রণেশ রায়ের কবিতা

 

চেয়েছিলাম বলে 

ভালোবেসে, 

তোমায় আমি চেয়েছিলাম বলে, 

আমার সঙ্গে মিলে 

তুমি আমার দান সাগর হলে ।

তোমার অনুগ্রহে অনেক লোভে পড়ে 

জানলাম আমি দয়ার সাগর থাকে অনেক দূরে, 

আমার এই দীন বেশে 

অনেক খুঁজেও পেলাম না তাকে শেষে ।

পাহাড়ী ঝর্ণা কোথায় আসে নেমে 

নদীর জলে শিশির বিন্দু হয়ে?

চোখ বন্ধ দেখি না যে কিছু ,

জানি আমি তোমার সঙ্গ নিলে 

চলি আমি পিছু পিছু 

মিলি আমরা সাগর মোহনায় এলে।

জানি আমি, দান সাগর !

সে সামান্য কেউ নয়, 

মোহের ঘোরে মিলতে চাই তার সাথে 

সাধ্য কি আমার তাকে করব জয় !

জানি আমি ক্ষুদ্র আমি 

আমার যে হয় ক্ষয়,

কি দিয়ে বাঁধবো তাকে ?

করি আমি ভয়,

দান সাগরের নেই যে কোন লয় ।

 

পাবল নেরুদার Your Laughter কবিতা অবলম্বনে

by Pablo Neruda

তোমার হাসি 

যদি চাও আমার থেকে ছিনিয়ে নাও, 

ছিনিয়ে নাও রুটি তাড়িয়ে নাও বাতাস 

কিন্তু তোমার মুখের হাসি 

কেড়  না কেড় না তা, অম্লান হয়ে থাক।

শরতের সমুদ্র বুকে তোমার হাসি 

ঝর্নার ফেনিল উচ্ছাসে উপচে পড়ে

সে যেন ফুলের প্রস্ফুটন আমার হৃদয় কাননে 

আমি অপেক্ষায় তোমার সে হাসির জন্যে 

সেই নীলাভ ফুল, 

সে গোলাপ ফুটে ওঠে রক্তিম পৃথিবীর  বুকে।

কণ্টকাকীর্ণ সে গোলাপ 

যা উপহার দিয়েছ তুমি 

নিও না নিও না  তা ছিনিয়ে;

জলপ্রপাত, হঠাৎ আনন্দ উচ্ছাস তার, 

ত্বরিতে যে রূপালী ঢেউ 

জন্ম যার তোমার হৃদয়ে 

জ্বলে যেন সন্ধ্যার প্রদীপ হয়ে।

তিক্ত সে আমার লড়াই শেষে 

ক্লান্ত তন্দ্রামগ্ন চোখে ফিরি আমি 

কোন পরিবর্তন দেখি না এ জগতে,

কিন্তু তোমার মুখে যখন হাসি ফোটে

আকাশপারে সে আমায় খোঁজে 

আমি পৌঁছে যাই আমার জীবন দুয়ারে ।

আমার প্রেম যখন আঁধারে দিশাহারা

কিন্তু অধরে তোমার হাসির ফোয়ারা 

তুমি যদি হঠাৎ দেখ 

আমার রক্ত ঝরে পথের পাথরে 

হাসি যেন থাকে তোমার মুখে 

কারণ আমার হাতে তোমার হাসি

মুক্ত তলোয়ার হয়ে ওঠে।

তুমি হাস হাস তুমি দিনে রাতে 

রাতের জ্যোৎস্নায় কোন এক দ্বীপে পথের বাঁকে,

মলিন ছেলেটি বাজায় বাঁশি 

সে  তোমাকে ভালোবাসে 

তার দিকে তাকিয়ে তোমার হাসি,

কিন্তু আমি যখন চোখ খুলি

যখন আবার তা বন্ধ করি 

আমার পা আগে চলে সে আবার পিছিয়ে যায়, 

কেড়ে নাও আমার রুটি আমার বাতাস

কেড়ে নাও আলো, ঝর্না আমার, 

কিন্তু তাও যেন তোমার মুখে  হাসি দেখি

কেড়ে নিও না সে হাসি তোমার 

যদি তোমার হাসি চলে যায়

জেনো,  তা যে মরণ আমার।

থাকি অপেক্ষায়

এ আঁধারে ভাবনার জগতে 

কত যে দুর্ভাবনা খেলা করে 

বয়ে চলে সর্বনাশের খেয়া বেয়ে,

উঠে এসে বসে ঘাড়ে এ মজা নদীর পারে, 

জীবন হারিয়েছে স্রোত, নদী মজে গেছে 

দুর্গন্ধ ছড়ায় আকাশে বাতাসে, 

সুগন্ধি ফুল মূর্চ্ছা যায় 

পাতা ঝরে পড়ে শীতের ঠান্ডায়।

তবু আমরা থাকি অপেক্ষায় 

শীত শেষে কখন বসন্ত আসে 

নতুন কিশলয় জীবন বনানী প্রান্তে 

নতুন ভাবনার উদয় আকাশে।

কথা 

রণেশ  রায়

কথাগুলো জটিল কথা তবু বলি তোমাকে

যদি তা মন্দ কথা ভুল বুঝ না আমাকে।

কিছু কথা বেশ  নরম কিছু  বড় রুক্ষ 

কিছু কথা মোটা  কিছু বড় সূক্ষ।

কিছু কথা স্বপনে কিছু কথা মরমে

কিছু কথা ধর্মে কিছু কথা কর্মে।

কিছু তার গাছে ফলে কিছু ফলে মগজে

কিছু বলে স্বজনে বলে কত সহজে।

কিছু বলে দেখে কিছু বলে শুনে

ক’টা কথা সত্যি নিও ঠিক গুনে।

কিছু কথা তরল তা ভাসে বাতাসে

কিছু কথা গরম জ্বলে যা আকাশে।

নিচু গলায় ছোট্ট কথা সে কথায় চমক

উঁচু গলায় বড় কথা সে কথায় ধমক।

কিছু কথা ক্লান্ত কিছু কথা শ্রান্ত 

কিছু কথা ভ্রান্ত কিছু কথা অভ্রান্ত ।

কিছু কথা আক্রোশে কিছু কথা ক্রোধে 

কিছু কথা অবোধে কিছু কথা বোধে।

কিছু কথা কিনে আনে অনেক খরচ করে

কিছু কথা ভেসে আসে খড়কুটো ধরে।

কিছু কথা প্রাঙ্গনে কিছু কথা অঙ্গনে

কিছু কথা প্রেম আমার জন্ম তার মনে।

কিছু কথা হৃদয়ের কিছু কথা মুখের 

কিছু কথা সুখের কিছু কথা দুঃখের ।

কিছু কথা মনে কিছু কথা বনে

শান্তির সে কথা পোড়ে না দহনে।

কিছু কথা বলে সে  নির্জনে

যদি দেখা পায় তোমার বিজন বিহনে।

যে কথা  আপন কথা রাখি তা তুলে

সে কথা কখনও যাই না যে ভুলে।

শুনতে চাই না যে কথা  অপ্রিয় সত্য

কানে তা মূর্ছা যায় সে কথা অকথ্য ।

কখনও কোন প্রিয় কথা আসে সন্তর্পনে

কানে কানে প্রেম কথা বসে বাতায়নে।

যে কথা কঠিন কথা আসে তা ধেয়ে

বলে যায় অপ্রিয় রাখে না লুকিয়ে।

শেষ কথা বলি দিয়ে শোন মন 

সব কথা বলতে নেই কিছু রেখো গোপন।

ও পথে যেও না তুমি আর 

সুপর্ণা স্বপ্ন বিলাস তোমার 

সুখস্বপ্নে বিভোর তুমি 

বিভ্রান্তি তোমার আজ, 

ঝাপসা আলোয় পথ চলা তোমার 

ভুল হাতে হাত ধরা 

খুঁজে পাবে না নিশান আর।

প্রিয়তমা, ও পথে যেও না আর 

ওই হাত ধরো না তার 

ওইখানে যেও নাকো তুমি 

ফিরে এসো তুমি সুপর্ণা আমার।

ওই মহাকাশে লক্ষত্র হয়ে জন্মাতে চেয়েছিলে

স্বপ্ন দেখেছিলে অবুঝ মননে

দেখনি তুমি অস্পষ্ট সে ছয়াপথে

কৃষ্ণ গুহা দাঁড়িয়ে পথ আগলে,

তুমি কি পেরেছিলে সঠিক পথে চলতে?

সুপর্ণা তুমি যেও না ওই পথ ধরে।

সুপর্ণা, ফিরিয়ে দাও তোমার সে সুখস্বপ্ন,

ফিরে এসো তুমি এই দুনিয়ায় 

কাঁটা বিছানো এই কণ্টক শয্যায়,

জানি আমি বাতাস দূষিত এ ধরায়

তবু ফিরে এসো তুমি 

ধর হাতে হাত সবার 

ফুল ফুটুক তোমার চেতনার গালিচায়, 

সুপর্ণা ওপথ তুমি ছাড় এবার 

নতুন সূর্য আমাদের অপেক্ষায়

নতুন পথে চলা আমার তোমার।

তাই তো আজও মিলি 

যদি জানতে  চাও

আমাদের দুজনের শৈশবের

কি মিল খুঁজে পাও

বলি আমি, সে যে সরলতা তখনের

হারিয়ে গেছে আজ তা, তাই তো 

তুমি আমি আলাদা, যে যার নিজের।

সে সরলতার আলিঙ্গন বন্ধনে

স্মৃতির খেয়া বেয়ে

বিস্মৃতির উজান ভেঙে

আজও এই বার্ধক্যের সায়াহ্নে

আমরা মিলি পরস্পর মননে।

তুমি আমি বন্ধু

ভাব গড়ে উঠুক ভাবনার অম্বরে 

তুমি আমি বন্ধু দুজনে 

বন্ধন আমাদের শিকড়ে শিকড়ে

ধর্মের কাঁটাতার ভেঙে মুক্ত সে দিগন্তে।

নতুন বাংলার খোঁজে

রমণী কোথায় তুমি

খুঁজে ফের কাকে ?

এ কোন বাংলার মুখ খোঁজ তুমি 

কোথা পাবে তাকে?

সেই সুদূর হিমালয় পাহাড় থেকে

সুন্দরবনের গরানের জঙ্গলে খুঁজেছ অনেক,

আকাশ পাতাল ঘুরেছ তাঁর খোঁজে 

খুঁজে পাওনি তাকে;

জানি আমি পাবে না তাকে আর,

বনলতা হারিয়ে গেছে কবে !

চলে গেছে সে নতুনের খোঁজে।

মনে তার প্রত্যয় বুকে স্পর্ধা

সে নতুন এক বাংলার মুখ দেখে,

যদি পেতে চাও তাকে

খোঁজ তাকে হৃদয় দুয়ারে,

ধর্ম বর্ণের বিভেদ ভুলে

নতুন বাংলার বুকে ঘুমায় সে।

 

যদি মনে পড়ে

হয় তো মনে নেই আমাকে

ভুলে গেছ

সেটাই যে স্বাভাবিক আজকে,

এত কিছুর মধ্যে

তুচ্ছ আমি,

বুদবুদের মত

দেখা দিয়ে মিলিয়ে যাই মুহূর্তে,

দাগ কাটে না মনে,

মনে থাকবে কি করে?

স্মৃতির দরজাটাও বন্ধ

সময়ের প্রবাহ অবরুদ্ধ

থমকে গেছে কোন এক মুহূর্তে

দেখা পাও না আর

দুর্বল এ স্নায়ু জগতে।

তাও যদি স্মৃতির দরজাটা 

খোলে একবার

 বিস্মৃতির উজান বেয়ে

পৌঁছে যাও স্মৃতির দুয়ারে। 

যদি মনে পরে আমাকে,

সৌভাগ্য আমার,

একান্ত নিরালায়

চলে এসো একবার

মুখোমুখি দুজনায়,

ফিরে যাব সেই অতীতে

শৈশবের খেলা ঘরে

কৈশোরের রহস্য পথে

যৌবনের স্পর্ধা ভরে, 

সেদিনের তোমার পায়ের নূপুর

বেজে উঠবে আমার শ্রবণে

সাড়া জাগাবে বার্ধক্যের মননে।

ঘৃণা আমার

চোখের জল পাথর হয়

আর আসে না কান্না

সাগর জজাহাজ ভাসে 

খুঁজে ফেরে পান্না।

নীল আকাশে ওড়ে ঘুড়ি

অচিন  দেশে যাত্রা

মেঘ ভেঙে বর্ষা নামে

শোন গো তার বার্তা।

জানি না আমি পান্না কোথায়

সাগর কন্যা মেয়ে

ভাসব আমি তোর দরিয়ায়

জীবন খেয়া বেয়ে।

হালে আমি পাই না পানি

জল নেই যে সাগরে

চোখের জল শুকিয়ে গেছে

ঘৃণা আমার বাসরে।

জীবানন্দ দাশ এর ‘ আকাশলীনা‘ কবিতার সৌজন্যে 

ধরনটা এক কিন্তু ভাবনাটা বিপরীত

ফির না আর 

সুকন্যা, ওইখানে চলে যেও তুমি, 

স্পর্ধা দেখাও তোমার একবার, 

ওই যুবকের সাথে যেও তুমি ওইখানে 

সুকন্যা, তুমি এই ভাগাড়ে ফির না আর।

সুকন্যা, জাননা তুমি? সমুদ্র গর্জায়

আকাশে মেঘ  আজ বর্ষায়, 

ফসল বুনতে যাও ক্ষেতের আঙিনায়

তুমি ফির না আর এই বেলায়।

সুকন্যা, যুবকের বুকে দেখ তুমি স্পর্ধা, 

খোঁজ  তাকে তোমার হৃদয় দুয়ারে, 

তোমার হৃদয়ে সিঞ্চিত হোক সে আস্পর্ধা 

বর্ষণ সিক্ত তুমি সোহাগে আদরে।

চলে যাও তুমি গরানের জঙ্গলে 

খুঁজে পাবে তাকে ওইখানে,

দানবের সঙ্গে বাঁচার যুদ্ধে, 

তুমি ফির না আর এই ভাগাড়ে।

ফির না তুমি আর এইখানে 

যুবকের সাথে মেল গিয়ে ওইখানে,  

তোমার বন্ধ দুয়ার ভাঙ  স্পর্ধা ভরে

নিজের ভাগ্য নাও তুমি নিজে গড়ে।

সুকন্যা, চলে যেও ওইখানে সময় ধরে 

নতুনের উদয় ওই আকাশে 

প্রলয় নাচন তুফানে বাতাসে,

সুকন্যা, তুমি ফির না আর এই কারাগারে।

সুকন্যা, তুমি বাঁচ নিজ সত্তায় 

যদি পাও তা যুবকের ভালোবাসায়,

সুকন্যা, তুমি ফির না আর 

যুবকের বুকে লিখে দাও তোমার অধিকার ।

সুকন্যা, আজ এই নবান্নের দুপুরে 

ফসল তোলার বেলা হলো যে 

যুবকের সাথে যেতে হয় ক্ষেতে 

ফসল তুলবে দুজনে হাতে হাত রেখে।

এলে তো মাত্র

কেন কর যাই যাই

এলে তো মাত্র

পাশে এসে বস  ভাই

কত না স্মৃতিকথা

তার যে শেষ নাই

সুখ দুঃখের ইতিকথা

কেঁদে ফেরে নীরব যাতনায়

কত না নীরব ব্যথা

ভাবি এস একত্রে দুজনায়

কোথায় এর সমাধান পাই!

 ভাবি এসো বসে নিরালায়

তারপর মিছিলে শ্লোগানে

কাঁধে কাঁধ রেখে

মিলি গিয়ে সকলের সনে

যে পথ গেছে বেঁকে

সে পথ ধরি দুজনে

যে পথ সত্যের সন্ধানে।

সাবধান

চট জলদি চলা

হাতে নিয়ে কলা

কত ভাবে বলা

কত না ছলাকলা

মুদ্রার রকমফের

দেখি আমি ঢের

লক্ষ্য যে একটাই

যদি সুযোগ একবার পাই

তাকে আমি ঠকাতে চাই

সাবধান! দিও না তাকে ঠাঁই। 

যদি দেখা পাই

তোমরা বল বুড়ো বয়সে ভীমরতি

হলোই বা তা

নিজেকে দিয়ে আহুতি

তাও আমি বলি আমার ব্যথা।

বসে আছি রেঁস্তোরার একটা টেবিলে

এক কাপ চা নিয়ে হাতে

কেউ নেই সাথে।

ওধারে আর একটা টেবিলে

কাকে দেখি বসে?

সবাইকে নিয়ে হট্টগোলে

কত না গুণগ্রাহী তাকে ঘিরে।

চিনেছি আমি তাকে

অনেকদিন পর এক অচেনা বেশে

বোধ হয় দেখেও দেখে নি আমাকে

অথবা হয়তো দেখেইনি এদিকে

 চেনে নি  এ অভাগাকে।

আমি পড়ি সংশয়ে

মন উসখুস করে

দেখা দেব কি পুরোন পরিচয়ে?

যদি না চেনে!

থাক তার থেকে ভালো থাকি চুপ করে।

মনে পড়ে সেদিনের কথা

সেই কৈশোর বেলা

প্রথম পরিচয়, বন্ধুত্বের ইতিকথা

ইতিউতি লুকোচুরি খেলা

কখনও বা লুকিয়ে রথ দেখা কলা বেচা।

তারপর সেই ভরা যৌবন

জ্যৈষ্ঠের দহন শ্রাবনের প্লাবন

শপথ প্রতিশ্রুতি পরস্পরে

চলি আমরা নিশান হাতে

একে অপরের হাত ধরে

চড়াই উৎরাই পথে

পৌঁছতে হবে উদয়ের ভোরে।

কি জানি আজের যৌবনের শেষে

ফুরিয়ে গেছি

চিনবেই বা কেন এ বার্ধক্যের বেশে

আমার এ গোধূলি লগনে

আমি বসে নির্জন সমুদ্র তটে।

জানি আমি তারও বয়েস হয়েছে

তাও সে আজও এক যুবতী,

আমি চুপ করে থাকি

যদি অনুগ্রহ তার আমার প্রতি।

আমি থাকি অপেক্ষায়

অমাবস্যার শেষে চাঁদ আকাশে

যদি দেখা পাই তার রাতের জ্যোৎস্নায়।

আমরা ঘুমাই

সারাদিন জ্বলতে জ্বলতে

মোমবাতিটা ফুরিয়ে গেছে

অসময়ে জ্বলে  সন্ধ্যা না হ’তে

সূর্য অস্তমিত পশ্চিম দিগন্তে

আঁধার নামে ঘরে

সাঁঝের বাতি জ্বলে না আর

আমরা ঘুমিয়ে কৃষ্ণ গহ্বরে

স্থায়ী হয় এ আঁধার।

কোথায় লুকোবে

কত আর আড়াল রাখবে?

রাখতে পার 

অন্যের কাছে নিজেকে আড়ালে,

তাও কিছুদিনের জন্য,

কিন্তু নিজের কাছে নিজেকে,

পারবে কি আড়াল করতে?

উলঙ্গ তুমি নিজের কাছে

ঠিক নদী যেমন সমুদ্রের কাছে।

কিছুই থাকে না ঢাকা

তোমার যা কিছু গোপন

গোপন সে পরের কাছে

কিন্তু তোমার হৃদয় আকাশে

উন্মোচিত সব তার কাছে

যত চাইবে নিজেকে আড়াল করতে

ততই তুমি নগ্ন নিজের মন জগতে।

চেষ্টা কর না আড়াল করতে

বরং খুলে দাও আগল হৃদয় দুয়ারের

চেষ্টা কর না রোদ্দুরের প্রবেশ রুখতে

লুকিয়ে থেকো না কৃষ্ণ গহ্বরে 

নিজেকে তুলে ধর সবার মধ্যে

খুঁজে পাবে নিজেকে আলোর সরোবরে।

আমার বসন্ত

গ্রীষ্মের জ্যৈষ্ঠের দুপুর বেলায়

সে কোন দানব !

সূর্যটাকে নিংড়ে নিয়ে আগুন ঝরায়।

বর্ষার নৈশ রাতে

আকাশ থেকে নেমে আসে মেঘদূত,

তার বিরহ কান্নায়

দুচোখে অশ্রু ঝরে আকাশে;

 শরতের শুভ্র ভোরে

সৌরভ ছড়ায় বাতাসে

ঝর্ণা নেমে আসে কল কল রবে।

হেমন্তের উজ্জ্বল রোদে

সোনালী ধানের হাসি উপচে পড়ে,

শীতের হারকাঁপানো রাতে

বনানী ধূসর, গাছের পাতা ঝরে;

বসন্তের আগমনে আমি অপেক্ষায়

কখন ফুল ফোটে নতুন এ ভোরে।

ঋতু চক্র

রণেশ রায়

  

প্রকৃতি কন্যা আমার এ স্বদেশ 

মৌসুমী  বৈচিত্রে বৈচিত্র তার

রামধনুর সাত রঙে রাঙায় নিজেকে

বৈশাখী ঝড়ের চুম্বন তার মাথায়

জ্যৈষ্ঠের দহনে দাবানল হয়ে জ্বলে

জলসিঞ্চন তার শ্রাবনের ধারায়

 অগ্রাহানের সকালে ফুলের সৌরভ

মাঘের ঠান্ডায় পাতা ঝরে যায়

ফাগুনে আবার সেজে ওঠে নতুন পাতায়।

ভোরের কলি

ভোরের কলি অপেক্ষায় 

রাত কেটে গেলে

ফুঁটবে সে  উদয় বেলায়

কিন্তু রাত শেষে অন্ধকার গভীর হয়

মেঘের আড়ালে সূর্য মুখ লুকায়

বাতাস বয় না আর 

 ফোঁটা হল  না তার।

আবার সে অপেক্ষায়

দিন শেষে সাঁঝের বেলায়

যদি পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্না দেখা দেয়

দূর হয় এ আঁধার

ফুঁটবে সে রাতের জোৎস্নায়।

পাবে না তাকে

রণেশ রায়

আর জন কোলাহলে পাবে না তাকে

প্রিয়জনের থেকে  দূরে বহুদূরে

সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে 

সে চলে গেছে আঁধারের নিরালায়

সরিয়ে নিয়েছে নিজেকে একান্তে

প্রকৃতি মাঝে সে থাকে নিজ সত্ত্বায়

কখনও জঙ্গলে বিজনে

কখনও বা পাহাড়ের চূড়ায়

কোন সে অতলে একাকিত্বের নিঃসঙ্গতায়।

রবীন্দ্রনাথের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার অনুপ্রেরণায়

যাত্রাপথে

রণেশ রায়

জীবন যাত্রার পথে

হঠাৎ দেখা দুজনে 

কোন এক রেলগাড়ির কামরায়

দেখা পরস্পর স্বজনে, 

সে বসে বিপরীত বেঞ্চিটায়

কত না গুণগ্রাহী তাকে ঘিরে;

অনেকদিনের সে অপেক্ষা 

আমি বসে দোটানায়

হয়তো মিটবে সে তিতিক্ষা।

আগে ও এসেছে কচি সবুজ শাড়িতে

এই অভাগার মানস তটে,

যেন ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত

কচি ঘাসের মাথায় শিশিরবিন্দু

জ্বল জ্বল করে, অপেক্ষারত

বাষ্প হয়ে কখন উড়বে

আকাশে সূর্যের সঙ্গে মিলবে।

 আজ দেখি ওকে সাদা বুটি তোলা কালো শাড়িতে 

ফুটে উঠেছে বয়সের গাম্ভীর্য পাহাড়ের প্রত্যয়

সে প্রত্যয় লেখা থাকে জীবনের শেষ প্রান্তে। 

আমি মূক হয়ে থাকি  আনমনে,

ভরসা পাই না চিনতে,

ভয়ে থাকি, সে যদি না চেনে !

লজ্জা পাই তার দিকে তাকাতে,

ভাবি স্তব্ধতাই সবচেয়ে ভালো;

যে ক্ষত বয়ে চলি চিরন্তন

রক্তক্ষরণ সেখান থেকে

স্তব্ধতাই তার নিরাময়

বন্ধ হবে রক্তক্ষরণ।

জাবর কেটে চলে স্মৃতি

বিস্মৃতির সমুদ্র মন্থন

যৌবনের সেই রঙিন সন্ধ্যা

অতীতের কত না সাতকাহন,

পথ ধরে হেঁটে চলা

নির্জন পার্কে মজলিস দুজনে

সময় কাটে একান্ত নিভৃতে

গ্রীষ্মের মধ্য গগণে সূর্যের দহনে,

নেয়ে উঠি দুজনে

ভবিষ্যতের ছবি এঁকে চলি

সমুদ্রের বালু তটে,

বাধি বালির বাঁধ, 

তারপর! দুটি পথ দুদিকে।

মনে হয় আমাকে দেখেছে

দেখেও না দেখার ভঙ্গিতে,

সে আমাকে আজ থোড়াই পোছে

যদিও বসে বিপরীতে,

নিজেকে রাখতে চায় আলো আঁধারে

এক কুহেলির আড়ালে।

তাকে চিনি নি কোন দিন,

জানি না কোথায় তার যাত্রা শেষ

কোন ইস্টিশনে সে নামবে,

তাও আমার কৌতূহল তাকে ঘিরে 

সে কৌতূহল ঘিরে থাকে তার পরনের শাড়িতে

শিরিষের মাথায় ভোরের শিশিরের নাচনে

অথবা আকাশের নিলাঞ্জনে

সে আজও আমার কুহেলিবনে।

স্টেশনের পর ষ্টেশন চলে যায়

কথা নেই দুজনায়

নিরুদ্বেগ তার, উদ্বেগ আমার

আমার নামার সময় হল বলে এবার,

তবে কি নিরর্থক রয়ে গেল এ অভিসার!

পুরোন ব্যথাটা যেন গুমরে মরে

রক্তক্ষরণ সে ক্ষতে আবার।

স্টেশন এসেছে, আমি উঠি নামব বলে

হঠাৎ ই সে চিনতে পারে সেই পুরোন আদলে,

জ্বলে ওঠে আলো রাতের জ্যোৎস্নায়

আমায় হাত নেড়ে দেয় বিদায়,

আমার মনে হয় এই বিদায় কালে,

‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশে সূর্য আজও হাসে

নিজেকে লুকিয়ে মেঘের আড়ালে’।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *