নেহানবাবু আমাদের গুরুদেবের কাছে নিয়ে গেলেন। গুরুদেবের মুণ্ডিত মস্তক, পরনে কালো আলখাল্লা, কোটরগত চোখদুটো হতে আগুনের লেলিহান শিখা যেন অনবরত জ্বলছে । সামনের সোফায় বসে পড়লাম ।
অঘোরবাবু অবশ্য আমাদের ব্যবহারে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন, একটা সমালোচনার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়েই সোজা চলে গেলেন গুরুদেবের সামনে। এরপর একটা সষ্টাঙ্গ প্রণাম ঠুকে উঠে দাঁড়ালেন।
গুরুদেব অত্যন্ত প্রসন্ন বদনে ডান হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন, “জয় হোক।”
এরপর আর অঘোরবাবুকে পায় কে। তিনি ডান হাতখানা নিয়ে একদম গুরুদেবের নাকের কাছটায় ধরলেন। বললেন, “খুব সমস্যায় আছি বাবা, এই কিছুদিন আগেই যমের মুখে পড়েছিলাম। বাঁচান বাবা !”
অঘোরবাবুর হাতে কি ছিল জানি না গুরুদেবের নাক একটু কুঞ্চিত হল, তারপর বিশাল মাপের একখানা হাঁচি ফেলে বললেন, “আমি হাত দেখি না, ললাট দেখে বিচার করি। তোমার কপালে দেখছি এখনো অনেক দূর্গতি আছে। ”
গুরুদেবের গুরুগম্ভীর বাণীতে অঘোরবাবুর ললাটে রেখার সংখ্যা এক-আধটা বাড়ল, সেটা গুরুদেবের চোখে না পড়লেও বিক্রমের চোখ এড়ালো না। বিক্রম ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু সফল হলো না। অঘোরবাবু একেই আমাদের উপর চটে ছিলেন তারপরে বিক্রমের এহেন আচরণে যথেষ্ট খাপ্পা হয়ে গেলেন। বিক্রমের দিকে ঘুরে বললেন, “আপনি মশাই পাঁড় নাস্তিক, ভুত ভগবানের বিশ্বাস নেই আপনার। ঐশ্বরিক মহিমা বোঝা আপনার কর্ম নয়।”
এবার গুরুদেবের দৃষ্টি বিক্রমের উপর পড়ল। তিনি বিক্রমের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে বললেন, “বিক্রমাদিত্য মুখোপাধ্যায়, বেসরকারি টিকটিকি,…. এস হে এস, এদিকে এস।”
বিক্রম ড্রাগনদুটো হাতে নিয়ে এগিয়ে গেল। নেহানবাবু বিক্রমের হাত হতে ড্রাগনদুটো নিয়ে গুরুদেবের হাতে দিলেন। ড্রাগনদুটো নাড়াচাড়া করতে করতে গুরুদেব গম্ভীর হয়ে বললেন, “কাজের লোক। তোমার যতটা নাম শুনেছিলাম তার চেয়েও তুমি বুদ্ধিমান।”
বিক্রম বলল,” হ্যাঁ, তান্ত্রিক…. ”
“.. মোহাবেশ।” গুরুদেব বিক্রমের কথা সম্পূর্ণ করে দিলেন। “তুমি ঠিকই ধরেছ গোয়েন্দা, আমিই তান্ত্রিক মোহাবেশ। তবে অনেকটা দেরি করে ফেলেছে। ড্রাগনদুটোও এখন আমার হাতে আর… “
” আর… ” আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
” আর তোমাদের জানও ! বুঝলে খোকা !” রক্ত হিম করা দৃষ্টিতে তাকালেন তান্ত্রিক মোহাবেশ। আমার শরীরটা যেন পাথর হয়ে এল। এতদিন যে তান্ত্রিক মোহাবেশের কথা শুনেছি এ তাহলে সেই ! মৃগাঙ্ক সেন আর নেহানবাবুর গুরুদেব তাহলে একই ব্যক্তি। আমার মুখ হতে আর কথা সরল না। অঘোরবাবুও এতক্ষণে অনেকটাই পিছিয়ে এসেছেন।
এরকম থমথমে পরিস্থিতিতে বিক্রমই নৈশব্দ ভাঙল। বিক্রম বলল, “আপনি দিবাস্বপ্ন দেখছেন তান্ত্রিক মোহাবেশ, এখানে যে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হবে সেটা আগে থেকেই জানতাম। আমি জানতাম যে সবকিছুর মূলে আপনিই।
