ল্যাটিন আমেরিকান কবিতার রূপরেখা – শংকর ব্রহ্ম

Story and Article

[দ্বিতীয় (শেষ) পর্ব]
আরও দশজন লাতিন আমেরিকান কবি-
লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের বয়স নেহাত কম নয়। বাচিক এবং লিখিত, দুই রূপ মিলিয়ে এ-সাহিত্যের বয়স পাঁচশ বছরের বেশি। এবং অবশ্যই সেটা কেবল হিস্পানি বা পর্তুগিজ ভাষায় রচিত হয়নি। স্বদেশি বা আদিবাসী নানান ভাষাতেও লাতিন আমেরিকার সাহিত্য রচিত হয়েছিল এবং সেটি ছিল বাচিক। আশ্চর্য শোনালেও এ-কথা সত্য যে লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে বাচিক ঐতিহ্যের ক্ষীণ একটি ধারা এখনো বহমান।

লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের প্রতি বাংলাভাষীদের আগ্রহ যেন অনিঃশেষ এবং কিছুটা হুজুগপ্রবণও বটে। ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে এই সাহিত্যের প্রতিনিধিত্বশীল কিছু রচনা, বিশেষ ক’রে উপন্যাস, ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ‘বুম’ [The Boom] নামের প্রবল প্রপঞ্চ সৃষ্টি করার পর সেই আগ্রহের ঢেউ অনেক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা থেকে বাংলাভাষী পরিসরও, সঙ্গত কারণেই, বাদ পড়ে নি।

উপন্যাস এবং ছোটগল্পের পাশাপাশি, প্রাক-কলম্বীয় যুগের কবি, দার্শনিক, যোদ্ধা ও স্থপতি নেযাহুয়ালকয়তাল [আনুমানিক ১৪০২-১৪৭২] থেকে শুরু ক’রে উপনিবেশিক যুগ, ঊনবিংশ ও বিংশ শতক পেরিয়ে সমসাময়িক আলেয়দা কুয়েভেদো [জন্ম ১৯৭২, কিটো] অব্দি নানান লাতিন আমেরিকান কবি যে বিচিত্র ও সমৃদ্ধ কাব্যজগতের সৃষ্টি করেছেন তার পরিচয় পেতে বাঙালি রসনা উন্মুখ হয়েছে এবং কিছু অনুবাদকের সুবাদে—তাঁদের মধ্যে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধায় অগ্রগণ্য—সেই রসভাণ্ডারের খানিকটা পরিচয় বাংলাভাষী পাঠক পেয়েছেন। কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে রবার্ট ফ্রস্টের সেই নৈরাশ্যবাদী ও প্রতিহারীসুলভ মন্তব্য আমাদের মনে পড়ে গেলেও, সৌভাগ্যক্রমে অনুবাদকেরা তাতে কর্ণপাত করেন নি।

অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তা আগলে রাখার চাইতে তাঁরা মনোযোগী হয়েছেন তাতে যা পাওয়া যায় তার সন্ধানে। তারই অনিবার্য ফলস্বরূপ আমরা পাঠকেরা লাভ করেছি লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন কবির নির্বাচিত কবিতার পৃথক বাংলা অনুবাদ, সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে দুই মলাটের মধ্যে নানান কবির কবিতার সংকলন।

মোশতাক আহমেদ নিজে কবি হিসেবে যশস্বী, দীর্ঘ দিন ধ’রে তিনি কাব্যচর্চায় রত। তিনি বিশ্বকবিতা অনুবাদে ব্রতী হয়েছেন বছর দশেক আগ । উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ুয়া থাকাকালীন-ই কাজটি শুরু করলেও এ-বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করেন ২০১১ সালে এবং তাঁর এই লাতিন আমেরিকান কবিতা অনুবাদ পরিক্রমা শুরু বছর কয়েক আগে। এখানে যে সাতজন লাতিন আমেরিকান কবির কবিতা তিনি অনুবাদ করেছেন—সিজার ভায়েহো [১৮৯২-১৯৩৮], মানুয়েল বানদেইরা [১৮৮৬-১৯৬৮], আলফোনসিনা স্তোর্নি [১৮৯২-১৯৩৮], হাভিয়ের আবরিল [১৯০৫-১৯৯০], রাফায়েল মেন্দেস দরিখ [১৯০৩-১৯৩৬], সালভাদোর নোভো [১৯০৪-১৯৭৪] এবং অক্তাভিও পাস [১৯১৪-৯৮]—তাঁদের মধ্যে প্রথম এবং শেষোক্ত কবির কবিতার অনুবাদ আমরা বাংলাভাষীরা প্রায়ই পেয়ে থাকলেও বাকি পাঁচজন-এর কবিতার অনুবাদ সহজলভ্য নয়, যদিও তাঁদের মধ্যে আলফোনসিনা স্তোর্নি যথেষ্ট খ্যাতিমান।

এবং অক্টাভিও পাস ছাড়া তাঁদের প্রায় সবার জন্ম ঊনবিংশ শতকের শেষ দশক থেকে বিংশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে। অর্থাৎ তাঁদের কাব্যকীর্তি লাতিন আমেরিকার সাহিত্যে যে পর্বটি বিখ্যাত ‘মদার্নিজমো’ [modernismo] নামে সুপরিচিত তার পরের সময়ের।

কবিতাগুলো নেয়া হয়েছে মূলত Dudley Fits সম্পাদিত Anthology of Contemporary Latin American Poetry’র ১৯৬৭ সালের সংস্করণ হতে, যদিও বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। নির্বাচিত কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু মৃত্যু, পলায়ন, ক্ষতি, অদম্য জীবন, প্রেম, প্রেমহীনতার বেদনা, প্রকৃতি, নিজ সংকল্পে অটল নারী, কবিতা, ইত্যাদি। কবি মোশতাক আহমেদ কবিতাগুলো ইংরেজি অনুবাদ থেকে আমাদের জন্যে বাংলায় পরিবেশন করেছেন।

জি এইচ হাবীব
সিজার ভায়েহো
আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন দ্রষ্টা। নিজের মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘এক প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে, বৃহস্পতিবারে’—ঘটেছিলও তাই! সিজার ভায়েহো [মার্চ ১৬, ১৮৯২-এপ্রিল ১৫, ১৯৩৮] ছিলেন পেরুনিবাসী কবি, নাট্যকার ও সাংবাদিক। জীবিতাবস্থায় মাত্র তিনটি কবিতার বই প্রকাশিত হলেও স্বাতন্ত্র্যগুণে যে কোনো ভাষায় বিশ শতকের অন্যতম প্রধান কবি হিসেবে তিনি বিবেচিত হন।

সাহিত্যের প্রচলিত ধারা থেকে তিনি নিজেকে রাখতেন এগিয়ে। প্রকাশমাত্রই তাঁর তিনটি কবিতার বইই বৈপ্লবিক আবির্ভাব হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। তবে নির্যাতন আর দারিদ্র্য সইতে হয়েছে কম না। কোনো কোনো সমালোচক তাঁকে দান্তের পরে সবচেয়ে বড় বিশ্বজনীন কবি হিসেবে চিহ্নিত করেন।

মিগুয়েল
পুরনো গোলঘরে বসে আছি
তোর না-থাকার পাশে, পাতকুয়োটির ধারে।
আমরা খেলতে শুরু করতে পারি, এখনই…
মা চেঁচাবেন, ‘ছেলেরা একটু আস্তে…’
আমরা হাসব, হাসতে হাসতেই লুকাব সিঁড়ির পেছনে,
কিংবা হলঘরে বা চিলেকোঠায়—
মা আর দেখতে পাবেন না আমাদের।
লুকোচুরি খেলায় আমরা ওস্তাদ ছিলাম, মিগুয়েল!
কিন্তু সব খেলাই চোখের জলে শেষ হয়।
আগস্ট মাসের সেই রাত্রিবেলা তুই যখন আবারো লুকালি—
কেউ আর হাসছিল না; ভোর হয়ে গেল ক্রমে।
তোর ভাই ক্রমাগত খুঁজেই চলেছে তোকে,
ঘিরে ধরেছে চতুর্দিকের ছায়ারা।
মিগুয়েল, ক্ষান্ত দে না এ বেলা, চাঁদমুখটা দেখা;
মা মিছিমিছি চিন্তা করবে।
প্যারিস, অক্টোবর ১৯৩৬
সমস্ত দৃশ্য থেকে আমিই কেবল পালিয়ে যাই।
পার্কের বেঞ্চি থেকে, নিজের পাতলুন থেকে,
সমস্ত সুবিধা থেকে, সমস্ত কাজ ফেলে দিয়ে,
নিজের প্রিয় সংখ্যাগুলো থেকে, সারাবেলা
সব কিছু থেকে আমিই কেবল পালিয়ে বেড়াই।
প্যারিস রোড থেকে পালিয়ে আমি চাঁদের টিলায় হাঁটি।
মৃত্যু আমাকে ছেড়ে যায়, ছেড়ে যায় টেলিফোন,
এবং চারপাশে ঘিরে থাকা লোকজন নিয়েও একাকী
আবারও নিজের চেহারা ফুটিয়ে তুলতে হয়,
এক এক করে বিদায় করি সবগুলো ছায়া।
এবং সমস্ত দৃশ্য থেকে আমিই কেবল সরে যাই, কেননা
আমার জুতো—তার ফিতে বাঁধবার ঘর, এমনকি
জুতোর তলায় লেগে থাকা কাদা, জামার ভাঁজ—
প্রত্যেকেই আমার চিহ্ন রাখতে চেয়েছিল।
সমস্ত দৃশ্য থেকে আমিই কেবল পালিয়ে যাই।
অক্টাভিও পাস
মেক্সিকোতে জন্ম নেয়া ১৯৯০ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবি অক্টাভিও পাসকে [১৯১৪- ১৯৯৮] বিশ শতকের লাতিন আমেরিকার অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক হিসেবে গণ্য করা হয়,

১৯৯০-তে, মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। আজীবন স্প্যানিশ ভাষায় কাব্যচর্চা করে চলা পাজ়ের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন স্যামুয়েল বেকেট, চার্লস টমলিনসন, এলিজ়াবেথ বিশপের মতো বিশিষ্ট লেখকরা। এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম হয়েছিল পাজ়ের। তাঁর সাহিত্যে মেক্সিকোর সমাজ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটে। উদ্ধৃত কবিতাটিতে মানব অস্তিত্ব ও দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন পাজ়, সুচারু দক্ষতায়।


যিনি আঁদ্রে ব্রেতোঁ কথিত ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সবচেয়ে খাঁটি কবি’। তিনি কূটনীতিক ছিলেন। কবিতা সমগ্র ছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে দ্যল্যাবিরিন্থ অব সলিচ্যুড, দ্য বো অ্যান্ড দা লাইর, এ ড্রাফট অব শ্যাডোজ, ঈগল অর সান ইত্যাদি। নোবেল কমিটি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছে ‘বিস্তৃত দিগন্ত প্রসারী অনুভূতিপূর্ণ লেখা, সংবেদন ও বুদ্ধিমত্তার যুগলবন্দি এবং মানবতাবাদী সততা দ্বারা চিহ্নিত।’

তাঁর কবিতা
সৌভ্রাতৃত্ব
একজন মানুষ হিসেবে আমার অস্তিত্ব আর কতটুকু
কিন্তু রাত্রি অসীম।
ওপরে তাকিয়ে দেখি
তারকালিখিত এক পৃষ্ঠা।
জানা নেই কিন্তু মনে হল
আমিও লিখিত এভাবে
এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই
কেউ একজন আমায় লিখে উঠল।
প্রতিপক্ষ
সূর্যটা অরণ্যে ডুবে গেছে বলে
অন্ধকারে, পর্বত ভেবে
আমার দেহে আরোহণ করছ!
