প্রথম পর্ব-সূচনা
‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে!’ গানের লাইন টা মনে করিয়ে দিলেন ইন্দ্রস্যার। সত্যিই ইতিমধ্যেই শীতের আমেজ কাটিয়ে বঙ্গে চলে এসেছে বসন্ত। আমার মন বলছে এই বসন্তে একটা কেস ঠিক চলে আসবে। মনে আছে তো আমার পিসতুতো দাদা রাজাদাদার কথা, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতের অধ্যাপক রাজেন্দ্র রায়ের কথা বলছি, যিনি টুকটাক গোয়েন্দাগিরি ও করে থাকেন।
সত্যি আজকের দিনে শখের গোয়েন্দা দেখাই যায় না, তাদের কাজ বড়োজোর কারোর উপর নজর রাখা। সেই গল্পের মতো ফেলুদা ব্যোমকেশ রা বাস্তবে মিসিং, তার চেয়ে বাস্তব সত্য বরং গোয়েন্দা লালবাজার। কিন্তু তাই বলে কি মানুষের জীবনে রহস্য নেই, মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত নানা সমস্যা চলে আসে আর তার সমাধান করতে প্রতিটা মানুষ কেই হয়ে উঠতে হয় শখের গোয়েন্দা।
তো সেরকম কোনো রহস্য বা বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়তে খুব ইচ্ছে করছিল কারণ সেই বিপদ থেকে বের হতে ত্রাতা হবে সেই রাজাদাদাই। কিন্তু হুট করে এই কলকাতায় বসে বসে বিপদে পরবই বা কেনো, তাই রাজাদাদা কে বললাম এই দোলের ছুটিতে কোথাও একটা ঘুরে আসা যায়।
“হ্যাঁ যাওয়া তো অনেক জায়গায় যায়, দোলে তো বাঙালি রা শান্তিনিকেতনে গিয়ে ভিড় করে, তো সেই ভিড় ভাট্টায় না গিয়ে তোকে একটা ভালো প্রস্তাব দিতে পারি।”
আমি আর উৎসাহ ধরে রাখতে পারলাম না, কিন্তু অত সহজে রাজাদাদা কি ওর প্ল্যান টা বলে দেবে।
“ব্যাগ গুছিয়ে রাখ কাল ভোরে উঠে সাঁতরাগাছি যেতে হবে।”
বাকিটা আর জানা গেলো না, আমি ভোরে সাঁতরাগাছি থেকে ছাড়া সমস্ত ট্রেন এর হদিশ দেখে রাখলাম।
ভোরে স্টেশনে পৌঁছে দেখি ইন্দ্র স্যার দাড়িয়ে। ওনার সাথে আলাপ করিয়ে দিই, উনি হলেন আমার স্কুলের বাংলার শিক্ষক ইন্দ্রনাথ চৌধুরী। আমি ক্লাস টুয়েলভে থাকতে উনি বদলি হয়ে চলে আসেন কলকাতায়, আর সৌভাগ্যেক্রমে আমিও এখন কলকাতায়।
আমাদের গন্তব্য বিষ্ণুপুর, ইন্দ্র স্যারের কাকার বাড়ি সেখানে, ওনার আমন্ত্রণেই আমাদের ওখানে যাওয়া। আসলে কলকাতায় বদলি হয়ে আসার পর থেকেই আমার সূত্র ধরেই রাজা দাদার সাথে খুব খাতির হয়ে গেছে ইন্দ্র স্যারের, তাই বিষ্ণুপুর যাওয়ার প্ল্যান টা করতেই আমাদের কথাই ওনার প্রথম মাথায় এসেছিল।
আমার এখন অবধি প্রতিটা দোল উত্তরবঙ্গে বাড়িতে কাটানো, তাই এই প্রথমবার দক্ষিণবঙ্গে দোল টা যে মন্দ হবে না বেশ ভালই বুঝছি। বিষ্ণুপুরের নাম আসতেই আমার প্রথমেই মনে পড়ল আমার কলেজের বন্ধুর কথা, ওকে যথারীতি ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আমি যাচ্ছি, ও যেন অবশ্যই দেখা করে।
সকাল সকাল পৌঁছে গেলেও রোদের তীব্রতায় বেশ গরম লাগছিল। আমরা বাড়িতে পৌঁছতেই আমাদের জন্য শরবত নিয়ে এলেন ইন্দ্র স্যারের কাকা বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী। উনি একা মানুষ, বিয়ে করেননি, ব্যবসার সূত্রেই নাকি বিগত পনেরো বছর ধরে এখানে থাকা। আমি জানতাম স্যারের গ্রামের বাড়ি সুন্দরবনে, ওখানে এখন স্যারের মা বাবা ছাড়া কেউই থাকেন না। স্যার আমাদের দুজনের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
“আমি খুব খুশি হয়েছি যে তোমরা এসেছ। আমি একা থাকি, মাঝে মাঝে বাড়িতে লোকজন এলে বড্ড ভালো লাগে। তবে হ্যাঁ আমি বাড়িতে থাকি ই বা কতক্ষন!”
আমি।’ কেনো আপনার কি কাজের খুব প্রেশার?’
“না আসলে আমার পুরোটা সময় কেটে যায় রায়চৌধুরী বাড়িতে। তোমাদের তো এখানে নিয়ে এসেছি সে কারণেই। দোল পূর্ণিমার রায়চৌধুরী বাড়িতে ঘটা করে শ্রী কৃষ্ণের পুজো হয়, পুরো গ্রামের মানুষ মেতে ওঠে এই বাড়ির দোল এ। ওদের ব্যাবসার ই আমি ছোট্ট একজন অংশীদার।”
ইন্দ্র স্যার।’ আমিও অনেক বছর পর এলাম রায়চৌধুরী দের সাথে দোল কাটাতে, আচ্ছা আমার বন্ধু সুনির্মল কেমন আছে? বহুদিন ওর সাথে যোগাযোগ নেই।’
কথাটা ঠিকই জীবনে চলার পথে আমরা কত কাছের বন্ধুর সাথেই না কাটাই, কিন্তু স্কুল লাইফ কলেজ লাইফ কেটে গেলে কতজনের সাথেই প্রায় ঠিক করে যোগাযোগ হয় বলুন তো। আমি কলেজে উঠেছি একবছর ও হয়নি কিন্তু এই জিনিস টা বুঝতে শিখেছি বেশ, যে খুব কম সংখ্যক মানুষ মানুষ বাদে আমাদের জীবনে সবাই ছোট একটা অধ্যায়ের মত।
বিনয় কাকা।”বিকেলে যাবি ত, তখনই দেখা করিস, এখন একটু বিশ্রাম নে।”
“আরে কাকা, তোমাকে তো আরেকটা কথা বলাই হয় নি, এই যে রাজা ও কিন্তু গোয়েন্দা ও। ওর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। দাড়াও তোমাকে পরখ করিয়ে দিচ্ছি, রাজা আমার কাকাকে ওর কোনো একটা পছন্দের জিনিস বলে চমকে দাও তো।”
রাজা দাদা।”আচ্ছা আপনি খুব ভগবান মানেন তাই না? না আসলে এই ছোট বাড়িতেও এত সুন্দর করে এতটা জায়গা জুড়ে মন্দির বানিয়েছেন, বুক সেলফ জুড়ে মাইথলজি এর বই আর ঠাকুরঘর দেখে বোঝাই যাচ্ছে প্রতিদিন দুবেলা নিয়মিত পুজো হয় তাছাড়া আপনার হাতে বাধা রুদ্রাক্ষ, হাতে আংটি, এসবে কি আদৌ কাজ হয়?”
বিনয় কাকা।”বাহ, চমৎকার। হ্যাঁ আমি তো মনে করি হয়, কথায় আছে না ‘ বিশ্বাসে মিলায় বস্তু’ ।”
ইন্দ্র স্যার।”ও বাড়িতে এখন কে কে আছে?”
বিনয় কাকা।”গত বছর তোর জেঠিমা মারা গেছেন আর জেঠুর শরীর ও ভালো নেই। সমস্ত রায়চৌধুরী বাড়ির দায়িত্ব এখন বাড়ির বড় ছেলে মানে তোর রূপ দার হাতে। আর রাজের বাজে স্বভাব গুলো যায়নি ছেলেটা ও দিন কে দিন বিগড়ে যাচ্ছে। রাজের ছেলে শীর্ষেন্দু কে সামলাতেই এখন ওর মামা অগ্নিস্বর এ বাড়িতেই থাকে। তুই তো অনেক বছর পরে এলি, গেলেই বুঝতে পারবি ও বাড়ির পরিবেশ এখন অনেকটা অন্যরকম।”
দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে ই আমরা ঘুরতে বের হবো। আজ হয়ত মন্দির গুলোতে ঢোকা যাবে না, তাও আশপাশ টা ঘুরে তারপর রায়চৌধুরী বাড়ি। আমার কলেজের বন্ধু সুপ্রতিম কেও ডেকে নিয়েছি।
বিকেল বেলা আমরা বেরিয়ে পরলাম। সুপ্রতিম আবার ওর বান্ধবী বাসবদত্তা কে নিয়ে এসেছে, আমরা এখন জোড় বাংলার বাইরে দাঁড়িয়ে। এমন সময় একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটল। শহর থেকে বাইক রেস করতে এসে মনে হয় গ্রামে ঢুকে পড়েছে, রাজাদাদা আর ইন্দ্র স্যার রাস্তা ক্রস করতে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ করে সামনে চলে আসায় একটা বড়োসর এক্সিডেন্ট ঘটতে যাচ্ছিল।
আমি সবসময় থ্রিল সাসপেন্স ভালোবাসি, কিন্তু তাই বলে রাস্তাঘাটে এমন হুট করে চলে আসা বিপদ কে কি বলবো? এটা কি তাহলে ‘Beginning of a new case’; নাকি নিছকই পথ দুর্ঘটনা??
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
দ্বিতীয় পর্ব- আলাপ চারিতা
আমরা এখন এসে গেছে রায়চৌধুরী বাড়ির আঙিনায়। বিশাল তিনতলা তলা বাড়ি, বনেদিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। এই নির্দিষ্ট কোণে আলাদা করে মন্দির রয়েছে, সেখানেই চলছে পুজোর তোড়জোড়। বাড়িতে ঢুকতেই ইন্দ্র স্যার ‘ সুনির্মল’ নাম নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, এত বছর পর কলেজের বন্ধু কে সামনে দেখে আনন্দে ভরে উঠলো সুনির্মল বাবুর মন। সুনির্মল বাবু কলেজের অধ্যাপক, উনি আর ইন্দ্র স্যার একই কলেজে বাংলা নিয়ে পড়েছেন। এবার ইন্দ্র স্যার গিয়ে সন্দীপ বাবুর পা ছুয়ে প্রণাম করলেন। উনি এই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, এই ব্যাবসার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে ওনার হাত ধরেই। আর সেই ব্যাবসা কেই এগিয়ে নিয়ে চলছে ওনার ছেলেরা।
এবার দোতলা থেকে একে একে নেমে এলেন রাজসিংহ, শীর্ষেন্দু আর অগ্নিশ্বর বাবু। অগ্নিশ্বর বাবু রাজাদাদার মাথায় চোট দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং এক্ষুনি রাজা দাদার ফাস্ট এইড এর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। অগ্নিশ্বর বাবুর সম্পর্কে ঠিকই শুনেছিলাম যে বাবা- ছেলে দুশ্চরিত্র হলেও মামা ভালো মানুষ। এখানকার গ্রামবাসী রাও ওনাকে বেশ সম্মান করেন।
অ্যাকসিডেন্ট এ ইন্দ্র স্যারের কিছু হয়নি কারণ রাজা দাদা ওনাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল কিন্তু নিজে সামান্য চোট পেয়েছে। বাসবদত্তা জানালো এই বাইক বাহিনী কে ও রিসেন্টলি এই গ্রামে প্রায়শই চলাফেরা করতে দেখছে। যাইহোক এতে মনে হয় না কোনো রহস্যের ব্যাপার আছে, আমি বৃথা সবসময় রহস্য খুঁজে বেড়াই।
একে একে এই তিনজনের পরিচয় দিয়ে দিই। রাজসিংহ বাবু একজন শিল্পী মানুষ, ছবি আঁকেন আর বাড়ির ব্যবসায় খুব একটা সাহায্য করতে না পারলেও টুকটাক কাজে সাহায্য করেন। শীর্ষেন্দুর স্বপ্ন ডাক্তার হবে তাই প্রথম বছর নিট এ ভালো ফল করতে না পারায় আবার প্রস্তুতি নিচ্ছে কলকাতায় কোচিং সেন্টারে। আর অগ্নিস্বর বাবু এবাড়ির ব্যবসায় যোগ দিয়েছে, জামাইবাবুর হয়ে সবটা উনিই সামলান।
ইন্দ্র স্যার।’ রাজ দা, কেমন আছো? মনে পড়ে আমাকে?’
রাজসিংহ।’ তোকে কি ভোলা যায় ভাই? সেবারে ওই কটা দিন তুই আমাদের সবাইকে নিয়ে যেভাবে গোটা বাড়ি মাতিয়ে রেখেছিলি,মিলিয়ে নিস এবারে তোকে সবটা ফিরিয়ে নেবো।বাবুই ওকে প্রণাম করো, উনি তোমার কাকার বন্ধু, অনেক কিছু শেখার আছে ওনার থেকে।’
ইন্দ্র স্যার।’ বৌদি কোথায়? আর রূপ দা..’
এমন সময় নিচে নেমে এলেন বাড়ির বড় ছেলে রূপনারায়ণ রায়চৌধুরী। বললেন,’ ওরা অন্দরমহলে আছে, বুঝতেই পারছিস পুজোর আয়োজন করা অত সহজ নয়, আমাদের এত বছরের পুরনো পুজো। কেমন আছিস বল, ইন্দ্র?’ স্যার আমাদের সাথে আলাপ করিয়ে দিতেই উনি বললেন,’আচ্ছা আগেই বলে রাখছি বিনয়কাকা ওরা তোমার অতিথি মানে আমারও অতিথি তাই ওনারা যতদিন এখানে থাকবে আমাদের বাড়িতেই থাকবে।’
বিনয়কাকার বাড়িতেই আমাদের সমস্ত লাগেজ রেখে জাস্ট একটা ব্যাগে নিত্য প্রয়োজনীয় কিছু গুটিয়ে নিয়ে আমরা উঠলাম রায়চৌধুরী বাড়িতে। আসলে বিনয়কাকার ও পুজোর কদিন এখানেই থাকার কথা। রাতে বনেদি বাড়ির ভোজ টা মনে ভরিয়ে দিল।
আজ দোল পূর্ণিমা। খুব সকাল সকাল ঘুম ভাঙলো কিন্তু সেটা বাড়িতে একটা শোরগোল শুনে। সকাল সকাল উঠেই যে আবার কি শুনতে হবে কে জানে, উঠে দেখি রাজা দাদা ইন্দ্র স্যার আগেই উঠে গেছে। রাজসিংহ বাবু চেঁচামেচি করছেন।
‘ দেখো রীনা, তুমি আমার কথা তো শুনবে না কিন্তু আমি অনেক আগেই বলেছি বাবুই কে দাদার থেকে দূরে রাখবে। দাদা ওর ক্ষতি করে ফেলবে আজ যা করতে যাচ্ছিল আমি যদি ঠিক সময়ে না আসতাম না জানি বাবুই কে অক্ষত পেতাম কিনা..।’
অদ্ভুত ভাবে রূপনারায়ন বাবু নিজের স্বপক্ষে একটা কথাও বলছেন না, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন আর অনুতাপ করছেন।
রীনা কাকিমা।’ কি হয়েছে সেটা তো খুলে বলবে?’
‘ দাদা আমার ছেলেকে মেরে ফেলতে চাইছে। কি বিশ্বাস হচ্ছেনা ত আমার কথা তো কেউ মানবেই না। আমি তো বাড়ির অপদার্থ ছেলে। তাও শুনতে চাও যখন বলছি আজ পুজো বলে আমি বাবুই কে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে তুলে দিতে ওর ঘরে ঢুকেছি ।দেখি দাদা এই লোহার রড টা হাতে নিয়ে বাবুই এর মাথায় মারতে যাচ্ছে। আমি ঢুকতেই হাতেনাতে ধরে ফেলেছি।’
স্বভাবতই রাজ সিংহ বাবুর কথা কেউ বিশ্বাস করল না কারণ দাদা কে সকলের সামনে ছোট করার এই প্রচেষ্টা ওনার প্রথমবার নয়।
অগ্নিস্বর।’ জামাইবাবু আপনার ভুল হচ্ছে, রূপ দা রড টা নিয়ে অন্য কোথাও যাচ্ছিল, আপনি সারাক্ষণ আপনার দাদার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করছেন তাই এরকম টা মনে হচ্ছে। আপনিই বলুন না রুপদা.. চুপ করে কেনো আছেন?’
‘ দোলের দিন সকাল বেলা এর থেকে বড় অপবাদ আর কিই বা জুটতে পারে অগ্নি! আমি জাস্ট ক্লান্ত আর কতবার রাজ কে বোঝাতে হবে আমি ওর বা ওর সন্তানের কোনো ক্ষতি চাইনা। আমার কোনো সন্তান নেই, বাবুই ই আমাদের সব। আমি কেনো ওর ক্ষতি চাইবো!’
‘ মি. রাজেন্দ্র রায়, ওরফে রাজাদাদা। আপনি তো গোয়েন্দাগিরি ও করেন শুনেছি আপনি তো এটা অ্যাপ্রুভ করতে পারবেন আমি মিথ্যে বলছি না।’
রাজা দাদা একটু হেসে বলল,’ বাহ দারুন ব্যাপার তো আমি যে টুকটাক গোয়েন্দাগিরি করি আপনি ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন। আমার যতদূর মনে পড়ছে বিনয়কাকা ছাড়া এখানে আসার পর কাউকেই ব্যাপার টা জানানো হয়নি এবং কাকা কেও আমি বারণ করেছিলাম। সে যাই হোক আমি যদি বলি আপনি আপনার দাদা কে ফাসাচ্ছেন এবং ওই রড টা ও আপনি আপনার দাদার হাতে তুলে দিয়েছেন!’
‘ আপনি বললেই ত হবে না, প্রমাণ করুন।’
‘ এক্সাক্টলি সেটাই প্রমাণ করতে হবে। শীর্ষেন্দু তখন ঘুমাচ্ছিল তাই আপনারা দুজন ছাড়া ঘরে কেউ ছিল না, তাই কে সত্যি বলেছে এটা জানা টা একটু তো সময়সাপেক্ষ।’
অগ্নিশ্বর।’ সকাল সকাল আর ঝামেলা পাকাবেন না।
জামাইবাবু। সবাই ফ্রেশ হয়ে নাও, পুজোর কাজে হাত লাগাতে হবে।’
ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ইন্দ্রস্যার একটু জোড় বাংলার দিকে হেঁটে আসার প্রস্তাব দিলেন, ওনার নাকি জায়গা টা খুব পছন্দ হয়েছে। আমিও রাজি ছিলাম কিন্তু শীর্ষেন্দু আমাকে ডেকে নিল কুমোরটুলি যাওয়ার জন্য, আমাদের উপর দায়িত্ব পরলো কৃষ্ণমূর্তি নিয়ে আসার। অগত্যা ইন্দ্র স্যার একাই বেরিয়ে পড়লেন। তবে রাজসিংহ বাবু ওনাকে সাবধান করলেন,’ তুই কিন্তু অনেক বছর পর বিষ্ণুপুরে, সব রাস্তা চিনিস না তাই সাবধানে যাস। আজকাল রাস্তাঘাটে বিপদ লেগেই রয়েছে কখন কি ঘটে যায়, কেউ কি বলতে পারে!’
কুমোরটুলি তে এসে মন ভোরে গেলো। সূর্যকিরনে উজ্জ্বল রাধাকৃষ্ণের মূর্তি দেখে সকালে ঘটে যাওয়া গোলযোগ ভুলেই গেলাম। সব পাওনা গন্ডা মিটিয়ে মৃৎশিল্পীর শেষ কাজ টুকু করিয়ে মূর্তি নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখি বাসবদত্তা ছুটতে ছুটতে আসছে এবাড়ির দিকে।
‘ আঙ্কেল, আঙ্কেল জলদি চলুন। কয়েকজন লোক এসে সুপ্রতিম আর ইন্দ্র স্যার কে তুলে নিয়ে গেছে।’
ইন্দ্র স্যার ত একাই বেরিয়েছিলেন তাহলে সুপ্রতিম এলো কোত্থেকে? তাহলে কি পথে ওদের দেখা হয়েছিল।আমার কানের কাছে রাজ সিংহ বাবুর সাবধানবাণী গুলো যেন বারবার রিপিট হতে লাগলো।এ কোন নতুন বিপদের সম্মুখীন আমরা?
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
তৃতীয় পর্ব- মরণখেলা শুরু
রূপনারায়ণ বাবু আমাদের আশ্বস্ত করতে বললেন এখনই পুলিশ কে খবর দেওয়া হবে।
‘ আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। রায়চৌধুরী বাড়ির কোনো অতিথির কোনরকম ক্ষতি হতে দেবো না। আগে মা বলো তো, ঠিক কি কি হয়েছে?’
আমি।’ তোর আর সুপ্রতিম এর সাথে ইন্দ্র স্যারের দেখাই বা কি করে হলো?’
বাসব দত্তা।’ আসলে মাঝে মাঝেই সকাল বেলা আমরা দেখা করতে জোড় বাংলার কাছে আসি। আজও এসেছিলাম, তখনই ইন্দ্র স্যার কে দেখতে পাই। তো আমরা ঠিক করলাম ওনাকে সঙ্গ দেবো, ওনাকে গ্রাম টা ঘুরে দেখাবো। তারপর একটা একটা জিপে করে একদল ছেলে আসে, ওদের সাথে অস্ত্র ছিল মানে ওই রড স্টিক লাঠি এইসব, কিন্তু একজনের কাছে ছিল রিভলবার। ইন্দ্র স্যার কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে আসুন মাষ্টারমশাই, ইন্দ্র স্যার রাজি না হলে ওরা গায়ে হাত তোলার হুমকি দেয়। অগত্যা স্যার রাজি হয়ে যায় অদের সাথে যেতে কিন্তু শর্ত দেয় আমাদের ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু সুপ্রতিম কিছুতেই স্যার কে যেতে দিচ্ছিল না তখন ওরা ওকেও গাড়িতে তুলে নেয়।’
রাজাদাদা ও বুঝতে পারছে না এখানে আসার পর থেকে একের পর এক হচ্ছে টা কি। রাজাদাদা বলে ইন্দ্র স্যার কে কেউ কেনো তুলে নিয়ে গেলো তা আন্দাজ করতে গেলে আমাদের একমাত্র সাহায্য করতে পারে সুনির্মল বাবু।
অগ্নিস্বর বাবু।’ আমি পুলিশে খবর দিয়ে দিয়েছি। সুনির্মল ওর ঘরেই আছে, এক্ষুনি তাহলে ওনার সাথে গিয়ে কথা বলুন।’
রাজা দাদা এবার সুনির্মল বাবু কে জিজ্ঞাসা করলো,’ আচ্ছা আপনি কি জানেন এই গ্রামে কারোর সাথে ইন্দ্র স্যারের কোনো শত্রুতা আছে কিনা। মানে ধরুন উনি তো এর আগেও এই গ্রামে এসেছেন, আগেরবার এমন কোনো ঘটনা বা কিছু কি ঘটেছিল যার শোধ তুলতে ওনাকে অপহরণ করা হয়েছে।’
‘ না রাজাবাবু, সেরকম তো কিছু নয়। আগেরবার বলতে যখন ও কলকাতায় চাকরি করতো ও প্রায়শই আসতো বিষ্ণুপুরে, উইকএন্ড তো এখানেই কাটাত। আর গ্রামের মানুষজন বুঝতেই পারছেন সবাই সবাইকে চেনে তাই ওর সাথে অনেকের ই পরিচয় বন্ধুত্ব এবং ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু খারাপ কিছু সেরকম তো মনে পড়ছে না।’
পুলিশের ভরসায় থেকে আমরা এদিকে সুনির্মল বাবুর সাথে কথা বলছিলাম। অন্যদিকে ঘটে গেছে আরেক বিপদ। সত্যিই আজকের দিনটা বটে, দোলের দিনে সকাল থেকে একের পর এক যা ঘটে যাচ্ছে। আচ্ছা এমনটা নয় ত এসব ইচ্ছে করে ঘটানো হচ্ছে আর সবটা হচ্ছে আজকে দোল এর শ্রীকৃষ্ণ পূজা বন্ধ করার জন্য?
জেঠিমা র চিৎকার শুনে আমরা সকলে ছুটে গেলাম ওনার ঘরে। স্বাগতা দেবী মানে জেঠিমা রূপনারায়ণ বাবু র স্ত্রী শীর্ষেন্দু কে পাঠিয়েছিল পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়ে আসতে, আসলে এবাড়ির রীতি আছে এ বংশের উত্তরাধিকারী র হাতে জ্বালানো বাতি দিয়ে কৃষ্ণমূর্তি র প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু প্রদীপে তেল ঢালতে ভুলে যাওয়ায় ঘর থেকে তেল ঢেলে আনতে বলেছিলেন উনি, কিন্তু ও পাকামি করে তেল ঢেলে আগুন জ্বালাতে গিয়ে কোনো দাহ্য বস্তুর গায়ে হয়ত আগুন ধরিয়ে দিয়েছে যে আগুনের আঁচ এঁকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এতো সহজেই এই আগুন দেখে দমিয়ে যাওয়ার পাত্র শীর্ষেন্দু নয় তার প্রমাণ কাল রাতে দাবা খেলতে গিয়ে পেয়েছি।
শীর্ষেন্দু কাউকে না ডেকে নিজেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিল, ভাগ্যিস ও ফিরছে না দেখে জেঠিমা উঠে এসেছিলেন। রূপনারায়ণ বাবু ঝাঁপিয়ে পড়লেন ঘরে এবং শীর্ষেন্দু কে আগুনের আঁচ থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলেন। কিন্তু এটা ও অনুমান করেছিলাম যে এরপর কি হবে নিশ্চিয়ই এটার জন্যও ওনা কেই দায়ী করবে রাজসিংহ বাবু।
‘ আর কতবার বলব, এখনও যদি তোমাদের চোখ না খোলে। নিজে যখন কিছু করতে পারছে না তখন দাদা বৌদির সাহায্য নিয়েছে। এবার বৌদি কে দিয়ে আমার ছেলের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে। আমি আগেই বলেছিলাম এ বাড়ি আমার ছেলের জন্য নিরাপদ নয়, আমি এখনই শীর্ষেন্দু কে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেব আর আজকে পুজো কোনোমতেই হবে না।’
যেনো এই শেষ কথাটার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম, এত কিছু করার বা ঘটনার একটাই উদ্দেশ্য এবারের রায়চৌধুরি বাড়ির দোল এর বারোটা বাজানো, কিন্তু কেনো? এই প্রশ্ন টা ই বারবার মাথায় এলো। রাজাদাদাও হয়ত এসবই ভাবছে আর সব ঘটনা গুলোকে পরপর সাজানোর চেষ্টা করছে।
এবারও রূপনারায়ণ বাবু চুপ থাকার পর একটি কথা বললেন শুধু,’ তুই আবারো ভুল বুঝছিস ভাই, আমি তোদের ক্ষতি করতে চাই না, কিন্তু..’ এমন সময় উপর থেকে বয়স্ক গলায় শোনা গেল ‘ শান্ত হ তোরা, আমি তো এখনও বেঁচে আছি নাকি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন ইনি সন্দীপ বাবু, বাড়ির সবচেয়ে বয়োজেষ্ঠ সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিলেন।
রূপনারায়ণ।’ বাবা তুমি নীচে কেনো নেমে আসছো?নন্দিনী বাবা কে উপরে নিয়ে যাও।’
সন্দীপ বাবু র দেখাশোনার দায়িত্ব নন্দিনীর। উনি বললেন,’ কি করবো বাবু, বাবুই এর গায়ে আগুন লেগেছে শুনে এমন বায়না করলেন..’
রাজসিংহ।’ বাবা কে যদি শান্ত ই না রাখতে পারো, তাহলে মাস গেলে মোটা মাইনে নাও কেনো?’
রাজসিংহ বাবু কে প্রথম থেকেই আমার ভালো লাগেনি, এখন এসব কথা শুনে ওনার উপর রাগ হতে লাগল।
সন্দীপ বাবু।’ ভদ্রভাবে কথা বল রাজ, নন্দিনী তুমি উপরে যাও, আমি আসছি। তোরা কি বলতে চাস শেষ জীবনটা আমি তোদের ঝগড়া দেখে কাটাই। কদিন ই বা আছি আমি, হয়ত আজই আমার শেষ দিন।’
এসব পারিবারিক ব্যাপারে কখনোই নাক গলায় না রাজাদাদা। তাই এসব কথা হচ্ছে দেখে বাইরের দিকে যেতে লাগল ঠিক তখনই এন্ট্রি নিল অগ্নিস্বর বাবু হয়ত আজ সকাল থেকে ঘটা এত ঘটনার শেষ দুংসংবাদ টা দিতে।
অগ্নিস্বর বাবু।’ পুলিশেরা স্পট থেকে এই চিরকুট টা পেয়েছে যেখানে লেখা _ ‘ কলকাতা থেকে আসা মাষ্টারমশাই আর খুদে শিশু দুজনই এখন আমাদের অধীনে। বেশি বাড়াবাড়ি আমরা একদম পছন্দ করি না আর তাই মাঝে মাঝে আমাদের ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে হয়। আমাদের কথা শুনছিল না তাই একজনের কৃষ্ণত্বপ্রাপ্তি হয়েছে আর আরেকজন কে যদি এখনও জীবিত দেখতে চান তো রূপদা পাঁচতালতলায় একা চলে আসবেন। আমাদের কাছে উকিল, কাগজপত্র সব রেডি করা আছে, জাস্ট একটা সই করে পুরো রায়চৌধুরী বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি আমাকে লিখে দিয়ে চলে যাবেন।
দোল টা ভালো কাটুক।
ইতি-
রূপনারায়ণ রায়চৌধুরী তোমার যম’
আমার মাথায় তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – কৃষ্ণত্বপ্রাপ্তির মানে কি মরে যাওয়া?
রায়চৌধুরি বাড়ির দোল
চতুর্থ পর্ব- বাঁচার আশা
পুলিশ ইতিমধ্যেই খোঁজা শুরু করে দিয়েছে। আমরাও বাইকে করে বেরিয়ে পরলাম। রাজাদাদা বললো ওরা কত টা সাংঘাতিক আমরা কিছুই জানি না, ইন্দ্র স্যারের সাথে কোনো পুরনো শত্রুতা আছে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে তাই আমার মনে হয় না ওরা এখনই কাউকে মেরে ফেলার মত জঘন্য কাজ করবে বলে, ওই কৃষ্ণত্ব প্রাপ্তির কথা টা নিতান্তই ভয় দেখানোর জন্য।
সেই চিরকুট আসার পর থেকে বিনয়কাকুর দুশ্চিন্তা বেড়ে গিয়েছে, ওদিকে সুপ্রতিম এর বাড়িতে খবর টা পৌঁছনোর পর কি হতে চলেছে জানি না। এই বিষ্ণুপুরে কিছুই চিনি না আমরা, যাইহোক সুনির্মল বাবুর বাইকে চেপে পুরো গ্রাম টা একবার ঘুরে বাড়ি ফিরে এলাম।
রাজসিংহ।’ আপনারা খুঁজে পেলেন না তো?(ক্রুর হাসি হেসে) দাদা কে জেরা করুন গোয়েন্দা রাজাবাবু, ওকে জিজ্ঞেস করলেই সব খোঁজ পেয়ে যাবেন।দাদাই নিজের লোক কে দিয়ে কিডন্যাপ করিয়েছে, আসল ব্যাপার টা জানেন কি ওর ১/৩ ভাগ সম্পত্তি তে পোষাচ্ছে। এ ব্যবসা তো ও হাতিয়েই নিয়েছে, এখন পুরো বাড়ি টাই ওর চাই।’
রাজাদাদা।’ সম্পত্তি হাতাতে গেলে তো সন্দীপ বাবুর সই লাগবে, রূপনারায়ণ বাবু র সই দিয়ে কি হবে। বোকা বোকা কথা বলবেন না, যদি আপনাদের থেকে কিছু হাতানোর থাকে তাহলে তো আপনাদের ডাকতো উনি তো নিজেই নিজেকে ডাকতেন না।’
‘ আজকের টা ত ট্রেইলার, হয়ত দেখবেন আজ ফিরে এসে দাদা বলছে বাবার সই লাগবে।’
‘ আচ্ছা আপনি বুঝি কিডন্যাপার দের পুরো প্ল্যান টাই জানেন।’
অগ্নিস্বর।’ জামাইবাবু এসব কেন করছেন? আমরা এখন এত চিন্তার মধ্যে আছি শুধু শুধু রূপ দা কে.. না না এখন এটা সময় নয়। এখন শুধু ভাবতে হবে কি করে সম্পত্তি বাঁচিয়ে ও ওনাদের দুজন কে উদ্ধার করে আনা যাবে। কিছু কি ভাবলেন রাজাবাবু?’
‘ ভাবছি তো অনেক কিছুই, সমস্যা টা হলো এক জায়গায় ওরা দুজন কে তুলে নিয়ে গেছে আর তাদের মধ্যে একজন এর কোনো খবর নেই এটা আমাকে বেশ ভাবাচ্ছে। তবে চিন্তা করবেন না রায়চৌধুরী বাড়ির কোনো ক্ষতি হবে না, আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। কিন্তু সেটা করতে হলেও আজকে রূপনারায়ণ বাবু কে যেতে ও হবে, সই ও করে দিয়ে আসতে হবে, একবার স্যার দের উদ্ধার করা যাক তারপর আমি বুঝে নেব।’
রাজসিংহ।’ ওরা কিন্তু কোনরকম চালাকি করতে বারণ করেছে। পুলিশ কে নিয়ে বা আপনি নিজে যদি যান ওখানে ওরা কিন্তু ওদের ক্ষতি করে দিতে পারে। আমার মনেহয় আপনার না যাওয়া টাই শ্রেয়।’
নন্দিনী এসে আমাকে ডাকলেন বললেন সন্দীপ বাবু আমার সাথে কথা বলতে চায়। একটু অবাক ই হলাম আমার সাথে আবার কি কথা, শীর্ষেন্দু আমাকে নিয়ে সন্দীপ বাবুর ঘরে গেল। কিন্তু সন্দীপ বাবু আমার সাথে একা কথা বলতে চায় তাই নন্দিনী আর শীর্ষেন্দু কে বাইরে বের করে দিলেন।
‘ শুভ দরজাটা ভেজিয়ে দাও। শোনো, তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। আমি জানি আমার জীবনের শেষ সময়ে আমি এসে পৌঁছেছি, কিন্তু তুমি কি পারবে আমাকে বাঁচাতে?’
‘ কি বলছেন আপনি এসব? আপনার বয়স্ হয়েছে মানে এই নয় যে আপনার সময় শেষ। আমি বুঝতে পারছি হয়ত নিচে দুই ভাইয়ের বিবাদ..’
‘ না শুভ, সেসব নয়। আমি যদি মরে যেতাম তাহলেই বোধহয় ভালো হতো কিন্তু মরেও বেঁচে থাকার কষ্ট টা বুঝি আমি। তোমাকে যা যা বলছি মন দিয়ে শোন সবটা সুযোগ বুঝে তোমার গোয়েন্দা দাদা কে জানাবে। দাড়াও আমি তোমাকে একটা জিনিস দিচ্ছি, লুকিয়ে রাখবে।’
উনি ওনার দেরাজ থেকে একটা ছোট কৃষ্ণমূর্তি নিয়ে এসে আমার হাতে দিলেন।
‘ বললেন এটা তোমাদের বিপদের সময় রক্ষা করবে। আমরা বিপদে পড়লে সবার আগে ঠাকুরকেই দোষারোপ করি যে ঠাকুর কেনো তুমি আমার সবকিছু কেড়ে নিলে কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কিন্তু ইনিই রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ায়।’
‘ এই বয়সে এসে সত্যিই হয়ত ঠাকুর কে ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। ঠিক আছে চিন্তা করবেন না এই মূর্তি টা আমি রাজাদাদা কে দিয়ে দেব আর আপনি একদম মরে যাওয়ার কথা বলবেন না।’
‘ সাধে কি আর বলছি শুভ? আমার এই বয়সে তুমিই বলো বাইরে যাওয়া কি ঠিক কিন্তু এখন আমাকে বেরোতে হবে। আসলে আমাদের পুজোর রীতি রাধারাণীর গহনা বাড়ির বড় ছেলেকে নিজে পছন্দ করে নিয়ে আসতে হয় কিন্তু রাজ কে তো দেখলে ও রূপ কে একদম পছন্দ করে না, তাই রূপ চায় যতদিন আমি বেঁচে থাকব প্রতি বছর আমিই যেন গহনা আনতে যাই।’
‘ আপনি রূপনারায়ণ বাবু কে বুঝিয়ে বলুন আজ আপনার শরীর টা ভালো নেই। উনি নিশ্চয়ই মেনে নেবেন।’
‘ ছেড়ে দাও রাজ ঝামেলা শুরু করবে। এমনিতেই সকাল থেকে যা সব হয়েছে পুজো শুরু হতে চলেছে। দেরি করা চলবে না, গহনার দোকান খুব বেশি দূরে নয় তাছাড়া আমরা গাড়িতে করে যাব। শুধু আমার একটা অনুরোধ তোমার সাথে যা যা কথা হলো বাইরে কেউ যেন জানতে না পারে শুধু তোমার দাদা ছাড়া।’
বাইরে বেরিয়ে দেখলাম রাজাদাদা এখনও ওনাদের সাথে পরামর্শ করছে। বুঝতে পারলাম এখন ওকে কিছুই বলা যাবে না। রূপনারায়ণ বাবু ওনার বাবা কে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আমি রাজাদাদা কে ইশারা করলাম, ঘরে নিয়ে গিয়ে সবটা বললাম, সবটা শুনে ও বললো সন্দীপ বাবুর খুব বিপদ আমাদের এখনই রূপনারায়ণ বাবু কে ফোন করতে হবে।
কিন্তু আমাদের অনেকটা দেরি হয়ে গেছিল, আমরা যখন এদিকে রূপনারায়ণ বাবু কে ফোন করছি তখন বাড়ির টেলিফোনে হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে, রাজাদাদার অনুমানই ঠিক হলো, আজকে ঘটে যাওয়া একের পর এক বিপদের চূড়ান্ত পর্ব।
রূপনারায়ণ বাবুর গাড়ির ব্রেকফেল করে, টাল সামলাতে না পেরে একটা গাছে গিয়ে আঘাত করে। রূপনারায়ণ বাবু সামান্য চোট পেলেও সন্দীপ বাবুর অবস্থা গুরুতর, ওনাকে ভেন্টিলেশনে দেওয়া হয়েছে। রায়চৌধুরী বাড়ির দোল আপাতত স্থগিত, সুনির্মল বাবু আর কোনো রিস্ক নিতে চাননি পুলিশ কে পুরো বাড়িটা সিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। সারাদিন যা হচ্ছে সিরিয়াসলি একটা তদন্তের দরকার।
আমার খুব আপসোস হচ্ছিল, আমি যদি রাজাদাদা কে আগে সবটা জানাতাম হয়ত কিছুই ঘটত না, উনি এতবার করে বলেছিলেন ‘ তুমি আমাকে বাঁচাতে পারবে?’
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
পঞ্চম পর্ব- রেসকিউ মিশন
এবার সত্যিই আপসোস হচ্ছিল দোলের ছুটি টা বাড়ি থেকে ঘুরে আসলেই পারতাম, কিন্তু রাজাদাদা কে নিয়ে বিষ্ণুপুর এ এসে একের পর এক বিপদের মুখোমুখি করতে হচ্ছে এবং কোনোকিছুর কূল কিনারা করতে পারছি না। কেনো ঘটছে এসব রাজাদাদা ওর সেই ডায়েরি টা বের করে আমায় দিয়ে বললো,’ শোন আমরা বিষ্ণুপুরে আসার পর যা যা পরপর ঘটেছে যেভাবে বলছি লেখ।’
১) দুজন স্বল্পবয়স্ক ছেলে বাইক চালিয়ে তুমুল গতিতে ধেয়ে এসেছিল ইন্দ্র স্যারের দিকে।
উদ্দেশ্য- ইন্দ্রস্যারের ক্ষতি করা
ক্লু- ওই ছেলে দুটোকে বাসবদত্তা আগেও দেখেছে তাই আরেকবার সামনে এলে চিনতে পারবে
২) ‘শীর্ষেন্দু রূপনারায়ণ বাবু লোহার রড দিয়ে মাথায় মেরে আহত করতে চেয়েছিল’ এমন গল্প রাজসিংহ বাবুর মুখে শোনা যায়।
উদ্দেশ্য- রূপনারায়ণ বাবুর বদনাম করা
ক্লু- সঠিক কোনো প্রমাণ নেই, হাতে রড ধরা অবস্থায় রূপনারায়ণ বাবু কে দেখা গিয়েছিল
৩) সকালে হাঁটতে গিয়ে অপহৃত হলো ইন্দ্রস্যার সাথে সুপ্রতিম ও।
উদ্দেশ্য- আবারো অবশ্যই ইন্দ্রস্যারের ক্ষতি করা
ক্লু- এবারও সাক্ষী সেই বাসবদত্তা, পুলিশ স্পট থেকে চিরকুট পেয়েছে তাতে লেখা পাঁচতালতলায় আসতে হবে, সময়ের উল্লেখ নেই। পুরো চিঠি টা ‘ আপনি’ সম্বোধন করেও শেষে ‘ তোমার যম’ উল্লেখ করা। তাহলে ব্যক্তিটি কি রূপনারায়ণ বাবুর পরিচিত?
৪) জেঠিমা স্বাগতা দেবী র নির্দেশ মত আগুন ধরাতে গিয়ে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে ফেলে শীর্ষেন্দু, শেষে রূপনারায়ণ বাবুই উদ্ধার করে।
উদ্দেশ্য- যদি রাজসিংহ বাবু সঠিক কথা বলেন তাহলে এটা করে রূপনারায়ণ বাবু নিজেকে ভালো প্রমাণ করতে চাইলেন শীর্ষেন্দু কে বাঁচিয়ে।
আর আমরা যেভাবে দেখে আসছি মানে রাজসিংহ বাবু লোকটা বরাবর দাদার বদনাম করতে চাইছেন তাহলে এটার ও উদ্দেশ্য একই।
ক্লু- একমাত্র শীর্ষেন্দু সত্যি টা বলতে পারতো কিন্তু ও মুখ খুলছে না, ও বলছে এটা একটা এক্সিডেন্ট।
৫) রূপনারায়ণ বাবু ওনার বাবা কে নিয়ে গেলেন ঠাকুরের গহনা আনতে, ফেরার পথে গাড়ির ব্রেকফেল করলো অথচ রূপনারায়ণ বাবু সামান্য আহত হলেন কিন্তু সন্দীপ বাবুর অবস্থা গুরুতর।
উদ্দেশ্য- সন্দীপ বাবু কে মেরে ফেললে যদি কোনো উইল করা না থাকে আইনমাফিক এবাড়ি তিন ভাগ ভাগ হবে। কিন্তু সেটা তো এমনিতেও হওয়ার কথা ওনাকে মেরে ফেলা দরকার কি, তাহলে নিশ্চয়ই কোনো উইল আছে যেটার কথা আমরা কেউ জানি না!
ক্লু- যাওয়ার আগে শুভ কে অনেককিছু বলে গেছেন উনি সেগুলোকে ভালোকরে বুঝতে হবে। আর ওই কৃষ্ণমূর্তি টা কিসের সংকেত? বাকি টা স্পটে গিয়ে পুলিশের সাথে কথা বললে জানা যাবে।
রায়চৌধুরী বাড়িতে পুলিশ চলে এসেছে, রাজসিংহ বাবুর সুনির্মল এর এই বাড়াবাড়ি টা কে মোটেই পছন্দ করেনি। আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশ আসার ঠিক আগেই আমরা একটা ফোন কল পেয়েছি। সেখানে জানানো হয়েছে,’ আজ সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে রূপনারায়ণ রায়চৌধুরী কে আসতে হবে। ওর চোট এমনকিছু গুরুতর নয়, কোনরকম চালাকির চেষ্টা করলে বা বাড়িতে পুলিশ এলে এই কিডন্যাপিং এর ব্যাপারে কিছু যেন জানানো না হয়, তাহলে কাউকেই আর আস্ত রাখবো না।’
তো সেইমত রাজসিংহ বাবু পুলিশ ওই ঘটনা বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই বললো।
ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত।’ আপনি যখন ডেকেছেন তখন একবার সবার সাথে কথা অবশ্যই বলবো কিন্তু সবটা শুনে আমার কিন্তু সবগুলো কেই এক্সিডেন্ট ই মনে হচ্ছে। সে বাইক এসে ধাক্কা মারা বলুন কিংবা ঘরে আগুন লেগে যাওয়া, আর এখন গাড়ির ব্রেক ফেল করা। আসলে আপনাদের এত বড় পুজো আর পুজোর ঠিক আগের মুহূর্তেই এত কিছু ঘটে গেছে যে আপনি সবগুলোর মধ্যে লিংক খুঁজে পাচ্ছেন কিন্তু এটা যে নিতান্ত কাকতালীয় সেটা হতেই পারে।’
রাজাদাদা ইন্সপেক্টর এর সাথে আলাপ করলেন, বাড়ির সবাইকে জেরা করা হলো। রূপনারায়ণ বাবু বাড়িতে ফিরে এসেছেন কারণ এখন বিকেল ৫ টা, হাতে আর দু ঘন্টাও নেই। বাড়ির লোকজন পালা করে সন্দীপ বাবুর সাথে দেখা করার জন্য হাসপাতাল যেতে চাইছে কিন্তু যেহুতু ভেন্টিলেশনে রাখা কেউই সামনা সামনি যেতে পারবে না।
রাজাদাদা।’ শুভ, তৈরি হয়ে নে। আমাদের মিশন এবার শুরু। শোন আমরা হাসপাতালে যাওয়ার নাম করে এখনই বেরিয়ে যাব। আমি হাসপাতালে কিছুক্ষন থেকে ঠিক ৬ টা নাগাদ বেরিয়ে যাবো। ঠিক তার আগেই বাসবদত্তা চলে আসবে, ও এসে সবাইকে জানাবে সুপ্রতিম বাড়ির লোক তোর সাথে দেখা করতে চায়। তুই বাসবদত্তার সাথে বেরিয়ে আসবি, তারপর তেমাথার কাছাকাছি গিয়ে মিট করবি ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত এর সাথে আমি বিপাকে পড়লেই আমার পাঠানো লোকেশন এ ওনাকে নিয়ে চলে আসবি। সব ব্যবস্থা করে রেখেছি, একদম ঘাবড়ের যাবি না।’
‘ এইটুকু রিস্ক ত নিতে হবেই ইন্দ্রস্যার আর আমার বন্ধু কে বাঁচাতে। কিন্তু ওরা ইতিমধ্যেই যদি কাউকে সিরিয়াসলি খুন করে ফেলে?’
‘ না ওটা ওরা করবে না আসলে দুজনের মধ্যে একজন হলো ওদের ট্রাম্প কার্ড, আমরা কোনরকম চালাকি করছি ওরা ওদের সেই ট্রাম্প কার্ডের সাহায্য নেবে। যাইহোক বেস্ট অফ লাক, চল বেরিয়ে পরি।’
সন্ধ্যা ৬:৪৫ মিনিট। রূপনারায়ণ বাবু পৌঁছে গেছেন , ওনাকে নিয়ে ওরা আরো কিছুটা দূরে একটা পরিত্যক্ত কারখানার দিকে নিয়ে গিয়েছে, রাজাদাদা অলরেডি সেই লোকেশন শেয়ার করে দিয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম, দশ মিনিট পেরিয়ে গেল।
বাসবদত্তা।’ শুভ, আমাদের এখনই যাওয়া উচিত। রাজাদাদার কল করার আশায় বসে থাকলে চলবে না , যদি রাজা দাদার ই কোনো ক্ষতি করে দেয় ওরা, তাছাড়া সুপ্রতিম কেমন আছে কিছু জানি না। ওরা যদি তোমাদের স্যার কে ছেড়ে দিয়ে ওকে রেখে দেয়.. না না ভাই চল এখনই বেরিয়ে পরি।’
‘ না রে এখন যাওয়া যাবে না। তুই কেনো বুঝতে পারছিস সেনগুপ্ত দা সাথে আছে জানলে ওরা আরো কোনো বড় ক্ষতি করে দিতে পারে, ওরা আগেই বলেছিল পুলিশ কে যেন কিছু জানানো না হয়।’
‘ সে তো ওরা এও বলেছিল জেঠু যেন একা যায়। কিন্তু তোর রাজাদাদা কি সেটা শুনেছে, না না সুপ্রতিম কে আজই উদ্ধার করতে হবে ও যতই দিনরাত রানী কে ফোন করুক আমি তো ওর কথা ভাবি..’ বলেই দৌড় লাগালো ও।
এটার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না, যেহুতু পুলিশ এ খবর দেওয়া বারণ তাই সেনগুপ্ত দা কে ওখানে রেখে আমিও ছুটলাম বাসবদত্তা কে আটকাতে। স্পটে পৌঁছে গিয়ে দেখলাম দুজন মাত্র লোক, দুজনেরই মুখ ঢাকা আর কালো রঙের পোশাক পরে। সামান্য বেটে লোকটি রিভলবার হাতে নিয়ে রূপনারায়ণ বাবুর দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে আছে আর অন্য জন চেয়ারে বসে রূপনারায়ণ বাবু কে কিসব বোঝাচ্ছে। আমরা কারখানার ঠিক বাইরে এসে লুকিয়ে পরলাম, এবার ওদের কথাও শোনা যাচ্ছিল।
‘ ইন্দ্রর সাথে তোমরা কি করেছ?’
‘ আরে রূপ বাবু, আপনার এত তারা কিসের বলুন ত, সবটা জানবেন ধীরে ধীরে..’
‘ আমি সই করে দেবো বলেছি ত, কিন্তু আমার দুজন কেই বহাল তবিয়তে ফেরত চাই। তোমরা কারা? আমার গাড়ির ব্রেক টাও..’
‘ আরে সব যদি এখনই জেনে যান গল্প তো এখানেই শেষ। আচ্ছা আপনাদের বাড়িতে এখন তো আবার গোয়েন্দা জুটেছে, কি যেন নাম ও হ্যাঁ সকলের প্রিয় রাজাদাদা, তো ওনাকে বলুন তদন্ত করতে। ও বের করুক আমি কে আছি বটে। ব্যাটা অনেকক্ষন আগেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছে এখনও বাড়িতে ফেরেনি নিশ্চয়ই আপনাকে বাঁচাতে এখানে আসতে চাইবে, সে আসুক ওর জন্য আমার দরজা খোলাই আছে, ওই যে দেখছেন না সামনের গেট দিয়ে ঢুকবে..’
গেট এর দিকে আঙুল তাক করতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিলাম।
‘ একদম ঝাঁঝরা করে দেব। এ গণশা ওই ছোকরা টা কে লিয়ে আয়।’
‘ দেখো আগেই বলছি আমার দুজনকেই চাই নইলে আমি কিন্তু পুলিশে খবর দেবো।’
‘ ( অট্টহাসি হেসে) এই জায়গা টা কাছাকাছি বলে বুকে খুব বল পেয়েছেন তাই না, কিন্তু পুলিশ হাজার চেষ্টা করলেও আমার আসল ডেরার টিকি টিও পাবে না। অত সহজে পুলিশ কে জানিয়ে দেবো নাকি কি ভেবেছেন! ওর জন্যই ত এখানে ডেকে আনলুম। সই সাবুদ করে দিয়ে ছোকরা টা কে লিয়ে বেরিয়ে যান, ইন্দ্র বাবুর কিছু হয়নি উয়াকে সময় হইলে ছেড়ে দেব।’
‘ কি গ্যারান্টি?’
‘ আপনি আমার কাছে গ্যারান্টি চাইছেন? আরে বাবু আপনার কাছে আর কোনো পথ খোলা নেই, বেশি বাড়াবাড়ি করলে ইন্দ্র কে তো পাবেন ই না সাথে সাথে আপনার আর ওই ছোকরার লাশ পড়ে থাকবে ওখানে।’
ওই তো দুজন লোক সুপ্রতিম কে নিয়ে এসেছে। এবার একটা দারুন কান্ড ঘটলো রূপনারায়ণ বাবু সই টা করতে যাবেন এমন সময় ওই দুজনের মধ্যে একজন একটা রিভলবার নিয়ে যিনি এতক্ষন কথা বলছিলেন তার মাথায় আর সুপ্রতিম একটা ঘুষি মেরে আরেকটা লোক কে কাত করে দিয়ে বেঁটে মত লোকটার রিভলবার কেড়ে নিল।
‘ আপনার মুখ খুলে ফেলুন এক্ষুনি!’
আরে এ যে রাজাদাদার গলা। তার মানে রাজাদাদা ই ওদের মত বেশ ধরে ওদের সাথে মিশে গিয়েছিল আর আগে থেকে সুপ্রতিম কে সবটার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিল, নইলে ওর পক্ষে এতটা সাহসিকতা দেখা অসম্ভব, এবার বাসবদত্তা অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো।
‘ মিস্টার রাজেন্দ্র রায় ওরফে রাজাদাদা, এসব খেলনা বন্দুক সরিয়ে রাখুন, কখন গুলি বেরিয়ে কি ঘটে যাবে কেই বলতে পারে। হয়ত দেখলেন আপনার একটা গুলি গিয়ে বিধলো সেই আপনার স্যারের বুকে।’
‘ স্যার কে যদি এখনই ছেড়ে না দিন তাহলে আপনি আজ আর বাঁচবেন না।’
‘ আপনি বুদ্ধিমান আছেন তাই ভালো করে আমার কথা শুনুন এতক্ষন আমার কাছে দুটো গুটি ছিল তাই আমি রাজ করছিলাম আর এখন আমারও একটা আপনার ও একটা আপনি যদি আমাকে মেরে ফেলেন স্যার কে কখনোই দেখতে পাবে না। তার চেয়ে বলি কি আপনি ওই ছোকরা কে…’
বাসবদত্তা ছুটে এসে একটা পাঞ্চ মারলো লোকটির মুখে। সাথে সাথে ওনার দলের লোকগুলো আমাদের দিকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো।
‘ আরে তোরা কেন হাত নোংরা করতে আসছিস। মিষ্টি মেয়েটার বয়স টা কম তাই উত্তেজনা ধরে রাখতে পারেনি। তবে আমার মুখোশ যদি কেউ খোলার চেষ্টা করেছেন একই ফল হবে।তো যেটা বলছিলাম মিস্টার রায় খেলাটা বুঝলেন কিনা টাই হয়ে গেছে, আপনি পুলিশের বাহিনী কে ডাকবেন আমার লোকেদের সাথে একটু খুনোখুনি হবে, আর তার ফল স্যার কে তো পাবেন না। তাই বলছি কি আজকে আপনারা বাড়ি ফিরে যান, পুলিশ কেও আসতে দেবেন না।’
‘ আমি রাজি আছে কিন্তু আমি একবার ইন্দ্র স্যারের সাথে কথা বলতে চাই।’
‘ নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই বলবেন কথা, রিভলবার টা নামান ফোনটা ত করতে দিন।’
‘ আমি দুঃখিত কিন্তু রিভলবার সরবে না। শুভ ওনাকে মোবাইল টা পকেট থেকে বের করে দে।’
লোকটি ফোন নাম্বার ডায়েল করলেন পুরো রিং হয়ে কেটে গেলো। লোকটির গলার স্বর খুব ভালো করে খেয়াল করলে চেনা চেনা লাগছিল। মুখোশের আড়ালে লোকটি তাহলে কে? আমাদের পরিচিত কেউ? ইনি কি তবে রাজসিংহ বাবু?
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
ষষ্ঠ পর্ব- রূপনারায়ণ এর জবানবন্দী
সুপ্রতিম আর বাসবদত্তা নিজেদের বাড়ি ফিরে গেল। আমি রাজাদাদা আর রূপনারায়ণ বাবু গিয়ে বসলাম দীঘির ধরে, আজ সারাটা দিন যা কাটলো। ওদিকে সন্দীপ বাবুর অবস্থা ও ভালো নেই।
‘ ধন্যবাদ রাজা, তোমরা ঠিক সময়ে চলে আসায় আজকে সুপ্রতিম কে বাঁচানো গেল। আমাদের এত বছরের পুরনো পুজো_ হা ঈশ্বর! কি থেকে কি হয়ে গেল?’
‘ আপনি ভেঙে পরবেন না, নিজেকে শক্ত করুন। দেখুন যা যা ঘটেছে সবটার সাথে আপনি জড়িয়ে তাই আপনাকে ঠান্ডা মাথায় আমাকে সবটা বলতে হবে। প্রথমেই বলুন গহনা আনতে গিয়ে ঠিক কি কি ঘটেছিল?’
‘ দেখুন যাওয়ার সময় কোনো অসুবিধে হয়নি। এবার আমরা যখন ফিরে আসবো তখন স্টার্ট দিয়ে একটু এগোতেই বুঝতে পারি ব্রেক কাজ করছে না, সবেমাত্র স্টার্ট দিয়েছি তাই গাড়ির স্পিড ও বেশি ছিল না। আমি বাবাকে বলে দরজা খুলে নেমে যেতে আমি যতটা সম্ভব স্লো করবো, বাবা রাজি হচ্ছিল না বলছিল বুড়ো বয়সে এভাবে নামতে গিয়ে যদি হাত পা ভেঙে যায় কিন্তু আমি একরকম জোর করে বাবা কে নেমে যেতে বলি কারণ গাড়ি টা খুবই আস্তে চলছিল।
বাবা নেমে যেতেই আমিও সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দিই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার মাথা টা কোনো ধারালো কিছুর সাথে ধাক্কা খায়, আর তাই আমি জ্ঞান হারাই। তারপর হাসপাতালে যখন জ্ঞান ফিরে পাই বাবা ভেন্টিলেশনে আছে শুনে রীতিমত চমকে যাই। আপনি বিশ্বাস করুন এক্সিডেন্ট টা এমন গুরুতর ছিল না, তবে ডাক্তার জানিয়েছে ওনার স্ট্রোক হয়েছে তাই অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। বাবার কিছু হয়ে গেলে…’
‘ আপনি চিন্তা করবেন না সন্দীপ বাবু সুস্থ হয়ে যাবেন। পুলিশ সবটা দেখে এটা কে এক্সিডেন্ট বলেই জানালেও আমার একটা খটকা হচ্ছিল আর এখন যখন আপনি বলছেন আপনারা সাবধানেই গাড়ি থেকে নেমে এসেছিলেন তখন এই সন্দেহ টা দৃঢ় হলো। রূপনারায়ণ বাবু আসলে পুরো ঘটনা টাই খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আরেকটা প্রশ্ন ওরা আপনার থেকে সই নিতে কেনো চাইছিল, এই পৈত্রিক ভিটের বাইরেও আপনার কি নিজস্ব কোনো জমি জমা না কিছু..!’
‘ আপনি আসলে বাবার উইলের কথা জানেন না বোধ হয়।’
‘ কোন উইল?’
‘ মা মারা যাওয়ার আগে মা বাবার কাছে একটা আবদার করে গিয়েছিল যে মায়ের যদি কিছু হয়ে যায় বাবা যেন উইল করে সব সম্পত্তি আমাকে লিখে দিয়ে যায়। মা জানতেন যে মা বেঁচে থাকলে ভাই মানে রাজ কে উনি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন কিন্তু বাবা সে টা পারবেন না, এবার আমার ভাই খুব শৌখিন, দুটো ছবি এঁকে আরাম করে জীবন কাটিয়ে দিতে চায়।
তাই আমার ভাইয়ের হাতে এই বাড়ি- ব্যবসা গেলে বেহাতে চলে যাবে, অন্যদিকে ছোটন এর মানে সুনির্মল কলেজের প্রফেসর তাছাড়া ও লেখালেখি ও করে ওর ব্যবসা না করলেও চলবে আর মা আমাকে ভরসা করতেন আমি যে ওদের বাড়িছাড়া করবো না বড় ছেলে হিসেবে মা আমাকে ভরসা করতেন। তো বাবা উইল করে সব সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন।’
‘ আচ্ছা এই কারণেই তাহলে আপনার পুরো সম্পত্তি ওরা লিখিয়ে নিতে চেয়েছিল।’
‘ মজার বিষয় কি জানেন ওরা হয়ত জানে না এই পুরো সম্পত্তি আমার নয়। আমার ছেলে আছে বাকিটা ওর নামে!’
‘ মানে? আপনার ছেলে? আমরা তো প্রথম থেকেই জেনে এসেছি আপনার কোনো সন্তান নেই।’
‘ এখন আর নেই বলতে পারেন। ইন্দ্র সবটা জানে, আপনার হয়ত এরই মধ্যে বলে ওঠেনি, ও তখন প্রায়ই এখানে আসত। আসলে এসব কথা বলতেও আমার লজ্জা লাগে। তাও আপনাকে সবটা বলছি,আমার ছেলে রনজয়, ক্লাস টুয়েলভে পড়ত।
সবে সতেরোয় পা দিয়েছে, এই বয়সের ছেলে মেয়েরা খুব অপরিনত মস্তিষ্ক এর হয় আর নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে ভাবে একে অপরকে ভালবাসে, একে অপরের সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমার সাথে আমার ছেলের খুব বনত, ও আমাকে সব কথাই বলত কিন্তু এই একটা কথা ও গোপন করে গিয়েছিল যে ও এই গ্রামের ই মেয়ে ওর সাথেই পড়ত, নাম অপর্ণা, ওকে পছন্দ করত।
টিউশন কামাই করে ওরা একসাথে সময় কাটাত। একটা ঝড়ের রাত সবকিছু পাল্টে দিল। টিউশন থেকে সবাই ফিরে এসেছে কিন্তু ওদের দুজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সে এমন ঝড় যে আমরাও তেমন খোঁজাখুঁজি করতে পারছিলাম না, দুই পরিবারেই চিন্তা হতে লাগলো। ব্যাচের বাকি বন্ধুদের থেকে ওদের সম্পর্কের কথা টা জানা গেলো, ঝড় থামলো তখন রাত তিনটে। একটা গ্রামবাসীর গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ওরা আর মেয়ে টা জানালো বলতেও কষ্ট হয় আমার ছেলে ওর উপর জোর খাটিয়েছে।
নিজেকে সামলাতে পারলাম না, নিজের ছেলের উপর এত বড় অপবাদ, আসলে জান তো রাজা আমি এখনও মাঝে মাঝে ভাবি হয়ত মেয়ে টা মিথ্যে বলেছে কিন্তু সেই মুহূর্তে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারিনি। সেদিনের পর ওকে আমি আইনি ব্যবস্থা নিয়ে ওকে ‘ত্যাজ্য পুত্র’ ঘোষণা করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিই। ওর মা অনেকবার চেয়েছিল ওর খোজ নিতে কিন্তু আমি দিইনি, কিন্তু আমার বাবার বিশ্বাস ওর কোনো দোষ নেই তাই কোনোদিন যদি ওর কোনো সাহায্যের দরকার হয় তখন বাবা উইল পাল্টে নতুন উইলে আমার ছেলেকে অর্ধেকে সম্পত্তি লিখে দেন।"
‘এই ব্যাপার টা কি বাড়ির সবাই জানে?’
‘ হ্যাঁ, বাবা আমার অমতেই কাজ টা করেছে।’
‘ আপনার এই কথাগুলো আমার তদন্তে অনেকটা সাহায্য করবে। যারা ইন্দ্রস্যার কে অপহরণ করেছিল তারা যদি ব্যাপার টা জেনে থাকে তাহলে আপনার পর ওদের টার্গেট হবে দুজন, এক আপনার ছেলে রনজয়। যে করেই হোক ওকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে, আপনি কি ওর ব্যাপারে কিছু জানেন না। এই ৫ বছরে কোনো খোঁজ নেননি?’
‘ না আমি তো নেইনি। কিন্তু ওর মা কে একবার জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন, আমি অনেকবার জানতে চেয়েছি বলেনি, আপনাকে যদি কিছু বলে।’
‘ খুব তারাতারি আমাদের রণজয় এর খোঁজ পেতে হবে আর দুই হসপিটালে পুলিশ সিকিউরিটি বাড়ানো দরকার কারণ সন্দীপ বাবু এই উইল গুলো করে গিয়েছেন তাই যদি ওরা রণজয় কে খুঁজে না পায় স্বাভাবিকভাবেই সন্দীপ বাবু কে দিয়ে উইল টা চেঞ্জ করাতে চাইবে। কিন্তু সেটা সন্দীপ বাবু সুস্থ থাকলে কিন্তু এখন তো ওনার অবস্থা ক্রিটিকাল।’
আমরা এবার বাড়ি ফিরে এলাম। আজ রূপনারায়ণ বাবু যা বললেন তা এই কেসে অনেক সাহায্য করবে। আজকের রাত টা আর নিরাপদে কাটলো।
আজ রংখেলা। আমাদের উত্তরবঙ্গে এবং শুনেছি মুর্শিদাবাদে ও এই নিয়ম পালন করা হয় আগেরদিন দোল, শ্রী কৃষ্ণের পায়ে রং ছুঁইয়ে আবিরের খেলা আর পরের দিন আসল রং খেলা। দক্ষিণবঙ্গবাসী অবশ্য দুইদিন ই মেতে ওঠে। আজকের পরিবেশ টাই অন্যরকম কিন্তু কারোর মন ভালো নেই, কারণ এ বছর যে রায়চৌধুরী বাড়ির দোল স্থগিত। গ্রামবাসীরা এবার তাই রং খেলছে না তেমন, খালি বাচ্চারা রং খেলায় মেতে উঠেছে। এখনও সন্দীপ বাবু অসুস্থ, ওদিকে ইন্দ্র স্যারের ও এখনও খোঁজ মেলেনি।
কিন্তু রায়চৌধুরী বাড়ির দোল এভাবে কি সমাপ্ত হতে পারে,তাই এবার যা খেল দেখালেন স্ময়ং ভগবান শ্রী কৃষ্ণ। বিশ্বাস হচ্ছে না তো, একটু অদ্ভুত লাগছে?আমারও লেগেছিল। সকাল তখন ১০ টা,মাথায় মুকুটের উপরে ময়ুরপুচ্ছ, কপালে তিলক, কানে অলংকার, মুখে হাসি, হাতে বাঁশি, গলায় ফুলের মালা- সকলের আরাধ্য দেবতা দাঁড়িয়ে। কিন্তু এটা কি বাস্তব নাকি মূর্তি! ভগবান হেঁটে আসছেন আর কথাও বলছেন।
আচ্ছা তাহলে কি আমার এখনও ঘুম ভাঙ্গেনি??
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
সপ্তম পর্ব- শ্রী কৃষ্ণের লীলা
মুহূর্তেই মধ্যেই কৃষ্ণমূর্তি জাগ্রত হওয়ার খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামের মানুষ একে একে জড়ো হচ্ছে রায়চৌধুরী বাড়ির বিগ্রহ কে দেখতে। মূর্তি টা নিজের জায়গা থেকে এক আঙ্গুল সরে গেলো আর ভেতর থেকে আওয়াজ এলো;
‘यदा यदा हि धर्मस्य ग्लानिर्भवति भारत ।
अभ्युत्थानमधर्मस्य तदात्मानं सृजाम्यहम् ।।
परित्राणाय साधूनां विनाशाय च दुष्कृताम् ।
धर्मसंस्थापनार्थाय सम्भवामि युगे युगे ॥’
আমি মর্ত্য তে আবার অবতীর্ণ হয়েছি পাপের বিনাশ করতে। এ বাড়িতে যে বিপর্যয় নেমে এসেছে তার কারণ আমাকে সঠিক স্থানে পুজো না করা। আমার অধিষ্ঠান এখানে নয়, যেখানে হওয়ার কথা এবার আমি সেখানেই যাবো, পাপের বিনাশ করে পুণ্যের প্রতিষ্ঠায় আমার যে তোদের সাহায্য লাগবে, তাই আমার সাথে আমি চাইবো তোরাও চল।’
রাজাদাদা এগিয়ে গেলো মূর্তির দিকে। কয়েকজন গ্রামের লোক আর বিনয়কাকা বাঁধা দিলেন।
‘ রাজা, স্ময়ং ভগবান এসেছেন। তুমি কি করতে চাইছো? এইসব ব্যাপারে একদম তোমার গোয়েন্দাগিরি ফলাতে আসবে না।’
‘ আপনি ভুল করছেন কাকা, গ্রামবাসীরা একবার একথা কে বিশ্বাস করে নিলে বিপদ বাড়বে। আপনাকেও বলিহারি ভগবানে বিশ্বাস করেন পুজো উপাসনা নিয়ে থাকেন ভালো কথা তাই বলে কৃষ্ণ মূর্তি জীবন্ত হয়ে গেছে। এটা একবিংশ শতাব্দী, এই সময়ে দাঁড়িয়ে ও এসব কথা বিশ্বাস করতে হবে। ইম্পসিবল! আমাকে দেখতে হবেই , আমি নিশ্চিত মূর্তির ভিতরে কোনো ডিভাইস রেখে দেওয়া হয়েছে আর সেটা দিয়েই আওয়াজ বের হচ্ছে।’
সুপ্রতিম।’ সেটাই এটা কখনো পসিবল নাকি! আমাদের বোকা বানানো হচ্ছে, এই ব্যাপার টা কে একদম প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।’
ব্যাপার টা কে নিয়ে লোকজন দু দলে ভাগ হয়ে গেলো। সকলে দাড়িয়ে আছে শ্রী কৃষ্ণের লীলাখেলা দেখতে। গ্রামের মানুষের মনে অন্ধবিশ্বাস আছে জানি কিন্তু তাই বলে এটা কে বিশ্বাস করার কোনো মানে হয় না। গণেশ দুধ খেলেও সেটার পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে, আর এতে তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে একটা ভয়েস রেকর্ডার বা কিছু রেখে দেওয়া হয়েছে আর মোটর বা কিছু দিয়ে সেটাকে চালনা করা হচ্ছে, ঠিক যেভাবে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি চালনা করা হয়। আমি নিজের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা কাজে লাগিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
বাসবদত্তা।’ কে শুনবে তোর কথা! ওরা সহজ সরল মানুষ এসব কি মানবে। আমাদের বাড়িতেই দেখ না ঠাকুমা এটার কথা জানতে পেরে নিশ্চিত ভগবান দর্শন করতে চলে আসবে।’
রায়চৌধুরী বাড়িতে হুলস্থুল কান্ড পরে গেল। পরিস্থিতি কে আরো খারাপ হওয়ার আগেই রাজাদাদা সকলকে উপেক্ষা করেই পৌঁছে গেলো মূর্তির কাছে, ঠিক তখনই সুনির্মল বাবু বাধা দিলেন।
‘ রাজাবাবু যাবেন না সামনে। ওর ভেতরে শুধু যে কোনো ডিভাইস ই আছে কে বলতে পারে, হার্মফুল কিছু লাইক বম্ব ও থাকতে পারে। আমি সেনগুপ্ত কে খবর দিচ্ছি..’
একথা শুনে আতঙ্ক ছড়ালো কয়েকজনের মনে এবং বিনয়কাকা আর রাজাদাদা কে দেখতে দিলেন না। সেনগুপ্ত দা আসবে ঠিক আছে কিন্তু গ্রামবাসী রা এই বিষয় টা কে নিয়ে যা বাড়াবাড়ি শুরু করেছে, একদিকে ভয় অন্যদিকে ভক্তি দুই কে সম্বল করে সকলেই মূর্তি টা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এবার মূর্তি টা চলতে শুরু করলো গেট এর দিকে, সকলে জায়গা ছেড়ে দিল। কৃষ্ণমূর্তি হেঁটে হেঁটে দূরে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমাদের কাছে অবশ্য মিলিয়ে গেল কিন্তু কয়েকজন ভক্তিভরে ছুটে চলল পেছনে পেছনে।
রাজসিংহ।’ এটা কি করলে, মূর্তি কে বেরিয়ে যেতে দিলে!! মূর্তির গায়ে সোনার অলংকার আছে ওগুলো যদি চুরি হয়ে যায়।’
সুনির্মল।’ আর সোনা, মূর্তি টা বাড়িতে থাকলে কি বিপদ হতে পারত কে জানে। আর ভালো লাগছে না একের পর এক অশান্তি, এবার একে একে সবকিছুর শেষ হওয়া দরকার। কি বলুন রাজাবাবু? আমার বন্ধু কে..’
‘ একদম, আপনার বন্ধু কে উদ্ধার করাটাই এখন প্রথম লক্ষ্য। তবে আমার মনেহয় আপনি ইন্দ্র স্যারের কাছের বন্ধু নন, এ বাড়িতে এটলিস্ট আপনার জানা উচিত ছিল স্যারের সাথে কারোর শত্রুতা আছে কিনা, একবার সেটা যদি জানা যেত…’
রূপনারায়ণ বাবু বাড়িতে ছিলেন না, উনি ওনার বাবার কাছে হাসপাতালে ছিলেন। রাজাদাদার মিশন ২ এবার শুরু হতে চলেছে। কাল রাতে শোয়ার আগে আমরা প্ল্যান করেছিলাম..
‘ শুভ, এবার সন্দীপ বাবুর কথাগুলোর মিনিং বুঝতে পারছি রে। উনি কি বলেছিলেন মনে আছে?’আমি যদি মরে যেতাম তাহলেই বোধহয় ভালো হতো কিন্তু মরেও বেঁচে থাকার কষ্ট টা বুঝি আমি।’ রূপনারায়ণ বাবুর কথা অনুযায়ী যদি মেজর কোনো এক্সিডেন্ট না হয়ে থাকে তাহলে তো সন্দীপ বাবুর সুস্থ থাকার কথা, আবার দেখ ওনার সাথে কেউ সামনা সামনি দেখা করতেও পারছে না। কালই আমাদের যেতে হবে এবং পুরো ব্যাপার টা যাচাই করতে হবে। উনি আদৌ অসুস্থ ত নাকি ডাক্তার ইচ্ছে করে হয়ত কোনো ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে ফেলে রেখেছে। পুরো ব্যাপারটা জানতে গেলে কাল একবার..’
‘ কিন্তু কিভাবে যাবে? কাউকেই তো ঢুকতে দিচ্ছে না। সুপ্রতিম আর বাসবদত্তা ছাড়া এবাড়ির কাউকেই তো ভরসা করা যায় না।’
‘ না ভরসা করতে হবে। জয়েন্টে অনেক প্রশ্নই তো মেথড অফ এলিমিনেশন কাজে লাগিয়ে করে এলি, প্রাকটিকাল ফিল্ডেও কাজে লাগা। কালকের মিশনের জন্য আমরা সঙ্গে নেবো সুনির্মল কে, একবার ভরসা করে দেখিই না কি হয়। আর সেনগুপ্তের সাথে সুনির্মল এর বেশ খাতির আছে তাই পুলিশি সাহায্য ও পাওয়া যাবে। তো কালকে রেডি থাকিস আমরা বেরিয়ে পড়বো সন্দীপ বাবু কে উদ্ধার করতে।’
আমরা ইন্সপেক্টর সেনগুপ্ত এর বাড়ি গেলাম। রাজাদাদা আর সুনির্মল ছদ্মবেশ নিল ডাক্তারের। সেনগুপ্ত দা বললেন আরো দুজন আসছে আমাদের সাহায্য করতে। সেই দুজন আর কেউই নয় সেদিনের দুই বাইক রেসার।
‘ আরে আপনি তো সেদিন আমার বাইকের সামনে চলে এসেছিলেন। আমি খুবই দুঃখিত, আসলে আমরা যতটা সম্ভব সাবধানেই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম..’
‘ ওটা যদি তোমাদের সাবধানের নমুনা হয়! যাইহোক সেসব না হয় ঠিক আছে কিন্তু বান্ধবী কে লেখা চিঠি আমাকে কেনো দিয়ে দিলে?’
আমি।’ চিঠি? কোনো চিঠি? তুমি তো বলোনি আমায় রাজাদাদা?’
‘ জানিস ওতে কি লেখা ছিল,’ প্রিয়তমা আমি এসে গিয়েছি বিষ্ণুপুরে, তোমার সাথে যত শীঘ্র সম্ভব দেখা করতে চাই। কোথায় দেখা করবে জানিও , ইতি – তোমারই স্নেহের অন্তু’!!’
সেনগুপ্ত দা আর সুনির্মল বাবু হাসতে লাগলো।
সেনগুপ্ত দা।’ অনন্ত থেকে অন্তু। হা.. হা.. হা। সে যাইহোক আলাপ করিয়ে দিই, তুমি কাকে প্রেমপত্র দিয়েছ তার পরিচয় টাও জেনে নাও উনি গোয়েন্দা রাজাদাদা, আমি জানি এটা বলাতে উনি আমার উপর অপ্রসন্ন হলেন বটে কিন্তু এটাই ওনার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। আর রাজাদাদা এরা হলো অনন্ত আর প্রীয়ম, আমাকে অনেক কেসেই সাহায্য করে। তো চলুন বেরিয়ে পড়া যাক।’
সেনগুপ্ত দা আমাকে নিয়ে ঢুকলো হাসপাতালে।
সেনগুপ্ত দা।’ রূপনারায়ণ দা বাবা এখন কেমন আছে?’
‘ একই রকম। ডাক্তার জানালো কোনো ইমপ্রুভ হয়নি। বাবার যে কি হবে? শুভ, তুমি এখানে এলে? রাজা আসেনি, ওদিকে যা শুনলাম। আর ভালো লাগছে না এসব, খুব অসহায় আর ক্লান্ত আমি। তোমার দাদা কে বলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইন্দ্র কে বাঁচিয়ে নিয়ে আসতে।’
আমি।’ কি করে আমরা জানবো বলুন তো স্যার কে ওরা কোথায় আটকে রেখেছে সেদিনের পর তো আর যোগাযোগ ই করনি কোনো।’
সেনগুপ্ত।’ শুভ, তোমরা একটু বাইরে গিয়ে কথা বলো। আর রূপনারায়ণ দা আমি একবার হাসপাতাল টা অবজার্ভ করতে চাই, আমার সন্দেহ কেউ এখানে ডাক্তার বা নার্স বা পেশেন্ট যা কিছুই হতে পারে ছদ্মবেশে লুকিয়ে আছে এখানে। তাই আমাদের ইমিডিয়েটলি অ্যাকশন নিতে হচ্ছে। কাকাবাবুর সাথে একজন ডাক্তার ছাড়া বাকি সবাইকে জায়গা খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি, একবার সবাইকে জেরা করা দরকার।’
সুনির্মল বাবু আর রাজাদাদা ঢুকে পড়লো সন্দীপ বাবুর কেবিনে। আসল ডাক্তারের মাথায় বন্দুক তাক করে বেডের দিকে তাকিয়ে দেখলো, বেডে যিনি শুয়ে আছেন উনি সন্দীপ বাবু নন, তারই বয়সী অন্য একজন পেশেন্ট।
তাহলে সন্দীপ বাবু কোথায়? এটাও কি শ্রীকৃষ্ণের লীলা?
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
অষ্টম পর্ব- যোগসূত্র
রাজাদাদার ধারণাই ঠিক হলো, সন্দীপ বাবুর হয়ত কিছুই হয়নি, ওনা কে কোথাও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যদি রায়চৌধুরী বাড়ির সম্পত্তি ই আসল লক্ষ্য হয় তাহলে উনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অপরাধীদের কাছে। সন্দীপ বাবুই পারেন উইল পাল্টে ফেলতে।
কিন্তু আমি যতটা ওনাকে চিনেছি আমার ধারণা, দাদু কে আর যাই হোক মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে কিছু করানো যাবে না। উনি বড্ড গোয়ার এবং নিজে যা ভালো বোঝেন সেটাই করেন, ঠিক যেমন পরিবারের অমতে রণজয় কে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন। তবে এখন ওনার বয়স হয়েছে, অনার প্রতিটা কথাই ছিল ধাঁধা র মত। উনি আগে থেকেই জানতেন যে ওনার সাথে কিছু একটা হতে চলছে, কিন্তু কিভাবে? তাহলে কি অপরাধী পরিবারের কেউ?
ইত্যাদি নানাবিধ চিন্তা রাজাদাদার মাথায় এলো। সেনগুপ্ত দা হসপিটালের সকলকে একে একে জেরা করতে শুরু করলো, এত বড় একটা হসপিটালে কি করে একটা মানুষ জাস্ট হওয়া হয়ে গেলো আর ঘটনা টা কবে হলো কেউ জানে না।
রাজাদাদা।’ ঠিক যেমন কৃষ্ণমূর্তি টা রাতারাতি পাল্টে গেলো। বুঝলি শুভ যা হচ্ছে আমাদের কাছের কেউই করছে, তাই ব্যাপার গুলো এত তারাতারি হচ্ছে। আর আমি যদি খুব ভুল না হই এই দুটো ঘটনাই কাল হয়েছে, যখন আমরা ব্যস্ত ছিলাম সুপ্রতীম কে উদ্ধার করতে। সেসময় কে কে বাড়িতে আর হসপিটালে ছিল এটা মনে করে বল দেখি!’
আমি।’ রাজসিংহ বাবু, শীর্ষেন্দু, অগ্নিস্বর বাবু ছিলেন বাড়িতে আর সুনির্মল বাবু ছিলেন হসপিটালে।’
‘ সন্দেহ টা কিন্তু সুনির্মল বাবুর দিকেই যাচ্ছে। হয়ত বাবা সম্পত্তি থেকে বিনা কারণে ওকে বঞ্চিত করেছে এটা ও মেনে নিতে পারছে না। যতই আয় থাকুক, পৈত্রিক ভিটে র উপর প্রতিটা মানুষই দখল পেতে চায়। কিন্তু আমরা এখন এতটা জড়িয়ে পড়েছি তাই ওকে বিশ্বাস করে চলতে হবে। তারপর দেখাই যাক না কি হয়।’
সুনির্মল বাবু এদিকে আসছেন দেখতে পেয়ে রাজাদাদা চুপ করে গেল।
‘ তো রাজাবাবু, কিছু ভাবলেন। প্রথমে আমার বন্ধু এখন বাবা, দুজন নিখোঁজ, কিছু তো একটা উপায় বলুন।’
‘ কৃষ্ণ! কৃষ্ণের খোঁজ করতে হবে।’
‘ মানে?’
‘ আপনার বাবা শুভ কে বলেছিলেন, একটা কৃষ্ণমূর্তি ও দিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত উনি সবটা আগে থেকে জানতেন, উনিই বলেছিলেন ‘আমরা বিপদে পড়লে সবার আগে ঠাকুরকেই দোষারোপ করি যে ঠাকুর কেনো তুমি আমার সবকিছু কেড়ে নিলে কিন্তু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কিন্তু ইনিই রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ায়।’ কৃষ্ণ কে বা কিসের ইঙ্গিত করছিলেন উনি এটা আমাদের জানতে হবে।’
কাছাকাছি ছিলেন সেনগুপ্ত দা, একথা শুনতে পেয়ে আমাদের দিকে এসে বললেন,
‘ কি বলছ? কৃষ্ণ? কৃষ্ণ তো এখন জেলে?’
‘ কে এই কৃষ্ণ?’
‘ আরে আমি কৃষ্ণকান্ত সরেন এর কথা বলছি। ও এখন লক আপে। গ্রামে যতরকম দু নম্বরী বেআইনি কাজ হয় সবকিছু ওর তদারকি তেই হত। কিন্তু এই যে সুনির্মল, ও আর আমি মিলে এমন প্ল্যান করলাম যে প্রমাণ সমেত ধরা পড়লো। ওর উপর যা কেস আছে এ জন্মে আর ছাড়া পাবে বলে তো মনে হয় না। তো তোমার কৃষ্ণের সাথে কি দরকার?’
‘ আমি জানি না কেনো কিন্তু যেহুতু নাম টা ওর কৃষ্ণ একবার ওর সাথে দেখা করতেই হবে। সেনগুপ্ত আমাকে এখনই একবার পুলিশ স্টেশন নিয়ে যেতে পারবে?’
‘ ঠিক আছে চলুন।’
থানা থেকে ফিরে এসে রাজাদাদার কাছ থেকে শুনে যা যা হয়েছিল সংক্ষেপে বলছি। কৃষ্ণকান্ত প্রথমে রাজাদাদার সাথে দেখা করতেই রাজি হননি, ওর বক্তব্য ছিল সেনগুপ্ত দা অন্যায়ভাবে চালাকি করে ওকে আরেস্ট করেছে আর নিজের কোনো লোকের সাথে করতেও দিচ্ছে না। সেনগুপ্ত দা পরে অবশ্য রাজাদাদা কে জানিয়েছিল ও ভুল কিছু বলেনি, আসলে এইসব বেআইনি করবার চালিয়ে বিশাল বড়োলোক ইনি।
গ্রামে রায়চৌধুরী বাড়ির পরেই যদি কোনো সৌখিন বাড়ি পাওয়া যায় তা কৃষ্ণকান্তের। কিন্তু ওর পরিবার এখানে থাকে না, ছেলে বিদেশে পড়ছে, মা কেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে। তাই বিষ্ণুপুরের এই বাড়িতে উনি এখন একা, দিব্যি কারবারের লোকেদের নিয়ে দিনরাত ওঠাবসা করছেন। সেনগুপ্ত দা কে মোটা টাকার অঙ্ক ঘুষ দিতে চেয়েছিলেন উনি, কিন্তু তার বদলে জুটেছে লাঠির বাড়ি।
‘ ওকে তুমি চেনো না রাজা, ডেঞ্জারাস লোক। ওকে এতদিন জেলে আটকে রাখতে পেরেছি এটাই ভাগ্যের ব্যাপার নইলে ও তো জেলে যায় একদিনের জন্য। তো তোমাকে কি বললো?’