নেহানবাবু যেদিন আমার কাছে এলেন সেদিনই একটা বিশদৃশ জিনিস আমার চোখে পড়েছিল, সেটা হল গলায় সোনার চেনে করে বাঁধা একটা প্যাঁচার করোটি। একজন নাসার গবেষকের গলায় প্যাঁচার করোটি খুব বিশদৃশ নয় কি ? সেদিন আমি কিছু বলিনি, কিন্তু সন্দেহ হয়েছিল।
আমি খবরাখবর নেওয়া শুরু করি। জানতে পারি রবার্টসন বলে কোনও গবেষক সেখান ইটি নিয়ে গবেষণা করছেন না। কিন্তু নেহানবাবু আমাকে মিথ্যা বললেন কেন ? এর উত্তর পাওয়ার জন্য আমি নেহানবাবুর ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করি। নেহানবাবু আমাকে সবকথাই মিথ্যা বলেননি, বিশেষ করে নিজের ব্যাপারে। উনি সত্যিই প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিক।
এরই মধ্যে ক্রিস্টাল ড্রাগন হতে বের হওয়া ড্রাগের রহস্যের উপর হতে পর্দা উঠে যায়। ড্রাগনটার পেটে একটা ছোট্ট অ্যামবার জাতীয় জিনিস ঢোকানো ছিল। এই দ্রব্যটির মাদকগুণসম্পন্ন । দাশগুপ্তর কাছ থেকে রেফারেন্স নিয়ে যাই বিশিষ্ট টক্সোলজিস্ট ডাঃ ইকবাল করিমের কাছে। ডাঃ ইকবাল যা জানালেন তা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিল।
ডাঃ ইকবাল বললেন, “তুমি যে ড্রাগটার কথা বলছ সেটা খুবই রেয়ার ড্রাগ। প্রাচীন ভারতে বিষবৈদ্য বলে একটা সম্প্রদায় ছিল, এদের কাজ ছিল বিভিন্ন রকমের বিষ ও রাসায়নিকের প্রয়োগে রোগীর আরোগ্যসাধন করা। কালক্রমে এদের অনেকেই তাদের বিদ্যা মানুষের অপকারে ব্যবহার করতে শুরু করে।
তিব্বতি বজ্রযানী তান্ত্রিকদের মধ্যেও এই বিষবিজ্ঞান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এটি তন্ত্রেরই একটা অভিন্ন অঙ্গে পরিণত হয়। “
ডাঃ ইকবালের কথা শোনার পর থেকেই আপনার কথা আমার মাথায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। এ তো হল আমার তদন্তের সারসংক্ষেপ, কিন্তু ড্রাগনদুটো নিয়ে আপনি কি করবেন সেটা জানতে পারলে ভালো হত।”
তান্ত্রিক মোহাবেশ একটা অট্টহাসি হেসে বললেন, “তোমার তদন্ত ঠিক পথেই এগিয়েছে টিকটিকি। মরার আগে তাহলে বাকিটুকু শুনে যাও। ”
বিক্রম বলল,” মরা বাঁচা ভগবানের হাতে, আপনার মতো শয়তানকে ভয় বা ভক্তি কোনোটাই আমি করি না। তবে বাকিটুকু শোনার ইচ্ছা আমারও আছে। আপনি বলুন।”
তান্ত্রিক মোহাবেশ একটা অবজ্ঞার হাসি হেসে শুরু করলেন,” এই বাংলারই কোনো এক অখ্যাত গ্রামে আমার জন্ম হয় প্রায় একহাজার বছর আগে। উপনয়নের পর আমার বাবা আমাকে গুরুগৃহে পাঠিয়েছিলেন। গুরুর আশ্রমে থাকাকালীন আমার সঙ্গে পরিচয় হয় উলুপীর। উলুপী ছিল বেদে সর্দারের একমাত্র কণ্যা। ওদের দলের সঙ্গেই আমি পালিয়ে যাই কামরুপে। ততদিনে বেদেসর্দারের কাছে তালিম নিয়ে আমি সমগ্র কামরুপের সর্বশ্রেষ্ঠ বিষবৈদ্য হয়ে উঠেছি।
কিন্তু পায়ে আমার সর্ষে, বেদেদের দলেও টিকতে পারলাম না। ভিড়ে গেলাম একদল বণিকের সঙ্গে। ওরা যাচ্ছিল তিব্বতে লবণের পসরা নিয়ে। তিব্বতে বেশ সুখেই কাটছিল জীবন, একদিন খবর পেলাম শ্রীজ্ঞান এসেছেন তিব্বতে, ছুটে গেলাম তার কাছে। শ্রীজ্ঞান বললেন, “তুমি জ্ঞানপিপাসু, তাই তোমাকে গ্রহন করলাম। তবে যেদিন তুমি পথভ্রষ্ট হবে সেদিনই আমি তোমাকে ত্যাগ করব।”
