লাশ

  • লাশ
    ————-
  • পুলক মন্ডল
  • ————-
    শীতের সকাল। তখনও কুয়াশা পুরোপুরি সরেনি। রোজকার মতো হাঁটতে বেরিয়েছেন সুপ্রতীম বাবু। লক্ষ্যও নির্দিষ্ট। শহরের একপ্রান্তে থাকা একটি পার্ক। দিনের অন্যসময় কিম্বা বিশেষ করে বিকালের পর থেকে এই পার্কটি উচ্ছল তরুণ-তরুণীর দখলে থাকলেও সাতসকালে তাঁর মতো প্রবীণ-বৃদ্ধরা ছাড়া বিশেষ কেউ আসেনা।
    পার্কের কাছাকাছি এসে সুপ্রতীম বাবুর মনে হল যেন শীতের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য কুয়াশার তাঁবু ঢেকে ফেলেছে এই ছোট্ট পার্কটাকে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ভেতরে থাকা গাছ-পাখি-প্রকৃতি। আধখোলা গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে তিনি বুঝলেন যে আজ তিনিই প্রথম। অবশ্য এমনটা আগেও হয়েছে, কখনো তিনি আগে এসেছেন কখনো দু-একজন আগেও এসে গেছে, যদিও খুব একটা দেরী তাঁর কোনদিনই হয়না। তিনি তাঁর সম্পূর্ণ শরীর দিয়ে কুয়াশা’র জাল সরাতে সরাতে আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর বেশ ভালো লাগছিল। আচমকা তাঁর পায়ে শক্ত মতো কি যেন একটা ঠেকল, তিনি খানিকটা হোঁচট খাওয়ার মতো পরিস্থিতি সামলে নিয়ে নীচের দিকে একটু ঝুঁকলেন, তারপরই চমকে উঠে তিনি দ্রুত দু-এক পা পিছিয়ে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে রইলেন।
    -একটি মেয়েমানুষের দেহ! প্রাণ আছে না নেই! এখানে কিভাবে এল? পার্কের ভেতরে কি আর কেউ আছে? এমনি নানাবিধ ভাবনার মধ্যে তিনি কুয়াশা ভেদ করে চারপাশে যতটা দেখা সম্ভব তা চেষ্টা করলেন, তারপর নীচু হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে উপুড় হয়ে থাকা দেহটাকে খানিকটা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। মধ্যবয়স্কা! তবে যৌবন এখনও অবশিষ্ট আছে। কিন্তু দেহে যে আর প্রাণ নেই তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলনা বিডিও অফিসের অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ বড়বাবু সুপ্রতীম বাবুর। গেটের কাছে গলার শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, তারপর পরিচিত প্রাতঃভ্রমণকারীদের ডেকে আনলেন। কেউ বললেন, ‘ছুঁয়ে দেখবেন না’, কেউ-‘এখনি পুলিশে খবর দেওয়া উচিত’, একজন বললেন, ‘আমার পরিচিত এক সাংবাদিক আছে, তাকে খবর দিচ্ছি’। তবে লাশটির পরিচয় যে উপস্থিত কেউই জানেননা সে ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত হলেন।
    ——- সুপ্রতীম বাবু পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে একবার সময় দেখে নিলেন। প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। তার মানে দু’ঘণ্টা হয়ে গেছে। এতক্ষনে তিনি বাড়ি চলে যান, কেননা আটটা’র সময় তাঁকে বাজার যেতে হয়, ন’টার সময় নাতিকে স্কুলে দিয়ে আসা, এ সময়টায় প্রতিদিনই তিনি খুব ব্যস্ত থাকেন। সুপ্রতীম বাবু ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু এখনই তাঁর বাড়ি ফেরার উপায় নেই কেননা এতক্ষনে পুলিশ এসে গেছে, অবশ্য তারও আগে চলে এসেছে সাংবাদিকরা। ইতিমধ্যে পুলিশ তাঁকে একপ্রস্থ জেরা করেছে এবং তাঁর ফোন নাম্বারটা নিয়ে রেখেছে। একজন পুলিশ অফিসার এখনি তাঁকে পার্ক ছাড়তে নিষেধ করেছেন। ওদিকে তাঁর ফেরায় দেরীতে বাড়ির পরিস্থিতি কি হবে সে কথা ভেবে এই শীতের সকালেও তিনি দেহে খানিকটা ঘাম অনুভব করলেন। এমনকি ফোন করে এখানকার ঘটনা বাড়িতে জানাবেন কিনা সে ব্যাপারে তিনি যখন ইতস্তত করছেন, তখনই একটি বড় ক্যামেরা এবং লাঠির ডগায় ধরে থাকা একটি মাউথপিসের মতো বস্তু তাঁর মুখের সামনে এগিয়ে এল। অলক্ষে থাকা কোন এক সম্মাননীয়ার উদ্দেশে লাঠি ধরে থাকা ব্যাক্তিটি বলে উঠলেন, ‘…তুমি শুনতে পাচ্ছ… আমার সামনে এখন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, যিনি প্রথম ঐ লাশটিকে দেখেন….আমি অনুরোধ করবো আমার ক্যামেরাম্যান…কে ওনাকে জুম করে ধরার জন্য…আপনার নাম কি? আপনি কখন প্রথম দেখেন? তারপর আপনি কি করলেন?’…… আচমকা একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নই হোক কিম্বা জীবনে এই প্রথমবার একগাদা লোকের মাঝখানে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর জন্যই হোক সুপ্রতীম বাবু রীতিমতো হকচকিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে তাঁর নামধাম-পরিচয় নিত্যসঙ্গীরা জানিয়ে দিয়েছেন। সাংবাদিক ততক্ষণে টিভির সংবাদ-পাঠিকার উদ্দেশ্যে বলে চলেছেন, ‘…তুমি বুঝতেই পারছ, সাতসকালে এমন একটা দৃশ্য থেকে উনি নার্ভাস হয়ে পড়েছেন, আমরা চেষ্টা করছি ওনার মুখ থেকে প্রকৃত সত্য তুলে ধরার, কেননা আমরাই একমাত্র চ্যানেল যারা সবার আগে সত্যকে তুলে ধরে…’। পাশ থেকে অন্যান্য সাংবাদিকদের কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে, কেউ বলছেন, ‘ খুব সম্ভবত খুনের আগে ঐ মহিলাকে রেপ করা হয়েছে, যদিও এটা তদন্তসাপেক্ষ তবুও বিশেষজ্ঞদের অনুমান এমনটা হতেও পারে’, কেউ বলছেন- ‘ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যাচ্ছে অবৈধ সম্পর্কের জেরেই মহিলাকে খুন করা হয়েছে’ , কেউ বলছেন- ‘ সম্পত্তির লোভেই মহিলাকে খুন করা হয়েছে এমনটা আমরা বিশেষ সুত্রে জানতে পারছি’। তবে সব চ্যানেলই যে ব্রেকিংনিউজ দেয় এবং প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে তা এই প্রথম কাছ থেকে অনুভব করলেন সুপ্রতীম বাবু।
    এরপর কেমন একটা স্বপ্নাচ্ছন ঘোরের মতো কিছু মুহূর্ত কাটে সুপ্রতীম বাবুর। সাংবাদিকরা কিছু জিজ্ঞেস করে। তিনি কিছু উত্তর দেন, যার সবটা তিনি পরে আর মনে করতে পারবেন না। আচমকা বাড়ি থেকে ফোন আসায় তিনি যেন সম্বিত ফিরে পান। দুরুদুরু বুকে তিনি ফোনটা রিসিভ করলেন। ছেলে বলে উঠলো, ‘বাবা তুমি চিন্তা কোরনা, আমি অফিস যাবার পথে তোমার নাতিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাব’। তারপরই গিন্নির গদগদ কণ্ঠ, ‘ওগো তোমাকে আজ বাজার করতে হবেনা, আমি বাড়ির সামনে সব্জিওয়ালার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছি, তুমি আরও খানিকক্ষণ থাকো ওখানে’। পাশ থেকে বৌমার গলা শোনা গেল, ‘বাবা আপনি বাড়ি ফিরুন, তারপরেই জলখাবারটা করব, গরম গরম খাবেন’। সবশেষে তাঁর সবচেয়ে আদরের ছোট্ট নাতিটা খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল, ‘দাদাই, আজ স্কুলে গিয়েই বন্ধুদের আর ম্যাম-স্যার সব্বাইকে বলব তোমাকে টিভিতে দেখাচ্ছে’।
    ফোনটা রেখে সুপ্রতীম বাবু একবার ভাববার চেষ্টা করলেন- অফিস যাবার পথে দশ মিনিট আগে বাড়ি থেকে বেরলে অনায়াসেই নাতিকে স্কুলে পৌঁছে দিতে পারে ছেলে কিম্বা বাড়ির সামনে দিয়ে রোজই তো রিক্সাভ্যানে সবজী যায়, কই! কোনদিন তো গিন্নী বলেনা- আজ বাজার যেতে হবে না, আবার নাতিকে স্কুলে দিয়ে ফেরার পর যখন তাঁকে ঠাণ্ডা জলখাবার গিলতে হয় তখন বৌমা তো কোনদিন বলেনি- দাঁড়ান বাবা, আমি খাবারটা গরম করে দিই।
    -কিন্তু কোন ভাবনাই তাঁর মনে দানা বাঁধতে পারলো না। চারপাশের চাপা কোলাহল, গুঞ্জন, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ, সাংবাদিকদের বক্তৃতা, নেতাদের আনাগোনা, পার্কের সামনের রাস্তায় সদ্য বসেপড়া খাবারের দোকানের সামনে কৌতূহলী মানুষের জটলা এই সবকিছুর মধ্যে তাঁর ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে উঠলো। ক্রমশ চারপাশ তাঁর কাছে অর্থহীন হয়ে উঠলো। তাঁর মনে এক গভীর প্রশ্ন জন্ম নিল- একটি নাম-পরিচয়হীন লাশ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কতজনের আর্থিক রোজগার দেওয়া থেকে কতজনকে মিডিয়ার পর্দায় ভিআইপি করে তুলল! জীবৎকালে ঐ লাশটি কি একটুও দামী ছিল নাকি যত দাম হল লাশ হবার পর? নাকি সব পরিচয়-গোত্রহীন মানুষই লাশ হবার পর কিছুক্ষণের জন্য দামী হয়ে ওঠে!
    পার্কের ভেতরে সারি সারি মানুষের অবয়বগুলি তখন যেন এক একটা কুয়াশা-টুকরো, যেগুলি পার্কের ভেতরে সেই মুহূর্তে একটু একটু করে উঠতে থাকা রোদে একটা একটা করে গলে যেতে থাকে…….
    ——————————————————————————–

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *