শিল্পী স্বপন গুপ্ত স্মরণে আলো আমার আলো – রণেশ রায়

শিল্পী স্বপন গুপ্ত স্মরণে
আলো আমার আলো – রণেশ রায়
কোন দৃষ্টিহীন গায়ককে দেখে অনেককে বলতে শোনা যায়, ‘‘ জান তো ও অন্ধ গায়ক‘‘। হয়তো কিছু ভেবে বলেন না। সহানুভূতি দেখিয়েই বলেন। কিন্তু আমার খুব রাগ হয়। মনে হয় এই কথার মান্যতা দেওয়া মানে ধরে নেওয়া যে একজন ঘটনা চক্রে দৃষ্টিহীন হলে সে এমনই শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে যে সে সাধারণভাবে সুগায়ক, শিল্পী হয়ে উঠতে পারে না। তার গায়ক হওয়াটা একটা ব্যতিক্রম। তাই তার প্রাপ্য এই সহানুভূতি আর তার সঙ্গে অনুগ্রহ। আমি এটা মান্যতা দিতে পারি না। কারণ এর ফলে তার যে শিল্প সত্ত্বা তার অন্ত:দৃষ্টিতে জীবনের যে আলো সে অবলোকন করে সেটা চাপা পরে যায় । তার জীবনবোধ তার শিল্প সত্ত্বা অসম্মানিত হয়।তার জীবন যুদ্ধটা স্বীকৃতি পায় না। তার সঠিক মূল্যায়ণ সম্ভব হয় না। আমার জীবনে এ ব্যাপারে যে অভিজ্ঞতা তা না থাকলে আমিও হয়তো এমনি ভাবেই ভাবতাম। কিন্তু আমার জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ভাবতে দেখতে শিখিয়েছে। আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমি সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আজ আমার প্রতিবেদনটি রাখব। আর যার জীবন নিয়ে আমার এই অভিজ্ঞতা সে হল বিংশ শতাব্দীর সত্তর আশি নব্বই দশকের রবীন্দ্র সঙ্গীতের জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বপন গুপ্ত।কিশোর কাল থেকে সে আমার বন্ধু। আমরা একসঙ্গে আমাদের দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছি। সুখে দুঃখে আজীবন আমরা বন্ধু। আমার এই অভিজ্ঞতা আরো প্রসারিত হয়েছে অন্য দুবন্ধুকে কেন্দ্র করে। একজন দিলীপ কাওয়াস এনসি আর টির অধ্যাপক ছিলেন যিনি মারা গেছেন বেশ কিছুদিন আগে আর একজন খিদিরপুর কলেজে আমার সহকর্মী অধ্যাপক অরুণাভ দত্ত মজুমদার।
স্বপন যখন ” আলো আমার আলো আলোয় ভুবন ভরা ——” গানটা গাইত তখন মনে হতো এ জীবনের সব আলো যেন বর্ষিত হয় ওর ওপর। আমরা জীবনের আলো দুভাবে দেখি —– অন্তদৃষ্টি দিয়ে আর বহি:দৃষ্টি দিয়ে। বহি:দৃষ্টি দিয়ে সকালে সূর্য উঠলে তার আলোয় এই ভৌতিক জগৎটাকে নেহাত একটা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য জগৎ হিসেবে দেখি যেটা চোখ নামক একটা ইন্দ্রিয়ের বাহ্যিক অনুধাবন। কিন্তু মানুষের একটা অন্তর্দৃষ্টি থাকে যা দিয়ে বিভিন্ন ইন্দ্রিয় দিয়ে বাহ্যিক এই দেখাকে অনুভূতির স্তরে নিয়ে যায় মানুষের মনোজগতে। সেখানে শুধু চোখ নয় প্রত্যেকটা ইন্দ্রিয় বাহ্যিক