আর আমি এই ভাসমান মধ্য রাতে
তোমাকে আঁকড়ে ধরেছি
নৌকা ভেবে!
সেতু
বর্তমান আর বর্তমানের মাঝে
তোমার আর আমার মাঝে
শব্দের সেতু।
সেতুতে উঠছ ধীরে, যেনবা
নিজেকেই ঢোকাচ্ছ সন্তর্পণে :
শব্দে শব্দে জোড়
আংটির মতো বৃত্তাবদ্ধ।
এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে
রংধনুর মতো
শরীর বেঁকে যাচ্ছে :
ওই খিলানের নিচে আমার সুখনিদ্রা।
আর কোনো ক্লিশে নয়
যেভাবে সূর্যের দিকে ডেইজির পাপড়ি মেলে,
তেমনিভাবে তোমার সুন্দর মুখ
উঁকি দিয়ে যায়
ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টানোর ফাঁকে।
পুরুষঘাতী জাদুকরী হাসি—
আহা! পুরো ম্যাগাজিনটাই অনিন্দ্য হয়ে উঠল!
নারী, তোমার জন্য নৈবেদ্য সাজিয়েছেন কত কবি?
কত দান্তে তোমাকে সাজিয়েছেন হে বিয়াত্রিচে?
মরীচিকার মোহে ফ্যান্টাসিভরা এই কবিতাকলা।
আজ আমি যদিও নতুন কবিতা লিখছি তোমার জন্য,
রচনা করব না নতুন কোনো ক্লিশে।
এই কবিতা সেই নারীদের জন্য
যাদের সৌন্দর্য তাঁদের প্রীতি সম্ভাষণে, তাঁদের আচরণে,
প্রসাধন চর্চিত চেহারায় নয়।
এই কবিতা তোমার জন্য, নারী—
যে শেহেরজাদি রোজ সকালে জেগে ওঠে
নতুন একটি গল্প বলবে বলে—
যে গল্পে আছে নতুন কোনো সুর,
যুদ্ধের মাঠে আশার দূত,
ভালোবাসার রণক্ষেত্রে বেঁচে থাকার লড়াই,
নতুন দিনের স্বপ্ন কিংবা আরও একটি রাত নিশ্চিত বেঁচে থাকার গল্প।
বেদনাগাঢ় এই পৃথিবীতে
হে উজ্জ্বল তারকা
হে অনমনীয় যোদ্ধা
হে আমার হৃদয়ের বন্ধু,
এখন থেকে আরাত্রি কাটবে নক্ষত্রের ধ্যানে
কোনো রঙিন ম্যাগাজিনের পাতা উল্টে নয়,
আর কোনো ক্লিশে নয়।
মানুয়েল বানদেইরা
ব্রাজিলের জনপ্রিয়তম কবি মানুয়েল বানদেইরা [১৮৮৬- ১৯৬৮]। তিনি ছিলেন সাহিত্যের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমালোচক। অসুস্থতার কারণে ১৯২২ সালের দিকে দীর্ঘ সময়ের জন্য ইউরোপ চলে যান এবং সেখানে আধুনিক সাহিত্য আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন যা কিনা ব্রাজিলে ফিরে এসে কবিতা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গঠনমূলক সমালোচনায় অবদান রাখতে রসদ জুগিয়েছে; ব্রাজিলের এই আধুনিকতার আন্দোলনের নাম ছিল ‘মদার্নিজমো’। কবির উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে লিবার্টিনিজম, কার্নিভাল, মর্নিং স্টার, ইভনিং স্টার, দিস আর্থ দ্যাট স্কাই, অ্যাশেস অব আওয়ারস ইত্যাদি।
মাতাল বন
বনের এ মাথা থেকে ও মাথা করে কানাকানি,
কিছু কি বলবে আজ!
ট্র্যাজেডি নাটকের অভিনেত্রীর ধরণে দুলছে সমূলে
বিদ্রোহী ডালপালা
দুলছে বিশ্বাসঘাতিনীর আশঙ্কায়;
নয়তোবা আছে নির্ঘাত জরুরি কোনো আবেদন।
বন কী জানে চাহিদা কি তার?
চাইছে কি জল?—নিশ্চয়ই না;
দু’দিন আগের বানের তোড়েই দিশেহারা আছে বন।
তবে কি শতাব্দীর জং মুছে শুদ্ধ হতে অগ্নি চাইছে আজ?
নাকি কোনোই চাহিদা নেই?
বোবা বন শুধু চাইছে কথা কইতে!
পৃথিবীর কোনো গোপন কথা
জমেছে কি গভীর মূলের কানে?
