শহরটির নাম গোলোকপুর। এই শহরের বাসিন্দাদের একটা করে নিজস্ব গোলোক আছে। একই পরিবারের সদস্য সংখ্যা হয়তো পাঁচ, তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গোলোক। সন্তর্পণে গোলোকের পারস্পারিক সংঘাত এড়িয়ে তারা পারিবারিক জীবন কাটায়।
গোলোকের মধ্যে আবদ্ধ থাকে তাদের চাওয়া পাওয়া, সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না। এই সকল অনুভূতিদের বাস গোলোকের ভিতর ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে । গোলোকপুরের বাতাসে ভাসমান ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় ,ঐ স্বচ্ছ কাচের ন্যায় বস্তু দ্বারা নির্মিত গোলোক।
গোলোকপুরের বাসিন্দা রূপানের আজ ঘুম থেকে উঠতে খানিক দেরী হয়ে গেছে। কাল শুতে শুতে অনেক রাত হয়েছিল। আসলে ,অনেক দিনের জমে থাকা মন খারাপের ঘরের পাল্লাটা হঠাৎ খুলে গিয়েছিল।
পাবলোর সাথে কাল দুপুর থেকে শুরু হওয়া ঝগড়ার ঝড়ের দাপটে। খোলা দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে মন খারাপেরা বেরিয়ে এসে রূপানের গোলোকের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে পড়েছিল।
নোনা জলের কল খুলে মন খারাপ গুলোর ওপর অনেক দিনের জমে থাকা শ্যাওলা ধুয়ে, তাদের পরিষ্কার করে ,ঘরের ভিতর গুছিয়ে রাখতে গিয়ে প্রায় মধ্য রাত হয়ে গিয়েছিল।
কান্না জলের নোনা ধারায় ,কিছু নরম মন খারাপ কেমন গলে গলে গেল … রূপান চেয়ে চেয়ে দেখল। মন খারাপের ঘরটা এখন যেন একটু ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে।
পাবলো অবশ্য রাতেই রূপানের মানভঞ্জন করেছিল তরঙ্গ বার্তার মাধ্যমে। চাকুম,চুকুম… চুমু খেয়েছিল সশব্দে। তরঙ্গ মাধ্যম অনুরণিত হয়েছিল বহুক্ষণ সেই শব্দে।
একটা ভালো লাগা নিয়ে শুতে গিয়েছিল রূপান।দু চোখের ওপর স্বপ্ন ঘরের দোর খুলে, বেছে বেছে আঁখি পাতে এঁকেছিল তার সেই প্রিয় স্বপ্নের কাজল…. যেটা পাবলো, তাকে তাদের প্রথম মান ভঞ্জন পর্বে উপহার দিয়ছিল।সেই…. একটা এমন দেশ, যেখানে সবাই সবার সাথে সুখে, দুঃখে একসাথে থাকে। পাশাপাশি, কাছাকাছি, গায়ে গা ঠেকিয়ে, মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তাদের সকল অনুভূতিরা। খোলস মুক্ত এক জীবনের দেশ।
ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে যাওয়ার সময় রূপান দেখলো… বসার ঘরের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে বাবার অফিসের টেনশনের কিয়দংশ।
রূপান মা বাবার ঘরে গিয়ে বাবার গোলোকে নক্ করল। বাবা একমনে ল্যাপটপে কাজ করছিল। বিরক্তি সহকারে মুখ তুলে চাইল।
” নিজের জিনিস নিজে সামলাতে পার না? বসার ঘরের মেঝেতে তোমার অফিসের টেনশনের কিছুটা পড়ে আছে দেখলাম। জানই তো… কোনোক্রমে যদি আমার বা মায়ের গোলোকের সংস্পর্শে সেটি চলে আসে, ওমনি আমাদের গোলোকে সেঁধিয়ে যাবে। “
” আমি ইচ্ছে করেই ফেলেছি। আমার টেনশন রুমে তিল ধারণের যায়গা নেই। তুই আর তোর মা একটু ভাগ নে এবার”।
” কেন? আমাদের অনুভূতির ভাগ কি তুমি নাও?? “
মায়ের গোলোক কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে রূপান খেয়াল করেনি। সরে দাঁড়ালো সে, পাছে পারস্পরিক সংঘাতে গোলোকে চিড় ধরে।
” সে দিন কত করে বললাম… আমার ভালোবাসার ঘরটা অনুভূতিতে ঠাসা। স্তূপাকার ভালোবাসা গুলো একটু গোছাবো। প্রেমের কিছু মুহুর্তদের তোমার ভালোবাসার ঘরে রাখবে? সে ঘর তো প্রায় ফাঁকাই পড়ে আছে। আজকাল তো আর তাদের ব্যাবহারই করোনা আমার উদ্দেশ্যে। খালি কাজের ঘরে দোর দিয়ে বসে থাকো। দীর্ঘ কাল অ ব্যাবহারের ফলে তোমার ভালোবাসার ঘরে ঝুল জমেছে , মৃতপ্রায় তারা… নিয়েছিলে? সে দিন আমার অনুভূতিদের…..।
রূপান বাবা মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। এখন চলবে এই দোষারোপ পর্ব। নিজের নিজের গোলোকের মধ্যে বন্দী অনুভূতিদের আদানপ্রদানের চেষ্টা চলে সুযোগ পেলেই।
সেদিন, পাবলো এসেছিল নিজের জৈবিক অনুভূতিদের নিয়ে রূপানের শুচিতার ঘরের দরজায়, তার ছাই চাপা কামাগ্নির খোঁজে। পাবলো দাঁড়িয়ে ছিল ঘরের দ্বারে অনেকক্ষণ। বন্ধ দ্বারে আঘাত হানছিল ,বার বার তার পৌরুষ। রূপানের সঙ্কোচ, ভয়, সংস্কারের অনুভূতিরা শুচিতার ঘরে খিল তুলে দিয়েছিল।
ফিরে গিয়েছিল পাবলো, নিজের প্রজ্জ্বলিত কামাগ্নিকে সঙ্গে নিয়ে। মনোমালিন্যের প্রবল হাওয়ার ঝাপটায় রূপান আর পাবলোর গোলোক ছিল কিছু দিন টালমাটাল। অবশেষে ভালোবাসা, বন্ধুত্বের অনুভূতিদের মধ্যস্থতায় গোলোকের স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছিল।
” মা আসছি”…. রূপান কলেজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে মা কে বলল।
” ক্ষিদের ঘরের খিল খুলতে ভুলিস না। সময় মত কিছু খেয়ে নিস”।
মায়ের গোলোকের ভিতর থেকে স্নেহের ঘরের স্নিগ্ধ বাতাস রূপানের গোলোককে আলতো করে ছুঁয়ে গেল।
“আচ্ছা মা খেয়ে নেব”…. রূপান আগত স্নেহের স্নিগ্ধ বাতাস সর্বাঙ্গে মেখে বাড়ির বাইরে পা রাখলো।
পথচলতি গোলোকাবৃত দের সাথে নিজের গোলোকের স্পর্শ বাঁচিয়ে রূপান বাসের লাইনে দাঁড়ালো। এই বাসগুলি বিশেষ ভাবে তৈরি যাতে গোলোকে গোলোকে ঘষাঘষি না হয়। এখন ভীড়ের সুযোগে অবাঞ্ছিত স্পর্শের হাত থেকে এই গোলোকের কল্যাণে রক্ষা পাওয়া যায়। কিন্তু দৃষ্টির ছোঁয়াচ থেকে বাঁচবে কী করে…
বাসের লাইনে রূপানের সামনে দাঁড়ানো মধ্য বয়স্ক লোকটির গোলোকের ভিতর লালসার ঘরের উন্মুক্ত দরজা দিয়ে লোভের গরম হলকা লাগছিল রূপানের গোলোকে। আবরণের বাইরের শীতলতায় কামনার বাষ্পরা জমাট বাঁধছিল।রূপান একটু সরে দাঁড়ালো।
হঠাৎ রূপানের নজর পড়ল উলটো দিকের কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই সময়কালের সবচেয়ে ভীতি প্রদানকারী ভাইরাস। অপেক্ষা করছে যদি কাউকে কব্জা করা যায়।
আগমন পর্বের শুরুতে, ঐ ভাইরাস তার দাদাগিরি দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে গোলোকপুরের বাসিন্দারা তাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচার উপায় খুঁজে নিয়েছে। গোলোকের ভিতর নিজেদের আবদ্ধ করে নিয়েছে তারা। সাথে বন্দী হয়েগেছে তাদের সকল অনুভূতি ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে।
এই গোলোকের আবরণ ভেদ করে ভিতরে ঢোকার সাধ্যি ভাইরাসের নেই। ভাইরাস বধের মারণাস্ত্র আবিষ্কার হয়ে গেলেই, গোলোকপুরের বাসিন্দারা খোলোস মুক্ত এক জীবন যাপন করবে ঠিক পাবলোর উপহার দেওয়া স্বপ্ন রাজ্যের মত।
রূপান দেখলো ভাইরাসটি গুটি গুটি পায়ে রাস্তা পেড়িয়ে তার বাসের লাইনের দিকেই এগিয়ে আসছে। সে চটজলদি নিজেকে একবার দেখে নিল। গোলোকের দরজা আরো শক্ত করে এঁটে নিল।
হঠাৎ রূপান খেয়াল করল ,তার সামনের মধ্য বয়স্ক লোকটি রূপানের শরীর লালসার মাধ্যমে আরও ভালো করে লেহন করার উদ্দেশ্যে নিজ গোলোক ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। রূপান তাকে সাবধান করার আগেই মারণ ভাইরাস লোকটির গলা চেপে ধরল।
“বাঁচাও… বাঁচাও.”.. .. লোকটির আর্তনাদে মুখরিত হল চারপাশ। অন্যান্য গোলোক বন্দী রা কেবল দর্শক মাত্র। কিছু করার উপায় নেই। রূপান দেখছিল…লোকটির বুক ওঠানামা করছে হাপরের মত, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে… উফ…. কি নির্মম দৃশ্য।
রূপানের ও দম বন্ধ হয়ে আসছে যেন এই গোলোকের ভিতর। আর কতদিন…. আর কতদিন….
উন্মুক্ত নীলাকাশের দিকে তাকিয়ে রূপান হাত জোড় করল…. ” মহিষাসুর বধের জন্য যেমন মা দূর্গার হাতে তুলে দিয়েছিলে অস্ত্র…. আজ এই ভাইরাস অসুর বধের জন্য মানুষের হাতে তুলে দাও অস্ত্র। সভ্যতা কে রক্ষা করে প্রভু…. ফিরিয়ে দাও গোলোকপুরের সুস্থতা। স্বপ্ন কে বাস্তবে পরিণত কর….. “