শীতের সকাল
কলমে – মোবারক মন্ডল
কনকনে শীতের সকাল। আলস্য ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠলাাম। বাইরে পা রাখতেই চোখে পড়লো প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য । সকালের মিষ্টি রৌদে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো যেনো মুক্তোদানা সদৃশ। কুঁয়াশার চাদর ভেদ করে সিম, কুমড়ো আর লাউসহ নানা রকমের সবজির ফুল যেন মাথা উঁচিয়ে তাদের সৌন্দর্যের জানান দিচ্ছে। খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে শীত উপেক্ষা করে খাদ্যের সন্ধানে রাজহাঁসের দল বেরিয়ে পড়েছে।
শিশিরের পরশে শিম,লাউ আর কুমড়া গাছগুলো হয়ে ওঠেছে আরও সতেজ। গ্রামের বাচ্চাগুলো রংবেরঙের শীতের পোষাক পরে বিভিন্ন খেলায় মত্ত। ছোট্ট ছোট্ট শিশির বিন্দু গুলো রোদের আলোয় ঝলমল করছে! সকাল বেলা ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে খালি পায়ে হেটে যাবার সময় এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। প্রতিটা দিন এমন করে হেটে গেলেও বারবার মনে হয়, আজই যে প্রথম। অদ্ভুত সত্যি অদ্ভুত!
ইচ্ছে গুলোকে সব সময় যদি নিজের পছন্দ মতন পালটানো যেতো তাহলে হয় তো অনেক ভালো হতো! সব সময় তো আর একি ধরণের ইচ্ছা পূরণ করতে ভালো লাগে না! লাগবার কথাও নয়! আবার যখন যা ইচ্ছে হয়, সেটা না করতে পারার অতৃপ্তি অনেক সময় ধরে তাড়িয়ে বেড়ায়।
হাড় কনকনে শীতে জবুথবু একটি গ্রামের ভোর। কুয়াশা ঢাকা কিষান বাড়ির উঠোনের একপ্রান্তে গনগনে জলন্ত উনুন। সে আগুনের আঁচে উনুনের ধার ঘেষে বসে আছে বাড়ির ছেলেবুড়ো সকলে। হাসিখুশী কিষানী বৌটির সুনিপুন হাতের পটুতায় ঢাকনা ঢাকা হাড়ির উপরে, একরতি কাপড়ের ভাজে ভাজে উঠছে আতপ চালের গুড়ো ঢাকা, নতুন খেঁজুর গুড় আর নারকেল কোরা দেওয়া ছোট বাটি।নামছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা হয়ে একেকবার একেকজনের পাতে । এ ছবি পরম মমতার, স্নেহ ও ভালোবাসার এবং পাবিরাবিক অটুট বাঁধনের এক চিরায়ত গ্রামবাংলার চিরচেনা শীতকালীন ছবি।
শীত মানেই বাইরে জলন্ত আগুন ঘিরে গ্রামের যে যার সাধ্যমত সোয়েটার, চাদর, মাফলার ইত্যাদি পোষাক পরে আড্ডায় মেতে ওঠা।শিশুদের ফোকলা দাঁতের হাসি, বৃদ্ধ দাদির তুষের অনলে গা গরম করা আর দাদার কোলে চাদর মোড়ানো কিশোর নাতীর শীত পোহানো।
সত্যিই শীত মানেই বাঙালির আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠা। শীত মানেই অলস নারীর শিশুর মতো দু চারদিন স্নান না করেও মিথ্যা বলা ! কে কতদিন স্নান করেনি এ নিয়ে বাক বিতন্ডা। শীত মানেই লেপের তলে জড়ো হয়ে শুয়ে শুয়ে প্রহর গুনা, শীত মানেই পিঠে পুলি সহ নানান স্বাদের খাবারের আয়োজন, শীত মানেই ঘুরতে যাওয়ার বায়না ধরা, শীত মানেই পাড়ায় পাড়ায় বিয়ের বাজনা, শীত মানেই বাড়ির পাশে বনভোজনের আয়োজন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে দুষ্ট ছেলের দল বেড়িয়ে পরে ঢিল ছুড়তে খেজুর গাছে লটকানো কলসি ফুটো করার ধান্ধায় ঢিল ছুড়েই কলসি ফুটো করে হা করে খেজুরের রস খাওয়া। রস পাড়তে এসে গাছি তাদের দেখে ফেললে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া ইশ! কতইনা মজা।
এই সময় গ্রামও শহরের হাঁট বাজারগুলোতে সব্জী পসারীর ডালায় ডালায় থরে থরে সাজানো শীতের সব্জী ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, পালং, ওলকপি, গাজর, টমেটো চোখ জুড়ায়, মন ভরায়।
শীতের আরেক স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য বিরাজ করে সরিষা ক্ষেতে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে ফুটে থাকা হলুদ সরিষার ফুল যেন বিছিয়ে রাখে হলুদ ফুলে চাদর। আর সেই ফুলকলিদের উপর উড়ে চলা রঙ্গিন প্রজাপতি আর মৌমাছিদের মিলনমেলা মন হরন করে।
এখনো রোদের হাসি ততোটা চড়াও হয়নি দিগন্তে। কুয়াশার মাঝে উকি দেওয়া গুচ্ছ গুচ্ছ আলো গুলোকে পকেটে ভরলাম। প্রতিটা রঙের আলোর জন্য আলাদা আলাদা থলে, আর সে রং গুলো রংহীন স্বপ্ন গুলোতে জুড়ে দিলাম। রংহীন থেকে রঙিন, আহা্! সত্যি সুন্দর! আচ্ছা সাদা-কালোকে কেন মানুষ রঙিন বলে না? এগুলোও তো রং!
বাড়ি ফিরতে ফিরতে চোখে পড়লো রাস্তার ধরে কারেন্টর পোলে বাতিটা এখনো নেভানো হয়নি! সারারাত সে একাই পাহারা দিয়ে গেছে তার আশেপাশে। একাকী, নিঃসঙ্গ ভাবে। আর আমাদের চোখে রাজ্যের ঘুম। বারবার জীবনে ফিরে আসুক প্রিয় ঋতু শীত।
তবে এই অপরুপ শীতের সৌন্দর্য্য অনুভবে ও উপভোগে ভুলে যাওয়া যায়না সেইসব ছিন্নমূল মানুষদের কথা। একটুকরো শীতের কাপড় বা মাথা গোঁজার ঠাই নেই যাদের তাদের জীবনে শীত আনন্দের নয়, অভিশাপের আর তাই যে যার সাধ্যমত কাছের দরিদ্র মানুষটির প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেই ও পৃথিবীকে করে তুলি সুন্দর ও মঙ্গলময়।