বনের এ মাথা ও মাথা করছে কানাকানি
মতিভ্রমের জঙ্গি মিছিল।
এক বাঁশঝাড়, একাকী
দূরে দাঁড়িয়ে
হালকা চালে দুলতে দুলতে
ওদের পাগলামি দেখে আর হাসে।
বাতাস ও জীবনের গান
বাতাস উড়িয়ে নিল পাতাদের
বাতাস উড়িয়ে নিল ফুল
বাতাস উড়াল যত মেওয়া
তবুও এ জীবন ভরপুর
ফুল ফল লতা পাতায়।
বাতাস উড়িয়ে নিল আলো
বাতাস উড়িয়ে নিল গান
বাতাস উড়াল যত সৌরভ
তবুও এ জীবন ভরপুর
সুগন্ধী, তারায়, গানে গানে।
বাতাস উড়িয়ে নিল স্বপ্নগুলো
বাতাস উড়িয়ে নিল বন্ধুদের
বাতাস উড়াল কত বান্ধবী
তবুও এ জীবন ভরপুর
নারী ও ভালোবাসায়।
বাতাস উড়িয়ে নিল মাসগুলো
বাতাস উড়িয়ে নিল উপমা
বাতাস উড়িয়ে নেয় সবকিছু
তবুও এ জীবন
সবকিছুতেই পূর্ণ—
ভরপুর।
নিশীথে
নিশী‌থে
ল্যাম্পপোস্টের ধারে
মশাশিকারি ব্যাঙের দৌরাত্ম্য।
রাস্তা নির্জন,
এমনকি মাতালশূন্য।
আমি নিশ্চিত, ছায়ার মিছিল যাচ্ছে;
যারা চলে গেছে—
কেউ এখনো জীবিত, কেউবা মৃত।
রাতের ঝরণা কাঁদছে নিরালায়
কিংবা কোনো বিগত বিশাল বিষাদ
আলফোনসিনা স্তোর্নি
আর্জেন্টিনার কবি আলফোনসিনা স্তোর্নি [১৮৯২-১৯৩৮] একজন গুরুত্বপূর্ণ লাতিন আমেরিকান কবি। তিনি শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা এবং নাটকের দলের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার দশটি কবিতার বই এবং কয়েকটি কাব্য সমালোচনার সংকলন আছে। স্তোর্নির জন্ম সুইজারল্যান্ডে। শৈশবে আর্জেন্টিনায় আসেন। আর্জেন্টিনার ছোট শহর করোনডাতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন; পাশাপাশি মুনডু আর্জেন্টিনোসহ অন্যান্য পত্রিকায় কাজ করতে শুরু করেন। ১৯১২ সালে তিনি বুয়েন্স আয়ার্সে গিয়ে কষ্টসাধ্য জীবনযাপন করতে শুরু করেন। ১৯১৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই লা ইনকুইদত দেল রোজাই [গোলাপেরঅস্থিরতা] প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালে তিনি ল্যানগুইদেজ গ্রন্থের জন্য জাতীয় পর্যায়ের সাহিত্য পুরস্কার পান। তাঁর লেখায় ক্রমশ নারীবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে ইউরোপ সফর তাঁর চেতনায় আরো পরিবর্তন আনে এবং তিনি মুনডো দে সেইতে পোজোছ [১৯৩৪] ও মাসকারিনা [১৯৩৮] বইতে নতুনতর নারীবাদী চেতনার স্বাক্ষর রাখেন। কথিত আছে কবি স্বেচ্ছায় সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হচ্ছে এল দুইচে দানো [মধুর আঘাত]।
উত্তরাধিকার
তুমি বলেছিলে—আমার পিতা কাঁদে নি কখনো;
তুমি বলেছিলে—আমার পিতামহ কাঁদে নি কখনো;
আমার বংশে পুরুষের কান্না বিরল,
ইস্পাতে মোড়ানো পৌরুষ।
এ কথা বলতে বলতে তোমার এক ফোঁটা অশ্রু
গড়িয়ে এল আমার মুখের ওপর, নোনা
যেন বা এক ফোঁটা বিষ
পান করলাম আজ।
বোকার হদ্দ বোঝ নি কি নিজেই,
শতাব্দী-প্রাচীন দুঃখের স্বাদ তোমার অশ্রুতে;
আহ, বইতে পারছি না এই ভার—
এই এক ফোঁটা অশ্রুর!
ঘুমুতে যাচ্ছি
ফুলের পাপড়ি, কুয়াশার জাল আর
গুল্মের কোল দিয়ে গড়া বিকল্প ধাত্রী
আমার জন্যেই গড়েছ মৃত্তিকার চাদর
শ্যাওলার নকশি কাঁথা।
ঘুমুতে যাচ্ছি আমি, হে ধাত্রী, শুইয়ে দাও আমাকে
মাথার কাছে মেলে দিয়ে তারাপুঞ্জের বাতি
যে ভাবে সাজাতে চাও—
এই নাবালে সবই আপন।
একা থাকতে দাও, শেষবার শুনি কলি ফোটার নৈঃশব্দ্য!
আকাশের ওই স্বর্গীয় ইশারায়
পাখিরাও শুধু তোমার জন্যেই গান গায়।
সব কিছু ভুলে যাবে, তবুও ধন্যবাদ
শুধু মনে রেখ—
সে যদি কখনও জানতে চায়, বলে দিও
যা কিছু ফেলে এসেছি, ফেলেই এসেছি তা
ঘামাই না মাথা আর।
মধুর উৎপাত
তোমার করপুটে ছড়িয়ে দিয়েছি এ জীবন—
আমার বিষণ্নতাগুলো সোনার গুঁড়োর মতো ঝিকমিক করছে
তোমার প্রশস্ত হাতে।
আমার সমুদয় মিঠেপনা, সেও তো ছিনিয়ে নিয়েছ দুই হাতে;
আমি এখন উপুড় করে দেয়া শূন্য সুগন্ধী শিশি।
নীরবে সয়ে গেছি সহস্র মধুর উৎপাত—
বিষাদ গাছের ছায়ায় এলিয়ে থাকা জীবন
বেঁচে থাকবার চালাকিগুলো জানে,
রেখে যাচ্ছে সকল চুম্বন
জীবন উজাড় করে নেয়া নির্বিকল্প দুই করতলে।
হাভিয়ের আবরিল
হাভিয়ের আবরিল ১৯০৫ সালে পেরুর রাজধানী লিমায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা ও গদ্য লেখার পাশাপাশি তিনি কবি সিজার ভায়েহোকে নিয়েও গবেষণা করেছেন।
তারুণ্যে তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। প্যারিসে অবস্থানকালে সুররিয়ালিস্টদের সান্নিধ্যে আসেন এবং এক পর্যায়ে জাঁ ককতোর শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন। শুরুতে তাঁর কবিতা সুররিয়ালিজম ঘরানার হলেও পরবর্তীকালে তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলে বিষণ্ণতা, রোমান্টিক নব্য প্রতীকবাদীদের মতো।
পেরুর এই গুরুত্বপূর্ণ কবির উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে : হলিউড, দ্রিফিসিল ত্রাবেজো, দেসকাব্রিমিয়েন্তো দেল আলবা ইত্যাদি।
১৯৯০ সালে তিনি মন্টিভিডিওতে মারা যান।
নৈশ সংগীত
(ছায়াহীন
প্রতিধ্বনিহীন প্রেম
আর নীরবতা)
প্রেমহীন এই রাত্রির নীরবতায়
শিশিরকণার মতো ঢুকে পড়েছ
বেদনায় ভাঙাচোরা
নিঃসঙ্গ চোরাকুঠুরি অনিঃশেষ আলোয় ভরে!
চলে গিয়েছিলাম নিজেরও আড়ালে
ঘৃণার প্রান্তরে বধির।
এক গভীর ঐকতান
আর এক অপলক চোখ
আত্মহারা করে দিল আমাকে!
ভৈরবী
এই ভোরে
গাইল আবারও
ছোট্ট পাখিরা,
ভোরকে বাজাল ভৈরবীতে।
আগের মতোই আছে দেখছি
এই আত্মার পাখিরা!
সমস্ত কিছুর গভীরে তাই
সংগীতের চোরাস্রোত।
আমার হৃদয় হরণ করে
হৃদয় দিয়ে গড়েছে নীড়
ছোট্ট পাখিরা।
রাফায়েল মেন্দেস দরিখ
[১৯০৩-১৯৩৬] আর্জেন্টিনার কবি
‘আলো হাতে চলিয়াছে’
আলো হাতে চলছিল মেয়েটি;
বলছিল, ‘কখনও নিভতে দেবো না!’
বুকের কাছে জড়িয়ে রাখল আলো
জ্বলে ওঠে উজ্জ্বল শিখা তার
‘কখনও নিভতে দেবো না!’ দমকা বাতাস
উসকে দিতেই চোখজোড়া গেল পুড়ে
পাগল মেয়ে হাসছে তবু;
‘কখনও নিভতে দেবো না’ বলছিল,
বুকের কাছে জড়ানো তার আলোকবর্তিকা।
সালভাদর নোভো
সালভাদর নোভো লোপেজ [১৯০৪- ১৯৭৪] একজন মেক্সিকান কবি, নাট্যকার, অনুবাদক, টিভি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি মেক্সিকোর সমসাময়িক সমাজ ও সাহিত্যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
কবি ও কবিতা
যে কবির তীব্র রোমান্টিক আর আবেগী জীবন
রাষ্ট্র ঘরে ঘরে—
তাঁর বই ফেরে হাতে হাতে
তাকে নিয়ে লেখা হয় বই, ভরে থাকে পত্রিকার পাতা
তাঁর ছবি দিয়ে।
হৃদয়ঘটিত, নারীঘটিত আর প্রকৃতি-খচিত পঙ্‌ক্তিময়
ভালোবাসা অঙ্কুর মেলে বেদনা-গভীর মৃত্তিকায়।
পয়ারে তাকে ধরে রাখে
ছন্দবিচ্যুতিহীন
নতুন নতুন রূপকের ঝলকানি!
কবিতার সুর সংক্রামক বড়—
শ্রোতার চোখে আনবে জল
অনুপ্রাণিত কবিতাগুলো,
কবির আবৃত্তি মথিত করবে হাততালি
শিরোপা বসবে মাথায়।
আমিও তো লিখতে পারি খাসা কবিতা
অনুপ্রাসে ঠাসা
আত্মহারা পাঠক বলে—‘বেড়ে লিখেছ বাপু!’
তাদের বলি তখন
কিভাবে লিখার শুরু কিশোরবেলায়,
অনুক্ত থেকে যায়
অগ্রজের কাছে আজীবনের দেনা।
দক্ষ অভিনেতার মতো বুঝিয়ে দেবো
পাঠকের মন কিভাবে বুঝতে পারি।
রাত্রি গভীর হলে, নির্জনে ভাবি
স্মৃতি ছাড়া, অন্য কবির কণ্ঠ ছাড়া
আমার কবিকণ্ঠ কী লতিয়ে উঠত অবেলায়!
কবি পরিচিতি:
পেরুর কবি সিজ়ার ভ্যালেজো
সিজার ভ্যালেজো (Caesar Vallejo), যাঁর পুরো নাম সিজার আব্রাহাম ভ্যালেজো মেনডোসা, ১৮৯২ সালে পেরুতে জন্মগ্রহণ করেন। কবিতা রচনা করেছেন স্প্যানিশ ভাষায়। তিনি ছিলেন শিমু সংস্কৃতি ও স্প্যানিশ ক্যাথলিক ধারার সংমিশ্রণের সম্পন্ন উত্তরাধিকারবাহী। ফলে তাঁর চেতনায় গভীর আধ্যাত্মিকতার ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। উচ্চশিক্ষিত কবির সৃষ্টিতে ছিল সমাজচেতনা, রাজনীতি, এমনকী সমাজের খেটে খাওয়া মানুষের লড়াইয়ের উজ্বল উপস্থিতি। জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি বই ছাপা হলেও প্রতিটিও ছিল ভাষা ও চেতনার দিক থেকে বৈপ্লবিক। ভ্যালেজোর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও মতাদর্শের কারণে তাঁকে ১৯৩০-এ পেরু থেকে নির্বাসিত করা হয়। তিনি ইউরোপ চলে যান।
“আমার আর্তি ছুঁয়ে থাকে অপার নৈঃশব্দ, অবিরাম বর্ষণ ও অফুরান রাস্তাগুলিকে…”
সিজার ভ্যালেজো।
নীচের কবিতাটি তাঁর প্যারিসে বসবাসকালে লিখিত।
” সাদা পাথরের ওপর শুয়ে কালো পাথর”
এক বর্ষণমুখর দিনে প্যারিসে আমার জীবনাবসান হবে
আমার স্মৃতিতে সে দিন বিমূর্ত।
প্যারিসে আমার মৃত্যু হবে। সেদিন এক পা-ও নড়ব না।
সম্ভবত বৃহস্পতিবার, যেমন আজও শরৎকালের এক বৃহস্পতিবার।
এ বৃহস্পতিবার না হয়ে যায় না কারণ আজই অবতীর্ণ হচ্ছে
এই পঙক্তিগুলি, ঘোর আসঞ্জনে স্পর্শ করে আছি
সমূহ ভুল, আজকের মতো কোনওদিনই নিজের সঙ্গে এভাবে দেখা হয়ে যায়নি
সম্মুখে প্রসারিত রাস্তাগুলিতে, একা।
সিজার ভ্যালেজো প্রয়াত। ওরা তাকে প্রহার করে তৃপ্তি পাবে
যদিও সে কখনও কারও প্রতি বিরূপ ছিল না;
তাঁকে নির্দয় বেত্রাঘাত করবে এবং
শত্রু দড়িতে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতেও ছাড়বে না, প্রত্যক্ষদর্শনের এই অভিঘাত
বৃহস্পতিবারেরই, এবং আমার আর্তি ছুঁয়ে থাকে
অপার নৈঃশব্দ, অবিরাম বর্ষণ ও অফুরান রাস্তাগুলিকে…
আলেজান্দ্রা পিয়ারনিক।
কবি পরিচিতি:
আলেজান্দ্রা পিয়ারনিক (Alejandra Pizernik) ১৯৩৬ সালে আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণ করেন। কবিতচা রচনা করতেন স্প্যানিশ ভাষায়। তিনি ছিলেন রাশিয়া থেকে আসা এক ইহুদি অভিবাসী পরিবারের সন্তান। তাঁর লেখা ও দর্শন প্রবল নারীবাদী চেতনার প্রতিফলন। ভালবাসা ও মৃত্যু তাঁর লেখায় সম্যক রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাঁর লেখায় আত্মজীবনীমূলক ভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উক্ত কবিতাটিতে ভালবাসা ও মৃত্যুর বিষাদ উপস্থাপিত।
তাঁর কবিতা:
বিদায়
আলো নেভাও, আগুন পরিত্যক্ত হোক
একটি বিরহী পাখির সুরে ভেসে আসে ভালবাসা
আমার নৈঃশব্দ ঘিরে কত লিপ্সা প্রাণিত হয়ে আছে
এবং এই অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত আমাকে সান্নিধ্য দেয়
লাতিন আমেরিকার কবি
‘মনচো আজুয়াগা’র কবিতা
(প্যারাগুয়ের কবি।)
কাব্যশাস্ত্র
আর লেখালেখি করবে না।
আর কোন কথা বলবে না, আমাকে শুধালো ওরা।
চুপ থাকবে।
সব কিছুই নিরর্থক, ওরা বললো আমাকে।
এত কষ্ট খাটা-খাটনি নেহাইত বেগার খাটা।
কিন্তু তবুও
বাহিরে, রাস্তায়
বেনামী কন্ঠগুলো, প্রতিচ্ছায়া, আধো-ছায়া
চেয়ে বসলো বাতাস, নীলাভ বৃষ্টি
নভোমণ্ডল।
Arte Poetica
Que ya no escriba.
Que ya no hable, me pidieron.
Que calle.
Que todo es inútil, me dijeron.
Que no vale la pena tanto esfuerzo.
Sin embargo,
afuera, en la calle,
voces anónimas, sombras, casi sombras
reclamaban el viento, la lluvia azul,
el cielo.
অক্টাভিও পাজের কবিতা
মেক্সিকোর গান
আমার দাদা কফি খেতে খেতে
গল্প করতেন – হুয়ারেজ আর পোরফিরিও,
জুয়াভ বাহিনী আর প্লাতেয়াদোর ডাকাত দল।
টেবিলক্লথ থেকে ভেসে আসতো বারুদের গন্ধ।
আমার বাবা পানীয় পানের ফাঁকে
শোনাতেন জাপাতা আর ভিয়া
সোতো, গামা আর ফ্লোরেস মাগোন ভাইদের কাহিনী।
টেবিলক্লথ থেকে ভেসে আসতো বারুদের গন্ধ।
আমি চুপ করে থাকতাম
আমি কার গল্প বলবো?
Cancion mexicana
Mi abuelo, al tomar el café,
Me hablaba de Juárez y de Porfirio,
Los zuavos y los plateados.
Y el mantel olía a pólvora.
Mi padre, al tomar la copa,
Me hablaba de Zapata y de Villa,
Soto y Gama y los Flores Magón.
Y el mantel olía a pólvora.
Yo me quedo callado:
¿De quién podría hablar?
কবি পরিচয়
সেলভা কাসাল (১৯৩০-) উরুগুয়ের কবি। উরুগুয়ের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুলিও কাসালের কন্যা, পঞ্চাশের দশক থেকে লেখালেখির শুরু। উপরের কবিতাটি তার ২০০১ সালের কবিতাগ্রন্থ ‘ভিভির এস পেলিগ্রোসো’ (‘বেঁচে থাকা বিপদজনক’) গ্রন্থ থেকে নেয়া।
সেলভা কাসালের কবিতা
সব মৃতই কখনো শিশু ছিল
তারাদের মত খসে যাবার আগে, মস্তক মাটিতে
গড়াগড়ি দেয়ার আগে
এসো বিলাপ করি, যে পশুদের বধ করেছি
যে মানুষদের হত্যা করেছি
যে প্রেমিকদের ক্রুশবিদ্ধ করেছি বিনা কারণে
যে অভিযানে যোগ দিয়েছি
একটিবারও বিস্মৃত না হয়ে
যে সব মৃতই কখনো শিশু ছিল
সব মানুষই।
Todos los muertos fueron niños
Antes que como astros las cabezas caigan
y rueden
lloremos por los animales que hemos matado
los hombres que hemos asesinado
los amores que hemos crucificado para nada
los viajes que no hicimos
sin olvidar
que todos los muertos fueron niños
todos los hombres.
কবি পরিচয়
হোসে এমিলিও পাচেকো (১৯৩৯-) – বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মেক্সিকোর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ২০০৯ সালে লাভ করেন হিস্পানিক বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার ‘প্রেমিও সের্ভান্তেস’।
অনুবাদ – হোসে এমিলিও পাচেকো’র কবিতা
তেওতিহুয়াকান
তেওতিহুয়াকান-এ বৃষ্টি পড়ছে।
কেবল মাত্র বৃষ্টিই
রহস্যোদ্ধার করতে পেরেছে এই মৃত্যুপুরীর।
Teotihuacan
Llueve en Teotihuacán.
Sólo la lluvia
ha descifrado a esta ciudad de muerte.
টীকা –
তেওতিহুয়াকান – মায়া সাম্রাজ্যের প্রাচীন নগরী, মেক্সিকো সিটি থেকে অনতিদূরে অবস্থিত। প্রাক-কলম্বাস যুগে পশ্চিম গোলার্ধের বৃহত্তম শহর ছিল। ৮৩ বর্গ কিমি জুড়ে এর বর্তমান ধ্বংসাবশেষ।
কবি পরিচয়
আলবের্তো ব্লাংকো (১৯৫১-) – আধুনিক মেক্সিকান কবিতার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রকাশ করেছেন কুড়িটিরও বেশী নিজস্ব কবিতার সংকলন, এবং সমপরিমাণ অনূদিত কবিতার বই।
অনুবাদ – আলবের্তো ব্লাংকো’র কবিতা
পালেংকে’র ভালবাসা
পৃথিবীর সকল
স্বচ্ছতা এই ভোরের শিশিরে
স্নেহশীল হাতে
বোনা শিলা এখানে প্রস্ফুটিত
প্রবালখন্ডগুলো
মন্দির আর কাপোকের মাঝে সাগরের পূর্বাভাস
ভেসে বেড়ায়, নিরুদ্দেশ;
নদী যেন শ্বেতবর্ণ বাঘের এক লিকলিকে ফিতে
Amor de Palenque
Presente toda
la claridad del mundo en el rocío
Manos amorosas
siembran piedras y los hacen florecer.
Formas de coral,
presagio del mar entre templos y ceibas.
Navegan, se pierden:
el río es una cinta de jaguares blancos.
টীকা –
পালেংকে – দক্ষিণ মেক্সিকোর চিয়াপাস প্রদেশে অবস্থিত প্রাচীন মায়ান শহর। এর ধ্বংসাবশেষ মায়া সংস্কৃতি ও সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। পালেংকের প্রাচীন দেয়ালে খোদাই কারুকাজ ও মূর্তি আজও বিস্ময়কর, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পর্যটকদের কাছে সমতুল্য আকর্ষনীয়, এবং ব্লাংকোর কবিতার উদ্দীপনা।
কাপোক গাছ – মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার স্বজাতীয় এক উদ্ভিদ প্রজাতি। বিশালাকৃতির গাছ, উচ্চতায় ২০০ ফুট ছাড়িয়ে যেতে পারে আর ব্যাসে ১০ ফুট। মায়া পুরানে অর্থবহ, পুণ্যময়ী গাছ। সেইবা নামেও পরিচিত।
কবি পরিচয়
আন্দ্রেস এলোয় ব্লাংকো (১৮৯৭-১৯৫৫) ভেনেজুয়েলার কবি ও রাজনীতিবিদ। তৎকালীন সামরিক শাসক হুয়ান ভিসেন্তে গোমেজ’এর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ‘২৮-এর প্রজন্ম’-র অন্যতম সদস্য।
অনুবাদ – আন্দ্রেস এলোয় ব্লাংকো’র (১৮৯৭-১৯৫৫) কবিতা
দরিদ্র ছন্দের সনেট
আমায় দাও রুটি তোমার নিজের হাতে দলা
আমায় দাও রুটি তোমার উনুনেতে সেঁকা
আমায় দাও রুটি তোমার যাতাকলে পেষা
আমায় দাও রুটি তোমার বেলনেতে বেলা
আমায় দাও জমি তোমার হাতের তালুয়ে গোঁজা
আমায় দাও পালং তোমার ঘরের কোনে ঠেসা
আমায় দাও চুমুক তোমার পিয়াসে নিংড়ানো
আমায় দাও পোশাক তোমার গায়ের ঘামে ভেজা
(অসমাপ্ত)
Soneto de la Rima Pobre
Me das tu pan en tu mano amasado,
me das tu pan en tu fogón cocido,
me das tu pan en tu piedra molido,
me das tu pan en tu pilón pilado.
Me das tu rancho en tu palma arropado,
me das tu lecho en tu rincón sumido,
me das tu sorbo, a tu sed exprimido,
me das tu traje, en tu sudor sudado.
Me das, oh Juan, tu dame de mendigo,
me das, oh Juan, tu toma de pobrero,
tu clara fe, tu oscuro desabrigo,
y yo te doy, por lo que dando espero,
el oscuro esperar con que te sigo
y el claro corazón con que te quiero.
কবি পরিচয়
মারিও বেনেদেত্তি (১৯২০-২০০৯) উরুগুয়ের কবি, ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক। বিংশ শতাব্দীর হিস্পানিক সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তার উপন্যাস লা ত্রেগুয়া (The Truce বা যুদ্ধবিরতি) কুড়িটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।
অনুবাদ – মারিও বেনেদেত্তি’র কবিতা।
এগারো
গীর্জার কোন পাদ্রীই
এখনো ব্যাখ্যা দিতেন পারেননি
কি কারণে
একাদশ কোন বিধান নেই
যেটি নারীকে নিষেধ করবে
তার পড়শীর স্বামীকে
কামনা না করতে।
(আরেকটি ভার্শন)
পড়শীর স্বামীকে ভালোবাসা নিষেধ
নারীকে আদেশ করে
এমন কোন একাদশ বিধান
কেন নেই
গীর্জার কোন পাদ্রীই
আজ অব্দি তার সদুত্তর দিতে পারেননি।
Once
Ningún padre de la iglesia
ha sabido explicar
por qué no existe
un mandamiento once
que ordene a la mujer
no codiciar al hombre
de su prójima.
টীকা –
সিনাই পাহাড়ের চূড়ায় মুসা নবীর প্রাপ্ত দশটি বিধানের (Ten Commandments) শেষটি ছিল “তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীকে কামনা করবে না” (thou shalt not covet thy neighbour’s wife)।
মার্টিন এস্পাদার কবিতা
১৯৫৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মার্টিন এস্পাদা। ১৯৮২ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘দা ইমিগ্রান্ট আইসবয়’স বোলেরো’ প্রকাশিত হ্য।‘সিটি অফ কাফিং অ্যান্ড ডেড রেডিয়েটরস’, ‘ইমাজিন দা এঞ্জেলস অফ ব্রেড’, ‘আলাবাঞ্জা’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।লাতিন আমেরিকা বিশেষ করে পুয়ের্তো রিকোর বিভিন্ন অনুষঙ্গ উঠে আসে এস্পাদার কবিতায়। দীর্ঘদিন লাতিন আমেরিকার শ্রমিকদের অভিবাসনের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি এবং আইনি পরামর্শদাতা হিসেবেও কাজ করেছেন।‘ রবার্ট ক্রেলি এ্যাওয়ার্ড’, ‘প্যাটারসন পোয়েট্রি প্রাইজ’ ছাড়াও ‘ন্যাশনাল বুক ক্রিটিক্স সার্কল অ্যাওয়ার্ড’- এর জন্য মনোনীত হয়েছিলেন এস্পাদা। বর্তমানে তিনি ম্যাসাচুসেটস-আমহাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন।
মার্টিন এস্পাদার কবিতা
শুকনো ভাত
আমরা পুয়ের্তোরিকানরা বলি
হাড়ির তলায়
শুকনো ভাত লেগে থাকার
মজাটাই আলাদা!
রান্নাঘরের প্রত্নতাত্মিকদের মতো
হাতা দিয়ে ঐ শুকনো ভাতগুলিকে
চেঁছে তুলি আমরা।
হয়ত ভাতের দামটাই এর কারণ
হয়ত হাঁড়ির তলায় শুকনো ভাত
আটকে থাকাটাকে আমরা
রূপক হিসেবে দেখি
আবার এমনও হতে পারে
হাঁড়ির তলায় লেগে থাকা শুকনো ভাতের
যন্ত্রণাটাই আমরা চিবিয়ে খেতে শিখে ফেলেছি।
যে মানুষগুলি লাল রঙের গাছ হয়ে গিয়েছে
আমি যখন লাল মেপল গাছগুলিকে দেখি
আমার ঐ মুচিটির কথা মনে পড়ে যায়
ঐ মাছওয়ালাটির কথাও মনে পড়ে
পাতার মত টকটকে লাল,
ম্যাসচুসেটস সরকার যাদের
ইলেকট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলেছিল।
আমি যখন লাল মেপল গাছগুলিকে দেখি
আমার লাল ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলের কথা মনে পড়ে
ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলের মতো দুজন কবি
কব্জিতে দড়ি বাঁধা
নেভির গানবোট ছাড়াই যারা
সান খুয়ান উপসাগরের কথা ভেবেছিল।
আমি যখন ফ্ল্যামবোয়েন্ট ফুলগুলিকে দেখি
ঠাকুমার কথা মনে পড়ে যায় আমার
ক্যাটালানে লাল রঙকে যা বলা হয়
সেটাই ঠাকুমার নাম ছিল,
স্পেনের যুদ্ধ
হাজার হাজার নামহীন শ্রমিক
ভাঙা রাইফেল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
যখন আমি আমার ঠাকুমাকে দেখি
ক্যাটালানে যার নামের অর্থ লাল রঙ,
আমার য়ুনিয়নের সংগঠকদের কথা মনে পড়ে
যারা নামহীন কবরে পড়ে থেকে শুধু
লাল গাছগুলির
খাওয়ার জুগিয়ে যাচ্ছে।
যখন আমি একটি পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে
কয়েকশ বছরের পুরনো লাল গাছগুলিকে দেখি
আমার মনে হয়, লাল পাতাগুলি আসলে
জেলে মরে যাওয়া সন্ত্রাসবাদীদের হাত আর
লাল ফুলগুলি, দড়ি দিয়ে বাঁধা কবিদের চোখ-মুখ
ওদের কথা মনে রাখার জন্যেই ফুলগুলি ফুটে আছে।
আমি দেখি লাল রঙের গাছ হয়ে যাওয়া মানুষগুলি
ভাঙা রাইফেলের মতো
তাদের ডালপালা আকাশে তুলে ধরেছে।
———————————————————
[ (সংগৃহীত ও সম্পাদিত) – ঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার –
১). সুরেশ রঞ্জন বসাক (ভূমিকা ও অনুবাদক)।
২). রাজেশ গঙ্গোপাধ্যায় (অনুবাদক)।
৩).মৃন্ময় চক্রবর্তী (অনুবাদক)।
৪).মোশতাক আহমদ (অনুবাদক)।
৫). শৌভিক দে সরকার (অনুবাদক)। ]
#story_and_article
#নিবন্ধ
https://storyandarticle.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *