতা । আমার মনে খটকা লাগে । ভেসে ওঠে সুহাস কাজলের নাম যাদের আমি চিনতাম। আর পরের প্রজন্মকে যেন দেখি ঝর্ণার কলতানে, পাহাড় শিখর থেকে তুষার গলে ঝর্ণা হয়ে নেমে এসে মেলে নদী মোহনায়। কাজল বেঁচে নেই সুহাসের খবর পাই না। তবে ওদের ছেলে রন্টুর সঙ্গে আমার এখনও যোগ আছে। ওদের পরিচয় এই কলমেই পাঠকরা আগে পেয়েছেন। আমি একে একে দুই করার চেষ্টা করি। মেলাবার চেষ্টা করি। কোথায় যেন একটা ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। সময় নষ্ট না করে সরেসবাবুর বাড়ি যাই। জানতে পারি ওর ছেলে বাবার খবর পেয়েছে। বাবার মৃতদেহ আনতে চলে গেছে ভিন প্রদেশে।
৬
বেশ কিছু সময় কেটেছে। এখন রিঙ্কু শহর থেকে দূরে মফস্বলে কোন এক আধা শহরে এক কামরা একটা ঘরে ভাড়া থাকে। এখন বয়স পঞ্চাশ উর্ধে। সঙ্গে স্ত্রী। অঞ্চলের ছেলে মেয়েদের দুজনে মিলে পড়িয়ে যে সামান্য রোজগার তা দিয়ে চলে যায়। ওদের সন্তান নেই। রিঙ্কু পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার নেই। আমাদের পূর্ব পরিচিত সেই স্কুলে পড়া ছেলেটি। ভালো গান বাজনায়। বাবা আমাদের সুহাস আর মা কাজল দুজনেই গত হয়েছেন আমরা জানি। দিদি রীতা সাংবাদিকতার কাজেই যুক্ত। সে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। কলকাতায় থাকে। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে মধ্যে মধ্যে আসে। রিঙ্কুও দিদির ওখানে যায়। রীতার দুই মেয়ে। তারাও এখন বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত। বাবা মায়ের উত্তরাধিকার বহন করে দুজনেই চলে। সমাজের সমস্যা দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। তা নিয়ে ভাবে। এ নিয়ে কি করা দরকার তা নিয়ে দাবিতে সোচ্চার হয়। রাষ্ট্রের ভুল নীতির বিরোধিতায় আন্দোলনে যুক্ত হয়। বাবা মায়ের উত্তরাধিকার বহন করলেই তাদের চিন্তাভাবনা যার যার চেতনার খাতে প্রবাহিত। সব কিছুতে মিল পাওয়া যায় না আবার মৌলিক কিছু বিষয়ে মিল আছে।আপাতদৃষ্টিতে অমিলটা প্রকট হলেও এর অন্তঃস্থলে যে মৌলিক মিল আছে তা হয়তো আগামী দিনে তাদের একই খাতে বইতে দেখা যাবে।
আজের সমাজে উগ্র শিল্পায়নের মুখে বিশেষ করে ভারতসহ সব আফ্রিকা এশিয়ার পিছিয়ে পড়া দেশগুলো যে পরিবেশ বৈচিত্র হারিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কবলে ধ্বংসের মুখে সেটা রিঙ্কুদের ভাবায়। একদিকে রুটি রোজগারের অভাব অপরদিকে পরিবেশ ধ্বংস। ভোগবাদের দরুন ভোগের লালসা এক কৃত্রিম ভোগ বিলাসী জীবন যেমন পরিবেশ দূষণের কারণ তেমনি কম জমিতে বেশি উৎপাদন রাসায়নিক শিল্পে লাভ ঘরে তোলার তাড়নায় কৃষি উৎপাদনে নয়া কৃষি প্রযুক্তি পরিবেশ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্য দূষণ জমির অবক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে। উন্নত আগ্রাসী দেশগুলো এর সুযোগ নিয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে শোষণ করে চলেছে। আর রাষ্ট্র এর তাবেদারী করছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করে রিন্টুরা। তারা ভাবে তাদের পূর্বসূরীরা এই দিকটা অবহেলা করে কেবল রুটি রোজগারের তাগিদকে কেন্দ্র করে শ্রেণী সংগ্রামকে দেখেছেন আর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা না বলে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলাকে একধরনের সৌখিন রাজনীতি বলে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। কার্ল মার্কসের যুগে পরিবেশ দূষণের বিষয়টা এত ভয়ঙ্কর আকার নেয় নি বলে তা ধ্রুপদী মার্ক্সবাদে তেমন গুরুত্ব পায় নি। কিন্তু আজ অবস্থা বদলেছে। পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে পশ্চাদপদ একটা দেশকে যে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দিচ্ছে গরিব মানুষরাই যে প্রধানত এর ফল ভোগ করছে সেটা পরিবেশ বিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। আক্রান্ত দেশগুলোর রুখে দাঁড়ানো দরকার। এই পরিবেশ দূষণ অবস্থাপন্ন মানুষদের জীবনও বিপর্যস্ত করে চলেছে। মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে ভোগবাদ তাদের জীবনের প্রকৃত আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে। আর বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির সুষ্ঠ ব্যবহার, সাধারণ মানুষের জীবনে তাকে নিয়ে যাওয়া আজ যে শ্রেণীর লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত সেটা বোঝা দরকার বলে রন্টুরা মনে করে। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি যেমন উৎপাদন প্রণালীতে একটা মৌলিক বদল এনেছে তেমনি মানুষের মনন প্রক্রিয়ায় জীবন ধারার পরিবর্তনে বদল আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর সবটার অভিমুখ কর্পোরেট স্বার্থ তার প্রাধান্যবাদ। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শ্রমজীবী মানুষ দেশপ্রেমিক মানুষ পরিবেশবিদদের একজোট হতে হয়। গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। তিনটে খাতে বয়ে যাওয়া আন্দোলনকে একটা মোহনায় মিলতে হয়। ভারতের মাওবাদী দল অনুসৃত শুধু খতম অভিযানের মাধ্যমে শুধু সমরবাদ দিয়ে এ লড়াইয়ের সামগ্রীকতা ধরা যায় না বলে রিঙ্কুরা মনে করে। বিষয়টা নিয়ে তারা আজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিভিন্ন মার্ক্সবাদী সংগঠনের সঙ্গে আলাপে উৎসাহী। তাদেরকেও আজ আন্দোলনের ভ্রাতৃপ্রতিম শক্তি হিসেবে পেতে চায়। তারা চরমপন্থীদের গণআন্দোলনকে পরিহার করার বিষয়টা মেনে নিতে পারে না।
রিঙ্কুর দিদি রীতার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিরোধটা মিটে গেছে। তারা আবার একসঙ্গে জীবন যাপন করছে। তাদের দুই মেয়ে। রীতা সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে বরাবরই সরব। সাংবাদিকতার সূত্রে সে ভারতে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করে। বিশেষ করে ছত্তিশগড় ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা উত্তর কর্নাটকের বিভিন্ন খনিজ অঞ্চল তার ঘোরা। সেখানে আদিবাসী দলিত মানুষের দুরবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আজ ভূমি সন্তানদের উৎখাত করে খনিজ সম্পদের ওপর অধিকার কায়েম করতে দেশি বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা কেমন তৎপর সে সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল। সেখানকার মানুষের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই নিয়ে লেখালেখি করে বলে সে রাষ্ট্রের কুনজরে। দু একবার গ্রেপ্তার হয়। ভারতের ধর্ম বর্ণ নিয়ে যে বিভাজন আর রাষ্ট্র তাকে কিভাবে ব্যবহার করে সেটা সে দেখেছে। রুটি রোজগারের লড়াইয়ের সঙ্গে এই দলিত সমাজ আদিবাসী সমাজের সমস্যাকে একটা সূত্রে কিভাবে বাঁধা যায় সেটা নিয়ে সে ভাবে। এর সঙ্গে নয়াউদারনীতিবাদ কিভাবে কর্পোরেট দুনিয়ার এই লুঠের রাজকে আজ ভয়ঙ্কর করে তুলেছে তা সে প্রত্যক্ষ করে। সেখানে যে লড়াই চলছে সেখানে ধ্রুপদী মার্কসবাদের তাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারতের বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিচার করার বিষয়টায় ঘাটতি রয়ে গেছে বলে রীতারা মনে করে। এর সঙ্গে সমাজের মননের পরিবর্তন দরকার। মানুষকে আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে ভোগবাদ বর্জন করে গরিবমানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। সেটা বিপ্লবএর পর দেখা যাবে বলে এড়িয়ে গেলে এ লড়াই সামগ্রীকতায় দানা বাঁধতে পারে না বলে রীতারা মনে করে। এর জন্য বস্তুভিত্তিক লড়াইয়ের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক লড়াইকে যুক্ত করতে হয় বলে তারা মনে করে। গড়ে তুলতে হয় বর্ণ ধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে লড়াই।
রীতার বড় মেয়ে আবার ভারতে মাওবাদী দলের সমর্থক। মধ্যে মধ্যে মাওবাদী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে ওর যাতায়াত। ও রিঙ্কুর ভাবনাকে কটাক্ষ করে। ওর গণআন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রাখাকে সংস্কারবাদী সুবিধাবাদী বলে হেয় করে। আবার রিঙ্কু ওকে সমরবাদী হটকারী রাজনীতির প্রবক্তা বলে। দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ তর্কবিতর্ক। আবার দুজনেই রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে লালগড় নন্দীগ্রামের আন্দোলনে দুজনে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করে। দুজনের মধ্যে একত্রিত হওয়ার আগ্রহ থাকলেও একজনের পার্টি লাইন আর আরেকজনের পার্টিবিহীন গণআন্দোলনের ধারণা দুজনকে মিলতে দেয় না। কিন্তু আন্দোলন ও তার সাফল্য ব্যর্থতা দুজনকেই কি ভাবে একত্রিত হওয়া যায় সেই ভাবনায় ভাবিত করে। রীতার মেয়ে কঙ্কা মুখে যাই বলুক গণআন্দোলনকে অস্বীকার করতে পারে না। পরিবেশের প্রশ্নটাও আজ সামনে এসে পড়ে। এছাড়া আছে ভারতের অর্থনীতিতে সমাজজীবনে কর্পোরেট সংস্থার প্রধান্যবাদের প্রশ্নটা।
তার বড় মেয়ে কঙ্কাকে নিয়ে রীতার নানা চিন্তা। ও ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সুব্রতর প্রেমে পড়েছে। সুব্রত পড়াশুনা ছেড়ে বিপ্লবী কাজকেই নিজের জীবন বলে গ্রহণ করেছে। বাড়ী ঘর ছাড়া পলাতক জীবন। পুলিশ খুঁজে বেড়ায়। ওদের দুজনের গোপন যোগাযোগ আছে যার সবটা নাগাল পায় না রীতা। আদর্শের দিক থেকে সুব্রত শ্রদ্ধার পাত্র হলেও রীতার ভয়। ও দেখেছে বিপ্লবী আন্দোলনে যখন ভাঁটার টান তখন অনেক বিপ্লবী হতাশায় নিমজ্জিত হয় গোপন জীবন থেকে বেরিয়ে এসে হতাশায় ভোগে। পড়াশুনা শেষ হয় নি আবার বেরিয়ে চাকরি নেই এই অবস্থায় কেউ যেন নিজেকে দায় বলে মনে করে। কঠিন বাস্তবের মোকাবিলা করতে পারে না। তখন তার মনে হয় ভুল করেছে কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। যেন না ঘরকা না ঘাটকা। আবার অনেকে গোপন জীবনযাপন করলেও নিজে এই ব্যবস্থার কুপ্রথাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেরিয়ে আসতে পারে না। এদের অনেকের মধ্যে অসংযত বেপরোয়া জীবন যাপনের ধরণ দেখা যায়। ছেলেদের মধ্যে পুরুষতন্ত্র কাজ করে। এটা রীতা আদিবাসী সমাজে গরিব মানুষের মধ্যেও দেখেছে যেখানে মেয়েরা জীবিকার জন্য মাঠে কলে কারখানায় কাজ করে। আর এটা মধ্যবিত্ত শহরে ছেলেদের মধ্যে দেখা যায়। পার্টি জীবনের সুস্থ জীবনযাপনের অনুশীলনের অভাবে এটা ব্যাপক। এর ফলে মুখে বিপ্লবী হলেও নারীপুরুষের সম্পর্কে ব্যাপারে তার ঘাটতি দেখা যায়। পরস্পর সহনশীলতা শ্রদ্ধার অভাবের জন্য সম্পর্কটা অনেকের ক্ষেত্রে ভঙ্গুর হয়। এর ফলে সম্পর্কটা বেশিদিন টেকে না। রীতার কাছে এটা চিন্তার। সুব্রতকে আদর্শ ছেলে মনে হলেও ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে রীতার দুশ্চিন্তা। সে মনে করে এই সমস্যা সমাধানের উপায় ব্যক্তিজীবনে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। যাই হোক নিশ্চয়তার পূর্বশর্ত দিয়ে কোন সম্পর্ক গড়া যায় না সেটা রীতা বোঝে। তাও তার ভেতর দ্বন্দ্ব। অবশ্য বাবা মায়ের মধ্যেকার আদর্শ সম্পর্কটা তাদের বিপ্লবী জীবনে ভাঁটা আর জোয়ারেও কিরকম অটুট ছিল সেটাও রীতা দেখেছে।
ভারতে এখন একটা চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায়। দেশের মধ্যে তারা ঘোর হিন্দুত্ববাদী। মুসলমান বিদ্বেষী। আবার মুসলমান সমাজের মৌলবাদীদের মুসলমান সমাজে কর্তৃত্ব। তাই ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজিত রাখার কাজকর্ম ভয়ঙ্কর মাত্রা পেয়েছে যা আবার ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের শর্ত তৈরি না করে! আবার বর্ণবাদ দেশকে ক্ষত বিক্ষত করে রেখেছে। গরিব নিম্ন বর্ণের মানুষ এর শিকার। গরিব বড়লোকের মধ্যে শ্রেণীবিভাজন ছাড়াও ধর্ম বর্ণে মানুষে মানুষে বিভাজনটা ভারতে শ্রেনিযুদ্ধকে জটিল এক রূপ দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের কর্মসূচিকে কার্যকরী করতে তাকে ত্বরান্তিত করতে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্তরে বৃহৎ শক্তির কাছে দায় বদ্ধ। সেজন্যই সরকার আজ করোনা কালকে সামনে রেখে তার আড়ালে তথাকথিত সংস্কারের কাজকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। বেসরকারিকরণ সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিল্প ব্যাংক ইন্সুরেন্স খনি শিক্ষা স্বাস্থ্য সবই বেসরকারি হাতে বিকিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি সংস্থার অনুপ্রবেশ অবাধ হয়েছে। বিদেশি পুঁজি অবাধে ঢুকে চলেছে। এর সংগে ভোগবাদের অবাধ বিস্তৃতি। ইতিমধ্যে শ্রম আইন বদল হয়েছে নতুন কৃষিআইন ঘোষিত হয়েছে যা নিয়ে কৃষক আন্দোলন ছমাস ধরে অব্যাহত। সব মিলিয়ে অবস্থা জটিল। অথচ সত্যিকারের বাম আন্দোলন বহুদা বিভক্ত। একটা চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে আর্থ সামাজিক জীবনে।
এই সংকটের মধ্যে রিঙ্কুরা নেমেছে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে। রাষ্ট্রের কড়া নজর যেন এই আন্দোলন সমাজতন্ত্র লড়াইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে কোনরকমে যুক্ত না হতে পারে। অথচ শেষ বিচারে এই আন্দোলনের সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা যেন আজ পৃথিবীজুড়ে একটা অনিবার্যতা হয়ে দাঁড়াতে চলেছে যা সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকে একটা ভিন্ন মাত্রা দেয়। পরিবেশের আন্দোলন দাবি জানায় প্রযুক্তির উন্নতিকে সঠিকখাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়া যাতে পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়নের ফসল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এটা আর কিছু সৌখিন মানুষের সখের আন্দোলন থাকতে পারে না। এই আন্দোলন নয়া উদারনীতিবাদকে অস্বীকার করে শেষ বিচারে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশের সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন। যেখানে বৃহত্তর বামআন্দোলন নতুন ভাবে বৃহত্তর জোটের মাধ্যমে গড়ে ওঠার শর্ত তৈরী হয়েছে। তাই পরিবেশ আন্দোলনকে কর্পোরেট দুনিয়া আজ কুনজরে দেখছে। তাদের ওপরও রাষ্ট্রের বল প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ এক বিপত্তি আজ সারা বিশ্বজুড়ে। করোনার আক্রমণ। মানুষের আর্থসামাজিক জীবন তছনছ করে দিয়েছে এই রোগ। এই সংকটকালে কর্পোরেট দুনিয়া ফায়দা তুলে চলেছে। লকডাউন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিদান। সমাজ জীবনে এক বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরী হয়েছে, পারস্পরিক অস্পৃশ্যতা অথচ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে হাতে গোনা ব্যবস্থা। অসংখ্য রুগী। বেসরকারি হাসপাতাল নার্সিং হোম হয়ে উঠেছে লুঠেরার রাজত্ব। আর রাষ্ট্র নিয়ে চলেছে একের পরে এক সংস্কার কর্মসূচী। সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দিচ্ছে। খুচরো বাজার থেকে জল জমি জঙ্গল কৃষি সবক্ষেত্রে বেসরকারি বিশেষ করে বিদেশি সংস্থার অবাধ লুঠের অধিকার স্বীকৃত। কৃষি সংস্কারের নামে কৃষি জমি থেকে ফসল, ফসল নিয়ে ব্যবসা সবেতেই কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য স্থাপিত হয়ে চলেছে। প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য। ছোট ছোট ব্যবসায়ী উৎপাদকদের কর্পোরেটদের দাস বানানো হচ্ছে। উঠে যাচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীদের দিন মজুরদের ন্যূনতম জীবন যাপনের সুযোগ। এরই মধ্যে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্থান। গ্রামীন স্বার্থ গোষ্ঠীর সাথে শিল্প কর্পোরেট স্বার্থ গোষ্ঠীর বিরোধ। রাষ্ট্র কর্পোরেট স্বার্থ গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে গরিব মানুষের জীবিকা দেশের স্বার্থ যা আজের পুঁজিবাদের প্রবক্তা নয়াউদারনীতিবিদরা অস্বীকার করে।
রন্টুরা ভাবে এটাই সময়। সব আন্দোলনকে একটা ধারায় বইয়ে দেওয়ার সময়। সবার জন্যই এই সংঘর্ষের ময়দান আজ এক মহামিলন প্রাঙ্গণ। তবে রাষ্ট্রের আক্রমণ আর শুধু মাওবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ও ভাবে দিদির মেয়ে কঙ্কা কি ভাবছে। ওর তো পাত্তা নেই। সেই যে গেছে! আজকাল বাড়িতে ফেরে না। রিঙ্কু খুব চিন্তিত। এই সেদিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে এনকউন্টারে কয়েকজন মারা গেছে। সুব্রত ধরা পড়ে জেলে। কঙ্কার কথা ভেবে ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ভাবে কি জানি কঙ্কার কি হয়? ও ভাবতে পারে না যে আজ নয় কাল নিজেও ও একই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে।
ভারতের কৃষক আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সারা ভারতে তা ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রেণীসংগ্রামে যুক্ত বামপন্থী দলগুলো পরিবেশবিদ দেশপ্রেমিক শক্তিগুলো একজোট হয়ে একে সমর্থন জানাচ্ছে। এটা এক ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ পেয়েছে। এটা সত্যি যে এর নেতৃত্বে দিচ্ছে বড় বড় জমির মালিক এমনকি গ্রামীন ফসল ব্যবসায়ী মধ্যসত্ত্বাভোগীরা। কিন্তু এর অভিমুখ যেহেতু বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা, কর্পোরেট মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী আর তাদের তাবেদার ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাই তা এত ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষজনের কাছে একে সমর্থন করা বলতে গেলে বাধ্যবাধকতা। আর বামপন্থীদের এই সুযোগে সংগঠন গড়ে তুলে নেতৃত্ব দিতে তৈরি থাকা দরকার। এই ভাবনা থেকে রিঙ্কুরা এই আন্দোলনের সমর্থক হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে একে কেন্দ্র করে যে মঞ্চ গড়ে ওঠে তার সঙ্গে থেকে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এদের উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে আজ রাষ্ট্র যে কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সেটা উন্মোচিত হয় পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ময়দানে গরিব মানুষদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালনার ঘটনায়। আর এর সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপটা ধরা পড়ে।
একদিকে নির্বাচন অন্যদিকে তারই মধ্যে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সমাবেশের ডাক। জমায়েতে খুব ভালো সারা। কেন্দ্রীয় বাহিনী রুট মার্চ করছে। তারা এই অবস্থায় জমায়েতের বিরোধিতা করে। বাধা দিতে থাকে। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। জমায়েতে রন্টুরা আছে। বাধাকে উপেক্ষা করে বক্তব্য রাখা শুরু হয়। আধাবাহিনী একটু একটু করে আগ্রাসন বাড়াতে থাকে। লাঠি চার্জ দিয়ে নিষ্ক্রিয় মৌখিক বাধাকে সক্রিয় সরব করে তোলা হয়। জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু হয়। বাহিনী কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া শুরু করে। জনতা কিছুটা ছত্র ভঙ্গ হতে থাকে। কেউ কেউ সে গ্যাসের বুলেট ধরে তা পাল্টা জোয়ানদের দিকে নিক্ষেপ করে। নিরস্ত্র জনতার সঙ্গে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর এক অসম পথযুদ্ধ। যে কোন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই অসম যুদ্ধের সাক্ষী আমাদের প্রতিটি রাজপথ দেশের আনাচে কানাচে সেই সুদূর অতীত থেকে বিশেষ করে ব্রিটিশ আমল থেকে। গত শতাব্দীর ষাট সত্তর দশকে এটা নিয়মিত হত। অনেকদিন পর আবার। যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানে এরপর কি অপেক্ষা করছে। তাই ঘটনা পরম্পরায় ঘটল। বাহিনী এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। গুলিতে মারা যায় চারজন। আহত অনেকে। রিঙ্কুর মত কয়েকজন ধরা পড়ে। খুব দ্রুত খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে কিছু যোগ হয়ে সরকারি প্রতিবেদনে যা দাঁড়ায় তা হলো:
৫ ই এপ্রিল ২০২১ সালে এক অবৈধ সশস্ত্র জমায়েতকে সৈন্যবাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করে। কিন্তু অবাধ্য জনতা মারমূখী হয়ে ওঠে। গুলি চালায়। আত্মরক্ষায় আধাসেনা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। গুলিতে জনা চারেক মারা যায়। আধাসেনামাহিনীর সাত আটজন গুরুতর আহত।
এ হল সেই পরিচিত বয়ান। পুলিশ হেফাজত থেকে বের করে গুলি করে মারা হোক আর জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি করে মারা হোক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির এদিক ওদিক হয় না। গতে বাঁধা পুলিশ মিলিটারি জনতার আচরণ আর সাংবাদ মাধ্যমে খবর।
রিঙ্কু থানার লক আপ হয়ে গেল জেল হাজতে। জেলে বসে ওর কঙ্কার কথা মনে পড়ে। ও একদিন তর্ক শেষে বলেছিল:
দেখ রিঙ্কু পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনে যতই নিশ্চিন্ত থাক সশস্ত্র লড়াইয়ের পথে না গিয়ে যতই গণতন্ত্র অহিংসার মহিমা কীর্তন করিস না কেন রাষ্ট্র কিছুদিন সেটা মেনে নিলেও যখন নিজের আঁতে ঘা লাগবে তখন কিন্তু সহ্য করবে না। রাষ্ট্রের সন্ত্রাস থেকে কেউ বাদ পড়বে না।
রিঙ্কু ভাগ্নি কঙ্কাকে আজ অস্বীকার করতে পারে না। তাই বলে গেরিলা লড়াই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একমাত্র পথ সেটা সে আজও মেনে নিতে পারে না। সে যে এমন হতে পারে ভাবে নি তা নয়। তবে গণআন্দোলন ছেড়ে গেলে জনগণকে সক্রিয় প্রতিরোধে সামিল করা যায় না। তাদের সঙ্গে না নিয়ে যুদ্ধে এগোন যায় না। আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করার সুযোগটা নেওয়া চলে। আজ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে রাষ্ট্রের কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বাড়ছে। সেটা ফ্যাসিসম। ফ্যাসিবাদকে রুখতে ব্যাপক মানুষকে সক্রিয় করে এ যুদ্ধে সামিল করা বিপ্লবের অঙ্গ। এতে মানুষ বাস্তব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। জনমত তৈরী হয়। মিথ্যে প্রচারের মোকাবিলা করা যায়। তাই লড়াইয়ের অন্যান্য রূপগুলোকে বুঝে নিতে হয় তার সুযোগ নিতে হয়। তবে শেষ বিচারে শ্রেণী লড়াইটা নির্ধারক যার সঙ্গে অন্য লড়াইগুলোকে মেলাতে হয়।
প্রতি রবিবারের মত রিঙ্কুর স্ত্রী আর রীতাও সাক্ষাৎ নিতে আসে ঠিক বিকেল চারটেতে। জালের এপার আর ওপার। দুপক্ষের মধ্যে কথোপকথন। আজও ওরা এসেছে। নানা কথার ফাঁকে রীতা একটা কাগজ রিঙ্কুর হাতে গুঁজে দেয়। কিছুক্ষণ কথা বলে আজকের মত সাক্ষাৎকার শেষ। রীতারা বিদায় নেয় আর রিঙ্কু ওয়ার্ডে ফেরে। ওর মন ছটপট করছে রীতার দেওয়া কাগজটায় কি আছে দেখার জন্য। কে কি লিখলো। কিন্তু তার জন্য নিরালা চাই।
ওয়ার্ডে ফিরে সবার সঙ্গে চা খেয়ে রিঙ্কু প্রলয়কে নিয়ে একটু আলাদা হয়ে বসে। প্রলয় ওর লড়াইয়ের সাথী। একসঙ্গে ধরা পড়েছে। ওর সঙ্গে কোন গোপনীয়তা থাকে না। কাগজটা খুলে দেখে একটা চিঠি। কঙ্কার লেখা। রিঙ্কুর উৎসাহে উগ্রতা বাড়ে। সে চিঠিটা পড়তে থাকে একটু জোরে যেন প্রলয় শুনতে পায়। কঙ্কা লিখেছে:
প্রিয় মামা,
জানলাম তুমি ধরা পড়েছ। জল্লাদদের গুলিতে চারজন সাথীকে হারিয়েছ। এটা আমাদের এখানে আজ প্রায় রোজের ঘটনা। জানোনা হয়তো আমিও বেশ কিছুদিন হল তোমার থেকে অনেক দূরে রাইপুর জেলে বন্দী। মা মাত্র জেনেছে। দুদিন আগে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে। সেই সুযোগে আমি চিঠিটা পাঠাচ্ছি। তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল। এখানে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের এমন কিছু শিখতে সাহায্য করেছে যা নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হত। আমার ধারণা আমাদের এই অভিজ্ঞতা আর আজের লড়াইয়ে তোমার অভিজ্ঞতা ভাবনার জগতে আমাদের কাছে টানতে সাহায্য করবে। আমাদের লড়াইয়ে একে অপরের সাথী হতে পারব। তাই এই চিঠি লেখার তাগিদ।
আমরা আজ গণআন্দোলনের গুরুত্বটা আরও বেশি করে বুঝছি। গণ আন্দোলন আমরা চাই বা না চাই মানুষ চালিয়ে যায় কারণ তাদের অভিজ্ঞতাই গণআন্দোলনের প্রয়োজন তাদের বুঝিয়েছে। তবে গণআন্দোলনকে সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিপূরক হিসেবে দেখতে হয়। অস্ত্র সমর্পণ করে গণ আন্দোলন দিশা হারায়। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চক্রজালে জড়িয়ে যায়। এর থেকে শিক্ষা এই যে গেরিলাযুদ্ধ সশস্ত্র লড়াইয়ের একমাত্র রূপ নয়। বিশেষ অবস্থায় তা সর্বোচ্চ রূপ হতে পারে। সে নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। আর আজকের নয়াউদার্নীতিবাদের যুগে পুঁজিবাদের যে কদর্য রূপ তার বিরুদ্ধে তোমাদের মত পরিবেশবিদরা যেমন লড়ছে তেমনি দেশপ্রেমিক শক্তিও লড়ছে। সেটাকে সন্মান দেওয়া উচিত যেটা আমরা দিই নি। তারাও তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝবে এ লড়াইকে কোন খাতে বইয়ে নিয়ে যেতে হয়। সমাজতন্ত্র গঠনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? এর সঙ্গে ভোগবাদের সমস্যা আছে যেটার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়তে হয় যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অঙ্গ। এ ছাড়া আছে রুটি রোজগারের লড়াই যেটা কলে কারখানায় ক্ষেত খামারে আবহমানকাল ধরে মানুষের লড়াই। সেখানে গণআন্দোলনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের দরুন উৎপাদন প্রণালীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিল্প কাঠামো বদলেছে। দৈহিক শ্রমের ওপর এই প্রযুক্তির প্রভাবটা বিশেষ অনুধাবনের বিষয়।এটা লড়াইয়ের পথ নির্ধারণে কি ভূমিকা পালন করে সেটা ভেবে দেখতে হয়। এই প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের মননে এক অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলছে। আর এর অপব্যবহার সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তথাকথিত সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে ভোগবাদকে মদত করছে। সমাজের অসম বন্টন জীবন জীবিকামর সুযোগে কুঠারাঘাত করছে। ফলে বিত্তশালী অনেকেও এর বিরুদ্ধে লড়াইটা চাইছে। সেদিক থেকে লড়াইয়ের ফ্রন্ট ব্যাপকতা লাভ করছে। শ্রেণীর লড়াইয়ের সাথে একে কিভাবে যুক্ত করা যায় সেটা ভাবা দরকার। এই উদ্ভূত প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধানের ওপর আগামীদিনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শর্ত নির্ভর করছে। লড়াই ত্যাগ করে নয় আরো তাকে আঁকড়ে ধরে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব বলে মনে হয়। এছাড়া নেতৃত্বের প্রতি নিঃস্বর্ত আনুগত্য বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না। এর থেকে এক ধরণের স্বেচ্ছাচারিতাকে মদত দেওয়া হয়। নেতৃত্ব ভুল করলে সেটা তুলে ধরার সুযোগ পার্টির মধ্যে থাকে না। কেন্দ্রিকতার ঝোঁক বাড়ে। পার্টির ওপরের তলার সঙ্গে নিচের তলার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা অস্বীকৃত হয়।
সবশেষে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটা শিক্ষা তুলে ধরছি যার সমাধান খুব কঠিন অথচ একটা গোপন বেআইনি দলের পক্ষে খুব জরুরি। প্রথমেই বলি সুব্রতর সংগে আমার আর পুরোন সম্পর্কটা নেই। রাজনৈতিক জীবনে ওর ত্যাগ স্বীকারকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি ব্যক্তিজীবনে ওর ভাবনা আর কাজকে আমি ঠিক বলে মনে করি না বলে আজ আমাকে ওর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অস্বীকার করতে হচ্ছে। ওর আচার ব্যবহারে আমার মনে হয়েছে মননের দিক থেকে পুরুষতন্ত্রের ছায়া যা ওর মধ্যে আমি দেখি। দুজনের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর দায়বদ্ধতা দুজনের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনটা বজায় রাখতে পারে। তাছাড়া পার্টিকে না জানিয়ে আমাকে না জানিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটা প্রবণতা ওর মধ্যে। এর থেকে আমার মনে হয়েছে বিপ্লবী কর্মীদের নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইটা একটা বিরামহীন সংগ্রাম।আত্মলালসা আত্মস্বার্থ ত্যাগ করতে না পারলে বিপ্লবী থাকা যায় না। যাক সেটা নিয়ে দেখা হলে কথা হবে। ভালো থাকিস। একদিন মুক্ত আকাশের নীচে দেখা হবে।
রিঙ্কুর মনে হল কয়েকদিনের মধ্যে এই সেদিনের কঙ্কা কত বড় হয়ে গেছে। ওর চিন্তা ভাবনা এখন অনেক পরিণত। ও যে শুধু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললো তা নয় রিংকুকেও তার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে সাহায্য করল। ওর দাদু সুহাসবাবু দিদা কাজল আর মা রীতার অভিজ্ঞতা যেন তৃতীয় প্রজন্মে মিলে এক নতুন দিশা হয়ে উঠেছে যা এ লড়াইয়ের বহমানতা। একই সূত্রে গাঁথা।
আজের সে দিনটা
রোজের মত আজও পদ্মা ভোর পাঁচটায় উঠে সংসারের কাজে লেগে পড়েছে। সংসার বলতে নীলমনি তাদের ছেলে কনক ওরফে বিশু আর সে। নীলমনি সকাল আটটার মধ্যে অফিস বেরিয়ে যায়। তারপর ছেলের স্কুল। ও দশটায় স্কুলে রওনা দেয়। রান্না ছাড়াও সংসারের সব কাজ পদ্মা নিজেই করে। তিনজন লোক হলেও সংসারের কাজ কম নয়। আজ কাজ সারতে গিয়ে পদ্মা যেন প্রতিটি পদে বাধা পাচ্ছে। বাধাটা ওর ভেতর থেকেই। সমস্ত পৃথিবীটা যেন মাথায় ভিড় করেছে। ওর কাছে পৃথিবীটা তেমন বড় নয়। ও বছর খানেক আগে থেকে নীলমনির সঙ্গে যে জুটি বেঁধেছে তারপর থেকে এক বছরের ঝোড়ো সংসারটাই আজ তার পৃথিবী। সেটা তার মাথায়। তবে এই ছোট মাথায় তার আগের সংক্ষিপ্ত একটা জীবন প্রায়ই ফিরে আসে। সে জীবনটা তাকে কখনও সুখস্মৃতিতে ভরিয়ে তোলে আবার সে স্মৃতি তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। সেটা ছিল তার আগের পৃথিবী।
খাওয়াদাওয়ার পর নীলমনি যখন একগ্লাস জল খেয়ে বেরোবে তখন জলটা এগিয়ে দিতে গিয়ে পদ্মার হাত থেকে পরে কাঁচের গ্লাসটা ভেঙ্গে যায়। সে যেন আঁতকে ওঠে। স্বগতোক্তি করে ওঠে :
— — এ কি করলাম আমি ! বেরোবার আগে এ কি অলুক্ষণে কাজ আমার। স্বগতোক্তি হলেও তা নীলমনির শোনার পক্ষে যথেষ্ট কারণ কোথাও বেরোবার মুহূর্তে ওর সবটাই মনোযোগ থাকে পদ্মার ওপর আর পদ্মাও ওর খুব কাছাকাছি এসে পড়ে।
— — — এসব কি বলছ? এ তো সবার ক্ষেত্রেই যখন তখন হতে পারে। এই বলে নীলমনি নিচু হয়ে কাঁচগুলো সরিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করতে যায়। পদ্মা বলে :
— — -যাও তোমার অফিসে দেরী হয়ে যাবে। সাবধানে যাবে। নীলমনি পদ্মার চিবুক্ ধরে আদর করে বলে :
— — — মনে কুসংস্কার রেখো না। আজকের দিনটা মনে আছে? একটা বিশেষ দিন তোমার। পদ্মা দিনক্ষণ মনে রাখে না। কাজের মধ্যে কটা দিন কিভাবে গেল, কবে কোন দিন কত তারিখ তার হিসেব সব সময় থাকে না । আর ওর আবার বিশেষ দিন কি !
ও উত্তর দিতে পারে না দেখে নীলমনি বলে:
— — — আজ সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ। আমি চললাম। ফিরে এসে জানব দিনটা খুঁজে পেয়েছ কিনা। সাবধানে থেক।
নীলমনি বেরিয়ে যায়। পদ্মা সব ভুলে আজের দিনটার বৈশিষ্ট্য কি তা খুঁজে বেড়ায়। পৃথিবীটা তার মাথায় সূর্যকে প্রদক্ষিন করতে থাকে। তোলপার হয়ে যায়। ওর জন্মদিন কোনদিন পালিত হয়নি। ও জানে না সেটা। বিয়ের দিন ? সেটাই বা নিদৃষ্ট করে বলে কি করে? যেটা ও জানে তাতে তো নীলমনির কিছু আসে যায় না । সে সেটা জানে না। তবে কি বললো ! ছেলে তো বড়। ১৪ই সেপ্টেম্বর কি বিশেষ দিন ? ছেলের জন্মদিন নয়ত ? ছেলে কি বলতে পারে ? ছেলে পাশের ঘরে পড়ছে। ওকে জিজ্ঞাসা করা যাক। পদ্মা ছেলের কাছে যায় ।
— — — বিশু, তোর জন্মদিনটা কবে বলত ?
— — — সে আবার কি ? আমার জন্মদিন নিয়ে আবার চিন্তা কেন ? স্কুলে দেওয়া একটা দিন আছে। সেটা তো বসিয়ে দেওয়া দিন। কোনদিন পালন হয় না। আজ কেন?
— — — তোর কাকু বলে গেল আজ একটা বিশেষ দিন। তবে সেটা কি ? বিশুর মন তোলপার হতে থাকে। মায়ের আবার বিশেষ দিন কি থাকতে পারে ? এও এক অদ্ভূত ব্যাপার। আমার মায়েদের মত মেয়েদের আবার বিশেষ দিন ! সে ভাবে কাকু বোধহয় ঠাট্টা করছে। সে মাকে হেসে বলে:
— — — তুমি মনে করার চেষ্টা কর। মনে আসবে।
— — — কি জানি কি বলিস তোরা ?
পদ্মা ফিরে আসে তার দৈনিক রুটিনে। ছেলে বিশুর মাথায় এখন পদ্মার পৃথিবী। সে একটা বিশেষ দিন মনে মনে খুঁজে বেড়ায়। গত বছর এরকম একটা দিন ছিল তার মায়ের বিশেষ সুন্দরতম দিন যেদিন মা মানবী বলে স্বীকৃতি পায় আবার এই দিনেই কারও কারও কাছ থেকে সে চূড়ান্ত অসন্মানিত হয়। নিজের জীবনেও সে আলোর পথ দেখে। তবে সেটা তো সেপ্টেম্বর মাস ছিল না। তবে কি? নানা চিন্তা ভাবনা তাকে আলোড়িত করতে থাকে।
ছেলে স্কুলে গেলে পদ্মা স্নান খাওয়া করে। এরই মধ্যে ঘর পরিষ্কার কাপড় কাঁচার কাজ সারে। খেয়ে নিয়ে আবার বাসন মেজে সে ঘরে আসে। এটাই তার বিশ্রামের সময়। কোন কাজ নেই সারা দুপুর । তবে গায়ে গতরে কাজ না থাকলেও মাথার কাজটা বেড়ে যায়। তার মাথাটা পেছন ফিরে সারা পৃথিবীটা খুঁজে বেড়ায়। আজ বিশেষ দিনটা তাকে পীড়া দিচ্ছে ! সুখের না দু:খের ! সে হাতরে বেড়ায় তার অতীতকে । কখনও তার শৈশব কখনও যৌবন আবার কখনও বর্তমান তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আজ তার স্মৃতি খুঁজে নিয়েছে নীলমনির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারকে বিশেষ দিন বলে। সেই ফুটপাতে তার জীবনে নীলমনির প্রবেশ। তার হাত ধরে নতুন জীবন। নীলমনি ভবানীপুরে রাস্তার ধারে ফুটপাতের বাচ্চাদের পড়াত। কাছেই একটা বস্তিতে পদ্মাদের বাস। ছেলের বয়স তখন বছর ছয় কি সাত। ওদের বেশ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ওর বাবা কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। সে রিক্সা চালাত। যা হোক করে সংসার চলত। স্বামী চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মার শুরু হয় সেই অসহনীয় জীবন। ছেলের পড়া পরের কথা তাদের দুবেলা খাবার জোটানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।। এর মধ্যে ফুটপাতের স্কুলের. খবর পেয়ে ছেলেকে নিয়ে আসে নীলমনির কাছে। সেই সাক্ষাৎকার তাকে যেন নতুন দিনের সন্ধান দেয়। তবে সেটা তো জ্যৈষ্ঠের দুপুর। কেমন করে সেপ্টেম্বর হবে!
স্মৃতির এই সূত্র ধরে পদ্মা তার অতীতে ফিরে যায়। নীলমনির সান্নিধ্যে ছেলে পড়াশুনায় মন দেয়। নীলমনির ধারণা ছেলেটি বেশ মেধাবী। কিছুদিন ফুটপাতের স্কুলে পড়া শেষ হলে ওকে একটা সরকারী স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে। সে-ই খরচ বহন করতে থাকে। ছেলের পড়াশুনোর যাবতীয় দায়িত্ব নেয়। তখন থেকেই পদ্মার সঙ্গে নীলমনির যোগাযোগ। সে নীলমনির সাহায্যকে অনুগ্রহ বলেই গ্রহণ করে। অনুগ্রহ আর কৃতজ্ঞতার নাগপাশেই প্রথম প্রথম সেটা বন্দী থাকে। সে এক রঙীন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তার বিশু লেখাপড়া করে বড় হবে, চাকরি করবে তাদের অভাবের আকাশে সুখের চাঁদ উঠবে। সেটা ঘটবে নীলমনির আশীর্ব্বাদে। সাক্ষাত ভগবানের আশীর্ব্বাদ। যখন-ই পদ্মা নীলমনিকে সাক্ষাত ভগবান বলে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেছে তখন-ই সে বকা খেয়েছে। এই বকাটা-ই তার শরীরে শিহরণ জাগাতো। কোন এক নতুন সম্পর্কের ছোঁয়া সে অনুভব করত। তাও সে এই সম্পর্ককে অনুগ্রহের সম্পর্কের বেশি কিছু ভাবতে পারে না। তার সামাজিক অবস্থান তাকে অনুশাসনে রাখত। আজ এই সামাজিক অনুশাসন আলগা হয়েছে। অনুগ্রহের বাইরের সম্পর্কটাতে যে মান অভিমান রাগ বিরাগ সোহাগ ভালবাসার সম্পর্ক তা স্পর্শ করে পদ্মাকে। সে যেন ফিরে পায় তার অতীতকে।
নীলমনির হাত ধরে পদ্মা এখানে একটি নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সারাদিন এ বাড়ি সে বাড়ি কাজের মধ্যেও সে মেয়েদের মধ্যে কাজ করতে থাকে। ছেলেকে কেন্দ্র করে যে অনুগ্রহের সম্পর্কের সূত্রপাত হয় তার অনুগ্রহের দিকটা আসতে আসতে ঢিলে হয়। নীলমনি তাতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। পদ্মার নিজের অজান্তেই তার আর নীলমনির আজকের এই সম্পর্ক সেদিন গড়ে ওঠে যা তখন সুপ্ত ছিল। এখনও এই সম্পর্ককে পদ্মা একধরনের অনুগ্রহ বলে একেবারে যে ভাবে না তা নয়। তবে সেই অনুগ্রহের সঙ্গে আজ যেন কিসের মিশ্রণ যা তাকে একটা নিজস্ব সত্তা দিয়েছে। সেখানে একটা সম্মানবোধ, স্বাধিকার বোধ কাজ করে।
পদ্মার মনে পড়ে সুন্দরবনে তাদের জীবনের কথা। অল্প বয়েসেই সুনুর সঙ্গে বিয়ে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই এই সন্তান। সামান্য জমির ওপর নির্ভর করে জীবন চলতে থাকে। কিন্তু বেশিদিন সুখ সইল না। সামান্য জমি আর জীবিকাকে কেন্দ্র করে যতটুকু সুখ ছিল তাও প্রকৃতি দেবী কেড়ে নেন। সেই ভয়ংকর আয়লা জমি শুদ্ধ সবকিছু ভাসিয়ে নেয়। সুনুর তৎপরতায় তারা বাঁচে। তারপর জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় আসা। ওর স্বামী ওকে খুব ভালোবাসত। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে তার জীবিকা। এরই মধ্যে হাসিখুসির জীবন। তাও টিকল না। সুনু যে কোথায় হারিয়ে গেল। তা নিয়েও নানা জনের কটুক্তি। তবে পদ্মা জানে সে কেমন ভালো মানুষ ছিল।
পদ্মা নীলমনির সহায়তায় আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। ছেলেকে আঁকড়ে ধরেই ওর জীবন। সেখানেও হানা দেয় এক অচেনা শত্রু। বস্তিতে সেই ভয়াভয় আগুন। পদ্মা একে ভগবানের মার বলে মেনে নিতে চায় । তবে নীলমনি বলে ওটা মানুষের লোভের পেটে গেছে। এক বড় প্রমোটার আগুন লাগিয়েছিল। জমি দখল নেওয়ার পর আজ সেখানে তো ফ্ল্যাটই হয়েছে। নীলমনি ভুল বলেনি। তাও মনে করে ভগবানকে আর দোষ দেওয়া কেন। নীলমনি বলে তোমার ভগবানের সঙ্গে এই মানুষগুলোর আঁতাত। ভগবানের ওপর বিশ্বাস-ই বা রাখা যায় আর কত! নীলমনি বলে নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। দেখলে তো একবার ভগবান আরেকবার মানুষ রূপী ভগবান আক্রমন হানছে। গরিবের বন্ধু তারা নয়। আজ আর কথাটা অস্বীকার কি করে করে পদ্মা। তাও অবিশ্বাসের মধ্যেও ওপরওয়ালার ওপর বিশ্বাস আর তাই নিয়েই বেঁচে থাকা।
ওই কতই সেপ্টেম্বর বলল? সেটা আবার তার কাছে বিশেষ কোনদিন! হাজার ভাবনা ভাবতে ভাবতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হ’য়ে এল বলে। আজ আর সংগঠনের কাজে যাওয়া হল না। আকাশ পাতাল ভেবেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সে দিনটাকে। এ এক অশান্তি। ছেলে স্কুল থেকে এসে খেলতে গেছে। নীলমনি আবার ছেলে খেলতে না গেলে রাগ করে। এসব ভাবতে ভাবতে নীলমনি এসে হাজির :
— — — কি শরীর খারাপ নাকি? এখনও ওঠোনি।
— — — না ভাবছিলাম ওই সেপ্টেম্বরের দিনটায় কি ছিল।
— — — থাক ওটা আর ভাবতে হবে না।
— — — আচ্ছা গতবছর যে দিনে তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ সে দিনটা কি?
— — — সে দিনটা আবার তোমার বিশষ দিন হবে কেন? সেদিন আমাদের বাড়িতে তুমি কিভাবে অসম্মানিত হয়েছিলে মনে নেই? তাছাড়া সেটা সেপ্টেম্বর মাস ছিল না।
— — — আমার অসম্মানের কথা ছাড়। সবমেয়েদের কপালেই সেটা জোটে। সেই দিনটাই তো আবার আমার এই জীবনের শুরু। আমার মত অভাগার কাছে সেটাই কত বড় ভগবানের আশীর্বাদ।
— — — তোমরা এই জন্যই আরও মরলে। জীবনটাকে কারও না কারও অনুগ্রহ বলেই ধরে নেও। আচ্ছা এখন একটু চা খাওয়াও। ওই দিনটা আমি খুঁজে এনে দেব।
— — — ও আমার ভুল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে সে রান্নাঘরে যায় চা করতে।
নীলমনি ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। ও বাড়ি থেকে বেরোবার আগে যেভাবে অপমানিত হয়েছে সেটা পদ্মার ভোলার নয়। কিন্তু সে ওটা ভুলে থাকে। কোনদিন রাগ হলেও পদ্মা সে কথা তোলেনি। নীলমনি ভাবে। সে আজ ঠিক করে এসেছে ছেলের সামনেই পদ্মার সেই বিশেষ দিনটা পদ্মাকে মনে করিয়ে দেবে।
পদ্মার মাথায় ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগের ঘটনাটা সবসময়ই মনে ঘোরে । ও ভুলবে কি করে! সেদিন আগুনে সব পুড়ে যাওয়ার পর বিকেলের আগে নীলমনি পদ্মাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। সঙ্গে ছেলে বিশু। তাকে আর বিশুকে নিজের ঘরে বসিয়ে মায়ের কাছে আসে। পাশের ঘর থেকে সব পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। নীলমনি বলে:
— — — মা ও এখানে থাকবে। ব্যবস্থা করতে হবে।
— — — তুই তো সব ঠিক করেই এসেছিস। তোর দাদা আছে বাড়িতে, অন্যেরা আছে তাদের মত নিতে হবে না? আর মেয়েটি কে, ছেলেটিই বা কে সব জানা দরকার তো। তোর সঙ্গে সম্পর্কই বা কি?
— — — সম্পর্কের প্রশ্নটা পরে। ওরা এখন উদ্বাস্তু, সহায় সম্বলহীন। ওদের আগে একটা ব্যবস্থা করতে হয় তো। নীলমনি কোন কথা না লুকিয়ে পদ্মার পুরো পরিচয় দেয়। ওর স্বামীর কথাও বলে।
— — — জাতপাতের ঠিক নেই। একটা রিক্সাওয়ালার বৌকে একটা ঢ্যাঙ্গা ছেলে শুদ্ধ এ বাড়িতে ওঠাতে হবে! সে কি কথারে খোকা ! এরই মধ্যে নীলমনির বৌদি আর বোন এসে উপস্থিত। তারা সব শোনে । বৌদি বলে:
— — — না তা কোনভাবেই হোতে পারে না। ও হবে আমার জা! তা কখনই নয়। নীলমনির উত্তর:
— — — বৌদি, তুমি তো ধরেই নিয়েছ ও আমার বউ। না জেনে না শুনে এটা ধরে নেওয়া কেন ? আর আমার বউ-ও যদি হয় তুমি আপত্তি করার কে ?
— — — ও কে মানে ? এ বাড়িতে বৌমারও তো একটা অধিকার আছে। দেখ খোকা আমি এটা মেনে নিতে পারি না। এর মধ্যে ও ঘর থেকে পদ্মা বেরিয়ে আসে। ও বলতে চায় যে যখন কারও মত নেই তখন থাক। আমরা আমাদের ব্যবস্থা করে নেব। ওর কথা না শুনেই নীলমনির বোন বলে:
— — — তুমি এখানে কেন আমাদের মধ্যে ?
— — — ওকে নিয়ে কথা, ওতো থাকতেই পারে । নীলমনি বলে।
— — — এসেছে ভিখিরি হয়ে আবার কথা। দাদা দেখ, এইসব ছাইপাশ যদি বাড়িতে ঢোকাস তবে ভালো হবে না কিন্তু! আর মনে হচ্ছেতো বিয়েটা করে নিয়েই এসেছিস। বৌদি বলে কি ভুল করেছে ?
— — — দেখ ফুলু তুই অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস। যাকে তাকে অসন্মান করার অধিকার তোর নেই।
— — — কাকে অসন্মান ! যে আশ্রয় চাইতে অসম্মান বোধ করে না তার আবার সম্মান কি ? একবার বিয়ে হয়ে গেছে, এত বড় ছেলে। আবার নিচু জাতের মেয়ে হয়ে আঁকাশের চাঁদ পেতে চায়। ভুজুং ভাজং দিয়ে ভুলিয়েছে তার আবার কথা। ফুলু বলে।
— — — এত কথার দরকার নেই। সবাই একমত তো। আমার ব্যাপারে আর কেউ এসো না। আর ফুলু, এরপর কথা বললে কিন্তু তোর কথাও উঠবে। সেটা তোর পক্ষে সম্মানজনক হবে না। নীলমনি বলে।
পদ্মা অনেক করে ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেও নীলমনি পদ্মা আর বিশুকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। পদ্মা কোনদিন নিজের ভাগ্যের সঙ্গে নীলমনির মত মানুষের ভাগ্য জড়াতে চায় নি। সে তার কাছে দেবতূল্য। এটা সে নীলমনিকে বলেছিল। সে নীলমনিকে ভালোবাসলেও তার এটাই ছিল দৃঢ় মত । কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! ফুলুর চোখের ঘৃণার প্রকাশটা পদ্মাকে এখনও বেঁধে। গত এক বছরে নীলমনির সস্নেহ সান্নিধ্য আর অকপট প্রেম সেটা অনেকটা দূর করতে সাহায্য করলেও আজ যেন সেটা আবার জিগিয়ে ওঠে।
চা বানিয়ে পদ্মা ঘরে ঢোকে। নীলমনি ছেলেকে ডেকে নেয়। সে বলে, কি দিনটা মনে করতে পারলে না তো ? বিশু তোরও সেটা জানা দরকার। বাবার সত্যিকারের পরিচয় ছেলে জানবে না তা কি করে হয়। বিশু জানতে আগ্রহী। লোকটা হারিয়ে গেল কেন কোথায় তা সে কিছুই জানে না। পদ্মা বলে হেয়ালি কোর না। যা বলবার বল।
নীলমনি কিছু না বলে তার ব্যাগ থেকে একটা ছবি বার করে পদ্মার হাতে দিয়ে বাইরে চলে যায়। পদ্মার চোখে জল। এই লোকটাই তো সেদিন হারিয়ে যায় যে দিনটাকে পদ্মা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সেদিনটাই আজের এ দিন। সবাই তাই জানে। অনেকে বলত সে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে নীলমনি বলেছিল হারায় নি। সে একটু অন্যভাবে তাকে জানত। আজ সে আর নেই। তার সেদিন থেকে আর খবর পাওয়া যায় নি। পদ্মার মনে পড়ে দিনটা ছিল ১৪ই সেপ্টেম্বর। অষ্টমী পুজো। রাতের দিকে কারা এসে সুনুকে ডেকে নিয়ে যায়। সেই যে সে যায় আর ফেরে নি। সে শুধু বলে যায় তার ডাক এসেছে। তাকে যেতে হবে।
পদ্মা বিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বাবার পরিচয়টা দেয়। বিশুর চোখে জল নেই। আনত মুখে মায়ের হাত থেকে নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো নীলমনির ছবিটার পাশে বাবার ছবিটা টাঙিয়ে দেয়। মাথা তুলে অদ্ভুত প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাসে ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পদ্মা চোখ মোছে।
শেষ চিঠি
বছর কুড়ি বয়েস। বাবা মায়ের দুই মেয়ের বড় মেয়ে। কলেজে পড়ে। ভালো ছাত্রী। সপ্রতিভ মেয়ে। কলকাতার উপকন্ঠে বাড়ি। মেয়েটির নাম সুহাসিনী। বাবা আদর করে নাম দিয়েছিলেন। ওর আলাদা করে কোন ডাক নাম নেই। এত বড় নামে ডাকতে অসুবিধে হওয়ায় সবাই সুনি বলে ডাকে। যেন কাঠবেড়ালির লেজটা খসে পড়েছে। ঠিক যেমন নাম থেকে হাসিটা উবে গেছে। কিন্তু সেটা মুখে যোগ হয়েছে। মুখের মিষ্টি হাসিটা ওর সব সময়ের সঙ্গী। মেয়েটি ছিপ ছিপে গড়নের। মেপে মেপে সুন্দরী না হলেও দেখতে মিষ্টি। চোখটা যেন সবসময় অশ্রুসিক্ত। বর্ষার মেঘের ছায়াটা মুখে আঁকা। একটু হলেই চোখে বর্ষা নামবে। কিন্তু নামবে নামবে বললেও নামে না। কেউ একবার দেখলে দ্বিতীয়বার দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
সুহাসিনী অর্থনীতি নিয়ে পড়ে। কলেজে বন্ধুর অভাব নেই। তার কলেজটা বাড়ি থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বাসে যাতায়াত করতে হয়। অঞ্চলে একটা মেয়েদের স্কুলে পড়ত। বাড়ির অন্তরমহলটাই তার জগৎ। বাবা মায়ের হাত ধরে কখনো বাইরেটা দেখেছে মাত্র। এখন তার সুযোগ হয়েছে নিজের পথ নিজে চিনে নেওয়ার। কলেজে ঢুকে তার পরিচয়ের দরজাটা যেন অবাধ হয়েছে। সেখানে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা। ও ক্লাসে খুব মনোযোগী। বন্ধুরা ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারলেও ও সেটা করে না। তবে আড্ডায় তার যে উৎসাহ নেই তা নয়। ক্লাস করে যতটুকু সময় পাওয়া যায় আড্ডা দেয়। বন্ধুদের কাছেও ও সুনি। তবে বন্ধুদের মধ্যে থাকলে নামের ‘হাসি’টা মুখে জুড়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । ও সেখানে সুহাসিনী, ডাকে সুনি হলেও।
প্রায়-কলকাতার মত একটা শহর অঞ্চল থেকে কলেজে এসে সে সমবয়সী শহুরে ছেলেদের সঙ্গে যেমন অবাধ মেলামেশার সুযোগ পেয়েছে তেমনি গ্রাম থেকে আসা ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব তাকে আমাদের বৃহত্তর সমাজটাকে চেনার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই দিক থেকে শহরের উপকণ্ঠে কলেজগুলো যেন গ্রামীন বাংলা আর শহুরে বাংলার এক মিলন তীর্থ। গ্রামের সকালের মিষ্টি রোদ্দুরের সঙ্গে শহরের দুপুরের যৌবনের দহনের এ যেন সঙ্গম। শহরের অনাবৃষ্টিতে যে তৃষ্ণা কেঁদে মরে তা গ্রামের বারিবর্ষণে মেটে। শহরের সাজানো বাগানে ফুলের সঙ্গে গ্রামের বৃক্ষের পাতাবাহার। এখানে শহুরে সংকীর্ণতা ও অহংটা যেন ভেঙে যায়। আবার গ্রামের সংস্কার এখানে হোঁচট খায়। সুহাসিনীরা বুঝতে পারে জীবনের পরিধির ব্যাপ্তিটা তারা এতদিন যা জেনে এসেছে তার থেকে অনেক বেশি, দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে। যেন রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়ে, ‘সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রোদ‘ মিলেছে এ কলেজ প্রাঙ্গণে।
তপন কিশোর অরিন্দম ইন্দ্রানী দেবযানী সুতপা সবাই কলেজে ওর বন্ধু। এক এক জনের এক একটা বিষয়। পড়াশুনা আড্ডা নিয়ে কলেজে বেশ চলে। নিজের বিষয় ছাড়াও বন্ধুদের মাধ্যমে রাজনীতি দর্শন সমাজতত্ত্ব সাহিত্য এমন কি রসায়ন নিয়েও ওদের আড্ডা হয়। রাজনীতি নিয়ে বাক বিতণ্ডা লেগেই থাকে। বন্ধুদের মধ্যে তপন সুহাসিনীকে যেন বেশি আকর্ষণ করে। খুব যে ব্যতিক্রমী ছেলে তা নয়। তপনের সাহিত্যে উৎসাহ বেশি। ইংরেজির ছাত্র। বাংলায় কবিতা গল্প লেখে। সাহিত্যের ছাত্রী না হলেও সুহাসিনী কবিতা ভালোবাসে। তপন ওকে একজন ভালো পাঠিকা পেয়েছে। আর পাঠক পাঠিকারাই লেখকদের সবচেয়ে আপনজন। পাঠক ছাড়া লেখকের জীবন বর্ষণবিহীন বর্ষাকাল। কল্পনায় জমে ওঠা বর্ষণসিক্ত মেঘ বর্ষায় না। চাতকের তৃষ্ণা মেটে না। পাঠিকা সাহিত্যিকের স্বভাব প্রেমিকা। প্রেম নিবেদন করতে হয় না। লুকিয়ে দেখা করার দরকার হয় না। পাঠিকাকে তার লেখা পড়াতে পারলেই প্রেম নিবেদন করা হয় নিজেদের অজান্তেই। পাঠিকাও সেটা সাদরে গ্রহণ করে।
কলেজ ফেরত ওরা দুজনে প্রায়ই একই বাসে। কলেজের সামনে থেকে ওঠে। সুহাসিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে যায়। তপনকে আরও প্রায় দের ঘন্টা যেতে হয়। তপনের বাড়ি শহর ছাড়িয়ে চব্বিশ পরগনার এক গ্রামে। চাষ-ই ওদের পরিবারের জীবিকা। আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হলেও স্বচ্ছল। তপন গ্রামে ভালো ছাত্র বলে পরিচিত। সাহিত্যে অনুরাগের বশবর্তী হয়ে ইংরেজি নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বলা কওয়ায় ইংরেজিতে খুবই কাঁচা।আজকের শহুরে কথায় কথায় ইংরেজি বলিয়েদের পাতে পড়ে না। কিছুটা ব্রাত্যই বটে। তবে গ্রামের স্কুল হলেও ইংরেজি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি ব্যাকরণটা ভালো শিখেছে। সুহাসিনীও লক্ষ্য করেছে অভিধান ওর অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। অবসর সময়ে ওকে অভিধান খুলে বসে থাকতে দেখা যায়। তাই বোধহয় যখন ইংরেজি লেখে তখন তা যেমন ব্যাকরণ ভিত্তিক হয় তেমনি লেখায় শব্দের বৈচিত্র পাওয়া যায়। ওর এই ইংরেজি জানাটা আলাপ চারিতায় একেবারেই ধরা পড়ে না। সেখানে সে গ্রাম্য বাঙালি। চলা ফেরায় তেমন সপ্রতিভ নয়। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার চাহিদার সঙ্গে মানানসই নয়। সেদিক থেকে কর্পোরেট ক্যারিয়ার জগৎ তার কাছে অন্ধকার। কিন্তু তার প্রিয় পাঠিকা সেদিক থেকে বেশি সরোগর। সুহাসিনী ও তপন যেন বিপরীত অক্ষে অবস্থান করে। ভবিষ্যতে কর্পোরেট দুনিয়ার হাতছানি সুহাসিনীকে ডাকে। কিন্তু তপন ডাক পায় না। দুজনের মধ্যে এই পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের সম্পর্কের অতলে যেন কোন এক অচেনা নদীর ফল্গুধারা।
ওদের সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিকতার লাগাম পরানো হয় নি। কেউ কাউকে প্রেম নিবেদন করে নি। তবে পস্পরের আকর্ষণটা বাড়তে থাকে। তপন প্রায়ই ওর গল্প বা কবিতা নিয়ে সুহাসিনীর সঙ্গে বসে। বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। কবিতা পাঠ করে। সুহাসিনীও আজকাল একটা আধটা কবিতা লেখে। তবে ওর পড়াশুনা থাকে যার জন্য অনেক সময় দেয়। ভালো ফল করে একটা ভালো চাকরির তাগিদ ওর জীবনে খুব বেশি। কিন্ত তপন পড়াশুনায় অনাগ্রহী না হলেও ক্যারিয়ার করার প্রশ্নে উদাসীন। ও ভালো তেমন চাকরির কথা ভাবে না। সাহিত্য চর্চায় বেশি সময় দেয়। দুজনেই দুজনের কথা ভাবে। তপনের পাঠক পাঠিকা আছে। তারাই তার প্রেম। কিন্তু সুহাসিনীর পার্থিব চাহিদাটা বেশি। সে ক্যারিয়ারই হোক আর ভবিষ্যৎ সংসার জীবনই হোক। কার সঙ্গে সংসার জীবনে জোট বাঁধা যায় সেটা সে ভাবে। পার্থিব প্রয়োজনে জোট বাঁধা আর ভালোবাসার মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা তাকে ভাবায়। ভাবে বলেই তপনের সঙ্গে একটা নৈস্বর্গিক প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও তার ভিত্তিতে সংসার গড়ার ভাবনা কতটা বিশুদ্ধ প্রেমের মর্যাদা পাবে সেটা নিয়ে তার সংশয় হয়। পার্থিব প্রেম সেই বিশুদ্ধ প্রেমের মর্যাদা হানি করবে বলে মনে হয়। শেষের কবিতার বন্যা আর অমিত। মনে করে পার্থিব প্রেম বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটার মত। ঘরার জল যা নিত্য ব্যবহারের জন্য পুকুর থেকে তোলা হয়। কিন্তু তাতে সমুদ্রে সাঁতারের আনন্দ নেই, বিহঙ্গ আকাশে ডানা মেলে না। অপার্থিব নিষ্কাম প্রেমেই তো সেটা সম্ভব। আমাদের সমাজে সংসার ও সকাম পার্থিব প্রেম সম্পর্কে তার ধারণাটা একদিন সুহাসিনী কবিতায় রূপ দেয়। তপনের সঙ্গে দেখা হয় কলেজ প্রাঙ্গনে। সেখানে সব বন্ধুদের সামনে সে কবিতাটা পাঠ করে। কবিতাটা সবার ভালো লাগে। ওটাই সুহাসিনীর লেখা প্রথম কবিতা যেটা ও তপনকে উৎসর্গ করে ।
সুহাসিনী জানে সংসারটা জরুরি। মানিয়ে চলা। পার্থিব সুখ দুঃখ দৈনিক মিলন বিরহ এর সঙ্গে যুক্ত। সে অনেকবার প্রস্তাব দেবে বলেও পিছিয়ে আসে। তপন এ নিয়ে ভাবে না। সাহিত্য সেবা নিয়েই তার কারবার। প্রয়োজনের তাগিদে যদি সংসার পাততে হয় তো পাতবে। এর জন্য প্রেম নিবেদন করতে হবে কেন? প্রেম তো নিজে থেকেই আসে। কাশর ঘণ্টা বাজিয়ে হই হই করে তাকে নিয়ে আসতে হবে কেন? সংশয়ের আঁধারে ওদের প্রেমের ইতিকথা হৃদয়ের গভীরে লুকায়। হৃদয় বাতায়ন ধরে সে উঁকি মারে।
কলেজের পালা শেষ হয়েছে। সুহাসিনী খুব ভালো ফল করেছে। তপন খারাপ করে নি। দুজনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিদ্যাদেবী দুজনকে বিদ্যাসাধনার প্রাঙ্গণে বন্দি করে রাখে। ইতিমধ্যে ওদের সম্পর্কটা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিকতা লাভ করেছে । বছর খানেক আগে কলেজে পড়াকালীন একদিন বাসে বাড়ি ফেরার সময় সুহাসিনী পড়ে গিয়ে আহত হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে তপন ওকে ওর বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে বাড়ির সবার সঙ্গে তপনের পরিচয়। ওর আচার আচরণ সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। বাড়ির দরজা ওর কাছে উন্মুক্ত হয়। সেই থেকে তপনের সুহাসিনীর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত। আনুষ্ঠানিক সম্পর্কটা গড়ে ওঠার শর্ত তৈরি হয়। মুক্ত পৃথিবীর উন্মুক্ত অপার্থিব প্রেম পার্থিব সম্পর্কে যেন বাঁধা পড়তে থাকে। সুহাসিনীর সংশয় থাকলেও সে সেটা অস্বীকার করতে পারে না। নিষ্কাম প্রেম কামনার খাঁচায় বন্দী হোয়ে পড়ে যেন। ভিন্ন বিষয় হলেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে দুজনের রোজই দেখা হয়। প্রেম নির্জনতা খোঁজে। নিষ্কাম কামনার অঙ্গে বাসা বাঁধে। কাম আর নিষ্কাম দ্বন্দ্ব সমাধান খোঁজে পার্থিব চাহিদায়। ওদের সম্পর্কটা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দু বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সুহাসিনীর বাবা মা জানে এ ব্যাপারে আপত্তি করে লাভ নেই। সুনি একরোখা মেয়ে। ছেলের বাড়িতে এ নিয়ে সাধারণত বেশি প্রশ্ন ওঠে না বিশেষ করে মেয়েটি যেখানে দেখাশোনার পরীক্ষায় সহজেই পাশ করার উপযুক্ত।
দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালোভাবে পাশ করে। সুহাসিনী প্রত্যাশামত একটা কোম্পানিতে গবেষণা বিভাগে চাকরি পেয়ে বেঙ্গালুরে চলে যায়। তপন তার দেশের বাড়ির কাছে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। সে সাহিত্য সেবায় মনোনিবেশ করার সুযোগ পায়। দুজনেই জীবিকা হিসেবে তাদের পছন্দের জায়গায় স্থান পায়। দুজনের মধ্যে চিঠি পত্রে বা দুরাভাসে যোগাযোগ থাকে। সমস্যা দেখা দেয় তারা কোথায় কিভাবে ব্যাক্তিজীবনে জোট বাঁধবে তা নিয়ে। ব্যাপারটা সমাধান হয় না। দুজনকে একজায়গায় থিতু হতে গেলে একজায়গায় কাজ নিতে হয়। কর্মজীবন নিয়ে দুজনের ভাবনা দুরকম। তপন চায় গ্রামে মাস্টারি করে কর্মজীবনে কিছুটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে, একই সঙ্গে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যেতে। সুহাসিনী চায় কর্পোরেট জীবনে প্রতিষ্ঠা যেটার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বেশি। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও সংসারের দাবি মেটান মুশকিল। তাও দুজনে অপেক্ষা করে। বিষয়টা নিয়ে কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। তপন যেমন চায় না সুহাসিনী নিজের সত্তা ছেড়ে নেহাৎ এক গৃহবধূ হয়ে থাকবে। আবার সুহাসিনীও চায় না তপনের সাহিত্য সেবায় বেঘাত ঘটুক। বাস্তবের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের সংঘাত কিভাবে মিটবে কেউ জানে না। অথচ দুজনেই দুজনকে পেতে চায়। নিষ্কাম প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হয়। কিন্তু কামনার টান কতদিন অস্বীকার করা যায়? কেউ জানে না। এছাড়া আছে পরিবারের বন্ধন।
বেঙ্গালুরে গবেষণার কাজে সুহাসিনী বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আর গবেষণার কাজ একটা যৌথ দায়িত্ব। এই কাজে অন্যদের সহযোগিতা বিশেষ দরকার। ওর সঙ্গে জনা দশেকের একটা টিম। প্রাতিষ্ঠানিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিজেদের অজান্তেই প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে কখন ব্যক্তিগত প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়ে সেটা সবসময় ঠাহর করা যায় না। ওর সঙ্গে কর্মরত সবাই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মেয়ে পুরুষ সবাই। ও ওখানে দুজন মেয়ের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। নিজেরা পালা করে নিজেদের কাজ করে। অন্যান্যরা আসে। অফিসের কথাবার্তা ছাড়াও ব্যক্তিগত আলাপ আড্ডা চলে।
স্কুলে শিক্ষকতার সূত্রে তপনের পরিচিতির বিস্তার ঘটেছে গ্রাম থেকে গ্রামে । লেখক হিসেবেও ওর নামডাক। কবিতা প্রেমিক প্রেমিকারা তাকে জড়িয়ে থাকে। বাড়িতে পাঠক পাঠিকাদের অবাধ যাতায়াত। নিজের বাড়ির একটা ঘরে কবিতা আবৃত্তির মহড়া চলে। বাচ্চাবুড়োদের নিয়ে বাচিক স্কুল। হেসে খেলে দিন যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাবার দাবি আসে।শহর থেকে প্রায়ই নেমন্তন্ন।এরই মধ্যে সংসারের কিছু দায়িত্ব। বিশেষ করে মায়ের প্রতি।ভাইরা থাকলেও বড় ছেলে হিসেবে তার দায়িত্ব বেশি। মায়ের কঠিন অসুখ। তাঁকে নিয়ে প্রায়ই কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে যেতে হয়। ছোট বোন সংসারের দায়িত্ব নিলেও তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। বাবা মা দুজনেই ওর বিয়ের কথা বলে। ও প্রয়োজনটা বোঝে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আগের মত সুহাসিনীর ঘন ঘন চিঠি তপন পায় না। এখন চিঠি লেখার প্রয়োজনটা ফুরিয়েছে সুহাসিনীর। মেসেজ বা আপে যোগাযোগটা হয়। মস্তিষ্কের কল্পনার জগৎটা বাঁধা পড়েছে হাতের মুঠোয়। তাতে তপনের মন ভরে না। সুহাসিনীর চলে যায়।ও নিজেও সুহাসিনীকে লেখা কমিয়ে দিয়েছে। সুহাসিনীর প্রেমটাও যেন সংসারের দরজায় করা নাড়ে।সংসারের মুঠোয় বন্দী হতে চায়।
তপন মেসেজে বার্তা পায়। সুহাসিনী তাকে জরুরি তলব করে। সে যেন বেঙ্গালোরে যায়। বিশেষ দরকার।সঙ্গে উড়ানের টিকিট। তপন বার্তা পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ভেবে পায় না কি এমন দরকার। সুহাসিনীর ডাককে সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারে না। স্কুল ছুটি নিয়ে রওনা দেয়। নির্ধারিত সময়ে উড়ান ধরে। উড়ানে বসে তার চিন্তার জগত তোলপাড়। কিছুদিন আগে সুহাসিনী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আবার কি তবে সে অসুস্থ! আবার সে ভাবে হয়তো তাদের সম্পর্কটাকে সে ঝালিয়ে নিতে চায়। অনেকদিন দেখা নেই। দেখা করতে চায়। তপন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এবার দেখা হলে সম্পর্কটার একটা চূড়ান্ত রূপ দিতে চায়। সে জানে সুহাসিনী বিয়ে করতে চায়। তবে তপনের পক্ষে বেঙ্গালোরে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া কি সম্ভব! তবে কি করার! তপন বিভ্রান্ত। তার মাথায় শুধু সুহাসিনী নয়, তার পরিবার বাবা মা বোনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা মাথায় ভিড় করে। সুহাসিনীর মা তো তপনকে খুব স্নেহ করেন। হয়তো মনে মনে তাকে জামাই বলে গ্রহণ করেছেন। সুহাসিনীর ছোট বোন সোহাগ ওর বিশেষ গুণগ্রাহী । ওর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি। কবি বাবু বলে ওকে ডাকে। দিদিকে নিয়ে মস্করা। একদিন ঠাট্টা করে সোহাগ তপনকে বলে দিদি তো মনে হচ্ছে ফিরবে না। তখন কি করবেন? তপন গম্ভীর হয়ে ওঠে। কবিগুরুর উদাসীন গম্ভীর মুখ দেখে সোহাগ লজ্জা পায়। এমনি টুকরো টুকরো কথার ঘাত প্রতিঘাতে ওদের মধ্যে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তপন জানে সোহাগের এক সহপাঠীর সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। যে কোন কারনেই হোক সোহাগের সে সম্পর্ক এখন নেই। বিষয়টা নিয়ে তপন ওর প্রতি সহানুভূতিশীল। মেয়েটি পড়াশুনায় তেমন আগ্রহী না হলেও গুণী। সংসারের কাজে পটু। ভালো রান্না করে। তপন ওদের বাড়ি গেলে ওর হাতের চা না খেয়ে ফেরে না। মেয়েটি ভালো কবিতা আবৃত্তি করে।
ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যে উড়ান বেঙ্গালুরু বিমান বন্দরে নামে। সেখান থেকে একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে ঠিকানা ধরে তপন পৌঁছে যায় সুহাসিনীর আস্তানায়। সুহাসিনী তপনের অপেক্ষায়। তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা।কলকাতার গ্রীষ্ম থেকে সে আসে বেঙ্গালুরুর বসন্তে।অপেক্ষারত সুহাসিনীর চোখে সেই বসন্তের স্পর্শ। তপন ওকে দেখে আপ্লুত হয়। তারা যেন ফিরে যায় ফাগুনের সন্ধ্যায় কলকাতার গঙ্গার ধারে। তপনের স্মৃতিতে সেই সন্ধ্যাগুলো ফিরে আসে। আজ অনেকদিন পর সুহাসিনীকে সে একান্তে পায়। সুহাসিনী তপনকে নিয়ে ঘরে বসে। দুজনের মধ্যে আলাপচারিতা শুরু হয়। সুহাসিনী জানতে চায়
— — — তোমার মা কেমন আছেন?
তপন বলে :
— — — ভালো না। এখন কাজকর্ম করতে পারে না। বোনের ওপর সংসারের চাপ।
সুহাসিনীর যেন কৌতুক মিশ্রিত উত্তর:
— — — এখন তো কাউকে বাড়িতে দরকার। আর বোনের তো ভবিষ্যত আছে।
তপন সুযোগ পায় কথাটা তুলতে। সে বলে:
— — — এখন তো আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাড়িতে সে ব্যাপারে সবাই অপেক্ষা করছে।
— — — হ্যাঁ ঠিকই তো। এই কথা বলে সুহাসিনী অন্য প্রসঙ্গে আসে। বলে:
— — — সোহাগ বললো তুমি ও বাড়িতে গিয়েছিলে। ওকে কেমন দেখলে?
তপন বলে:
— — — ভালো। এখন অনেক স্বাভাবিক। মনে হয় আঘাতটা সহ্য করে নিয়েছে। আমি ফিরলে আমাকে একদিন মাংস রান্না করে খাওয়াবে বলেছে।
সুহাসিনীর উত্তর :
— — — ওর হাতে খেয়ে তৃপ্তি পাবে। আমি ও কাজে লবডঙ্কা।
কথা বলতে বলতে কলিংবেল। কে আবার! কাবাব মে হাড্ডি। তপন ভাবে। সুহাসিনী দরজা খোলে। তপন আড় চোখে দেখে একজন সুদর্শন ভদ্রলোকের প্রবেশ। তপনের মনে হয় ভদ্রলোকের আসার কথা সুহাসিনী জানত।সুহাসিনী তপনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। উনার নাম রামস্বামী যার কথা তপন আগেই শুনেছে। উনিই অসুস্থ সুহাসিনীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিন জন গল্প করতে বসে।ওদের দুজনের মধ্যে তৃতীয়ের এই উপস্থিতি তপনকে অস্বস্তিতে ফেলে। ভদ্রলোক অবাঙালি।তাই ইংরেজিতে আলাপচারিতা যা তপনের পক্ষে বিড়ম্বনা। তপন কোনমতে চালিয়ে যায়। কথা বলতে বলতে রাত হয়। ইতিমধ্যে ফরমাস অনুযায়ী দোকান থেকে খাবার আসে। খাবার শেষ হলে সুহাসিনী বলে:
— — — — তপন তুমি উনার সঙ্গে যাও।ওখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উনি তোমার জন্য হোটেলে ব্যবস্থা করতে দিলেন না।
পরের দিন । সুহাসিনী রামস্বামীর বাড়িতে হাজির। ইতিমধ্যে তপনের উনার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। রামস্বামীর আতিথেয়তায় তপন মুগ্ধ হয়। রামস্বামী অবিবাহিত। একাই থাকে। সকালে উঠে চা ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে করে খাওয়ান। বাড়ি চেন্নাই। রামস্বামী পাশের ঘরে যান। তপনের সঙ্গে সুহাসিনী একা। কালকের কথার রেশ টেনে তপন বলে:
— — এবার আমাদের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলা যাক। সুহাসিনী বলে
— — আমার বাড়িতে চলো সব কথা হবে।
এরপর দুজনের আলাপচারিতা। রামস্বামী এসে যোগ দেয়। দুপুরে এখানেই খাওয়া দাওয়া সেরে সুহাসিনী তপনকে নিয়ে ওর ডেরায় যায়। বাড়িতে এসে দুজনে আবার নিভৃতে আলাপ। তপন বিয়ের কথা তোলে। সুহাসিনীও তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। তপনকে প্রস্তাব দেয় এখানে একটা স্কুলে চাকরি নিতে। ইংরেজি ওর বিষয় বলে সেটা পেতে অসুবিধে হবে না জানায়। যদি তপন রাজি হয় তবে সে তাকে একটা স্কুলে কালকেই নিয়ে যেতে পারে। এই ইন্টারভিউএর ব্যবস্থা করেই সুহাসিনী তাকে আসতে বলে।তপন জানায় সেটা তার পক্ষে সম্ভব নয় । দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়। তবে তা বেশিদূর এগোয় না। সুহাসিনীর সংশয় ছিল তপন তার জায়গা ছেড়ে আসবে কি না। আর তপন জানে সুহাসিনী আত্মমর্যাদা আত্মসত্তা ছেড়ে সংসার করবে না। সেটা তার কাছে দাসত্ব। তাও ও বিশ্বাস করে সুহাসিনী কখনো পশ্চিম বঙ্গে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে আসবে। সে আর জোরাজুরি করে না। বাড়ি ফিরে আসে ।
একদিন দুজনের মধ্যে মোবাইলে কথা হয়। কে কেমন আছে জানার পর উভয়ের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়। সুহাসিনী জানায় যে সে তপনকে একটা চিঠি দিয়েছে। তপন জানায় সে সেটা পেয়েছে। চিঠিতে কি লিখেছে? সেটা আমাদের সকলেরই কৌতূহলের।
সুহাসিনী রামস্বামীর এক বন্ধুর সঙ্গে নিজের বিয়ের একটা কার্ড পাঠিয়েছে। বিয়েতে ঘটক রামস্বামী। তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার থেকে একটা কবিতার অংশ:
মোর লাগি করিও না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই — –
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
এর সঙ্গে তার অনুরোধ তপন যেন বিয়ে করে। সংসারের প্রয়োজনটা তারও আছে। তপনকে সে ভালোবাসে তাই তার দায় আছে এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা। সে উপযুক্ত পাত্রী হিসেবে তার বোন সোহাগকে চিঠিতে উপস্থিত করে। তপন একটু বোকা বনে যায়। একটা সন্দেহ উঁকি মেরেছিল। প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু এ কি, সোহাগিনীর তরফ থেকেই! ভেবে পায় না। সোহাগিনীর ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
একটু ধাতস্থ হয়ে কদিন পরে তপনও চিঠিতে তার বাস্তব অবস্থাটা জানায়। সে প্রস্তাবটা মেনে নেয় তবে সোহাগের স্বেচ্ছামত সাপেক্ষে। সে মতটা পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তার সংশয় আছে যেখানে তাদের সম্পর্কটা ও জানে। ব্যাপারটা সুহাসিনীর ওপর ছেড়ে দেয়। সে চিঠিতে তার অনুমতি জানায়। যেন এরকম একটা কিছুর জন্য সে প্রস্তুত ছিল। ভাবনার জগৎটা তার ছিন্ন ভিন্ন। সে ভেবে চলে :
ভালোই করেছ। কোন নিশ্চয়তার শর্তে ঘর বাঁধা! শত সহস্র ফুটো সে ঘরের ছাদে। গ্রীষ্মের দহন শীতের কাঁপন বর্ষায় প্লাবন সে ঘরে। বসন্তে ফুল ফোটে না এ বাগানে। প্রেমের কলি মুর্চ্ছা যায় সে বাসরে। ভালোই করেছ তুমি বালির বাধ না বেঁধে, অনিশ্চয়তার জোয়ারে না ভেসে। আর জেনো প্রেম বাঁধে না নিজেকে, ধরা দেয় না সংসারের পাঁকে। মুক্ত বিহঙ্গ সে, ডানা মেলে ওড়ে আকাশে, নীরব গুঞ্জন তার বাতাসে।
তপনের ভাবনায় দোলাচল। হঠাৎ একটা দমকা হওয়া। তার ভাবনায় একটা চমক, একটা সংকোচ, যেন একটা উদ্বেগ: সোহাগের থেকে কি ছাড়পত্র পাওয়া যাবে?
সোহাগের সেদিনের সেই ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতূহলী চোখটা ভেসে ওঠে। সেদিনের সে ঔদাসীন্য তপনের মুখে আর দেখা যায় না । আবার সুহাসিনীর পাঠানো চিঠিটায় যেন লেখা শেষের কবিতায় অমিতের প্রতি বন্যার অভয় বাণী :
তোমার হয় নি কোন ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোন নৈবিদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষ্ণায়,
তার সাথে দিও না মিশায়ে
যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আগে তুমি নিজে
হয়তো — বা করিবে রচন
মোর স্মৃতি টুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়,
হে বন্ধু, বিদায়।
উচ্ছেদ
প্রতিদিন সকালে একটু বেলা হলে দেখা যেত করবাবু মানে আমাদের ধীমানের বাবাকে দুধ সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে কাগজ হাতে বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে থাকতে। জ্যৈষ্ঠের দুপুরের আকাশটা তাঁর মাথায় ঝলমল করত। এক নাতনী এসে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে:
দাদুর মাথায় টাক
বসবে এসে কাক
দাদু কাগজ থেকে মুখ তুলে নাতনিকে আদর করে কোলে নিয়ে বলেন, “ মুখটা তোর দ্যাখ ”। কাগজ পড়ার ফাঁকেই দাদু কাকে যেন খুঁজে ফিরতেন। কার জন্য যেন অপেক্ষায়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বাজারের থলি নিয়ে মাসিমা ফিরতেন। মেসোমশাইয়ের উৎসুক চোখ। বলতেন:
— — — কি মাছ পাইলা ? মাসিমা হয়তো বলতেন :
— — — ছোট মোরোলা মাছ।
— — — ক্যান্ ! বড় কাটা রুই পাইলা না ?
— — — দাম বেশি। কাইল বেশি টাকা দিও আইনা দিবাম। খালি খাওয়ন আর খাওয়ন !
— — তা, সঙ্গে কাঁচা আম আনছ ত ? দমে গিয়ে মেসোমশাই বলতেন।
— — না আইন্যা যাইবাম কই !
সকালের রোজনামচা শেষে মাসিমা ভেতরে চলে যেতেন। উনুনঘরে তাঁর অনেক কাজ। বাজে বকার সময় কই!
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এই সময় সকাল ন`টা বা দশটায় সামনের দিক থেকে গোল এই বাড়ির বারান্দাটা রোদে ঝলমল করত। সেই সাতসকাল থেকেই শিশু থেকে বৃদ্ধ কতজনকে দেখা যেত। কাকভোরে ধীমানের বাবা করবাবু ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ি থেকে বেরোতেন। উদ্দেশ্য প্রাত:ভ্রমন। অন্যেরা একটু বেলা হলে কেউ কেউ অফিসে বাজারে বেরোত, কেউ কেউ স্কুলে। শিশুরা খেলা করত বারান্দায়। রোদের আবির মেখে দৌড়োদৌড়ি, হুড়োহুড়ি। বন্ধুবান্ধবের অবাধ আনাগোনা। দক্ষিণে একদিকে নিমগাছের পাতার দুলুনি। আরেক দিকে নারকেল পেপে গাছ। বর্ষাকালে চারদিক জলে থৈ থৈ করত। খালি মাঠগুলো ভর্তি হয়ে পুকুর। পাড়ার মোড় থেকে মনে হ`ত বাড়িটা ভাসছে। যেন তাজমহল। ধীমানকে বললে ও বলতো,“ওটা বাবার প্রেম।“ ও ভুল বলতো না। সন্দেহ নেই ওর বাবার চাল চলন ছিল শাজাহানি। আর ওর মা সত্যি মমতাজ সুন্দরী ! একই সঙ্গে তিনি বাড়ির রাঁধুনি, বাজার সরকার। রোজই তাকে বাজার করতে দেখা যেত। তিনি বাজার করে নিজের হাতে রান্না না করলে করবাবুর রুচতো না। স্ত্রীর প্রতি তাঁর কর্তৃত্ব, আবার অবাধ প্রেম , নির্ভরশীলতা। এ সবই আজ ইতিহাস।
ওরা মানে ধীমানরা নিজেদের এখন-ও বাঙাল বলে পরিচয় দেয়। বলে ওরা ওদেশের বাসিন্দা, যখন ওদেশটাও এদেশ ছিল। বোধ হয় ক্ষতটা এখন-ও রয়ে গেছে। ওখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে এন্টালি বালিগঞ্জে কাটিয়ে কর সাহেবের অবসরজীবনে সপরিবারে এই পল্লী বাস। এই দেশে। শোনা যেত বারেন্দায় বসে অবসরপ্রাপ্ত ধীমানের বাবার হুঙ্কার, “ওগো.কখন এককাপ চা চাইসি। এখনও হইল না !“ পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন কি না জানি না। তবে করবাহাদুরের জমিদারি মেজাজটা আমৃত্যু তাঁর জীবনে বহাল। তৎপর আর একই সঙ্গে সন্ত্রস্ত মাসিমা সঙ্গে সঙ্গে এককাপ চা নিয়ে উপস্থিত। মাসিমা উনুনঘরে যেতেই আবার হাঁক, “ওগো, কয়টা বাজে দেখতো“। মাসিমা ঘড়ি না দেখেই গলা তুলে বলতেন, “বারোটা পাঁচ“।
করবাবুর মাথার ওপর ঘড়িটা পাঁচ মিনিট আগে ঢং ঢং করে জানিয়ে গেছে বেলা বারোটা।
করবাবুর মেজ ছেলে ধীমান কর। এখন সে বৃদ্ধ। তার ছাত্র জীবনের শেষ প্রান্ত থেকে আজ সে পৌঁছেছে জীবনের শেষ প্রান্তে। এখানেই আজও বাস। দুই ছেলে মেয়ে। মেয়ে চাকুরীরত স্বামীর সঙ্গে পুত্র নিয়ে ভিন প্রদেশে। কলেজে চাকুরী ছেড়ে স্বামীকে সঙ্গ দেওয়া আর ছেলেকে মানুষ করার কাজে আজ দীক্ষিতা। পুত্র সাফল্যের সঙ্গে পড়াশুনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। সেও ভিন প্রদেশের বাসিন্দা। মোটা মাইনে। খরচ আরও মোটা। ঋণ পত্রে খরচের বাহার। এখানেও ধীমান নিঃশ্চুপ। বলার কী আছে ! ওদের আজ ক্ষমতা আছে। ধীমানদের ছিল না। সমাজটাও বদলেছে।
প্রতিষ্ঠিত সব সন্তানদের বাবা-মায়ের মত ধীমানরাও আজ নিজ বাড়িতে দুজন। স্ত্রী-ও তার মতই অবসর প্রাপ্তা পেনশন ভোগী কর্মচারী। আর্থিক ভাবে যথেষ্ট সচ্ছল। একাকিত্ব আর রোগভোগের আতঙ্ক ছাড়া জীবনে আর কোন অনিশ্চয়তা কোথায় ! হ্যাঁ আছে। এক বিচ্ছিন্নতার আতঙ্ক যাকে ইংরেজিতে বলে alienation। এই সভ্যতা সমাজ জীবনে নামিয়ে এনেছে এক ভয়াভয় বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা জন্ম দিয়েছে সমাজবিমুখতা। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা। শৈশবের বিচ্ছিন্নতা, যৌবনের বিচ্ছিন্নতা, বার্ধক্যের বিচ্ছিন্নতা। সমাজ জীবন থেকে ব্যক্তিজীবনের বিচ্ছিন্নতা। সৃষ্টি থেকে স্রষ্টা বিচ্ছিন্ন। পরিবেশ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদের বিচ্ছিন্নতা। সমরবাদের বিচ্ছিন্নতা। মৌলবাদের বিচ্ছিন্নতা। ধর থেকে মাথাটাই ছিন্ন। সবার জীবনকে এই বিচ্ছিন্নতা এক উপগ্রহ হয়ে প্রদক্ষিণ করে। বিচ্ছিন্নতার পূর্ণগ্রাস নামিয়ে আনে অন্ধকার। এক তমসা। সভ্যতার নিদান মেনে মানুষ পরিকল্পনামত ছোট সংসার পেতেছে। পরিবার পরিকল্পনার দৌলতে সচ্ছল জীবন ভোগ করছে। শৈশবকাল থেকে শিশুকে ইঁদুর দৌঁড়ে সামিল করেছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয়। তাই এই সমঝোতা। সে ছেলেমেয়েকে `মানুষ` করেছে। যে ভাবে চেয়েছে সেভাবে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে সুযোগ না থাকায় তাদের ভিনপ্রদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তবে প্রয়োজনে তারা সবসময় উপস্থিত। তাই তার স্বস্তি যে এই বিচ্ছিন্নতা তার পরিবারকে এখনো সম্পূর্ণ গ্রাস করতে পারে নি। কিন্তু তার বস্তুগত শর্ত তৈরী হয়েছে। এ তো তার স্বেচ্ছা সন্ন্যাস। এর জন্য কাউকে দায়ী করা চলে না। ধীমান বোঝে। এ হ`ল মধ্যযুগীয় জীবনবোধ থেকে আধুনিক, আধুনিক থেকে আধুনিকোত্তর জীবনবোধে উত্তরণ। কাউকে কাউকে দেখা যায় উদয়নের পথে। সভ্যতার উদয়ন ! আকাঙ্খার অপমৃত্যু।
পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। এখন বাড়িটা প্রায় জনশুন্য। বৃদ্ধাবাস। বাড়ির বারান্দায় রোদের আনাগোনা বন্ধ। শৈশব উধাও। যৌবনের দ্বীপান্তর। বৃষ্টিতে বন্যা বয়ে গেলেও মাঠগুলি আর পুকুর হয় না। বৃষ্টির জল নিকাশি পথ ধরে বেরিয়ে যায়। ভাসে পেছনে দূরে কোথাও নিম্নাঞ্চল। ইটের দেওয়ালের আড়ালে সূর্য মুখ লুকায়। ঘরে রোদের প্রবেশ নিষেধ।
ধীমান লেখনী ধরে। কম্পিউটারে লিখে চলে :
সকালে বিছানায় শুয়ে
মটকা মেরে পড়ে
কোথায় গেল সে !
নেই কেন পাশে !
কে যেন কাঁদে,
দেখি চোখ খুলে
রোদটা পর্দার ওপাড়ে
ফাঁসিতে ঝুলে
ঢ্যাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে।
চারিদিকে বহুতল বাড়িগুলো স্পর্ধায় দাঁড়িয়ে। ধীমানদের শাসনে রাখে। যেন রোদের তাপ না লাগে। স্যাঁৎ স্যাঁৎ-এ ঘরে দোতলায় ধীমান কর আর তার স্ত্রী। নিচে ওপরে আর দুই ভাই। সেই যৌথ পরিবার ভেঙে আজ সমবায় পরিবার। পিতৃদত্ত বাড়িটাই সমবায় সংস্থার পুঁজি। সাধারনের জমি। যে যেমন চাষ করে তেমন তার চলন বলন। কারও ব্যাপারে কেউ খুব একটা নেই। একটা ছাদের তলায়। তাও যে যার। বাড়িটা না থাকলে নিশ্চয় যে যার পছন্দ মত জায়গায় ফ্ল্যাটে থাকত। ন্যূনতম যোগসূত্রটাও থাকত কি না সন্দেহ। এরই মধ্যে ধীমান কর আলোর স্পর্শ পায়। তার আর অন্য দু ভাই অন্যত্র ফ্লাট নিয়ে থাকে। তারা পৈতৃক সম্পত্তির অংশীদারিত্ব দাবি করে ধীমানদের পথ দেখিয়ে দেয় না। সেখানে সে নিজেদের পরিবারের পারস্পরিক বন্ধনের একটা রেশ খুঁজে পায়।
বেলা হয়েছে। কারও তেমন কাজ নেই। সময় কাটে না। কাটাতে হয়। বিরাম বসে কম্পিউটার নিয়ে। আর সুকন্যা গল্পের বই নিয়ে। কাজতো নয় অকাজ। বিরাম বলে :
— — — -একটু কফি করে খাওয়াও না ! অনুরোধের সুর। সুকন্যা বোঝে অনুরোধের সুরে আদেশ। সে বলে,
— — — দেখছো না আমি বইটা পড়ছি। নিজে উঠে ইলেকট্রিক কেটলিতে জল বসিয়ে দাও না। বসে বসে আদেশ না করে পেছনটা ওঠাও।
— — — কোথায় আদেশ করলাম ! এটাতো অনুরোধ মাত্র। আমি কাজে ব্যস্ত। তোমার হাত খালি। তাই বলা। না পারলে দিও না। বিরাম গুম হয়ে যায়। সুকন্যা বই ফেলে রান্নাঘরে ঢোকে। ধীমানের মাথার ওপর সাবেকি আমলের ঘড়িটা। সেই কবে বারোটা বেজে থেমে গেছে ।
ধীমানের পুত্র মধ্যে মধ্যে আসে। তার ইচ্ছে বাবা-মা তার সঙ্গে ভিন প্ৰদেশে গিয়ে বাকি জীবন কাটায়। ধীমানের তাতে মত নেই। আবার উচ্ছেদ ! দেশ ভাগের সেই উচ্ছেদের মর্মান্তিক স্মৃতি ফিরে আসে। এখানে পৈতৃক বাড়িতে অতীতের স্মৃতিটা বেঁচে থাকে। চেনা পরিবেশ চেনা মহল্লা। ঘর থেকে বেরোলেই পরিচিতজন। এক ধরনের উত্তরাধিকার। ছেলে বলে এ বাড়িতো সবার। যার যার পাওনা বুঝিয়ে দিতে হয়। ধীমান যৌথ পরিবারের উত্তরাধিকারটা আঁকড়ে ধরে। ছেলের কথা মানে না। ভাইরাতো দাবি করে নি। আর সেতো তাদের ভাগাভাগি করে যার যেটা পাওনা সেটা নিয়ে নিতে বলেছে। তাদের ভাগে একটা ঘর পড়লেও সেটাই তাদের দুজনের চলে যাবে। পৈতৃক বাড়িটাতো বাঁচবে। অন্যত্র থাকা ভাইরা এ ব্যাপারে উৎসাহী নয়। কিন্তু আজ ধীমানরা চলে গেলে সেটা প্রোমোটারের পেটে যাবে। প্রোমোটারকে ঘেঁষতে দিতে তার মন চায় না। অনেক প্রোমোটার আবেদন করেছে। সে রাজি হয় নি। ধীমান এখানেই বাকি জীবন কাটাতে চায়। এরই মধ্যে বছরে একবার ছেলের ওখানে মাস দুয়েক আর মেয়ের ওখানে গরমটা কাটাবে। এখানেই বন্ধু প্রিয়জন নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে ইচ্ছে। ছেলে কি আর করে। মেনে নিতে হয়। আর সত্যি-ই ত ভিন প্রদেশে বাবা-মা সঙ্গীহীন হয়ে পড়বে।
কিছুদিন হল ধীমান গত হয়েছে। পুত্র কন্যা দুজনেই এসেছে। মায়ের সঙ্গে বসে কথা হচ্ছে। দুজনেই মাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এখানে মা তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। ধীমানের মত তার কাছেও এ বাড়ি একটা স্মৃতস ভরা ঐতিহ্য। এ পাড়ায় তার বাপের বাড়ি। সেই শিশু বেলা থেকে, ধীমানদের আগে থেকে তার এখানে আশ্রয়। এ পল্লীর সেই পুরোনো স্মৃতি। আসে পাশে ভাই বোনেরা এ পাড়ায় ওপাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বন্ধু বান্ধব অনেকে। কিন্তু ছেলে মেয়ে নাচার। মাকে নিয়ে যাবেই। মায়ের মন চায় না। আর ধীমানের স্মৃতিও তার স্মৃতিতে ঘোরাঘুরি করে।
তিনজন কথা বলছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। কুরিয়ারে চিঠি এসেছে। যেন একটা আদেশনামা নিয়ে। ছেলে উঠে গিয়ে আদেশ নামাটা নেয়। ভালো করে পড়ে। পরের প্রজন্মের কেউ একজন জানিয়েছে বাড়িটা যৌথ সম্পত্তি, সবার পাওনা। ভাগ করে দিতে হবে। ধীমান বিষয়টা আগে বহুবার তুললেও ভাইরা গুরুত্ব দেয়নি। আজ পরের প্রজন্মের কেউ সেটা দাবি করছে। সেটাতো স্বাভাবিক। ছেলে মাকে বলে, “দেখো মানুষ যাযাবর জাতি। অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সন্ধানে আজ এখানে কাল সেখানে“। মাকেও মেনে নিতে হয়। ঠিক হয় মাকে নিয়ে তারা চলে যাবে। ওদিকে প্রোমোটারের হাতছানি। মনে পড়ে এক প্রোমোটার বলেছিলো, ” দেখব আর কদিন বাড়িটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন”।
মালিকানা
দু কামরার ছোট ফ্ল্যাট শহরতলিতে। থাকে সুখেন বোস স্ত্রী বাচ্চা মাকে নিয়ে। বাবা মারা গেছেন অনেকদিন। মা অসুস্থ। মেয়ে বছর পাঁচেকের। সুখেন সওদাগর অফিসে কাজ করে। স্ত্রী ঘর সামলায়। সুখেন কাজের চাপে ঘরে বেশি সময় দিতে পারে না। মেয়েটি স্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। সুখী ছোট পরিবার। হেসে খেলে চলছিল। কিন্তু হঠাৎ যেন সব বন্ধ । মেয়ের স্কুল নেই নিজের অফিসের কাজ বাড়ি থেকেই করতে হয়। বাইরে বেরোন বন্ধ। যতটুকু বাজার করা বা অন্য প্রয়োজনে না গেলে নয়। এতদিন স্ত্রী নয়না বাজার করত। এখন সুখেনকেই করতে হয়। স্ত্রী রান্না ঘর মোছা কাপড় কাঁচার কাজ করে। তাছাড়া আছে মেয়ে ও মাকে দেখার ভার। কাজের যে মেয়েটি ছিল তার আসা বারণ।
কোথা থেকে যে করোনার হানা সব স্তব্ধ করে দিল। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয় দরজা জানালা দিয়ে কখন ঘরে ঢোকে! তারপর শরীরে তো ছিদ্রের অভাব নেই। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনের ছিদ্র। সামাজিক দূরত্ব। কেউ যেন স্পর্শ না করে। যে যার নিজের। অন্যের সংস্পর্শ বিপদের কারণ। এক মহাভয়। মহামারি। রোজ আক্রান্ত আর মৃত্যু বেড়ে চলেছে। এটা শুধু এই বোসবাড়ি নয় সারা পৃথিবীর চেহারা। সত্যিকারের বিশ্বায়ন। করোনার বিশ্বায়ন। গরিব বড়লোক সব একাকার। করোনা ঘোর সাম্যবাদী। কাউকে রেওয়াত করে না। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান। সবার জীবন যাপনটা খেয়ে পরে টিকে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে । গাড়ি থাকলেও তার ব্যবহার নেই, মলে গিয়ে কেনাকাটা বন্ধ হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়া ফুর্তি বন্ধ। আরো মুশকিল বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের খেলাধুলো বন্ধ। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই মোবাইল ল্যাপটপে দক্ষ হয়ে উঠছে। ফেসবুক হোয়াটস আপে নেশা চেপে বসছে। এটাই আজ জীবন। ডিজিটাল জীবন।
এই অসহায় জীবনের মধ্যেও বাড়ির গিন্নিরা নতুন একটা জীবনের স্বাদ পাচ্ছে যেন। করোনার আগে কেউ অফিস কেউ স্কুলে গেলে সারাদিন তারা বাড়িতে একা থাকতেন। ঘরের সব কাজ কাঁধে। নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে একা সংসারের বোঝা টানতে হয়। সারাদিন কাজ কিন্তু তার মধ্যেই এক নিঃসঙ্গতা, গৃহস্থালির নিঃসঙ্গতা। আজ সেখানে স্বামী মেয়ে ছেলে সারাদিন সঙ্গে। ভরা সংসার। পরিবারের বন্ধনটা যেন এক আনন্দলোক। এতদিন পুরুষরা মনে করত বাড়িতে স্ত্রীদের বেশ মজা। কত বিশ্রাম। আর তাদের কত ঝামেলা। বিশ্রাম নেই, বাসে ট্রামে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাতায়াত। রোজগারের ধান্দা। কিন্তু কয়েকদিন বাড়িতে থেকে বোস বাবুরা বোঝে ব্যাপারটা তা নয়। চোখে আঙুল দিয়ে করোনা দেখিয়ে দেয় কত ধানে কত চাল। সুখেন বাবু সব দেখে বোঝে ঘরের কাজে হাত লাগানো দরকার। স্ত্রীকে সাহায্য করার হাত বাড়িয়ে দেয়। এটা করোনার অনুগ্রহ নয়নার মত বিশুদ্ধ গৃহিনীর কাছে। সেখানেই তারা যেন আকাশে নিজেদের ভাগটা পায়। জানলা দিয়ে দেখে আজ আকাশ পরিষ্কার। সন্ধ্যায় তারাগুলো কি উজ্জ্বল। জ্যোৎস্নার উদ্ভাসিত আলো বারান্দা হয়ে ঘরে। মনের কোণে উঁকি মারে। রাতের শয্যা ডাকে। সংসারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এই স্বামীস্ত্রী ভাগ করে সংসার চালাবার আনন্দটা আগে এরা পায় নি। তাই এত আতঙ্কের মধ্যেও করোনাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
নয়নার ফুরফুরে মেজাজ। সামনে বসার ছোট্ট ঘরটায় সুখেন মোবাইল হাতে। রান্না হয়ে গেছে। এখন একটু বিশ্রাম। আর আজকাল সুখেন স্নানের সময় কাপড় কেঁচে দেয়। মেয়ে বসে গেছে অনলাইনের স্কুলে। নয়নার কবিতা লেখার ঝোঁক। করোনা যে সুখবার্তা এই দুর্যোগের মধ্যে তার কাছে পৌঁছে দিয়েছে তা নিয়ে সে স্বামীকে তার কবিতার একচ্ছত্র শোনান:
আগে কখনও আমি
ভাবিনি কি আনন্দ ঘরে
প্রিয়জনের মধুর মিলনে
নিভৃত একান্ত আশ্রয়ে
কি মধুর ভালোবাসার ছোঁয়া
দোলা লাগে আমার অন্তরে।
স্ত্রীর এই উৎফুল্ল মনের ভাগিদার সুখেনও। সে ভাবে স্ত্রীকে এত স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে আগে সে দেখেনি তো। তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয় স্ত্রীর আনন্দ গুঞ্জন। সে পরিবারের এই পরিবেশটাকে উপভোগ করে। এর মধ্যেই এতদিনের অভ্যস্ত বাইরের জীবনটা তাকে টানে। সেখানেও যে খোলা মুক্ত জীবনের একটা আনন্দ আছে সেটা সে বোঝে। কিন্তু তাসত্ত্বেও এই সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারটাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। রোগএর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সে তো পূরণ চলতি প্রথা। নতুন কিছু না। মনে আছে ছোটবেলায় পক্স হলে রোগীকে আলাদা করে দেওয়া হত। তার সংস্পর্শে অন্যদের হত। আর স্মল পক্স কলেরা সে তো প্রাণ নিয়ে টানা টানি। কিন্তু সামাজিক দূরত্বটা কি। এ যেন অস্পৃশ্যতা! এ নিয়ে যা চলছে মেনে নেওয়া যায় না। কাজের মেয়েটাকে সেইজন্য বিদায় নিতে হল। সুখেন বলেছিল ওদের দিকটা ভেবে সবেতন ছুটি দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা কার্যকরী করা সম্ভব হয় নি। কাজের লোক ঢোকাই বারণ। স্ত্রীও তাকে বিনা কাজে বেতন দিতে রাজি নয়।
এমনি করে চলছে। এখন পুরো লক ডাউন। দুধ কাগজ এমন কি তরী তরকারীও ঘরে দরজার বাইরে ঠিক করে দেওয়া লোক পৌঁছে দেয়। সাফাই কর্মীরা ময়লা দরজার কাছ থেকে নিয়ে যায়। আর তাদের পেটের দায়ে করোনার ঝুঁকি নিয়েও বেরোতে হয়। তবে পরিবারের লোকের ভয় তারা করোনার বাহক। সুখেন ভাবে আমরা যে কেউ তো করোনার বাহক হতে পারি। তার কাছে সব গুলিয়ে যায়। ভাবে এই মানুষগুলোর যদি পেটে ভাত থাকত তবে তারাও তো করোনার ভয়ে কাজগুলো করতে অস্বীকার করতে পারত।তারা নিজেদের বাঁচাতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার তাগিদ বোধ করত।তবে তাদের কিভাবে চলত। আর সবাই তো জানে উড়ো জাহাজে উচ্চবিত্তদের দেহ ভর করে এদেশে করোনা আমদানি হয়েছে। অথচ তারা করোনা বাহক হলো, তারাই অচ্যুত! আসলে যার ভাত নেই তার কিছুই নেই। আত্মসম্মান নেই নিরাপত্তা নেই। যাই হোক সুখেনবাবুদের বেশ চলছে খাওয়া দাওয়া আর নিজেদের মধ্যে আনন্দে। এতে নয়না বিশেষ খুশি। তার তো বাইরে জীবন নেই তাই এই বদ্ধ জীবনের কষ্টটা তার নেই। বরং এর মধ্যে সে একটা খোলা জীবনের নতুন স্বাদ পাচ্ছে আজ।
অনেক বেলা হয়েছে। সকালে দুধ আসে। কিন্তু আজ এখনও আসে নি। সুখেন বাবুর আবার দুধ ছাড়া চা চলে না। এদিকে সুখেন বাবুর অফিস থেকে খবর আসে তাদের চাকরি আর নেই। কোম্পানি এ মাসের মাইনে দিয়ে সামনের মাস থেকে তাদের আর দরকার নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে। সে খবরটা নয়না এখনও জানে না। সে দুধ না আসায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সুখেন বলে পাশের ফ্ল্যাটে সৌরভদের বাড়ি থেকে আপাতত দুধ এনে কাজ চালিয়ে নিক পরে সুখেন বেরিয়ে ব্যবস্থা করবে। করোনার আগে এভাবে একে অপরের সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে দু পক্ষই। তাই সেটা কোন সমস্যা নয় সুখেন ভাবে। নয়না বেরিয়ে যায় দুধের ব্যবস্থা করতে। সুখেন তখন ফোনে নিরাপত্তা অফিস থেকে জানতে পারে যে এখানে একটা ফ্ল্যাটে করোনা হওয়ায় ভয়ে দুধ দিতে ছেলেটি আসে নি। ইতিমধ্যে কিছুটা অপ্রস্তুত আর যেন বিরক্ত হয়ে নয়না ফেরে। সুখেন ওকে এরকম অবিন্যস্ত দেখে কি হয়েছে জানতে চায়। নয়না বলে সৌরভের মা দরজা খোলে নি। কার যেন করোনা হয়েছে এই ফ্ল্যাটে কোথায় তাই নয়নাকে বিদায় করে দেয়। সে যেন অচ্যুৎ। সুখেনকে এ কথা বলায় সুখেন হাসে। নয়না বিরক্ত হয়ে বলে:
— — — হাসছ কেন?
সুখেন ওকে পাশে বসায়। ঠান্ডা মাথায় বলে:
— — এটাই হবার ছিল। এর জন্য রাগ করার কিছু নেই। আজ আমরা সামাজিক দূরত্বের মধ্যে আছি। শুধু এটা শারীরিক দূরত্ব নয়। একটা মানসিক দূরত্বও যা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। সেই জন্যই তো কাজের মেয়েকে বারণ করেছি বা করতে বাধ্য হয়েছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছি না। ও ভাবছে তোমার করোনা আর তুমি ভাবছ ওর। কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
নয়না কথাটা পুরো মানে না। মনে করিয়ে দেয় সে সৌরভ এর জন্য কত কি করেছে। সুখেন জানে সেটা। কিন্তু এখন যে অবস্থা বদলেছে সেটা আর কে কাকে বোঝাবে? যাই হোক সে জানায় অফিস থেকে খবর এসেছে তার সামনের মাস থেকে চাকরিটা নেই। নয়নার মাথায় হাত। এবার কি হবে। সুখেনের অফিসের ওপর রাগ করে সে বলে:
— — — এ কি? এতদিন অফিসকে দিয়ে গেলে। আজ এই প্রতিদান?
সুখেন বলে:
— — — কোম্পানী জীবনে এটাই নিয়ম। ওটা আমার কোম্পানী আমি ঠিক যেমন কাজের মেয়েটার কোম্পানী।
নয়না বলে:
— — — কাজের মেয়ে আর তুমি এক হল?
সুখেনের উত্তর:
— — — হ্যাঁ একই। আমার কোম্পানী আমার প্রভু আমি যেমন কাজের মেয়েটির প্রভু। যাই হোক আমাদের কিছুদিন চলে যাবে। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে প্রভিডেন্ড ফান্ড আছে। কিছুদিন পর একটা কিছু হয়ে যাবে। আমি ভাবছি ওই মেয়েটির পরিবারটার কি হবে। ওদের যে কিছুদিনও চলবে না। আমি তোমাকে না জানিয়ে দুমাস মাসে ৭৫ শতাংশ মাইনে দিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন সেটা তো আমার পক্ষে আর সম্ভব নাও হতে পারে।
দিদিগিরি
মিত্রবাবুদের ঘোর দুপুর বারোটার পর পাড়ার মোরের আড্ডাটা ছাড়া চলে না। জীবনের সব ক্ষেত্রে ঋতু চক্র কাজ করে। গরম যায়, বর্ষা শরৎ শীত হয়ে বসন্ত আসে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শীতের আক্রমনটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। যত বয়স হচ্ছে তত বসন্ত ছোট হয়ে আসছে কিন্তু শীত যেন প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য দুদিক দিয়েই বেড়ে চলেছে। শরীরের তাপ কমলেও গ্রীষ্মের দহন জ্বালাটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আড্ডার ঋতুচক্র নেই। তার বসন্ত যায় না। সে চিরবসন্ত। চিরবসন্ত যদি কারও জীবনে থাকে তবে তা এই আড্ডার। সেই বসন্তের ছোঁয়াতেই আড্ডার বুড়োগুলো যেন চনমনে হয়ে ওঠে। নিজেদের জীবনের বসন্তের দিনগুলো স্মরণ করে। জীবনের বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসে আলোচনায় । মজলিস জমে ওঠে। তারা অতীতচারি হয়ে পরেন। আড্ডার বিষয়ে চাল থাকে না, বেচাল হয়ে যায়। ওদের আলোচনা শুনে পাশ দিয়ে যাওয়া কিশোর কিশোরী যুবক যুবতীরাও লজ্জা পায়। কিন্তু বুড়োদের লজ্জা নেই। একদিন মিত্রবাবুর স্ত্রী তাঁকে বলেন:
— — — — কি সব আজে বাজে আলোচনা হয় তোমাদের আড্ডায় ! মেয়েও লজ্জা পায়
— — — — মেয়ে কেন শুনতে যায় বড়দের কথা ! আর মায়েদের রসকষ ফুরিয়ে গেলেও আমাদের তো কিছু অবশিষ্ট আছে। মিত্রবাবু রসিকতা করার চেষ্টা করেন বুঝে স্ত্রী আর কথা বাড়াননা। আবার কি বলতে কি বলবেন।মেয়ে পাশের ঘরে।এসব লোককে না ঘাটানোই ভালো।
আজ রোদটা পূর্ণ মাত্রায় পেকেছে। ঘামের সঙ্গে দহন জ্বালা। লু চলছে যেন। আবহাওয়া অফিস থেকে দুদিন ধরে এর বিরুদ্ধে সাবধান বাণী শোনাচ্ছে। জানা যাচ্ছে আজকের গরম গত পঁচিশ বছরে সব থেকে বেশি। আড্ডার সময় হয়ে এল। স্ত্রী অফিস গেছে। মেয়ের কলেজ নেই তাই ব্যাঙ্কের কাজ সারতে গেছে। ও একটা কলেজে পড়ায়। বাড়িতে ওই অভিভাবক। ওর অভিভাবকত্বে বাবা মা দুজনেরই প্রানান্ত। বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া হলে ও সালিশীতে বসে। কার কি অন্যায় বোঝাতে বসে। বোঝে না যে এটা বিবাহিত জীবনের অঙ্গ। বাবাকে এই গরমে বারণ করে গেছে কিন্তু নিজে বারণ করা সত্ত্বেও বেরোল। না গেলে নাকি তার চলবেই না। সবাই বলে বাপকা বেটি। একবার যা ভাববে তা করা চাই। অথচ অন্য সবাইকে “এটা কোর না ওটা কর“ নির্দেশ। কলেজে পড়ানোর মেজাজটা এখানেও। মিত্রবাবু জানেন আজ বেরোলে ঘরে কুরুক্ষেত্র । ও বাবার আড্ডায় যাওয়াটা যে পছন্দ করে না তা নয়। বরং বলে ঘরে বসে আর কি করবে, আড্ডায় যাও, সেটাই ভালো। মন ভালো থাকবে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। মিত্রবাবু ভাবেন উনি যদি আজ বেরোন তবে মেয়ের সর্দারি করার কিছু থাকবে না কারণ সেও বাবার কথা না শুনে বেরিয়েছে। তবে ওর একটা যুক্তি থাকবে। বাবা বেরিয়েছে অকাজে আর মেয়ে বেরিয়েছে কাজে। আর দুজনের বয়সতো এক নয়। একজন সত্তর বছরের বুড়ো আরেকজন মাত্রই ত্রিশ বছরের তরুণী। সুতরাং যুদ্ধের মযদানটা তৈরী হবে বাবা বেরোলে তাতে সন্দেহ নেই। তবে সে ময়দানতো তৈরিই। যুদ্ধটা রোজের ব্যাপার হয় মায়ের সঙ্গে না হয় বাবার সঙ্গে। এইতো সেদিন বিয়ে করতে বলায় কুরুক্ষেত্র বাধল। কি আর করা যাবে !
মিত্রবাবু এই গরমে বেরোবেন না বেরোবেন না করেও ঘরে চাবি দিয়ে নিচে নেমে আসেন । অভ্যেসমত নিচে ভাইয়ের ঘরে চাবিটা রেখে পা বাড়ান আড্ডার দিকে। সঙ্গে তাঁর সঙ্গী ছাতা। আড্ডায় পৌছে দেখা গেল রোজের মত প্রায় সবাই উপস্থিত। সকলেই গরমে কাতর। তাও আসতে হল । বসন্তের টানে। সত্যিই বসন্ত। আড্ডা শুরু হতেই যেন গ্রীষ্ম উধাও। আজ আড্ডায় নেশা ধরেছে। মদ বা পুড়িয়া নয়, ওতে মিত্রবাবুদের বিশেষ কারও আগ্রহ নেই। যাদের একটু আধটু আছে তাঁরা এখানে মদত পান না। আজকের নেশার উপাদান হ`ল সাম্প্রতিক রাজপটের পরিবর্তন। পরিবর্তনে মিত্রবাবু উৎফুল্ল। দাস বাবু নিরাশ। তবে দাসবাবু নৈরাশ্য প্রকাশ করেন না। কে যেন দাস বাবুকে উস্কে দেওয়ার জন্য বলেন :
— — — — কি হ`ল, অস্ত গেল ! সূর্যকে আকাশে বসিয়ে দিলেও তিনি থাকতে চাইলেন না। উদয় হলে তো অস্ত যেতেই হয়। দাসবাবু জানেন এটা আজ তাঁর দিন নয়। এতদিন অনেক বলেছেন এখন তাঁর শোনার পালা। তিনি ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে আগুন কিন্তু তা চেপে রেখে বলেন :
— — — বাজে বোক না। দুদিন হল এসেছ তাতেই গান শুরু হয়ে গেছে, কাজ করব কি করে, সব লুঠে নিয়ে গেল। আরে কোন বাপের বেটা ভারতে একনাগারে পয়ত্রিশ বছর রাজত্ব করেছে ? রাযবাবু একটু খোঁচা দিয়ে বলেন
— — — ওটা পয়ত্রিশ নয় চৌত্রিশ
— — — ওই হলো। এরই মধ্যে কাঁদুনি শুরু হয়ে গেছে কাজ করব কি করে, ওরা লক্ষীর ভান্ডার লুঠে নিয়ে গেল। আরে লক্ষীর ভান্ডার ছিল বলেইতো সেটা লুঠ হল। আজতো লক্ষীই তার ভান্ডার নিয়ে পালিয়েছে। আরে পাঁচ বছর টেঁক, তারপর কথা বলিস।
— — — লুটে পুটে নয়ত কি ? প্রচার করে বেরালি সবেতে প্রথম, তবে এখন লাস্ট কেন। বললেন ব্যানার্জি।
পর্দা চড়ছে, আড্ডাটা জমে উঠেছে। পাশে বসা মজুমদার বাবু কোনুই মেরে মিত্রবাবুকে বলেন:
— — — — ওই দেখ কে আসছে
মিত্রবাবু দেখে একটু অপ্রস্তুতে পড়েন, কি হলো এখানেই হুজ্জুতি বাধাবে নাকি। মেয়ে আসছে। বোধহয় গরমে বেরিয়েছেন বলে ও তেতে গেছে। এখানে সবাই ওকে স্নেহ করে। যদি যুদ্ধ বাঁধায় তবে সবাই ওর সেনাপতি হয়ে যাবে। একা লড়বেন কি করে? ভাবতে ভাবতে মেয়ে হাজির। একটু ইতস্তত হয়ে আগ বাড়িয়ে মিত্রবাবু বলেন :
— — — — এইতো বাড়িতে একা, ভালো লাগছিল না তাই এলাম। দেখতো গাছের নিচে কি হাওয়া। সবাই এসেছে দেখ। মেয়ে বলে:
— — — কে কৈফয়েত চেয়েছে। তোমরা জাহান্নামে যাও। মজুমদার ফোড়ন কাটে
— — — পাগলি দেখ, আমরা বলছিলাম এই গরমে বেরলি কেন ? ছোটবেলা থেকে কাকুরা ওকে পাগলি বলেই ডাকে । মজুমদার শয়তানটা নাম দিয়েছে। রীতা উত্তর দেয়
— — — তা তোমরা বেরিয়েছ কেন ?
— — — আমাদের বাড়িতেতো তোর মত একটা পাগলি মেয়ে নেই । আজ কোথায় মেয়ের ছুটি, তার সঙ্গে বসে গল্প করবে না এই গরমে বেরোনো চাই। মজুমদার ওকে তাতিয়ে দেন । রীতা রেগে যায়, বলে
— — — দেখো ফালতু কথা বোল না, আমি কাজে এসেছি।
— — — কি কাজ সেটা বল। কেউ বাড়িতে এসেছে নাকি? জানতে চান মিত্রবাবু
— — — না, তোমরা আমার সঙ্গে চল
— — — কেন কোথায়?
— — — ব্যাঙ্কে। চল, চল বলছি। এত ব্যাখ্যা দিতে পারব না। মিত্রবাবু একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যা ঠোঁট কাটা মেয়ে ! আবার কাকে কি বলে বসলো ! নাকি ব্যাঙ্কের সামনে যে চ্যংরাগুলো বসে তাদের সঙ্গে লাগলো।
— — — সবাইকে যেতে হবে? বলত মালপত্র নিয়ে যাই। শিক্ষা দিয়ে দেব। ঠাট্টা করে জানাবাবু বলেন ।
— — — ও! তোমাকে কে বাঁচায় তার ঠিক নেই, তোমার মুরদ কত জানা আছে। কথাটা রীতা খুব ভুল বলেনি। জানা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভিতু। কোন গোলমাল দেখলে পিঠটান দেয়।
— — — দেখো তোমরা কিন্তু দায়িত্ব এড়াচ্ছ। না গেলে বল আমি যাচ্ছি। রিতা যেন আরও বিরক্ত হয়।
— — — কিসের দায়িত্ব কি ব্যাপার কিছুই বুঝলাম না আর তুই আমাদের দোষ দিচ্ছিস? কোথায় যাবি চল। মজুমদার বলে।
সবাই ওঠে। মিত্রবাবু বলেন সবাই এভাবে যাওয়া ঠিক নয়। চল মজুমদার, আমরা দুজন যাই আগে দেখি ব্যাপারটা কি।
রিতা রওনা দিয়ে দিয়েছে, আমরা ওর পেছন পেছন যাই। ও প্রায় ছুটছে। যেন সামরিক বাহিনীর জোয়ান। মজুমদার বলেন :
— — — — দেখো কোথায় কি হোল, ওকে বিশ্বাস নেই। মনে আছে একটা ছেলেকে কেমন ঠাসিয়ে দিয়েছিল ওর পেছনে লাগার জন্য।
— — — সেটাইতো ভয়।
— — — তারপর থেকে ওর পেছনে কেউ লাগে না। সব মেয়েরা এরকম হলে রাস্তাঘাটে ওদের আর ভুগতে হয় না। মিত্রবাবু একটু শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কি জানি কি হল!
তারা ব্যাংকের দরজায় চলে আসে। সেখানে গিয়ে ঢোকে । মনে হল কর্মচারীরা সবাই যেন রিতার জন্যই অপেক্ষা করছে। সামনে বসে এক বৃদ্ধ। উঠে এসে রিতার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। মিত্রবাবুরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। কি হল রে বাবা ! কিছুই বোঝেন না। কোন ডাকাতি টাকাতির ব্যাপার নাকি ! মজুমদার এগিয়ে যান ভদ্রলোকের দিকে। রিতাকে বলেন
— — — কিরে কি হল ? ভদ্রলোক নিজেকে সামলে বলেন
— — — এই মেয়ে ছিল বলে আজ আমি বাঁচলাম। মজুমদার বলেন
— — — কেউ কি ছিনতাই করতে এসেছিল? বৃদ্ধ বলেন
— — — সেটা হলে তো একটা কথা ছিল। যেটা হয়েছে সেটা আমার কাছে খুব লজ্জার ব্যাপার। আমার ছেলে, বলি কি করে ! উনি আবার কেঁদে ফেলেন। মিত্রমশাইরা ভাবেন কি জানি উনার ছেলে রিতার সঙ্গে কোন অসন্মানজনক ব্যাবহার করলো কিনা। তবে ছেলে আসেপাশে কোথাও আছে বলেতো মনে হচ্ছে না। এসবের মধ্যে ব্যাঙ্কের একজন বয়স্ক কর্মচারি এসে বলেন:
— — — উনার ছেলে উনাকে উনার জমানো পাঁচ লাখ টাকা তাকে লিখে দিতে বলে। ভদ্রলোক সেটাতে রাজি না হওয়ায় ও জোর করতে থাকে।কথাকাটাকাটির পর সুপুত্র বাবাকে মারতে থাকে। তখনই ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে ছেলের গালে এক চড় মেরে উনাকে ছাড়িয়ে নেন। আমরা সবাই মিলে তখন ছেলেটিকে ঘাড় ধরে বার করে দিই। ধন্যি মেয়ে।আমরা যেটা পারিনি ও সেটা করলো। রিতা যেন একটু লজ্জা পেল। ও বলে,
— — — ওসব কথা থাক। মেসোমশাই-এর একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। উনি বাড়ি যেতে ভরসা পাচ্ছেন না। মজুমদার একটু উচ্ছসিত বোধ করেন। বলেন
— — — সেটা এমন কোন ব্যাপার নয়। আমার বাড়িতে না হয় থাকবেন। আজ থেকে তোর মেসোমশাই আমাদের আড্ডার ক্লাবের সদস্য। রিতা তুই বাড়ি যা। হ্যা মাকে বলিস রাতে মাংস ভাতের ব্যবস্থা করতে। সবার জন্য কিন্তু। তোর অনারে। টাকা দেবেন তোর মেসোমশাই। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলেন:
— — — কি রাজি তো।
রীতা টিপ্পনি কাটে
— — — এটা তোলাবাজি হয়ে যাচ্ছে না ! সবাই হেসে ওঠে। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে রিতার মেশোমশায়ায় I
ফিরে দেখা
০৭/০৪/২০২১
ভদ্রলোকের নাম রূপক। বয়স পঁচাত্তর ঊর্ধ্ব। পুরো নাম রূপক সুর। এই পল্লী অঞ্চলে বাস প্রায় ত্রিশ বছর। অবসরের বেশ কিছুদিন আগেই এখানে ঘর বেঁধেছে। ইচ্ছে ছিল ছিমছাম শহর থেকে দূরে এখানে পরিবার নিয়ে থাকবে। পরিবার বলতে স্ত্রী এক মেয়ে আর এক ছেলে। সঙ্গে বাবা মা থাকতেন। আজ তাঁরা আর নেই। ছেলে মেয়ে দুজনেই প্রবাসী। তাই পরিবারটা বহরে কমতে কমতে দু’য়ে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই এত বড় বাড়িতে। তার মধ্যে বছরে কিছুদিন ছেলে মেয়ের ওখানে। এখানে এখন এক একাকীত্বের জীবন।
রূপকবাবু ছিমছাম মিশুকে আড্ডাবাজ মানুষ। সরেস চরিত্রের। এককালে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আর অত্যাচার সহ্য করতে হত স্ত্রীকে। তিনি সেটা চিরকাল হাসিমুখে মানিয়ে নিতেন। এখন বয়স হয়েছে। বন্ধুবান্ধব অনেকে বিদায় নিয়েছে। কেউ কেউ আর বেরোতে পারে না। আড্ডাটা আর সেরকম নেই। কেউ কখনও আসে। রূপকবাবুও এর তার বাড়ি মাঝে মধ্যে যায়। তবে একান্তই অনিয়মিত। ফোনেই কাজ সারে। লেখালেখি নিয়ে সময় কাটে। তাও হাতে অঢেল সময়। তাই সময় কাটে না। এ ধরণের আড্ডাবাজ মানুষের জীবনে আড্ডার সংস্থানটা উঠে গেলে একাকীত্ব বোধটা যেন আরও চেপে বসে। মনটাও খিঁচড়ে থাকে। আর স্ত্রীর সঙ্গে কত আর কথা? সবটাই যেন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। কখনও সখনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বন্ধু এলে ভালো লাগে সময় কেটে যায়। স্ত্রীও সেটাতে আনন্দ পায়।
এই বয়সে সবাইকে বোধহয় অতীতটা টানে। অতীতের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে যেন মানুষ নিজেকে ফিরে পেতে চায়। রূপকবাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কেন হবে! সেও মধ্যে মধ্যে অতীতচারিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে। বিস্মৃতির সমুদ্রের অতলে যেন তলিয়ে যায়। খুঁজে ফেরে সমুদ্রের অতলের রত্ন ভান্ডার। আর ওর ঘটনাবহুল জীবনে আজ অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও স্মৃতির বৈঠা বেয়ে যতটুকু হাজির হয় তা নেহাৎ কম নয় বরং বৈচিত্রে ভরপুর যেন এক মহাভারত। টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন। বিস্মৃতির অন্ধকার ঠেলে অনেক কিছু পরস্পর পরম্পরায় আলোয় আসতে পারে না বলে ঘটনাগুলো যা ভেসে ওঠে মনসাগরের ওপরের স্তরে সেগুলো ছিন্ন ভিন্ন । পরস্পরকে একটা গ্রন্থিতে বাঁধা যায় না। তাই সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে ওঠে। এরই মধ্যে কিছু স্মৃতি পরস্পর পরম্পরায় মনোজগতে ভেসে ওঠে, স্নায়ুর প্রাঙ্গনে খেলা করে। সেগুলো নিয়ে সময় কাটে ভালো।
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ কৌশিকের সাথে। সেটা কর্মজীবনে দুজনের কর্মক্ষেত্র আলাদা হওয়ায় কিছুদিনের জন্য শিথিল হয়ে পড়েছিল। আজ এই শেষ বয়সে আবার ভালো করে ঝালিয়ে নেওয়া গেছে। অন্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ। এছাড়া আছে বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের বন্ধু। পাড়ার ছেলে বুড়োরা। তবে আজকাল বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন হয় না বলে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হতে বসেছে। এটা হয়েছে আরও প্রযুক্তিতে অনুরাগ থেকে যা মাদকতা বা addiction এর জন্ম দেয়। আজ সামাজিক সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা এনে প্রযুক্তির কল্যাণে হোয়াটস আপ এ যোগাযোগ কথপোকথন আড্ডা। তাই মনে হয় প্রযুক্তি দিয়েছে যত কেড়েছে তার থেকে বেশি। যেন রূপকবাবুর মত মানুষের মননটাই একটা ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত হয় এখন। আর গত প্রায় দেড় বছর করনাকালে এটা এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সমাজের গঠন প্রক্রিয়াটাই যেন বদলে যাচ্ছে। রক্ত মাংসের প্রাণ স্পন্দনের জায়গায় গেড়ে বসতে চলেছে যন্ত্রের কম্পন, যেন এক নতুন স্পন্দন যেখানে প্রানের স্পন্দনটা আগের মত অনুভূত হয় না। তবে নেশার আচ্ছন্নতা জীবনকে ধোঁয়াশা করে তুলেছে। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে নয় যন্ত্রের মুখোমুখি হয়ে তার সঙ্গে নির্বাক আলাপেই যেন জীবন অতিবাহিত হয়। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখিতে যে প্রানের স্পন্দন এতদিন সে অনুভব করত সে সম্পর্কে রূপকবাবুর অনুভূতিটা:
বয়ে চলে বুকের অলিন্দে
স্রোতস্বিনী নদী
থৈ থৈ তার কলতানে
সুখের ডিঙা বেয়ে।
আজের পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর মনে হয়:
সেই নদী শ্রোতহারা আজ
একাকিত্বের পলি জমে
হালে পানি পায় না আর
পাল হারা সে ক্রমে।
হৃদয়ে আমার গভীর ক্ষত
রক্ত ঝরে তাতে
রক্তের নদী বয়ে চলে
তুফান ওঠে প্রাতে।
এই যে যন্ত্র নিয়ে এই মাদকতা আজ করোনা কালে, যে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেটাই যেন রূপকবাবুর ওপর চেপে বসতে সাহায্য করেছে। সে অনুভব করে যেন অজানা এক আতংক সবাইকে তাড়া করে বেড়ায়। কেউ আর চায় না একজন আরেকজনের বাড়িতে আসুক পাছে করোনা সঙ্গে আসে। সে আরও বোঝে এখন যেটা মানুষ ভয়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য করছে সে তাকে অন্য একটা জীবনে অভ্যস্ত করে দেবে। যন্ত্র নিয়ে বসে থাকা মাদক গ্রস্ত মানুষ অন্তর্মুখী হয়ে পড়বে বেরোতে চাইবে না। সামাজিক বিচ্ছিন্নতাটাই তার কাম্য হয়ে উঠবে। এই লক্ষণ রূপকবাবু নিজের মধ্যেও দেখছেন। যেমন ওঁদের একমাত্র স্নেহের বোন যে মাত্র পাঁচ ছ কিল মিটার দূরে থাকে আজ প্রায় একবছর ওর সঙ্গে দেখা হয় না। বা রূপকবাবুর খুব স্নেহের পাত্রী শালী খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও সে তাকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পারে নি। কাছে থাকা সত্ত্বেও তার ছেলে বারণ করার জন্য বাড়িতেও যাওয়া হয় নি। ছেলের দুটি বাচ্চা আছে। তার ভয় কেউ গেলে যদি করনা ঢোকে। তাই মায়ের বেশি কথা বলা উচিত নয় সে যুক্তিতে আত্মীয়স্বজনের প্রবেশও যেন নিষিদ্ধ। আর এই তো সেদিন মেয়ের বাড়ির এপার্টমেন্টে একজনের অনুরোধে রূপকবাবু তাঁর সঙ্গে পরিচিত একজনের ফ্ল্যাটে যায়। দরজা থেকে উনি স্ত্রী অসুস্থ অজুহাতে তাদের বিদায় করেন। রূপকবাবু এটা অনুমান করেছিল ভদ্রলোকের সাম্প্রতিক চলন বলনে। কিন্ত প্রতিবেশীর অনুরোধে যেতে হয়। তাতে তাঁর অনুমানটা সত্য বলে প্রমাণ হয়। ভদ্র সমাজে মানুষের চালচলন আঁচার ব্যবহারে এই যে পরিবর্তন তার জন্য ব্যক্তিবিশেষে কাউকে দায়ী করা যায় না। এ এক সামাজিক মনস্তত্বের পরিবর্তন যা প্রাত্যহিক জীবনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কি জানি এটাই হয়তো নিয়ম হতে চলেছে। সে একটা রোবট চালিত জীবন যেটা নিয়ে পশ্চিমি জগত আজ উত্তাল। সমাজের যে পরিবর্তন যেটা সমাজ জীবনের যান্ত্রিকরনের ফলে নীরবে ঘটে চলেছিল সেটা করোনা আক্রমণে সরব হয়ে ওঠে ত্বরান্বিত হয় আজ ভারতের মত দেশেও। নিন্দুকরা বলে এর পেছনে একটা কায়েমী স্বার্থ কাজ করে।
যাই হোক আজ এটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এল। পাঠকরা হয়তো একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। আমরা আমাদের গল্পে ফিরে আসি। সারাদিন কম্পিউটারে মোবাইলে লেখালেখি কিছুটা পড়াশুনার পর রাতে বিছানা নিলে রূপকবাবুর অতীতটা তাঁর স্নায়ুর জগতে হানা দেয়। শৈশবের খেলাঘর থেকে কৈশোর জীবনে বিচরণ তার। কত কথা মনে পড়ে। খেলার মাঠ থেকে লেখাপড়া প্রেম বাদবিবাদ সব কিছু নিয়ে সে যেন এক উপন্যাস। তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট টুকরো টুকরো গল্প। এ রকমই একটা গল্প রূপকবাবুর কৈশোরের প্রেম নিয়ে সেটাই যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেই কিশোরীর মুখ। তার নাম গোত্র সবই মনে আছে। মনের বাসরে আজও তার যাতায়াত। ভুলতে চেষ্টা করলেও ভোলা যায় না। বঙ্কিম চাটুজ্জের ভাষায় ‘বাল্যপ্রণয়ে অভিসম্পাত আছে’। সেটা বাস্তবায়িত হয় না। সবার জীবনে কথাটা সত্য না হলেও রূপকের জীবনে সত্য। আর তা নিয়ে যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রনা। হারিয়ে গেল সে। রূপক খুঁজে আনতে পারল না। সেটা যেন তার ব্যর্থতা। কেমন যেন একটা হেরো হেরো মনোভাব। একটা হীনমন্য মানসিকতা। হারটাকে আজও মেনে নিতে পারে নি রূপক। আর সেজন্যই বোধ হয় আজও রূপকের মানসে মেয়েটি এত সুন্দরী, আজও ভরা যৌবন তার রূপকের কল্পলোকে। তার দেহের গন্ধ যেন আজও রূপককে আবিষ্ট করে। রূপকের অনুশোচনা যে মেয়েটির সঙ্গে কোনোদিন তেমন ঝগড়া ঝাটি মনোমালিন্য হয় নি তাও বিচ্ছেদ। তার নীরবে আসা নীরবে হারিয়ে যাওয়া। মেনে নেওয়া যায় না। তাও মেনে নিতে হয় বাল্য প্রণয়ে অভিসম্পাত থাকায়। তবে রূপক ব্যর্থ প্রেমিক হলেও দেবদাস হয়ে যায় নি। পরে বিয়ে করেছে সংসার করেছে। হয় তো রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার বন্যা ভেবেই রূপক তাকে গ্রহণ করেছে যে তার হৃদসাগরে এক সাগর যে জলে সে আজও সে সাঁতার করে। আর ঘরণী তার স্ত্রী যে ঘরার জল, তাঁর রোজের তৃষ্ণা মেটায়।
শুধু যে প্রেম কাহিনী তা নয় শৈশবের স্মৃতি বালক বেলার গুলি লাট্টু ঘুড়ি আজও রূপককে যেন ইশারায় ডাকে। ফুটবল ক্রিকেট মাঠ। মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি আবার ওদের নিয়ে কত না দুষ্টুমি। মা বাবার দৃষ্টি এড়িয়ে পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। আর আছে দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে কলকাতায় কোন এক ফ্ল্যাটে বাবা মা জ্যাঠতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাই বোনদের নিয়ে জনা বিশেকের যৌথ পরিবার। দাদা দিদিদের কোলে পিঠে বড় হওয়া। সে এক কোলাহল মুখর জীবন যা আজ স্মৃতি। এ ছাড়া আছে তার যৌবনের স্মৃতিকথা। রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন রূপকএর জীবনকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। আত্মস্বার্থে নিজের রোজগেরে জীবন নয় পরার্থে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাকে নিয়ে গেছে জীবনের অন্য এক প্রাঙ্গণে যেখানে তার কাছে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। খুব কাছ থেকে সে অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তার জীবন যাপন দৈনিক জীবনের টান পোড়েন দেখেছে। তাদের স্বপ্ন স্বার্থক না হলেও তার সেদিনের সেই যৌবন তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে অনেক। সেই জন্য একই সঙ্গে সে কৃতজ্ঞ সেই জীবনের কাছে যাকে তার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন বলা চলে। সময়ের দিক থেকে সেটা সংক্ষিপ্ত হলেও গভীরতার দিক থেকে তা যেন অতল সমুদ্র। এই জীবনের আয়নায় সে তার নিজের জীবনের দুটো সত্তার সন্ধান পায়। তার ভেতরের সত্তা যা তার মননে তার চেতনায় এক আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার তাগিদ অনুভব করতে শেখায়। অপরদিকে ব্যবহার জীবনে আত্মস্বার্থে মগ্ন আরেকটা সত্তা যে নিজেকে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দকে বেশী বোঝে। এ এক দ্বৈত সত্তার একই মানুষ।
সারাদিনের পর আধা ঘুমে আধা জেগে থাকা রূপকের রাত কাটে স্মৃতিচারণে। সকালে আজকাল উঠতে দেরী হয়। পায়ের জোর কমে যাওয়ায় হাটাহাটিতে অনীহা।কোষ্ঠ কাঠিন্যের এক অদ্ভুত কঠিন জীবন। সকালে উঠেই যন্ত্রের মাদকতা তাকে আকৃষ্ট করে। কেউ যদি আসেও তার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে মোবাইল বা ট্যাবে রূপক বাবুর উৎসাহ বেশি। স্ত্রী তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে অসামাজিক হয়ে গেছে। যেন আত্মস্বার্থের আমিটা জেগে ওঠে রাতে যে ঘুমিয়ে ছিল। এই ভাবে তার নিজেকে নিয়ে চলে। এ জীবনে না আছে ভাড়ার ঘরে চুরি হওয়ার ভয় আবার না আছে ভাড়ারে কিছু জমা পড়ার সম্ভাবনা। এক নিস্তরঙ্গ জীবন। যেন স্রোতহীন এক মজা নদী।
রূপক সকালে যথারীতি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ মোবাইল জানান দেয় কে তাকে ডাকছে। সে মোবাইলে লেখা বন্ধ করে সে ডাকে সাড়া দেয়। ওপার থেকে কার কণ্ঠস্বর। রূপক চিনতে পারে না। আজকাল ও ভয়ে শিটকে থাকে। কি জানি আবার কোন জালিয়াত জাল পাতে নি তো। এই সেদিন ফাঁদে পড়ে তাকে কিছু গুনাকার দিতে হয়েছে। এটা আজ রোজের ঘটনা। সে লাইন কেঁটে দেবে ভাবতে ভাবতে ওপার থেকে জানান দেয় তার স্কুলের বন্ধু কুণাল তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এক বন্ধুর কাছ থেকে ওর নম্বরটা পেয়ে ফোন করেছে। কুণাল মানে কুণাল মিত্র। ও পড়াশুনা শেষ করে সেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হলো অন্য প্রদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। বোধহয় রায়পুর না কোথায়। তারপর থেকে যোগাযোগ নেই। ওর ফোন পেয়ে রূপক উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওরা স্কুল টিমে একসঙ্গে খেলত। মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া সব কথা। কুণালের বাবা মা রূপককে খুব ভালোবাসতো। ওর এক বোন ছিল। রূপকের সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিল। ওকে নিয়ে বন্ধুবান্ধব অনেকের উৎসাহ থাকলেও রূপক যেন ওর অভিবাবক ছিল। ও ডানপিটে ছিল বলে বন্ধুবান্ধব ওকে সমীহ করত। রূপক ওর অভিবাবক তথা দাদা হয়ে একটা আত্মসন্তুষ্টিতে থাকত। ওকে আগলে রাখত। এরকম একজন পাহারাদার পাওয়ায় কুণালের বাবা মাও নিশ্চিন্ত। আর টুম্পাও ওকে ভরসা করত। রূপক এই পবিত্র সম্পর্কে প্রেমের ‘কালিমা‘ যেন না লাগে তার চৌকিদার হয়ে উঠেছিল। তারপর কিছুদিন রূপকের সেই কৈশোর প্রেমকাহিনী যার পত্রবাহক ছিল টুম্পা। যাই হোক উত্তেজিত রূপক মোবাইলে কুণালকে নেমন্তন্ন করে। করোনার বিধিনিষেধে কিছুটা ছেদ টানা হয়। কুণালও আসতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। একটা দিন স্থির হয় যেদিন কুণাল আসবে ওর স্ত্রীকে নিয়ে। রূপক কৌশিককেও সেদিন আসতে বলবে বলে স্থির হয়।
রোববার উপস্থিত। কুণাল কৌশিকরা এসেছে। সঙ্গে ওদের স্ত্রীরা। কৌশিকের স্ত্রীকে রূপক আর রূপকের স্ত্রী চেনে। কিন্তু কুণালের স্ত্রীর সঙ্গে ওদের এই প্রথম পরিচয় হয়। রূপকের আর কৌশিকের স্ত্রীর সাথে কুণালের পরিচয় হয়। কুনাল স্কুলের বন্ধু হলেও অনেকদিন হলো স্মৃতির অন্তরালে চলে যায়। এখন চেহারায় চলন বলনে সবারই পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রথম দর্শনেই চিনেছে একে অপরকে তা বলা যায় না। সবাই ছোটবেলার বন্ধুকে সেই ছোটবেলার আদলে চিনতে চায়। কিন্তু সময় সেটা হতে দেয় না। তাই মনের মধ্যে উথাল পাতাল সত্বেও সেভাবে নিজের করে নিতে একটু সময় লাগে। মহিলারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যেমন একটা গ্রন্থি গড়ে তুলতে ব্যস্ত তেমনি পুরোনো বন্ধুরা স্মৃতির অলিন্দ ধরে পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয় বিভিন্ন ঘটনা ধরে। আস্তে আস্তে আড্ডা জমে ওঠে। আজ ওরা সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবে। কুণাল স্ত্রীকে নিয়ে রূপকের মুখোমুখি। স্ত্রীর নাম কি ওর বাপের বাড়ি কোথায় ওদের বিয়ের বিষয় সব বিষয় আলোচনায় ওঠে। সবাই খুব অল্প সময়ে একে অপরের আন্তরিক হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি। ছোটবেলায় কে কেমন ছিল এসব আলোচনা উঠে আসে। কুণাল রূপকের শৈশবের প্রেম নিয়ে ঠাট্টা করে। সে কুণালের সেই প্রেমিকাকে চিনত না তবে ব্যাপারটা জানত। এ ছাড়া সবার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীদের নিয়ে আলোচনা জমে ওঠে।
প্রথম পর্বের আড্ডার পর খাওয়া দাওয়ার পালা। সবাই একসঙ্গে বসে। মহিলারা সবাই পরিবেশনে হাত লাগায়। মাছ মাংস মিলিয়ে জমাটি ব্যবস্থা। রান্না রূপকের স্ত্রীর হাতের। সঙ্গে পরিচালিকা। সবাই রান্নার বিশেষ প্রশংসা করে। কুণাল জানায় ওর স্ত্রীও ভালো উত্তর ভারতীয় খাবার রান্না করে। ও থাকতে থাকতে ওরা যদি কুণালের ওখানে যায় তবে একদিন আবার আড্ডাটা বসতে পারে কুণালের ওখানে মানে কুণালের পৈতৃক বাড়িতে যেখানে কুণালের দাদার পরিবার থাকে। দাদার বউ তাদের ছেলে আর ছেলের বউ। কুণাল জানায় কোন অসুবিধে নেই এ ব্যাপারে। ওর দাদা আর বৌদি ওদের বন্ধুর মত। সবাই রাজি হয়। খাওয়াদাওয়ার মধ্যেই রূপক লক্ষ্য করে কুণালের স্ত্রী যেন ওর ওপর একটু বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে। রূপক যতটা পারে নীরব দর্শক। নিজেকে প্রকাশ করে না। ও সাবধান ওর প্রকাশে যেন কোন কৌতূহল না থাকে। আর কৌতূহল থাকবেই বা কেন ? ও তো আগে ওকে দেখে নি। ভাবতে ভাবতে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে। খাওয়া পর্ব শেষ হয়। রূপকের অস্বস্তিটা কেউ তেমন টের পায় না। তবে হাব ভাবে বোঝা যায় রূপকের স্ত্রী যেন কিছু একটা ইঙ্গিত পেয়েছে। কি জানি বুড়ো বয়সে আবার ভীমরতি না কি! পরস্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ!
খাওয়া দাওয়ার পর মহিলারা একটা ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে। রূপক কৌশিক আর কুনাল বসে বসার ঘরে। ওদের স্মৃতিচারণ আবার শুরু হয়। সেই স্কুল, স্কুল প্রাঙ্গণ। স্কুলের শিক্ষকরা। বালিগঞ্জের তেমন নাম না জানা স্কুল। যাই হোক সে তো নিজেদের স্কুল। সেটা যেমন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উপাসনাগার তেমনি সেটা বাল্য ও কৈশোরের উপবন। একটা সমাজিকরণের প্রতিষ্ঠান যেখানে সমবয়সীদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয়। পরিবারের বাইরের অভিভাবকদেরও চিনিয়ে দেয়। তাদের স্নেহে শুধু পাঠাভ্যাস নয়, জীবনের মূল্যবোধও তৈরী হয়। এ ব্যাপারে কোন শিক্ষক কেমন ছিলেন তা নিয়ে যে যার মত দেয়। পরিবারের মধ্যেকার বজ্রকঠিন বাঁধুনি স্কুলে বন্ধুদের সান্নিধ্যে অনেকটা আলগা হয়। তাছাড়া এই সময়ে সিগারেট খাওয়া আড্ডা দেওয়ার কু অভ্যাসগুলো তৈরি হয়। আপাত কুঅভ্যাসগুলো জীবনে যে প্রাণশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে সেটা কথায় কথায় ওঠে । আজকের শিশুদের মত পড়ার চাপ তখন ছিল না। প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার পরস্পর প্রতিযোগিতা ছিল না। যতটুকু পড়াশুনা সেটা স্বেচ্ছা কল্প। বাধ্যতামূলক নয়। পাশ করা নিয়ে কথা। তাই একইসঙ্গে খেলাধুলার সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠত। স্কুলে উঠোনে গুলি খেলার রীতি ছিল। টিফিনে সেটাতে বারণ ছিল না। পড়াশুনায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার প্রতিযোগিতা না থাকলেও দুষ্টুমিতে প্রতিযোগিতা ছিল। কে কত বেশি দুষ্টু হতে পারে। আর দুষ্টুমির জন্য মাষ্টারমশাইদের ঠিক করে দেওয়া এক এক ধরণের শাস্তি উপহার হিসেবে পাওনা ছিল। হাতে বা পিঠে বেত্রাঘাত, নিলডাউন, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি। আবার কোন কোন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যারা দুষ্টুমির জন্য নয় শাস্তি দিয়ে আনন্দ পেতেন বলে শাস্তি দিতেন। যারা দুষ্টুমি করার জন্য শাস্তি দিতেন তাদের ওপর রাগটা স্থায়ী হত না। ওটা প্রাপ্য বলে ছাত্ররা মেনে নিত। কিন্তু যারা আনন্দ পাবার জন্য শাস্তি দিত তাদের ওপর রাগটা স্থায়িত্ব পায়। রূপকদের স্কুল পড়াশুনায় সামনের সারিতে না থাকলেও খেলাধুলায় প্রথম সারিতে থাকত। বিশেষ করে ক্রিকেটে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। স্কুল থেকে ভালো ভালো খেলোয়াড় উঠে এসেছে যারা রাজ্যের হয়ে এমনকি দেশের হয়েও খেলেছে। নানা বিষয়ে অতীতচারিতায় সময় কেটে যায়। চা আসে। সবাই চা নিয়ে বসে। স্ত্রীরাও যোগ দেয়। চা খেয়ে এবার ফেরার পালা। ফিরতে না চাইলেও সবাইকে ফিরতে হয়। এর পর কুণালের বাড়িতে দেখা হবে আশা করে যে যার বিদায় নেয়।
সবাই চলে যাওয়ার পর রূপকের স্ত্রী রূপককে নিয়ে ঠাট্টা শুরু করে। জানায় সে লক্ষ্য করেছে কুণালের স্ত্রীর বিশেষ নজর ছিল ওর ওপর। আর কুণালের চোখেও এক বিস্ফোরণ। কি ব্যাপার বুড়োবয়সে পরস্ত্রীকাতরতা। কুনাল ঠাট্টা করে বলে বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্ক অস্বাভাবিক কি? ওর ভেতর একটা পৌরুষ আছে বলেই তো ওর প্রতি মহিলাদের আকর্ষণ। এটা তো নতুন কিছু না। রূপক এটাও জানায় যে কুণালের স্ত্রীর সঙ্গে আগে ওর পরিচয় ছিল না । এই প্রথম। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে তার কৈশোর প্রেম সম্পর্কে রূপক নিজেই তার স্ত্রীকে জানিয়েছিল। সেটা তুলে খোঁটা দিতে মিতা তাকে ছাড়ে না।
রূপকের এই আড্ডার পর কেমন যেন পরিবর্তন আসে। সে যেন তার পুরোনো সত্তাটা ফেরত পায়। দুদিন মোবাইলে কোন কাজ করে না। পাড়ার পুরোনো ভাঙা আড্ডাটায় বেলার দিকে যায়। আবার সেই পুরোনো পরিবেশে আগের সবাক রূপক। যেন মৌনব্রত ভঙ্গ করে। একাকীত্বের স্তব্ধতার শ্মশান থেকে উঠে দাঁড়াতে চায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে নিজেকে পেতে চায়। করোনা আক্রমণের ভয়ে গুটিয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু ও চাইলেই তো হবে না। সামাজিক পরিবেশ তার সহায়ক নয়। তাও সবকিছুতে আরও আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে চাইছে। তার এই চেষ্টার দিন তিনেক পর এক সন্ধ্যায় কুণাল এসে হাজির। ও একাই এসেছে। রূপক খুব খুশি হয়। জানতে চায় কুণালের স্ত্রী আসে নি কেন। কুণাল জানায় ও আসতে পারে নি। তবে একটা চিঠি পাঠিয়েছে রূপকের উদ্দেশ্যে। চিঠিটা ও রূপকের হাতে দেয়। রূপক অবাক হয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে:
প্রিয় রূপক
কাল বোধ হয় আমাকে চিনতে পারো নি। বয়স হয়েছে। বদলে গেছি। তাই না চেনা স্বাভাবিক। তবে আমি তোমায় দেখেই চিনেছি। সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের জন্য ফিরে গেলাম সেই অতীতের আমিতে। সেদিনের চিত্রা। আমাদের বিচ্ছেদের প্রায় দশ বছর পর কুণালের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আর বিয়েতে ঘটকালি করে তোমার স্নেহধন্যা টুম্পা, কুণালের বোন। টুম্পাকে চিনলেও কুণালকে আমি চিনতাম না। কুণালও আমাকে চিনত না। টুম্পা আমাদের বিয়ের খবরটা গোপন রেখেছিল তোমাকে বলে নি তুমি আঘাত পাবে ভেবে। যাই হোক তারপর প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। আমরা মানিয়ে নিয়েছি। ছেলে মেয়েকে নিয়ে সংসার করছি। তুমিও তাই। যে কোন কারণে আমাদের বিয়েটা হয় নি। আর সেজন্যই বোধ হয় টানটা বেড়েছে। তাই দেখেই চিনেছি। তবে জানান দিই নি। জানি না তুমি বোধ হয় আমাকে চেন নি বা চিনতে চাও নি। ভালোবাসা জেনো
ইতি
চিত্রা
চিঠিটা পড়ে রূপক মাথা তুলে কুণালের দিকে তাকাল। কুণাল জানতে চাইলো রূপক কি বুঝলো। রূপক হেসে উত্তর দিল:
‘‘হ্যাঁ অনেকদিনের ব্যাপার তো। একটু ঝালিয়ে নিলাম।‘‘
কুণাল বলল, “চিত্রা আমাকে সব বলেছে। তুই আর সংকোচ করিস না। সেদিন ওকে তুই চিনতে চাস নি।‘‘
রূপক জানায় সেও চিত্রাকে চিনতে ভুল করে নি। তবে হ্যাঁ চিনতে চায় নি।
রূপক কুণালের কাছ থেকে টুম্পার ফোন নম্বরটা চেয়ে নেয়। কুণাল চলে গেলে মোবাইলে টুম্পাকে ফোন করে। সে বলে:
‘’টুম্পা তুমি তোমার দাদার সঙ্গে চিত্রার বিয়েতে ঘটকালি করেছ অথচ আমাকে জানাও নি। একেবারে হাইজাক করে ওকে নিয়ে গেলে !’’
টুম্পা ওপাস থেকে জানায়:
“কোথায় হাইজাক করলাম! তোমাদের বিচ্ছেদ তো আগেই হয়ে গেছে। তুমি তো তখন নিজের জন্য গুছিয়ে নিয়েছ। তোমার বিয়ের বেশ কিছু পর ওদের বিয়ে হয়েছে। অসুবিধে কোথায়? চিত্রাদি নিজের জীবন গুছিয়ে নিক সেটা তুমি নিশ্চয় চেয়েছিলে কারণ ওকে তুমি ভালোবাসো। তোমাকে জানানোটা দরকার ছিল না। দাদাকেও তোমাদের সম্পর্কের কথা জানাই নি।” রূপক আর কোন কথা বলে না।
মুখোশ
করোনা লেগেছে। সবাই আতঙ্কিত। বিশেষ কেউ ঘর থেকে বেরোয় না । বয়স্করা তো একেবারেই নয়। বাঘে ছুলে আঠারো ঘা। করোনা ছুলে আটান্ন ঘা। কে না জানে? জানেন না শুধু প্রতীক বাবু। তিনি কিছুতেই মানেন না । মুখোশ পড়বেন না। বাড়ির লোক আতঙ্কিত বিরক্ত। হাজার বলেও হেল দোল নেই। কাকস্য পরিবেদনা। বয়স তো কম হলো না। হাজার বলেও কি করা যায়! ছেলে গোটা চারেক বাহারি মুখোশ এনে দিয়েছে। ওগুলো অব্যবহৃত পড়েই থাকে। বাড়ির আসে পাশের কেউ কিছু বলেন না। মানে বলতে ভয় পান। প্রতীক বাবু একটা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের নেতা। ক্ষমতাবান লোক। তবে এলাকায় জনপ্রিয় সন্দেহ নেই। খুবই অমায়িক। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই কিছুটা শ্রদ্ধায় কিছুটা ভয়ে কেউ কিছু বলতে ভরসা পায় না। সবাই মুখোশধারি শুধু প্রতীকবাবু নন। উনি নাকি স্পষ্টবাদী, উনি যা সেভাবেই থাকতে চান। কোন মুখোশ নয়।
প্রতীক বাবু বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতে অভ্যস্ত নন । রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার দৌলতে তিনি জনগণের লোক।অফিসের পর যতটুকু সময় পান তা তাঁর সংগঠনের কাজ আর জনসেবার কাজে লাগে । পরিবারের জন্য সময় কোথায়? স্ত্রী আর ছেলে আছে। কিন্তু তার দায় সামান্য। স্ত্রী ঘর সামলান।স্বামীর সমাজের পরিচয়ের ব্যাপারটা তাঁর কাছে গর্বের। সেটা তাকে একটা বাড়তি দম দেয় যার জন্য একা হাতে ঘর সামলানোর থেকে যাবতীয় ঝামেলা স্বেচ্ছায় তিনি মেনে নেন। তবে করনার আবির্ভাব আর তার জন্য ঘর বন্দী তার জীবনে একটা উপরি পাওনার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রতীক বাবুকে বাড়িতে পান। আফিস বেশি যেতে হয় না। আর পাড়াও তো যেন শ্মশান হয় গেছে। ভয়ে সবাই বাড়িতে সিটকে।সেটা তাঁর কম পাওনা নয়।কিন্তু প্রতীক বাবুর কাছে এই ঘরবন্দী দশাটা একটা ভয়ানক বন্দী দশা। রাজনীতির কল্যাণে তিনি কিছুদিন জেলবন্দী ছিলেন। সেটাও যেন এত দমবন্ধ হওয়া বন্দী দশা নয়। এই অবস্থায় হাসিখুশি এই মানুষটা যেন কেমন খিট খিটে হয়ে যাচ্ছেন । ঘরে স্ত্রীকে বেশিক্ষণ পেযে যেন জীবনে যতটুকু রোমান্স ছিল তাও উবে যাওয়ার উপক্রম । কি আর করেন এটা আজ মেনে নিতেই হয়। তাও ফ্ল্যাটের অন্যান্যদের থেকে তিনি বেশি বের হন। কিন্তু কিছুতেই পরিবর্তিত এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। কবে যে করোনা বিদায় নেবে তাই ভাবেন। প্রতীক বাবুর স্ত্রীর কাছে এটা খুব বেদনাদায়ক। বিশেষ করে যখন দেখেন পাশের ফ্ল্যাটের পরিবারগুলো কি সুন্দর এই বিশেষ অবস্থায় বউ ছেলে মে নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছে। আর ওদের ছেলে তো সারাদিন মোবাইল কম্পিউটার নিয়ে অফিসের কাজ করছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর নামে কাজ বেড়ে গেছে । অথচ কোম্পানি ৭০ শতাংশ মাইনে দেবে বলেছে। চাকরি থাকবে কি না সেই ভয়ে ছেলের দিন কাটে।
করোনার আক্রমণ বেড়ে চলেছে। ধারে কাছে সে এসে গেছে। সরকারী নির্দেশে মুখোশ বাধ্যতা মূলক। তাও প্রতীকবাবু অচঞ্চল। উনি মুখোশহীন মানুষ। কারো ধার ধারেন না। এরই মধ্যে এক আধবার দোকানে যান। সেখানে উনাকে চেনে না এমন দুচারজন মুখোশ কই জানতে চাইলে উনি বলেন উনি মুখোশহীন মানুষ। আর এর উত্তর যাকে তাকে দিতে বাধ্য নন।
বাড়িতে ইদানিং সবার সঙ্গে ঝামেলা। এদিকে সরকারি কড়াকড়ি বেড়েছে। জারি হয়েছে আদেশ মুখোশ না পড়লে জরিমানা বা জেল। প্রতীকবাবুর ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁর দল থেকেও এটা সবাইকে মানতে বলছে। সবাই মানছেওl কিন্তু প্রতীক বাবু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। কিসের জোরে তার এত বুকের পাটা? সবাই অবাক হয়। অনেকে ভাবে লোকটার সাহস আছে। না রোগ না পুলিশ কাউকে ভয় করে না।
প্রতীক বাবু রাস্তায় বেরিয়েছেন। লোকজন বেশি নেই। যা দুচারজন তাঁরা সংক্রমণের ভয়ে প্রতীকবাবুকে এড়িয়ে চলেন। প্রশস্ত রাস্তা ধরে নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে প্রতীকবাবু চলছেন।পেছনে কুত্তা করে ফুকার, তাতে প্রতীকবাবুর কোন দিন কিছু আসে যায় না। কিন্তু হঠাৎ এক জ্বালা। মোটরসাইকেলে দুজন এসে প্রতীকবাবুকে জেরা শুরু করে। প্রতীক বাবু বোঝেন এরা কারা। কেন মুখে মুখোশ নেই? প্রশ্ন ছুটে আসে। সাধারণত থানার বড় বাবুও প্রতীক বাবুকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করে না। কিন্তু আজ যেখানে সরকারের ঢালাই আদেশ সেখানে এই চুনোপুটিদেরও যে কিছু সাহস দেখাবার লাইসেন্স জোটে সেটা প্রতীকবাবু বোঝেন। তারাও যে প্রতীকবাবুকে চেনে না তা নয়। তবে আজ ওপরওয়ালার কড়া নির্দেশ। প্রতীকবাবু বলেন, “আপনারা অন্ধ দেখেন না। মুখোশ আছে।” পুলিশ বলে, “তবে পড়েন নি কেন?” প্রতীকবাবু বলেন, “ চলুন আপনাদের বসকে আমি এর উত্তর দেব।” পুলিশ ঘাবড়ে যায়। এ প্রভাবশালী লোক। কি দরকার। চলুক বড় বাবুর সঙ্গে বুঝে নেবেন। পুলিশ বাইকে করে প্রতীকবাবুকে থানায় নিয়ে যায়।
থানায় প্রতীকবাবুকে বড়বাবু আহবান জানান। জানতে চান কি হয়েছে। অর্ধস্তন পুলিশরা বলে উনি মুখোশ পরেন নি । আমরা পরতে বললে উনি বলেন উনি পরেই আছেন। এ ব্যাপারে আপনাকে যা বলার বলবেন। আমাদের সংগে তাই নিয়ে এসেছি। বড় বাবু বলেন: “ প্রতীক বাবু কি ঠাট্টা ইয়ার্কি করছেন? জানেন না আপনাদের পার্টির এটা নির্দ্দেশ। তারাই তো ক্ষমতায়। আমাদের কি করার?” প্রতীক বাবু নিরুত্তাপ। বলেন: “ ওরা না হয় দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আমাকে চিনেও আপনি চিনছেন না। পার্টির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে আমি মুখোশ পরেই আছি।” বড়বাবু বিচলিত হন। বলেন, “ হেঁয়ালি ছাড়ুন। আসল কথা বলুন।” প্রতীকবাবুর আবার একদফা হাসি। বলেন, “আমি যে মুখোশ পরেই আছি। ভালোভাবে দেখুন।”
বড়বাবু বলেন “ সেই মুখোশের কথা বলছি না। করোনা মুখোশ, মানুষের মুখোশ নয়”।
“ও তাই বলুন! চিনতে একটু দেরি হলো! তবে তো আমার এ মুখোশটা খুলতে হয়। দুটো মুখোশের ভার সইতে পারব না। এটা খুলে যে শেয়ালের মুখের করোনা মুখোশ পড়তে হয়। সেটা পাব কোথায়? সেটা তো বাজারে নেই। মানুষের মুখের করোনা মুখোশ তো আমার ছেলে বেশ কয়েকটা এনে দিয়েছে। জানেন তো আমাদের করে খেতে হয়। এই মুখোশ খুললে খাব কি? আর আপনারাই বা কি খাবেন।” বলেন প্রতীক বাবু। সত্যিই তো বড়বাবু বড় চিন্তায় পড়েন।
শেষ অংশ
প্রিয় মামা,
জানলাম তুমি ধরা পড়েছ। জল্লাদদের গুলিতে চারজন সাথীকে হারিয়েছ। এটা আমাদের এখানে আজ প্রায় রোজের ঘটনা। জানোনা হয়তো আমিও বেশ কিছুদিন হল তোমার থেকে অনেক দূরে রাইপুর জেলে বন্দী। মা মাত্র জেনেছে। দুদিন আগে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে। সেই সুযোগে আমি চিঠিটা পাঠাচ্ছি। তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল। এখানে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের এমন কিছু শিখতে সাহায্য করেছে যা নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হত। আমার ধারণা আমাদের এই অভিজ্ঞতা আর আজের লড়াইয়ে তোমার অভিজ্ঞতা ভাবনার জগতে আমাদের কাছে টানতে সাহায্য করবে। আমাদের লড়াইয়ে একে অপরের সাথী হতে পারব। তাই এই চিঠি লেখার তাগিদ।
আমরা আজ গণআন্দোলনের গুরুত্বটা আরও বেশি করে বুঝছি। গণ আন্দোলন আমরা চাই বা না চাই মানুষ চালিয়ে যায় কারণ তাদের অভিজ্ঞতাই গণআন্দোলনের প্রয়োজন তাদের বুঝিয়েছে। তবে গণআন্দোলনকে সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিপূরক হিসেবে দেখতে হয়। অস্ত্র সমর্পণ করে গণ আন্দোলন দিশা হারায়। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চক্রজালে জড়িয়ে যায়। এর থেকে শিক্ষা এই যে গেরিলাযুদ্ধ সশস্ত্র লড়াইয়ের একমাত্র রূপ নয়। বিশেষ অবস্থায় তা সর্বোচ্চ রূপ হতে পারে। সে নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। আর আজকের নয়াউদার্নীতিবাদের যুগে পুঁজিবাদের যে কদর্য রূপ তার বিরুদ্ধে তোমাদের মত পরিবেশবিদরা যেমন লড়ছে তেমনি দেশপ্রেমিক শক্তিও লড়ছে। সেটাকে সন্মান দেওয়া উচিত যেটা আমরা দিই নি। তারাও তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝবে এ লড়াইকে কোন খাতে বইয়ে নিয়ে যেতে হয়। সমাজতন্ত্র গঠনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? এর সঙ্গে ভোগবাদের সমস্যা আছে যেটার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়তে হয় যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অঙ্গ। এ ছাড়া আছে রুটি রোজগারের লড়াই যেটা কলে কারখানায় ক্ষেত খামারে আবহমানকাল ধরে মানুষের লড়াই। সেখানে গণআন্দোলনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের দরুন উৎপাদন প্রণালীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিল্প কাঠামো বদলেছে। দৈহিক শ্রমের ওপর এই প্রযুক্তির প্রভাবটা বিশেষ অনুধাবনের বিষয়।এটা লড়াইয়ের পথ নির্ধারণে কি ভূমিকা পালন করে সেটা ভেবে দেখতে হয়। এই প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের মননে এক অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলছে। আর এর অপব্যবহার সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তথাকথিত সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে ভোগবাদকে মদত করছে। সমাজের অসম বন্টন জীবন জীবিকামর সুযোগে কুঠারাঘাত করছে। ফলে বিত্তশালী অনেকেও এর বিরুদ্ধে লড়াইটা চাইছে। সেদিক থেকে লড়াইয়ের ফ্রন্ট ব্যাপকতা লাভ করছে। শ্রেণীর লড়াইয়ের সাথে একে কিভাবে যুক্ত করা যায় সেটা ভাবা দরকার। এই উদ্ভূত প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধানের ওপর আগামীদিনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শর্ত নির্ভর করছে। লড়াই ত্যাগ করে নয় আরো তাকে আঁকড়ে ধরে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব বলে মনে হয়। এছাড়া নেতৃত্বের প্রতি নিঃস্বর্ত আনুগত্য বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না। এর থেকে এক ধরণের স্বেচ্ছাচারিতাকে মদত দেওয়া হয়। নেতৃত্ব ভুল করলে সেটা তুলে ধরার সুযোগ পার্টির মধ্যে থাকে না। কেন্দ্রিকতার ঝোঁক বাড়ে। পার্টির ওপরের তলার সঙ্গে নিচের তলার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা অস্বীকৃত হয়।
সবশেষে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটা শিক্ষা তুলে ধরছি যার সমাধান খুব কঠিন অথচ একটা গোপন বেআইনি দলের পক্ষে খুব জরুরি। প্রথমেই বলি সুব্রতর সংগে আমার আর পুরোন সম্পর্কটা নেই। রাজনৈতিক জীবনে ওর ত্যাগ স্বীকারকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি ব্যক্তিজীবনে ওর ভাবনা আর কাজকে আমি ঠিক বলে মনে করি না বলে আজ আমাকে ওর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অস্বীকার করতে হচ্ছে। ওর আচার ব্যবহারে আমার মনে হয়েছে মননের দিক থেকে পুরুষতন্ত্রের ছায়া যা ওর মধ্যে আমি দেখি। দুজনের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর দায়বদ্ধতা দুজনের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনটা বজায় রাখতে পারে। তাছাড়া পার্টিকে না জানিয়ে আমাকে না জানিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটা প্রবণতা ওর মধ্যে। এর থেকে আমার মনে হয়েছে বিপ্লবী কর্মীদের নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইটা একটা বিরামহীন সংগ্রাম।আত্মলালসা আত্মস্বার্থ ত্যাগ করতে না পারলে বিপ্লবী থাকা যায় না। যাক সেটা নিয়ে দেখা হলে কথা হবে। ভালো থাকিস। একদিন মুক্ত আকাশের নীচে দেখা হবে।
রিঙ্কুর মনে হল কয়েকদিনের মধ্যে এই সেদিনের কঙ্কা কত বড় হয়ে গেছে। ওর চিন্তা ভাবনা এখন অনেক পরিণত। ও যে শুধু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললো তা নয় রিংকুকেও তার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে সাহায্য করল। ওর দাদু সুহাসবাবু দিদা কাজল আর মা রীতার অভিজ্ঞতা যেন তৃতীয় প্রজন্মে মিলে এক নতুন দিশা হয়ে উঠেছে যা এ লড়াইয়ের বহমানতা। একই সূত্রে গাঁথা।
On Sat, Dec 25, 2021 at 9:22 PM Ranesh Ray <raneshray2011@gmail.com> wrote:
উপস্থাপনা:
মানুষের জীবনযাপন আচার আচরণ সমাজ পরিচালনা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দৈনন্দিন যে কাজকর্ম তার প্রতিফলন ঘটে তার মনোজগতে। সৃষ্টি হয় মানুষের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির একটা অংগ সাহিত্য। গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের মাধ্যমে সংস্কৃতির অংগ হিসেবে সাহিত্যকে উপস্থিত করা হয় তার নিজস্ব আঙিনায় আমরা যাকে সাহিত্যের আঙিনা বলছি। অনেকে অবশ্য বলেন কোন একটা সামাজিক ধরণের ওপর নির্ভর করে কিভাবে মানুষের কার্যকলাপ তার মনোজগতে প্রতিভাত হয় তা। এক এক ধরণের আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় তা এক এক ভাবে প্রতিফলিত হয়। সেই দিকটাকে অনুসরণ করে বলা হয় যে অর্থনীতির উপরিকাঠামো হল রাজনীতি আর সংস্কৃতি। সাহিত্য সংস্কৃতির অংগ। তাই আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা নিরপেক্ষে সাহিত্য তার দিশা পায় না। আমরা এই বিতর্কে এখানে যাচ্ছি না। সাহিত্যের অংগ হিসেবে গল্প কবিতা উপন্যাস প্রবন্ধের সাহিত্যের আঙিনায় অনুপ্রবেশই আমাদের বইয়ের বিষয়বস্তু। সেই অনুযায়ী বইয়ের নাম দিয়েছি সাহিত্যের আঙিনা।
সাহিত্যের আঙিনায় কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ, উপন্যাস, রম্য রচনা যে যার বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। সাহিত্য যেন একটা সমুদ্র মোহনা, একটা ফুলের বাগান। নানা বর্ণ গন্ধের এক সমাহার। প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্রোতে বয়ে চলা এক একটি স্রোতস্বিনী নদী। বিভিন্ন স্রোতস্বিনী নদী এসে মেলে এই মোহনায়। আমরা আমাদের আলোচনায় সাহিত্যের বিভিন্ন অংশকে কিভাবে দেখি সেটা তুলে ধরব। উল্লেখযোগ্য যে আমার সাহিত্য চর্চা সাম্প্রতিক ঘটনা, বলা চলে ঘটনা চক্র। আমি ব্যাকরণ ধরে সাহিত্য চর্চা করি নি। সে পান্ডিত্য আমার নেই। সেই অর্থে সাহিত্যিক নই। জীবন থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতা ধরে আমার লেখার জীবন। মেঠো সাহিত্যিকের মেঠো সাহিত্য। যেভাবে জীবনকে দেখেছি পেতে চেয়েছি তা নিয়ে ভাবনা চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যাবে আমার সাহিত্য চর্চায়। এ নিয়ে আমি যেভাবে সাহিত্যকে তার বিভিন্ন রূপে দেখি সেটা তুলে ধরার স্পর্ধা দেখালাম ।
সাহিত্যিকের কাজ হলো সময়টাকে ধরা তাকে উপলব্ধি করা। সময় যদি বিশেষ বার্তাবাহক হয় তবে সাহিত্যের মাধ্যমে সেই বার্তা সাধারণের কাছে গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরার সামাজিক দায়িত্ব সাহিত্যিক অস্বীকার করতে পারেন না। ২০২০ এমনি একটা সময়কাল যা করোনা আর অর্থনৈতিক সংকটের দ্বিমুখী আক্রমণে আমাদের সমাজ জীবনকে বিশ্ব জুড়ে তছনছ করে দিয়েছে। এই বিষয়টা আজ আমাদের মনোজগতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। তার প্রতিফলন আংশিক ভাবে হলেও দেখা যাবে এই বইতে।
এই শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুর বছরটা শেষ হতে চলেছে। কি দেখলাম কেমন থাকলাম কি করলাম এ বছরটায়? প্রশ্ন উঠবেই কারণ অন্য বছরগুলো থেকে এ বছরের থাকা খাওয়া পরা করা দেখা সবই আলাদা। সারাবছরই কোন একটা ঘরে বন্দী থাকলাম একান্তে নিভৃতে। বুকে নিয়ে একরাশ নিরাশা। বিচ্ছিন্ন একা একা মুখোশ পরে সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বলা চলে কারাগারের কোন এক সেলে। ভয়ঙ্কর এক আতঙ্কের মধ্যে। আপাতদৃষ্টিতে এক বিশাল শূন্যতা অনিশ্চয়তা। জানতে পারি মানুষ করোনা ১৯ নামে মারণরোগে আক্রান্ত অথবা আতংকগ্রস্থ, কখন তাকে ধরে। অর্থনীতি সংকটে, বাজারে চাকুরী নেই, আজ যাদের আছে কাল থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ। বাচ্চাদের খেলাধুলো বন্ধ। বছরটা করোনা বছর বলে চিহ্নিত। সমাজজীবন ভেঙে তছনছ। বাচ্চা বুড়ো সবাই ঘর বন্দী। একজন আরেকজনকে সন্দেহ। বোধ হয় করোনা ভাইরাস নিয়ে এসেছে। কাছে এলেই ছুলেই সংক্রমণ। তাই না আসাই ভালো। করোনা আতঙ্কের সঙ্গে জুটেছে চিকিৎসা আতংক। সত্যি করোনা হয়েছে কিনা, হলেও এর চিকিৎসা কি কত টাকার দায়, সমাজে অস্পৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়, মরলে শব দাহ কিভাবে হবে কে করবে এসব নিয়ে প্রশ্ন। আর এরই মধ্যে করোনাকে সামনে রেখে রাষ্ট্র একের পর এক তথাকথিত সংস্কার নীতি অবলম্বন করে চলেছে যা কর্পোরেট রাজের ভীত শক্ত করে।
এই সবের মধ্যে আমিও পড়ি। তবে আমার বয়স ৭৫ এর ওপর। আমার বাইরের জগৎ ছোট হতে হতে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে গেছে। এমনিতেই নিরূপদ্রোপ একাকিত্বের জীবন। খাওয়া পরা ঘুম। জীবনের রূপ রস বর্ণ গন্ধ বিলীন হতে চলেছে। মোবাইল বা কিছুটা লেখালিখি নিয়ে সময় কাটে। স্কুল কলেজ নেই খেলাধুলো নেই, পরিচিত বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় শূন্যে পৌঁছেছে। কোন কাজে যাবার তাড়া নেই। তাই জীবনটা শূন্যে দোদুল্যমান। অপেক্ষারত। কিন্তু যাদের জীবনে এখনও প্রানের স্পন্দন তাদের অবস্থাটা কি? ভাবা যায় না। অবশ্য ঘরে দাদু দিদা বাবা মা ছেলে মেয়ে নিয়ে পরিপূর্ণ সংসার। একজন আরেকজনকে আরো সময় দিতে পারছে যদিও বিধান আছে ‘সামাজিক দূরত্ব‘ বজায় রাখার। এই একাকিত্বের মধ্যে থেকেও মানুষ ভাবে, আশা নিয়ে বাঁচে।
আমারও এইভাবে কাটে বছরটা। এই নৈরাশ্যের মধ্যেও শিখলাম জানলাম অনেক কিছু। জানলাম সমাজজীবনে কোন ধরণের সরকারের প্রয়োজন কেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা গবেষণার ওপর সরকারের খরচ বাড়ান দরকার কেন। উগ্র শিল্পায়নে পরিবেশ ধ্বংস কতটা ক্ষতিকর। কিভাবে এই সংকটকালেও মুনাফাবাজরা ফায়দা তোলে, ভোগবাদ কতটা অসাড়, যুদ্ধবাজরা যুদ্ধের মহড়া দেয়। জানলাম সমাজটাকে ঢেলে সাজাবার প্রয়োজন কেন। এর থেকে প্রতিভাত হওয়া মনন নিয়ে বছরটা ধরে কালি কলম নিয়ে কাটালাম। এই করোনা কালে মানব সমাজের আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে যা নিয়ে কলম ধরতে হয়েছে। আর এরই ফসল এই বই। এটাই এই সংকটকালে আমার প্রাপ্তি। এতদিনকার চলমান জীবন ছেড়ে এই অন্ধকারের থিতু জীবনের মধ্যে আলো। বইতে ২০২০ র সংকটকালটা তুলে ধরার যেমন চেষ্টা হয়েছে তেমনি এর থেকে প্রাপ্য শিক্ষা জায়গা পেয়েছে । আর আছে এই কালের আগের কিছু লেখা। আজ এই করোনা সংকটের সময়কালে যা আরও তাৎপর্য পূর্ণ হয়ে উঠেছে। আজ দুনিয়াজুড়ে সব দেশ যখন করোনা ১৯ আর অর্থনৈতিক সংকটের দ্বৈত আক্রমের মুখে মানব সমাজে তখন আবার সমাজ পুনর্গঠনের দাবি উঠে আসছে পৃথিবী জুড়ে।। করোনা আমাদের কাছে সেই বার্তাই পৌঁছে দিচ্ছে। সাহিত্যের মাধ্যমে সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁরা সাহিত্য চর্চা করেন তাঁদের ওপর বর্তায়।।
চেতনার জগতে সাহিত্যের মাধ্যমে অভিজ্ঞতার সারসংকলন ঘটে। তাই সৃষ্টিশীল হতে গেলে সাহিত্যকে জীবনমুখী হতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় কল্পনা। কল্পনার প্রচ্ছদে সাহিত্যিক ভবিষ্যতের ছবি আঁকেন । আমার এই বইয়ে তাই জায়গা পেয়েছে একই সঙ্গে গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা। আমার জীবনবীক্ষা অনুসরণ করে যে সব গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা ছড়া লিখেছি তার অনেকগুলোর সাহায্যে আমি আমার জীবনবোধকে বহুমাত্রিক করে তুলতে চেয়েছি। মেলাতে চেয়েছি তাদের সাহিত্যের মোহনায়।
গল্প প্রবন্ধ বা কবিতা কোনটাই আমার মস্তিষ্ক প্রসূত নয়। এর জন্ম আমার কল্পনায় নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আশ্রয় করে লেখা প্রবন্ধ গল্প কবিতার মেলবন্ধন ঘটাতে চেষ্টা করেছি। আজকের এই ঘটে যাওয়া ঘটনা হলো অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে করোনা ১৯ এর সংযোজন যা পৃথিবীতে মানব সভ্যতার জন্য এক অভাবনীয় সংকট নামিয়ে এনেছে। চলতি আর্থ সামাজিক ব্যাবস্থাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের আদর্শের প্রেক্ষাপটে গল্প কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে তাকে তুলে ধরা হয়েছে। সমাজ বদলের দাবিকে সোচ্চার করে তুলেছে। ভবিষ্যতের কাঙ্খিত সমাজ গঠনে আমাদের সাহিত্য চর্চাকে এই প্রচেষ্টায় কাজে লাগাবার চেষ্টা করা হয়েছে। কাঙ্খিত সমাজ যেহেতু এখনও বাস্তবায়িত হয়নি তাই তা এখনও কল্পনায় বিরাজ করে। কল্পনায় বিরাজমান সেই সমাজের উপাদান আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন প্রবন্ধ গল্প কবিতায় থাকলেও তাদের একটা সমন্বিত সামগ্রিক রূপ পাওয়া যেতে পারে এই গ্রন্থে। খন্ড সত্যকে অখন্ড সত্যে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে এই সামগ্রিক রচনা। বিভিন্ন বিষয়ের পরস্পরের মধ্যে আন্তঃ:সম্পর্ক, তাদের মধ্যে মিল অমিল, ঐক্য বিরোধ, সহযোগ অসহযোগের একটা সামগ্রিক ছবি পাওয়া যেতে পারে।
গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গ। কেউ স্নায়ু জগতে খেলা করে, কারও বাস হৃদয় প্রান্তরে, সে একান্তে নিজেকে খুঁজে ফেরে। আবার কেউ মুখের স্বাদ পেটের খিদে মেটায়। সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। সকলেই জীবনের কথা বলে জীবনের ছবি আঁকে। জীবনকে সম্পূর্ণতা দিতে চেষ্টা করে। কাউকে বাদ দিয়ে সাহিত্য সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। এককথায় গল্প কবিতা প্রবন্ধ সকলে মিলে মিশে সাহিত্যের বৈঠকখানায় আড্ডা মারে। কেউ কল্পনায় সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে আবার কেউ উঁকি মারে পাশের বাড়ির গৃহস্থের ঘরে আবার কেউ প্রকৃতি প্রেমের উপাসক। কেউ জীবন যুদ্ধে সৈনিক। প্রত্যেকেই নিজ ছন্দে নিজ তালে লয়ে যেন নেচে চলে। সাহিত্য যেন সমুদ্র মোহনা। গল্প উপন্যাস কবিতা প্রবন্ধ হল প্রবাহিত নদী যারা এসে মেলে সমুদ্র মোহনায়। আমি আমার গল্প কবিতা প্রবন্ধের সেই মিলন মেলায় মিলতে চেয়েছি। গল্প কবিতা প্রবন্ধ কোনটাকে ভিন্ন জাতের বলে একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করে রাখি নি। আমার গল্পে প্রবন্ধে কবিতা এসে মিলেছে। আবার কোন কোন কবিতাকে গল্পের আঙ্গিকে তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি। চেষ্টা করেছি সবাইকে একতারায় বাঁধতে। সাহিত্যকে তার সমগ্রতায় বিভিন্ন অঙ্গের মিলনে পরিপূর্ণতায় পেতে চেয়েছি।
সাহিত্যে গল্প:
সাহিত্যের জগতে উপন্যাস যেখানে বহুমাত্রিক গল্প সেখানে এক মাত্রিক। কোন একটা মূল ঘটনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় গল্প। গল্পে চমক থাকে। খুব সহজভাবে কোন ঘটনাকে উপস্থাপন তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা চমকটাকে সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত না করে ইঙ্গিতে তাকে পরিবেশন করার শিল্পগুন গল্প লেখকের বৈশিষ্ট্য। সীমিত বহরে রেখে সুক্ষভাবে বিষয়টাকে প্রকাশ করা হয় গল্পে। গল্প বিভিন্ন বিষয় নিয়ে হয়। এক একটা গল্প এক একটা বিষয় মুখী হয়। যেমন প্রেমের গল্প শিকারের গল্প খেলার গল্প অভিযানের গল্প মানুষের গল্প পশুর গল্প প্রভৃতি। একটা বিষয় নিয়ে একটা গল্প হয়। গল্পে চরিত্র উপস্থাপিত হয় কিন্তু উপন্যাসের মত বেশি চরিত্র একটা গল্পে স্থান পায় না। গল্পের লেখকের কল্পনা বিস্তারের সুযোগ থাকে। বাস্তবে ঘটে না তার কল্পনায় আশ্রয় করে এমন বিষয় নিয়ে লেখক গল্প বানাতে পারে। আবার বাস্তবে ঘটে যাওয়ার বিষয়কে নিজের কল্পনার রঙে রাঙিয়ে তাকে পরিবেশন করতে পারে। গল্পে প্রবন্ধের মত যুক্তি তর্কের বিন্যাস তেমন গুরুত্ব পায় না। তাও প্রতিটি গল্পে তার নিজের একটা যুক্তি থাকে। তবে গল্পটা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার বিষয় ততটা গুরুত্বপূর্ন নয়, তার রস সিঞ্চন করে তাকে উপভোগ করার বিষয়টাই প্রধান। আনন্দ উপভোগ হতে পারে বেদনার রেশ থেকে যেতে পারে গল্পে যা যুক্তি থেকে আবেগকে তাড়িত করে বেশি। গল্পে কবিতার মত ছন্দের খেলা না থাকলেও প্রতিটি গল্পের নিজের একটা ছন্দ থাকে। সেই ছন্দটা কেটে গেলে গল্পের রস আস্বাদন করা যায় না। গল্প আবার ছোট গল্প হতে পারে আবার বড় গল্প হতে পারে। ছোট গল্প স্বাভাবিক ভাবে ছোট মাপের। কিন্তু কেবল মাপ দিয়ে এ পার্থক্য বিচার হয় না। বড় গল্প যেন হাটে পরিবেশিত হয় যেখানে গল্পের উপাদান অনেক বিস্তৃত। অন্তর্নিহিত বেশি কিছু অবলা থাকে না। তার আঙ্গিক বড় হয়ে তাকে উন্মোচিত করে দেওয়া হয় বেশি করে। ছোট গল্প যেন পরিবেশিত হয় খেতে খেতে অল্প সময়ে যেন ঘরের মধ্যে আড্ডার আসরে। ছোট গল্পে অল্প কথায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়। অনুন্ন্মোচিত থাকে অনেকটাই। চমকটা রেখে দেওয়া হয়। সেই জন্যই রবি ঠাকুরের ভাষায়:
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
নিতান্ত সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারটি অশ্রু জল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
গল্প নিয়ে একটা প্রবাদ চালু আছে। বলা হয় যে গল্পের গরু গাছে ওঠে। অর্থাৎ খুশি মত অবাস্তব যা কিছু নিয়ে গল্প লেখা যায় যার সঙ্গে বাস্তবতার যোগ নেই, যা লেখকের কল্পনার খামারে উৎপাদিত হয়। বলা হয় গল্পে কোন মূল্যবোধ না থাকলেও চলে। গল্প নিয়ে এ ধরণের ভাবনার আমরা বিরোধী। সাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে গল্প মানুষের সেবায় কাজ করে। মানুষের সুস্থ চিন্তা ভাবনার বিকাশে সহায়ক যদিও গল্পে লেখকের কল্পনার বিশেষ ভূমিকা থাকে। কিন্তু সে কল্পনায় এমন গল্প না রচনা করাই বাঞ্ছনীয় যাতে গরু গাছে ওঠে। সুস্থ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য এটা কাম্য নয়।
কয়েকটি গল্প
একই সূত্রে
১
শহরের উপকণ্ঠে একটা ছিমছাম পল্লী। তারই একপ্রান্তে একটা ছোট অর্ধ সমাপ্ত বাড়ি। বাড়িটাতে অভাবের ক্লেদ যেমন চোখে পড়ে না তেমনি প্রাচুর্যের আতিশয্য নেই। এ বাড়িতে গত প্রায় পনেরো বছর ধরে থাকেন এক মহিলা তাঁর চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলেকে নিয়ে। মহিলার বয়েস যা অনুমান করতে পারি আর ছেলের বয়সের হিসেব থেকে বলা যায় মহিলা একটু দেরীতে বিয়ে করেছেন বোধ হয়। অবশ্য ধরে নিই যে ওনার এই একই ছেলে। আর সেটা প্রতিবেশীদের ধরে নেওয়ার কারণ আছে বৈকি। কারণ গত পনের বছরে এ বাড়িতে এমন কাউকে আসতে দেখা যায় নি যাকে দেখলে তাঁর বড় ছেলে বা বড় মেয়ে বলে মনে হতে পারে। এসব অনুমানের ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে ওনার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ বছর। আরেকটা বিষয় হল যে এ বাড়ীতে এমন কোন প্রবীণ পুরুষ দেখা যায় নি যাকে ওঁর স্বামী বলে মনে হতে পারে। তবে পাড়ার অনুসন্ধিৎসু অনেকের মতে ওনার স্বামী ওনাকে ছেড়ে গেছেন । ছেড়ে গেছেন বললে ভুল হবে। ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। ওদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকলেই সমালোচকদের ওনার সম্পর্কে অনুমানগুলো সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ভেবে তারা তৃপ্তি পান। সম্ভবনা নয় কেউ কেউ নিশ্চিত যে ওনাদের বিবাহ বিচ্ছেদই হয়েছে। এনারা কারণটাও জানেন। সেটা রসিয়ে কষিয়ে আড্ডায় বলেন। ঊষাদেবীর স্বামী নাকি খুব বেচারা মানুষ। নেহাতই ভালোমানুষ। আর ঊষাদেবী দাম্ভিক, অহংকারে পা পড়ে না। স্বামী এত ভালোমানুষ হলে কি চলে? পৌরুষ কোথায়? তাই মানানো চলে না। বিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। অন্তত ঊষাদেবীর তরফ থেকে।ওদের মতে আজ এর জন্য ঊষাদেবীকে ভুগতে হচ্ছে। এত ভালো রোজগেরে দেবতুল্য মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার ফল। বিচ্ছেদের গল্পে তাদের আলোচনার বিষয় বেশি প্রাণ পায় বলে তাদের ধারণা।এক এক জনের মুখে এক এক গল্প। আবার কেউ কেউ বলেন উনি মারা গেছেন। তবে হলপ করে কেউ কিছু বলতে পারেন না। নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে রঙ্গ রসিকতা করলেও কেউ কোনদিন সামনাসামনি ওনাকে জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পায় নি। কারণ মহিলা পাড়ায় বেশি মেশেন না। যেন একটু এড়িয়ে চলেন। দুচারজন যাদের সঙ্গে ওঁর আলাপ আছে, পথে দোকানে বাজারে দেখা হয়, দুচার কথা হয় তারাও কিন্তু ওনাকে কেন জানি না এসব কথা জিজ্ঞাসা করেন না। বা করতে ভরসা পান না। অবশ্য আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয় ঊষাদেবীর চেহারায় এমন একটা ব্যক্তিত্ব বা বিশেষ কিছু আছে যা তাঁকে অন্যেদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সব মিলিয়ে যেন একটা রহস্য না হোক অস্বাভিকতা জড়িয়ে আছে। পাড়ার সবাই এ নিয়ে তেমন মাথা না ঘামালেও কৌতূহলী মানুষের তো বঙ্গ সমাজে অভাব নেই। তাই অনেকের কাছে কবির ‘সাল বনের এই দুরত্ব’ একটা আলোচনার বিষয় তো নিশ্চয়। তবে সবার কাছে যেটা বিশেষ ভাবে কৌতূহলের সেটা হল বাড়িতে বসে ঊষাদেবী নিয়মিত গানের রেওয়াজ করেন। ছেলে সঙ্গে সঙ্গত করে। আর এটা তিনি খুব নিষ্ঠাভরেই করেন।বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলে তাঁর গানের গলায় আকৃষ্ট হতেই হয়। তিনি সন্ধ্যার দিকে নিয়ম করে বের হন। সঙ্গে প্রায়ই ছেলে থাকে। আবার ছেলেকে নিয়ে ফেরেন। আমরা অনেকেই ভাবি ছেলেকে হয় তো পড়াতে নিয়ে যান। কিন্তু ওই যে কৌতূহলী মানুষেরা! তারা রোজই উনি কোথায় যান তা নিয়ে নিত্য নতুন গবেষণার ফল প্রকাশ করেন ঠিক আজের কভিড ১৯ এর ভ্যাকসিন এর মত। তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। তবে এই অনুসন্ধানে যে ফলরসের উদ্ভব হয় তাতে নেশার উপাদান আছে অস্বীকার করা যায় না। আড্ডায় সে ‘সোম’ রসের নেশা থেকে কেউ বঞ্চিত হতে চায় না।
মায়ের পরিচয় পেলেন। এবার ছেলের পরিচয় না পেলে ওই দুজনের খুদে সংসারের সামগ্রিক পরিচয়টা পাওয়া যায় না। দুজনে যে দুজনের পরিপূরক। ছেলেটি ছিমছিমে রোগা লম্বা। চোখ মুখে একটা উজ্জ্বলতা ধরা পড়ে। চোখের ইশারায় যেন নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলে। চোখে অজস্র প্রশ্ন জড়িত কোনোটারই যেন ও উত্তর পায় না। এমনিতে মিশুকে হলেও ঘরে মায়ের সাথে সময় কাটে। ক্লাস টেনে পড়ে অর্থাৎ সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবে তা নিয়ে খুব একটা দুর্ভাবনা আছে তা মনে হয় না। বন্ধু বান্ধব ইতস্তত থাকলেও তারা খুব একটা বাড়ি আসে না। পাড়ার ক্লাবে মধ্যে মধ্যে টেবিল টেনিস খেলতে যায়। বন্ধুবান্ধব যারা আছে তারাও ছেলেটির বাবা বা তাদের আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না। ছেলেটি এ ব্যাপারে যেন উদাসীন। মায়ের সঙ্গেই তার জীবন। তবে ওর এক মেয়ে বন্ধুকে মাঝে মাঝে বাড়ি আসতে দেখা যায়। মেয়েটি অতি সাধারণ দেখতে। বোঝা যায় দুজন দুজনের খুব বন্ধু। ঊষা দেবী অর্থাৎ ছেলেটির মা ওকে খুব ভালোবাসে।ওদের বন্ধুত্বকে যেন একটু বেশি মদত করে যেটা আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে খুব স্বাভাবিক নয়। এ নিয়েও পাড়ায় কৌতূহলিদের মধ্যে কানাকানি শ্লেষা শ্লেষি।
ঘটনাচক্রে আমার সঙ্গে পরবর্তী কালে পরিবারটির ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে । আমি আঞ্চলিক একটা বিদ্যালয়ে মাস্টারি করতাম বলে এলাকায় বুড়ো বাচ্চা সবারই পরিচিত। আর প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাড়ার চায়ের দোকানে আমাদের একটা আড্ডা আছে। একদিন দেখি ছেলেটি পাড়ার কিছু আড্ডাবাজ ছেলের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে ছেলেগুলো টিটকিরি মারছে উত্তেজিত করছে। ওকে সাধারণত মাথা তুলে জোরে কথা বলতে দেখা যায় না। আজ সে ব্যতিক্রমটা দেখি। ব্যাপারটা এতদূর এগোয় যে ওকে এবার মারধর খেতে না হয়! আমি এগিয়ে যাই। ছেলেগুলোকে নিরস্ত করি। আর ব্যাপারটা বাড়ে না। জানতে পারি ছেলেটি ও তার মায়ের ব্যাপারে ছেলেগুলো কিছু প্রশ্ন করে যেগুলো ওদের অধিকার বহির্ভূত বলে ছেলেটি মনে করে আর সেটা ওদের মুখের ওপর বলে। তাই নিয়ে বিবাদ। ছেলেটির সাথে কথা বলে মনে হলো ওর আত্মসম্মান বোধ তীব্র। সেখানে আঘাত লাগলে ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, ভয় পায় না। এটা আমার ভালো লাগে। ওকে নিয়ে আমি ওর বাড়ির দিকে এগোই। বাড়ির সামনে এসে ও আমাকে প্রায় জোর করে বাড়ির ভেতর নিয়ে যায়। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। আমিও নিজের মধ্যে চাপা ঔৎসুক্যটার বশবর্তী হয়ে আলাপে একটু বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। আলাপের মাধ্যমে যদি পরিবারের রহস্য কিছু থেকে থাকে সেটা যদি ভেদ করতে পারি। আর আমাদের সবার জীবনের অন্দরে রহস্য ভেদের জন্য একজন ফেলুদা আছে সেটা তো অস্বীকার করতে পারি না। ওর মায়ের সাথে কথায় কথায় জানি ছেলেটিকে পড়াবার জন্য ওরা একজন ইংরেজি শিক্ষক খুঁজছে। ঘটনা চক্রে ওটা আমার বিষয়। তাই স্বেচ্ছায় সেই দায়িত্ব নিই। তবে আমার তাগিদটা শিক্ষক হিসেবে যতটা তার থেকে গোয়েন্দা হিসেবে বেশি।
আমি খুব অল্পদিনের মধ্যে নিজের অজান্তেই যেন রন্টুদের পরিবারের একজন হয়ে পড়ি। বলা হয়নি ছেলেটির নাম রন্টু। আমাকে এখন মামা বলে ডাকে। আমার যেমন এ বাড়িতে অবাধ প্রবেশ ওরাও আমার বাড়ি যায়। ঊষা দেবী আমার স্ত্রীর বান্ধবী হয়ে উঠেছেন। আগে যেমন ওনাকে কোন এক ধোঁয়ার আড়ালে দেখতাম এখন সেটা অনেকটা দূর হয়ে গেছে। সূর্যের আলোক রশ্মি ওনার চোখে মুখে দেখি। ওনারা যেখানে যান আমাকে নিয়ে যান। এমন কি বিকেলের সেই রহস্যের অন্তরালে। আমার কাছেও যেন ফুলের প্রস্ফুটন। একটা একটা করে পাপড়ি খোলে। তবে ঊষাদেবীর স্বামীর অন্তরীণ হওয়ার রহস্য এখনও আমার অজানা। অবশ্য নিশ্চিত হয়েছি যে উনি বেঁচে আছেন। তবে কোথায় কেন জানি না। ঊষাদেবী একটা কঠিন রোগে আক্রান্ত। বোধ হয় সেইজন্য নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে রাখেন। আর নিজেকে দূরে রেখে স্বামীকেও যেন অন্তরীণ রাখতে সাহায্য করেন।
কোন কোন দিন যেমন ওদের সঙ্গে যাই তেমনি সেদিনও গেছি। একটা গানের আসর। আসর বসিয়েছেন কিছু গণ্য মান্য ব্যক্তি। বলা চলে এক মজলিস। বোঝা যায় যে এ ধরণের মজলিসে ঊষাদেবীকে আসতে হয় তার জীবিকার জন্য। যারা পাড়ায় এ ধরণের একটা সন্দেহ প্রকাশ করেন সেই ফেলুদারা আমার আগেই রহস্য ভেদ করেছেন সন্দেহ নেই। সেখানে ঊষাদেবী গায়িকা। আজ তাঁর সঙ্গে তবলা সঙ্গত করবে তার ছেলে। যে নিয়মিত তবলায় সঙ্গত করে সে আজ আসতে পারবে না। ছেলের বান্ধবীও আজ সঙ্গে এসেছে।
মজলিস শুরু হয়েছে। আজ ঊষাদেবীর শরীর ভালো নেই। তাও পেটের তাগিদে আসতে হয়। গান ধরেছেন ঊষাদেবী। উপস্থিত অতিথিরা গুছিয়ে মেজাজে বসেছেন। ঊষাদেবীর গলা তাদের আমেজটা ফিরিয়ে আনে। একটা মাদকতার পরিবেশ তৈরি হয়। ছেলে সুন্দর সঙ্গত করছেন। সঙ্গে একটা বাদ্য যন্ত্র। মধ্যে মধ্যে মায়ের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে। সে এই সংগীতের পরিবেশে অভ্যস্ত বোঝা যাচ্ছে। শ্রোতাদের মধ্যে কয়েকজন মদ মাতাল আছে যারা উচ্ছসিত প্রশংসায় আসর জমিয়ে তুলছে। দু তিনটে গান হয়েছে। আসর এখনও সে উচ্চতায় উঠতে বাকি। শ্রোতাদের পয়সা ছোড়া দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন উচ্চে আসর উঠবে। হঠাৎ ঊষাদেবীর কাশি ওঠে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারেন না। পুরোণ রোগটার আক্রমণ। গলা স্তব্ধ হয়ে আসে। ছেলেও বোঝে। বাজনা ছেড়ে মাকে এসে ধরে তোলে। ঊষা দেবী উঠতে থাকেন। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন। সংগঠক বিড়ম্বনায় পড়েন। তিনি এসে ঊষাদেবীকে মনের জোর দেন, আবার গানে বসতে বলেন। ছেলে আমাকে মঞ্চ থেকে ইশারা করায় আমি আর বান্ধবী মেয়েটি এগিয়ে যাই। ঊষাদেবীকে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে মাইক্রোফোন নিয়ে গান শুরু করে মা যেখানে শেষ করেন সেখান থেকে। প্রথমে বিরক্ত হলেও এই অল্প বয়স্ক ছেলের গান আর তার সঙ্গে নাচ মাদকতার পরিবেশটা ফিরিয়ে আনে। ঊষাদেবী আমাদের সঙ্গে এসে বসেন। উনার পাশে এক ভদ্রলোক শ্রোতা। ঊষাদেবীকে জল খাইয়ে একটু সুস্থ হতে সাহায্য করেন। ছেলের গান জমে ওঠে । মায়ের জায়গা পূরণ হয়। আবার মেতে ওঠেন শ্রোতারা। বৃষ্টির মত পয়সা পড়তে থাকে। সংগঠক ভদ্রলোক সেগুলো কুড়িয়ে তোলে। তাই দেখে ছেলে বিরক্ত হয়। গানের মাঝে সেও পয়সা কিছু কুড়িয়ে নেয়। এভাবে চলতে চলতে অনুষ্ঠান শেষ হয়। উঠে জায়গায় ফিরতেই সংগঠক ভদ্রলোক এসে রন্টুর কুড়িয়ে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে বলেন। তার মজুরি যেটা প্রাপ্য সেটা সে পাবে বলে আশ্বস্ত করেন। রন্টু মানে না। সে বলে ওই টাকা মায়ের আর তার শ্রমের পয়সা সেটা তাদের প্রাপ্য। সংগঠক হিসেবে ওনার যা প্রাপ্য সেটা ওরা ওনাকে দেবে। ঊষাদেবী ছেলেকে টাকা দিয়ে দিতে বলেন। ছেলে সেটা না দিয়ে দৌড়ে ওখান থেকে পালায়। ঊষাদেবী সংগঠককে বলেন উনি টাকা ফেরত দিয়ে দেবেন। সংগঠক সেই প্রতিশ্রুতিতে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। আমি এতক্ষন খেয়াল করি নি। যে ভদ্রলোক ঊষাদেবীর শুশ্রূষা করছিলেন উনি তখনও দাঁড়িয়ে। ঊষাদেবী আমার সঙ্গে উনার পরিচয় করিয়ে দেন স্বামী বলে। এতক্ষন আমি উনার দিকে তাকাই নি। এবার তাকালাম। দেখি আরে এ তো আমার সেই কলেজের বন্ধু। শুনেছি ও স্বাধীনতা যুদ্ধে বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পুলিশ ওকে খুঁজে পায় নি। ও আমাকে চিনতে পারে। দুজনেই আবেগ তাড়িত হলেও সংযত থাকি। বুঝি এটা আবেগ প্রকাশের জায়গা নয়। এটা ঊষাদেবীর যেমন জীবিকার জায়গা তেমনি গোপনে স্বামীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ। একটু এদিক ওদিক হলে বিপত্তি। উনি বেরিয়ে যান। আমরাও বাড়ির দিকে এগোই। আমি বুঝি এ লড়াইটা ওদের তিনজনের, গোটা পরিবারের। পরিবারে কেউ হারিয়ে যায় নি। একই সূত্রে বাঁধা।
২
বেরিয়ে এসে দেখি রন্টু দাঁড়িয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি ওর অধিকারের লড়াইটা যে সমর্থন করি তা ও বোঝে। ও এসে মায়ের দায়িত্ব নেয়। সবাই মিলে একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমরা ফিরে আসি। ওদের বাড়িতে নামিয়ে আমি নিজের বাড়িতে। আমার অতীতও যেন আমার সঙ্গে ফিরে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়ার সময় সুহাস বিপ্লবী দলে ঢুকে যায়। আমিও ওদের সমর্থক ফেউ হয়ে ওদের সাথে ঘুরতাম। ওরা তখন ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনের কথা বলত। বিশ্বাস করত যে ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পায় নি। আর দ্বিতীয় স্বাধীনতার যুদ্ধের সঙ্গে সমাজতন্ত্র গঠনের লড়াই এর সংহতি সাধন করা দরকার বলে মনে করত। তাই ওরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিল। সুহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হওয়ার আগেই সব ছেড়ে চলে যায়। আমি মধ্যে মধ্যে ইতস্তত খবর পেলেও সব খবর পেতাম না। শুনেছিলাম বিয়ে করেছে।
স্ত্রী খাওয়ার তাগিদ দেয়। কিন্তু আমি যেন আমার অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা করছি। নানা ঘটনা মনে করার চেষ্টা করছি। যেন কোন অঙ্ক মেলাতে আমি মশগুল। খাবার ইচ্ছে নেই। স্ত্রীকে পাশে বসাই। ওকে সব বলি। ও সুহাসকে না চিনলেও আমার কাছে ওর কথা শুনেছে। আর তখনকার বিপ্লবী রাজনীতির কথা ও জানে। দূর থেকে সুহাসের ওপর একটা শ্রদ্ধা ওর মনে। বোধ হয় আমাদের সমাজে সব মেয়েদের ক্ষত্রেই এটা সত্যি। ওদের মুক্তির ইচ্ছের মধ্যে ওরা বোধ হয় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বিপ্লবীদের খুঁজে পায়। ওকে সব বলে আমিও কিছুটা হালকা হই। তারপর খেতে যাই। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ি।
শুয়ে শুয়ে ভাবি ঊষাদেবীর ছেলেকে নিয়ে বর্তমান এই কঠিন জীবন। পর্দার আড়ালে থেকে এক আত্মবলিদান। আর্থিক অনটন তার ওপর এই অসুস্থতা। ছেলেকে এক হাতে বড় করা। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। স্রোতে গা ভাসানো নেই। আছে খালি অধীর প্রতীক্ষা। আর প্রত্যয়। অথচ এই মহিলাকে নিয়ে কত অকথা কুকথা। যারা সুহাসকে চেনে না তারা এই মহিলাকে নিচে নামাবার জন্য সুহাসকে বেচারি বানায়।প্রচুর রোজগেরে বলে প্রচার করে। অথচ সুহাস ছিল ডান পিটে। শিক্ষকদের সঙ্গেও তর্ক করত। রোজগার কোনদিন করেছে বলে জানি না। সব ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিপ্লবের কাজে। একেবারেই বেচারি নয়। আসলে আমাদের মধ্যে জন্মের পর থেকে যে নারী বিদ্বেষ গড়ে ওঠে এই সমাজে তাই কালক্রমে বিষবৃক্ষ হয়ে এই ফলই ফলায়। সেটাই পুরুষ প্রধান সমাজের নিয়ম। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়ি।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে আবার দৈনন্দিন জীবন। আমি অনেক দিন হল অবসরজীবী। সকাল বিকেল আড্ডা আর পড়ানো যখন যেমন থাকে। যতটা বাড়ির কাজ না করলে চলে না ততটুকু করা। বাকিটা স্ত্রী করে। এর সঙ্গে রন্টুকে পড়াতে যাওয়া। অন্য ছাত্ররা আমার বাড়িতে এসে পড়লেও রন্টুকে আমি পড়াতে যাই। কেন সেটা আগেই বলেছি। গোয়েন্দা গিরির জন্য। সেটা আর সেদিনের পর থেকে দরকার নেই তাও আমি যাই। বলতে দ্বিধা নেই এখন যাই ঊষার আকর্ষণে। ওরা যেন আত্মীয় সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এখন রন্টুকে পড়ানোর আগে পরে ঊষার সঙ্গেও কথা হয়।
ঊষাদেবী বাড়ি এসে বিছানা নেয়। পুরনো রোগটা ভালোই মাথা চাড়া দেয়। এরই মধ্যে গেলে পরে ওনার সঙ্গে দেখা হয়। আমি যতটা সম্ভব উনার খবরাখবর নিই। একদিন আমি পড়াতে গেছি। রন্টু বাড়ি নেই। ঊষার সঙ্গে কথা শুরু হয়। এটা ওটা কথার পর সুহাসের কথা ওঠে। ওরা নিজেরা বিয়ে করেছে জানায় ঊষা। তাও যেন অনেক কিছু অবলা রয়ে যায়। আমি বলি ঊষাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না। তবে কার সঙ্গে ওর মিল পাই। ঊষা হেসে ওঠে। ওকে আমি এই প্রথম মন খুলে হাসতে দেখলাম। মনে হল ও যেন নিজেকে মেলে দিতে চায়। এ যেন খাঁচায় বন্দি এক পাখি খাঁচার বাইরে ডানা মেলেছে। ও আমাকে বলে, “ আমি আগেই আপনাকে চিনেছি। কিন্তু তাও অচেনাই রয়ে গেছি। জানান দিই নি। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে দিন কতক দেখা হয়েছে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে। আপনি একই রকম আছেন বদলান নি। বয়স হলেও চিনতে অসুবিধে হয় না”।
“তবে তুমিই কাজল!” আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে।
আমার শুধু সুহাসের কথা মনে পড়ে। আর ওকে জড়িয়ে সেই মেয়েটির কথা যাকে আমি দুচারবার দেখেছি। আবছা যে চেহারাটা প্রায় চল্লিশ বছর আগের ওই মেয়েটার কথা মনে করিয়ে দেয় তার সঙ্গে ঊষাদেবীর চেহারার যে খুব মিল পাচ্ছি তা না। ও পরিচয় দেবার পর আজকে সব মিলিয়ে একটা মিল পাই। আমার স্মৃতিতে আবছা হলেও ফিরে আসে কাজল।
তখন মেয়েটি সুহাসদের বিপ্লবী কাজকর্মে যোগাযোগের বাহন ছিল। তবে আমার চেনার সুযোগ খুব হয় নি। আপাত শান্ত ওই মেয়েটি খুব বুদ্ধিমতী ছিল। খুব ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করত। সুহাস ওর খুব গুণগ্রাহী ছিল। আমি অবশ্য এর বেশি কিছু জানতাম না। কৌতূহলী হওয়াটাও আমাদের কারও নিষেধ না থাকা সত্ত্বেও বারণ ছিল। আত্মনির্ধারিত বারণ।আজ জানলাম ওই মেয়েটিই আজকের ঊষাদেবী।
৩
ঊষাদেবী বেশ কিছুদিন ভোগেন। রন্টুর বান্ধবী উনার সেবা যত্ন করে। দরকারে এ বাড়িতে থেকে যায়। ওর বাবা মা প্রায়ই আসেন। মেয়েটির বাবা সুহাস বাবুর বন্ধু ওই পরিবারের হিতাকাঙ্খী। ঊষাদেবীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন । বাড়িতে থেকেই এই রোগের চিকিৎসা। যক্ষায় আক্রান্তদের চিকিৎসা হল খাওয়া দাওয়া আর নিয়মিত ওষুধ। মেয়েটি খুবই দক্ষতার সঙ্গে ঊষাদেবীর দেখাশোনা করে। এই ব্যাপারটাও পাড়ার কৌতূহলী জনতার চোখ এড়ায় না। তারা রন্টুর সঙ্গে মেয়েটির সম্পর্ককে কেন্দ্র করে নির্ভুল সহজ যোগের অঙ্ক কষেন। মুখে মুখেই একে একে দুইয়ের অংকের ফল ছড়িয়ে পড়ে। পরিবারের মধ্যে ভবিষ্যৎ পরিবারের অঙ্কুর এনারা দেখতে পান। সেটা দুই অর্বাচীন পরিবারের আদিখ্যেতা বলে মনে করেন। এত অল্প বয়সে এই সম্পর্ক নিয়ে বাবামায়ের প্রশ্রয়কে আর যাই হোক অভিভাবক সুলভ নয় বলে মত দেয়। অবশ্য এতে ঊষাদেবীর কিছু আসে যায় না। আর মেয়ের বাবামাকেও আমি নির্বিকার দেখি। এরই মধ্যে মেয়ের বাবামায়ের সঙ্গে আমারও ঘনিষ্টতা গড়ে ওঠে সুহাসের সংগে আমার আর বিপিন মানে মেয়ের বাবার একআক্ষিক সম্পর্কের দৌলতে। দুজনেই সুহাস সম্পর্কে উদগ্রীব তাই দুজনের মধ্যে আলোচনার দরজা খোলাই থাকে। বিপিনবাবুর মেয়ের নাম রীতা। বিপিন বাবু একটা জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করেন। আর্থিক অবস্থা ভালো। কলকাতায় বালিগঞ্জে একটা এপার্টমেন্টে থাকেন। ওনারা আমার বাড়ি আসেন আমরাও ওনার বাড়ি যাই। আমাদের সম্পর্কের সূত্র ধরে আমার মেয়ের সাথে রন্টু ও রীতারও ভাব হয়। তবে ওদের দুজনের সম্পর্ককে আমার মেয়ে ও তার মা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে। এ ব্যাপারে আমারও যে রক্ষণশীলতা কাজ করে না তা নয়। তবে আমি মানিয়ে চলি। সম্পর্কটাকে স্বাভাবিকভাবে দেখার চেষ্টা করি।
মাস ছয় ভোগার পর ঊষাদেবী ভালো হয়ে উঠেছেন। আগের জীবনের ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। এদিকে ছেলের মাধ্যমিক পরীক্ষা এসে গেছে। সেই নিয়ে উনি ব্যস্ত। জীবিকার প্রয়োজনে গানটা ধরে রাখতে হয়েছে। আমি রন্টুর পড়াশুনার দেখভাল করি। ছেলেটি পড়াশুনায় খারাপ নয়। তবে খুব ভালো নম্বর পাবার জন্য যথেষ্ট নয়। নম্বর পাবার কৌশলটা সেরকম রপ্ত করে নি।সেই অর্থে ভালো ছাত্রের দলে পড়ে না। তবে পাঠ্য বইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ে। বিশেষ করে গল্পের বই। এটা বোধ হয় বাবা মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আমার কাজ এই ক‘মাসে ভালো নম্বর পাবার কায়দাটা যতটা পারা যায় শিখিয়ে দেওয়া। আজকাল প্রশ্নের যা ধরণ বিশ্লেষণ পদ্ধতি নয় ওপর ওপর জানার প্রয়োজনটা বেশি। এক আধ কথায় বা টিক মেরে যা চাওয়া হয় তার জানান দেওয়া। নিজের জ্ঞান উজাড় করে দেওয়ার দরকার নেই।
আমার বিপিন বাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ঊষাদেবী সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা হয়ে যায় যার কিছুই জানতাম না। বিপিনবাবু সুহাসের পাড়ার বন্ধু ছোটবেলা থেকে। বিপিনবাবু সুহাসবাবুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে গভীরে কিছু না জানলেও ওঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন যেটা আবার আমি জানি না। সুহাসের বাড়ির সঙ্গে পাড়ার সূত্রে ওদের বাড়িরও যোগাযোগ। সুহাসের এক ভাইয়ের সাথে বিপিনের এখনও যোগাযোগ আছে। বোঝা যায় সুহাসের প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা আছে আর তাকে কেন্দ্র করে আকর্ষণ। আর ঊষাদেবী নিজের গুনেই ওদের খুব কাছের মানুষ। সুহাস ঊষাদেবীর বিয়ে থেকে পরবর্তীকালের অনেক খবরই বিপিনবাবু আর বিপিনবাবুর স্ত্রী মিনাদেবী রাখেন। উনাদের কাছ থেকেই জানতে পারি ওদের বিয়ের খবর। বিয়ের পর ঊষাদেবীর গ্রামের স্কুলে পড়াবার খবর। ওখানে স্কুলে চাকরিটা চলে যাওয়ার পর ঊষাদেবী এখনকার বর্তমান বাসস্থানে ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন।
বিপিনবাবুর স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে ছোট সংসার। মা ও মেয়ের জীবন খুবই সাধারণ ছিম ছাম। সেই তুলনায় বিপিনবাবু একটু সৌখিন মনে হয়। তবে সংস্কার মুক্ত খোলা মনের মানুষ। চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল স্ত্রীকে উনি অত্যন্ত সন্মান করেন। মেয়ে বাবা পাগল। পড়াশুনায় মোটামুটি। একটু আবেগপ্রবণ। ভালো কবিতা গল্প লেখে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়লেও বাংলায় আসক্তি। বাংলায় সাহিত্য চর্চ্চা। রন্টুর প্রতি এক দুর্নিবার আকর্ষণ। যেন এক অধিকার বোধ। রন্টু যেন একান্তই ওর এমন একটা ভাব। অথচ দুজনে সব সময় যে গায়ে গায়ে তা নয়। এক এক সময় দুজনের মধ্যে কোন বিষয় নিয়ে তর্ক এমন কি হাতাহাতিও হয়। রীতা যেন রন্টুর অভিভাবক বিপিনবাবু আর তাঁর স্ত্রী সেটা যেন উপভোগ করেন। আর দুজনেরই ঊষাদেবীর ওপর অগাধ আস্থা।
আমার এখন জীবন ঊষাদেবী আর বিপিনবাবুর সন্নিধ্যেই কাটে। স্ত্রীও সঙ্গে থাকে। তিনটে পরিবারকে নিয়ে যেন একটা ত্রিভুজ। আর এই ত্রিভুজের অতিভূজ যেন সুহাস-ঊষাদেবীর পরিবার। সুহাসের অনুপস্থিতিই অতিভুজের বাহুর বাড়তিটুকু যোগ করেছে। সুহাসের প্রতি আমাদের আকর্ষণই তৃতীয় বাহুর বাড়তি অংশটুকু। এখন আর আমার পড়ানোর জীবন নেই। রন্টুর পরীক্ষা হয়ে গেছে বছর দুই হয়ে গেল। এখন ও বারো ক্লাসে পড়ে আমার মেয়ের সাথেই। বিপিনের মেয়েও বিএ ক্লাসে পড়ছে। ও রন্টুর থেকে বড় বলে জানলাম। ও নিয়ে আর আজকাল আমি ভাবি না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে যদিও ওদের সম্পর্কটা মানতে চান না। ঊষাদেবীও আজ আমাদের মধ্যে একজন। আজকাল ওনার গানের প্রোগ্রাম তেমন থাকে না। আর্থিক টানাটানি চলছে।
দেখতে দেখতে আরও বছর তিনেক কেটে গেল। রন্টু বারো ক্লাস পাশ করে একটা ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি হয়েছে। রীতা বাংলা নিয়ে এমএ পড়ে। লেখালেখিতে একটু পরিচিতি হয়েছে। ও এখন যেন রন্টুর অভিভাবক। রন্টু এর পর কি করবে না করবে সব ব্যাপারেই ওর কর্তৃত্ব। রন্টুর সঙ্গে সম্পর্কে যেন নতুন মোড় নিচ্ছে। কর্তৃত্বটা বাড়ছে কিন্তু বাহ্যিক আবেগটা কমছে। আজকাল রীতার এক সহপাঠীর সঙ্গে রীতাকে প্রায়ই দেখা যায়। রন্টুর সাথে ওর খুব ভাব। রন্টুরও ভয় ওর কাছ থেকে সাধন যদি রন্টুকে ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু রন্টু যে সাধনকে হিংসে করে তা নয়। বরং সাধনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারে। রীতাকে নিয়ে খেপায়। আমি ঠিক বুঝি না। আমার বোঝার কথা নয়। আর বুঝেই বা কি করব। বিপিনবাবুরাই তো আছেন। এ ব্যাপারে উনাদের তেমন মাথা ব্যথা নেই। ঊষা দেবীও নির্লিপ্ত। আমার এখানে মাথা ঘামানোর দরকার কি। তাও আমার স্ত্রী মেয়ে মাথা ঘামায়। আমাকে প্রশ্নে জর্জরিত করে যার উত্তর আমার জানা নেই। এ আমার এক বিড়ম্বনা। তাই আমি আজকাল যথাসম্ভব ওদের এড়িয়ে বিপিনবাবুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখি।
আজকাল আমার বিপিনের ওখানে বেশি যাওয়া হয় না। শরীরটা খারাপ। আর একটু অলস হয়ে পড়েছি। বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে না। তবে ঊষার বাড়ি যাই। সুহাসের খবর নিই। রন্টু মধ্যে মধ্যে আসে। ফোনে বিপিনের সঙ্গে কথা হয়। একদিন বিপিনের সঙ্গে কথা হলো ও আসবে। আমি সময় ঠিক করলাম। ওরা বিকেলে আসবে। রাতে খেয়ে যাবে।
বিপিন দিনক্ষণ ঠিক রেখে এল। আমিও অপেক্ষায় ছিলাম । আজ অনেকদিন পর চুটিয়ে আড্ডা হবে। ঊষা আর রন্টুকেও রাতে খেতে বলেছি। আমি আর বিপিন বসার ঘরে বসেছি। ওরা শোবার ঘরে। বিপিনের সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলার পর ও পকেট থেকে একটা নেমন্তন্ন পত্র বার করল। রীতার বিয়ে। জানতে পেরে আমার আগ্রহ বেড়ে গেল। পাত্র কে? তবে কি রন্টুর সঙ্গে ছাড়া ছাড়ি হয়ে গেল। রন্টু হলে তো আমি এ বাড়ির থেকে জানতে পারতাম যদিও এ ব্যাপারে ঊষা কোনোদিন মুখ খোলে নি আমিও প্রশ্ন করি নি। আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারি নি। বিপিনকে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম। বিপিন জানাল সাধন পাত্র। তখন ওকে আমি বলেই বসি যে আমরা তো সবাই জানি রন্টু পাত্র। পাড়ার সবাই তাই জানে। বিপিন হো হো করে হেসে ওঠে। হাসি থামিয়ে বলে:
“সে কি তুমি জানো না! বাইরের কারো জানার কথা নয় অবশ্য। তবে আমি ভেবেছি যে ঊষা তোমাকে বলেছে। তুমি জান। তাই আমি বলি নি।”
আমি জানাই যে না এ ব্যাপারে আমিও কিছু জানতে চাই নি ঊষাও বলে নি। তবে ওদের মেলা মেশা দেখে সবাই আন্দাজ করেছি এই মাত্র। বিপিন তখন বলে,
“ শোন তোমার সব জানা দরকার। পেছনের অনেক কিছু জানার আছে। ঊষা যখন স্কুলে পড়ায় তখন অন্তঃসত্তাকালীন সুহাসের সঙ্গে ধরা পড়ে। জেলে থাকাকালীন ওর মেয়ে হয়। রীতাই সে মেয়ে। ওই অবস্থায় খুব অসুবিধেতে পড়ে। সে মেয়েকে আমরা বড় করার দায়িত্ব নিই। বছর খানেক পরে ওরা ছাড়া পায়। ঊষার আর স্কুলের চাকরিটা থাকে না। কিছুদিন পরে ওদের ছেলে হয়।ওই রন্টু। আমরা আমাদের কাছে রেখেই রীতাকে বড় করি আর ঊষা ছেলেকে নিয়ে তোমাদের পাড়ায় ও বাড়িতে আশ্রয় নেয়। গানকে পুঁজি করে জীবন চালাতে থাকে। আর সুহাস তো যথারীতি অন্তরীণ। ও ওর কাজ করে যায়। রীতা একটু বড় হলে ব্যাপারটা জানতে পারে । আমিই ওকে জানাই। তখন থেকে ও ভাইকে আগলে রাখে। ঊষার ওখানে ওর দ্বিতীয় বাসস্থান। বাইরের লোকেদের কাছে অন্যরমম লাগে। এই নিয়ে আমি বা ঊষা কেউ মাথা ঘামাই না।” আমি স্তম্ভিত। ঊষাকে আরও ভালোভাবে চিনলাম। আর চিনলাম এই বিপিনকে।
৪
রীতার বিয়ের পর অনেকদিন কেটে গেছে। রীতা এখন সাংবাদিকতার কাজ করে। সঙ্গে সাহিত্যচর্চা আছে। সাংবাদিকতার জগতে স্পষ্ট বক্তা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। তার সঙ্গে সে স্বাভাবিকভাবেই অনেক মানুষ ও কিছু স্বার্থগোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়েছে। আজের বাজারে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যেতে সরকারবিরোধী কথা বলতে স্পর্ধার দরকার হয়। সেটা নিজের ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে। আর রাষ্ট্রের চোখে বাবা যখন এক রাষ্ট্রবিরোধী তখন সেটা জানাজানি হলে ও ক্ষমতাগোষ্ঠীর সুনজরে থাকতে পারে না সেটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত জীবনে ওর একটা অঘটন ঘটে। সাধনের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ। ওর শিশুসন্তানকে নিয়ে ও বাবা মানে বিপিনের সঙ্গে থাকে। ইতিমধ্যে ওর মা মারা যায় একটা কঠিন অসুখে। বিপিন এখন অনেকটাই মেয়ে নির্ভর। সর্বক্ষণের সঙ্গী নাতনী। এদিকে রন্টু এখন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। বিয়ে করেছে। গান নিয়েই আছে। গানই ওর জীবিকা। আজ এখানে কাল সেখানে গানের জন্য ডাক আসে। তাতে যা রোজগার চলে যায়। বাড়িতে একটা গানের স্কুলও চালায়। ঊষা আজকাল তার মা মারা যাওয়ার পর নাকি ভাইয়ের ওখানে গিয়ে নিয়মিত থাকে। পাড়ায় বেশি দেখা যায় না। আমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় নি। যা খবর পাই রন্টুর কাছ থেকে । রন্টু মাঝে মাঝে আসে। আমার মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে আমরা দুজন। বাইরে জগতের সঙ্গে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তবে বিপিনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ফোনেই বেশি কথা হয়। কখনও ও আসে। আমিও যাই। আমার আর বিপিনের মধ্যে এখনও অনুপস্থিত অন্তরিনে থাকা সুহাস। জেনেছি ও দীর্ঘদিন জেলবাসের পর এখন বাইরে। তবে মূল স্রোতে নয়। কানাঘুষোয় ওর সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়। বিপিন কিভাবে জেনেছে যে ও বাইরে কোন এক প্রদেশে জঙ্গল অঞ্চলে এখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করে। ও নাকি এক আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে থাকে। বিয়ে করেছে কি না ঠিক জানা নেই। তবে কোনোটাই অসম্ভব নয়। আমাদের মত ছা পোষা মানুষের কাছে বিষয়টা অকাম্য হলেও এটা অসম্ভব কিছু না। জীবনের নিয়মে এটা ঘটে থাকে বিশেষ করে ব্যতিক্রমী মানুষের ক্ষেত্রে। তবে ঊষাদেবীর জন্য খারাপ লাগে। ও নিশ্চয় এটা ভালোভাবে নেয় নি। ওর সঙ্গে দেখা হয় না বিশেষ তাই এ ব্যাপারে ওর প্রতিক্রিয়া আন্দাজই শুধু করতে হয়। আর সেজন্যই বোধ হয় নিজের সংসার থেকে দূরে ভাইয়ের ওখানে থাকে। আর ভাই নাকি বিয়ে করেনি। দুজনের পক্ষেই তাই সেটাই বেশি সুবিধেজনক। যাই হোক জীবনে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয় তাই ঊষাও বোধ হয় মানিয়ে নিয়েছে। আমাদের দিন চলে যাচ্ছে। বিপিনেরও আমার মত অবস্থা। আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। এর মধ্যে পৃথিবীতে নতুন এক দুর্যোগ। করোনা দুর্যোগ। সব কিছু থমকে গেছে। চিন্তা ভাবনা বাজার হাট একের সঙ্গে ওপরের যোগাযোগ। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নতুন ধরনের জীবনের বিধান। সব কিছুই ওলট পালট। এর মধ্যে সচল কেবল এক ভীতি। হার হীম হওয়া ভয়। কি জানি কখন করোনা ধরে। আর এ নিয়ে নানা গবেষণা। আমাদের মত বয়স্ক লোকেরা আসতে আসতে একা সব কিছু থেকে দূরত্বে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। সময় সবই কেড়ে নেয়। নিচ্ছিলও। কিন্তু অল্প বয়স্কদের এ কি জীবন। বাচ্চাদের মোবাইল কম্পিউটার হাতে শিক্ষা বন্ধুত্ব খেলাধুলো সব। ছেলেমেয়েদের অফিস বাজার সবেতেই অন লাইন। কতদিন চলবে জানা নেই। অনেকে বলেন এটাই নতুন সভ্যতা। ডিজিটাল সভ্যতা। মেনে নিতে হয়। কেউ একে বিজ্ঞান দিয়ে আবার কেউ ধর্ম দিয়ে বোঝে । আমাদের কাছে কোন ব্যাখ্যা নেই। ওই যে বললাম আমরা না ঘরকা না ঘাটকা। না পারি বিশ্বাস করতে না পারি অবিশ্বাস করে ছুড়ে ফেলে দিতে। অনিশ্চয়তার ভয়টা আমাদেরও গ্রাস করে। ঊষার অনেকদিন খবর নেই। মধ্যে মধ্যে ফোন করত। সুহাসের শেষ খবর পাওয়ার পর ওর ওপর দুর্বলতা যেন বেড়ে গেছে। ওর কথা মনে হলেই কাজলের মুখটা ভেসে ওঠে। একটা সহানুভূতির ছোঁয়া যেন নিজের অজান্তেই ছুঁয়ে যায়। আজ সেটার তীব্রতা কেন যেন বেড়েছে। একটু বেলা হতে বেরিয়ে রন্টুর কাছে যাই। এটা ওটা কথার পর ঊষার কথা জিজ্ঞাসা করি। ও জানায় মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই আসতে পারে না। ওই নাকি প্রায়ই যায়। মাকে আসতে বললেও আসতে চায় না। মামার ওখানেই থাকে। তবে চিন্তার নেই। তাও রন্টুকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখলাম। বোধ হয় মায়ের শরীর নিয়ে চিন্তা। আর ঊষার সাবেকি অসুখটা তো ভালো নয়। ওটা নিয়ে চিন্তা তো হবেই। তা ছাড়া ওর জীবনে যে ঝড় বয়ে গেল। শেষ জীবনে একটা ধাক্কা খেল। আর ধাক্কাটা আর কারও কাছ থেকে নয়, সুহাসের কাছ থেকে যার জন্য ও জীবনটাকে বলতে গেলে উৎসর্গ করেছে। জীবনে কিছু পায় নি। আশাও করে নি। আমি মনে মনে ভাবি।
দিনকতক পরে রীতার ফোন পাই। রীতা এবার ওর বাবার জন্মদিন পালন করবে। এখনকার ছেলেমেয়ের মধ্যে এই উৎসাহটা খুব দেখা যায়। আমরা কোনদিন ঘটা করে জন্মদিন পালন হতে দেখি নি। আজ ছেলেমেয়েরা শুধু নিজের ছেলেমেয়ে নয় বাবা মায়ের জন্মদিন পালনেও উৎসাহী। ব্যাপারটা মন্দ লাগে না। ছেলেমেয়েরা আজ বাবা মায়ের প্রতি কর্তব্য নিষ্ঠ নয় বলে যে অভিযোগটা করা হয় তা সর্বতোভাবে সত্যি নয়। আসলে কর্মজীবনের তাগিদে ওদের জীবনধারণে বদল এসেছে। কাজের স্বার্থে অন্য কোথাও থাকতে হয়। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে ওদের আচার আচরণে পার্থক্য আছে। আর আমাদের যে রক্ষণশীল জীবন তা সবটা ঠিক তা নয়। তাই নানা কারণে একটা দূরত্ব এসেছে। এর জন্য আমরাও কিছুটা দায়ী। যাই হোক রীতার নেমন্তন্নে মন ভরে ওঠে। আজ এই করনার বাজারে হোটেল রেষ্টুরেন্ট করা যাবে না। বেশি লোকের সমাবেশ বারণ। তাই আমরা দুচারজন ওদের বাড়িতেই মিলব সেই শুভ জন্মদিনে, সেটাই ঠিক হয়। আমি আর স্ত্রী নিমন্ত্রিত।
আমরা বিপিনবাবুর জন্মদিনে ওদের বাড়ি যাই। রাস্তাঘাটের যানবাহনের অবস্থা খারাপ ভেবে বিপিন তার ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেয়। সাধারণত বিপিন গাড়ি বিশেষ ব্যবহার করে না। । গাড়ি থাকলেও খুব দরকার ছাড়া গাড়ি চড়ে না। আর স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ওর গাড়ির ব্যবহারটা কমে গেছে। এখন ওটা রীতাই বেশি ব্যবহার করে। মনে হয় রীতা আমাদের অসুবিধের কথা ভেবে গাড়ির ব্যবস্থা করে। বিপিনের ঘরে ঢুকে দেখি বিপিন আর এক ভদ্রলোক বসে। এই গোঁফওয়ালা ভদ্রলোককে আমি চিনি না। অবাঙালি বলে মনে হল। বিপিন ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। বিপিনের মামাতো ভাই। দিল্লিতে থাকে। ব্যবসা করে। কথায় হিন্দি টান । বাঙালি হলেও বাঙালি বলে মনে হয় না। নানা বিষয়ে আলোচনা হতে থাকে। আর আজ আলোচনায় করনাই প্রাধান্য পায়। রোগটা কি কতটা সংক্রমক কতটা প্রাণঘাতি এসব মিশিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। দিল্লিতে সংক্রমণ বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে শুরু হলেও এখনও মারাত্মক রূপ ধারণ করে নি। তবে আতংকিত সবাই। এরই মধ্যে এ নিয়ে আতংক সৃষ্টি করা প্রচারের বাহুল্যতা এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। আলোচনার মধ্যে রীতা চা নিয়ে আসে। চায়ের পর্ব শেষ হলে কেক কাটার আয়োজন। সবাই বেশ কৌতুক বোধ করি। আমাদের জীবনে এটা তো কৌতুক বটেই। ছোটবেলায় জন্মদিনে মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার মধ্যেই মজাটা থাকত। বাকিটা আদিখ্যেতা বলে ভাবা হত। এর মধ্যে রীতা এসে বসে। ওর সাংবাদিকতা নিয়ে নানা কথা ওঠে। ওর সংবাদে যে সংবাদ পরিবেশিত হয় তা নিয়ে ও যে অসুবিধের মধ্যে পরে তাও ও বলে। বেশ কিছুদিন আগে একটা আদিবাসী অঞ্চলে পুলিশের সাথে গ্রামবাসীর সংঘর্ষের ব্যাপারটা ও তুলে ধরে। ওখানকার এক নেতার সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেই নিয়ে রীতাকে কম ভুগতে হয় নি। ওকে গ্রেপ্তার করার কথাও ওঠে। এ নিয়ে বিপিন যথেষ্ট উদ্বেগে। এই আলোচনায় সুমিতবাবু অর্থাৎ নতুন পরিচিত ভদ্রলোকও যথেষ্ট উৎসাহের সঙ্গে অংশ গ্রহণ করে। এরপর কেক কাটার পালা। উৎসাহের সঙ্গে সেটা পালন হয়। রীতার ছোট্ট মেয়ে কেক কেটে গান গেয়ে অনুষ্ঠানকে উৎসব মুখর করে তোলে।
কেক পর্ব শেষ হলে আবার আমরা গপ্পো করতে বসি। জানতাম না যে আমার জন্য এরকম একটা রহস্যের উপাদান সংগ্রহ করে রেখেছে বিপিন। আলোচনার মধ্যে হঠাৎ আগুন্তুক ভদ্রলোক গোফ খুলে ফেলে। মাথা থেকে একটা কৃত্রিম চুলের গোছা খুলে একধারে রাখে।আমি অবাক হয়ে দেখি সুহাস সামনে বসে যাকে আমি বেশ কিছুদিন আগে ঊষার গানের মজলিসে দেখি। আমি আবেগ প্রবণ হয়ে উঠে আসি ওকে জড়িয়ে ধরার জন্য। ও বলে থাক সামাজিক দূরত্বটা বজায় থাক। আবেগ চেপে নিজের জায়গায় বসি। রীতা জানায় কিছুদিন আগে উনার সঙ্গে বসেই ও ইন্টারভিউ নেয়। সেদিন ওনাকে চিনতে পারে নি। ও জানত না বাবার সংগে উনার ভাব আছে। আর উনি অন্য কেউ নন সুহাসবাবু, রীতার বাবা, যার সম্পর্কে সে বিপিনবাবুর কাছেই জানতে পারে।
তারপর আমাদের মধ্যে নানা কথাবার্তা শুরু হয়। সেই কলেজের কথা। ইউনয়ন গঠন সুহাসের রাজনীতি এসব। কাজলের কথাও। কাজলের কথার সঙ্গে ঊষাদেবী উঠে আসেন। আমি বা বিপিন যে কথার জন্য উদগ্রীব সেটা তোলার সুযোগ পাই। জানতে চাই এখন সুহাস কেমন আছে এখন কি করছে। ওর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কি। সুহাস কিছুই গোপন করে না। ওর জেল জীবন তারপরের জীবনের কথা বলে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলে না। আমি সেটা উস্কে দেবার জন্য ঊষার কথা রন্টুর কথা বার বার তুলি। কিন্তু আমরা ওর বর্তমান জীবনের কথা যা শুনেছি তা জানতে পারি না । আমাদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমি তখন ঊষার ওর ভাইয়ের সঙ্গে থাকার কথা ওর অসুস্থতার কথা বলি। সুহাস কোথায় কার সঙ্গে থাকে তা জানতে চাই। এবার সুহাস মুখ খোলে। ও জানায় রাজনীতিগত ভাবে দলের সঙ্গে ওর মত বিরোধ হয়েছে। ও মনে করে পূরণ ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটছে দলের কাজে। তবে এখন অনেকেই সেটা মানছে না।এই নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধ করলে দলে ভাঙ্গন ধরতে পারে। তাই সুহাস চুপ করে সরে আছে। ওর আশা দল যখন ভুল বুঝবে তখন আপনা থেকে দূরত্ব কমবে। এ বিষয় গুলো নিয়ে আমাদের উৎসাহ থাকলেও ওর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আমরা বেশি উৎসাহী। আমি আবার জানতে চাই ঊষাদেবীর খবর কি? উনার চিকিৎসার কি হচ্ছে? সুহাস বলে:
“ কেন তোমরা জান না? ও মারা গেছে”
আমরা আকাশ থেকে পড়ি। আমি বলি:
“ রন্টু বলল যে ওর মা মামার ওখানে থাকে। ও অসুস্থ”। সুহাস বলে:
“ ওটা রন্টু বলে কারণ ওকে সেটাই বলতে বলা হয়েছিল। ঊষা বেশ কিছুদিন হল আমার ওখানে গিয়েই থাকত। সবাই জানত ও একজন আদিবাসী মহিলা আমার সঙ্গে থাকে । দলের নির্দ্দেশে ও ওখানে মেয়েদের শিক্ষার দায়িত্বে ছিল। সেই সূত্রে ওদের মধ্যে রাজনীতির কাজও করত। বছর তিনেক আগে ও যে গ্রামে কাজ করত সেখানে ম্যালেরিয়া হানা দেয়। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ ওখানে মারাত্মক। তাতে মৃত্যুর হার আজ কবিড থেকে কম নয়। আর সেটা প্রধানত গরিব মানুষের ঘরেই হানা দেয়। তাতে কাজল মানে তোমাদের উষা মারা যায়। এটা খবরের কাগজে বের হয়। তবে ঊষা অন্য নামে ছিল। ওখানকার বাইরের জগৎ ঊষা নামে কেউ মারা গেছে বলে জানে না। পুলিশ সাংবাদিক কেউ না। এটা বোধ হয় আমার ব্যক্তিগত জীবনে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। পার্টির স্বার্থে বিপ্লবের স্বার্থে আমাকে মেনে নিতেই হয়। ওর আত্মত্যাগ অমর হয়ে থাকবে “
আমি আর বিপিন পরস্পর মুখের দিকে তাকাই। এটাই তবে সুহাসের আদিবাসী মহিলাকে নিয়ে বসবাসের গল্প।
৫
উনাকে কেউ সরেসদা আবার কেউ সরেসবাবু বলে ডাকেন। সুরেশ বসু নাম হলেও ওনাকে কেউ সুরেশ বাবু বা সুরেশদা বলেন না। ওই নামটা যে উনার সেটাই আমরা কয়েকজন কাছের লোক ছাড়া অন্যেরা জানেন না। অনেকে সত্যিকারের নামটা ভুলেই গেছেন।শহরের ক্লান্তিকর পরিবেশ থেকে দূরে কল্যানীর একপ্রান্তে সরেসবাবুর ছোট্ট বাড়ি। সরকারি অফিস থেকে অবসরের পর এই বাড়ি করে তিনি এখানের নিজ বাড়ির পাকা বাসিন্দা হয়েছেন। তবে কলকাতার পরিচিত মহল ওনাকে এখনও টানে। প্রতিসপ্তাহেই সেখানে কফি হাউসে আড্ডায় এখনো যান। কখনো কখনো দাদার বাড়ি বা বন্ধুর বাড়িতে কলকাতায় থাকেন। এখানে স্ত্রী আর উনি একা। স্ত্রী আছেন। একা বলি কি করে! যদিও বাঙালি হিন্দু পরিবারে একে একে এক। আজ আমরা মনে করি দুজনে দুটো সত্তা। তাই একা নন দোকা। আজকাল আমিও ওখানে থাকি।কার্যত এটাই আমার পৈতৃক ভিটে।
সরেসবাবুদের ছেলে মেয়ে দুজনেই ভিন প্রদেশে। ছেলে ও ছেলের বউ দুজনেই চাকরিরত আর সেই সূত্রে ভিনপ্রদেশ বেঙ্গালোরে । আর মেয়ে জামাইয়ের চাকরির দৌলতে তার সঙ্গে বোম্বেতে। সেই সূত্রে বছরে কিছু সময় ধরে সরেসবাবু ঘর ছাড়া। ছেলে মেয়ের সঙ্গে কাটে। বয়স হয়েছে। শারীরিক কারণে পরনির্ভরশীলতা বেড়েছে। তাই ছেলে মেয়ে এখানকার বাস উঠিয়ে ওখানে ওদের কারও একজনের সঙ্গে বা পালা করে দুজনের ওখানে থাকার কথা বললে সেটা সরেসবাবু অস্বীকার করতে পারেন না । হয়তো ভবিষ্যতে সেটা মেনে নিতে হবে। কিন্তু এখনই সরেসবাবু সেটা চান না নিজের জীবন সবটা বর্জন করে। যদিও স্ত্রীর এতে আপত্তি নেই। ওনার মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে মেয়ের বাড়িতে বেশ কাটে। কিন্তু সরেসবাবু সেটায় এখনই রাজি নন বলে স্ত্রী এ ব্যাপারে চুপ। আর তাঁর চুপ থাকাটাই সরেসবাবুর পক্ষে বিড়ম্বনা। মনে হয় উনি ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে চুপ থাকেন। বরং নিজের মত প্রকাশ করলে ইচ্ছেকে মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানালে একটু অশান্তি হয় তো হতো কিন্তু এই বিড়ম্বনাটা থাকত না। যে সব মেয়েরা আমাদের সমাজে নিজের ইচ্ছেকে দমন করে থাকে তাদের নিয়ে এই সমস্যাটা দেখা যায়। এছাড়া একটা ব্যাপার আছে। ছেলে মেয়েদের জীবন ধারণ আর আগের যুগের পুরনো ধাঁচের মানুষের জীবনধারণ ভাবনা চিন্তার মধ্যে একটা সংঘাত আছে। সেটাকে এড়িয়ে চলতে গেলে যতদিন সম্ভব আলাদা থাকাই ভালো। সরেস বাবুর এই যুক্তিটাকে স্ত্রী সুব্রতা অস্বীকার করতে পারেন না। এটা অল্প বিস্তর হলেও ওনার পক্ষেও সত্যি। আর কলকাতায় ভাই বোন পরিচিত সবাই যাদের সঙ্গে একই ভাষায় গল্প গুজব করা যায়। তাই একটা পেছন টান ওনারও আছে।
সরেস বাবু মিশুকে প্রাণবন্ত সরেস মানুষ। তিনি তাঁর জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে অন্তত এই সরেস ডাকটার প্রতি সুবিচার করে গেছেন। জনপ্রিয় ওই নামটা ছাড়া ওনার নামডাক খুব একটা নেই। পরিচিতির ছোট গন্ডির মধ্যে সরেসবাবু যথেষ্ট জনপ্রিয়। আলাপে প্রলাপে দক্ষ। নিজের বয়স হলেও অল্প বয়স্কদের মধ্যে উনি এখনও যুবক। হাসি ঠাট্টা টিকা টিপ্পনীতে উনি সত্যি এক রসিক পুরুষ। কিন্তু আপাত এই হালকা চালের মানুষটার গভীরে এক সত্যনিষ্ঠ গম্ভীর মানুষ যেন লুকিয়ে থাকে। যেটা উনি বিশ্বাস করেন সেটা বললে কেউ ক্ষুন্ন হবে ভেবে তিন পিছিয়ে থাকেন না। এই নিয়ে ঘরে বাইরে তার বিবাদ। সক্রিয় ভাবে এখন আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও কোন আন্দোলন মিটিং মিছিলে এখনও পা মেলাতে চেষ্টা করেন। সে সূত্র ধরে সমাজের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ।
এখন বয়স হয়েছে। আগে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন সরেস বাবু।লেখালেখি নিয়ে থাকেন। সাবেকি সমাজ আন্দোলনের ভাবনার সঙ্গে এখন বৃদ্ধদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে তাঁর সমাজ ভাবনা। তাঁদের সুস্থ থাকা, অসুস্থ হলে যথারীতি চিকিৎসার ব্যবস্থা এসব নিয়ে তাঁর ভাবনা। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের ভূমিকা। এর সঙ্গে একটা বিষয় তাঁকে বিশেষ ভাবে ভাবায়। এ নিয়ে পরিচিত অপরিচিত মহলে বিভিন্নজনের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বাধে। অবশ্য কাউকে কাউকে তিনি সহমতে পেয়ে যান। বিষয়টা হল বার্ধক্যে অসুস্থ থাকাকালীন যখন শরীর আর নিতে পারে না তখন পরিণতির অনিবার্যতা। অথচ তাকে পরিবারের সবার মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে পরিবারকে সর্বশান্ত করে আরও কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখার প্রথাগত চেষ্টার তিনি বিরোধী। এই অবস্থায় তিনি ইচ্ছামৃত্যুকে অধিকার বলে সরকারের মেনে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন। উনি উদাহরণ তুলে বলেন কি দুরবস্থা ও মানসিক কষ্টের মধ্যে মা বিছানায় অসুস্থ ছেলের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আদালতে ছেলের স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকার দাবি করতে বাধ্য হয়। আদালত তা মেনে না নেওয়াকে অমানবিক বলে মনে করেন সরেসবাবু। এই নিয়ে যুক্তি তর্কে বসলে অনেকে বলেন সম্পত্তির লোভে এই সুযোগ নিয়ে ছেলে মেয়েরা বাবা বা মায়ের হত্যা মৃত্যুকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলে চালাবে তাই এটা মেনে নেওয়া যায় না। এই মতের সঙ্গে সরেসবাবুর একমত নন। তাঁর মতে এমন কোন নিয়ম দেশে আছে কি যার অপব্যবহার হয় না? এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হিসেবে একটা দুটো অঘটন ঘটলেও পরপ্রজন্মের প্রতি এ ধরণের অবিশ্বাস উনার মতে ঠিক নয়। তাহলে কোন নিয়মই চালু করা চলে না। আবার অনেকের মতে জন্ম মৃত্যুতে মানুষের হাত নেই। দুটোই ওপরওয়ালার হাতে। সেখানে উনার মতে তাহলেতো জন্ম নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি চালু করা চলে না। জন্মনিরোধক ওষুধ ব্যবহার করা অপরাধ। আমরা জানি অনাকাঙ্খিত সন্তান সম্ভাবনা দেখা দিলে ভ্রূণ হত্যা করা হয়। এসব ক্ষেত্রে আমরা নিয়মিত ওপরওয়ালার বিধান ভাঙ্গি। অথচ একজন কষ্টরত বৃদ্ধ যার প্রয়ান আজ বা কাল অনিবার্য তাকে বিছানায় কষ্ট দিয়ে পরিবারকে সর্বশান্ত করে সবার নিরানন্দের কারণ হয়ে বাঁচিয়ে রেখে কোন উপরওয়ালার বিধান মানা হয় সেটা সরেসবাবুর তা বোধগম্য হয় না। তিনি ইচ্ছামৃত্যুকে একটা অধিকার বলেই মনে করেন। আরও ভাবেন যে এই নিয়ম চালু হলে মানুষও এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে প্রাথমিক পর্যায়ে মানিয়ে নিতে অসুবিধে হলেও। এ নিয়ে সরেসবাবু আন্দোলন গড়ে তোলার পক্ষে। কারো কারোকে সঙ্গে পেলেও এ নিয়ে তিনি তেমন সাড়া পান না। আন্দোলন গড়ে ওঠে না। একে উনি মানুষের পিছিয়ে থাকা চিন্তার ফল বলে মনে করেন। ভাবেন আজকের সমাজজীবনে বৃদ্ধদের অবস্থা যেদিকে এগোচ্ছে করোনার মতো ভাইরাস একে যেমন সংকটাকীর্ন করে তুলছে তাতে আগামীদিন এই দাবিটা উঠতে বাধ্য।
এখন সরেসবাবুর ছেলে বদলি হয়ে কলকাতায়। সঙ্গে বৌমাও। সরেসবাবুর সঙ্গে থাকে। নাতি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ছেলে ছেলের বউ নাতি স্ত্রীকে নিয়ে আনন্দে আছেন। স্ত্রী নাতির পড়াশুনা দেখেন। একসঙ্গে টিভি দেখা কেরাম খেলা নিয়ে নাতির সঙ্গে ভালই কাটে। এই আনন্দের সংসারে যেন যতদিন পারা যায় কাটিয়ে যাওয়া। বার্ধক্যে সবাইকে নিয়ে এই চলার আনন্দ ভোগ করার জন্যই সরেসবাবুর বেঁচে থাকা। শরীরটা ভেঙে পড়লেও এখনো সম্পূর্ণ অচল হয় নি। এরই মধ্যে বেরন।তবে বুঝতে পারছেন যখন তখন বসে যেতে পারেন। এরই মধ্যে করোনা ভাইরাস। আর বয়সজনিত সমস্যাতো আছেই। তবে সরেসবাবু দমতে রাজি না। এর মধ্যেই নিজের লেখাপড়া। তবে ছেলে মেয়ের এখনকার জীবন যাপন তাদের ব্যক্তি ভবিষ্যত নিয়ে ধারণা এসব নিয়ে ছেলের সঙ্গে বিরোধ দেখা যায়। স্ত্রী চুপ করতে বলে। মেয়ে ফোনে ছেলের পক্ষ নে। এ নিয়ে বিরোধ যেন বেড়ে চলেছে। আজকাল স্ত্রীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডা।আর এসব বিরোধ ঘরে বন্দি থাকে না। বাইরে সাতকানে পৌঁছায় যে না তা নয়। তবে তাতে সরেস বাবুর কিছু আসে যায় না। সরেস বাবু জানে সব সংসারে এসব থাকে। তবে তিনি এটাও জানেন যে অন্যান্য অনেকের থেকে উনি ভালো আছেন। আর ছেলে বা মেযে সব সময় তার সঙ্গে আপদে বিপদে। আর বউ মাকে নিয়ে কোন সমস্যাই নেই। স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনদিন অভিযোগ ছিল না আজও নেই। তবে মতবিরোধ যখন হয় তখন তা তুঙ্গে। এছাড়া ভাই বোনদের সঙ্গে সরেস বাবুর মোটামুটি সুসম্পর্ক। এখনো পূরণ যৌথ পরিবারের রেশটা এ বাড়িতে আনাচে কানাচে উঁকি মারে।
আজকাল পাড়ায় আড্ডায় বিশেষ কেউ আসে না। বাজার যাতায়াতের পথ অনুসরণ করে যে কজন বের হন তাদের সস্নিদ্ধ চোখ খুঁজে ফেরে । যদি কাউকে পাওয়া যায় জমে থাকা মনের কথা বলার জন্য। সরেসাবুর তেমন খবর নেই। মিশুকে সবার প্রিয় আড্ডার মধ্যমণি মানুষটা যেন হারিয়ে গেছে। করোনা র দৌলতে কেউ কারো বাড়ি তেমন যায় না তাই খবর পাওয়া যায় না। আমরা জানি কোমরে একটা চোট লাগায় সরেসবাবু আজকাল একেবারেই বেরোতে পারেন না। আজ বাজারে শোনা গেল উনার কভিড হোয়েছে। খবরটা শুনে সকলের মন খারাপ। খবরটা কতটা সত্যি জানা দরকার। হঠাৎ বিশু বাবুর সঙ্গে আমার দেখা । উনাকে জিজ্ঞাসা করেও বিশেষ কিছু জানা গেল না। দুজনে ঠিক করলাম সরেস বাবুর বাড়ি গিয়ে খবর নেব। পরের দিন রবিবার সরেস বাবুর বাড়িতে আমি আর বিশুবাবু। বাড়িতে সবাই আছে। সরেস বাবু বিছানায়। আমাদের দেখে স্বভাবসুলভ হাসি উনার মুখে উপচে পড়ল। কেমন আছেন জানতে চাইলে কোমরের ব্যাথার কথা বললেন। আমরা করোনার কথা জানতে ইচ্ছুক থাকলেও সেটা জানতে চাইতে পারছি না। সংকোচে একটু বেশি দুরত্ব রেখে চলছি। এমনিতেই ভাবনার জগতে একটা অস্পৃশ্যতার রোগের ছোঁয়া। অস্বীকার করা যায় না। এই রোগটা আজ সবাইকে আক্রমণ করেছে। সরেস বাবু বুদ্ধিমান লোক। আমাদের অস্বস্তির দিকটা বোঝেন। নিজে থেকেই বলেন:
‘‘ছেলে বলল বাজারে রটেছে আমার নাকি করোনা হয়েছে। আজ এটা খুব স্বাভাবিক। যদি সত্যি সত্যি করোনা হয় তবে অবাক হবার কিছু নয়। শরীরে ব্যাথা ঠান্ডা লাগা সব নিয়ে আমিও ভয়ে ভয়ে ছিলাম। আর আমার ভয়টা শুধু করোনা নিয়ে নয়। করোনা চিকিৎসা নিয়ে। তাছাড়া আমার বয়স হয়েছে। কিছু হলে যন্ত্রণা সবার। বাড়িতে এতগুলো লোক। আমার জন্য ওদের সারাজীবন বিপন্ন। শুধু রোগ নয়। বেসামাল অর্থ খরচ। কে সামলাবে বলুন? সেজন্যই আমার বরাবরের স্বেচ্ছা মৃত্যুর দাবি।”
আমরা তখনও বুঝি নি উনার করোনা হয়ছে কি না। ছেলে পাশে দাঁড়িয়ে। উনার স্ত্রী চা করতে গেছেন। ছেলের কথায় আমরা আশ্বস্ত হলাম। ছেলে জানাল:
‘‘দেখুন না কাকু, বাবার সেই চিন্তাটা মাথাচাড়া দিয়েছে। স্বেচ্ছা মৃত্যুর অধিকার। করোনার ভয় সেটাকে জিগিয়ে তুলেছে। যাই হোক করোনা টেষ্ট করা হয়েছে। কিছু পাওয়া যায় নি। কোমরের চোট টাও তেমন কিছু নয় বলে ডাক্তার জানিয়েছেন। উনার ভয় যদি করোনা হয় যদি বিছানায় পড়েন তবে আমাদের কি হবে। বোঝাতে পারছি না বয়স হলে এগুলো সঙ্গী।” সরেসবাবুর লেখা একটা চিরকুট ছেলে তুলে ধরে তাতে লেখা :
“ যদি আমার কভিড হয় আর আমাকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ গ্রহণ করতে হয় তবে আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী থাকবে না। এটা আমার স্বেচ্ছা মৃত্যু। যদি কাউকে দায়ী করতে হয় তবে তা হল রাষ্ট্রের স্বেচ্ছামৃত্যুর দাবিকে অস্বীকার।যদি এই দাবি মান্যতা পেত তবে আমার ইচ্ছা অনুযায়ী আমি আরও কিছুদিন এই পৃথিবীতে থাকতে পারতাম। প্রিয়জনদের ছেড়ে আমি চলে যেতে চাই না। তাও এটা যে অনিবার্যতা আজ হোক কাল। আমি এও চাই না যে অসুস্থ হয়ে পড়ে থেকে প্রিয়জনের স্বাভাবিক সুন্দর জীবন বিপন্ন করে তুলি, চিকিৎসা ব্যবসার খপ্পরে পড়ে তারা নিঃস্ব হোক। তাই কিছুটা আগেই আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। পরে অসুস্থ অবস্থায় হয়তো সেটা সম্ভব হবে না। পড়ে থাকতে হবে মৃত্যু শয্যায়। সেটা এড়াতে আমার এই স্বেচ্ছামৃত্যু। স্বেচ্ছামৃত্যুর সোচ্চার দাবি।”
আমরা পড়ে হাসি।তবে কি উনি করোনা ধরে নিয়ে ভয়ে এরকম একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু উনিত এত দুর্বল মনের লোকতো নন। আমরা জানতে চাই। উনি বলেন:
‘‘ হ্যাঁ ভয়ে । তবে করোনার ভয়ে নয়। চিকিৎসার ভয়ে, বিছানায় অক্ষম হতে পড়ে থাকার ভয়ে, অন্যদের কি হবে সেই ভয়ে আর সর্বোপরি আমার অধিকারের দাবিতে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে।‘‘
ছেলে চিরকুটটা ছিঁড়ে ফেলে।
যাই হোক আমরা বিরম্বনা মুক্ত। করোনার ভয়টা কাটে। এরপর সরেস বাবু তার স্বমূর্তিতে। চুটিয়ে অনেকদিন পর আড্ডা। নানা কথা। আজ মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। করোনার আবহে ছাঁটাই হয়ে চলেছে, ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ। এরই মধ্যে নিরবে নতুন শ্রম আইন কৃষি আইন । একটার পর একটা সংস্কার। চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা। সরকার লেজে গোবরে। পৃথিবীজুড়ে করোনা আর আর্থিক সংকটের দ্বৈত আক্রমণ আলোচনায় উঠে আসে। আলোচনা শেষে সবাই তৃপ্ত। অন্তত এই দুঘন্টা আমাদের মুক্ত মন। করোনা আতংক পালায়। আমরা বুঝি সরেস বাবু সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা আবার ছন্দে ফিরব। বেলা হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। করোনা আপদ থাকলেও সে অনেকটা মানুষের শরীরের নিরাপদ আশ্রয়ে। যদিও কখনও কখনো কারো কারো শরীরে মারাত্মক বিবাদী হয়ে ওঠে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে আবার সেরে উঠছে। আমরা বুঝে গেছি এ নিয়েই বাঁচতে হবে। সবাই বের হচ্ছে। কাজ কর্ম শুরু হয়েছে। তবে দেশে ব্যাপক কর্মহীনতা। অর্থনীতি পুনরুদ্ধার দূর অস্ত। পরিবেশ দূষণ যুদ্ধের আবহ মানুষের জীবন জীবিকার সমস্যা আরও জটিল করে তুলেছে। নতুন কৃষি নীতির দৌলতে জমি অকৃষি সম্প্রদায়ের হাতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। কৃষি কাজের সুযোগ কমছে।এর ফলে মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ বাড়ছে। মানুষের প্রতিবাদের অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ ভেঙে চুরমার। বিচারবিভাগ তার নিজস্ব স্বত্বা হারাতে বসেছে। এদিকে লক ডাউন উঠে গেছে। রাষ্ট্র আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। মানুষ আর ঘরে বসে থাকছে না যদিও করোনার ভয়ে যে সামাজিক বন্ধনটা আলগা হোয়ছে তার রেশটা থেকে গেছে। আমাদের আড্ডার বহর ছোট আকারে হলেও আবার জমে উঠেছে। আর সরেস বাবু এলে তো কথাই নেই। তবে উনি মধ্যে মধ্যে উধাও হয়ে যান। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন করেন এমন উনার কিছু বন্ধু আছে তাদের কাছে চলে যান। তাদের সঙ্গে পাহাড়ে জঙ্গলে সমুদ্রে বেড়াতে যাওয়ার নেশাটা আবার পেয়ে বসেছে। এক একটা এলাকা ঘুরে এসে সেখানকার মানুষ সেখানকার পরিবেশ নিয়ে উনার রসালো আলাপ আড্ডাকে নতুন মাত্রা দেয়। আমাদের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে।
আজ মানুষের মধ্যেকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষোভ যেন একটা মোহনায় মিলতে চলেছে। পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনের ডাকে সামিল হয়ে শ্রমজীবি মানুষ তাদের অধিকারের কথাও বলছে। আবার শ্রমিকদের আন্দোলনে পরিবেশবিদরাও যুক্ত হচ্ছে। করোনাই বোধ হয় একে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করছে। মানুষের শ্রম সময় বাড়িয়ে তাকে কম্পিউটারমুখী করে মানুষের স্বাস্থ্যের যে বারোটা বাঝছে সেটা দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। একটা মনোরোগ সমাজকে গ্রাস করছে। আর জমি অকৃষি সম্প্রদায়ের হাতে গিয়ে রিয়েল এস্টেটের ব্যবসার বাধ্যমে যে পরিবেশ দূষণ বাড়াবে সেটা মানুষ বুঝতে পারছে। খনির অধিকার কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার জন্য যে আজকের কৃষি সংস্কার কাজ করবে সেটা পরিষ্কার হচ্ছে। ব্যবসা বাণিজ্য বেনিয়া মাফিয়াদের হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে অগ্নিগর্ভ অবস্থা যা রাষ্ট্র বলের প্রয়োগ করে ছাই চাপা দিয়ে রাখছে। আপাতভাবে অবস্থা শান্ত। রাষ্ট্র নিশ্চিন্ত। কিন্তু মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের দাবি দানা বাঁধছে। দেখা যাচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ জানান না দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তরে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে।
হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে একটা খবর পড়ে পাড়ায় সবাই স্তম্ভিত উদ্বিগ্ন। ঝাড়খন্ড ছত্তিশগড় বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল ধরে মানুষ অধিকারের দাবিতে সোচ্চার। বিরাট জমায়েত। রাষ্ট্র জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু মানুষ উত্তাল। পরিবেশবিদরা পরিবেশ রক্ষার দাবিতে, মানুষ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনের অধিকারের দাবিতে রুটি রোজগারের দাবিতে কৃষি জমি অকৃষিবিভাগে স্থানান্তরিত হতে না দেওয়ার দাবিতে বিরাট বিক্ষোভ সমাবেশ। তা সামলাতে পুলিশ গুলি চালায়, ব্যাপক গ্রেপ্তার করে। জনা কুড়ি মানুষ গুলিতে মারা যায়। মারা যাওয়ার তালিকায় সুরেশ বোসের নাম দেখা যায় যার বাড়ি পশ্চিম বঙ্গে। আমাদের সরেস বাবুর নাম। আমরা জানি উনি উনার পরিবেশবিদ বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়েছেন। নামটা দেখে আমাদের সংশয় হয়। আর আমি আরেকটা নাম পাই যিনি ধরা পড়েন। একজন মহিলা সাংবাদিক যাঁর নাম রীতা । আমার মনে খটকা লাগে । ভেসে ওঠে সুহাস কাজলের নাম যাদের আমি চিনতাম। আর পরের প্রজন্মকে যেন দেখি ঝর্ণার কলতানে, পাহাড় শিখর থেকে তুষার গলে ঝর্ণা হয়ে নেমে এসে মেলে নদী মোহনায়। কাজল বেঁচে নেই সুহাসের খবর পাই না। তবে ওদের ছেলে রন্টুর সঙ্গে আমার এখনও যোগ আছে। ওদের পরিচয় এই কলমেই পাঠকরা আগে পেয়েছেন। আমি একে একে দুই করার চেষ্টা করি। মেলাবার চেষ্টা করি। কোথায় যেন একটা ধারাবাহিকতা খুঁজে পাই। সময় নষ্ট না করে সরেসবাবুর বাড়ি যাই। জানতে পারি ওর ছেলে বাবার খবর পেয়েছে। বাবার মৃতদেহ আনতে চলে গেছে ভিন প্রদেশে।
৬
বেশ কিছু সময় কেটেছে। এখন রিঙ্কু শহর থেকে দূরে মফস্বলে কোন এক আধা শহরে এক কামরা একটা ঘরে ভাড়া থাকে। এখন বয়স পঞ্চাশ উর্ধে। সঙ্গে স্ত্রী। অঞ্চলের ছেলে মেয়েদের দুজনে মিলে পড়িয়ে যে সামান্য রোজগার তা দিয়ে চলে যায়। ওদের সন্তান নেই। রিঙ্কু পরিবেশ আন্দোলন নিয়ে জড়িয়ে পড়েছে। ওকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার দরকার নেই। আমাদের পূর্ব পরিচিত সেই স্কুলে পড়া ছেলেটি। ভালো গান বাজনায়। বাবা আমাদের সুহাস আর মা কাজল দুজনেই গত হয়েছেন আমরা জানি। দিদি রীতা সাংবাদিকতার কাজেই যুক্ত। সে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। কলকাতায় থাকে। ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে মধ্যে মধ্যে আসে। রিঙ্কুও দিদির ওখানে যায়। রীতার দুই মেয়ে। তারাও এখন বড় হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত। বাবা মায়ের উত্তরাধিকার বহন করে দুজনেই চলে। সমাজের সমস্যা দেখে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। তা নিয়ে ভাবে। এ নিয়ে কি করা দরকার তা নিয়ে দাবিতে সোচ্চার হয়। রাষ্ট্রের ভুল নীতির বিরোধিতায় আন্দোলনে যুক্ত হয়। বাবা মায়ের উত্তরাধিকার বহন করলেই তাদের চিন্তাভাবনা যার যার চেতনার খাতে প্রবাহিত। সব কিছুতে মিল পাওয়া যায় না আবার মৌলিক কিছু বিষয়ে মিল আছে।আপাতদৃষ্টিতে অমিলটা প্রকট হলেও এর অন্তঃস্থলে যে মৌলিক মিল আছে তা হয়তো আগামী দিনে তাদের একই খাতে বইতে দেখা যাবে।
আজের সমাজে উগ্র শিল্পায়নের মুখে বিশেষ করে ভারতসহ সব আফ্রিকা এশিয়ার পিছিয়ে পড়া দেশগুলো যে পরিবেশ বৈচিত্র হারিয়ে জীবনের সব ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কবলে ধ্বংসের মুখে সেটা রিঙ্কুদের ভাবায়। একদিকে রুটি রোজগারের অভাব অপরদিকে পরিবেশ ধ্বংস। ভোগবাদের দরুন ভোগের লালসা এক কৃত্রিম ভোগ বিলাসী জীবন যেমন পরিবেশ দূষণের কারণ তেমনি কম জমিতে বেশি উৎপাদন রাসায়নিক শিল্পে লাভ ঘরে তোলার তাড়নায় কৃষি উৎপাদনে নয়া কৃষি প্রযুক্তি পরিবেশ দূষণ মানুষের স্বাস্থ্য দূষণ জমির অবক্ষয় ঘটিয়ে চলেছে। উন্নত আগ্রাসী দেশগুলো এর সুযোগ নিয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে শোষণ করে চলেছে। আর রাষ্ট্র এর তাবেদারী করছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করে রিন্টুরা। তারা ভাবে তাদের পূর্বসূরীরা এই দিকটা অবহেলা করে কেবল রুটি রোজগারের তাগিদকে কেন্দ্র করে শ্রেণী সংগ্রামকে দেখেছেন আর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সমাজতন্ত্রের অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা না বলে পরিবেশ আন্দোলন গড়ে তোলাকে একধরনের সৌখিন রাজনীতি বলে তুচ্ছ জ্ঞান করেছেন। কার্ল মার্কসের যুগে পরিবেশ দূষণের বিষয়টা এত ভয়ঙ্কর আকার নেয় নি বলে তা ধ্রুপদী মার্ক্সবাদে তেমন গুরুত্ব পায় নি। কিন্তু আজ অবস্থা বদলেছে। পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে পশ্চাদপদ একটা দেশকে যে ধ্বংসের কিনারে ঠেলে দিচ্ছে গরিব মানুষরাই যে প্রধানত এর ফল ভোগ করছে সেটা পরিবেশ বিরোধী আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে। আক্রান্ত দেশগুলোর রুখে দাঁড়ানো দরকার। এই পরিবেশ দূষণ অবস্থাপন্ন মানুষদের জীবনও বিপর্যস্ত করে চলেছে। মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে ভোগবাদ তাদের জীবনের প্রকৃত আনন্দ কেড়ে নিচ্ছে। আর বিষয়টার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির সুষ্ঠ ব্যবহার, সাধারণ মানুষের জীবনে তাকে নিয়ে যাওয়া আজ যে শ্রেণীর লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত সেটা বোঝা দরকার বলে রন্টুরা মনে করে। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি যেমন উৎপাদন প্রণালীতে একটা মৌলিক বদল এনেছে তেমনি মানুষের মনন প্রক্রিয়ায় জীবন ধারার পরিবর্তনে বদল আনতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আর সবটার অভিমুখ কর্পোরেট স্বার্থ তার প্রাধান্যবাদ। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য শ্রমজীবী মানুষ দেশপ্রেমিক মানুষ পরিবেশবিদদের একজোট হতে হয়। গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হয়। তিনটে খাতে বয়ে যাওয়া আন্দোলনকে একটা মোহনায় মিলতে হয়। ভারতের মাওবাদী দল অনুসৃত শুধু খতম অভিযানের মাধ্যমে শুধু সমরবাদ দিয়ে এ লড়াইয়ের সামগ্রীকতা ধরা যায় না বলে রিঙ্কুরা মনে করে। বিষয়টা নিয়ে তারা আজ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিভিন্ন মার্ক্সবাদী সংগঠনের সঙ্গে আলাপে উৎসাহী। তাদেরকেও আজ আন্দোলনের ভ্রাতৃপ্রতিম শক্তি হিসেবে পেতে চায়। তারা চরমপন্থীদের গণআন্দোলনকে পরিহার করার বিষয়টা মেনে নিতে পারে না।
রিঙ্কুর দিদি রীতার এখন যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাঁর স্বামীর সঙ্গে বিরোধটা মিটে গেছে। তারা আবার একসঙ্গে জীবন যাপন করছে। তাদের দুই মেয়ে। রীতা সাংবাদিক হিসেবে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা নিয়ে বরাবরই সরব। সাংবাদিকতার সূত্রে সে ভারতে প্রত্যন্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করে। বিশেষ করে ছত্তিশগড় ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা উত্তর কর্নাটকের বিভিন্ন খনিজ অঞ্চল তার ঘোরা। সেখানে আদিবাসী দলিত মানুষের দুরবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। আজ ভূমি সন্তানদের উৎখাত করে খনিজ সম্পদের ওপর অধিকার কায়েম করতে দেশি বিদেশি কর্পোরেট সংস্থা কেমন তৎপর সে সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল। সেখানকার মানুষের এই আক্রমণের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই নিয়ে লেখালেখি করে বলে সে রাষ্ট্রের কুনজরে। দু একবার গ্রেপ্তার হয়। ভারতের ধর্ম বর্ণ নিয়ে যে বিভাজন আর রাষ্ট্র তাকে কিভাবে ব্যবহার করে সেটা সে দেখেছে। রুটি রোজগারের লড়াইয়ের সঙ্গে এই দলিত সমাজ আদিবাসী সমাজের সমস্যাকে একটা সূত্রে কিভাবে বাঁধা যায় সেটা নিয়ে সে ভাবে। এর সঙ্গে নয়াউদারনীতিবাদ কিভাবে কর্পোরেট দুনিয়ার এই লুঠের রাজকে আজ ভয়ঙ্কর করে তুলেছে তা সে প্রত্যক্ষ করে। সেখানে যে লড়াই চলছে সেখানে ধ্রুপদী মার্কসবাদের তাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারতের বিশেষ প্রেক্ষাপটে বিচার করার বিষয়টায় ঘাটতি রয়ে গেছে বলে রীতারা মনে করে। এর সঙ্গে সমাজের মননের পরিবর্তন দরকার। মানুষকে আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে ভোগবাদ বর্জন করে গরিবমানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। সেটা বিপ্লবএর পর দেখা যাবে বলে এড়িয়ে গেলে এ লড়াই সামগ্রীকতায় দানা বাঁধতে পারে না বলে রীতারা মনে করে। এর জন্য বস্তুভিত্তিক লড়াইয়ের সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক লড়াইকে যুক্ত করতে হয় বলে তারা মনে করে। গড়ে তুলতে হয় বর্ণ ধর্মকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্র অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে লড়াই।
রীতার বড় মেয়ে আবার ভারতে মাওবাদী দলের সমর্থক। মধ্যে মধ্যে মাওবাদী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে ওর যাতায়াত। ও রিঙ্কুর ভাবনাকে কটাক্ষ করে। ওর গণআন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে রাখাকে সংস্কারবাদী সুবিধাবাদী বলে হেয় করে। আবার রিঙ্কু ওকে সমরবাদী হটকারী রাজনীতির প্রবক্তা বলে। দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ তর্কবিতর্ক। আবার দুজনেই রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়ে। যেমন পশ্চিমবঙ্গে লালগড় নন্দীগ্রামের আন্দোলনে দুজনে একসঙ্গে অংশগ্রহণ করে। দুজনের মধ্যে একত্রিত হওয়ার আগ্রহ থাকলেও একজনের পার্টি লাইন আর আরেকজনের পার্টিবিহীন গণআন্দোলনের ধারণা দুজনকে মিলতে দেয় না। কিন্তু আন্দোলন ও তার সাফল্য ব্যর্থতা দুজনকেই কি ভাবে একত্রিত হওয়া যায় সেই ভাবনায় ভাবিত করে। রীতার মেয়ে কঙ্কা মুখে যাই বলুক গণআন্দোলনকে অস্বীকার করতে পারে না। পরিবেশের প্রশ্নটাও আজ সামনে এসে পড়ে। এছাড়া আছে ভারতের অর্থনীতিতে সমাজজীবনে কর্পোরেট সংস্থার প্রধান্যবাদের প্রশ্নটা।
তার বড় মেয়ে কঙ্কাকে নিয়ে রীতার নানা চিন্তা। ও ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু সুব্রতর প্রেমে পড়েছে। সুব্রত পড়াশুনা ছেড়ে বিপ্লবী কাজকেই নিজের জীবন বলে গ্রহণ করেছে। বাড়ী ঘর ছাড়া পলাতক জীবন। পুলিশ খুঁজে বেড়ায়। ওদের দুজনের গোপন যোগাযোগ আছে যার সবটা নাগাল পায় না রীতা। আদর্শের দিক থেকে সুব্রত শ্রদ্ধার পাত্র হলেও রীতার ভয়। ও দেখেছে বিপ্লবী আন্দোলনে যখন ভাঁটার টান তখন অনেক বিপ্লবী হতাশায় নিমজ্জিত হয় গোপন জীবন থেকে বেরিয়ে এসে হতাশায় ভোগে। পড়াশুনা শেষ হয় নি আবার বেরিয়ে চাকরি নেই এই অবস্থায় কেউ যেন নিজেকে দায় বলে মনে করে। কঠিন বাস্তবের মোকাবিলা করতে পারে না। তখন তার মনে হয় ভুল করেছে কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। যেন না ঘরকা না ঘাটকা। আবার অনেকে গোপন জীবনযাপন করলেও নিজে এই ব্যবস্থার কুপ্রথাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করে বেরিয়ে আসতে পারে না। এদের অনেকের মধ্যে অসংযত বেপরোয়া জীবন যাপনের ধরণ দেখা যায়। ছেলেদের মধ্যে পুরুষতন্ত্র কাজ করে। এটা রীতা আদিবাসী সমাজে গরিব মানুষের মধ্যেও দেখেছে যেখানে মেয়েরা জীবিকার জন্য মাঠে কলে কারখানায় কাজ করে। আর এটা মধ্যবিত্ত শহরে ছেলেদের মধ্যে দেখা যায়। পার্টি জীবনের সুস্থ জীবনযাপনের অনুশীলনের অভাবে এটা ব্যাপক। এর ফলে মুখে বিপ্লবী হলেও নারীপুরুষের সম্পর্কে ব্যাপারে তার ঘাটতি দেখা যায়। পরস্পর সহনশীলতা শ্রদ্ধার অভাবের জন্য সম্পর্কটা অনেকের ক্ষেত্রে ভঙ্গুর হয়। এর ফলে সম্পর্কটা বেশিদিন টেকে না। রীতার কাছে এটা চিন্তার। সুব্রতকে আদর্শ ছেলে মনে হলেও ভবিষ্যতে কি হবে তা নিয়ে রীতার দুশ্চিন্তা। সে মনে করে এই সমস্যা সমাধানের উপায় ব্যক্তিজীবনে নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। যাই হোক নিশ্চয়তার পূর্বশর্ত দিয়ে কোন সম্পর্ক গড়া যায় না সেটা রীতা বোঝে। তাও তার ভেতর দ্বন্দ্ব। অবশ্য বাবা মায়ের মধ্যেকার আদর্শ সম্পর্কটা তাদের বিপ্লবী জীবনে ভাঁটা আর জোয়ারেও কিরকম অটুট ছিল সেটাও রীতা দেখেছে।
ভারতে এখন একটা চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায়। দেশের মধ্যে তারা ঘোর হিন্দুত্ববাদী। মুসলমান বিদ্বেষী। আবার মুসলমান সমাজের মৌলবাদীদের মুসলমান সমাজে কর্তৃত্ব। তাই ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজিত রাখার কাজকর্ম ভয়ঙ্কর মাত্রা পেয়েছে যা আবার ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের শর্ত তৈরি না করে! আবার বর্ণবাদ দেশকে ক্ষত বিক্ষত করে রেখেছে। গরিব নিম্ন বর্ণের মানুষ এর শিকার। গরিব বড়লোকের মধ্যে শ্রেণীবিভাজন ছাড়াও ধর্ম বর্ণে মানুষে মানুষে বিভাজনটা ভারতে শ্রেনিযুদ্ধকে জটিল এক রূপ দিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বায়নের কর্মসূচিকে কার্যকরী করতে তাকে ত্বরান্তিত করতে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক স্তরে বৃহৎ শক্তির কাছে দায় বদ্ধ। সেজন্যই সরকার আজ করোনা কালকে সামনে রেখে তার আড়ালে তথাকথিত সংস্কারের কাজকে ত্বরান্বিত করে চলেছে। বেসরকারিকরণ সরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিল্প ব্যাংক ইন্সুরেন্স খনি শিক্ষা স্বাস্থ্য সবই বেসরকারি হাতে বিকিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি সংস্থার অনুপ্রবেশ অবাধ হয়েছে। বিদেশি পুঁজি অবাধে ঢুকে চলেছে। এর সংগে ভোগবাদের অবাধ বিস্তৃতি। ইতিমধ্যে শ্রম আইন বদল হয়েছে নতুন কৃষিআইন ঘোষিত হয়েছে যা নিয়ে কৃষক আন্দোলন ছমাস ধরে অব্যাহত। সব মিলিয়ে অবস্থা জটিল। অথচ সত্যিকারের বাম আন্দোলন বহুদা বিভক্ত। একটা চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে আর্থ সামাজিক জীবনে।
এই সংকটের মধ্যে রিঙ্কুরা নেমেছে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে। রাষ্ট্রের কড়া নজর যেন এই আন্দোলন সমাজতন্ত্র লড়াইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে কোনরকমে যুক্ত না হতে পারে। অথচ শেষ বিচারে এই আন্দোলনের সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়াটা যেন আজ পৃথিবীজুড়ে একটা অনিবার্যতা হয়ে দাঁড়াতে চলেছে যা সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকে একটা ভিন্ন মাত্রা দেয়। পরিবেশের আন্দোলন দাবি জানায় প্রযুক্তির উন্নতিকে সঠিকখাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়া যাতে পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়নের ফসল সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এটা আর কিছু সৌখিন মানুষের সখের আন্দোলন থাকতে পারে না। এই আন্দোলন নয়া উদারনীতিবাদকে অস্বীকার করে শেষ বিচারে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দেশপ্রেমের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা দেশের সম্পদ লুঠের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন। যেখানে বৃহত্তর বামআন্দোলন নতুন ভাবে বৃহত্তর জোটের মাধ্যমে গড়ে ওঠার শর্ত তৈরী হয়েছে। তাই পরিবেশ আন্দোলনকে কর্পোরেট দুনিয়া আজ কুনজরে দেখছে। তাদের ওপরও রাষ্ট্রের বল প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ এক বিপত্তি আজ সারা বিশ্বজুড়ে। করোনার আক্রমণ। মানুষের আর্থসামাজিক জীবন তছনছ করে দিয়েছে এই রোগ। এই সংকটকালে কর্পোরেট দুনিয়া ফায়দা তুলে চলেছে। লকডাউন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিদান। সমাজ জীবনে এক বিচ্ছিন্নতার আবহ তৈরী হয়েছে, পারস্পরিক অস্পৃশ্যতা অথচ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে হাতে গোনা ব্যবস্থা। অসংখ্য রুগী। বেসরকারি হাসপাতাল নার্সিং হোম হয়ে উঠেছে লুঠেরার রাজত্ব। আর রাষ্ট্র নিয়ে চলেছে একের পরে এক সংস্কার কর্মসূচী। সরকারি সংস্থা বিক্রি করে দিচ্ছে। খুচরো বাজার থেকে জল জমি জঙ্গল কৃষি সবক্ষেত্রে বেসরকারি বিশেষ করে বিদেশি সংস্থার অবাধ লুঠের অধিকার স্বীকৃত। কৃষি সংস্কারের নামে কৃষি জমি থেকে ফসল, ফসল নিয়ে ব্যবসা সবেতেই কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য স্থাপিত হয়ে চলেছে। প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে কর্পোরেট দুনিয়ার আধিপত্য। ছোট ছোট ব্যবসায়ী উৎপাদকদের কর্পোরেটদের দাস বানানো হচ্ছে। উঠে যাচ্ছে ছোট ব্যবসায়ীদের দিন মজুরদের ন্যূনতম জীবন যাপনের সুযোগ। এরই মধ্যে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্থান। গ্রামীন স্বার্থ গোষ্ঠীর সাথে শিল্প কর্পোরেট স্বার্থ গোষ্ঠীর বিরোধ। রাষ্ট্র কর্পোরেট স্বার্থ গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে গরিব মানুষের জীবিকা দেশের স্বার্থ যা আজের পুঁজিবাদের প্রবক্তা নয়াউদারনীতিবিদরা অস্বীকার করে।
রন্টুরা ভাবে এটাই সময়। সব আন্দোলনকে একটা ধারায় বইয়ে দেওয়ার সময়। সবার জন্যই এই সংঘর্ষের ময়দান আজ এক মহামিলন প্রাঙ্গণ। তবে রাষ্ট্রের আক্রমণ আর শুধু মাওবাদীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ও ভাবে দিদির মেয়ে কঙ্কা কি ভাবছে। ওর তো পাত্তা নেই। সেই যে গেছে! আজকাল বাড়িতে ফেরে না। রিঙ্কু খুব চিন্তিত। এই সেদিন সেনাবাহিনীর সঙ্গে এনকউন্টারে কয়েকজন মারা গেছে। সুব্রত ধরা পড়ে জেলে। কঙ্কার কথা ভেবে ও বিমর্ষ হয়ে পড়ে। ভাবে কি জানি কঙ্কার কি হয়? ও ভাবতে পারে না যে আজ নয় কাল নিজেও ও একই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে।
ভারতের কৃষক আন্দোলন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সারা ভারতে তা ছড়িয়ে পড়েছে। শ্রেণীসংগ্রামে যুক্ত বামপন্থী দলগুলো পরিবেশবিদ দেশপ্রেমিক শক্তিগুলো একজোট হয়ে একে সমর্থন জানাচ্ছে। এটা এক ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ পেয়েছে। এটা সত্যি যে এর নেতৃত্বে দিচ্ছে বড় বড় জমির মালিক এমনকি গ্রামীন ফসল ব্যবসায়ী মধ্যসত্ত্বাভোগীরা। কিন্তু এর অভিমুখ যেহেতু বিশ্বের বড় বড় কর্পোরেট সংস্থা, কর্পোরেট মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবসায়ী আর তাদের তাবেদার ভারত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তাই তা এত ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছে। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানুষজনের কাছে একে সমর্থন করা বলতে গেলে বাধ্যবাধকতা। আর বামপন্থীদের এই সুযোগে সংগঠন গড়ে তুলে নেতৃত্ব দিতে তৈরি থাকা দরকার। এই ভাবনা থেকে রিঙ্কুরা এই আন্দোলনের সমর্থক হয়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গে একে কেন্দ্র করে যে মঞ্চ গড়ে ওঠে তার সঙ্গে থেকে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এদের উদ্দেশ্য। একই সঙ্গে আজ রাষ্ট্র যে কি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সেটা উন্মোচিত হয় পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনের ময়দানে গরিব মানুষদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালনার ঘটনায়। আর এর সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপটা ধরা পড়ে।
একদিকে নির্বাচন অন্যদিকে তারই মধ্যে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে সমাবেশের ডাক। জমায়েতে খুব ভালো সারা। কেন্দ্রীয় বাহিনী রুট মার্চ করছে। তারা এই অবস্থায় জমায়েতের বিরোধিতা করে। বাধা দিতে থাকে। এই নিয়ে কথা কাটাকাটি। জমায়েতে রন্টুরা আছে। বাধাকে উপেক্ষা করে বক্তব্য রাখা শুরু হয়। আধাবাহিনী একটু একটু করে আগ্রাসন বাড়াতে থাকে। লাঠি চার্জ দিয়ে নিষ্ক্রিয় মৌখিক বাধাকে সক্রিয় সরব করে তোলা হয়। জনতা প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু হয়। বাহিনী কাঁদুনে গ্যাস ছোড়া শুরু করে। জনতা কিছুটা ছত্র ভঙ্গ হতে থাকে। কেউ কেউ সে গ্যাসের বুলেট ধরে তা পাল্টা জোয়ানদের দিকে নিক্ষেপ করে। নিরস্ত্র জনতার সঙ্গে সশস্ত্র রক্ষীবাহিনীর এক অসম পথযুদ্ধ। যে কোন আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই অসম যুদ্ধের সাক্ষী আমাদের প্রতিটি রাজপথ দেশের আনাচে কানাচে সেই সুদূর অতীত থেকে বিশেষ করে ব্রিটিশ আমল থেকে। গত শতাব্দীর ষাট সত্তর দশকে এটা নিয়মিত হত। অনেকদিন পর আবার। যাদের অভিজ্ঞতা আছে তারা জানে এরপর কি অপেক্ষা করছে। তাই ঘটনা পরম্পরায় ঘটল। বাহিনী এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। গুলিতে মারা যায় চারজন। আহত অনেকে। রিঙ্কুর মত কয়েকজন ধরা পড়ে। খুব দ্রুত খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। তার সঙ্গে কিছু যোগ হয়ে সরকারি প্রতিবেদনে যা দাঁড়ায় তা হলো:
৫ ই এপ্রিল ২০২১ সালে এক অবৈধ সশস্ত্র জমায়েতকে সৈন্যবাহিনী শান্তিপূর্ণভাবে নিরস্ত্র করতে চেষ্টা করে। কিন্তু অবাধ্য জনতা মারমূখী হয়ে ওঠে। গুলি চালায়। আত্মরক্ষায় আধাসেনা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়। গুলিতে জনা চারেক মারা যায়। আধাসেনামাহিনীর সাত আটজন গুরুতর আহত।
এ হল সেই পরিচিত বয়ান। পুলিশ হেফাজত থেকে বের করে গুলি করে মারা হোক আর জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে গুলি করে মারা হোক। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির এদিক ওদিক হয় না। গতে বাঁধা পুলিশ মিলিটারি জনতার আচরণ আর সাংবাদ মাধ্যমে খবর।
রিঙ্কু থানার লক আপ হয়ে গেল জেল হাজতে। জেলে বসে ওর কঙ্কার কথা মনে পড়ে। ও একদিন তর্ক শেষে বলেছিল:
দেখ রিঙ্কু পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনে যতই নিশ্চিন্ত থাক সশস্ত্র লড়াইয়ের পথে না গিয়ে যতই গণতন্ত্র অহিংসার মহিমা কীর্তন করিস না কেন রাষ্ট্র কিছুদিন সেটা মেনে নিলেও যখন নিজের আঁতে ঘা লাগবে তখন কিন্তু সহ্য করবে না। রাষ্ট্রের সন্ত্রাস থেকে কেউ বাদ পড়বে না।
রিঙ্কু ভাগ্নি কঙ্কাকে আজ অস্বীকার করতে পারে না। তাই বলে গেরিলা লড়াই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একমাত্র পথ সেটা সে আজও মেনে নিতে পারে না। সে যে এমন হতে পারে ভাবে নি তা নয়। তবে গণআন্দোলন ছেড়ে গেলে জনগণকে সক্রিয় প্রতিরোধে সামিল করা যায় না। তাদের সঙ্গে না নিয়ে যুদ্ধে এগোন যায় না। আর গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবহার করার সুযোগটা নেওয়া চলে। আজ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকেজো করে সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে রাষ্ট্রের কাজ করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বাড়ছে। সেটা ফ্যাসিসম। ফ্যাসিবাদকে রুখতে ব্যাপক মানুষকে সক্রিয় করে এ যুদ্ধে সামিল করা বিপ্লবের অঙ্গ। এতে মানুষ বাস্তব থেকে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। জনমত তৈরী হয়। মিথ্যে প্রচারের মোকাবিলা করা যায়। তাই লড়াইয়ের অন্যান্য রূপগুলোকে বুঝে নিতে হয় তার সুযোগ নিতে হয়। তবে শেষ বিচারে শ্রেণী লড়াইটা নির্ধারক যার সঙ্গে অন্য লড়াইগুলোকে মেলাতে হয়।
প্রতি রবিবারের মত রিঙ্কুর স্ত্রী আর রীতাও সাক্ষাৎ নিতে আসে ঠিক বিকেল চারটেতে। জালের এপার আর ওপার। দুপক্ষের মধ্যে কথোপকথন। আজও ওরা এসেছে। নানা কথার ফাঁকে রীতা একটা কাগজ রিঙ্কুর হাতে গুঁজে দেয়। কিছুক্ষণ কথা বলে আজকের মত সাক্ষাৎকার শেষ। রীতারা বিদায় নেয় আর রিঙ্কু ওয়ার্ডে ফেরে। ওর মন ছটপট করছে রীতার দেওয়া কাগজটায় কি আছে দেখার জন্য। কে কি লিখলো। কিন্তু তার জন্য নিরালা চাই।
ওয়ার্ডে ফিরে সবার সঙ্গে চা খেয়ে রিঙ্কু প্রলয়কে নিয়ে একটু আলাদা হয়ে বসে। প্রলয় ওর লড়াইয়ের সাথী। একসঙ্গে ধরা পড়েছে। ওর সঙ্গে কোন গোপনীয়তা থাকে না। কাগজটা খুলে দেখে একটা চিঠি। কঙ্কার লেখা। রিঙ্কুর উৎসাহে উগ্রতা বাড়ে। সে চিঠিটা পড়তে থাকে একটু জোরে যেন প্রলয় শুনতে পায়। কঙ্কা লিখেছে:
প্রিয় মামা,
জানলাম তুমি ধরা পড়েছ। জল্লাদদের গুলিতে চারজন সাথীকে হারিয়েছ। এটা আমাদের এখানে আজ প্রায় রোজের ঘটনা। জানোনা হয়তো আমিও বেশ কিছুদিন হল তোমার থেকে অনেক দূরে রাইপুর জেলে বন্দী। মা মাত্র জেনেছে। দুদিন আগে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছে। সেই সুযোগে আমি চিঠিটা পাঠাচ্ছি। তোমাকে অনেক কিছু বলার ছিল। এখানে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের এমন কিছু শিখতে সাহায্য করেছে যা নিয়ে আমাদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক হত। আমার ধারণা আমাদের এই অভিজ্ঞতা আর আজের লড়াইয়ে তোমার অভিজ্ঞতা ভাবনার জগতে আমাদের কাছে টানতে সাহায্য করবে। আমাদের লড়াইয়ে একে অপরের সাথী হতে পারব। তাই এই চিঠি লেখার তাগিদ।
আমরা আজ গণআন্দোলনের গুরুত্বটা আরও বেশি করে বুঝছি। গণ আন্দোলন আমরা চাই বা না চাই মানুষ চালিয়ে যায় কারণ তাদের অভিজ্ঞতাই গণআন্দোলনের প্রয়োজন তাদের বুঝিয়েছে। তবে গণআন্দোলনকে সশস্ত্র লড়াইয়ের পরিপূরক হিসেবে দেখতে হয়। অস্ত্র সমর্পণ করে গণ আন্দোলন দিশা হারায়। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চক্রজালে জড়িয়ে যায়। এর থেকে শিক্ষা এই যে গেরিলাযুদ্ধ সশস্ত্র লড়াইয়ের একমাত্র রূপ নয়। বিশেষ অবস্থায় তা সর্বোচ্চ রূপ হতে পারে। সে নিয়েও পরীক্ষা নিরীক্ষা দরকার। আর আজকের নয়াউদার্নীতিবাদের যুগে পুঁজিবাদের যে কদর্য রূপ তার বিরুদ্ধে তোমাদের মত পরিবেশবিদরা যেমন লড়ছে তেমনি দেশপ্রেমিক শক্তিও লড়ছে। সেটাকে সন্মান দেওয়া উচিত যেটা আমরা দিই নি। তারাও তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝবে এ লড়াইকে কোন খাতে বইয়ে নিয়ে যেতে হয়। সমাজতন্ত্র গঠনের সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? এর সঙ্গে ভোগবাদের সমস্যা আছে যেটার বিরুদ্ধে লড়তে গেলে নিজের ব্যক্তি স্বার্থের বিরুদ্ধে লড়তে হয় যেটা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অঙ্গ। এ ছাড়া আছে রুটি রোজগারের লড়াই যেটা কলে কারখানায় ক্ষেত খামারে আবহমানকাল ধরে মানুষের লড়াই। সেখানে গণআন্দোলনের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। আজ প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশের দরুন উৎপাদন প্রণালীতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিল্প কাঠামো বদলেছে। দৈহিক শ্রমের ওপর এই প্রযুক্তির প্রভাবটা বিশেষ অনুধাবনের বিষয়।এটা লড়াইয়ের পথ নির্ধারণে কি ভূমিকা পালন করে সেটা ভেবে দেখতে হয়। এই প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের মননে এক অবিশ্বাস্য প্রভাব ফেলছে। আর এর অপব্যবহার সমাজের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তথাকথিত সভ্যতাকে বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। একই সঙ্গে ভোগবাদকে মদত করছে। সমাজের অসম বন্টন জীবন জীবিকামর সুযোগে কুঠারাঘাত করছে। ফলে বিত্তশালী অনেকেও এর বিরুদ্ধে লড়াইটা চাইছে। সেদিক থেকে লড়াইয়ের ফ্রন্ট ব্যাপকতা লাভ করছে। শ্রেণীর লড়াইয়ের সাথে একে কিভাবে যুক্ত করা যায় সেটা ভাবা দরকার। এই উদ্ভূত প্রশ্নগুলোর সঠিক সমাধানের ওপর আগামীদিনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের শর্ত নির্ভর করছে। লড়াই ত্যাগ করে নয় আরো তাকে আঁকড়ে ধরে সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব বলে মনে হয়। এছাড়া নেতৃত্বের প্রতি নিঃস্বর্ত আনুগত্য বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না। এর থেকে এক ধরণের স্বেচ্ছাচারিতাকে মদত দেওয়া হয়। নেতৃত্ব ভুল করলে সেটা তুলে ধরার সুযোগ পার্টির মধ্যে থাকে না। কেন্দ্রিকতার ঝোঁক বাড়ে। পার্টির ওপরের তলার সঙ্গে নিচের তলার দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটা অস্বীকৃত হয়।
সবশেষে আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক একটা শিক্ষা তুলে ধরছি যার সমাধান খুব কঠিন অথচ একটা গোপন বেআইনি দলের পক্ষে খুব জরুরি। প্রথমেই বলি সুব্রতর সংগে আমার আর পুরোন সম্পর্কটা নেই। রাজনৈতিক জীবনে ওর ত্যাগ স্বীকারকে শ্রদ্ধা জানিয়েও বলছি ব্যক্তিজীবনে ওর ভাবনা আর কাজকে আমি ঠিক বলে মনে করি না বলে আজ আমাকে ওর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অস্বীকার করতে হচ্ছে। ওর আচার ব্যবহারে আমার মনে হয়েছে মননের দিক থেকে পুরুষতন্ত্রের ছায়া যা ওর মধ্যে আমি দেখি। দুজনের পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা আর দায়বদ্ধতা দুজনের মধ্যে সম্পর্কের বন্ধনটা বজায় রাখতে পারে। তাছাড়া পার্টিকে না জানিয়ে আমাকে না জানিয়ে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের একটা প্রবণতা ওর মধ্যে। এর থেকে আমার মনে হয়েছে বিপ্লবী কর্মীদের নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াইটা একটা বিরামহীন সংগ্রাম।আত্মলালসা আত্মস্বার্থ ত্যাগ করতে না পারলে বিপ্লবী থাকা যায় না। যাক সেটা নিয়ে দেখা হলে কথা হবে। ভালো থাকিস। একদিন মুক্ত আকাশের নীচে দেখা হবে।
রিঙ্কুর মনে হল কয়েকদিনের মধ্যে এই সেদিনের কঙ্কা কত বড় হয়ে গেছে। ওর চিন্তা ভাবনা এখন অনেক পরিণত। ও যে শুধু নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললো তা নয় রিংকুকেও তার অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে সাহায্য করল। ওর দাদু সুহাসবাবু দিদা কাজল আর মা রীতার অভিজ্ঞতা যেন তৃতীয় প্রজন্মে মিলে এক নতুন দিশা হয়ে উঠেছে যা এ লড়াইয়ের বহমানতা। একই সূত্রে গাঁথা।
আজের সে দিনটা
রোজের মত আজও পদ্মা ভোর পাঁচটায় উঠে সংসারের কাজে লেগে পড়েছে। সংসার বলতে নীলমনি তাদের ছেলে কনক ওরফে বিশু আর সে। নীলমনি সকাল আটটার মধ্যে অফিস বেরিয়ে যায়। তারপর ছেলের স্কুল। ও দশটায় স্কুলে রওনা দেয়। রান্না ছাড়াও সংসারের সব কাজ পদ্মা নিজেই করে। তিনজন লোক হলেও সংসারের কাজ কম নয়। আজ কাজ সারতে গিয়ে পদ্মা যেন প্রতিটি পদে বাধা পাচ্ছে। বাধাটা ওর ভেতর থেকেই। সমস্ত পৃথিবীটা যেন মাথায় ভিড় করেছে। ওর কাছে পৃথিবীটা তেমন বড় নয়। ও বছর খানেক আগে থেকে নীলমনির সঙ্গে যে জুটি বেঁধেছে তারপর থেকে এক বছরের ঝোড়ো সংসারটাই আজ তার পৃথিবী। সেটা তার মাথায়। তবে এই ছোট মাথায় তার আগের সংক্ষিপ্ত একটা জীবন প্রায়ই ফিরে আসে। সে জীবনটা তাকে কখনও সুখস্মৃতিতে ভরিয়ে তোলে আবার সে স্মৃতি তাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। সেটা ছিল তার আগের পৃথিবী।
খাওয়াদাওয়ার পর নীলমনি যখন একগ্লাস জল খেয়ে বেরোবে তখন জলটা এগিয়ে দিতে গিয়ে পদ্মার হাত থেকে পরে কাঁচের গ্লাসটা ভেঙ্গে যায়। সে যেন আঁতকে ওঠে। স্বগতোক্তি করে ওঠে :
— — এ কি করলাম আমি ! বেরোবার আগে এ কি অলুক্ষণে কাজ আমার। স্বগতোক্তি হলেও তা নীলমনির শোনার পক্ষে যথেষ্ট কারণ কোথাও বেরোবার মুহূর্তে ওর সবটাই মনোযোগ থাকে পদ্মার ওপর আর পদ্মাও ওর খুব কাছাকাছি এসে পড়ে।
— — — এসব কি বলছ? এ তো সবার ক্ষেত্রেই যখন তখন হতে পারে। এই বলে নীলমনি নিচু হয়ে কাঁচগুলো সরিয়ে নিয়ে পরিষ্কার করতে যায়। পদ্মা বলে :
— — -যাও তোমার অফিসে দেরী হয়ে যাবে। সাবধানে যাবে। নীলমনি পদ্মার চিবুক্ ধরে আদর করে বলে :
— — — মনে কুসংস্কার রেখো না। আজকের দিনটা মনে আছে? একটা বিশেষ দিন তোমার। পদ্মা দিনক্ষণ মনে রাখে না। কাজের মধ্যে কটা দিন কিভাবে গেল, কবে কোন দিন কত তারিখ তার হিসেব সব সময় থাকে না । আর ওর আবার বিশেষ দিন কি !
ও উত্তর দিতে পারে না দেখে নীলমনি বলে:
— — — আজ সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ। আমি চললাম। ফিরে এসে জানব দিনটা খুঁজে পেয়েছ কিনা। সাবধানে থেক।
নীলমনি বেরিয়ে যায়। পদ্মা সব ভুলে আজের দিনটার বৈশিষ্ট্য কি তা খুঁজে বেড়ায়। পৃথিবীটা তার মাথায় সূর্যকে প্রদক্ষিন করতে থাকে। তোলপার হয়ে যায়। ওর জন্মদিন কোনদিন পালিত হয়নি। ও জানে না সেটা। বিয়ের দিন ? সেটাই বা নিদৃষ্ট করে বলে কি করে? যেটা ও জানে তাতে তো নীলমনির কিছু আসে যায় না । সে সেটা জানে না। তবে কি বললো ! ছেলে তো বড়। ১৪ই সেপ্টেম্বর কি বিশেষ দিন ? ছেলের জন্মদিন নয়ত ? ছেলে কি বলতে পারে ? ছেলে পাশের ঘরে পড়ছে। ওকে জিজ্ঞাসা করা যাক। পদ্মা ছেলের কাছে যায় ।
— — — বিশু, তোর জন্মদিনটা কবে বলত ?
— — — সে আবার কি ? আমার জন্মদিন নিয়ে আবার চিন্তা কেন ? স্কুলে দেওয়া একটা দিন আছে। সেটা তো বসিয়ে দেওয়া দিন। কোনদিন পালন হয় না। আজ কেন?
— — — তোর কাকু বলে গেল আজ একটা বিশেষ দিন। তবে সেটা কি ? বিশুর মন তোলপার হতে থাকে। মায়ের আবার বিশেষ দিন কি থাকতে পারে ? এও এক অদ্ভূত ব্যাপার। আমার মায়েদের মত মেয়েদের আবার বিশেষ দিন ! সে ভাবে কাকু বোধহয় ঠাট্টা করছে। সে মাকে হেসে বলে:
— — — তুমি মনে করার চেষ্টা কর। মনে আসবে।
— — — কি জানি কি বলিস তোরা ?
পদ্মা ফিরে আসে তার দৈনিক রুটিনে। ছেলে বিশুর মাথায় এখন পদ্মার পৃথিবী। সে একটা বিশেষ দিন মনে মনে খুঁজে বেড়ায়। গত বছর এরকম একটা দিন ছিল তার মায়ের বিশেষ সুন্দরতম দিন যেদিন মা মানবী বলে স্বীকৃতি পায় আবার এই দিনেই কারও কারও কাছ থেকে সে চূড়ান্ত অসন্মানিত হয়। নিজের জীবনেও সে আলোর পথ দেখে। তবে সেটা তো সেপ্টেম্বর মাস ছিল না। তবে কি? নানা চিন্তা ভাবনা তাকে আলোড়িত করতে থাকে।
ছেলে স্কুলে গেলে পদ্মা স্নান খাওয়া করে। এরই মধ্যে ঘর পরিষ্কার কাপড় কাঁচার কাজ সারে। খেয়ে নিয়ে আবার বাসন মেজে সে ঘরে আসে। এটাই তার বিশ্রামের সময়। কোন কাজ নেই সারা দুপুর । তবে গায়ে গতরে কাজ না থাকলেও মাথার কাজটা বেড়ে যায়। তার মাথাটা পেছন ফিরে সারা পৃথিবীটা খুঁজে বেড়ায়। আজ বিশেষ দিনটা তাকে পীড়া দিচ্ছে ! সুখের না দু:খের ! সে হাতরে বেড়ায় তার অতীতকে । কখনও তার শৈশব কখনও যৌবন আবার কখনও বর্তমান তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আজ তার স্মৃতি খুঁজে নিয়েছে নীলমনির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারকে বিশেষ দিন বলে। সেই ফুটপাতে তার জীবনে নীলমনির প্রবেশ। তার হাত ধরে নতুন জীবন। নীলমনি ভবানীপুরে রাস্তার ধারে ফুটপাতের বাচ্চাদের পড়াত। কাছেই একটা বস্তিতে পদ্মাদের বাস। ছেলের বয়স তখন বছর ছয় কি সাত। ওদের বেশ চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন ওর বাবা কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। সে রিক্সা চালাত। যা হোক করে সংসার চলত। স্বামী চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পদ্মার শুরু হয় সেই অসহনীয় জীবন। ছেলের পড়া পরের কথা তাদের দুবেলা খাবার জোটানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।। এর মধ্যে ফুটপাতের স্কুলের. খবর পেয়ে ছেলেকে নিয়ে আসে নীলমনির কাছে। সেই সাক্ষাৎকার তাকে যেন নতুন দিনের সন্ধান দেয়। তবে সেটা তো জ্যৈষ্ঠের দুপুর। কেমন করে সেপ্টেম্বর হবে!
স্মৃতির এই সূত্র ধরে পদ্মা তার অতীতে ফিরে যায়। নীলমনির সান্নিধ্যে ছেলে পড়াশুনায় মন দেয়। নীলমনির ধারণা ছেলেটি বেশ মেধাবী। কিছুদিন ফুটপাতের স্কুলে পড়া শেষ হলে ওকে একটা সরকারী স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে। সে-ই খরচ বহন করতে থাকে। ছেলের পড়াশুনোর যাবতীয় দায়িত্ব নেয়। তখন থেকেই পদ্মার সঙ্গে নীলমনির যোগাযোগ। সে নীলমনির সাহায্যকে অনুগ্রহ বলেই গ্রহণ করে। অনুগ্রহ আর কৃতজ্ঞতার নাগপাশেই প্রথম প্রথম সেটা বন্দী থাকে। সে এক রঙীন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তার বিশু লেখাপড়া করে বড় হবে, চাকরি করবে তাদের অভাবের আকাশে সুখের চাঁদ উঠবে। সেটা ঘটবে নীলমনির আশীর্ব্বাদে। সাক্ষাত ভগবানের আশীর্ব্বাদ। যখন-ই পদ্মা নীলমনিকে সাক্ষাত ভগবান বলে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেছে তখন-ই সে বকা খেয়েছে। এই বকাটা-ই তার শরীরে শিহরণ জাগাতো। কোন এক নতুন সম্পর্কের ছোঁয়া সে অনুভব করত। তাও সে এই সম্পর্ককে অনুগ্রহের সম্পর্কের বেশি কিছু ভাবতে পারে না। তার সামাজিক অবস্থান তাকে অনুশাসনে রাখত। আজ এই সামাজিক অনুশাসন আলগা হয়েছে। অনুগ্রহের বাইরের সম্পর্কটাতে যে মান অভিমান রাগ বিরাগ সোহাগ ভালবাসার সম্পর্ক তা স্পর্শ করে পদ্মাকে। সে যেন ফিরে পায় তার অতীতকে।
নীলমনির হাত ধরে পদ্মা এখানে একটি নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সারাদিন এ বাড়ি সে বাড়ি কাজের মধ্যেও সে মেয়েদের মধ্যে কাজ করতে থাকে। ছেলেকে কেন্দ্র করে যে অনুগ্রহের সম্পর্কের সূত্রপাত হয় তার অনুগ্রহের দিকটা আসতে আসতে ঢিলে হয়। নীলমনি তাতে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। পদ্মার নিজের অজান্তেই তার আর নীলমনির আজকের এই সম্পর্ক সেদিন গড়ে ওঠে যা তখন সুপ্ত ছিল। এখনও এই সম্পর্ককে পদ্মা একধরনের অনুগ্রহ বলে একেবারে যে ভাবে না তা নয়। তবে সেই অনুগ্রহের সঙ্গে আজ যেন কিসের মিশ্রণ যা তাকে একটা নিজস্ব সত্তা দিয়েছে। সেখানে একটা সম্মানবোধ, স্বাধিকার বোধ কাজ করে।
পদ্মার মনে পড়ে সুন্দরবনে তাদের জীবনের কথা। অল্প বয়েসেই সুনুর সঙ্গে বিয়ে হয়। কিছুদিনের মধ্যেই এই সন্তান। সামান্য জমির ওপর নির্ভর করে জীবন চলতে থাকে। কিন্তু বেশিদিন সুখ সইল না। সামান্য জমি আর জীবিকাকে কেন্দ্র করে যতটুকু সুখ ছিল তাও প্রকৃতি দেবী কেড়ে নেন। সেই ভয়ংকর আয়লা জমি শুদ্ধ সবকিছু ভাসিয়ে নেয়। সুনুর তৎপরতায় তারা বাঁচে। তারপর জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় আসা। ওর স্বামী ওকে খুব ভালোবাসত। সারাদিন রিক্সা চালিয়ে তার জীবিকা। এরই মধ্যে হাসিখুসির জীবন। তাও টিকল না। সুনু যে কোথায় হারিয়ে গেল। তা নিয়েও নানা জনের কটুক্তি। তবে পদ্মা জানে সে কেমন ভালো মানুষ ছিল।
পদ্মা নীলমনির সহায়তায় আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। ছেলেকে আঁকড়ে ধরেই ওর জীবন। সেখানেও হানা দেয় এক অচেনা শত্রু। বস্তিতে সেই ভয়াভয় আগুন। পদ্মা একে ভগবানের মার বলে মেনে নিতে চায় । তবে নীলমনি বলে ওটা মানুষের লোভের পেটে গেছে। এক বড় প্রমোটার আগুন লাগিয়েছিল। জমি দখল নেওয়ার পর আজ সেখানে তো ফ্ল্যাটই হয়েছে। নীলমনি ভুল বলেনি। তাও মনে করে ভগবানকে আর দোষ দেওয়া কেন। নীলমনি বলে তোমার ভগবানের সঙ্গে এই মানুষগুলোর আঁতাত। ভগবানের ওপর বিশ্বাস-ই বা রাখা যায় আর কত! নীলমনি বলে নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। দেখলে তো একবার ভগবান আরেকবার মানুষ রূপী ভগবান আক্রমন হানছে। গরিবের বন্ধু তারা নয়। আজ আর কথাটা অস্বীকার কি করে করে পদ্মা। তাও অবিশ্বাসের মধ্যেও ওপরওয়ালার ওপর বিশ্বাস আর তাই নিয়েই বেঁচে থাকা।
ওই কতই সেপ্টেম্বর বলল? সেটা আবার তার কাছে বিশেষ কোনদিন! হাজার ভাবনা ভাবতে ভাবতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হ’য়ে এল বলে। আজ আর সংগঠনের কাজে যাওয়া হল না। আকাশ পাতাল ভেবেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সে দিনটাকে। এ এক অশান্তি। ছেলে স্কুল থেকে এসে খেলতে গেছে। নীলমনি আবার ছেলে খেলতে না গেলে রাগ করে। এসব ভাবতে ভাবতে নীলমনি এসে হাজির :
— — — কি শরীর খারাপ নাকি? এখনও ওঠোনি।
— — — না ভাবছিলাম ওই সেপ্টেম্বরের দিনটায় কি ছিল।
— — — থাক ওটা আর ভাবতে হবে না।
— — — আচ্ছা গতবছর যে দিনে তুমি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছ সে দিনটা কি?
— — — সে দিনটা আবার তোমার বিশষ দিন হবে কেন? সেদিন আমাদের বাড়িতে তুমি কিভাবে অসম্মানিত হয়েছিলে মনে নেই? তাছাড়া সেটা সেপ্টেম্বর মাস ছিল না।
— — — আমার অসম্মানের কথা ছাড়। সবমেয়েদের কপালেই সেটা জোটে। সেই দিনটাই তো আবার আমার এই জীবনের শুরু। আমার মত অভাগার কাছে সেটাই কত বড় ভগবানের আশীর্বাদ।
— — — তোমরা এই জন্যই আরও মরলে। জীবনটাকে কারও না কারও অনুগ্রহ বলেই ধরে নেও। আচ্ছা এখন একটু চা খাওয়াও। ওই দিনটা আমি খুঁজে এনে দেব।
— — — ও আমার ভুল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে সে রান্নাঘরে যায় চা করতে।
নীলমনি ঘরে এসে শুয়ে পড়ে। ও বাড়ি থেকে বেরোবার আগে যেভাবে অপমানিত হয়েছে সেটা পদ্মার ভোলার নয়। কিন্তু সে ওটা ভুলে থাকে। কোনদিন রাগ হলেও পদ্মা সে কথা তোলেনি। নীলমনি ভাবে। সে আজ ঠিক করে এসেছে ছেলের সামনেই পদ্মার সেই বিশেষ দিনটা পদ্মাকে মনে করিয়ে দেবে।
পদ্মার মাথায় ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার আগের ঘটনাটা সবসময়ই মনে ঘোরে । ও ভুলবে কি করে! সেদিন আগুনে সব পুড়ে যাওয়ার পর বিকেলের আগে নীলমনি পদ্মাকে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। সঙ্গে ছেলে বিশু। তাকে আর বিশুকে নিজের ঘরে বসিয়ে মায়ের কাছে আসে। পাশের ঘর থেকে সব পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। নীলমনি বলে:
— — — মা ও এখানে থাকবে। ব্যবস্থা করতে হবে।
— — — তুই তো সব ঠিক করেই এসেছিস। তোর দাদা আছে বাড়িতে, অন্যেরা আছে তাদের মত নিতে হবে না? আর মেয়েটি কে, ছেলেটিই বা কে সব জানা দরকার তো। তোর সঙ্গে সম্পর্কই বা কি?
— — — সম্পর্কের প্রশ্নটা পরে। ওরা এখন উদ্বাস্তু, সহায় সম্বলহীন। ওদের আগে একটা ব্যবস্থা করতে হয় তো। নীলমনি কোন কথা না লুকিয়ে পদ্মার পুরো পরিচয় দেয়। ওর স্বামীর কথাও বলে।
— — — জাতপাতের ঠিক নেই। একটা রিক্সাওয়ালার বৌকে একটা ঢ্যাঙ্গা ছেলে শুদ্ধ এ বাড়িতে ওঠাতে হবে! সে কি কথারে খোকা ! এরই মধ্যে নীলমনির বৌদি আর বোন এসে উপস্থিত। তারা সব শোনে । বৌদি বলে:
— — — না তা কোনভাবেই হোতে পারে না। ও হবে আমার জা! তা কখনই নয়। নীলমনির উত্তর:
— — — বৌদি, তুমি তো ধরেই নিয়েছ ও আমার বউ। না জেনে না শুনে এটা ধরে নেওয়া কেন ? আর আমার বউ-ও যদি হয় তুমি আপত্তি করার কে ?
— — — ও কে মানে ? এ বাড়িতে বৌমারও তো একটা অধিকার আছে। দেখ খোকা আমি এটা মেনে নিতে পারি না। এর মধ্যে ও ঘর থেকে পদ্মা বেরিয়ে আসে। ও বলতে চায় যে যখন কারও মত নেই তখন থাক। আমরা আমাদের ব্যবস্থা করে নেব। ওর কথা না শুনেই নীলমনির বোন বলে:
— — — তুমি এখানে কেন আমাদের মধ্যে ?
— — — ওকে নিয়ে কথা, ওতো থাকতেই পারে । নীলমনি বলে।
— — — এসেছে ভিখিরি হয়ে আবার কথা। দাদা দেখ, এইসব ছাইপাশ যদি বাড়িতে ঢোকাস তবে ভালো হবে না কিন্তু! আর মনে হচ্ছেতো বিয়েটা করে নিয়েই এসেছিস। বৌদি বলে কি ভুল করেছে ?
— — — দেখ ফুলু তুই অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস। যাকে তাকে অসন্মান করার অধিকার তোর নেই।
— — — কাকে অসন্মান ! যে আশ্রয় চাইতে অসম্মান বোধ করে না তার আবার সম্মান কি ? একবার বিয়ে হয়ে গেছে, এত বড় ছেলে। আবার নিচু জাতের মেয়ে হয়ে আঁকাশের চাঁদ পেতে চায়। ভুজুং ভাজং দিয়ে ভুলিয়েছে তার আবার কথা। ফুলু বলে।
— — — এত কথার দরকার নেই। সবাই একমত তো। আমার ব্যাপারে আর কেউ এসো না। আর ফুলু, এরপর কথা বললে কিন্তু তোর কথাও উঠবে। সেটা তোর পক্ষে সম্মানজনক হবে না। নীলমনি বলে।
পদ্মা অনেক করে ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেও নীলমনি পদ্মা আর বিশুকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। পদ্মা কোনদিন নিজের ভাগ্যের সঙ্গে নীলমনির মত মানুষের ভাগ্য জড়াতে চায় নি। সে তার কাছে দেবতূল্য। এটা সে নীলমনিকে বলেছিল। সে নীলমনিকে ভালোবাসলেও তার এটাই ছিল দৃঢ় মত । কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল! ফুলুর চোখের ঘৃণার প্রকাশটা পদ্মাকে এখনও বেঁধে। গত এক বছরে নীলমনির সস্নেহ সান্নিধ্য আর অকপট প্রেম সেটা অনেকটা দূর করতে সাহায্য করলেও আজ যেন সেটা আবার জিগিয়ে ওঠে।
চা বানিয়ে পদ্মা ঘরে ঢোকে। নীলমনি ছেলেকে ডেকে নেয়। সে বলে, কি দিনটা মনে করতে পারলে না তো ? বিশু তোরও সেটা জানা দরকার। বাবার সত্যিকারের পরিচয় ছেলে জানবে না তা কি করে হয়। বিশু জানতে আগ্রহী। লোকটা হারিয়ে গেল কেন কোথায় তা সে কিছুই জানে না। পদ্মা বলে হেয়ালি কোর না। যা বলবার বল।
নীলমনি কিছু না বলে তার ব্যাগ থেকে একটা ছবি বার করে পদ্মার হাতে দিয়ে বাইরে চলে যায়। পদ্মার চোখে জল। এই লোকটাই তো সেদিন হারিয়ে যায় যে দিনটাকে পদ্মা হাতড়ে বেড়াচ্ছে। সেদিনটাই আজের এ দিন। সবাই তাই জানে। অনেকে বলত সে বিয়ে করে অন্য কোথাও চলে গেছে। তবে নীলমনি বলেছিল হারায় নি। সে একটু অন্যভাবে তাকে জানত। আজ সে আর নেই। তার সেদিন থেকে আর খবর পাওয়া যায় নি। পদ্মার মনে পড়ে দিনটা ছিল ১৪ই সেপ্টেম্বর। অষ্টমী পুজো। রাতের দিকে কারা এসে সুনুকে ডেকে নিয়ে যায়। সেই যে সে যায় আর ফেরে নি। সে শুধু বলে যায় তার ডাক এসেছে। তাকে যেতে হবে।
পদ্মা বিশুকে বুকে টেনে নিয়ে বাবার পরিচয়টা দেয়। বিশুর চোখে জল নেই। আনত মুখে মায়ের হাত থেকে নিয়ে দেওয়ালে টাঙানো নীলমনির ছবিটার পাশে বাবার ছবিটা টাঙিয়ে দেয়। মাথা তুলে অদ্ভুত প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাসে ছবি দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। পদ্মা চোখ মোছে।
শেষ চিঠি
বছর কুড়ি বয়েস। বাবা মায়ের দুই মেয়ের বড় মেয়ে। কলেজে পড়ে। ভালো ছাত্রী। সপ্রতিভ মেয়ে। কলকাতার উপকন্ঠে বাড়ি। মেয়েটির নাম সুহাসিনী। বাবা আদর করে নাম দিয়েছিলেন। ওর আলাদা করে কোন ডাক নাম নেই। এত বড় নামে ডাকতে অসুবিধে হওয়ায় সবাই সুনি বলে ডাকে। যেন কাঠবেড়ালির লেজটা খসে পড়েছে। ঠিক যেমন নাম থেকে হাসিটা উবে গেছে। কিন্তু সেটা মুখে যোগ হয়েছে। মুখের মিষ্টি হাসিটা ওর সব সময়ের সঙ্গী। মেয়েটি ছিপ ছিপে গড়নের। মেপে মেপে সুন্দরী না হলেও দেখতে মিষ্টি। চোখটা যেন সবসময় অশ্রুসিক্ত। বর্ষার মেঘের ছায়াটা মুখে আঁকা। একটু হলেই চোখে বর্ষা নামবে। কিন্তু নামবে নামবে বললেও নামে না। কেউ একবার দেখলে দ্বিতীয়বার দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
সুহাসিনী অর্থনীতি নিয়ে পড়ে। কলেজে বন্ধুর অভাব নেই। তার কলেজটা বাড়ি থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে। বাসে যাতায়াত করতে হয়। অঞ্চলে একটা মেয়েদের স্কুলে পড়ত। বাড়ির অন্তরমহলটাই তার জগৎ। বাবা মায়ের হাত ধরে কখনো বাইরেটা দেখেছে মাত্র। এখন তার সুযোগ হয়েছে নিজের পথ নিজে চিনে নেওয়ার। কলেজে ঢুকে তার পরিচয়ের দরজাটা যেন অবাধ হয়েছে। সেখানে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সবার সঙ্গে অবাধ মেলামেশা। ও ক্লাসে খুব মনোযোগী। বন্ধুরা ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে আড্ডা মারলেও ও সেটা করে না। তবে আড্ডায় তার যে উৎসাহ নেই তা নয়। ক্লাস করে যতটুকু সময় পাওয়া যায় আড্ডা দেয়। বন্ধুদের কাছেও ও সুনি। তবে বন্ধুদের মধ্যে থাকলে নামের ‘হাসি’টা মুখে জুড়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে । ও সেখানে সুহাসিনী, ডাকে সুনি হলেও।
প্রায়-কলকাতার মত একটা শহর অঞ্চল থেকে কলেজে এসে সে সমবয়সী শহুরে ছেলেদের সঙ্গে যেমন অবাধ মেলামেশার সুযোগ পেয়েছে তেমনি গ্রাম থেকে আসা ছেলে মেয়েদের বন্ধুত্ব তাকে আমাদের বৃহত্তর সমাজটাকে চেনার সুযোগ করে দিয়েছে। সেই দিক থেকে শহরের উপকণ্ঠে কলেজগুলো যেন গ্রামীন বাংলা আর শহুরে বাংলার এক মিলন তীর্থ। গ্রামের সকালের মিষ্টি রোদ্দুরের সঙ্গে শহরের দুপুরের যৌবনের দহনের এ যেন সঙ্গম। শহরের অনাবৃষ্টিতে যে তৃষ্ণা কেঁদে মরে তা গ্রামের বারিবর্ষণে মেটে। শহরের সাজানো বাগানে ফুলের সঙ্গে গ্রামের বৃক্ষের পাতাবাহার। এখানে শহুরে সংকীর্ণতা ও অহংটা যেন ভেঙে যায়। আবার গ্রামের সংস্কার এখানে হোঁচট খায়। সুহাসিনীরা বুঝতে পারে জীবনের পরিধির ব্যাপ্তিটা তারা এতদিন যা জেনে এসেছে তার থেকে অনেক বেশি, দৈর্ঘ্যে আর প্রস্থে। যেন রবীন্দ্রনাথের সাধারণ মেয়ে, ‘সজল মেঘ আর উজ্জ্বল রোদ‘ মিলেছে এ কলেজ প্রাঙ্গণে।
তপন কিশোর অরিন্দম ইন্দ্রানী দেবযানী সুতপা সবাই কলেজে ওর বন্ধু। এক এক জনের এক একটা বিষয়। পড়াশুনা আড্ডা নিয়ে কলেজে বেশ চলে। নিজের বিষয় ছাড়াও বন্ধুদের মাধ্যমে রাজনীতি দর্শন সমাজতত্ত্ব সাহিত্য এমন কি রসায়ন নিয়েও ওদের আড্ডা হয়। রাজনীতি নিয়ে বাক বিতণ্ডা লেগেই থাকে। বন্ধুদের মধ্যে তপন সুহাসিনীকে যেন বেশি আকর্ষণ করে। খুব যে ব্যতিক্রমী ছেলে তা নয়। তপনের সাহিত্যে উৎসাহ বেশি। ইংরেজির ছাত্র। বাংলায় কবিতা গল্প লেখে। সাহিত্যের ছাত্রী না হলেও সুহাসিনী কবিতা ভালোবাসে। তপন ওকে একজন ভালো পাঠিকা পেয়েছে। আর পাঠক পাঠিকারাই লেখকদের সবচেয়ে আপনজন। পাঠক ছাড়া লেখকের জীবন বর্ষণবিহীন বর্ষাকাল। কল্পনায় জমে ওঠা বর্ষণসিক্ত মেঘ বর্ষায় না। চাতকের তৃষ্ণা মেটে না। পাঠিকা সাহিত্যিকের স্বভাব প্রেমিকা। প্রেম নিবেদন করতে হয় না। লুকিয়ে দেখা করার দরকার হয় না। পাঠিকাকে তার লেখা পড়াতে পারলেই প্রেম নিবেদন করা হয় নিজেদের অজান্তেই। পাঠিকাও সেটা সাদরে গ্রহণ করে।
কলেজ ফেরত ওরা দুজনে প্রায়ই একই বাসে। কলেজের সামনে থেকে ওঠে। সুহাসিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে যায়। তপনকে আরও প্রায় দের ঘন্টা যেতে হয়। তপনের বাড়ি শহর ছাড়িয়ে চব্বিশ পরগনার এক গ্রামে। চাষ-ই ওদের পরিবারের জীবিকা। আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হলেও স্বচ্ছল। তপন গ্রামে ভালো ছাত্র বলে পরিচিত। সাহিত্যে অনুরাগের বশবর্তী হয়ে ইংরেজি নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বলা কওয়ায় ইংরেজিতে খুবই কাঁচা।আজকের শহুরে কথায় কথায় ইংরেজি বলিয়েদের পাতে পড়ে না। কিছুটা ব্রাত্যই বটে। তবে গ্রামের স্কুল হলেও ইংরেজি শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে ইংরেজি ব্যাকরণটা ভালো শিখেছে। সুহাসিনীও লক্ষ্য করেছে অভিধান ওর অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। অবসর সময়ে ওকে অভিধান খুলে বসে থাকতে দেখা যায়। তাই বোধহয় যখন ইংরেজি লেখে তখন তা যেমন ব্যাকরণ ভিত্তিক হয় তেমনি লেখায় শব্দের বৈচিত্র পাওয়া যায়। ওর এই ইংরেজি জানাটা আলাপ চারিতায় একেবারেই ধরা পড়ে না। সেখানে সে গ্রাম্য বাঙালি। চলা ফেরায় তেমন সপ্রতিভ নয়। আজকের কর্পোরেট দুনিয়ার চাহিদার সঙ্গে মানানসই নয়। সেদিক থেকে কর্পোরেট ক্যারিয়ার জগৎ তার কাছে অন্ধকার। কিন্তু তার প্রিয় পাঠিকা সেদিক থেকে বেশি সরোগর। সুহাসিনী ও তপন যেন বিপরীত অক্ষে অবস্থান করে। ভবিষ্যতে কর্পোরেট দুনিয়ার হাতছানি সুহাসিনীকে ডাকে। কিন্তু তপন ডাক পায় না। দুজনের মধ্যে এই পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের সম্পর্কের অতলে যেন কোন এক অচেনা নদীর ফল্গুধারা।
ওদের সম্পর্কে এখনও আনুষ্ঠানিকতার লাগাম পরানো হয় নি। কেউ কাউকে প্রেম নিবেদন করে নি। তবে পস্পরের আকর্ষণটা বাড়তে থাকে। তপন প্রায়ই ওর গল্প বা কবিতা নিয়ে সুহাসিনীর সঙ্গে বসে। বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে। কবিতা পাঠ করে। সুহাসিনীও আজকাল একটা আধটা কবিতা লেখে। তবে ওর পড়াশুনা থাকে যার জন্য অনেক সময় দেয়। ভালো ফল করে একটা ভালো চাকরির তাগিদ ওর জীবনে খুব বেশি। কিন্ত তপন পড়াশুনায় অনাগ্রহী না হলেও ক্যারিয়ার করার প্রশ্নে উদাসীন। ও ভালো তেমন চাকরির কথা ভাবে না। সাহিত্য চর্চায় বেশি সময় দেয়। দুজনেই দুজনের কথা ভাবে। তপনের পাঠক পাঠিকা আছে। তারাই তার প্রেম। কিন্তু সুহাসিনীর পার্থিব চাহিদাটা বেশি। সে ক্যারিয়ারই হোক আর ভবিষ্যৎ সংসার জীবনই হোক। কার সঙ্গে সংসার জীবনে জোট বাঁধা যায় সেটা সে ভাবে। পার্থিব প্রয়োজনে জোট বাঁধা আর ভালোবাসার মধ্যে যে পার্থক্য আছে সেটা তাকে ভাবায়। ভাবে বলেই তপনের সঙ্গে একটা নৈস্বর্গিক প্রেমের সম্পর্ক থাকলেও তার ভিত্তিতে সংসার গড়ার ভাবনা কতটা বিশুদ্ধ প্রেমের মর্যাদা পাবে সেটা নিয়ে তার সংশয় হয়। পার্থিব প্রেম সেই বিশুদ্ধ প্রেমের মর্যাদা হানি করবে বলে মনে হয়। শেষের কবিতার বন্যা আর অমিত। মনে করে পার্থিব প্রেম বাড়ির পুকুরে সাঁতার কাটার মত। ঘরার জল যা নিত্য ব্যবহারের জন্য পুকুর থেকে তোলা হয়। কিন্তু তাতে সমুদ্রে সাঁতারের আনন্দ নেই, বিহঙ্গ আকাশে ডানা মেলে না। অপার্থিব নিষ্কাম প্রেমেই তো সেটা সম্ভব। আমাদের সমাজে সংসার ও সকাম পার্থিব প্রেম সম্পর্কে তার ধারণাটা একদিন সুহাসিনী কবিতায় রূপ দেয়। তপনের সঙ্গে দেখা হয় কলেজ প্রাঙ্গনে। সেখানে সব বন্ধুদের সামনে সে কবিতাটা পাঠ করে। কবিতাটা সবার ভালো লাগে। ওটাই সুহাসিনীর লেখা প্রথম কবিতা যেটা ও তপনকে উৎসর্গ করে ।
সুহাসিনী জানে সংসারটা জরুরি। মানিয়ে চলা। পার্থিব সুখ দুঃখ দৈনিক মিলন বিরহ এর সঙ্গে যুক্ত। সে অনেকবার প্রস্তাব দেবে বলেও পিছিয়ে আসে। তপন এ নিয়ে ভাবে না। সাহিত্য সেবা নিয়েই তার কারবার। প্রয়োজনের তাগিদে যদি সংসার পাততে হয় তো পাতবে। এর জন্য প্রেম নিবেদন করতে হবে কেন? প্রেম তো নিজে থেকেই আসে। কাশর ঘণ্টা বাজিয়ে হই হই করে তাকে নিয়ে আসতে হবে কেন? সংশয়ের আঁধারে ওদের প্রেমের ইতিকথা হৃদয়ের গভীরে লুকায়। হৃদয় বাতায়ন ধরে সে উঁকি মারে।
কলেজের পালা শেষ হয়েছে। সুহাসিনী খুব ভালো ফল করেছে। তপন খারাপ করে নি। দুজনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। বিদ্যাদেবী দুজনকে বিদ্যাসাধনার প্রাঙ্গণে বন্দি করে রাখে। ইতিমধ্যে ওদের সম্পর্কটা বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিকতা লাভ করেছে । বছর খানেক আগে কলেজে পড়াকালীন একদিন বাসে বাড়ি ফেরার সময় সুহাসিনী পড়ে গিয়ে আহত হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে তপন ওকে ওর বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে বাড়ির সবার সঙ্গে তপনের পরিচয়। ওর আচার আচরণ সরলতা সবাইকে মুগ্ধ করে। বাড়ির দরজা ওর কাছে উন্মুক্ত হয়। সেই থেকে তপনের সুহাসিনীর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত। আনুষ্ঠানিক সম্পর্কটা গড়ে ওঠার শর্ত তৈরি হয়। মুক্ত পৃথিবীর উন্মুক্ত অপার্থিব প্রেম পার্থিব সম্পর্কে যেন বাঁধা পড়তে থাকে। সুহাসিনীর সংশয় থাকলেও সে সেটা অস্বীকার করতে পারে না। নিষ্কাম প্রেম কামনার খাঁচায় বন্দী হোয়ে পড়ে যেন। ভিন্ন বিষয় হলেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে দুজনের রোজই দেখা হয়। প্রেম নির্জনতা খোঁজে। নিষ্কাম কামনার অঙ্গে বাসা বাঁধে। কাম আর নিষ্কাম দ্বন্দ্ব সমাধান খোঁজে পার্থিব চাহিদায়। ওদের সম্পর্কটা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দু বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সুহাসিনীর বাবা মা জানে এ ব্যাপারে আপত্তি করে লাভ নেই। সুনি একরোখা মেয়ে। ছেলের বাড়িতে এ নিয়ে সাধারণত বেশি প্রশ্ন ওঠে না বিশেষ করে মেয়েটি যেখানে দেখাশোনার পরীক্ষায় সহজেই পাশ করার উপযুক্ত।
দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালোভাবে পাশ করে। সুহাসিনী প্রত্যাশামত একটা কোম্পানিতে গবেষণা বিভাগে চাকরি পেয়ে বেঙ্গালুরে চলে যায়। তপন তার দেশের বাড়ির কাছে স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করে। সে সাহিত্য সেবায় মনোনিবেশ করার সুযোগ পায়। দুজনেই জীবিকা হিসেবে তাদের পছন্দের জায়গায় স্থান পায়। দুজনের মধ্যে চিঠি পত্রে বা দুরাভাসে যোগাযোগ থাকে। সমস্যা দেখা দেয় তারা কোথায় কিভাবে ব্যাক্তিজীবনে জোট বাঁধবে তা নিয়ে। ব্যাপারটা সমাধান হয় না। দুজনকে একজায়গায় থিতু হতে গেলে একজায়গায় কাজ নিতে হয়। কর্মজীবন নিয়ে দুজনের ভাবনা দুরকম। তপন চায় গ্রামে মাস্টারি করে কর্মজীবনে কিছুটা সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে, একই সঙ্গে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যেতে। সুহাসিনী চায় কর্পোরেট জীবনে প্রতিষ্ঠা যেটার সুযোগ পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বেশি। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক থাকলেও সংসারের দাবি মেটান মুশকিল। তাও দুজনে অপেক্ষা করে। বিষয়টা নিয়ে কেউ কাউকে দোষারোপ করে না। তপন যেমন চায় না সুহাসিনী নিজের সত্তা ছেড়ে নেহাৎ এক গৃহবধূ হয়ে থাকবে। আবার সুহাসিনীও চায় না তপনের সাহিত্য সেবায় বেঘাত ঘটুক। বাস্তবের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের সংঘাত কিভাবে মিটবে কেউ জানে না। অথচ দুজনেই দুজনকে পেতে চায়। নিষ্কাম প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে হয়। কিন্তু কামনার টান কতদিন অস্বীকার করা যায়? কেউ জানে না। এছাড়া আছে পরিবারের বন্ধন।
বেঙ্গালুরে গবেষণার কাজে সুহাসিনী বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছে। আর গবেষণার কাজ একটা যৌথ দায়িত্ব। এই কাজে অন্যদের সহযোগিতা বিশেষ দরকার। ওর সঙ্গে জনা দশেকের একটা টিম। প্রাতিষ্ঠানিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা নিজেদের অজান্তেই প্রতিষ্ঠান ছাড়িয়ে কখন ব্যক্তিগত প্রাঙ্গনে ঢুকে পড়ে সেটা সবসময় ঠাহর করা যায় না। ওর সঙ্গে কর্মরত সবাই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মেয়ে পুরুষ সবাই। ও ওখানে দুজন মেয়ের সঙ্গে একটা ফ্ল্যাটে থাকে। নিজেরা পালা করে নিজেদের কাজ করে। অন্যান্যরা আসে। অফিসের কথাবার্তা ছাড়াও ব্যক্তিগত আলাপ আড্ডা চলে।
স্কুলে শিক্ষকতার সূত্রে তপনের পরিচিতির বিস্তার ঘটেছে গ্রাম থেকে গ্রামে । লেখক হিসেবেও ওর নামডাক। কবিতা প্রেমিক প্রেমিকারা তাকে জড়িয়ে থাকে। বাড়িতে পাঠক পাঠিকাদের অবাধ যাতায়াত। নিজের বাড়ির একটা ঘরে কবিতা আবৃত্তির মহড়া চলে। বাচ্চাবুড়োদের নিয়ে বাচিক স্কুল। হেসে খেলে দিন যায়। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা পাঠাবার দাবি আসে।শহর থেকে প্রায়ই নেমন্তন্ন।এরই মধ্যে সংসারের কিছু দায়িত্ব। বিশেষ করে মায়ের প্রতি।ভাইরা থাকলেও বড় ছেলে হিসেবে তার দায়িত্ব বেশি। মায়ের কঠিন অসুখ। তাঁকে নিয়ে প্রায়ই কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে যেতে হয়। ছোট বোন সংসারের দায়িত্ব নিলেও তার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হয়। বাবা মা দুজনেই ওর বিয়ের কথা বলে। ও প্রয়োজনটা বোঝে।
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আগের মত সুহাসিনীর ঘন ঘন চিঠি তপন পায় না। এখন চিঠি লেখার প্রয়োজনটা ফুরিয়েছে সুহাসিনীর। মেসেজ বা আপে যোগাযোগটা হয়। মস্তিষ্কের কল্পনার জগৎটা বাঁধা পড়েছে হাতের মুঠোয়। তাতে তপনের মন ভরে না। সুহাসিনীর চলে যায়।ও নিজেও সুহাসিনীকে লেখা কমিয়ে দিয়েছে। সুহাসিনীর প্রেমটাও যেন সংসারের দরজায় করা নাড়ে।সংসারের মুঠোয় বন্দী হতে চায়।
তপন মেসেজে বার্তা পায়। সুহাসিনী তাকে জরুরি তলব করে। সে যেন বেঙ্গালোরে যায়। বিশেষ দরকার।সঙ্গে উড়ানের টিকিট। তপন বার্তা পেয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ভেবে পায় না কি এমন দরকার। সুহাসিনীর ডাককে সে কোনোদিন অস্বীকার করতে পারে না। স্কুল ছুটি নিয়ে রওনা দেয়। নির্ধারিত সময়ে উড়ান ধরে। উড়ানে বসে তার চিন্তার জগত তোলপাড়। কিছুদিন আগে সুহাসিনী অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আবার কি তবে সে অসুস্থ! আবার সে ভাবে হয়তো তাদের সম্পর্কটাকে সে ঝালিয়ে নিতে চায়। অনেকদিন দেখা নেই। দেখা করতে চায়। তপন রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এবার দেখা হলে সম্পর্কটার একটা চূড়ান্ত রূপ দিতে চায়। সে জানে সুহাসিনী বিয়ে করতে চায়। তবে তপনের পক্ষে বেঙ্গালোরে স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া কি সম্ভব! তবে কি করার! তপন বিভ্রান্ত। তার মাথায় শুধু সুহাসিনী নয়, তার পরিবার বাবা মা বোনের সঙ্গে তার সম্পর্কটা মাথায় ভিড় করে। সুহাসিনীর মা তো তপনকে খুব স্নেহ করেন। হয়তো মনে মনে তাকে জামাই বলে গ্রহণ করেছেন। সুহাসিনীর ছোট বোন সোহাগ ওর বিশেষ গুণগ্রাহী । ওর সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কি। কবি বাবু বলে ওকে ডাকে। দিদিকে নিয়ে মস্করা। একদিন ঠাট্টা করে সোহাগ তপনকে বলে দিদি তো মনে হচ্ছে ফিরবে না। তখন কি করবেন? তপন গম্ভীর হয়ে ওঠে। কবিগুরুর উদাসীন গম্ভীর মুখ দেখে সোহাগ লজ্জা পায়। এমনি টুকরো টুকরো কথার ঘাত প্রতিঘাতে ওদের মধ্যে একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তপন জানে সোহাগের এক সহপাঠীর সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। যে কোন কারনেই হোক সোহাগের সে সম্পর্ক এখন নেই। বিষয়টা নিয়ে তপন ওর প্রতি সহানুভূতিশীল। মেয়েটি পড়াশুনায় তেমন আগ্রহী না হলেও গুণী। সংসারের কাজে পটু। ভালো রান্না করে। তপন ওদের বাড়ি গেলে ওর হাতের চা না খেয়ে ফেরে না। মেয়েটি ভালো কবিতা আবৃত্তি করে।
ঘণ্টা আড়াইয়ের মধ্যে উড়ান বেঙ্গালুরু বিমান বন্দরে নামে। সেখান থেকে একটা ভাড়া গাড়ি নিয়ে ঠিকানা ধরে তপন পৌঁছে যায় সুহাসিনীর আস্তানায়। সুহাসিনী তপনের অপেক্ষায়। তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা।কলকাতার গ্রীষ্ম থেকে সে আসে বেঙ্গালুরুর বসন্তে।অপেক্ষারত সুহাসিনীর চোখে সেই বসন্তের স্পর্শ। তপন ওকে দেখে আপ্লুত হয়। তারা যেন ফিরে যায় ফাগুনের সন্ধ্যায় কলকাতার গঙ্গার ধারে। তপনের স্মৃতিতে সেই সন্ধ্যাগুলো ফিরে আসে। আজ অনেকদিন পর সুহাসিনীকে সে একান্তে পায়। সুহাসিনী তপনকে নিয়ে ঘরে বসে। দুজনের মধ্যে আলাপচারিতা শুরু হয়। সুহাসিনী জানতে চায়
— — — তোমার মা কেমন আছেন?
তপন বলে :
— — — ভালো না। এখন কাজকর্ম করতে পারে না। বোনের ওপর সংসারের চাপ।
সুহাসিনীর যেন কৌতুক মিশ্রিত উত্তর:
— — — এখন তো কাউকে বাড়িতে দরকার। আর বোনের তো ভবিষ্যত আছে।
তপন সুযোগ পায় কথাটা তুলতে। সে বলে:
— — — এখন তো আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বাড়িতে সে ব্যাপারে সবাই অপেক্ষা করছে।
— — — হ্যাঁ ঠিকই তো। এই কথা বলে সুহাসিনী অন্য প্রসঙ্গে আসে। বলে:
— — — সোহাগ বললো তুমি ও বাড়িতে গিয়েছিলে। ওকে কেমন দেখলে?
তপন বলে:
— — — ভালো। এখন অনেক স্বাভাবিক। মনে হয় আঘাতটা সহ্য করে নিয়েছে। আমি ফিরলে আমাকে একদিন মাংস রান্না করে খাওয়াবে বলেছে।
সুহাসিনীর উত্তর :
— — — ওর হাতে খেয়ে তৃপ্তি পাবে। আমি ও কাজে লবডঙ্কা।
কথা বলতে বলতে কলিংবেল। কে আবার! কাবাব মে হাড্ডি। তপন ভাবে। সুহাসিনী দরজা খোলে। তপন আড় চোখে দেখে একজন সুদর্শন ভদ্রলোকের প্রবেশ। তপনের মনে হয় ভদ্রলোকের আসার কথা সুহাসিনী জানত।সুহাসিনী তপনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। উনার নাম রামস্বামী যার কথা তপন আগেই শুনেছে। উনিই অসুস্থ সুহাসিনীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিন জন গল্প করতে বসে।ওদের দুজনের মধ্যে তৃতীয়ের এই উপস্থিতি তপনকে অস্বস্তিতে ফেলে। ভদ্রলোক অবাঙালি।তাই ইংরেজিতে আলাপচারিতা যা তপনের পক্ষে বিড়ম্বনা। তপন কোনমতে চালিয়ে যায়। কথা বলতে বলতে রাত হয়। ইতিমধ্যে ফরমাস অনুযায়ী দোকান থেকে খাবার আসে। খাবার শেষ হলে সুহাসিনী বলে:
— — — — তপন তুমি উনার সঙ্গে যাও।ওখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। উনি তোমার জন্য হোটেলে ব্যবস্থা করতে দিলেন না।
পরের দিন । সুহাসিনী রামস্বামীর বাড়িতে হাজির। ইতিমধ্যে তপনের উনার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। রামস্বামীর আতিথেয়তায় তপন মুগ্ধ হয়। রামস্বামী অবিবাহিত। একাই থাকে। সকালে উঠে চা ব্রেকফাস্ট নিজের হাতে করে খাওয়ান। বাড়ি চেন্নাই। রামস্বামী পাশের ঘরে যান। তপনের সঙ্গে সুহাসিনী একা। কালকের কথার রেশ টেনে তপন বলে:
— — এবার আমাদের ব্যাপারটা ঠিক করে ফেলা যাক। সুহাসিনী বলে
— — আমার বাড়িতে চলো সব কথা হবে।
এরপর দুজনের আলাপচারিতা। রামস্বামী এসে যোগ দেয়। দুপুরে এখানেই খাওয়া দাওয়া সেরে সুহাসিনী তপনকে নিয়ে ওর ডেরায় যায়। বাড়িতে এসে দুজনে আবার নিভৃতে আলাপ। তপন বিয়ের কথা তোলে। সুহাসিনীও তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। তপনকে প্রস্তাব দেয় এখানে একটা স্কুলে চাকরি নিতে। ইংরেজি ওর বিষয় বলে সেটা পেতে অসুবিধে হবে না জানায়। যদি তপন রাজি হয় তবে সে তাকে একটা স্কুলে কালকেই নিয়ে যেতে পারে। এই ইন্টারভিউএর ব্যবস্থা করেই সুহাসিনী তাকে আসতে বলে।তপন জানায় সেটা তার পক্ষে সম্ভব নয় । দুজনের মধ্যে এ নিয়ে মনোমালিন্য হয়। তবে তা বেশিদূর এগোয় না। সুহাসিনীর সংশয় ছিল তপন তার জায়গা ছেড়ে আসবে কি না। আর তপন জানে সুহাসিনী আত্মমর্যাদা আত্মসত্তা ছেড়ে সংসার করবে না। সেটা তার কাছে দাসত্ব। তাও ও বিশ্বাস করে সুহাসিনী কখনো পশ্চিম বঙ্গে কোথাও চাকরি নিয়ে চলে আসবে। সে আর জোরাজুরি করে না। বাড়ি ফিরে আসে ।
একদিন দুজনের মধ্যে মোবাইলে কথা হয়। কে কেমন আছে জানার পর উভয়ের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়। সুহাসিনী জানায় যে সে তপনকে একটা চিঠি দিয়েছে। তপন জানায় সে সেটা পেয়েছে। চিঠিতে কি লিখেছে? সেটা আমাদের সকলেরই কৌতূহলের।
সুহাসিনী রামস্বামীর এক বন্ধুর সঙ্গে নিজের বিয়ের একটা কার্ড পাঠিয়েছে। বিয়েতে ঘটক রামস্বামী। তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার থেকে একটা কবিতার অংশ:
মোর লাগি করিও না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।
মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই — –
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
সেই ধন্য করিবে আমাকে।
শুক্লপক্ষ হতে আনি
রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
যে পারে সাজাতে
অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ রাতে,
যে আমারে দেখিবারে পায়
অসীম ক্ষমায়
ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি।
এর সঙ্গে তার অনুরোধ তপন যেন বিয়ে করে। সংসারের প্রয়োজনটা তারও আছে। তপনকে সে ভালোবাসে তাই তার দায় আছে এ ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা। সে উপযুক্ত পাত্রী হিসেবে তার বোন সোহাগকে চিঠিতে উপস্থিত করে। তপন একটু বোকা বনে যায়। একটা সন্দেহ উঁকি মেরেছিল। প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু এ কি, সোহাগিনীর তরফ থেকেই! ভেবে পায় না। সোহাগিনীর ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যায়।
একটু ধাতস্থ হয়ে কদিন পরে তপনও চিঠিতে তার বাস্তব অবস্থাটা জানায়। সে প্রস্তাবটা মেনে নেয় তবে সোহাগের স্বেচ্ছামত সাপেক্ষে। সে মতটা পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তার সংশয় আছে যেখানে তাদের সম্পর্কটা ও জানে। ব্যাপারটা সুহাসিনীর ওপর ছেড়ে দেয়। সে চিঠিতে তার অনুমতি জানায়। যেন এরকম একটা কিছুর জন্য সে প্রস্তুত ছিল। ভাবনার জগৎটা তার ছিন্ন ভিন্ন। সে ভেবে চলে :
ভালোই করেছ। কোন নিশ্চয়তার শর্তে ঘর বাঁধা! শত সহস্র ফুটো সে ঘরের ছাদে। গ্রীষ্মের দহন শীতের কাঁপন বর্ষায় প্লাবন সে ঘরে। বসন্তে ফুল ফোটে না এ বাগানে। প্রেমের কলি মুর্চ্ছা যায় সে বাসরে। ভালোই করেছ তুমি বালির বাধ না বেঁধে, অনিশ্চয়তার জোয়ারে না ভেসে। আর জেনো প্রেম বাঁধে না নিজেকে, ধরা দেয় না সংসারের পাঁকে। মুক্ত বিহঙ্গ সে, ডানা মেলে ওড়ে আকাশে, নীরব গুঞ্জন তার বাতাসে।
তপনের ভাবনায় দোলাচল। হঠাৎ একটা দমকা হওয়া। তার ভাবনায় একটা চমক, একটা সংকোচ, যেন একটা উদ্বেগ: সোহাগের থেকে কি ছাড়পত্র পাওয়া যাবে?
সোহাগের সেদিনের সেই ইঙ্গিতপূর্ণ কৌতূহলী চোখটা ভেসে ওঠে। সেদিনের সে ঔদাসীন্য তপনের মুখে আর দেখা যায় না । আবার সুহাসিনীর পাঠানো চিঠিটায় যেন লেখা শেষের কবিতায় অমিতের প্রতি বন্যার অভয় বাণী :
তোমার হয় নি কোন ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃতমুরতি
যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
হোক তব সন্ধ্যাবেলা,
পূজার সে খেলা
ব্যাঘাত পাবে না প্রত্যহের ম্লান স্পর্শ লেগে;
তৃষার্ত আবেগ-বেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোন নৈবিদ্যের থালে।
তোমার মানস-ভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষ্ণায়,
তার সাথে দিও না মিশায়ে
যা মোর ধুলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে।
আগে তুমি নিজে
হয়তো — বা করিবে রচন
মোর স্মৃতি টুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন।
ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায়,
হে বন্ধু, বিদায়।
উচ্ছেদ
প্রতিদিন সকালে একটু বেলা হলে দেখা যেত করবাবু মানে আমাদের ধীমানের বাবাকে দুধ সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে কাগজ হাতে বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে থাকতে। জ্যৈষ্ঠের দুপুরের আকাশটা তাঁর মাথায় ঝলমল করত। এক নাতনী এসে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে:
দাদুর মাথায় টাক
বসবে এসে কাক
দাদু কাগজ থেকে মুখ তুলে নাতনিকে আদর করে কোলে নিয়ে বলেন, “ মুখটা তোর দ্যাখ ”। কাগজ পড়ার ফাঁকেই দাদু কাকে যেন খুঁজে ফিরতেন। কার জন্য যেন অপেক্ষায়।
কিছুক্ষনের মধ্যেই বাজারের থলি নিয়ে মাসিমা ফিরতেন। মেসোমশাইয়ের উৎসুক চোখ। বলতেন:
— — — কি মাছ পাইলা ? মাসিমা হয়তো বলতেন :
— — — ছোট মোরোলা মাছ।
— — — ক্যান্ ! বড় কাটা রুই পাইলা না ?
— — — দাম বেশি। কাইল বেশি টাকা দিও আইনা দিবাম। খালি খাওয়ন আর খাওয়ন !
— — তা, সঙ্গে কাঁচা আম আনছ ত ? দমে গিয়ে মেসোমশাই বলতেন।
— — না আইন্যা যাইবাম কই !
সকালের রোজনামচা শেষে মাসিমা ভেতরে চলে যেতেন। উনুনঘরে তাঁর অনেক কাজ। বাজে বকার সময় কই!
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এই সময় সকাল ন`টা বা দশটায় সামনের দিক থেকে গোল এই বাড়ির বারান্দাটা রোদে ঝলমল করত। সেই সাতসকাল থেকেই শিশু থেকে বৃদ্ধ কতজনকে দেখা যেত। কাকভোরে ধীমানের বাবা করবাবু ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে বাড়ি থেকে বেরোতেন। উদ্দেশ্য প্রাত:ভ্রমন। অন্যেরা একটু বেলা হলে কেউ কেউ অফিসে বাজারে বেরোত, কেউ কেউ স্কুলে। শিশুরা খেলা করত বারান্দায়। রোদের আবির মেখে দৌড়োদৌড়ি, হুড়োহুড়ি। বন্ধুবান্ধবের অবাধ আনাগোনা। দক্ষিণে একদিকে নিমগাছের পাতার দুলুনি। আরেক দিকে নারকেল পেপে গাছ। বর্ষাকালে চারদিক জলে থৈ থৈ করত। খালি মাঠগুলো ভর্তি হয়ে পুকুর। পাড়ার মোড় থেকে মনে হ`ত বাড়িটা ভাসছে। যেন তাজমহল। ধীমানকে বললে ও বলতো,“ওটা বাবার প্রেম।“ ও ভুল বলতো না। সন্দেহ নেই ওর বাবার চাল চলন ছিল শাজাহানি। আর ওর মা সত্যি মমতাজ সুন্দরী ! একই সঙ্গে তিনি বাড়ির রাঁধুনি, বাজার সরকার। রোজই তাকে বাজার করতে দেখা যেত। তিনি বাজার করে নিজের হাতে রান্না না করলে করবাবুর রুচতো না। স্ত্রীর প্রতি তাঁর কর্তৃত্ব, আবার অবাধ প্রেম , নির্ভরশীলতা। এ সবই আজ ইতিহাস।
ওরা মানে ধীমানরা নিজেদের এখন-ও বাঙাল বলে পরিচয় দেয়। বলে ওরা ওদেশের বাসিন্দা, যখন ওদেশটাও এদেশ ছিল। বোধ হয় ক্ষতটা এখন-ও রয়ে গেছে। ওখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে এন্টালি বালিগঞ্জে কাটিয়ে কর সাহেবের অবসরজীবনে সপরিবারে এই পল্লী বাস। এই দেশে। শোনা যেত বারেন্দায় বসে অবসরপ্রাপ্ত ধীমানের বাবার হুঙ্কার, “ওগো.কখন এককাপ চা চাইসি। এখনও হইল না !“ পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন কি না জানি না। তবে করবাহাদুরের জমিদারি মেজাজটা আমৃত্যু তাঁর জীবনে বহাল। তৎপর আর একই সঙ্গে সন্ত্রস্ত মাসিমা সঙ্গে সঙ্গে এককাপ চা নিয়ে উপস্থিত। মাসিমা উনুনঘরে যেতেই আবার হাঁক, “ওগো, কয়টা বাজে দেখতো“। মাসিমা ঘড়ি না দেখেই গলা তুলে বলতেন, “বারোটা পাঁচ“।
করবাবুর মাথার ওপর ঘড়িটা পাঁচ মিনিট আগে ঢং ঢং করে জানিয়ে গেছে বেলা বারোটা।
করবাবুর মেজ ছেলে ধীমান কর। এখন সে বৃদ্ধ। তার ছাত্র জীবনের শেষ প্রান্ত থেকে আজ সে পৌঁছেছে জীবনের শেষ প্রান্তে। এখানেই আজও বাস। দুই ছেলে মেয়ে। মেয়ে চাকুরীরত স্বামীর সঙ্গে পুত্র নিয়ে ভিন প্রদেশে। কলেজে চাকুরী ছেড়ে স্বামীকে সঙ্গ দেওয়া আর ছেলেকে মানুষ করার কাজে আজ দীক্ষিতা। পুত্র সাফল্যের সঙ্গে পড়াশুনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠিত। সেও ভিন প্রদেশের বাসিন্দা। মোটা মাইনে। খরচ আরও মোটা। ঋণ পত্রে খরচের বাহার। এখানেও ধীমান নিঃশ্চুপ। বলার কী আছে ! ওদের আজ ক্ষমতা আছে। ধীমানদের ছিল না। সমাজটাও বদলেছে।
প্রতিষ্ঠিত সব সন্তানদের বাবা-মায়ের মত ধীমানরাও আজ নিজ বাড়িতে দুজন। স্ত্রী-ও তার মতই অবসর প্রাপ্তা পেনশন ভোগী কর্মচারী। আর্থিক ভাবে যথেষ্ট সচ্ছল। একাকিত্ব আর রোগভোগের আতঙ্ক ছাড়া জীবনে আর কোন অনিশ্চয়তা কোথায় ! হ্যাঁ আছে। এক বিচ্ছিন্নতার আতঙ্ক যাকে ইংরেজিতে বলে alienation। এই সভ্যতা সমাজ জীবনে নামিয়ে এনেছে এক ভয়াভয় বিচ্ছিন্নতা। বিচ্ছিন্নতা জন্ম দিয়েছে সমাজবিমুখতা। জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতা। শৈশবের বিচ্ছিন্নতা, যৌবনের বিচ্ছিন্নতা, বার্ধক্যের বিচ্ছিন্নতা। সমাজ জীবন থেকে ব্যক্তিজীবনের বিচ্ছিন্নতা। সৃষ্টি থেকে স্রষ্টা বিচ্ছিন্ন। পরিবেশ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা। আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদের বিচ্ছিন্নতা। সমরবাদের বিচ্ছিন্নতা। মৌলবাদের বিচ্ছিন্নতা। ধর থেকে মাথাটাই ছিন্ন। সবার জীবনকে এই বিচ্ছিন্নতা এক উপগ্রহ হয়ে প্রদক্ষিণ করে। বিচ্ছিন্নতার পূর্ণগ্রাস নামিয়ে আনে অন্ধকার। এক তমসা। সভ্যতার নিদান মেনে মানুষ পরিকল্পনামত ছোট সংসার পেতেছে। পরিবার পরিকল্পনার দৌলতে সচ্ছল জীবন ভোগ করছে। শৈশবকাল থেকে শিশুকে ইঁদুর দৌঁড়ে সামিল করেছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম। কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে হয়। তাই এই সমঝোতা। সে ছেলেমেয়েকে `মানুষ` করেছে। যে ভাবে চেয়েছে সেভাবে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে সুযোগ না থাকায় তাদের ভিনপ্রদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। তবে প্রয়োজনে তারা সবসময় উপস্থিত। তাই তার স্বস্তি যে এই বিচ্ছিন্নতা তার পরিবারকে এখনো সম্পূর্ণ গ্রাস করতে পারে নি। কিন্তু তার বস্তুগত শর্ত তৈরী হয়েছে। এ তো তার স্বেচ্ছা সন্ন্যাস। এর জন্য কাউকে দায়ী করা চলে না। ধীমান বোঝে। এ হ`ল মধ্যযুগীয় জীবনবোধ থেকে আধুনিক, আধুনিক থেকে আধুনিকোত্তর জীবনবোধে উত্তরণ। কাউকে কাউকে দেখা যায় উদয়নের পথে। সভ্যতার উদয়ন ! আকাঙ্খার অপমৃত্যু।
পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। এখন বাড়িটা প্রায় জনশুন্য। বৃদ্ধাবাস। বাড়ির বারান্দায় রোদের আনাগোনা বন্ধ। শৈশব উধাও। যৌবনের দ্বীপান্তর। বৃষ্টিতে বন্যা বয়ে গেলেও মাঠগুলি আর পুকুর হয় না। বৃষ্টির জল নিকাশি পথ ধরে বেরিয়ে যায়। ভাসে পেছনে দূরে কোথাও নিম্নাঞ্চল। ইটের দেওয়ালের আড়ালে সূর্য মুখ লুকায়। ঘরে রোদের প্রবেশ নিষেধ।
ধীমান লেখনী ধরে। কম্পিউটারে লিখে চলে :
সকালে বিছানায় শুয়ে
মটকা মেরে পড়ে
কোথায় গেল সে !
নেই কেন পাশে !
কে যেন কাঁদে,
দেখি চোখ খুলে
রোদটা পর্দার ওপাড়ে
ফাঁসিতে ঝুলে
ঢ্যাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে।
চারিদিকে বহুতল বাড়িগুলো স্পর্ধায় দাঁড়িয়ে। ধীমানদের শাসনে রাখে। যেন রোদের তাপ না লাগে। স্যাঁৎ স্যাঁৎ-এ ঘরে দোতলায় ধীমান কর আর তার স্ত্রী। নিচে ওপরে আর দুই ভাই। সেই যৌথ পরিবার ভেঙে আজ সমবায় পরিবার। পিতৃদত্ত বাড়িটাই সমবায় সংস্থার পুঁজি। সাধারনের জমি। যে যেমন চাষ করে তেমন তার চলন বলন। কারও ব্যাপারে কেউ খুব একটা নেই। একটা ছাদের তলায়। তাও যে যার। বাড়িটা না থাকলে নিশ্চয় যে যার পছন্দ মত জায়গায় ফ্ল্যাটে থাকত। ন্যূনতম যোগসূত্রটাও থাকত কি না সন্দেহ। এরই মধ্যে ধীমান কর আলোর স্পর্শ পায়। তার আর অন্য দু ভাই অন্যত্র ফ্লাট নিয়ে থাকে। তারা পৈতৃক সম্পত্তির অংশীদারিত্ব দাবি করে ধীমানদের পথ দেখিয়ে দেয় না। সেখানে সে নিজেদের পরিবারের পারস্পরিক বন্ধনের একটা রেশ খুঁজে পায়।
বেলা হয়েছে। কারও তেমন কাজ নেই। সময় কাটে না। কাটাতে হয়। বিরাম বসে কম্পিউটার নিয়ে। আর সুকন্যা গল্পের বই নিয়ে। কাজতো নয় অকাজ। বিরাম বলে :
— — — -একটু কফি করে খাওয়াও না ! অনুরোধের সুর। সুকন্যা বোঝে অনুরোধের সুরে আদেশ। সে বলে,
— — — দেখছো না আমি বইটা পড়ছি। নিজে উঠে ইলেকট্রিক কেটলিতে জল বসিয়ে দাও না। বসে বসে আদেশ না করে পেছনটা ওঠাও।
— — — কোথায় আদেশ করলাম ! এটাতো অনুরোধ মাত্র। আমি কাজে ব্যস্ত। তোমার হাত খালি। তাই বলা। না পারলে দিও না। বিরাম গুম হয়ে যায়। সুকন্যা বই ফেলে রান্নাঘরে ঢোকে। ধীমানের মাথার ওপর সাবেকি আমলের ঘড়িটা। সেই কবে বারোটা বেজে থেমে গেছে ।
ধীমানের পুত্র মধ্যে মধ্যে আসে। তার ইচ্ছে বাবা-মা তার সঙ্গে ভিন প্ৰদেশে গিয়ে বাকি জীবন কাটায়। ধীমানের তাতে মত নেই। আবার উচ্ছেদ ! দেশ ভাগের সেই উচ্ছেদের মর্মান্তিক স্মৃতি ফিরে আসে। এখানে পৈতৃক বাড়িতে অতীতের স্মৃতিটা বেঁচে থাকে। চেনা পরিবেশ চেনা মহল্লা। ঘর থেকে বেরোলেই পরিচিতজন। এক ধরনের উত্তরাধিকার। ছেলে বলে এ বাড়িতো সবার। যার যার পাওনা বুঝিয়ে দিতে হয়। ধীমান যৌথ পরিবারের উত্তরাধিকারটা আঁকড়ে ধরে। ছেলের কথা মানে না। ভাইরাতো দাবি করে নি। আর সেতো তাদের ভাগাভাগি করে যার যেটা পাওনা সেটা নিয়ে নিতে বলেছে। তাদের ভাগে একটা ঘর পড়লেও সেটাই তাদের দুজনের চলে যাবে। পৈতৃক বাড়িটাতো বাঁচবে। অন্যত্র থাকা ভাইরা এ ব্যাপারে উৎসাহী নয়। কিন্তু আজ ধীমানরা চলে গেলে সেটা প্রোমোটারের পেটে যাবে। প্রোমোটারকে ঘেঁষতে দিতে তার মন চায় না। অনেক প্রোমোটার আবেদন করেছে। সে রাজি হয় নি। ধীমান এখানেই বাকি জীবন কাটাতে চায়। এরই মধ্যে বছরে একবার ছেলের ওখানে মাস দুয়েক আর মেয়ের ওখানে গরমটা কাটাবে। এখানেই বন্ধু প্রিয়জন নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবে ইচ্ছে। ছেলে কি আর করে। মেনে নিতে হয়। আর সত্যি-ই ত ভিন প্রদেশে বাবা-মা সঙ্গীহীন হয়ে পড়বে।
কিছুদিন হল ধীমান গত হয়েছে। পুত্র কন্যা দুজনেই এসেছে। মায়ের সঙ্গে বসে কথা হচ্ছে। দুজনেই মাকে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু এখানে মা তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে। ধীমানের মত তার কাছেও এ বাড়ি একটা স্মৃতস ভরা ঐতিহ্য। এ পাড়ায় তার বাপের বাড়ি। সেই শিশু বেলা থেকে, ধীমানদের আগে থেকে তার এখানে আশ্রয়। এ পল্লীর সেই পুরোনো স্মৃতি। আসে পাশে ভাই বোনেরা এ পাড়ায় ওপাড়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। বন্ধু বান্ধব অনেকে। কিন্তু ছেলে মেয়ে নাচার। মাকে নিয়ে যাবেই। মায়ের মন চায় না। আর ধীমানের স্মৃতিও তার স্মৃতিতে ঘোরাঘুরি করে।
তিনজন কথা বলছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। কুরিয়ারে চিঠি এসেছে। যেন একটা আদেশনামা নিয়ে। ছেলে উঠে গিয়ে আদেশ নামাটা নেয়। ভালো করে পড়ে। পরের প্রজন্মের কেউ একজন জানিয়েছে বাড়িটা যৌথ সম্পত্তি, সবার পাওনা। ভাগ করে দিতে হবে। ধীমান বিষয়টা আগে বহুবার তুললেও ভাইরা গুরুত্ব দেয়নি। আজ পরের প্রজন্মের কেউ সেটা দাবি করছে। সেটাতো স্বাভাবিক। ছেলে মাকে বলে, “দেখো মানুষ যাযাবর জাতি। অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের সন্ধানে আজ এখানে কাল সেখানে“। মাকেও মেনে নিতে হয়। ঠিক হয় মাকে নিয়ে তারা চলে যাবে। ওদিকে প্রোমোটারের হাতছানি। মনে পড়ে এক প্রোমোটার বলেছিলো, ” দেখব আর কদিন বাড়িটাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন”।
মালিকানা
দু কামরার ছোট ফ্ল্যাট শহরতলিতে। থাকে সুখেন বোস স্ত্রী বাচ্চা মাকে নিয়ে। বাবা মারা গেছেন অনেকদিন। মা অসুস্থ। মেয়ে বছর পাঁচেকের। সুখেন সওদাগর অফিসে কাজ করে। স্ত্রী ঘর সামলায়। সুখেন কাজের চাপে ঘরে বেশি সময় দিতে পারে না। মেয়েটি স্কুলে প্রথম শ্রেণীর ছাত্রী। সুখী ছোট পরিবার। হেসে খেলে চলছিল। কিন্তু হঠাৎ যেন সব বন্ধ । মেয়ের স্কুল নেই নিজের অফিসের কাজ বাড়ি থেকেই করতে হয়। বাইরে বেরোন বন্ধ। যতটুকু বাজার করা বা অন্য প্রয়োজনে না গেলে নয়। এতদিন স্ত্রী নয়না বাজার করত। এখন সুখেনকেই করতে হয়। স্ত্রী রান্না ঘর মোছা কাপড় কাঁচার কাজ করে। তাছাড়া আছে মেয়ে ও মাকে দেখার ভার। কাজের যে মেয়েটি ছিল তার আসা বারণ।
কোথা থেকে যে করোনার হানা সব স্তব্ধ করে দিল। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয় দরজা জানালা দিয়ে কখন ঘরে ঢোকে! তারপর শরীরে তো ছিদ্রের অভাব নেই। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মনের ছিদ্র। সামাজিক দূরত্ব। কেউ যেন স্পর্শ না করে। যে যার নিজের। অন্যের সংস্পর্শ বিপদের কারণ। এক মহাভয়। মহামারি। রোজ আক্রান্ত আর মৃত্যু বেড়ে চলেছে। এটা শুধু এই বোসবাড়ি নয় সারা পৃথিবীর চেহারা। সত্যিকারের বিশ্বায়ন। করোনার বিশ্বায়ন। গরিব বড়লোক সব একাকার। করোনা ঘোর সাম্যবাদী। কাউকে রেওয়াত করে না। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান। সবার জীবন যাপনটা খেয়ে পরে টিকে থাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে । গাড়ি থাকলেও তার ব্যবহার নেই, মলে গিয়ে কেনাকাটা বন্ধ হোটেল রেস্টুরেন্টে খাওয়া ফুর্তি বন্ধ। আরো মুশকিল বাচ্চাদের নিয়ে। তাদের খেলাধুলো বন্ধ। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই মোবাইল ল্যাপটপে দক্ষ হয়ে উঠছে। ফেসবুক হোয়াটস আপে নেশা চেপে বসছে। এটাই আজ জীবন। ডিজিটাল জীবন।
এই অসহায় জীবনের মধ্যেও বাড়ির গিন্নিরা নতুন একটা জীবনের স্বাদ পাচ্ছে যেন। করোনার আগে কেউ অফিস কেউ স্কুলে গেলে সারাদিন তারা বাড়িতে একা থাকতেন। ঘরের সব কাজ কাঁধে। নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে একা সংসারের বোঝা টানতে হয়। সারাদিন কাজ কিন্তু তার মধ্যেই এক নিঃসঙ্গতা, গৃহস্থালির নিঃসঙ্গতা। আজ সেখানে স্বামী মেয়ে ছেলে সারাদিন সঙ্গে। ভরা সংসার। পরিবারের বন্ধনটা যেন এক আনন্দলোক। এতদিন পুরুষরা মনে করত বাড়িতে স্ত্রীদের বেশ মজা। কত বিশ্রাম। আর তাদের কত ঝামেলা। বিশ্রাম নেই, বাসে ট্রামে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাতায়াত। রোজগারের ধান্দা। কিন্তু কয়েকদিন বাড়িতে থেকে বোস বাবুরা বোঝে ব্যাপারটা তা নয়। চোখে আঙুল দিয়ে করোনা দেখিয়ে দেয় কত ধানে কত চাল। সুখেন বাবু সব দেখে বোঝে ঘরের কাজে হাত লাগানো দরকার। স্ত্রীকে সাহায্য করার হাত বাড়িয়ে দেয়। এটা করোনার অনুগ্রহ নয়নার মত বিশুদ্ধ গৃহিনীর কাছে। সেখানেই তারা যেন আকাশে নিজেদের ভাগটা পায়। জানলা দিয়ে দেখে আজ আকাশ পরিষ্কার। সন্ধ্যায় তারাগুলো কি উজ্জ্বল। জ্যোৎস্নার উদ্ভাসিত আলো বারান্দা হয়ে ঘরে। মনের কোণে উঁকি মারে। রাতের শয্যা ডাকে। সংসারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এই স্বামীস্ত্রী ভাগ করে সংসার চালাবার আনন্দটা আগে এরা পায় নি। তাই এত আতঙ্কের মধ্যেও করোনাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
নয়নার ফুরফুরে মেজাজ। সামনে বসার ছোট্ট ঘরটায় সুখেন মোবাইল হাতে। রান্না হয়ে গেছে। এখন একটু বিশ্রাম। আর আজকাল সুখেন স্নানের সময় কাপড় কেঁচে দেয়। মেয়ে বসে গেছে অনলাইনের স্কুলে। নয়নার কবিতা লেখার ঝোঁক। করোনা যে সুখবার্তা এই দুর্যোগের মধ্যে তার কাছে পৌঁছে দিয়েছে তা নিয়ে সে স্বামীকে তার কবিতার একচ্ছত্র শোনান:
আগে কখনও আমি
ভাবিনি কি আনন্দ ঘরে
প্রিয়জনের মধুর মিলনে
নিভৃত একান্ত আশ্রয়ে
কি মধুর ভালোবাসার ছোঁয়া
দোলা লাগে আমার অন্তরে।
স্ত্রীর এই উৎফুল্ল মনের ভাগিদার সুখেনও। সে ভাবে স্ত্রীকে এত স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে আগে সে দেখেনি তো। তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয় স্ত্রীর আনন্দ গুঞ্জন। সে পরিবারের এই পরিবেশটাকে উপভোগ করে। এর মধ্যেই এতদিনের অভ্যস্ত বাইরের জীবনটা তাকে টানে। সেখানেও যে খোলা মুক্ত জীবনের একটা আনন্দ আছে সেটা সে বোঝে। কিন্তু তাসত্ত্বেও এই সামাজিক দূরত্বের ব্যাপারটাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। রোগএর হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা সে তো পূরণ চলতি প্রথা। নতুন কিছু না। মনে আছে ছোটবেলায় পক্স হলে রোগীকে আলাদা করে দেওয়া হত। তার সংস্পর্শে অন্যদের হত। আর স্মল পক্স কলেরা সে তো প্রাণ নিয়ে টানা টানি। কিন্তু সামাজিক দূরত্বটা কি। এ যেন অস্পৃশ্যতা! এ নিয়ে যা চলছে মেনে নেওয়া যায় না। কাজের মেয়েটাকে সেইজন্য বিদায় নিতে হল। সুখেন বলেছিল ওদের দিকটা ভেবে সবেতন ছুটি দেওয়া হোক। কিন্তু সেটা কার্যকরী করা সম্ভব হয় নি। কাজের লোক ঢোকাই বারণ। স্ত্রীও তাকে বিনা কাজে বেতন দিতে রাজি নয়।
এমনি করে চলছে। এখন পুরো লক ডাউন। দুধ কাগজ এমন কি তরী তরকারীও ঘরে দরজার বাইরে ঠিক করে দেওয়া লোক পৌঁছে দেয়। সাফাই কর্মীরা ময়লা দরজার কাছ থেকে নিয়ে যায়। আর তাদের পেটের দায়ে করোনার ঝুঁকি নিয়েও বেরোতে হয়। তবে পরিবারের লোকের ভয় তারা করোনার বাহক। সুখেন ভাবে আমরা যে কেউ তো করোনার বাহক হতে পারি। তার কাছে সব গুলিয়ে যায়। ভাবে এই মানুষগুলোর যদি পেটে ভাত থাকত তবে তারাও তো করোনার ভয়ে কাজগুলো করতে অস্বীকার করতে পারত।তারা নিজেদের বাঁচাতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার তাগিদ বোধ করত।তবে তাদের কিভাবে চলত। আর সবাই তো জানে উড়ো জাহাজে উচ্চবিত্তদের দেহ ভর করে এদেশে করোনা আমদানি হয়েছে। অথচ তারা করোনা বাহক হলো, তারাই অচ্যুত! আসলে যার ভাত নেই তার কিছুই নেই। আত্মসম্মান নেই নিরাপত্তা নেই। যাই হোক সুখেনবাবুদের বেশ চলছে খাওয়া দাওয়া আর নিজেদের মধ্যে আনন্দে। এতে নয়না বিশেষ খুশি। তার তো বাইরে জীবন নেই তাই এই বদ্ধ জীবনের কষ্টটা তার নেই। বরং এর মধ্যে সে একটা খোলা জীবনের নতুন স্বাদ পাচ্ছে আজ।
অনেক বেলা হয়েছে। সকালে দুধ আসে। কিন্তু আজ এখনও আসে নি। সুখেন বাবুর আবার দুধ ছাড়া চা চলে না। এদিকে সুখেন বাবুর অফিস থেকে খবর আসে তাদের চাকরি আর নেই। কোম্পানি এ মাসের মাইনে দিয়ে সামনের মাস থেকে তাদের আর দরকার নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে। সে খবরটা নয়না এখনও জানে না। সে দুধ না আসায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সুখেন বলে পাশের ফ্ল্যাটে সৌরভদের বাড়ি থেকে আপাতত দুধ এনে কাজ চালিয়ে নিক পরে সুখেন বেরিয়ে ব্যবস্থা করবে। করোনার আগে এভাবে একে অপরের সাহায্যে হাত বাড়িয়েছে দু পক্ষই। তাই সেটা কোন সমস্যা নয় সুখেন ভাবে। নয়না বেরিয়ে যায় দুধের ব্যবস্থা করতে। সুখেন তখন ফোনে নিরাপত্তা অফিস থেকে জানতে পারে যে এখানে একটা ফ্ল্যাটে করোনা হওয়ায় ভয়ে দুধ দিতে ছেলেটি আসে নি। ইতিমধ্যে কিছুটা অপ্রস্তুত আর যেন বিরক্ত হয়ে নয়না ফেরে। সুখেন ওকে এরকম অবিন্যস্ত দেখে কি হয়েছে জানতে চায়। নয়না বলে সৌরভের মা দরজা খোলে নি। কার যেন করোনা হয়েছে এই ফ্ল্যাটে কোথায় তাই নয়নাকে বিদায় করে দেয়। সে যেন অচ্যুৎ। সুখেনকে এ কথা বলায় সুখেন হাসে। নয়না বিরক্ত হয়ে বলে:
— — — হাসছ কেন?
সুখেন ওকে পাশে বসায়। ঠান্ডা মাথায় বলে:
— — এটাই হবার ছিল। এর জন্য রাগ করার কিছু নেই। আজ আমরা সামাজিক দূরত্বের মধ্যে আছি। শুধু এটা শারীরিক দূরত্ব নয়। একটা মানসিক দূরত্বও যা সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি করে। সেই জন্যই তো কাজের মেয়েকে বারণ করেছি বা করতে বাধ্য হয়েছি। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছি না। ও ভাবছে তোমার করোনা আর তুমি ভাবছ ওর। কাউকে ব্যক্তিগত ভাবে দোষ দিয়ে লাভ নেই।
নয়না কথাটা পুরো মানে না। মনে করিয়ে দেয় সে সৌরভ এর জন্য কত কি করেছে। সুখেন জানে সেটা। কিন্তু এখন যে অবস্থা বদলেছে সেটা আর কে কাকে বোঝাবে? যাই হোক সে জানায় অফিস থেকে খবর এসেছে তার সামনের মাস থেকে চাকরিটা নেই। নয়নার মাথায় হাত। এবার কি হবে। সুখেনের অফিসের ওপর রাগ করে সে বলে:
— — — এ কি? এতদিন অফিসকে দিয়ে গেলে। আজ এই প্রতিদান?
সুখেন বলে:
— — — কোম্পানী জীবনে এটাই নিয়ম। ওটা আমার কোম্পানী আমি ঠিক যেমন কাজের মেয়েটার কোম্পানী।
নয়না বলে:
— — — কাজের মেয়ে আর তুমি এক হল?
সুখেনের উত্তর:
— — — হ্যাঁ একই। আমার কোম্পানী আমার প্রভু আমি যেমন কাজের মেয়েটির প্রভু। যাই হোক আমাদের কিছুদিন চলে যাবে। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে প্রভিডেন্ড ফান্ড আছে। কিছুদিন পর একটা কিছু হয়ে যাবে। আমি ভাবছি ওই মেয়েটির পরিবারটার কি হবে। ওদের যে কিছুদিনও চলবে না। আমি তোমাকে না জানিয়ে দুমাস মাসে ৭৫ শতাংশ মাইনে দিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন সেটা তো আমার পক্ষে আর সম্ভব নাও হতে পারে।
দিদিগিরি
মিত্রবাবুদের ঘোর দুপুর বারোটার পর পাড়ার মোরের আড্ডাটা ছাড়া চলে না। জীবনের সব ক্ষেত্রে ঋতু চক্র কাজ করে। গরম যায়, বর্ষা শরৎ শীত হয়ে বসন্ত আসে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শীতের আক্রমনটাও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। যত বয়স হচ্ছে তত বসন্ত ছোট হয়ে আসছে কিন্তু শীত যেন প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য দুদিক দিয়েই বেড়ে চলেছে। শরীরের তাপ কমলেও গ্রীষ্মের দহন জ্বালাটা অসহ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু আড্ডার ঋতুচক্র নেই। তার বসন্ত যায় না। সে চিরবসন্ত। চিরবসন্ত যদি কারও জীবনে থাকে তবে তা এই আড্ডার। সেই বসন্তের ছোঁয়াতেই আড্ডার বুড়োগুলো যেন চনমনে হয়ে ওঠে। নিজেদের জীবনের বসন্তের দিনগুলো স্মরণ করে। জীবনের বিভিন্ন ঘটনা উঠে আসে আলোচনায় । মজলিস জমে ওঠে। তারা অতীতচারি হয়ে পরেন। আড্ডার বিষয়ে চাল থাকে না, বেচাল হয়ে যায়। ওদের আলোচনা শুনে পাশ দিয়ে যাওয়া কিশোর কিশোরী যুবক যুবতীরাও লজ্জা পায়। কিন্তু বুড়োদের লজ্জা নেই। একদিন মিত্রবাবুর স্ত্রী তাঁকে বলেন:
— — — — কি সব আজে বাজে আলোচনা হয় তোমাদের আড্ডায় ! মেয়েও লজ্জা পায়
— — — — মেয়ে কেন শুনতে যায় বড়দের কথা ! আর মায়েদের রসকষ ফুরিয়ে গেলেও আমাদের তো কিছু অবশিষ্ট আছে। মিত্রবাবু রসিকতা করার চেষ্টা করেন বুঝে স্ত্রী আর কথা বাড়াননা। আবার কি বলতে কি বলবেন।মেয়ে পাশের ঘরে।এসব লোককে না ঘাটানোই ভালো।
আজ রোদটা পূর্ণ মাত্রায় পেকেছে। ঘামের সঙ্গে দহন জ্বালা। লু চলছে যেন। আবহাওয়া অফিস থেকে দুদিন ধরে এর বিরুদ্ধে সাবধান বাণী শোনাচ্ছে। জানা যাচ্ছে আজকের গরম গত পঁচিশ বছরে সব থেকে বেশি। আড্ডার সময় হয়ে এল। স্ত্রী অফিস গেছে। মেয়ের কলেজ নেই তাই ব্যাঙ্কের কাজ সারতে গেছে। ও একটা কলেজে পড়ায়। বাড়িতে ওই অভিভাবক। ওর অভিভাবকত্বে বাবা মা দুজনেরই প্রানান্ত। বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া হলে ও সালিশীতে বসে। কার কি অন্যায় বোঝাতে বসে। বোঝে না যে এটা বিবাহিত জীবনের অঙ্গ। বাবাকে এই গরমে বারণ করে গেছে কিন্তু নিজে বারণ করা সত্ত্বেও বেরোল। না গেলে নাকি তার চলবেই না। সবাই বলে বাপকা বেটি। একবার যা ভাববে তা করা চাই। অথচ অন্য সবাইকে “এটা কোর না ওটা কর“ নির্দেশ। কলেজে পড়ানোর মেজাজটা এখানেও। মিত্রবাবু জানেন আজ বেরোলে ঘরে কুরুক্ষেত্র । ও বাবার আড্ডায় যাওয়াটা যে পছন্দ করে না তা নয়। বরং বলে ঘরে বসে আর কি করবে, আড্ডায় যাও, সেটাই ভালো। মন ভালো থাকবে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রম। মিত্রবাবু ভাবেন উনি যদি আজ বেরোন তবে মেয়ের সর্দারি করার কিছু থাকবে না কারণ সেও বাবার কথা না শুনে বেরিয়েছে। তবে ওর একটা যুক্তি থাকবে। বাবা বেরিয়েছে অকাজে আর মেয়ে বেরিয়েছে কাজে। আর দুজনের বয়সতো এক নয়। একজন সত্তর বছরের বুড়ো আরেকজন মাত্রই ত্রিশ বছরের তরুণী। সুতরাং যুদ্ধের মযদানটা তৈরী হবে বাবা বেরোলে তাতে সন্দেহ নেই। তবে সে ময়দানতো তৈরিই। যুদ্ধটা রোজের ব্যাপার হয় মায়ের সঙ্গে না হয় বাবার সঙ্গে। এইতো সেদিন বিয়ে করতে বলায় কুরুক্ষেত্র বাধল। কি আর করা যাবে !
মিত্রবাবু এই গরমে বেরোবেন না বেরোবেন না করেও ঘরে চাবি দিয়ে নিচে নেমে আসেন । অভ্যেসমত নিচে ভাইয়ের ঘরে চাবিটা রেখে পা বাড়ান আড্ডার দিকে। সঙ্গে তাঁর সঙ্গী ছাতা। আড্ডায় পৌছে দেখা গেল রোজের মত প্রায় সবাই উপস্থিত। সকলেই গরমে কাতর। তাও আসতে হল । বসন্তের টানে। সত্যিই বসন্ত। আড্ডা শুরু হতেই যেন গ্রীষ্ম উধাও। আজ আড্ডায় নেশা ধরেছে। মদ বা পুড়িয়া নয়, ওতে মিত্রবাবুদের বিশেষ কারও আগ্রহ নেই। যাদের একটু আধটু আছে তাঁরা এখানে মদত পান না। আজকের নেশার উপাদান হ`ল সাম্প্রতিক রাজপটের পরিবর্তন। পরিবর্তনে মিত্রবাবু উৎফুল্ল। দাস বাবু নিরাশ। তবে দাসবাবু নৈরাশ্য প্রকাশ করেন না। কে যেন দাস বাবুকে উস্কে দেওয়ার জন্য বলেন :
— — — — কি হ`ল, অস্ত গেল ! সূর্যকে আকাশে বসিয়ে দিলেও তিনি থাকতে চাইলেন না। উদয় হলে তো অস্ত যেতেই হয়। দাসবাবু জানেন এটা আজ তাঁর দিন নয়। এতদিন অনেক বলেছেন এখন তাঁর শোনার পালা। তিনি ভেতরে ভেতরে ক্ষেপে আগুন কিন্তু তা চেপে রেখে বলেন :
— — — বাজে বোক না। দুদিন হল এসেছ তাতেই গান শুরু হয়ে গেছে, কাজ করব কি করে, সব লুঠে নিয়ে গেল। আরে কোন বাপের বেটা ভারতে একনাগারে পয়ত্রিশ বছর রাজত্ব করেছে ? রাযবাবু একটু খোঁচা দিয়ে বলেন
— — — ওটা পয়ত্রিশ নয় চৌত্রিশ
— — — ওই হলো। এরই মধ্যে কাঁদুনি শুরু হয়ে গেছে কাজ করব কি করে, ওরা লক্ষীর ভান্ডার লুঠে নিয়ে গেল। আরে লক্ষীর ভান্ডার ছিল বলেইতো সেটা লুঠ হল। আজতো লক্ষীই তার ভান্ডার নিয়ে পালিয়েছে। আরে পাঁচ বছর টেঁক, তারপর কথা বলিস।
— — — লুটে পুটে নয়ত কি ? প্রচার করে বেরালি সবেতে প্রথম, তবে এখন লাস্ট কেন। বললেন ব্যানার্জি।
পর্দা চড়ছে, আড্ডাটা জমে উঠেছে। পাশে বসা মজুমদার বাবু কোনুই মেরে মিত্রবাবুকে বলেন:
— — — — ওই দেখ কে আসছে
মিত্রবাবু দেখে একটু অপ্রস্তুতে পড়েন, কি হলো এখানেই হুজ্জুতি বাধাবে নাকি। মেয়ে আসছে। বোধহয় গরমে বেরিয়েছেন বলে ও তেতে গেছে। এখানে সবাই ওকে স্নেহ করে। যদি যুদ্ধ বাঁধায় তবে সবাই ওর সেনাপতি হয়ে যাবে। একা লড়বেন কি করে? ভাবতে ভাবতে মেয়ে হাজির। একটু ইতস্তত হয়ে আগ বাড়িয়ে মিত্রবাবু বলেন :
— — — — এইতো বাড়িতে একা, ভালো লাগছিল না তাই এলাম। দেখতো গাছের নিচে কি হাওয়া। সবাই এসেছে দেখ। মেয়ে বলে:
— — — কে কৈফয়েত চেয়েছে। তোমরা জাহান্নামে যাও। মজুমদার ফোড়ন কাটে
— — — পাগলি দেখ, আমরা বলছিলাম এই গরমে বেরলি কেন ? ছোটবেলা থেকে কাকুরা ওকে পাগলি বলেই ডাকে । মজুমদার শয়তানটা নাম দিয়েছে। রীতা উত্তর দেয়
— — — তা তোমরা বেরিয়েছ কেন ?
— — — আমাদের বাড়িতেতো তোর মত একটা পাগলি মেয়ে নেই । আজ কোথায় মেয়ের ছুটি, তার সঙ্গে বসে গল্প করবে না এই গরমে বেরোনো চাই। মজুমদার ওকে তাতিয়ে দেন । রীতা রেগে যায়, বলে
— — — দেখো ফালতু কথা বোল না, আমি কাজে এসেছি।
— — — কি কাজ সেটা বল। কেউ বাড়িতে এসেছে নাকি? জানতে চান মিত্রবাবু
— — — না, তোমরা আমার সঙ্গে চল
— — — কেন কোথায়?
— — — ব্যাঙ্কে। চল, চল বলছি। এত ব্যাখ্যা দিতে পারব না। মিত্রবাবু একটু ব্যস্ত হয়ে পড়েন, যা ঠোঁট কাটা মেয়ে ! আবার কাকে কি বলে বসলো ! নাকি ব্যাঙ্কের সামনে যে চ্যংরাগুলো বসে তাদের সঙ্গে লাগলো।
— — — সবাইকে যেতে হবে? বলত মালপত্র নিয়ে যাই। শিক্ষা দিয়ে দেব। ঠাট্টা করে জানাবাবু বলেন ।
— — — ও! তোমাকে কে বাঁচায় তার ঠিক নেই, তোমার মুরদ কত জানা আছে। কথাটা রীতা খুব ভুল বলেনি। জানা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভিতু। কোন গোলমাল দেখলে পিঠটান দেয়।
— — — দেখো তোমরা কিন্তু দায়িত্ব এড়াচ্ছ। না গেলে বল আমি যাচ্ছি। রিতা যেন আরও বিরক্ত হয়।
— — — কিসের দায়িত্ব কি ব্যাপার কিছুই বুঝলাম না আর তুই আমাদের দোষ দিচ্ছিস? কোথায় যাবি চল। মজুমদার বলে।
সবাই ওঠে। মিত্রবাবু বলেন সবাই এভাবে যাওয়া ঠিক নয়। চল মজুমদার, আমরা দুজন যাই আগে দেখি ব্যাপারটা কি।
রিতা রওনা দিয়ে দিয়েছে, আমরা ওর পেছন পেছন যাই। ও প্রায় ছুটছে। যেন সামরিক বাহিনীর জোয়ান। মজুমদার বলেন :
— — — — দেখো কোথায় কি হোল, ওকে বিশ্বাস নেই। মনে আছে একটা ছেলেকে কেমন ঠাসিয়ে দিয়েছিল ওর পেছনে লাগার জন্য।
— — — সেটাইতো ভয়।
— — — তারপর থেকে ওর পেছনে কেউ লাগে না। সব মেয়েরা এরকম হলে রাস্তাঘাটে ওদের আর ভুগতে হয় না। মিত্রবাবু একটু শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। কি জানি কি হল!
তারা ব্যাংকের দরজায় চলে আসে। সেখানে গিয়ে ঢোকে । মনে হল কর্মচারীরা সবাই যেন রিতার জন্যই অপেক্ষা করছে। সামনে বসে এক বৃদ্ধ। উঠে এসে রিতার হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। মিত্রবাবুরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করেন। কি হল রে বাবা ! কিছুই বোঝেন না। কোন ডাকাতি টাকাতির ব্যাপার নাকি ! মজুমদার এগিয়ে যান ভদ্রলোকের দিকে। রিতাকে বলেন
— — — কিরে কি হল ? ভদ্রলোক নিজেকে সামলে বলেন
— — — এই মেয়ে ছিল বলে আজ আমি বাঁচলাম। মজুমদার বলেন
— — — কেউ কি ছিনতাই করতে এসেছিল? বৃদ্ধ বলেন
— — — সেটা হলে তো একটা কথা ছিল। যেটা হয়েছে সেটা আমার কাছে খুব লজ্জার ব্যাপার। আমার ছেলে, বলি কি করে ! উনি আবার কেঁদে ফেলেন। মিত্রমশাইরা ভাবেন কি জানি উনার ছেলে রিতার সঙ্গে কোন অসন্মানজনক ব্যাবহার করলো কিনা। তবে ছেলে আসেপাশে কোথাও আছে বলেতো মনে হচ্ছে না। এসবের মধ্যে ব্যাঙ্কের একজন বয়স্ক কর্মচারি এসে বলেন:
— — — উনার ছেলে উনাকে উনার জমানো পাঁচ লাখ টাকা তাকে লিখে দিতে বলে। ভদ্রলোক সেটাতে রাজি না হওয়ায় ও জোর করতে থাকে।কথাকাটাকাটির পর সুপুত্র বাবাকে মারতে থাকে। তখনই ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে ছেলের গালে এক চড় মেরে উনাকে ছাড়িয়ে নেন। আমরা সবাই মিলে তখন ছেলেটিকে ঘাড় ধরে বার করে দিই। ধন্যি মেয়ে।আমরা যেটা পারিনি ও সেটা করলো। রিতা যেন একটু লজ্জা পেল। ও বলে,
— — — ওসব কথা থাক। মেসোমশাই-এর একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। উনি বাড়ি যেতে ভরসা পাচ্ছেন না। মজুমদার একটু উচ্ছসিত বোধ করেন। বলেন
— — — সেটা এমন কোন ব্যাপার নয়। আমার বাড়িতে না হয় থাকবেন। আজ থেকে তোর মেসোমশাই আমাদের আড্ডার ক্লাবের সদস্য। রিতা তুই বাড়ি যা। হ্যা মাকে বলিস রাতে মাংস ভাতের ব্যবস্থা করতে। সবার জন্য কিন্তু। তোর অনারে। টাকা দেবেন তোর মেসোমশাই। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলেন:
— — — কি রাজি তো।
রীতা টিপ্পনি কাটে
— — — এটা তোলাবাজি হয়ে যাচ্ছে না ! সবাই হেসে ওঠে। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে রিতার মেশোমশায়ায় I
ফিরে দেখা
০৭/০৪/২০২১
ভদ্রলোকের নাম রূপক। বয়স পঁচাত্তর ঊর্ধ্ব। পুরো নাম রূপক সুর। এই পল্লী অঞ্চলে বাস প্রায় ত্রিশ বছর। অবসরের বেশ কিছুদিন আগেই এখানে ঘর বেঁধেছে। ইচ্ছে ছিল ছিমছাম শহর থেকে দূরে এখানে পরিবার নিয়ে থাকবে। পরিবার বলতে স্ত্রী এক মেয়ে আর এক ছেলে। সঙ্গে বাবা মা থাকতেন। আজ তাঁরা আর নেই। ছেলে মেয়ে দুজনেই প্রবাসী। তাই পরিবারটা বহরে কমতে কমতে দু’য়ে দাঁড়িয়েছে। দুজনেই এত বড় বাড়িতে। তার মধ্যে বছরে কিছুদিন ছেলে মেয়ের ওখানে। এখানে এখন এক একাকীত্বের জীবন।
রূপকবাবু ছিমছাম মিশুকে আড্ডাবাজ মানুষ। সরেস চরিত্রের। এককালে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আর অত্যাচার সহ্য করতে হত স্ত্রীকে। তিনি সেটা চিরকাল হাসিমুখে মানিয়ে নিতেন। এখন বয়স হয়েছে। বন্ধুবান্ধব অনেকে বিদায় নিয়েছে। কেউ কেউ আর বেরোতে পারে না। আড্ডাটা আর সেরকম নেই। কেউ কখনও আসে। রূপকবাবুও এর তার বাড়ি মাঝে মধ্যে যায়। তবে একান্তই অনিয়মিত। ফোনেই কাজ সারে। লেখালেখি নিয়ে সময় কাটে। তাও হাতে অঢেল সময়। তাই সময় কাটে না। এ ধরণের আড্ডাবাজ মানুষের জীবনে আড্ডার সংস্থানটা উঠে গেলে একাকীত্ব বোধটা যেন আরও চেপে বসে। মনটাও খিঁচড়ে থাকে। আর স্ত্রীর সঙ্গে কত আর কথা? সবটাই যেন একঘেয়ে হয়ে ওঠে। কখনও সখনও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বন্ধু এলে ভালো লাগে সময় কেটে যায়। স্ত্রীও সেটাতে আনন্দ পায়।
এই বয়সে সবাইকে বোধহয় অতীতটা টানে। অতীতের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে যেন মানুষ নিজেকে ফিরে পেতে চায়। রূপকবাবুর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কেন হবে! সেও মধ্যে মধ্যে অতীতচারিতায় মগ্ন হয়ে পড়ে। বিস্মৃতির সমুদ্রের অতলে যেন তলিয়ে যায়। খুঁজে ফেরে সমুদ্রের অতলের রত্ন ভান্ডার। আর ওর ঘটনাবহুল জীবনে আজ অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও স্মৃতির বৈঠা বেয়ে যতটুকু হাজির হয় তা নেহাৎ কম নয় বরং বৈচিত্রে ভরপুর যেন এক মহাভারত। টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন। বিস্মৃতির অন্ধকার ঠেলে অনেক কিছু পরস্পর পরম্পরায় আলোয় আসতে পারে না বলে ঘটনাগুলো যা ভেসে ওঠে মনসাগরের ওপরের স্তরে সেগুলো ছিন্ন ভিন্ন । পরস্পরকে একটা গ্রন্থিতে বাঁধা যায় না। তাই সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ভেসে ওঠে। এরই মধ্যে কিছু স্মৃতি পরস্পর পরম্পরায় মনোজগতে ভেসে ওঠে, স্নায়ুর প্রাঙ্গনে খেলা করে। সেগুলো নিয়ে সময় কাটে ভালো।
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ কৌশিকের সাথে। সেটা কর্মজীবনে দুজনের কর্মক্ষেত্র আলাদা হওয়ায় কিছুদিনের জন্য শিথিল হয়ে পড়েছিল। আজ এই শেষ বয়সে আবার ভালো করে ঝালিয়ে নেওয়া গেছে। অন্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ। এছাড়া আছে বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের বন্ধু। পাড়ার ছেলে বুড়োরা। তবে আজকাল বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোন হয় না বলে সকলের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হতে বসেছে। এটা হয়েছে আরও প্রযুক্তিতে অনুরাগ থেকে যা মাদকতা বা addiction এর জন্ম দেয়। আজ সামাজিক সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা এনে প্রযুক্তির কল্যাণে হোয়াটস আপ এ যোগাযোগ কথপোকথন আড্ডা। তাই মনে হয় প্রযুক্তি দিয়েছে যত কেড়েছে তার থেকে বেশি। যেন রূপকবাবুর মত মানুষের মননটাই একটা ভিন্ন স্রোতে প্রবাহিত হয় এখন। আর গত প্রায় দেড় বছর করনাকালে এটা এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। সমাজের গঠন প্রক্রিয়াটাই যেন বদলে যাচ্ছে। রক্ত মাংসের প্রাণ স্পন্দনের জায়গায় গেড়ে বসতে চলেছে যন্ত্রের কম্পন, যেন এক নতুন স্পন্দন যেখানে প্রানের স্পন্দনটা আগের মত অনুভূত হয় না। তবে নেশার আচ্ছন্নতা জীবনকে ধোঁয়াশা করে তুলেছে। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে নয় যন্ত্রের মুখোমুখি হয়ে তার সঙ্গে নির্বাক আলাপেই যেন জীবন অতিবাহিত হয়। মানুষের সঙ্গে মুখোমুখিতে যে প্রানের স্পন্দন এতদিন সে অনুভব করত সে সম্পর্কে রূপকবাবুর অনুভূতিটা:
বয়ে চলে বুকের অলিন্দে
স্রোতস্বিনী নদী
থৈ থৈ তার কলতানে
সুখের ডিঙা বেয়ে।
আজের পরিবর্তন সম্পর্কে তাঁর মনে হয়:
সেই নদী শ্রোতহারা আজ
একাকিত্বের পলি জমে
হালে পানি পায় না আর
পাল হারা সে ক্রমে।
হৃদয়ে আমার গভীর ক্ষত
রক্ত ঝরে তাতে
রক্তের নদী বয়ে চলে
তুফান ওঠে প্রাতে।
এই যে যন্ত্র নিয়ে এই মাদকতা আজ করোনা কালে, যে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেটাই যেন রূপকবাবুর ওপর চেপে বসতে সাহায্য করেছে। সে অনুভব করে যেন অজানা এক আতংক সবাইকে তাড়া করে বেড়ায়। কেউ আর চায় না একজন আরেকজনের বাড়িতে আসুক পাছে করোনা সঙ্গে আসে। সে আরও বোঝে এখন যেটা মানুষ ভয়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য করছে সে তাকে অন্য একটা জীবনে অভ্যস্ত করে দেবে। যন্ত্র নিয়ে বসে থাকা মাদক গ্রস্ত মানুষ অন্তর্মুখী হয়ে পড়বে বেরোতে চাইবে না। সামাজিক বিচ্ছিন্নতাটাই তার কাম্য হয়ে উঠবে। এই লক্ষণ রূপকবাবু নিজের মধ্যেও দেখছেন। যেমন ওঁদের একমাত্র স্নেহের বোন যে মাত্র পাঁচ ছ কিল মিটার দূরে থাকে আজ প্রায় একবছর ওর সঙ্গে দেখা হয় না। বা রূপকবাবুর খুব স্নেহের পাত্রী শালী খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকলেও সে তাকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পারে নি। কাছে থাকা সত্ত্বেও তার ছেলে বারণ করার জন্য বাড়িতেও যাওয়া হয় নি। ছেলের দুটি বাচ্চা আছে। তার ভয় কেউ গেলে যদি করনা ঢোকে। তাই মায়ের বেশি কথা বলা উচিত নয় সে যুক্তিতে আত্মীয়স্বজনের প্রবেশও যেন নিষিদ্ধ। আর এই তো সেদিন মেয়ের বাড়ির এপার্টমেন্টে একজনের অনুরোধে রূপকবাবু তাঁর সঙ্গে পরিচিত একজনের ফ্ল্যাটে যায়। দরজা থেকে উনি স্ত্রী অসুস্থ অজুহাতে তাদের বিদায় করেন। রূপকবাবু এটা অনুমান করেছিল ভদ্রলোকের সাম্প্রতিক চলন বলনে। কিন্ত প্রতিবেশীর অনুরোধে যেতে হয়। তাতে তাঁর অনুমানটা সত্য বলে প্রমাণ হয়। ভদ্র সমাজে মানুষের চালচলন আঁচার ব্যবহারে এই যে পরিবর্তন তার জন্য ব্যক্তিবিশেষে কাউকে দায়ী করা যায় না। এ এক সামাজিক মনস্তত্বের পরিবর্তন যা প্রাত্যহিক জীবনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কি জানি এটাই হয়তো নিয়ম হতে চলেছে। সে একটা রোবট চালিত জীবন যেটা নিয়ে পশ্চিমি জগত আজ উত্তাল। সমাজের যে পরিবর্তন যেটা সমাজ জীবনের যান্ত্রিকরনের ফলে নীরবে ঘটে চলেছিল সেটা করোনা আক্রমণে সরব হয়ে ওঠে ত্বরান্বিত হয় আজ ভারতের মত দেশেও। নিন্দুকরা বলে এর পেছনে একটা কায়েমী স্বার্থ কাজ করে।
যাই হোক আজ এটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। প্রসঙ্গক্রমে উঠে এল। পাঠকরা হয়তো একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন। আমরা আমাদের গল্পে ফিরে আসি। সারাদিন কম্পিউটারে মোবাইলে লেখালেখি কিছুটা পড়াশুনার পর রাতে বিছানা নিলে রূপকবাবুর অতীতটা তাঁর স্নায়ুর জগতে হানা দেয়। শৈশবের খেলাঘর থেকে কৈশোর জীবনে বিচরণ তার। কত কথা মনে পড়ে। খেলার মাঠ থেকে লেখাপড়া প্রেম বাদবিবাদ সব কিছু নিয়ে সে যেন এক উপন্যাস। তার মধ্যে জড়িয়ে থাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছোট ছোট টুকরো টুকরো গল্প। এ রকমই একটা গল্প রূপকবাবুর কৈশোরের প্রেম নিয়ে সেটাই যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেই কিশোরীর মুখ। তার নাম গোত্র সবই মনে আছে। মনের বাসরে আজও তার যাতায়াত। ভুলতে চেষ্টা করলেও ভোলা যায় না। বঙ্কিম চাটুজ্জের ভাষায় ‘বাল্যপ্রণয়ে অভিসম্পাত আছে’। সেটা বাস্তবায়িত হয় না। সবার জীবনে কথাটা সত্য না হলেও রূপকের জীবনে সত্য। আর তা নিয়ে যেন এক অব্যক্ত যন্ত্রনা। হারিয়ে গেল সে। রূপক খুঁজে আনতে পারল না। সেটা যেন তার ব্যর্থতা। কেমন যেন একটা হেরো হেরো মনোভাব। একটা হীনমন্য মানসিকতা। হারটাকে আজও মেনে নিতে পারে নি রূপক। আর সেজন্যই বোধ হয় আজও রূপকের মানসে মেয়েটি এত সুন্দরী, আজও ভরা যৌবন তার রূপকের কল্পলোকে। তার দেহের গন্ধ যেন আজও রূপককে আবিষ্ট করে। রূপকের অনুশোচনা যে মেয়েটির সঙ্গে কোনোদিন তেমন ঝগড়া ঝাটি মনোমালিন্য হয় নি তাও বিচ্ছেদ। তার নীরবে আসা নীরবে হারিয়ে যাওয়া। মেনে নেওয়া যায় না। তাও মেনে নিতে হয় বাল্য প্রণয়ে অভিসম্পাত থাকায়। তবে রূপক ব্যর্থ প্রেমিক হলেও দেবদাস হয়ে যায় নি। পরে বিয়ে করেছে সংসার করেছে। হয় তো রবি ঠাকুরের শেষের কবিতার বন্যা ভেবেই রূপক তাকে গ্রহণ করেছে যে তার হৃদসাগরে এক সাগর যে জলে সে আজও সে সাঁতার করে। আর ঘরণী তার স্ত্রী যে ঘরার জল, তাঁর রোজের তৃষ্ণা মেটায়।
শুধু যে প্রেম কাহিনী তা নয় শৈশবের স্মৃতি বালক বেলার গুলি লাট্টু ঘুড়ি আজও রূপককে যেন ইশারায় ডাকে। ফুটবল ক্রিকেট মাঠ। মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি আবার ওদের নিয়ে কত না দুষ্টুমি। মা বাবার দৃষ্টি এড়িয়ে পড়াশুনা ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে বেড়ানো। আর আছে দেশ থেকে উচ্ছেদ হয়ে কলকাতায় কোন এক ফ্ল্যাটে বাবা মা জ্যাঠতুতো খুড়তুতো পিসতুতো ভাই বোনদের নিয়ে জনা বিশেকের যৌথ পরিবার। দাদা দিদিদের কোলে পিঠে বড় হওয়া। সে এক কোলাহল মুখর জীবন যা আজ স্মৃতি। এ ছাড়া আছে তার যৌবনের স্মৃতিকথা। রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন। এই স্বপ্ন রূপকএর জীবনকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। আত্মস্বার্থে নিজের রোজগেরে জীবন নয় পরার্থে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। তাকে নিয়ে গেছে জীবনের অন্য এক প্রাঙ্গণে যেখানে তার কাছে পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। খুব কাছ থেকে সে অত্যন্ত সাধারণ মানুষ তার জীবন যাপন দৈনিক জীবনের টান পোড়েন দেখেছে। তাদের স্বপ্ন স্বার্থক না হলেও তার সেদিনের সেই যৌবন তাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে অনেক। সেই জন্য একই সঙ্গে সে কৃতজ্ঞ সেই জীবনের কাছে যাকে তার সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক জীবন বলা চলে। সময়ের দিক থেকে সেটা সংক্ষিপ্ত হলেও গভীরতার দিক থেকে তা যেন অতল সমুদ্র। এই জীবনের আয়নায় সে তার নিজের জীবনের দুটো সত্তার সন্ধান পায়। তার ভেতরের সত্তা যা তার মননে তার চেতনায় এক আদর্শ মানুষ হয়ে ওঠার তাগিদ অনুভব করতে শেখায়। অপরদিকে ব্যবহার জীবনে আত্মস্বার্থে মগ্ন আরেকটা সত্তা যে নিজেকে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দকে বেশী বোঝে। এ এক দ্বৈত সত্তার একই মানুষ।
সারাদিনের পর আধা ঘুমে আধা জেগে থাকা রূপকের রাত কাটে স্মৃতিচারণে। সকালে আজকাল উঠতে দেরী হয়। পায়ের জোর কমে যাওয়ায় হাটাহাটিতে অনীহা।কোষ্ঠ কাঠিন্যের এক অদ্ভুত কঠিন জীবন। সকালে উঠেই যন্ত্রের মাদকতা তাকে আকৃষ্ট করে। কেউ যদি আসেও তার সঙ্গে কথা বলার চেয়ে মোবাইল বা ট্যাবে রূপক বাবুর উৎসাহ বেশি। স্ত্রী তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে অসামাজিক হয়ে গেছে। যেন আত্মস্বার্থের আমিটা জেগে ওঠে রাতে যে ঘুমিয়ে ছিল। এই ভাবে তার নিজেকে নিয়ে চলে। এ জীবনে না আছে ভাড়ার ঘরে চুরি হওয়ার ভয় আবার না আছে ভাড়ারে কিছু জমা পড়ার সম্ভাবনা। এক নিস্তরঙ্গ জীবন। যেন স্রোতহীন এক মজা নদী।
রূপক সকালে যথারীতি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ মোবাইল জানান দেয় কে তাকে ডাকছে। সে মোবাইলে লেখা বন্ধ করে সে ডাকে সাড়া দেয়। ওপার থেকে কার কণ্ঠস্বর। রূপক চিনতে পারে না। আজকাল ও ভয়ে শিটকে থাকে। কি জানি আবার কোন জালিয়াত জাল পাতে নি তো। এই সেদিন ফাঁদে পড়ে তাকে কিছু গুনাকার দিতে হয়েছে। এটা আজ রোজের ঘটনা। সে লাইন কেঁটে দেবে ভাবতে ভাবতে ওপার থেকে জানান দেয় তার স্কুলের বন্ধু কুণাল তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। এক বন্ধুর কাছ থেকে ওর নম্বরটা পেয়ে ফোন করেছে। কুণাল মানে কুণাল মিত্র। ও পড়াশুনা শেষ করে সেই প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হলো অন্য প্রদেশে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। বোধহয় রায়পুর না কোথায়। তারপর থেকে যোগাযোগ নেই। ওর ফোন পেয়ে রূপক উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। ওরা স্কুল টিমে একসঙ্গে খেলত। মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া সব কথা। কুণালের বাবা মা রূপককে খুব ভালোবাসতো। ওর এক বোন ছিল। রূপকের সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিল। ওকে নিয়ে বন্ধুবান্ধব অনেকের উৎসাহ থাকলেও রূপক যেন ওর অভিবাবক ছিল। ও ডানপিটে ছিল বলে বন্ধুবান্ধব ওকে সমীহ করত। রূপক ওর অভিবাবক তথা দাদা হয়ে একটা আত্মসন্তুষ্টিতে থাকত। ওকে আগলে রাখত। এরকম একজন পাহারাদার পাওয়ায় কুণালের বাবা মাও নিশ্চিন্ত। আর টুম্পাও ওকে ভরসা করত। রূপক এই পবিত্র সম্পর্কে প্রেমের ‘কালিমা‘ যেন না লাগে তার চৌকিদার হয়ে উঠেছিল। তারপর কিছুদিন রূপকের সেই কৈশোর প্রেমকাহিনী যার পত্রবাহক ছিল টুম্পা। যাই হোক উত্তেজিত রূপক মোবাইলে কুণালকে নেমন্তন্ন করে। করোনার বিধিনিষেধে কিছুটা ছেদ টানা হয়। কুণালও আসতে ইচ্ছে প্রকাশ করে। একটা দিন স্থির হয় যেদিন কুণাল আসবে ওর স্ত্রীকে নিয়ে। রূপক কৌশিককেও সেদিন আসতে বলবে বলে স্থির হয়।
রোববার উপস্থিত। কুণাল কৌশিকরা এসেছে। সঙ্গে ওদের স্ত্রীরা। কৌশিকের স্ত্রীকে রূপক আর রূপকের স্ত্রী চেনে। কিন্তু কুণালের স্ত্রীর সঙ্গে ওদের এই প্রথম পরিচয় হয়। রূপকের আর কৌশিকের স্ত্রীর সাথে কুণালের পরিচয় হয়। কুনাল স্কুলের বন্ধু হলেও অনেকদিন হলো স্মৃতির অন্তরালে চলে যায়। এখন চেহারায় চলন বলনে সবারই পরিবর্তন এসেছে। তাই প্রথম দর্শনেই চিনেছে একে অপরকে তা বলা যায় না। সবাই ছোটবেলার বন্ধুকে সেই ছোটবেলার আদলে চিনতে চায়। কিন্তু সময় সেটা হতে দেয় না। তাই মনের মধ্যে উথাল পাতাল সত্বেও সেভাবে নিজের করে নিতে একটু সময় লাগে। মহিলারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে যেমন একটা গ্রন্থি গড়ে তুলতে ব্যস্ত তেমনি পুরোনো বন্ধুরা স্মৃতির অলিন্দ ধরে পঁয়তাল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের দিনগুলো ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয় বিভিন্ন ঘটনা ধরে। আস্তে আস্তে আড্ডা জমে ওঠে। আজ ওরা সবাই একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করবে। কুণাল স্ত্রীকে নিয়ে রূপকের মুখোমুখি। স্ত্রীর নাম কি ওর বাপের বাড়ি কোথায় ওদের বিয়ের বিষয় সব বিষয় আলোচনায় ওঠে। সবাই খুব অল্প সময়ে একে অপরের আন্তরিক হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ঠাট্টা ইয়ার্কি। ছোটবেলায় কে কেমন ছিল এসব আলোচনা উঠে আসে। কুণাল রূপকের শৈশবের প্রেম নিয়ে ঠাট্টা করে। সে কুণালের সেই প্রেমিকাকে চিনত না তবে ব্যাপারটা জানত। এ ছাড়া সবার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনীদের নিয়ে আলোচনা জমে ওঠে।
প্রথম পর্বের আড্ডার পর খাওয়া দাওয়ার পালা। সবাই একসঙ্গে বসে। মহিলারা সবাই পরিবেশনে হাত লাগায়। মাছ মাংস মিলিয়ে জমাটি ব্যবস্থা। রান্না রূপকের স্ত্রীর হাতের। সঙ্গে পরিচালিকা। সবাই রান্নার বিশেষ প্রশংসা করে। কুণাল জানায় ওর স্ত্রীও ভালো উত্তর ভারতীয় খাবার রান্না করে। ও থাকতে থাকতে ওরা যদি কুণালের ওখানে যায় তবে একদিন আবার আড্ডাটা বসতে পারে কুণালের ওখানে মানে কুণালের পৈতৃক বাড়িতে যেখানে কুণালের দাদার পরিবার থাকে। দাদার বউ তাদের ছেলে আর ছেলের বউ। কুণাল জানায় কোন অসুবিধে নেই এ ব্যাপারে। ওর দাদা আর বৌদি ওদের বন্ধুর মত। সবাই রাজি হয়। খাওয়াদাওয়ার মধ্যেই রূপক লক্ষ্য করে কুণালের স্ত্রী যেন ওর ওপর একটু বেশি দৃষ্টি দিচ্ছে। রূপক যতটা পারে নীরব দর্শক। নিজেকে প্রকাশ করে না। ও সাবধান ওর প্রকাশে যেন কোন কৌতূহল না থাকে। আর কৌতূহল থাকবেই বা কেন ? ও তো আগে ওকে দেখে নি। ভাবতে ভাবতে ও একটু অন্যমনস্ক হয়ে ওঠে। খাওয়া পর্ব শেষ হয়। রূপকের অস্বস্তিটা কেউ তেমন টের পায় না। তবে হাব ভাবে বোঝা যায় রূপকের স্ত্রী যেন কিছু একটা ইঙ্গিত পেয়েছে। কি জানি বুড়ো বয়সে আবার ভীমরতি না কি! পরস্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ!
খাওয়া দাওয়ার পর মহিলারা একটা ঘরে চলে যায় বিশ্রাম নিতে। রূপক কৌশিক আর কুনাল বসে বসার ঘরে। ওদের স্মৃতিচারণ আবার শুরু হয়। সেই স্কুল, স্কুল প্রাঙ্গণ। স্কুলের শিক্ষকরা। বালিগঞ্জের তেমন নাম না জানা স্কুল। যাই হোক সে তো নিজেদের স্কুল। সেটা যেমন আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উপাসনাগার তেমনি সেটা বাল্য ও কৈশোরের উপবন। একটা সমাজিকরণের প্রতিষ্ঠান যেখানে সমবয়সীদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয়। পরিবারের বাইরের অভিভাবকদেরও চিনিয়ে দেয়। তাদের স্নেহে শুধু পাঠাভ্যাস নয়, জীবনের মূল্যবোধও তৈরী হয়। এ ব্যাপারে কোন শিক্ষক কেমন ছিলেন তা নিয়ে যে যার মত দেয়। পরিবারের মধ্যেকার বজ্রকঠিন বাঁধুনি স্কুলে বন্ধুদের সান্নিধ্যে অনেকটা আলগা হয়। তাছাড়া এই সময়ে সিগারেট খাওয়া আড্ডা দেওয়ার কু অভ্যাসগুলো তৈরি হয়। আপাত কুঅভ্যাসগুলো জীবনে যে প্রাণশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে সেটা কথায় কথায় ওঠে । আজকের শিশুদের মত পড়ার চাপ তখন ছিল না। প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার পরস্পর প্রতিযোগিতা ছিল না। যতটুকু পড়াশুনা সেটা স্বেচ্ছা কল্প। বাধ্যতামূলক নয়। পাশ করা নিয়ে কথা। তাই একইসঙ্গে খেলাধুলার সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠত। স্কুলে উঠোনে গুলি খেলার রীতি ছিল। টিফিনে সেটাতে বারণ ছিল না। পড়াশুনায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়ার প্রতিযোগিতা না থাকলেও দুষ্টুমিতে প্রতিযোগিতা ছিল। কে কত বেশি দুষ্টু হতে পারে। আর দুষ্টুমির জন্য মাষ্টারমশাইদের ঠিক করে দেওয়া এক এক ধরণের শাস্তি উপহার হিসেবে পাওনা ছিল। হাতে বা পিঠে বেত্রাঘাত, নিলডাউন, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি। আবার কোন কোন শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যারা দুষ্টুমির জন্য নয় শাস্তি দিয়ে আনন্দ পেতেন বলে শাস্তি দিতেন। যারা দুষ্টুমি করার জন্য শাস্তি দিতেন তাদের ওপর রাগটা স্থায়ী হত না। ওটা প্রাপ্য বলে ছাত্ররা মেনে নিত। কিন্তু যারা আনন্দ পাবার জন্য শাস্তি দিত তাদের ওপর রাগটা স্থায়িত্ব পায়। রূপকদের স্কুল পড়াশুনায় সামনের সারিতে না থাকলেও খেলাধুলায় প্রথম সারিতে থাকত। বিশেষ করে ক্রিকেটে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। স্কুল থেকে ভালো ভালো খেলোয়াড় উঠে এসেছে যারা রাজ্যের হয়ে এমনকি দেশের হয়েও খেলেছে। নানা বিষয়ে অতীতচারিতায় সময় কেটে যায়। চা আসে। সবাই চা নিয়ে বসে। স্ত্রীরাও যোগ দেয়। চা খেয়ে এবার ফেরার পালা। ফিরতে না চাইলেও সবাইকে ফিরতে হয়। এর পর কুণালের বাড়িতে দেখা হবে আশা করে যে যার বিদায় নেয়।
সবাই চলে যাওয়ার পর রূপকের স্ত্রী রূপককে নিয়ে ঠাট্টা শুরু করে। জানায় সে লক্ষ্য করেছে কুণালের স্ত্রীর বিশেষ নজর ছিল ওর ওপর। আর কুণালের চোখেও এক বিস্ফোরণ। কি ব্যাপার বুড়োবয়সে পরস্ত্রীকাতরতা। কুনাল ঠাট্টা করে বলে বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্ক অস্বাভাবিক কি? ওর ভেতর একটা পৌরুষ আছে বলেই তো ওর প্রতি মহিলাদের আকর্ষণ। এটা তো নতুন কিছু না। রূপক এটাও জানায় যে কুণালের স্ত্রীর সঙ্গে আগে ওর পরিচয় ছিল না । এই প্রথম। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে তার কৈশোর প্রেম সম্পর্কে রূপক নিজেই তার স্ত্রীকে জানিয়েছিল। সেটা তুলে খোঁটা দিতে মিতা তাকে ছাড়ে না।
রূপকের এই আড্ডার পর কেমন যেন পরিবর্তন আসে। সে যেন তার পুরোনো সত্তাটা ফেরত পায়। দুদিন মোবাইলে কোন কাজ করে না। পাড়ার পুরোনো ভাঙা আড্ডাটায় বেলার দিকে যায়। আবার সেই পুরোনো পরিবেশে আগের সবাক রূপক। যেন মৌনব্রত ভঙ্গ করে। একাকীত্বের স্তব্ধতার শ্মশান থেকে উঠে দাঁড়াতে চায়। বাড়ি থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে নিজেকে পেতে চায়। করোনা আক্রমণের ভয়ে গুটিয়ে থাকতে চায় না। কিন্তু ও চাইলেই তো হবে না। সামাজিক পরিবেশ তার সহায়ক নয়। তাও সবকিছুতে আরও আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে চাইছে। তার এই চেষ্টার দিন তিনেক পর এক সন্ধ্যায় কুণাল এসে হাজির। ও একাই এসেছে। রূপক খুব খুশি হয়। জানতে চায় কুণালের স্ত্রী আসে নি কেন। কুণাল জানায় ও আসতে পারে নি। তবে একটা চিঠি পাঠিয়েছে রূপকের উদ্দেশ্যে। চিঠিটা ও রূপকের হাতে দেয়। রূপক অবাক হয়ে চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে:
প্রিয় রূপক
কাল বোধ হয় আমাকে চিনতে পারো নি। বয়স হয়েছে। বদলে গেছি। তাই না চেনা স্বাভাবিক। তবে আমি তোমায় দেখেই চিনেছি। সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের জন্য ফিরে গেলাম সেই অতীতের আমিতে। সেদিনের চিত্রা। আমাদের বিচ্ছেদের প্রায় দশ বছর পর কুণালের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আর বিয়েতে ঘটকালি করে তোমার স্নেহধন্যা টুম্পা, কুণালের বোন। টুম্পাকে চিনলেও কুণালকে আমি চিনতাম না। কুণালও আমাকে চিনত না। টুম্পা আমাদের বিয়ের খবরটা গোপন রেখেছিল তোমাকে বলে নি তুমি আঘাত পাবে ভেবে। যাই হোক তারপর প্রায় চল্লিশ বছর কেটে গেছে। আমরা মানিয়ে নিয়েছি। ছেলে মেয়েকে নিয়ে সংসার করছি। তুমিও তাই। যে কোন কারণে আমাদের বিয়েটা হয় নি। আর সেজন্যই বোধ হয় টানটা বেড়েছে। তাই দেখেই চিনেছি। তবে জানান দিই নি। জানি না তুমি বোধ হয় আমাকে চেন নি বা চিনতে চাও নি। ভালোবাসা জেনো
ইতি
চিত্রা
চিঠিটা পড়ে রূপক মাথা তুলে কুণালের দিকে তাকাল। কুণাল জানতে চাইলো রূপক কি বুঝলো। রূপক হেসে উত্তর দিল:
‘‘হ্যাঁ অনেকদিনের ব্যাপার তো। একটু ঝালিয়ে নিলাম।‘‘
কুণাল বলল, “চিত্রা আমাকে সব বলেছে। তুই আর সংকোচ করিস না। সেদিন ওকে তুই চিনতে চাস নি।‘‘
রূপক জানায় সেও চিত্রাকে চিনতে ভুল করে নি। তবে হ্যাঁ চিনতে চায় নি।
রূপক কুণালের কাছ থেকে টুম্পার ফোন নম্বরটা চেয়ে নেয়। কুণাল চলে গেলে মোবাইলে টুম্পাকে ফোন করে। সে বলে:
‘’টুম্পা তুমি তোমার দাদার সঙ্গে চিত্রার বিয়েতে ঘটকালি করেছ অথচ আমাকে জানাও নি। একেবারে হাইজাক করে ওকে নিয়ে গেলে !’’
টুম্পা ওপাস থেকে জানায়:
“কোথায় হাইজাক করলাম! তোমাদের বিচ্ছেদ তো আগেই হয়ে গেছে। তুমি তো তখন নিজের জন্য গুছিয়ে নিয়েছ। তোমার বিয়ের বেশ কিছু পর ওদের বিয়ে হয়েছে। অসুবিধে কোথায়? চিত্রাদি নিজের জীবন গুছিয়ে নিক সেটা তুমি নিশ্চয় চেয়েছিলে কারণ ওকে তুমি ভালোবাসো। তোমাকে জানানোটা দরকার ছিল না। দাদাকেও তোমাদের সম্পর্কের কথা জানাই নি।” রূপক আর কোন কথা বলে না।
মুখোশ
করোনা লেগেছে। সবাই আতঙ্কিত। বিশেষ কেউ ঘর থেকে বেরোয় না । বয়স্করা তো একেবারেই নয়। বাঘে ছুলে আঠারো ঘা। করোনা ছুলে আটান্ন ঘা। কে না জানে? জানেন না শুধু প্রতীক বাবু। তিনি কিছুতেই মানেন না । মুখোশ পড়বেন না। বাড়ির লোক আতঙ্কিত বিরক্ত। হাজার বলেও হেল দোল নেই। কাকস্য পরিবেদনা। বয়স তো কম হলো না। হাজার বলেও কি করা যায়! ছেলে গোটা চারেক বাহারি মুখোশ এনে দিয়েছে। ওগুলো অব্যবহৃত পড়েই থাকে। বাড়ির আসে পাশের কেউ কিছু বলেন না। মানে বলতে ভয় পান। প্রতীক বাবু একটা ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক দলের নেতা। ক্ষমতাবান লোক। তবে এলাকায় জনপ্রিয় সন্দেহ নেই। খুবই অমায়িক। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক। তাই কিছুটা শ্রদ্ধায় কিছুটা ভয়ে কেউ কিছু বলতে ভরসা পায় না। সবাই মুখোশধারি শুধু প্রতীকবাবু নন। উনি নাকি স্পষ্টবাদী, উনি যা সেভাবেই থাকতে চান। কোন মুখোশ নয়।
প্রতীক বাবু বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকতে অভ্যস্ত নন । রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার দৌলতে তিনি জনগণের লোক।অফিসের পর যতটুকু সময় পান তা তাঁর সংগঠনের কাজ আর জনসেবার কাজে লাগে । পরিবারের জন্য সময় কোথায়? স্ত্রী আর ছেলে আছে। কিন্তু তার দায় সামান্য। স্ত্রী ঘর সামলান।স্বামীর সমাজের পরিচয়ের ব্যাপারটা তাঁর কাছে গর্বের। সেটা তাকে একটা বাড়তি দম দেয় যার জন্য একা হাতে ঘর সামলানোর থেকে যাবতীয় ঝামেলা স্বেচ্ছায় তিনি মেনে নেন। তবে করনার আবির্ভাব আর তার জন্য ঘর বন্দী তার জীবনে একটা উপরি পাওনার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রতীক বাবুকে বাড়িতে পান। আফিস বেশি যেতে হয় না। আর পাড়াও তো যেন শ্মশান হয় গেছে। ভয়ে সবাই বাড়িতে সিটকে।সেটা তাঁর কম পাওনা নয়।কিন্তু প্রতীক বাবুর কাছে এই ঘরবন্দী দশাটা একটা ভয়ানক বন্দী দশা। রাজনীতির কল্যাণে তিনি কিছুদিন জেলবন্দী ছিলেন। সেটাও যেন এত দমবন্ধ হওয়া বন্দী দশা নয়। এই অবস্থায় হাসিখুশি এই মানুষটা যেন কেমন খিট খিটে হয়ে যাচ্ছেন । ঘরে স্ত্রীকে বেশিক্ষণ পেযে যেন জীবনে যতটুকু রোমান্স ছিল তাও উবে যাওয়ার উপক্রম । কি আর করেন এটা আজ মেনে নিতেই হয়। তাও ফ্ল্যাটের অন্যান্যদের থেকে তিনি বেশি বের হন। কিন্তু কিছুতেই পরিবর্তিত এই অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন না। কবে যে করোনা বিদায় নেবে তাই ভাবেন। প্রতীক বাবুর স্ত্রীর কাছে এটা খুব বেদনাদায়ক। বিশেষ করে যখন দেখেন পাশের ফ্ল্যাটের পরিবারগুলো কি সুন্দর এই বিশেষ অবস্থায় বউ ছেলে মে নিয়ে আনন্দ ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছে। আর ওদের ছেলে তো সারাদিন মোবাইল কম্পিউটার নিয়ে অফিসের কাজ করছে। ওয়ার্ক ফ্রম হোম এর নামে কাজ বেড়ে গেছে । অথচ কোম্পানি ৭০ শতাংশ মাইনে দেবে বলেছে। চাকরি থাকবে কি না সেই ভয়ে ছেলের দিন কাটে।
করোনার আক্রমণ বেড়ে চলেছে। ধারে কাছে সে এসে গেছে। সরকারী নির্দেশে মুখোশ বাধ্যতা মূলক। তাও প্রতীকবাবু অচঞ্চল। উনি মুখোশহীন মানুষ। কারো ধার ধারেন না। এরই মধ্যে এক আধবার দোকানে যান। সেখানে উনাকে চেনে না এমন দুচারজন মুখোশ কই জানতে চাইলে উনি বলেন উনি মুখোশহীন মানুষ। আর এর উত্তর যাকে তাকে দিতে বাধ্য নন।
বাড়িতে ইদানিং সবার সঙ্গে ঝামেলা। এদিকে সরকারি কড়াকড়ি বেড়েছে। জারি হয়েছে আদেশ মুখোশ না পড়লে জরিমানা বা জেল। প্রতীকবাবুর ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁর দল থেকেও এটা সবাইকে মানতে বলছে। সবাই মানছেওl কিন্তু প্রতীক বাবু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। কিসের জোরে তার এত বুকের পাটা? সবাই অবাক হয়। অনেকে ভাবে লোকটার সাহস আছে। না রোগ না পুলিশ কাউকে ভয় করে না।
প্রতীক বাবু রাস্তায় বেরিয়েছেন। লোকজন বেশি নেই। যা দুচারজন তাঁরা সংক্রমণের ভয়ে প্রতীকবাবুকে এড়িয়ে চলেন। প্রশস্ত রাস্তা ধরে নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে প্রতীকবাবু চলছেন।পেছনে কুত্তা করে ফুকার, তাতে প্রতীকবাবুর কোন দিন কিছু আসে যায় না। কিন্তু হঠাৎ এক জ্বালা। মোটরসাইকেলে দুজন এসে প্রতীকবাবুকে জেরা শুরু করে। প্রতীক বাবু বোঝেন এরা কারা। কেন মুখে মুখোশ নেই? প্রশ্ন ছুটে আসে। সাধারণত থানার বড় বাবুও প্রতীক বাবুকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করে না। কিন্তু আজ যেখানে সরকারের ঢালাই আদেশ সেখানে এই চুনোপুটিদেরও যে কিছু সাহস দেখাবার লাইসেন্স জোটে সেটা প্রতীকবাবু বোঝেন। তারাও যে প্রতীকবাবুকে চেনে না তা নয়। তবে আজ ওপরওয়ালার কড়া নির্দেশ। প্রতীকবাবু বলেন, “আপনারা অন্ধ দেখেন না। মুখোশ আছে।” পুলিশ বলে, “তবে পড়েন নি কেন?” প্রতীকবাবু বলেন, “ চলুন আপনাদের বসকে আমি এর উত্তর দেব।” পুলিশ ঘাবড়ে যায়। এ প্রভাবশালী লোক। কি দরকার। চলুক বড় বাবুর সঙ্গে বুঝে নেবেন। পুলিশ বাইকে করে প্রতীকবাবুকে থানায় নিয়ে যায়।
থানায় প্রতীকবাবুকে বড়বাবু আহবান জানান। জানতে চান কি হয়েছে। অর্ধস্তন পুলিশরা বলে উনি মুখোশ পরেন নি । আমরা পরতে বললে উনি বলেন উনি পরেই আছেন। এ ব্যাপারে আপনাকে যা বলার বলবেন। আমাদের সংগে তাই নিয়ে এসেছি। বড় বাবু বলেন: “ প্রতীক বাবু কি ঠাট্টা ইয়ার্কি করছেন? জানেন না আপনাদের পার্টির এটা নির্দ্দেশ। তারাই তো ক্ষমতায়। আমাদের কি করার?” প্রতীক বাবু নিরুত্তাপ। বলেন: “ ওরা না হয় দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু আমাকে চিনেও আপনি চিনছেন না। পার্টির আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে আমি মুখোশ পরেই আছি।” বড়বাবু বিচলিত হন। বলেন, “ হেঁয়ালি ছাড়ুন। আসল কথা বলুন।” প্রতীকবাবুর আবার একদফা হাসি। বলেন, “আমি যে মুখোশ পরেই আছি। ভালোভাবে দেখুন।”
বড়বাবু বলেন “ সেই মুখোশের কথা বলছি না। করোনা মুখোশ, মানুষের মুখোশ নয়”।
“ও তাই বলুন! চিনতে একটু দেরি হলো! তবে তো আমার এ মুখোশটা খুলতে হয়। দুটো মুখোশের ভার সইতে পারব না। এটা খুলে যে শেয়ালের মুখের করোনা মুখোশ পড়তে হয়। সেটা পাব কোথায়? সেটা তো বাজারে নেই। মানুষের মুখের করোনা মুখোশ তো আমার ছেলে বেশ কয়েকটা এনে দিয়েছে। জানেন তো আমাদের করে খেতে হয়। এই মুখোশ খুললে খাব কি? আর আপনারাই বা কি খাবেন।” বলেন প্রতীক বাবু। সত্যিই তো বড়বাবু বড় চিন্তায় পড়েন।
#storyandarticle