অনুভূতি ছাড়াও অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে আমাদের বিভিন্ন অনুভূতিকে হৃদয়ের গভীরে নিয়ে যায়। যেমন কোন কিছু চোখে দেখলে দেখা বিষয়টা আমাদের হৃদয়কে আলোকিত করে তার গভীর মননে। আলো যার ওপর বর্ষিত হয় শুধু তার অবয়ব আমরা দেখি না। তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভবও করি। যেমন সুন্দর হাসি মুখ দেখলে আমাদের মননে এক আনন্দ অনুভূতি সৃষ্টি হয়। মনের মধ্যে গেঁথে যায় এক সৌন্দর্যের প্রতিমূর্ত যা চির অম্লান।শুধু দেখা নয়, হাত দিয়ে স্পর্শ করলে বিষয়টার বৈশিষ্ট্য আমাদের মনকে স্পর্শ করে। শব্দ শুনলে তা হৃদয়ে ঝঙ্কৃত হয়, সে বিভিন্ন বার্তা পোঁছে দেয় আমাদের মননে। ফুলের গন্ধে ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করে ঘ্রাণ। কোন কিছু খেলে তার স্বাদে আমাদের মনে আনন্দ নিরানন্দর ঢেউ খেলে যায়। স্বপনের মত দৃষ্টিহীনদের এই অন্তর্দৃষ্টি তাদের জীবনে এই আলো বর্ষিত করে তাদের ভাবনায় তাদের আঁচার আচরণ এক কথায় জীবন যাপনে।এ ব্যাপারে দুএকটা টুকরো টুকরো স্মৃতি তুলে ধরে স্বপনের এই অন্তদৃষ্টি প্রখর অনুভূতির বিষয়টা তুলে ধরব যা তাকে শুধু একজন শিল্পী হিসেবে গড়ে তুলেছে তা নয় তাকে একজন সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।তার জীবনে একটা ইন্দ্রিয়ের অভাব অন্য ইন্দ্রিয়গুলি পুষিয়ে দিয়েছে।
ওর মেয়ে তানিয়া ( আত্রেয়ী গুপ্ত) স্বপনের একটা স্মরণ সভায় একটা লিখিত বার্তা পাঠিয়েছে যেখানে সে বাবার এই প্রখর অনুভূতি শক্তি তার অন্তর্দৃষ্টির বিষয়টা তুলে ধরেছে। সে জানিয়েছে যে তার কোনোদিন মনে হয়নি যে তার বাবা দৃষ্টিহারা বলে সে চোখে দেখার অসুবিধেটা সেভাবে বোধ করত।তার জীবনের এই অভাবটা তাকে কখনও পীরা দিত না। বরং সব ব্যাপারে তার সতত সতর্কতা দেখা যেত। বাবা হিসেবে সে যেমন কর্তব্য করেছে মেয়েকে ঘরে দেখাশুনা করেছে তেমনি সে ছিল মেয়ের বন্ধু। আর বাবা তাকে দেখত বলে মা অধ্যাপিকা তপতীর ওকে বাড়ি রেখে কাজে যাওয়ায় অসুবিধে হত না। আমরা বাড়িতে আমাদের স্ত্রীদের এভাবে সাহায্য করি না। বরং ঘরের কাজে তাদের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। তানিয়ার বাবা স্বপন ছিল তার দাবা খেলার সাথী।সে স্পর্শে কিভাবে একটা দুরুহ বিষয়কে বুঝত তার উদাহরণ দিয়েছে সে। মেয়ে বাবার কাছে খেলায় হারার ভয়ে বাবা বুঝবে না ভেবে দাবার গুটির অবস্থান বদলে দিত। কিন্তু বাবা সেটা ধরে ফেলে কোন গুটি কোথায় ছিল সেভাবে আবার সাজিয়ে দিত । তার চুরিটা ধরে ফেলত। এ এক সূক্ষ বোধ শক্তি স্বপন যেটা স্পর্শে বুঝতে পারত। এটা তানিয়াকে চমকিত করত। ঠিক আমিও চমকিত হতাম যখন আমার পায়ের শব্দ পেয়ে ও বুঝত আমি এসেছি।বলত, ‘‘ কে রণেশ এসেছিস। আয়।‘‘