আমি এগিয়ে চললাম জ্ঞানের পথে। এরপর কতকাল কেটে গেল, শ্রীজ্ঞান দেহ রাখলেন। তার অব্যবহিত পরে আমার সঙ্গে সংঘের সম্পর্ক বাড়তে থাকল।
আমার স্বেচ্ছাচারী তা আর জীবনযাপনের অস্বচ্ছতা আমাকে পথভ্রষ্ট করল। আমি তখন মারন, উচাটন এর মতো বিদ্যার দিকে আগ্রহী হতে থাকলাম। আবিষ্কার করলাম চিরযুবক হয়ে থাকার গূঢ়তত্ত্ব।
এরপর কেটে গেল অনেকগুলো বছর, আমি তখন সমগ্র তিব্বতে আতঙ্কের প্রতিমূর্তি। যে পথ দিয়ে আমি যাই লোকজন দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরের ভেতরে লুকিয়ে পড়ে। আমার যাতায়াতের পথে একটা কুকুর বিড়ালও বের হতে সাহস করে না। এরকমই চলছিল, হঠাৎ এলেন ‘নাংগা লামা’ । ওর সঙ্গে লড়াইয়ে আমার সর্বশক্তি নষ্ট হয়ে গেল, আমি পরাজিত হলাম ।
এমনই সময় আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন স্বয়ং মার। তিঁনি তাঁর মায়াবলে জলের গহ্বরে তৈরি করলেন এক মন্দির, আর সেই মন্দিরের গর্ভগৃহে বন্দি করলেন ‘নাংগা লামা’কে । মন্দিরটাকে রেখে এলেন সময়ের জটিল আবর্তে।
বন্দি হওয়ার আগে ‘নাংগা লামা’ আমার সমস্ত শক্তিকে অভিমন্ত্রিত করে রাখলেন একটা কালগোলকে, যে কালগোলকের হদিস দিতে পারে একমাত্র এই ড্রাগনদুটো।
এবার আসি শশাঙ্কশেখরের কথায়, ও জেনেফেলেছিল আমার গোপন কথা। মারের হাতে বন্দি ‘নাংগা লামা’ শশাঙ্কশেখরের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে থাকেন। ওকে পাগল না করে আমার কোনও উপাই ছিল না। আর সেই ডায়েরির সূত্র ধরে এলে তোমরা। “
কথা শেষ করেই একটা পিস্তল বের করলেন তান্ত্রিক মোহাবেশ। এরপর নেহানবাবুর হাতে দিয়ে বললেন,” আমি বললেই তুমি এটা সোজা নিজের মাথায় চালিয়ে দেবে । ” নেহানবাবু পিস্তলটা নিয়ে নিজের কানপাটিতে ঠেকাল। এরপর তান্ত্রিক মোহাবেশ বললেন,” শক্তি নিঃশেষ হলেও রসায়ন ও সন্মোহন বিদ্যায় আজও আমি অদ্বিতীয়।”
এরপরেই একটা ধোঁয়ার মেঘ উঠলো, গোটাঘর ভরে গেল সাদা ধোঁয়ায়। চোখের সামনেটা ঘোলাটে হয়ে এল। তলিয়ে গেলাম অন্ধকারের অতলে। যখন চোখ খুললাম তখন সারা ঘর ফাঁকা, আমরা চারজন ছাড়া কেউ কোত্থাও নেই।
চোখ কচলাতে কচলাতে অঘোরবাবু বললেন,”কি হলো বলুন তো..…! “
বিক্রম বলল,” নেহানবাবুকে বাঁচাতে হবে। তান্ত্রিক মোহাবেশ নিজের হাতে কাউকে মারে না বটে কিন্তু কাউকে ছেড়ে দেয় এমন সুনাম তার নেই।”
“কিন্তু কোথায় খুঁজে পাব ওকে ? কিভাবেই বা পাবো ?” দেবলীনা তার আশঙ্কার কথা জানাল। আমিও দেবলীনার কথায় সায় দিলাম।
বিক্রম বলল, “সে ব্যবস্থা নেহানবাবু নিজেই করে রেখেছেন। “
” নিজেই করে রেখেছেন মানে !” আমি সবিস্ময়ে বিক্রমকে প্রশ্নটা করলাম। বিক্রম ঘরটা খুঁটিয়ে দেখছিল আর নমুনা সংগ্রহ করে এভিডেন্স ব্যাগে ভরছিল। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,”যুগ এগোচ্ছে সায়ক, যুগ এগোচ্ছে । এখন সঙ্গে কিছু থাক আর না থাক মোবাইল নামক বস্তুটি থাকবেই। আর আধুনিক মোবাইল মানেই জিপিএস।
আমি দেখেছি নেহানবাবুর মোবাইল নেহানবাবুর পকেটেই ছিল। এখন প্রেমাকে (বিক্রমের পাঠকেরা প্রো সিং চৌহানকে চেনেন, ইনি বীরভূমের একটা সাবডিভিশনের এসডিপিও।) ফোন করে নেহানবাবুর অবস্থান জেনে নিতে হবে। “
বিক্রম প্রেমাকে ফোন করল। কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল,” চল বেরিয়ে পড়ি। নেহানবাবুর অবস্থান জানা গেছে। চল কুইক, কিছু অঘটন ঘটার আগেই নেহানবাবুকে উদ্ধার করতে হবে। “
গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বিক্রম এমনিতে গাড়ি চালায় খুব সাবধানে, কিন্তু এখন গাড়ি ছোটাচ্ছে উল্কার গতিতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে পৌঁছাল গঙ্গার ধারে একটা ফাঁকা মতো জায়গায়। জায়গাটা খুবই নিরিবিলি, একপাশে ঘন ঘাঁসে ঢাকা মাঠ আর সেই মাঠটা পেরোলেই কতগুলো গোডাউন সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা গাড়ি দাঁড় করিয়ে পায়ে হেঁটে এগোতে লাগলাম। অঘোরবাবু আর দেবলীনাকে গাড়িতেই রেখে এসেছি।
একটা ক্ষয়টে ইটের ঘর দেখিয়ে বিক্রম বলল, “নেহানবাবুর মোবাইলটা এখানেই আছে।চল, সাবধানে।”
দরজার কাছে পজিশন নিলাম। বিক্রম দরজা ঠেলে সন্তর্পনে ভেতরে ঢুকলো, পেছন পেছন ঢুকলাম আমি। ঘরটা একটা পরিত্যক্ত গোডাউন, চারদিকে যন্ত্রপাতি আর আবর্জনার স্তুপ। ঘরে ঢোকার মাত্রই একরাশ ধুলো নাকে মুখে ঢুকে পড়ল বিনা বাধায়। ধুলোর ধাক্কায় আমার কাশি শুরু হয়ে গেলেও বিক্রমের কোনও বিকার নেই।
ঘরটা আঁতিপাতি করে খুঁজে অবশেষে এক কোন আয় একটা চেয়ারের সঙ্গে হাতপা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেল নেহানবাবুকে। নেহানবাবুর পকেট হতে একটা কাগজ উঁকি দিচ্ছে। বিক্রম কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলতেই দেখল একখানা চিঠি। বিক্রমকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
প্রিয় বিক্রম,
আজ তোমাকে প্রিয় সম্বোধনই করছি, কারন ইতিমধ্যেই তুমি তোমার বুদ্ধি আর সাহসে আমার মন জয় করে নিয়েছো। কালিদাস আমার প্রিয় কবি ছিলেন, এ পথে না এলে হয়তো কবিই হতাম। আবেগ মানুষকে সাফল্য দেয় না কিন্তু আবেগ না থাকলে মানুষ যে কত নির্মম আর ভয়ঙ্কর হয় তার প্রমাণ আমি।
হাজার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু এখনও আমি চোখ বুজলে দেখতে পাই সেই ছোট্ট গোবর নিকানো উঠান, যেখানে চরে বেড়াচ্ছে ফিট সাদা দুটো হাঁস। তার পাশেই এক্কাদোক্কা খেলছে আমার ছোট্ট বোনটা। পুকুর হতে শালুক তুলে দরজার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ঘর হতে ভেঁসে আসছে মায়ের গলার স্বর, “আসুক একবার, ঝেঁটিয়ে বিষ ঝেড়ে দেব। সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা। হে ভগবান এত লোক মরে আমাকে কেন মরন দাও না ! আর ওই এক আছেন শঙ্করের বাবা, সারাদিন শুধু পড়া আর পড়া। হে ভগবান….”
আমি বা আমার বাবা কেউই মাকে সুখী করতে পারিনি। বাবা অধ্যাপনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। বাবার কাছেই পড়েছিলাম আদিকবির সেই অমোঘ বাণী
‘মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতমঃ।। ’
আর আজ দেখো আমি নিজেই নিষাদ। বিশ্বাস করো বিক্রম আজও আমি ফিরে যেতে চাই সেই ছোট্টবেলাতে, আবার বাবার কোলে বসে আবৃত্তি করতে চাই, সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ
‘ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু
মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।।’
সায়ককে বোলো তার জন্য আমার সমবেদনা রইলো। তার পরের উপন্যাসের ভিলেনের রোলটা ঠিকঠাক অভিনয় করতে পারলাম না। আবার যদি কোনোদিন দেখা হয় সেদিন তান্ত্রিক মোহাবেশ নয়, আত্মভোলা গ্রামের সহজ সরল ছেলে শঙ্করকেই দেখতে পাবে।
যাবার সময় বলে যাই, যা দেখছো হয়তো তার বাইরেও এমন কিছু আছে যা তোমাকে চমকে দিতে পারে।সে যাই হোক, যাবার সময় নেহানকে উদ্ধার করে নিয়ে যেয়ো। তোমার জয় হোক।
অনেক অনেক ভালোবাসা সহ
শঙ্কর
চিঠিটা পড়ার পর কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলো বিক্রম, তারপর পকেট হতে পিস্তলটা বের করে নেহানবাবুর কপালে ঠেকিয়ে বলল, “এবার বল শয়তান, তোর উদ্দেশ্য কি ?”
আমি নেহানবাবুর মুখের বাঁধন খুলে দিলাম। নেহানবাবু বললেন, “সব চক্রান্ত। গুরুদেবের চক্রান্ত। আমার জামার তলায় বোম বেঁধে রেখে গেছে।” কথা শেষ হতে না হতেই নেহানবাবুর গালে পড়ল বিশাল চড়, নেহানবাবুর বাঁদিকের তিন চারটে দাঁত ভেঙ্গে বেরিয়ে এল, সঙ্গে গলগল করে রক্ত। নেহানবাবু এবার কাতরস্বরে বললেন, “বলছি, সব বলছি।
সমস্ত পরিকল্পনা আমার ছিল। গুরুদেব আমার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করেছেন। উনি বলেছিলেন নীল ড্রাগনটা উদ্ধার করে দিলে উনি আমাকে সময়যন্ত্রের নকশা দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।”
বিক্রম নেহানবাবুর জামার ভেতর হতে বোমা বের করে তারগুলো পটপট করে ছিঁড়ে ফেললেন। আতঙ্কে আমার শরীর হিম হয়ে এল। বিক্রম বলল,” ভয়ের কিচ্ছু নেই, যাবার সময় নেহানবাবুকে কিছুটা শিক্ষা দিয়ে গেছেন তান্ত্রিক মোহাবেশ। নকল বোম ফিট করে মৃত্যুভয় কাকে বলে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
তবে নেহানবাবু, আপনার বিরুদ্ধে অঘোরবাবুর অপহরণে জড়িত থাকা ছাড়া আর কোনও অভিযোগ নেই। সেই অভিযোগ হতেও আপনাকে অব্যাহতি দিলাম। আশাকরি জীবনের বাকি দিনগুলো সৎভাবে নির্বাহ করবেন। আর শেষ নেই যার তিনি নতুনভাবে শুরু করুন আত্মভোলা শঙ্কর হয়ে। “
নেহানবাবুকে মুক্ত করে দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম। এরপর গাড়িতে করে সোজা কফিহাউস, জমিয়ে আড্ডা মারতে হবে তো।
– – সমাপ্ত–