‘ লোকটা একেবারেই সুবিধের নয়, আমাকে অবধি বাগে আনতে চেয়েছিল। আমিও সেই সুযোগ টা কাজে লাগিয়ে ওকে উল্টো বুঝিয়ে কিছু কথা বের করেছি। ও বলেছে ওকে এখানে আটকে রেখে কিচ্ছু করতে পারবে না। ওকে সবাই এই গ্রামে নাকি ভগবান মানে, ভগবান কৃষ্ণের আরেক রূপ।’
‘ এ কি কান্ড!(হেসে)গ্রামে তাহলে এখন দুটো কৃষ্ণ দুটোই জ্যান্ত, একটা নড়াচড়া করে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায় আর কথা বলে আর আরেকটা র মুখে কথার ফুলঝুরি কিন্তু জেলে এক জায়গায় বসে থাকে।’
‘ লোকটা কে আরো চার্জ করো, ও অনেককিছুই জানে। ও বলছে সন্দীপ বাবুর গাড়িতে ব্রেকফেল ওর নির্দেশেই ওর লোকজন ই করেছে। আর সবচেয়ে যেটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো আমার আরেকটা অনুমান মিলে যাচ্ছে।’
‘ কোন অনুমান?’
‘ তুমি রণজয় কে চেনো নিশ্চয়ই। আমার ধারণা
রায়চৌধুরী বাড়িতে থাবা বসাতে হলে এবারের নেক্সট টার্গেট হবে ও।’
‘ সে কি করে হয়? প্রায় পাঁচ বছর ধরে ওর কোনো খোঁজ নেই।’
‘ আমার ধারণা প্রতি বছর ই ও দোলে এখানে আসে এবং এবছরও এসেছে। কিন্তু কোথায় আছে সেটা কেউ জানে না, অবশ্যই ছদ্মবেশে আছে। কৃষ্ণের বক্তব্য এবারে নাকি রনজয়ের পালা, রণজয় কে ওরা তুলে নিয়ে যাবে।’
‘ ইন্দ্র দা, সন্দীপ কাকা আর এবার রণজয় কিন্তু কেনো?’
‘ এই কেনোর উত্তর খোঁজার আগে আমাদের রণজয়ের সাথে যোগাযোগ করতেই হবে। তুমি থানায় থাকো, দেখো ওর মুখ থেকে আরো কথা বের করতে পারো নাকি আমি বাড়ি যাচ্ছি সুনির্মলের থেকে রনজয়ের একটা ফটো যোগাড় করে বেরিয়ে পড়তে হবে।’
সুনির্মল বাবু ফটো তো দিলেন কিন্তু উনিও অবাক। গত পাঁচ বছরে নাকি রণজয় কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি।
‘ সুনির্মল,তোমাকে আবার অভিনয় করতে হবে।’
‘ আবার আমাকে? আচ্চা বলো’
‘ রণজয় এর গলা নকল করতে হবে।’
‘ অ্যা! তা কি করে?’
‘ হসপিটালে দেখলাম তো ডাক্তারের অভিনয় টা মন্দ করনি এবারও পারবে। রণর গার্লফ্রেন্ড অপর্ণা কে ফোন করতে হবে, ওর থেকে কথা বের করে বুঝতে হবে এই ক বছরে ওর সাথে রণোর কোনো যোগাযোগ হয়েছে কিনা!’
আমরা আগেই সেনগুপ্ত দার থেকে অপর্ণা সম্পর্কে সব টা জেনে নিয়েছিলাম। ও এখন চাকরি করে, শ্রীরামপুরে থাকে।সুনির্মল বাবু ফোন লাগালেন।
‘ হ্যালো, কি রে অপর্ণা চিনতে পারছিস আমি
রনজয় বলছি!’
‘ কে রণজয়?’
‘ আরে তোর রন্টু!’
‘ তুই রন্টু, তোর গলাটা এরকম শোনালো আর তাছাড়া তুই তো আমাকে কখনো অপর্ণা বলে ডাকিস না, তোর অপু ডাকটাই যে আমার খুব প্রিয়।’
রাজাদাদা ফিসফিস করে বলল,’ তার মানে ওদের মধ্যে যোগাযোগ আছে এবং রিসেন্ট কথা ও নিশ্চয়ই হয়েছে। এবার জিজ্ঞেস করো দোলে গ্রামে আসছে না?’
‘ তোকে খুব মিস করছি রে। একবার টি তোকে দেখতে চাই!’
সত্যিই আমারই হাসি পাচ্ছিল কাকা তার ভাস্তার প্রক্সি দিচ্ছে। তবে সুনির্মল বাবুর সাথে শুনেছি রনজয়ের বন্ডিং টা দারুন ছিল, ও ওর কাছে সব কথাই বলতো, বাবা কে প্রেমের ব্যাপারে না জানালেও কাকা কে সবটাই বলেছিল আর এটাকেই কাজে লাগিয়ে একটু রিস্ক নিয়েও রাজাদাদা ফোন টা করিয়েছে।
‘ বাড়ির থেকে যা কান্ড শুনলাম, ভালো হয়েছে যেতে পারিনি এবার গ্রামে। আচ্ছা ইন্দ্র কাকা কে শুনলাম কেউ অপহরণ করেছে, কথাটা কি সত্যিই?’
‘ হ্যাঁ রে, যা ঘটছে একের পর এক।’
‘ ইন্দ্রকাকা তোকে মানুষ করেছে। ও না থাকলে তুই কলেজের পড়া শেষ করতেই পারতিস না, এবার তোর দায়িত্ব ওকে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার, ওকে খুঁজে বের কর।’
রাজাদাদা।’ এবার তাহলে দুয়ে দুয়ে চার করা যাচ্ছে। এই কারণেই তাহলে ইন্দ্র স্যার কে তুলে নিয়ে যাওয়া, তবে এত সহজে অপর্ণা র মুখ দিয়ে এই কথাটা বেরিয়ে আসবে আশা করেনি, তুমি তো কামাল করে দিচ্ছ হ হে সুনির্মল। তাহলে এবার জিজ্ঞেস করে ফেলো তো কি করে তোমাদের অভিমান মিটলো।’
‘ হ্যাঁ রে নিশ্চয়ই, উনি না থাকলে আমাদের আবার সব ভুল বোঝাবুঝি মিটত কি করে। তোর মনে আছে সেই দিনটা ওই ঘটনার পরে যখন প্রথমবার আমাদের দেখা হয়েছিল।’
‘ সেটা কি আর ভুলতে পারি। প্রায় দু বছর পর হঠাৎ একদিন তুই আমাকে কল করে বললি দেখা করবি, আমার সাহস হচ্ছিল ও না তোর সামনে যেতে তাও দেখা করলাম আর তুই সমস্ত রাগ টা আমার উপর ঝারলি, কেনো আমি এভাবে তোর সাথে বিট্রে করলাম। তোর..’
‘ আমি কিন্তু এখনও তোর কথা বিশ্বাস করি না..’
‘ তুই এখনও ভাবিস ওসব আমি নিজের ইচ্ছে করেছি? না রে সত্যিই তোর বড় কাকা আমাকে বাধ্য করেছিল।’
তার মানে রনজয় কে ও বাড়িছাড়া করেছে রাজসিংহ বাবু। তাহলে সবকিছুর মুলে এই রাজসিংহ বাবুই, ওনা কে ধরলেই সন্দীপ বাবু, ইন্দ্র স্যার দুজনকেই উদ্ধার করা যাবে। অপর্ণার থেকে আরো যতটুকু ইনফরমেশন নেওয়া সম্ভব ছিল নেওয়া হলো, তারপর সুনির্মল বাবু নিজের পরিচয় দিয়েই দিলেন, কারণ আরেকটু পরেই অপর্ণা বুঝতে পেরেছিল গলাটা রন্টু র নয়।এরপরই সুনির্মল বাবু আর রাজাদাদা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো রাজসিংহ বাবুর ঘরের দিকে, আজ একটা হেস্তনেস্ত হবেই।
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
নবম পর্ব- রেসকিউ মিশন ২
রাজসিংহ বাবুকে চেপে ধরা হলো। উনি যথারীতি সমস্ত ব্যাপার টা এড়িয়ে গেলেন এর একটাতেও সম্মতি জানালেন না।
‘ অপর্ণার যদি আজ মুখ খোলে, আপনার কি হবে ভাবতে পারছেন রাজসিংহ। আপনি আমাদের অনেক মিথ্যে কথা বলে ঘোল খাইয়েছেন, এবার আপনার খেলা শেষ।’
‘ অপর্না মুখ খুললে সেদিনই খুলতে পারতো, সেদিন যখন কিছু বলেনি আজ হঠাৎ কেনো কিছু বলতে যাবে বলুন ত? আর তাছাড়া আমার ভাইপো টির যে চরিত্রের দোষ আছে সেটা তো..’
সুনির্মল।’ মুখ সামলে দাদা। আজ শুধুমাত্র তোমার জন্য রণ বাড়ির বাইরে। এত বছর পর সব সত্যিটা জেনে গেছি যখন তোমার মুখোশ টা সবার সামনে খুলে দেবো।’
অগ্নিস্বর।’ আপনারা এত উত্তেজিত হবেন না।জামাইবাবু, সত্যিটা বলে দিন, আপনিই কি কাজ টা করেছেন বলে দিন। দেখুন এমনিতেও আপনাকে এবাড়ির লোক বা গ্রামের লোক কেউই পছন্দ করে না, এই সত্যিটা বলে দিলে ছেলেটা কে তো খুঁজে বের করে ঘরে ফেরানো যেতে পারে।’
‘ সেটাই অগ্নি, এবাড়িতে আমার আর সম্মান কোথায়? কিন্তু রাজাবাবু, আমার চ্যালেঞ্জ রইলো আপনি প্রমাণ করতে পারলে পরুন যে আমি অপর্ণা কে চাপ দিয়ে রনর বদনাম করিয়েছি।’
‘ সেটা তো হয়ে যাবেন, কিন্তু এর থেকেও ঘৃণ্য কাজ করেছেন আপনি। নিজের বাবা কে অপহরণ করেছেন আপনি, স্যার কে আটকে রেখেছেন।’
‘ আপনি মোটেও ভালো গোয়েন্দা নন, রাজাবাবু। এত সহজে আমাকে সব কিছুর জন্য দোষী করে দিলেন। আসলে আমার ইমেজ টা ই এমন হয়ে গেছে, শুনুন রাজাবাবু যে কাজ আমি করেনি তার দায় আমি নেবো না, আমিও চাই বাবা কে ফিরে পেতে। বাবা কে বলে উইল পাল্টে ফেলতে। আপনি যেভাবে বলবেন আমি সাহায্য করতে রাজি আছি।’
‘ বেশ তাহলে শুনুন, আগেরদিন যে নম্বর থেকে এই বাড়িতে ফোন করে বিকেল পাঁচটার মধ্যে দেখা করার কথা বলেছিল ওরা সেই নম্বর টা আমি আপনার মোবাইল থেকে ডায়েল করবো, এবং তা এক্ষুনি, আপনি কথা বলবেন!’
রাজসিংহ বাবু বাধা দিলেন না। ডায়েল করতেই দেখা গেলো নম্বর টা কৃষ্ণ নামে সেভ করা।ফোন টা অল্প রিং হয়েই কেটে গেলো, আবার করা হলো।
‘ কি মশাই ফোন করে বিরক্ত করছেন কেন?’
রাজাদাদার কথা মত,’ বাবা আর ইন্দ্র কেমন আছে?’
‘ সেসব নিয়ে চিন্তা করবেন না, টাকা টা সময় মতো পেয়ে গেলেই হবে গুরু।’
‘ ঠিক আছে, আজ আমি একবার যাব। লোকেশন টা একবার পাঠা।’
‘ কি বলছো, তুমি রাজ দা ই তো, আমার বাড়ি চিনতে পারবে না!’
‘ আরে ওদের কোথায় আটকে রাখবেন সেটা কি আমাকে আগে জানিয়ে রেখেছিস নাকি!’
‘ জানানোর তো কথা, ও না জানালে এখন জেনে নাও। বাড়িতে ঢুকে একবার কল করো, নইলে তোমার সাধ্যি নেই,; কোথায় আছি খুঁজে বের করার। পুলিশ তো কতবার বাড়ি ঘুরে গেল।’
‘ ঠিক আছে শোন, আমি আর এক ঘণ্টার মধ্যেই আসছি।’
ফোনটা রাখলো রাজসিংহ বাবু।
রাজাদাদা।’ সহযোগিতা করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। কৃষ্ণ কে এবার তো বলুন।’
‘ আমি কিছু জানি না। এটা কৃষ্ণের নম্বর এটুকুই আমি জানি আর ওর সাথে আমি তুই তোকারি করেই কথা বলি, একই গ্রামে একসাথে বড়ো হয়েছি। কিন্তু আমি এটাও জানি ছোটন আর সেনগুপ্ত মিলে ওকে ধরে জেলে পুড়েছে। তাই ওর পক্ষে একাজ গুলো করা সম্ভব নয়, এবার আমি কার সাথে কথা বললাম সত্যিই জানি না!’
অগ্নিস্বর।’ আপনি কি মজা করছেন? লোকটা আপনাকে গুরু বললো, টাকা টা পেয়ে গেলেই সব সামলে নেবে বললো আর আপনি এখনো বলছেন কিছু করেননি।’
‘ না আমি সত্যিই কিছু জানিনা, জেলে যে আছে হয় সে কৃষ্ণকান্ত আর বাইরে যে আছে সে অন্য কেউ নয়ত এর উল্টোটা।’
রাজাদাদা।’ ধন্যবাদ বাকিটা আমরা বের করে নেবো। কিন্তু সব প্রমাণ এর খাতিরে আপনাকে অ্যারেস্ট করা হচ্ছে, সেনগুপ্ত এখনই চলে আসবে। আচ্ছা এবার সবাইকে বলছি বাড়ির সবাইকে জানিয়ে দেবেন, রাজসিংহ বাবু কে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে কিন্তু বাড়ি ছেড়ে কেউ বের হতে পারবেন। পুলিশ পুরো বাড়ি টা কে ঘিরে ফেলবে। ইন্দ্র স্যার আর সন্দীপ বাবুর নিরাপত্তার জন্য আমাকে এটুকু করতেই হচ্ছে।
কৃষ্ণকান্তের বাড়ি চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হলো। সেনগুপ্ত দা পুরো ফোর্স নিয়ে চলে এসেছেন। এদিকে একের পর এক টানটান কান্ড ঘটছে যে ওদিকে সুপ্রতীম কে ফোন করে ওদিকের কি হাল যে জানবো সে উপায় নেই। সেই যে কৃষ্ণমূর্তি হেঁটে কোথায় চলে গেলো কে জানে! কেসটা র এত তাড়াতাড়ি সুরাহা হয়ে যাবে ভাবিনি, এবার শুধু মঙ্গলমত স্যার আর দাদু কে উদ্ধার করতে পারলেই হয়।
রাজাদাদা।’ সবাই তৈরি তো? এতবড় বাড়ি, কোথায় কৃষ্ণ স্যার কে আটকে রেখেছে আমরা কিছুই জানি না, তাই প্রতিটা কাজ খুব বুদ্ধি করে করতে হবে। একবার ধরা পড়ে গেলেই কিন্তু ওনাদের ক্ষতি হতে পারে। যেসব পুলিশ বাড়ির চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে তাদের আগেই বলে দিয়েছি লুকিয়ে থাকতে আমার ইশারা না পাওয়া পর্যন্ত ওরা আসবে না, সো আমি আর সেনগুপ্ত ঢুকবো। অনন্ত তুমি শুভ এর সাথে থাকবে ঠিক দরজার বাইরে।’
রাজাদাদা রাজসিংহ বাবুর মোবাইল থেকে কল করলো।
‘ হ্যালো মিস্টার রাজেন্দ্র রায় ওরফে রাজা দাদা। কেমন আছেন? চিনতে পারছেন আমাকে?’
‘ ও আপনি! শুভ দ্বিপ্রহর, আমি কি আপনার বাড়িতে ঢুকতে পারি?’
‘ আরে এ কি সৌভাগ্য আপনার আপনি এই অধমের বাড়িতে আসবেন। রাজ দা কে অ্যারেস্ট করিয়ে কাজ টা মোটেই ঠিক করেননি, তা বেশ আপনার প্ল্যান দেখে ভালো লাগলো। আমার বাড়ির চারদিক টা সুন্দর করে সাজিয়েছেন পুলিশ দিয়ে, কোথায় আজ রং খেলবো তা না চোর পুলিশ খেলছি।’
‘ রং খেলা নিশ্চয়ই হবে। আগে এই খেলায় জিতুন।’
‘ হা হা.. হাসালেন। আপনি বুদ্ধিমান আছেন আপনার দুটো গুটি যে এখনও ঘর থেকেই বের হয়নি, কি নিয়ে খেলবেন আপনি? যেখানে আমি প্রায় টার্গেট এর একদম কাছাকাছি।’
‘ পুটের জন্যও কিনতু অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আর সেই সুযোগে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দুটো গুটি জিতে যেতে ও পারে, মিস্টার কৃষ্ণ।’
‘ ওটা তো rare কেস। সে যাইহোক, রং খেলবেন বলছিলেন, আগে শ্রী কৃষ্ণের পায়ে রং ছোয়ান। প্রাণহীন কৃষ্ণ তো পালিয়ে গেলো, আমিই আচি জীবন্ত কৃষ্ণ আমার পায়ে রং ছুঁইয়ে ই নাহয় এবারের দোল টা শুরু হোক। কি বলেন রাজা দাদা (সেই ক্রুর হাসিটা হাসতে লাগলেন)?’
‘ রং খেলা ত হবেই, আর আজই হবে। আপনার পালানোর কোনো পথ নেই, আপনি তৈরি থাকুন আমি ঢুকছি ঘরে।’
অতি সাবধানে রিভলভার হাতে নিয়ে রাজা দাদা ও সেনগুপ্ত দা পা ফেলতে লাগলো। একতলা পুরো ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই। আরো কয়েকজন পুলিশ কে নিয়ে আমরাও ঢুকে পড়লাম। পুরো উপরতলা ঘুরে কোথাও কিছু না পেয়ে যখন আমরা ফিরে আসবো তখনই সেনগুপ্ত দা একটা সুড়ঙ্গের মত কিছু আবিস্কার করলো।
ড্রয়িং রুমের সোফা সরাতেই একটা আংটার মত কিছু একটা উঠে আছে দেখা গেল সেটা তে হাত দিতেই বোঝা গেলো এটা আর কিছু নয় একটা কাঠের পাটাতন সুন্দর করে পাতা রয়েছে কোনো কিছুকে ঢেকে রাখতে। ওটা তুলতেই একটা ঘরের মতো জায়গা পাওয়া গেলো, আমরা নিচে নামতেই দেখি ইন্দ্রস্যার আর সন্দীপবাবুর হাত আর মুখ বেঁধে চেয়ার এ বসিয়ে রেখেছে। আমরা ওনাদের ত খুঁজে পেলাম, কিন্তু কৃষ্ণের দর্শন পেলাম না।
জীবন্ত কৃষ্ণ কোথায় যখন ভাবছি, তখনই পাওয়ার কাট হয়ে গেলো। সবাই যেনো অন্ধকূপে আটকে গেছি, তাহলে কৃষ্ণ কি ফিরে এলো?
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
দশম পর্ব- পুনর্মিলন
অবশেষে ইন্দ্রস্যার আর সন্দীপ বাবু কে সুস্থ অবস্থায় বের করে নিয়ে আসা হলো। পাওয়ার কাট হয়ে যাওয়ায় আমরা সাময়িক বিপদে পড়লেও এতজন পুলিশ ফোর্স এসেছিল, ওদের সাহায্য নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলাম। একজন পুলিশ জানালো ওর ধারণা এই পাওয়ার কাট টা করানো হয়েছিল আমাদের সাময়িক বিভ্রান্ত করতে আর সেই সুযোগে কৃষ্ণ পালিয়ে গেছে এই বাড়ি থেকে। কিন্তু বাইরেও ত কম পুলিশ নেই, কেউ দেখলো না কৃষ্ণ কে। কৃষ্ণ কি হওয়ায় মিলিয়ে গেল? আমরা বেরিয়ে এলাম।
রাজাদাদা।’ স্যার আপনারা কেমন আছেন? ওরা কোনরকম ..’
ইন্দ্রস্যার।’ আরে না না, ওরা আমাদের সাথে কিছুই করেনি। শুধু এই বদ্ধ ঘরে থাকতে হত তাই যা একটু কষ্ট হত, দিনরাত খাবার দিত, আবার সাধারণ খাবার না এলাহী খাবার।’
সন্দীপবাবু।’ হয়েছে তোকে আর ওদের প্রশংসা করতে হবে না ইন্দ্র। তোর শুধু ওটাই মনে আছে কিন্তু আমাকে দিয়ে নতুন উইল লেখানোর জন্য কি অত্যাচার করেছে সেটা তো তুই বলবি না।’
‘ তোমার গায়ে ত হাত লাগায় নি, আমরা সুস্থ আছি কিনা সেটাই রাজা জানতে চেয়েছে।’
‘ তুই আর পাল্টালি না, আগে নীলুর (সুনির্মল বাবুর নাম বোধহয়) থেকে কলেজে তুই কি করতিস তার গল্প শুনেছি, তারপর তুই ত এখনই আসতিস প্রায়ই তখনও দেখেছি। তোর অন্যের হয়ে কথা বলার স্বভাব টা গেলো না।’
আমি।’ এটাতে কিন্তু আমিও সম্মতি জানাচ্ছি, স্যার আমাদের বরাবর ই ভালো। তবে এটা ঠিক উনি ভালোর ভালো, কিন্তু খারাপের যম। খারাপ লোকের সাথে কিন্তু উনি..’
রাজাদাদা।’ সন্দীপবাবু ওনারা তো উইল লেখাতে পারেনি কিন্তু কখনো কোনো সই নিয়েছে আপনার থেকে?’
‘ হ্যাঁ রাজা, আমি পারিনি ওদের কে সই নেওয়া থেকে আটকাতে। আসলে আমি উইল করাতে একদম রাজি হচ্ছিলাম না বলে ওরা ঠিক করেছিল আপাতত ব্লাঙ্ক পেপার এ আমার সই করিয়ে নিয়ে নেবে, কিন্তু আমি তাতেও রাজি হইনি, তখন ওরা ইন্দ্র কে মেরে ফেলার হুমকি দিল তো বাধ্য হয়ে..’
‘ কিন্তু এভাবে ব্লাঙ্ক পেপারে সই নিলে হবে না, আই উইটনেস ও লাগবে। ইন্দ্রস্যার আপনার ও সই নিয়েছে নিশ্চয়ই?’
স্যার।’ হ্যাঁ ওই কাগজেই করতে হয়েছে।’
‘ আমি যতদূর জানি দুজন আই উইটনেস লাগে আর উকিল এর ব্যাবস্থা নিশ্চয়ই ওরা করে নিয়েছে। রাইট, উকিল, উকিল। সেনগুপ্ত, এই গ্রামে এটলিস্ট এই এলাকার যত উকিল আছে এখনই তাদের খোঁজ নাও। কৃষ্ণকান্ত সরেন এর জামিনের জন্য যে উকিল এসেছিল তাকে একবার জেরা করা দরকার। কুইক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা করো। কেস টা তো এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে, এই জীবন্ত কৃষ্ণ আর মূর্তি কৃষ্ণের যোগসূত্র খুঁজে বের করতে হবেই।’
সন্দীপ বাবু।’ আমি এখন বাড়ি ফিরতে চাই, আমার কৃষ্ণের পূজা হলো না এবার আমারই জন্য।’
‘ আপনি হয়তো এখনো সবটা জানেন না বাড়িতে কি কান্ড হয়েছে যাইহোক আপনার জন্য আর হ্যাঁ অবশ্যই স্যারের জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।’
আমি জানতে চাইলাম কি সারপ্রাইজ রাজাদাদা অনন্ত কে নিয়ে এলো আমাদের সামনে।
‘ কি সন্দীপ বাবু চিনতে পারছেন আপনার নাতি রণজয়, আপনার রন্টু কে চিনতে? অবশ্য আপনার সাথে যদি প্রতি বছর দুবার ওর দেখা হয়ে থাকে তাহলে তো চেনা টাই স্বাভাবিক।’
আমি।’ কি বলছো এসব, অনন্ত দা ই রণজয়?’
সন্দীপ বাবু।’ কি রে দাদুভাই কেমন আছিস? তোর সাথে দেখাই হলো না, তার আগেই আমাকে চলে আসতে হলো রে।’
স্যার।’ তুই এখানে এসে আমার সাথে যোগাযোগ করবি তো?’
রাজাদাদা।’ ওকে বকবেন না, ও তো আপনার সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছিল কিন্তু আমিই ত আপনার আর ওর মাঝে চলে এলাম। প্রথমদিনের ঘটনা মনে আছে, বাইকে চেপে ও এসেছিল আমাদের ধাক্কা মারতে নয়, আপনার কাছাকাছি এসে আপনাকে একটা চিরকুট দিতে, তবে হ্যাঁ ও যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেছিল যে চিঠির শুরু তে ‘ প্রিয়তমা’ লিখে সম্বোধন করেছি যাতে বেহাত হলেও সেটা নিতান্ত প্রেমিকাকে লেখা চিঠি বলে মনে হয়। এবার দূর থেকে এত স্পীডে ও আসছিল যে আপনার কিছু হতে পারে ভেবে আপনাকে ঠেলে দিয়ে আমি মাঝ রাস্তায় চলে আসলাম, আর চিরকুট টা আমার হাতে চলে এলো।’
রনজয়।’ আপনি কি করে বুঝে উঠলেন আমি ই রণোজয়, শুধু ঐ চিঠিটা থেকেই?’
‘ না তা একেবারেই নেই। আসলে দেখো প্রথমদিন থেকেই যা যা ঘটছিল আমার প্রথম থেকে সন্দেহ হচ্ছিল কেউ একজন ইন্দ্র স্যারের ক্ষতি চায়। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ইন্দ্রস্যারের সাথে কারো একটা শত্রুতা আছে, এবার রাজসিংহ বাবুর একটা কথা আমার খুব কানে লেগেছিল, উনি শীর্ষেন্দু কে বলেছিলেন,’তোকে কি ভোলা যায় ভাই? সেবারে ওই কটা দিন তুই আমাদের সবাইকে নিয়ে যেভাবে গোটা বাড়ি মাতিয়ে রেখেছিলি,মিলিয়ে নিস এবারে তোকে সবটা ফিরিয়ে নেবো।
বাবুই ওকে প্রণাম করো, উনি তোমার কাকার বন্ধু, অনেক কিছু শেখার আছে ওনার থেকে।’কথাটা কেমন যেন ব্যঙ্গাত্মক শোনাচ্ছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল রাজসিংহ বাবুর সাথে ইন্দ্র স্যারের কোনো বিবাদ থাকলেও থাকতে পারে। তারপর রূপনারায়ণ বাবুর থেকে তোমার কথা যেদিন জানলাম, সেদিন একটা সন্দেহ হয়েছিল যে স্যার তোমাকে লুকিয়ে রাখেনি তো? সেদিন তোমার বান্ধবীর কাছ থেকে ব্যাপার টা জানতে পারলাম।’
‘ হ্যাঁ সেদিন যখন বাবা আমাকে তাড়িয়ে দেয়, তখন ছোটকা ইন্দ্র কাকা কে বলে আমাকে কলকাতায় পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে। তো প্রথম কমাস গ্রামেই থাকতে হয়, দাদু গোপনে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, কিন্তু ও বাড়ির কেউ সকলের সামনে আমার সাথে যোগাযোগ রাখেনি, আসলে রায়চৌধুরী বাড়ির মান সম্মান একটা বড় ব্যাপার। উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েই আমি কলকাতা চলে আসি, দাদু টাকা পাঠাতেন, কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যাপার টা জানাজানি হয়ে যায়। বড়কাকা আমাকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেন, তখন দাদু বাড়ির অর্ধেক সম্পত্তি আমার নামে লিখে দেন আর ইন্দ্র কাকা ই আমার কলকাতার খরচা চালিয়ে আমাকে পড়িয়েছেন। আজ যতটা আমি সবটাই ওনার জন্য। আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।’
‘ তোমরা আমাকে কেন ভরসা করলে না? তোমার পরিচয় আমার থেকে গোপন করলে? সুনির্মল, সেনগুপ্ত সবাই জানতো তুমি রনজয়। আমাকে বিভ্রান্ত করার জন্য সুনির্মল বাবু তোমার জায়গায় অন্য একটা ছেলের ছবি দেখিয়েছে আমাকে। তোমার রিসেন্ট কোনো ছবি পেলে তোমাকে খুঁজে পেতে সুবিধে হবে ভেবেই আমি বৌদি কে মানে স্যারের স্ত্রী কে ফোন করি। আমার আইডিয়া কাজে লেগে যায়, বৌদি রন্টু কে চেনে আর ওর ছবি ও ওনার কাছে আছে। উনি আমাকে পাঠিয়ে দেয়, ব্যস্ ওই ছবিতে নকল দাড়ি গোঁফ আর কোকরানো পরচুলা লাগালেই যে অনন্তের মত দেখতে লাগবে সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে গোয়েন্দা হওয়ার দরকার পড়ে না।’
সন্দীপ বাবু।’ ধন্য ধন্য তুমি রাজা। অপরাধী ধরা পড়েছে?’
সেনগুপ্ত।’ হ্যাঁ কাকা, রাজ দা কে আমরা অ্যারেস্ট করেছি।’
সন্দীপ বাবু।’ তাহলে এতকিছু র পেছনে আমার ছেলে রাজ? রাজ অপদার্থ হতে পারে, ও খুব হিংসাপরায়ন কিন্তু ও খুব ভালো ছবি আঁকে। একজন প্রকৃত শিল্পী ও, তুমি কি নিশ্চিত রাজা, ওই অপরাধী?’
রাজাদাদা।’ না, নিশ্চিত নই, সবটাই অনুমান। আসলে কৃষ্ণ নিয়ে একটা গোলমাল হয়েছে সেটা একবার ক্র্যাক করতে পারলেই, এদিকে কৃষ্ণকান্ত জেলে, অন্যদিকে কৃষ্ণমূর্তি হেঁটে চলছে, আপনাদের যে বাড়িতে আটকে রেখেছিল সে ও কৃষ্ণ, আপনি আবার শুভ কে কৃষ্ণমূর্তি উপহার দিয়েছেন।’
সন্দীপ বাবু।’ তুমি বিচক্ষণ মানুষ, এই লাস্ট ধাঁধা। এটার সমাধান তোমাকেই করতে হবে। দেখি তুমি ঠিক বিচার করতে পারো কিনা?’
‘ আপনি চিন্তা করবেন না, কেউ বিনা অপরাধে শাস্তি পাবে না। শুভ, একবার সুপ্রতিম কে ফোন কর এক্ষুনি।’
সুপ্রতিম কে ফোন পাওয়া গেলো না, নম্বর টা নট রিচেবল বলছে। বাসবদত্তার ফোন এও একই ব্যাপার। তাহলে ওরা কোথায় গেল? ওদের কোনো বিপদ হলো না তো?
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
একাদশ পর্ব- অন্তিম প্রস্তুতি
আমরা সকলে রায়চৌধুরী বাড়িতে ফিরে এলেন। এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত লাগছে, শুধু রীনা কাকিমা কে দেখে খারাপ লাগছিল। শীর্ষেন্দু তো খুব রেগে আছে রাজাদাদার উপর আর রেগে গেলে ও যা খুশি করতে পারে, ওর নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না। রাজাদাদা কে হুমকি দিয়েছে আজ রাতের মধ্যে যদি ওর বাবা কে লক আপ থেকে না ছাড়িয়ে আনা হয় ও রাজাদাদা কে খুন করে দেবে। শীর্ষেন্দুর হুমকি আর এখন কেউ ধর্তব্যের মধ্যে ফেলছে না কারণ অন্য একটা চিন্তা করার বিষয় এসেছে।
এতজন গ্রামবাসী কোথায় গেলো সেই কৃষ্ণমূর্তি র সাথে। রূপনারায়ণ বাবু এবার উদ্যোগ নিলেন,
‘ এভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবে না, আমাদের বাড়ি থেকেই মূর্তি টা বেরিয়ে গেছে। ওই মূর্তির থেকে যদি কোনরকম বিপদ হওয়ার চান্স থাকে সেটার দায় আমাদের ই। তাই আর বসে থাকলে চলবে না, এখনই বেরিয়ে পড়তে হবে।’
সুনির্মল।’ হ্যাঁ দাদা, চলো বেরিয়ে পরি।’
‘ ঠিক আছে তুই সেনগুপ্ত কে নিয়ে একদিকে যাবি, আমি আর অগ্নিস্বর আরেকদিকে। রাজা আর শুভ তোমরা এখানে কিছুই চেনো না তাই আমি চাইবো তোমরা বাড়িতেই থেকো। রন্টু বাড়ির সবার খেয়াল রাখবি।’
রাজাদাদা।’ আমরা বাড়িতেই আছি, আপনারা আগে খোঁজ করুন কোথায় আছে ওরা। খবর দিলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো।’
একঘন্টা কেটে গেলো। এই তো সুপ্রতিম এর ফোন এসেছে।
‘ হ্যালো হ্যালো, শুভ’
‘ হ্যাঁ রে বল, তোরা কোথায়?’
‘ রাজাদাদা কোথায়? আমি জানি না জায়গা টা কোথায়, আমার ধারণা এটা শিরোমনিপুর।’
‘ আরে আমরা এখানে কিছু চিনি নাকি? ফোন টা লাউডস্পিকারে দিয়েছি, বল কি বলবি?’
রাজাদাদা।’ বল তোরা ঠিক আছিস ত?’
‘ না রাজাদাদা, আমাদের আলাদা করে দিয়েছে। শিরমনিপুর এর গ্রামের লোকজন ব্যাপার টা কে অন্য ভাবে নিয়েছে, ঠিক ওই ‘ দেবতার জন্ম’ এর মত। ওখানেই মদনমোহন মন্দিরের এক পুরোহিত এর বাড়ি, উনি বিধান দিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ রুষ্ট হয়েছেন, তাই সেই মূর্তি থেকে বের হওয়া আওয়াজ মানে কথা মত অবিবাহিত মেয়েদের একজায়গায় জড়ো হয়ে পুজো দিতে হবে। মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে আরো কিসব।’
‘ বিনয়কাকা কি এসব মেনে নিচ্ছে?’
‘ রাজা দা, ওখানে কি ভিড় হয়েছে জানো না, বিনয় কাকা কে আর দেখতেই পারিনি। আমি বাসবদত্তা কে নিয়ে তখনই কেটে পরব ভেবেছিলাম, কিন্তু জেদ ধরলো ও থেকে যাবে। ওই কয়েকজন পুরোহিত জড়ো হয়ে সব অবিবাহিত তরুণীদের আলাদা লাইন করালো, সবাইকে মোবাইল জমা করতেও বলেছে।’
‘ সবটা শুনে তো মনে হচ্ছে ওরা ওই মেয়েদের ক্ষতি করার কোনো প্ল্যান করেছে।’
‘ আমি তো সে কারণেই বাসব কে ছাড়তে চাইনি, ও বললো মোবাইল লুকিয়ে রাখবে, কোনো বিপদ হলেই আমাদের জানাবে। ওর নাকি ওখানে থাকা টা দরকার। ওই মূর্তিটা কোথাও এতক্ষন দাড়ালো না সেই শিরোমণিপুরে এসেই দাঁড়াতে হলো। আমি জানি না কি হবে, নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না এতক্ষন। আমি ফিরছিলাম বিষ্ণুপুরের দিকে, এই নেটওয়ার্ক আসতেই তোমাদের কল করেছি, বলো এখন কি করবো?’
‘ ওরা কোথায় পুজো টা করবে জানিস কিছু?’
‘ না ওরা তো বলছিল কৃষ্ণ যেখানে থেমে মত জানাবেন সেখানেই।’
‘পুরো ব্যাপার টা আমার কাছে নারী পাচারের কোনো পরিকল্পনা বলে মনে হচ্ছে।এবার বিষ্ণুপুর থেকে এতজন কে নিয়ে বাইরে যাওয়া টা, হুম, হয় মেদিনীপুর নয় বাঁকুড়া, শুভ গুগল এ শিরোমণিপুর লোকেশন টা দেখা তো।’
রাজাদাদা ম্যাপের চারপাশ টা দেখে বললো,
‘ ওরা জঙ্গলমহল এর দিকেই যাচ্ছে। খুব রিসেন্ট একটা খবর গেছিল এই সব দুষ্কর্মের, আমার পুরোটা জানা নেই। শোন সুপ্রতিম তুই ফিরে আসিস না , আমাদের জঙ্গলমহল এর দিকে যেতে হবে।’
ফোন টা রেখে দিলাম।
‘আমরা যাবো জঙ্গলমহল কিন্তু এভাবে না’
‘ মানে? কি বলছো রাজাদাদা?’
‘ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই আমাদের বাঁচাবে। আমাদের ও কৃষ্ণ সাজতে হবে। শোন মোড়ের মাথায় যে দোকান টা রং সাজিয়ে বসেছে আমি দেখেছি কৃষ্ণের মুখোশ পাওয়া যাবে। পাঁচটা কিনে নিয়ে আয়। আমরা একা যাব না, শীর্ষেন্দু আর রন্টু কেও নিয়ে যাব।’
‘ কিন্তু তাহলে এই বাড়ি তে একজন কেউ..’
‘ চিন্তা করিস না, এদিকে আর কোনো বিপদ নেই। আর রূপনারায়ণ বাবু র বহাল করা দুজন কনস্টেবল তো আছেন। একবার যদি ওরা জঙ্গলমহলে আমি যেই গ্যাং এর কথা ভাবছি ওদের হাতে যদি চলে যায়…’
‘ কেনো ওরা খুব কি ডেঞ্জারাস? একটা সময় শুনতাম ওখানে মাওবাদী দের অ্যাটাক হত কিন্তু এখন তো ওসব হয় না শুনেছি।’
‘ যেই গ্যাং টার কথা বলেছি ওদের কে পুলিশেরা অবধি ভয় পায়। আর তাছাড়া কয়েকজন পুলিশ কে তো টাকা খাইয়ে রেখেছে ই তাই যদি ভালো কেউ ওদের ঘাঁটি তে হানা দেয় সে আর বেঁচে ফিরে আসে না। এতক্ষন যা ছিল তা শুধুমাত্র পারিবারিক প্রতিহিংসা, সম্পত্তির লোভে সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন! ওটা একটা আন্তর্জাতিক পাচার চক্র। সেনগুপ্ত রা শীঘ্রই পৌঁছে যাবে বলেছে, আমাদের ও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেতে হবে।’
আমরা রাস্তায় গাড়িতে সুপ্রতিম কে তুলে নিলাম। হঠাৎ ই বাসবদত্তার মেসেজ এলো,
‘ হ্যালো, শোন দুজন কৃষ্ণ সেজে এসেছে। ওদের মধ্যে কি একটা ঝামেলা হয়েছে, আসার পর তো দুজনেই ভগবানের দূত বলে নিজেদের পরিচয় দিল আর একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো। কিছু একটা কলহ হচ্ছে ওদের মধ্যে, এই সুযোগে ভয়েস করছি, লোকেশন টা দেখে নে।’
রাজাদাদা।’ আমাকে মোবাইল টা দে, ওকে মেসেজ করে জানিয়ে দিচ্ছি, আমাদের প্ল্যান টা।’
সুপ্রতিম।’ আরে তুমি বলো না আমি লিখে দিচ্ছি, মোবাইল টা না নিলেই নয়, আসলে বুঝতেই পারছ একটু পার্সোনাল।’
‘ এটা এসবের উপযুক্ত সময় নয়। দে আমাকে..’
রাজাদাদা লিখছিল, শীর্ষেন্দু মোবাইল টা কেড়ে নিল।
‘ আমাদের কে কেনো বলছো না তোমার প্ল্যান কি? আমার বাবা কে জেলে ঢুকিয়েছ, এবার আমার পরিবারের আর কাকে জেলে ঢোকাবে তুমি? তোমাদের টাইম মত পৌঁছতে দেবো না আমি, নাটু দা(ড্রাইভার) গাড়ি থামাও।’
‘ বেশি পাকামো করতে এসো না, তোমার ভুলের জন্য কত বড় বিপদে মধ্যে কতগুলো মানুষ পড়তে পারো জানো! গাড়ি যেনো না থামে নাটু।’
‘ ইউ ফা..’
কথা আর শেষ হলো না, রাজাদাদার একটা চড়ে কাহিল হয়ে পরল শীর্ষেন্দু, ওর হাত দুটো বেঁধে রেখে দিল।সবটা এত কম সময়ের মধ্যে হল যে ড্রাইভার ভয় পেয়ে গাড়ি না থামিয়ে চালাতে লাগলো।
আমরা পৌঁছে গেছি বাসবদত্তার লোকেশন এ। কিন্তু কোথায় কেউ ত নেই এখানে, ওর মোবাইলের শেয়ার করা লাইভ লোকেশন ও এই জায়গা টা কেই চিহ্নিত করেছে। তাহলে কি ওরা জঙ্গলমহলে পৌছে গেল??
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
দ্বাদশ পর্ব- ফাইন্যাল মিশন
একটু এগিয়ে যেতেই আওয়াজ কানে এলো, বুঝতে পারলাম ওরা খুব বেশিদূর যেতে পারেনি। আমাদের এখনই যেতে হবে, এমন সময় রাজাদাদা আটকালো, এবার তাহলে শোন পুরো প্ল্যান টা।
‘ নাটু গাড়িটা নিয়ে যাবে একদম ওই যেখানে জমায়েত টা হয়েছে সেখানে, স্বাভাবিক ভাবেই ওরা একটু হড়কে যাবে গাড়িটা মাঝপথে এসে পড়েছে দেখে। তখনই তোরা চারজন ওই ভিড়ে মধ্যে ঢুকেই চারদিকে রং ছড়িয়ে দিবি। যুবতী দের জানাবি তোরাও ভগবানের দূত এবং এই রং খেলা টাও শ্রী কৃষ্ণের ইচ্ছে তে। আর এভাবেই তোদের চারজন এর মধ্যে অন্তত একজন পৌঁছে যাবি যারা কৃষ্ণ সেজে এসেছে তাদের কাছাকাছি, শীর্ষেন্দু কাজ টা ঠিকমতো করবে, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি তোমার বাবা আজই ছাড়া পাবে যদি এখানে সবটা আমরা সামলে দিতে পারি।’
আমি।’ কিন্তু মেয়েগুলো আমাদের কথা শুনবে তার নিশ্চয়তা কি?’
‘ ওই যে বাসব দত্তা, ও ইতিমধ্যেই রটানো শুরু করেছে যে শ্রী কৃষ্ণের দোল খেলার সখ হয়েছে।’
শীর্ষেন্দু।’ ভোগাস যতসব! গ্রামের লোকজন এত মূর্খ হয় কি করে? নিট টায় কোয়ালিফাই করে বেরিয়ে যেতে পারলে বেঁচে যাই।’
‘ গ্রামের লোকজন মূর্খ নয়, ওরা খুব সহজ সরল হয়, আর ওদের এই ধর্মবিশ্বাস টা কেই আশ্রয় করে বহু মানুষ ওদের ঠকায়। ধর্ম-ঈশ্বর এগুলো এমন একটা জিনিস যে খুব সহজেই এগুলোর আশ্রয় নিয়ে মানুষ কে বোকা বানানো যায়। এটা একবিংশ শতাব্দী, কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে ও এসব হচ্ছে। কিন্তু আজ ওদের জিততে দিলে চলবে না, প্ল্যান মত কাজ শুরু করা যাক।’
‘ আর তুমি কি করবে?’
‘ আগেও বলেছি নিজের কাজ টা কর, আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’
রাজাদাদার প্লানমত সবটা হলো। আমরা মিশে গেলাম ঐ দুই মুখোশধারীর সাথে। ওরা একেবারে চুপ করে গেছে, ওরা বুঝতে পেরেছে কথা বললেই ধরা পড়ে যাবে, রাজাদাদার কথা মত আমরাও চুপ করে আছি। ওরাও কনফিউজড, আমরাও। এই ঘটনা টা আমাকে নেটফ্লিক্সের একটা ওয়েব সিরিজের কথা মনে করিয়ে দিল। কয়েক মুহূর্তের জন্য সব চুপচাপ, একজন পুরোহিত কে অপরজন কে বলতে শুনলাম,
‘ ওরা তো দুজন বলেছিল মুখোশ পরে আসবে, এতজন কি করে হয়ে গেলো?’
হঠাৎ ই দুজনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হলো। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কি যে হচ্ছে, কিন্তু রাজাদাদার নির্দেশ মত মুখোশ আমরা খুলিনি। একজন রিভলবার বের করে আরেকজনের পিঠে তাক করলো, সেই পরিচিত অট্টহাসি যা আগে দুবার শুনেছি।
‘ মেদিনীপুরে আপনাকে স্বাগত মিস্টার রাজেন্দ্র রায় ওরফে রাজাদাদা, এবার মুখোশ টা খুলে ফেলুন দেখি রাজাদাদা।’
ঠিকই বলেছে লোকটা, মুখোশ খুলতেই দেখা গেল রাজাদাদা কে।
‘ ওহ, তোমার সাথে আর কত গেম খেলবো বলো তো। তুমি তো প্রথম থেকেই হেরো। সেই প্রথম দিন এত প্ল্যান করে আমারই লোকেদের মধ্যে ভিড়ে গিয়ে ভাবলে আমাকে হারিয়ে দেবে কিন্তু তোমার সাধের ইন্দ্র স্যার, তাকে বাঁচাতে সেদিনও তুমি হেরে গেলে। আর সবচেয়ে রিসেন্ট আজ, কি বোকা টাই না বানালাম তোমায়। তোমার নাকের ডগা দিয়ে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।’
‘ আপনি ভাবছেন জিতে গিয়েছেন, কিন্তু তা নয়। আমি কিন্তু আপনার পরিচয় জানি মিস্টার মামাবাবু, যেটা কে আপনার বাড়ি বলছেন সেটা কৃষ্ণকান্তের বাড়ি। আর আপনি আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বেরিয়ে আসেন নি কারণ সেই সাহস আপনার নেই, আপনি আসলে আজ ওই বাড়িতে ছিলেন ই না।’
‘ ভালো ভালো, অনেককিছুই দেখছি আন্দাজ করেছ। কিন্তু সে গুড়ে বালি, এবার যে তোমার সময় শেষ আমার একটা গুলি…’
মামাবাবু কে? তা জানিনা কিন্তু রাজাদাদার কনুইয়ের জোর ধাক্কায় বেশ আহত হলো মামাবাবু, আর সেই সঙ্গে রাজাদাদা লাফিয়ে লুফে নিল ওর হাত থেকে পড়ে যাওয়া রিভলভার টা। মামাবাবুর মাথায় তাক করে,
‘ ইউর গেম ইজ ওভার মিস্টার অগ্নিস্বর, শীর্ষেন্দুর মামা,.. মা- মা_ বা_ বু’
মুখোশ টা খুলে দিতেই আমরা চমকে উঠলাম, সত্যিই অগ্নিস্বরবাবু ওনা কে আমরা ভালো লোক হিসেবেই জানতাম, কিন্তু উনিই যে এতকিছুর পেছনে। গ্রামের বহু মানুষ ওনা কে শ্রদ্ধার চোখে দেখে কিন্তু ভালোমানুষির আড়ালে যে এই ছিল তা অনুমানের বাইরে ছিল। মামা তো নন, যেনো শকুনি মামা, দিদির সংসারে এসেছেন ঝামেলা পাকাতে।
অগ্নিস্বর বাবু।’ ভাগ্নে, তুমি তোমার মুখোশ খুলে নাও, আমাকে বাঁচাও ভাগ্নে।’
মামার কথা শুনে শীর্ষেন্দু সাথে সাথে মুখোশ টা খুলে দিয়ে বললো,’ তুমি ওখানে কেনো? তুমি তোমার পার্টনার কে পাঠাতে পারলে না গাড়ি তে কে আছে দেখতে? আমি ভাবলাম তুমি বুঝি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে তাই আমি ছুটে এসে এখানে যে কৃষ্ণ সেজে দাঁড়িয়ে ছিল তার কাছে এলাম। ওকে পালিয়ে যেতে দিয়েছি, ভাবলাম তুমি বুঝি ওখানে ছিলে।’
রাজাদাদা।’ শুভ, শীর্ষেন্দু কে আটকে রাখ..’
কিন্তু শীর্ষেন্দুর কাছে আর যেতে পারলাম না, শীর্ষেন্দু একটা মেয়ের গলায় ছুরি ধরলো।
‘ সাবাশ ভাগ্নে, এই না হলে আমার ভাগ্নে। দেখুন রাজাবাবু আমাকে ছেড়ে দিন নইলে আমার ভাগ্নে তো আছেই। ওর বয়স টা বড্ড কম, এই বয়স খুন খারাপি করে জেলে গেলে কি হবে বলুন ত! ও তো পড়াশোনাই করতে পারবে না! তার চেয়ে বলছি ছেড়ে দিন আমায়।’
‘ শীর্ষেন্দু, ছুরি টা ফেলে দাও। দেখো তুমি যদি ওনার কিছু করো তুমি নিজে তো বাঁচবেই না, আমিও গুলি চালাবো তোমার মামার দিকে।’
বাসব দত্তা উঠে এসে কিছু একটা করার কথা ভাবছিল কিন্তু
‘ খবরদার, তোকে কিন্তু আমি খুব ভালো করে চিনি। সেদিন উঠে এসে আমার মামা কে ঘুষি মেরে ছিলি, আজ যদি একটু ও বাড়াবাড়ি করেছিস কি..’
তার মানে আগেরদিন সেই বেঁটে যে লোকটা ছিল মামাবাবুর সাথে সে আর কেউই নয় শীর্ষেন্দু। মামাবাবুর সব কাজকর্মের সাথে তাহলে আগে থেকে জড়িত ও। রাজাদাদা রিভলবার নামিয়ে দিতে বাধ্য হলো।
অগ্নিস্বর।’ধন্যবাদ রাজাদাদা। দাড়াও আমার পার্টনার কে ফোন করি, আমার ভাগ্নে ও না পারে বটে আমার জায়গায় আমার পার্টনার কে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।’
তখনই ভিড়ের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এলো সে।
‘ আরে দাদা, ভাববেন না। আপনাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়ার স্বভাব টা আমার নেই, যতই হোক আমি তো ভগবান, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।’
‘ রাখো তো তোমার ভগবান। এদিকে সবটা তো বিগড়ে গেছে এখন কি করবে বলো। বাচ্চা মেয়েগুলো কে তো আরো কিছুটা পথ হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দড়ি বা কিছু এনেছ, রাজার দলবল কে বেঁধে ফেলতে হবে।’
পুরোহিত গুলো আমাদের কে নিয়ে একজায়গায় নিয়ে এলো।
‘ দেখে নাও ভালোমত আর কেউ নেই তো, বাসব দত্তা কে রেখে দাও, ওকে বিক্রি করলে..!’
নাটকের পারদ যখন চড়ছে, তখনই প্রবেশ করলো রাজসিংহ বাবু আর ইন্দ্রস্যার।
‘ ছি! ছি, অগ্নি তুমি এতটা নিচে নেমে গেছ। আর বাবুই তুই তোর মামাকে এসব কাজে সাহায্য করছিস?’
‘ আরে জামাইবাবু, কেনো ঝামেলা করছেন আপনি আর আমি তো একই দলের লোক, নাকি আপনাকে না জানিয়ে করছি বলে আপনার গোঁসা হয়েছে।’
‘ বাবুই এসব একেবারেই ঠিক কাজ নয়। মেয়ে পাচারের কাজে তুই ওকে সাহায্য করবি না। আমি মানছি আমি দাদার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, কিন্তু এইরকম জঘন্য কাজে.. না না… বাবুই তুই ফিরে আয়।’
ইন্দ্রস্যার।’ দেখ শীর্ষ, রাজা কিন্তু ওর কোথা রেখেছে। রাজা তোকে কথা দিয়েছিল তোর বাবাকে আজই জেল থেকে বের করে নিয়ে আসবে, আমি নিজে গেছিলাম রাজার কথা মত।’
শীর্ষেন্দু কে অনেক বোঝানোর পর যখন ও ফিরে আসতে রাজি হলো, তখন অগ্নিস্বর বাবু শীর্ষেন্দুর মাথায় রিভলবার তাক করলো।
‘ ভাগ্নে, ভুল করছিস। তুই আমার সব কাজের সঙ্গী, সবটা জানিস তুই তোকে ত এইভাবে যেতে দিতে পারিনা। এতটাও বোকা ভাবিস আমায়..’
‘ মামা, তুমি আমাকে বন্দুক এর ভয় দেখাচ্ছ?’
‘ জানিস ই তো তোকে আমি কি বলি, যুদ্ধ আর ভালোবাসায় সবকিছু ফেয়ার। তাই..’
‘ আমি তোমাকে সবার থেকে বাচালাম, এতদিন তুমি যা কিছু করেছ আমি না থাকলে সম্ভব হত, আর এখন কিনা তুমি..’
‘ ওর জন্যই ত বলছি তোকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।’
‘ চালাও গুলি, মামা, চালাও..’
রাজাদাদা।’ কৃষ্ণ, কিছু একটা…’
রাজাদাদা কৃষ্ণ কে কিছু বলবার আগেই কৃষ্ণ অগ্নিস্বরের দিকে রিভলবার তাক করে ওর টা কেড়ে নিল। সেনগুপ্ত বাবু পুলিশ নিয়ে পৌঁছে গেলেন স্পটে, অগ্নিস্বর কে অ্যারেস্ট করা হলো। কৃষ্ণ কে কেউ কিছু করলো না, শেষে অবশ্য ওই আমাদের সাহায্য করেছে, তাহলে কৃষ্ণ কি পুলিশের লোক?
কৃষ্ণ।’ তো রাজা দাদা, চিনতে পারলেন আমাকে?’
‘ দেখো আগেই বলেছি তুমি ভালো অভিনেতা, কিন্তু গলার স্বর টা যতই চেঞ্জ করো খটকা একটা লাগেই। তোমাকে চিনতে এতদিন অসুবিধে হলেও আজ সামনাসামনি তোমাকে দেখেও চিনতে পারব না ভাবলে কি করে? তুমি হলে আমাদের প্রিয়………..’
আমি ও রাজাদাদার মত ওনার চেহারা আর গলার স্বর টা লক্ষ্য করে ভাবতে শুরু করলাম কে এই কৃষ্ণ।
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
ত্রয়োদশ পর্ব- রাজাদাদার সমাধানসূত্র
আমি ভেবে বললাম এখানে তো রূপনারায়ণ বাবু উপস্থিত নেই তবে কি ইনি রূপনারায়ণ রায়চৌধুরী।
রাজাদাদা।’ না, উনি সুনির্মল বাবু।’
ঠিকই বলেছিল রাজাদাদা, কৃষ্ণের মুখোশ পরা লোকটি সুনির্মল বাবু। কিন্তু তাহলে উনি অগ্নিস্বর বাবু কে সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু শেষে… কিছু বুঝতে পারছিলাম না।
সুনির্মল।’ বাকি কথা বাড়ি গিয়েই হোক নাকি, দুদিন অনেক ধকল গেলো। সেনগুপ্ত অগ্নি দা কে জেলে পুরে দাও ওর প্রিয় বন্ধু কৃষ্ণকান্তের সাথে।’
গ্রামবাসীর মধ্যে শোরগোল শুরু হয়েছিল, কৃষ্ণের মূর্তি নিয়ে।
সুনির্মল।’ ওটা আমারই সৃষ্টি। আপনারা ভুল ভাবছিলেন এতক্ষন, দাড়ান ..’
মূর্তির ভেতর থেকে স্পিকার টা আর ওর বানানো বট টা বের করে নিয়ে এলেন।
‘ এটা হচ্ছে ব্লুটুথ আর এটা অ্যাম্পলিফায়ার, সহজ করে বলছি এই যে আপনারা ফোনে আপনাদের আপন জনের সাথে কথা বলেন তো, তেমনি আমি বাড়িতে বসেই যা বলি সেটা এই ডিভাইস থেকে শোনা যায়। আর ওই যে দেখছিলেন মূর্তি টা চলছিল সেটাও আমারই কেরামতি। আপনাদের বিশ্বাস নিয়ে কিংবা আপনাদের জীবন নিয়ে খেলবার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু আপনাদের মনের অন্ধবিশ্বাস কেউ কাটানো দরকার।’
সুনির্মল বাবু গ্রামবাসীদের কে সামলে নিল, পুরোহিত রাও নাকি ওনার কথামতই কাজ করছিল। আমরা ফিরে রায়চৌধুরী বাড়িতে।
রাজসিংহ বাবু ।’ দাদা, আমি অনেক অন্যায় করেছি, আর নয় এ বাড়ি তোমারই দাদা।’
রীনা কাকিমা।’ দাদা মাপ করে দেবেন, স্বামীর অকর্মণ্যতা দেখে আমি ভেবেছিলাম ভাই যদি আপনাদের ব্যবসায় সাহায্য করতে পারে। কিন্তু তখন তো বুঝতে পারিনি, আমায় ক্ষমা করবেন..’
সন্দীপ বাবু।’ এবছরের দোল এভাবেই কেটে গেলো, আর মন খারাপ করার কারণ নেই, বৌমা যাও সবার জন্য ভালোমন্দ খাবারের ব্যবস্থা করো।’
সুপ্রতিম।’ রাজা দাদা তুমি কি করে সবটা জানলে, বলবে না?? সে যে তুমি সবাইকে ঘরে বসিয়ে নাকি পুরো ঘটনা টা বলো শুনেছি।’
রাজাদাদা হেসে ফেললো।
‘ খাবার টেবিলে সবাইকে পাওয়া যাবে, কাকীমার হাতের গরম গরম লুচি খেতে খেতে না হয় সবটা শুনবি।’
সবাই চলে এসেছে। এবার তাহলে রাজাদাদা শুরু করবে,
‘ গল্প টা একেবারে প্রথম থেকেই শুরু করি। রায়চৌধুরী পরিবার, গ্রামে সবাই ওদের সম্মান করে ওদের এত জমিজমা আর ব্যাবসার সমৃদ্ধির জন্য। সন্দীপ বাবুর পরিশ্রমের ফসল এই ব্যবসায় উত্তরাধিকার হয় রূপনারায়ণ বাবু।
কিন্তু তার বাকি দুই ছেলে কারোরই ব্যবসায় মন ছিল না, সুনির্মল বাবু নিজের যোগ্যতায় অধ্যাপক হয়েছে, তাছাড়া ওনার লেখা বই খুব হিট। তাই বাপের ব্যবসার কোনো দরকার নেই তার, নিজের টাকা তেই ইতিমধ্যে কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে রেখে দিয়েছে ভবিষ্যতে যদি কখনো কলকাতায় সেটল হতে হয় এই ভেবে। সন্দীপ বাবুর মতে বাড়ির একমাত্র অকর্মণ্য ছেলে রাজসিংহ বাবু, ওনার না মন আছে লেখা পড়ায় না ব্যবসার কিছু বোঝে।
ছোটোবেলা থেকেই এই কারণে বাবা মায়ের থেকে কথা শুনতে শুনতে ওর মনে দাদার প্রতি একটা প্রতিহিংসা জন্মায়। উনি কোনোদিনই রূপনারায়ণ বাবু কে সহ্য করতে পারতেন, উনি মনে করতেন সবাই ত একরকম হয় না। উনি একজন শিল্পী, ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। প্রথমদিকে ছবি বিক্রি করে ভালো পসার জমাতে পারেননি। এবার ঘটনা টা আজ থেকে প্রায় পাঁচ বছর আগের, সন্দীপ বাবুর স্ত্রী মারা যাওয়ার আগে নির্দেশ দেন বাড়িটা বড়ো ছেলের নামে লিখে দিতে। আমি ঠিক জানিনা কেনো উনি এমন নির্দেশ দিয়েছিলেন, হয়ত রাজসিংহ বাবু টাকার অপব্যাবহার করবে ভেবেই..’
সন্দীপ বাবু।’ হ্যাঁ আসলে ওদের মা জানতেন এই ব্যবসা যদি কেউ সামলাতে পারে তা হলো রূপ। আর রূপ যে কখনো এ বাড়ির মালিক হয়ে রাজ আর নিলু কে তাড়িয়ে দেবে না এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিন্ত ছিলাম।’
‘ এই ঘটনা রাজসিংহ বাবুর বিদ্বেষের মধ্যে ঘৃতাহুতি র কাজ করে। ততদিনে রীনা কাকিমা নিজের ভাই কে এবাড়িতে নিয়ে এসেছেন ব্যবসায় সাহায্য করতে। কিন্তু অগ্নিস্বর বাবু রাজ সিংহ বাবু কে কুমন্ত্রণা দিতে থাকতেন। আমার ধারণা রন্টু কে বাড়ি ছাড়া করার পরিকল্পনা টা আপনার একার নন, অগ্নিস্বর বাবুর তাই তো?’
রাজসিংহ।’ হ্যাঁ অগ্নি আমাকে বলেছিল যে সব সম্পত্তি যদি দাদার হয়, তাহলে তার একমাত্র উত্তরাধিকার হবে রন্টু। আমার বাবুই কিছুই পাবে না, তাই যদি এমনকিছু করে রন্টু কেই সরিয়ে দেওয়া যায়। তখন আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, অপর্ণার সাথে রন্টুর একটা সম্পর্ক আছে। অপর্ণা কে ভয় দেখিয়ে রাজি করানো হলো কাজটা করতে।’
‘ কাজটা নিশ্চয়ই আপনি করলেন, অগ্নিস্বর বাবু এমনই লোক ছিলেন একটা কাজেও নিজে ইনভলব থাকেনি, নিজে আড়ালে থেকে সব সময় কাউকে দিয়ে কখনো রাজ সিংহ বাবু কিংবা কখনো কৃষ্ণকান্ত বা এখন কৃষ্ণ। আমি রন্টু কে জিজ্ঞেস করলে ও কিন্তু ওর বড়কাকা মানে আপনার কথাই বলেছিল, মানে একবারও অগ্নিশ্বরের কথা বলেনি। ঘটনা টা ঘটার পর রায়চৌধুরী পরিবারের বদনাম রুখতে রূপনারায়ণ ওকে তাজ্য পুত্র করলেন।
তাহলে এবাড়ির এখন একমাত্র উত্তরাধিকার শীর্ষেন্দু। কিন্তু সুনির্মল বাবু আর দাদু মানে সন্দীপ বাবু ঘটনা টা বিশ্বাস করলেন না, ওরা দুজনে মিলে ঠিক করলো রন্টু কে সাহায্য করবে কিন্তু ওরা নিজেরা যদি ইনভোলভ থাকে আর রাজসিংহ বাবু যদি সবটা জেনে যায় তাহলে ঝামেলা পাকাতে পারে ভেবে ওনারা ইন্দ্র স্যারের সাহায্য নিলেন। ইন্দ্র স্যার ই রন্টু র সমস্ত পড়াশোনা থেকে শুরু করে, কলকাতায় থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তারপর রন্টু অপর্ণার সাথে দেখা করে কলকাতায়।
রন্টু দা।’ হ্যাঁ কলকাতায় কলেজে দু তিন মাস কাটার পরেই জানতে পারি অপর্ণা ও কলকাতায় আছে। ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি, ও রাজি হয় না। তারপর একদিন ওর কলেজে চলে গিয়ে মুখোমুখি হই, ও বাধ্য হয়ে সবটা খুলে বলে। আমরা ঠিক করি কলকাতায় নিয়মিত যোগাযোগ রাখব, বাড়ির লোকজন কে ব্যাপার টা জানাবো না।’
‘ তারপর কেটে যায় পাঁচ বছর। ব্যাবসায় ভালো মুনাফা হচ্ছে কিন্তু টাকার নয়ছয় হচ্ছে, কে করছে বুঝতে না পেরে রূপনারায়ণ বাবু অগ্নিস্বরের সাহায্য নেয়। তখনই প্রথম সন্দেহ হয় সুনির্মল বাবুর, উনি ভাবেন দাদা কি অগ্নি দা কে ভরসা করে ঠিক করছে? ওর সাথে সেনগুপ্তের খুব খাতির ছিল, ও আর সেনগুপ্ত মিলে প্ল্যান করে ব্যাপার টা খতিয়ে দেখবে। সুনির্মল বাবুর বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়, এমন পরিকল্পনা করেন যাতে টাকা গুলো কোথায় যাচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করে।
অগ্নিস্বরের বাবুর সব কাজের সাগরেদ ছিল এই কৃষ্ণকান্ত সরেন। ওকে অ্যারেস্ট করা হয়, কিন্তু অগ্নিস্বর বাবুর বিরুদ্ধে একটা প্রমান ও পাওয়া যায় না। কৃষ্ণকান্ত এগ্রামে র প্রভাবশালী ব্যক্তি তাই ওকে জেল এ আটকে রাখা সম্ভব নয়, জামিনের ব্যবস্থা করে নিয়ে ওদের জাস্ট এক দিন লাগবে।
তাই সেনগুপ্ত ব্যাপার টা গোপন করে আর কৃষ্ণকান্তের উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু করে। বিলাসবহুল কৃষ্ণকান্ত এই অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে জানিয়ে দেয় এসবের পেছনে অগ্নিস্বর আছে। তারপরের পুরো প্ল্যান সুনির্মল বাবুর। উনি ঠিক করলেন এমনকিছু একটা করবেন যাতে সবার সামনে প্রমানসহ ধরা পড়ে অগ্নিস্বর।’
সুনির্মল বাবু।’ হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছিলাম ছোড়দা কে যদি ঠিক পথে আনতে হয় তাহলে অগ্নি দার মুখোশ টা সবার সামনে খুলে যাবে। তখনই আমি ছক কষলাম, আমার মাথায় কৃষ্ণ কে নিয়ে একটা দারুন আইডিয়া এলো, আর প্ল্যান টা কে ইমপ্লিমেন্ট করার মোক্ষম সময় হলো এই দোল। দেখুন আমি বাংলার অধ্যাপক হতে পারি,আমার বন্ধুবান্ধব ইঞ্জিনিয়ার, ওদের মুখেই ওদের নানা রোবোটিক্স এর কাজকর্ম দেখে আমার বেশ ভালো লাগতো। ওই যে সিস্টেম টা দেখলেন কৃষ্ণমূর্তি র ভেতর সবটা আমার একজন বন্ধুর তৈরি করে দেওয়া।’
‘ বেশ ভালো আইডিয়া ছিল, কিন্তু একথা একবারও ভাবেননি এই সময়ে এসব অন্ধবিশ্বাস কেউ মানবে না। আর আপনার স্ক্রিপ্ট টা আরেকটু উন্নত হওয়া দরকার ছিল, শ্রীকৃষ্ণের মূর্তি কে দিয়ে আপনি যে কথা গুলো বলেছিলেন সেগুলো শুনলে একটুও ভক্তি আসে না।’
‘ ঠিক আছে( হেসে) নেক্সট টাইম এমন স্ক্রিপ্ট বানাবো আপনিও ভক্তিভরে পুজো করতে শুরু করবেন।’
‘ এবার আপনার মাথায় আইডিয়া এলো ইন্দ্র স্যার কে এবারের দোলে আমন্ত্রণ করলে কেমন হয়। আপনি ইন্দ্র স্যারের কাছে আমার গোয়েন্দাগিরির অনেক গল্প শুনেছেন, স্যার তো সারাক্ষণ আমার প্রশংসা করতে থাকেন। আপনি চাইলেন এই পুরো ব্যাপার টা তে একজন গোয়েন্দা কে ইনভোলব করলে কেমন হয়, তাই আপনি ই গিয়ে বিনয় কাকাকে বললেন স্যার কে এবারের দোলে বিষ্ণুপুরে আসতে সাথে যেন আমরাও আসি। আমার ধারণা স্যার এইসব প্ল্যানের কিছুই জানত না।’
ইন্দ্র স্যার।’ হ্যাঁ গো রাজা, আমি কিছুই জানতাম না। জানলে কি আর নিজের কিডন্যাপিং প্লট রাখতাম..’
‘ তো আমরা এলাম বিষ্ণুপুরে। প্রথমদিনের গল্প শুরু এক্সিডেন্ট দিয়ে সেটার কথা তো আগেই বলেছি, রন্টু ইন্দ্রস্যার কে ও যে এসেছে চিরকুট মারফত জানাতে গিয়ে আমার উপর এসে পড়ে। এবার যেকোনো বড় কিছু ঘটার আগে কিছু কিছু ছোট ঘটনা ঘটিয়ে যাতে আগে থেকেই সকলের সন্দেহ টা রাজসিংহ বাবুর উপর থাকে, তাই অগ্নিস্বর বাবু রাজ সিংহ বাবু কে দিয়ে একবার ওই রডের আঘাত ও পরে ওই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া এসব করালেন। শীর্ষেন্দু সব কাজে মামা আর বাবা কে হেল্প করত তাই ও একটুও মুখ খুলতো না। রাজ সিংহ বাবু এসব করতেন এই ভেবে যে বাবা কে যদি বোঝানো যায় দাদা শীর্ষেন্দুর ক্ষতি চাইছে, বাবা যদি সম্পত্তি তে ওনার ভাগ ফিরিয়ে দেয়।’
রাজসিংহ।’ আপনি তাহলে প্রথমদিন থেকেই সন্দেহ করেননি?
এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমাদের সবার প্রথম সন্দেহ ছিল রাজসিংহ বাবুর উপর, তাহলে রাজাদাদা কি ভেবেছিল?
(ক্রমশ)
( অন্তিম পর্ব)
রায়চৌধুরী বাড়ির দোল
অন্তিম পর্ব
রাজসিংহ বাবু র রূপনারায়ণ বাবুর প্রতি বিদ্বেষ সকলকেই ওনার সম্পর্কে খারাপ ধারণা তৈরি করেছিল। রাজাদাদার ও এর অন্যথা হয়নি। রাজাদাদা উত্তর দিল,
‘ না একেবারেই তা নয়। আপনার উপর সন্দেহ ছিল ই কিন্তু ওই যে খটকা লাগত। আপনি যা করেন খোলাখুলি, সকলের সামনে কাউকে কিছু বলার বা কারোর ক্ষতি করার সাহস আছে আপনার, কিন্তু লুকিয়ে থেকে কাউকে কিডন্যাপ করিয়ে এসব কাজ কি আপনি আদৌ করবেন? সন্দেহ হচ্ছিল, আর তারপর আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম আপনার ছবি গুলো খুবই বিখ্যাত, আপনার উপার্জন ও কিছু কম নয়।
কলকাতায় আর্ট একাডেমী থেকে জানা গেল আপনি খুবই সজ্জন ব্যক্তি, আর আপনি আদৌ পুরো ব্যাপার টার সাথে জড়িয়ে আছেন কিনা জানার জন্য সবার আগে আপনাকে অ্যারেস্ট করালাম। আমার দুজনের উপর সন্দেহ হতে থাকল এক সুনির্মল বাবু আর দুই অগ্নিস্বর বাবু।’
সুনির্মল বাবু।’ আপনি আমাকে ও সন্দেহের তালিকায় রেখেছিলেন?’
‘ রাখাটা কি স্বাভাবিক নয়, আপনি ক্রমাগত আমাদের মিথ্যে বলে গেছেন। এমনকি রন্টু র ছবি চাইলে অন্য একটা ছেলের ছবি দেখিয়েছেন। অন্যদিকে সেনগুপ্তের থেকে জানতে পারি ইন্দ্র স্যার কিডন্যাপ হওয়ার খবর টা ওরা প্রায় তিন ঘণ্টা পর জানতে পেরেছে, এদিকে অগ্নিস্বর বাবু তো এসে বললেন উনি পুলিশে খবর দিয়েছেন।
খোঁজ জানতে পারলাম রায়চৌধুরী বাড়িতে আসার আগে অগ্নিস্বর বাবু বেকার ছিলেন, তাই ওনার এই সম্পত্তি ব্যবসার প্রতি লোভ থাকার মোটিভ টা সবচেয়ে স্ট্রং। এবার চিরকুট টায় পুরো চিঠি টা রূপনারায়ণ বাবু কে ‘ আপনি’ সম্বোধন করলে ও শেষে ‘ তোমার ‘ লেখাটা বুঝিয়ে দিল লোকটা রূপনারায়ণ বাবুর পরিচিত। বিকেলে আমরা গেলাম ইন্দ্র স্যার কে উদ্ধার করতে, ঠিক সেই সময় কে কোথায় ছিল সেটার খোঁজ নিয়ে জানতে পারি শীর্ষেন্দু রাজসিংহ বাবু অগ্নিস্বর বাবু আর সুনির্মল বাবু কোথায় কেউ জানে না, তাই এদের কে প্রাইম সাসপেক্ট হিসেবে কাউন্ট করলাম।’
আমি।’ তারপর দাদু যে আমাকে ডেকে ওসব বলল, তাহলে দাদু কি সবটাই জানত?’
‘ হ্যাঁ সন্দীপ বাবু সবটাই জানতেন। পুরো প্ল্যান টা এখানে চারজন জানতেন, সুনির্মল বাবু, সেনগুপ্ত, সন্দীপ বাবু আর বিনয় কাকা। বিনয় কাকা ই তো সাহায্য করেছিল গ্রামবাসী দের বিশ্বাস অর্জন করতে। মনে আছে আমি যখন বাধা দিচ্ছিলাম এসব গুজব আটকাতে মূর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম প্রথমে বিনয় কাকা ভগবানের দোহাই দিয়ে আমাকে আটকেছিলেন। আর তারপরেও যখন আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম সুনির্মল ইচ্ছে করে বোম্ব থাকার আতঙ্ক টা ছড়ালো।’
সুনির্মল।’ তো কি করতাম বলুন আপনি তো আমার পুরো প্ল্যানে জল ঢেলে দিচ্ছিলেন।’
আমি।’ তার মানে আপনি ইচ্ছে করে আপনার বাবার গাড়ি র ব্রেকফেল করিয়েছেন?’
‘ না রে শুভ, কাজটা যথেষ্ট রিস্কি, সুনির্মল বাবু কখনোই ওটা করতেন কারণ, কারণ একটু অসাবধান হলেই বড়সর এক্সিডেন্ট ঘটতে পারে। কাজটা করিয়েছে অগ্নিস্বর বাবু।’
বাসবদত্তা।’ আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। অগ্নিস্বর বাবু সুনির্মল বাবুর সাথে হাত কেনো মেলাবেন?’
‘ আরে পুরো ব্যাপার টা বুঝলি না। সেদিন সুনির্মল কি প্ল্যান করেছিল জানিস.. ওই যে কৃষ্ণ। কৃষ্ণকান্ত সরেন এর প্রথম দুই অক্ষর,আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, সবটা কে গুলিয়ে দেওয়ার জন্যই এমন প্ল্যান। সেনগুপ্ত কে দিয়ে চাপ দিয়ে কৃষ্ণকান্ত বাবু বাধ্য হলেন রাজসিংহ কে ফোন করতে, ফোন করে জানালেন,’ আমাকে কয়েকদিনের জন্য গা ঢাকা দিতে হচ্ছে, ততদিন আমার জায়গায় একজন আমার নাম মানে ‘ কৃষ্ণ’ সেজে আপনার সাথে যোগাযোগ করবে।
এখন পুলিশ অনেক সক্রিয় হয়েছে তাই ছদ্মবেশ ছাড়া আসবেন না আপনিও কৃষ্ণ সেজে আসবেন আমার লোককেও কৃষ্ণ সাজিয়ে পাঠাবো, ওর মাথায় একটা দারুন প্ল্যান এসেছে, একটা বড় দাও মারবো অগ্নি, আমাদের জীবন টা ই পাল্টে যাবে।’
বুঝলি তাহলে, আসলে কৃষ্ণ একজন নয় কৃষ্ণ হলো তিনজন- এক কৃষ্ণকান্ত বাবু দুই অগ্নিস্বর বাবু আর তিন সুনির্মল বাবু। কিন্তু সুনির্মল বাবু আমার একটা প্রশ্ন আছে আপনি কি নিজেই যেতেন অগ্নিস্বর বাবুর সাথে দেখা করতে?? উনি যা ধুরন্ধর মানুষ আপনি তো সহজেই ধরা পড়ে যেতে পারতেন।’
সুনির্মল বাবু।’ ঠিকই ধরেছেন, আমি এই শেষ দিন ই প্রথম কৃষ্ণ সাজি আগে যতবার অগ্নিস্বর বাবুর সাথে যে মিট করেছে সে আমি নই, আমার পাঠানো আরেকজন। আমার প্ল্যান ছিল কৃষ্ণকান্তের নাম করে অগ্নি দা কে টোপ দিলাম, জঙ্গলমহলে একটা আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, কম করে ২০ টা মেয়ে জোগাড় করে দিতে পারলে বড় অঙ্কের টাকা দেবে।
অগ্নি দা টোপ টা গিললো আর প্ল্যান টা জানতে চাইলে এই পুরো কৃষ্ণমূর্তি র জীবন্ত হয়ে ওঠার পুরো ব্যাপার টা বুঝিয়ে বলা হলো। উনি একটু অবাক ই হলেন, কৃষ্ণকান্তের লোক এত ট্যালেন্টেড ভাবতেই পারেননি, কিন্তু উনিও ডাউট করেছিলেন গ্রামবাসীরা বিশ্বাস করবেন কি করে। তখন আমার লোক ওকে বলেন মদনমোহন মন্দিরের পুরোহিত কে হাত করতে হবে, আরো কয়েকজন পুরোহিত কে যদি আমাদের দলে টানতে পারি, ওরা বললে গ্রামবাসী রা বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেই।’
‘ দারুন প্ল্যান কষেছিলেন বটে। কিন্তু আপনার বাবার গাড়ি এক্সিডেন্ট করে আপনার বাবা কে আর ইন্দ্র স্যার কে কিডন্যাপ করা হবে এসব ছিল অগ্নিস্বর বাবুর প্ল্যান। আপনার উপর যাতে অগ্নিশ্বরের কোনোরকম সন্দেহ না হয়,নিজের প্ল্যান টা বাঁচাতে ওর প্ল্যান মত কাজ করতে হলো। জেলে যখন আমি কৃষ্ণকান্ত বাবুর সাথে কথা বললাম ও আমাকে বললো যে গাড়ির ব্রেকফেল টা ওই মানে কৃষ্ণ করিয়েছে, কিন্তু ও তো জেলে।
তখন থেকেই একাধিক কৃষ্ণের অস্তিত্বের প্রমাণ পেলাম। যাইহোক ফিরে আসি গল্পে, আমি রনজয় এর পরিচয় জানতে পারলাম। সেদিন ইচ্ছে করেই সুনির্মল বাবু কে দিয়ে ফোন টা করেছিলাম অপর্ণা কে, তখন মনে আছে শুভ তুই বলেছিলি আমার আইডিয়া গ্রেট, আসলে তা নয় সুনির্মল বাবু আগে থেকে অপর্ণা কে ব্যাপার টা জানিয়ে রেখেছিল।
আমরা পুলিশ নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘিরে ফিরেছিলাম, আমি যেভাবে চারদিকে পুলিশ প্লেস করেছিলাম তাতে নিশ্চিত ছিলাম কেউ পালিয়ে যেতে পারবে না, পালিয়ে গেলেও তাকে পুলিশের সামনা সামনি আসতে হবে, তাই লোড শেডিং পর যখন সবাই বলেছিল এই পাওয়ার কাট করিয়ে কৃষ্ণ পালিয়ে গেছে আসলে তা নয় কৃষ্ণ ত আসেইনি।আসলে সেনগুপ্ত করেছে পাওয়ার কাট টা, গিয়ে মেইন সুইচ অফ করে দিয়েছে।
ওদিকে আমি নিজে রায়চৌধুরী বাড়ি থেকে সকলের বের হওয়া বন্ধ করিয়েছি, তাই কেউ ভেতর থেকে বেরিয়ে এলে নির্ঘাত চোখে পড়বে। ফোন টা অগ্নিস্বর বাবু বাড়িতে থেকেই করেছিলেন, উনি আর শীর্ষেন্দু মিলে। শীর্ষেন্দু পাহাড়া দিচ্ছিল যাতে ঘরে কেউ ঢুকতে না পারে।
আর আপনারা হয়ত যখন কৃষ্ণের নম্বর টা রাজসিংহের মোবাইল এ সেভ করা দেখেছেন এবং উনি কৃষ্ণের সাথে দিব্যি কথা বলছিলেন ওটাও করিয়েছে অগ্নিস্বর বাবু, এবং কাজ টা করেছে শীর্ষেন্দু। মামার কথামত ও বাবার মোবাইল নম্বর টা সেভ করে দিয়েছিল , তখন অবশ্য বুঝতে পারেনি এসব করে ও বাবার ই বিপদ ডেকে আনছে। তারপর ফাইনালি সুনির্মল বাবুর মাস্টার প্ল্যান নারী পাচার চক্র।’
রূপনারায়ণ।’ নীলু কাজটা মোটেই ঠিক করিস নি, যদি সত্যি সত্যি জঙ্গলমহলে পৌঁছে যেত। অগ্নিস্বর যদি তোর পরিচয় জেনে যেত তাহলে? এতটা রিস্কি কাজ!’
‘ এটা না করলে ছোড়দা আর বাবুই এর সামনে অগ্নি দার আসল মুখোশ টা খোলা যেত না। এবার বলুন রাজা বাবু আপনি কি করে জানলেন আমি আর অগ্নি দা দুজনেই কৃষ্ণ হলেও আমি ভালোর জন্য কাজ করছি?’
‘ দেখুন প্রাইম সাসপেক্ট আপনারা দুজনই ছিলেন, এবং কৃষ্ণকান্ত বাবু জেলে থাকা অবস্থায় দুজন কৃষ্ণ সেজে আছে। দুজনের সাথেই আপনাদের দুজনের উচ্চতা, চেহারা মিল যায়। অগ্নিস্বর বাবুর গুন হলো ও গলার স্বর পুরো পাল্টে ফেলতে পারেন সহজে ধরা পড়েন না, কিন্তু আপনি সেটা একদম ই পারেন না। আগেও বলেছি আপনি নিতান্তই বাজে অভিনেতা আর এটা আমি বুঝেছি বারবার আপনাকে অভিনয় করতে বলে, মনে আছে তো সেই ডাক্তার সেজে হসপিটালে যাওয়া। কিন্তু আপনি একটা ভুল করেছিলেন, আর সেটাই আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে আপনি সবকিছু করছেন রায়চৌধুরী বাড়ির ভালোর জন্য।’
‘ কি ভুল?’
‘ আপনি আপনার বাবার একটুও ক্ষতি হতে দেননি। তাই আপনার বাবা রাতে যে ওষুধ টা রোজ খায় সেটা কৃষ্ণ সেজে গিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। ওনাদের কে যেই ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল সেখান থেকেই এই ফাঁকা ওষুধের প্যাকেট টা পাই, সৌভাগ্যক্রমে সেদিন দুটো ওষুধ ই বেঁচে ছিল তাই ওটা ওখানে ই ফেলে দিন আবার এদিকে আপনার বাবার ওষুধপত্র আপনি ই কেনেন, আর আপনার বাবা কে শুভ কে যা যা ক্লু দিয়েছিল পুরো প্ল্যান টা না জানা থাকলে ওনার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হত না। ও কিন্তু শুভ কে একথাও বলেছিল, ভগবান ই শেষমেষ রক্ষাকর্তা হয়ে ওঠে মানে কৃষ্ণ অর্থাৎ আপনাকে ইঙ্গিত করেছিলেন।’
বিনয় কাকা।’ ধন্য ধন্য তুমি রাজা।’
এবার সবটা বোঝা গেলো। রাজাদাদা এই কেসটাও সলভ করে ফেলল, আমার আরেকটা গল্প লেখার সুযোগ চলে এলো। যেহেতু এই দুদিন এত ঝড় ঝাপটার মধ্যে কেটে গেলো তাই ঠিক হলো রায়চৌধুরী বাড়ির দোল হবে, কাল আমরা সবাই দোল খেলবো।
এই প্রথমবার দোলের দুদিন পরেও আমরা রং খেলছি, সত্যিই গ্রামের এই একতা বড়ই ভালো লাগে। সবাই মিলে এমন মেতে উঠেছি যে, একটিবার ও মনে হচ্ছিল না আজ দোল নয়।
শীর্ষেন্দু।’ রাজাদাদা, আমাকে ক্ষমা করে দিও। মামার কথা শুনে..?’
‘ ওসব নিয়ে আর কথা নয়, বলেছি না সব ভুলে যাও।’
‘ ভুলে যাব, কিন্তু তুমি আজই চলে যেও না। তোমার সাথে ঠিক করে মেশার সুযোগ ই পেলাম না, আমিও গোয়েন্দাগিরি শিখতে চাই। ডাক্তারি তে চান্স তো পাবো না, এই একবছর ত মামাকে সাহায্য করতেই কেটে গেছে।’
এমন সময় বাসব দত্তা আর সুপ্রতিম ছুটে এলো। বাসব দত্তা বলল,’ রাজাদাদা তোমাকে থেকে যেতেই হবে কেস এখনও শেষ হয়নি?’
‘ কেনো আজ আবার কার কিডন্যাপিং এর খবর নিয়ে এলে।’
‘ কিডন্যাপিং কিনা জানি না, কাল আমরা যতজন মেয়েরা জড়ো হয়েছিলাম তাদের মধ্যে তিনজন মিসিং।’
সমাপ্ত