উপরোক্ত স্মরণ সভায় স্বপনের স্ত্রী আর আমিও উপস্থিত ছিলাম। তপতীকে কিছু বলতে বলা হলে ও যা বলে সেটা তুলে ধরে স্বপনের আরেকটা দিক তুলে ধরছি। তপতী বলে ( আমরাও যেটা জানি) স্বপন ছিল সদা হাস্যমান অসম্ভব সংযত এক ব্যাক্তিত্ব। ও যখন হাসত তখন পুরো পরিবেশটা আনন্দ মূখর হয়ে উঠত। জীবনের সব গ্লানি মুছে যেত। সে হাসি অন্তরলোককে আলোকিত করত। ওর সেই অন্তরলোকের আলোয উপস্থিত সবাই আলোয় উদ্ভাসিত হত। চোখে মুখে অন্তরের সেই দীপ্ত আলোর শিখায় বোঝা যেত না যে সে দৃষ্টিহীন। বরং হাসির মধ্যে দিয়েই ও পরিবেশকে আত্মস্থ করে নিত। তার হাসি ছিল অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার আলো। উপস্থিত সবাই ওর অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতাম। ওর হাসিটা নেহাত বাহ্যিক চ্ছটা ছিল না যা আমাদের মোহিত করত, তা ছিল অন্তরের আলোর স্ফুরণ যা নিজেকে যেমন আলোকিত করত তেমনি সবাইকে আলোকিত করত। এ হাসিতে অন্তরের একটা আবেদন ছিল। ভালোবাসার আবেদন। ওর হাসি সম্পর্কে বলতে গেলে কবি পাবলো নেরুদার কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে:
Take bread away from me, if you wish,
take air away, but
do not take from me your laughter.
উপরোক্ত কয়েক লাইনের বাংলা করলে দাঁড়ায়:
যদি চাও আমার থেকে ছিনিয়ে নাও,
ছিনিয়ে নাও রুটি তাড়িয়ে নাও বাতাস,
কিন্তু তোমার মুখের হাসি
কেড় না কেড় না তা, অম্লান হয়ে থাক।
আজ আমার জীবন সায়াহ্নে স্বপনের সঙ্গে প্রায় ষাট বছরের বন্ধুত্ব আর ওর সান্নিধ্যে জমে ওঠা অসংখ্য টুকরো টুকরো স্মৃতি ভেসে ওঠে। সেই স্মৃতির আলোতে তাকে আজও আমি বোঝার চেষ্টা করি। সে ছিল অসম্ভব ধীর স্থির প্রখর অনুভূতিসম্পন্ন। আমরা একবার মুকুটমনিপুর বেড়াতে গেছি। ওর মেয়ে আমার ছেলে আর ওর স্ত্রী তপতী আমার স্ত্রী সাধনা। সাধনা আবার কিছুদিনের জন্য ওর গানের ছাত্রী। মুকুট মনিপুরে কংসাবতী নদীতে নৌকো বিহারে বেরিয়েছি। গান গল্প গুজবে আড্ডা চলছে। ওদিকে আমার ছেলে ওর থেকে একটু বড় তানিয়ার পেছনে লেগে আছে। তানিয়া ভয়ে গুটিয়ে। হঠাৎ স্বপন বলে, ‘‘রণেশ, আমরা নিশ্চয় নদীর পাড় ঘেঁষে চলেছি‘‘। ও তো দেখতে পায় না বুঝলো কি করে? ওর কথায় আমার চোখ খুললো। দেখি নৌকো চলেছে নদী কিনারা ধরে। গাছের ছায়া এসে পড়েছে নৌকোতে। বুঝলাম এর ফলে যে শীতলতা তৈরী হয়েছে তার অনুভবে সে বুঝেছে নৌকোর এই শৈত্য। আমরা যেটা দেখেও দেখি না ও সেটা অনুভবে বোঝে। ও একই সঙ্গে ছিল খুব রসিক। টুকরো টুকরো চুটকিতে মাতিয়ে রাখত আড্ডা। কিন্তু অসম্ভব সংযত। বন্ধুদের মধ্যে আমাদের কথা বার্তা ছিল লাগামহীন। ভাষা স,র,ল,ব নানা বিশেষণে বিশেষিত। কিন্তু ওর মুখে কোনদিন অসংযত কথা শুনিনি। অথচ বাবা মায়ের শাসনে ও বড় হয় নি। অনাথ আশ্রমের জীবন কেটেছে শৈশবে বাল্যে একান্ত অবহেলায়। ওর স্মৃতিশক্তি ছিল তুখোড়।
আমরা আমাদের জীবনের প্রয়োজনে অপরিহার্য রুটি নিশ্বাস নেওয়ার বাতাস ছাড়তে পারি কিন্তু স্বপনের হাসি যেন আমাদের না ছাড়ে। স্বপন চলে গেছে, সামনে বসে ওর সেই হাসি আর দেখতে শুনতে পাব না কিন্তু ওর হাসির আলোর প্রভা রয়ে গেছে অমর অক্ষয়।সে হাসিতেই ওকে আমরা ওর শারীরিক অনুপস্থিতেও পাই।আমরা ওর হাসিতে আমাদের অনুভূতিতে তাকে পাই:
সেই হাসি
কোথায় গেল সেই হাসি
যে হাসিতে জ্যোৎস্না ঝরে
বিষাদ আমার ঘুচিয়ে দিয়ে
হৃদয় মাঝে নৃত্য করে।
কোথায় দেখি সেই হাসি
যে হাসিতে দুখের দিনে
দুঃখ সব ভুলিয়ে দিয়ে
সুখ আমায় জড়িয়ে ধরে।
কোথায় গেল সেই হাসি
যে হাসিতে রাতের তারা
ডাকে আমাকে ইশারায়
দুই চোখে তার দুষ্টুমি ভরা।
কোথায় লুকায় সেই হাসি
যে হাসিতে প্রেম আমার
নির্জনে নিভৃতে পেতে চায়
হৃদয়ের উষ্ম স্পর্শ তোমার।
কোথায় দেখি সেই হাসি
যে হাসিতে ঝড়ের রাতে
মুক্ত ঝরে অঝোরে
সূর্য ওঠে রাত পোহালে।
আমি দেখি সেই হাসি
যে হাসিতে ফুল ফোটে
ফুলের সৌরভ বাতাসে
অন্তর তার জ্বলে ওঠে।
ওই দেখ সেই হাসি
রাত শেষে ভোরের আগমনে
শিরীষ এর মুখে শিশির বিন্দু
মেলে গিয়ে সূর্যের কিরণে।
কোথায় দেখি সেই হাসি
যে হাসে জীবন অন্তরে
আলো হয়ে জ্বলে মনের গভীরে
খেলা করে সবুজ প্রান্তরে।
কোথায় গেল সেই হাসি
যে হাসিতে শৈশব ফিরে আসে
কৈশোর ডানা মেলে
সুগন্ধ তার আকাশে বাতাসে।
ওই দেখ সেই হাসি
জীবন নদী পার হয়ে
হিসাব নিকাশ শেষে
পৌঁছায় সে আনন্দ লোকে।
স্বপনের প্রথম জীবনের গাওয়া , ‘‘ ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু, পথে যদি পেঁছিয়ে পরি কভু‘‘ গানটা তখন খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল গানটা ওর গলায় একটা সার্বজনীন আবেদন রাখত বলে।আজ এই গানটাকে সামনে রেখে বলতে ইচ্ছে করে স্বপনের কোথায় ক্লান্তি। ও তো জীবন যুদ্ধে এক ক্লান্তিহীন সৈনিক। কে তাকে ক্ষমা করবে। আর পথে ও কখনও পিছিয়ে পড়েনি। সারাজীবন তার ক্লান্তিহীন যাত্রা। এবার আমরা স্বপনের জীবন প্রবাহ ধরে তার এই যাত্রাপথ তথ্য উত্থান পর্বের আলোচনায় আসব।
#storyandarticle

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *