১
বাড়িতে বসে লকডাউনের সকালে পড়তে বসি নিয়ম করে। এই কদিনে পড়ে ফেললাম আরণ্যক, পুতুলনাচের ইতিকথা, হিঙের কচুরি আর খবরের কাগজ প্রত্যেকদিন। সত্যি আমরা পুতুল।
মানুষরূপী পুতুলকে, নাচিয়ে চলেছে প্রকৃতি। কি অসহায় অদ্ভূত মানবসমাজ। সুতো বাঁধা আছে নেপথ্য নায়কের আঙুলে। যেমন নাচান তেমনই নাচি। জীবনমৃত্যুর এই দোলাচলে লকডাউনে পৃথিবী থমকে গেছে মৃত ময়ালের মত লম্বা রাস্তায়। তবু অবুঝ কিছু মানুষ অকারণে খোলা রাস্তায় লকডাউন না মেনে।
মনে মনে ভাবছি এই বুঝি এল করুণ করোনার কালো থাবা। তবু মনকে সজাগ রেখে এগিয়ে চলি সকাল থেকে দুপুর, পরিবার সঙ্গে নিয়ে নকল আনন্দে।কখনও ক্যারাম কখনও দাবা আবার কখনও বা লুডো খেলি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। করোনাকে কেন্দ্র করে ভাঙা, মরচেপড়া সম্পর্কগুলো সেরে উঠছে হোয়াটস আ্যপে আর মোবাইলের দৌলতে।
পিডিএফ আর ই বুকে ছড়াছড়ি গল্প. কবিতা পড়তে পড়তে সন্ধে গড়িয়ে আসে। রান্নাবান্না করেন স্ত্রী। তাঁকে একটু সাহায্য করি। কথা বলতে বলতে চিন্তার মাঝে উঁকি দেয় কোভিড আতঙ্ক। জীবন কত মধুর কত সুন্দর এই ঘরে বসে টের পাই। উঠোনের জুঁইগাছে আলো করে ফুটে আছে ফুল। জবা জড়ায় উঠোনজুুুড়ে লালরঙের মাস্ক।
ছাদে থেকে দেখি, সবুজ আলে আদরমাখা পথে বড় বেজিটা লেজ উঁচু করে পার হচ্ছে আলপথ।হয়ত আমাদের আনন্দের খবর দিতে মুখ তুলে বলছে, মাভৈ। সে বোধহয় বলছে, সাবধানে পা ফেলো মানুষ। এখনও বসন্তের বাসনা আছে পৃথিবীর হৃদয়ে।
২
মোবাইলে ছেলেটি ফোন করল মা কে।
– মা আমি আটকে গেছি কেরালায়। লকডাউনের ফলে ট্রেন বন্ধ।
মা বললেন, আমি আসছি। ভয় নেই।
– তুমি কি করে আসবে?
– তোর বন্ধুর স্কুটি নেব। আমি যাব।
– না মা। পনেরশ কিমি কি করে আসবে? তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
– কিচ্ছু হবে না।
ফোন কেটে দিলেন মা।
স্কুটি চলেছে…
এবার ফিরছে মা ও ছেলে হাসিমুখে।
ছেলে বলছে আপনমনে , নেটের কভারেজ এরিয়া মাপা যায়। কিন্তু মায়ের স্নেহের কভারেজ এরিয়া হৃদয় ছাড়িয়ে অসীম দূরত্বে চলে যায় নিমেষে…
৩
– এই যে বাবা, একটু এদিকে এস বাবা
– যাই
একজন বৃদ্ধ জানলা থেকে লকডাউনের সময় পুলিশকে ডাকছেন।
পুলিশ শশব্যস্ত হয়ে কাছে এসে বললেন, বলুন আপনার কি উপকার করতে পারি?
বৃদ্ধ বললেন, আমার প্রয়োজনে বলব। কিন্তু এই দশহাজার টাকা আমি সরকারি ত্রাণ তহবিলে দেব। এটা নাও বাবা। আমার শেষ সম্বল।
পুলিশটি তার কর্তৃপক্ষকে ফোন করে টাকাটা নিলেন।
টাকাটা রেখে পুলিশটি বৃদ্ধকে প্রণাম করলেন।বললেন, মানুষের পাশে আমরা আছি।
বিকেলের সূর্য তখন প্রায় বিদায়ের পথে…
৪
– মা খিদে পেয়েছে। খেতে দাও
– চুপ করে বসে থাক
পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিধবা মা ভাঙ্গা ঘরে পেটে গামছা বেঁধে পরে আছে।কারণ লকডাউন চলছে। খেটে খাওয়ার পথ বন্ধ।
সামনে গঙ্গা নদী। তবু জলটা আছে। কিন্তু খাবার নেই এই প্রত্যন্ত জঙ্গলের গ্রামে।
আবার মেয়েটি বলে, মা খেতে দাও। আজ চারদিন কিছু খাই নি।
– শুধু খাই খাই। মরতে পারিস না অভাগির দল। কোথায় খাবার পাব। আমাকে খা।
ছেলেমেয়েরা কাঁদতে শুরু করল। তাদের মা চিৎকার করে উঠে গলা টিপে ধরল দুটো ছেলের। একে একে পাঁচজনকে মেরে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিল।
এখন মা কাঁদে আর পাগলির মত বলে, আয় চাঁদ তোকে খাই,আয় তারা তোকে খাই।
৫
-করোনা রোগে মরে গেছে ফুটপাতের লোকটি।
– কি করে জানলি করোনা রোগ। তুই ডাক্তার নাকি?
– না তবে শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল লোকটার। যারা দেখেছে তারা বলেছে।
– তারা হাসপাতালে দিতে পারেনি রোগিকে।
– কে দেবে। সবাই নিজের জীবন নিয়েই ব্যস্ত।
– চল, পুলিশকে খবর দি
– একা পুলিশই সব করবে। আমরা নাগরিক। আমাদের একটা কর্তব্য থাকা উচিত।
নিয়াজুল আর ইজাজুর কথা বলছিল মরে যাওয়া লোকটিকে নিয়ে। তারা পাঁচজন বন্ধু মাস্ক পরে, রেনকোট পরে সর্বাঙ্গ ঢেকে কাছে এসে দেখল লোকটা হিন্দু। গলায় পৈতে আছে।
তারা শবদেহ প্লাষ্টিকে ঢেকে একটা বাঁশের খাটিয়ায় তুলে নিয়ে গেল শ্মশানে।নিয়াজুল ততক্ষণে পুলিশ ডেকে এনেছে। পুলিশ আইনের দিকটা দেখল।
সেখানে দাহ করে গঙ্গায় স্নান সেরে তারা ফিরে এল বাড়ি।
নিয়াজুল বলল, বিপদের কোন জাত হয় না রে কাকা..
৬
ছেলেটা মন মরা হয়ে ঘ্যানর ঘ্যানর করে চলেছে। আর ভাল লাগছে না। কবে লকডাউন উঠবে বাবা। কবে নতুন পৃথিবী দেখব। পরের দিন সকালে ছেলটা বলল,
– বাবা দেখ তো কপালটা গরম লাগছে আজকে।
– ও কিছু না
– না বাবা যদি করোনা হয়?
— ওরকম মনে হয় সকলের।
তারপর রাতে ছেলেটার ধুমজ্বর এল। বাবা বেগতিক দেখে ফোন করল হাসপাতালে।
ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়া পর আর দেখতে পায় নি ওরা। কারণ লকডাউনের আইন ভেঙ্গে করোনা রোগীর কাছে যাওয়া যাবে না।
বাবার মনে হলো, ছেলের ছবিটা কথা বলে উঠল, বাবা কবে নতুন পৃথিবী দেখব?
৭
রাজু বিয়ে করে চলে গেল কাজের জায়গা কেরালায়। মোবাইলে কথা হয় দুজনার।
– আবার কবে আসবে?
– ছুটি পেলেই চলে আসব।
– তোমাকে খুব মিস করছি
-না না আমি যাব তাড়াতাড়ি
– এবার এসে আমাকে নিয়ে যাবে বলে দিলাম।
— হুম এবার তোমাকে নিয়ে আসব। একটা আলাদা ঘর নেব। শুধু তুমি আর আমি।
তারপর দুদিন পরে করোনা মহামারীতে দেশ ছেয়ে গেল। শয়ে শয়ে মানুষ মরতে লাগল বিশ্বজুড়ে। আমাদের দেশেও লকডাউন চালু হল। ঘরে থাকতে হবে। সমস্ত যানবাহন বন্ধ।
রাজুকে মোবাইলে কল করেও পায় না কেউ। কারণ রাজু করোনা পজিটিভ হয়ে আইসোলেশনে আছে।
বাড়ির কেউ জানল না রাজু একটা সংখ্যা হয়ে উড়ে গেছে পরিযায়ী পাখির মত….
৮
আমার স্ত্রী বাজারে গেছিলেন আজ। দোকানে দড়ি দিয়ে মেপে এক মিটার দূরে ইঁট পাতা আছে।লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন গ্রাহকরা,।পুলিশ পর্যবেক্ষণ করছেন বাজার, রাস্তা। জরুরি অবস্থায় সকলে চিন্তিত। কি করে একুশ দিন কাটবে। কাটবে ঠিকই। আবার ফুটবে ফুল। আবার হাসবে শিশু পৃথিবী। আজ ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম।এখন সকাল নয়টা বাজে ঘড়িতে। চা মুড়ি আর প্রেশারের ওষুধটা খেলাম। সাবান দিয়ে হাত ধুয়েছি অবশ্যই।খবরের কাগজ পেলাম।হেডিং -ভালবাসার দেশ কিউবা।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করতে ইতালিতে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদল পাঠিয়েছে কিউবা। দেশটি জানিয়েছে, ইতালির অনুরোধে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও নার্সের একটি ব্রিগেড রওনা হয়ে গেছে। করোনায় জর্জরিত ইতালির লমবার্দি অঞ্চলে কাজ করবে তারা।
৯
-এই যে মাস্ক পরেন নি কেন?
– না মানে নেই
– রুমাল আছে তো
– হ্যাঁ, তা আছে
– জড়ান, নাকে মুখে
– ঠিক আছে
এইভাবে পুলিশের দল কাজ করছে।
দুজন পুলিশ কথা বলছে। একজন প্রথমে বলল,
-সমাজ সচেতন লোক যারা তারা বেরোয় না বাইরে। আর একজন উত্তর দিলো,
-দিন আনে দিন খায় তাদের তো বেরোতে হবে
– তাদের ঘরে খাবার দিয়ে আসতে হবে
– কিন্তু সবাই কি পাবে। জঙ্গলমহলে, প্রত্যন্ত গ্রামে যারা থাকে তারা কি পাবে।
দুজন পুলিশের আলোচনা শুনে একজন অন্ধলোক এগিয়ে এসে বললেন, আমার এই পাঁচশ টাকা দয়া করে সেবার কাজে লাগান প্লিজ। তার মুখে মাস্ক।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে জানালার ওপারে ঘরে বসে আছি আর ভাবছি কত লোককে নতুন করে চিনলাম।
এই মারণ রোগ না এলে মানুষ চেনা বাকি থেকে যেত সকলের।
১০
একটা চড় খেয়েই অমৃতা যে সত্যটা সবার সামনে প্রকাশ করে দেবে, অভিজিৎ সেটা বুঝতে পারে নি।
কয়েকদিন ধরে চর পাতাইহাটে নদীর কিনারায় তারা লুকিয়ে দেখা করত। করোনার ভয়ে এখন বাড়িতে বেরোতে দিচ্ছে না অমৃতাকে বাড়ির লোক। অমৃতার স্কুলও ছুটি। তবু সে লুকিয়ে দেখা করে অভিজিৎ এর সঙ্গে।
অমৃতার বাবা বললেন একদিন, কোথায় গিয়েছিলে তুমি। অমৃতা বলল, এক বান্ধবীর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলাম।
তার বাবা বললেন, আর যাওয়ার দরকার নেই।
অমৃতা বলল, বেশ।
অমৃতার বাবা খুব রাশভারি মানুষ। বারবার এককথা বলতে ভালবাসেন না।
কিন্তু অমৃতা এক সপ্তাহ পরে ধরা পড়ে গেল তার বাবার চর পাতাইহাটের বন্ধুর হাতে। তার বাবার বন্ধু মোবাইলে ফোন করে জানালেন, চর পাতাইহাটে নদীর ধারে তোর মেয়ে একটা ছেলের সাথে গল্প করছে। তাড়াতাড়ি আয়।
অমৃতার বাবা মটোর সাইকেল নিয়ে এলেন। খুব রেগে গিয়ে মেয়ের কাছে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ না দিয়েই এক চড় মারলেন মেয়ের গালে। তিনি বললেন, লুকিয়ে প্রেম করা। এতবড় সাহস তোর। তারপর অভিজিতের দিকে তেড়ে যেতেই অমৃতা তার বাবাকে ধরে ফেলল।সে বলল,আমি সব সত্যিকথা তোমাকে বলছি।
আশেপাশে লোকজন জমে গেছে অনেক। অমৃতা বাবার দিকে দুইহাতের তালুতে ধরা মাস্কগুলো দেখিয়ে বলল, এখানে গরীব লোকগুলো মাস্ক কিনতে পারছে না। আমি আর অভিজিৎদা একত্র হয়ে চাঁদা তুলে এই মাস্কগুলো কিনেছি, এদের বিতরণ করব বলে।
তারপর অমৃতা অভিজিতের দিকে তাকিয়ে থাকল। অভিজিৎ তখন মুখে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করছে।অমৃতা চড় খেয়ে সবকথা ভয়ে বলে ফেলেছে।
অমৃতার বাবা ও তার বন্ধু খুব লজ্জা পেলেন। মুখ নিচু করে বললেন অমৃতা ও অভিজিতকে,পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা…
১১
এক বৃদ্ধা তার স্বামীকে নিয়ে টোটো খুঁজছেন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। তারপর তারা মাস্ক পরে রাস্তা পেরোলেন। একজন পুলিশের আই সি বললেন, আপনারা বাইরে কেন?
বৃদ্ধা উত্তর দিলেন, আমরা দুদিন না খেয়ে আছি। আমি না খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু আমার স্বামী পারে না।
বৃদ্ধ বলেন, হাসপাতালে ভরতি হলে খাবারটা তো পাব।
অফিসার বললেন, বাড়ি চলুন। আমি আপনাদের ছেলের মত। আমি দেব আপনাদের খাবার।
বাড়িতে এসে তিনি দিয়ে গেলেন চাল, ডাল আর আলু। এক প্যাকেট সন্দেশও দিলেন তাদের।
বৃদ্ধ বললেন, তোমার কল্যাণ হোক।
বৃদ্ধা কোন কথা বলতে পারলেন না। তার চোখে তখন জল…
১২
আলো দেখলো পাশের বাড়িতে জমি জায়গা নিয়ে ঝগড়া চলছে দুই চাষীর। সে বলছে, তুই আমার আলে পা দিবি না।
আর অন্য একজন, চাষী তার গরু উঠিয়ে আল ভেঙ্গে দেয়।
আমি জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে থামতে বললাম,বেঁচে থাকলে অনেক জমি হতে পারে। এখন ঝগড়া করার সময় নয়।
তারা আলোর কথা শুনে ঝগড়া থামালো। জমি পরে থাকে।মানুষ চলে যায়।
একজন আলোকে মেসেঞ্জার বক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছিল। আলোর কথা বলা হয়নি তার সঙ্গে। তাই সে রেগে তাকে ব্লক করে দিল।
সব ঝগড়ার সূত্র সেই ভুল বোঝাবুঝি। সময়ের ঈশারা বোঝেন কজন?
যাইহোক মেসেঞ্জার, কয়েকদিনের জন্য আনইন্সটল করে দিলো আলো। এখন একটাই চিন্তা পৃথিবীর এই কঠিন রোগ। কোভিড নাইনটিন, ভাইরাস আ্যাটাকে সারা বিশ্ব রোগগ্রস্ত। এখন দূরে দূরে থাকার সময়। দূরে থাকলে বাঁচবে জীবন, একত্রে সমাবেশ করলে মরবে।
ভাইরাস মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাচ্ছে শিকলের মত। এই শিকল ভাঙ্গার জন্য লকডাউন
১৩
লকডাউন চলছে।
– কি রে মাস্ক ছাড়া রাস্তায় কেন?
পুলিশের একটা লাঠির আঘাতে পিঠে খুব লাগল আলাপের।
– স্যার একটু বাজার যাব। মাস্ক কিনব।
– যা কিন্তু এবার বেরোলে মার খাবি।
আলাপ বাজার করে মাস্ক কিনে মুখ ঢেকে বাড়ি এল। নিজেই রান্নাবান্না করল। তারপর দুপুরে সেই দায়ীত্ববান পুলিশের কাছে খাবার নিয়ে বলল, খেয়ে নিন। আমাদের জন্য কত কষ্ট করছেন আপনারা।
– তোমাকে চেনা চেনা লাগছে।
– হুঁ স্যার।আমি সকালের সেই মাস্কবিহীন ছেলেটা।
মাস্ক পরে আলাপ বলল, বাড়িতে আপনার কে কে আছে?
– আমার মেয়ে আর তার মা।
– কতদিন বাড়ি যান নি?
– এখন তো যাব না ভাই। আমি গেলে যদি ওদের উপর করোনার কোপ পরে? তোমার কে আছে?
– আমার কেউ নেই। আমি একা। পরিযায়ী এক শ্রমিক।বাড়ি যেতে পারি না। ঘর ভাড়া করে আছি। টাকাপয়সাও ফুরিয়ে আসছে ক্রমশ…
১৪
নীরেনবাবু স্কুলে কাজ করেন। মাইনেও ভাল পান। বাড়িতে বুড়ি মা আছেন। নীরেনবাবু অকৃতদার। করোনার সময় মানুষ সবাই ঘরবন্দি। তাই পথের কুকুরগুলোকে ধরে বাড়িতে রাখেন,খেতে দেন।
কুকুরগুলোই তার ছেলেমেয়ে। তাদের খেতে দেন। চিকিৎসা করান। কিন্তু কাজের চাপে কুকুরগুলোকে দেখশোনার সময় পান না বেশি। এখন স্কুল বন্ধ। তাই সময় আছে।
মা বলেন, কুকুর তো প্রায় একশো ছাড়িয়ে গেল। আর কত আনবি।
নীরেনবাবু বলেন, মা তুমি আমার কাছে আছ বলে ভরসা পাই। কুকুরগুলোর কেউ নেই। কেউ লেজে পটকা বেঁধে আগুন দিত। কেউ আবার গরম ফ্যান ঢেলে দিত তাদের গায়ে। বড় নিষ্ঠুর তারা।
নীরেনের কথা শুনে তার মায়ের চোখে জল চিকচিক করে।
মা বলেন, আমিও দেখব তোর পোষ্যদের। তুই বস গিয়ে যা।
নীরেনবাবু বললেন, মা আমি স্কুল এখন যাচ্ছি না,করোনার কারণে।সরকার বন্ধ রেখেছে স্কুলগুলি।
এদের দেখব আর খেতে দেব বলে, আমিই এখন থেকে রান্না করব। তোমার তো বয়স হয়েছে। তুমি বিশ্রাম নাও আর আমার সঙ্গে থাক।
তার মা বলেন তোর মত পাগলের খুব প্রয়োজন সমাজে…
১৫
অনুপের মা মরে গেছেন লকডাউন পিরিয়ডে। মোবাইলে খবরটা পেল।
মায়ের কাছে তো যেতেই হবে।
বন্ধু বলল, কি করে যাবি? সব চাকা বন্ধ।
– আমি হেঁটে যাব
– এতদূর হাঁটবি কি করে?
– মায়ের আশীর্বাদে ঠিক পৌঁছে যাব।
বন্ধুও সঙ্গ ধরল।
দুজনে হাঁটতে হাঁটতে তিনদিন পরে গ্রামে পৌঁছল। তখন মায়ের দাহ কাজ শেষ।
অনুপ কাছা পরে মায়ের শ্রাদ্ধের কাজ সমাপ্ত করল।
বন্ধু বলল, মায়ের আশীর্বাদ পেলে সমুদ্রও বোধহয় সাঁতারকেটে পার হতে পারি।
অনুপ শুধু বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে রইল কিছুক্ষণ।
মায়ের হাসি মুখটার ছবি ভেসে উঠল অনুপের মনের আয়নায় বারবার..
১৬
একুশদিনের লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। কাজকর্ম এখন নেই। আজ আরণ্যক নিয়ে বসেছি। পড়তে পড়তে মগ্ন হয়ে গেছি প্রকৃতির রঙে, রূপে,রসে। শুনলাম লকডাউনের আর একটা ভাল দিক উন্মোচিত হয়েছে। প্রকৃতির খোলা হাওয়ায় পশুপাখি ঘুরছে। পৃথিবী নির্মল হচ্ছে।
আবার আজ সকালে দেখলাম বইগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। ধুলোবালি ঝেড়ে বইগুলি তাকে আবার সাজিয়ে রাখলাম।
সপরিবারে টিভি দেখলাম। ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো সাজিয়ে নেওয়ার সময় পেয়েছি। করোনা আক্রান্ত বেড়েই চলেছে। কিছু মানুষ অনুগত নয়। তারা বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে পুলিশের মার খাচ্ছে। করোনার ভয় কি তাদের নেই। তাদের বোঝা উচিত এটা একার ব্যাপার নয়। দশ ও দেশের সমস্যা।রোগ ছড়িয়ে পড়লে আর নিয়ন্ত্রণ করা মুস্কিল হয়ে যাবে।
আজও দেখলাম কিছু লোক মশারি টাঙিয়ে জঙ্গলে তাস খেলছে।
আজকে সকালে উঠে আমি নিজে চা বানিয়ে খেলাম। স্ত্রী ও পুত্রকে বেড টি দিলাম। কিছুতেই নেবে না। শেষে রাজী করালাম।
আজ তরকারিটা আমি রান্না করলাম। ছেলে বলল,বাবা আমিও শিখব রান্না। সেও আমাকে হেল্প করল।
পুলিশ তার ডিউটি করছে যতটা পারছে। জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে।
সুদীপ ঘোষাল নন্দনপাড়া খাজুরডিহি পূর্ববর্ধমান ৭১৩১৫০।