যৌনাচার যে দেশে হাজার বছরের প্রথা – সিদ্ধার্থ সিংহ
দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাউইয়ের দক্ষিণের উপজাতি গ্রামগুলোতে এখনও রয়েছে এক অদ্ভুত প্রথা।
মেয়েরা প্রথম ঋতুমতী হলেই ওখানকার মেয়েদেরকে একজন পুরুষের সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভাবে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। এর বিনিময়ে আবার সেই পুরুষকে অর্থও দিতে হয়। এই প্রথাকে বলা হয়— ‘কুসাসা ফুম্বি’। সোজা বাংলায় ‘শুচিকরণ’। এই গোষ্ঠীর মানুষদের ধারণা, এই প্রথার মধ্য দিয়েই শুদ্ধ হয় কিশোরীরা।
আবার কোনও মহিলার স্বামী মারা গেলে, সেই স্বামীর দেহ সমাধিস্থ করার আগেই ওখানকার রীতি অনুযায়ী সেই বিধবাকে ‘শুদ্ধ’ হওয়ার জন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করতে হয়। সে যদি গর্ভবতীও হয়, তা হলেও। এটাকে বলা হয়— ‘কুলোয়া কুফা’।
আর এই প্রথাটাকেই ওখানে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বলে গণ্য করা হয়।
তবে যে কোনও পুরুষের সঙ্গেই যে এটা করা যাবে, তা কিন্তু নয়। এর জন্য বাঁধাধরা কিছু লোক আছে। স্থানীয় ভাষায় তাদের বলা হয়— হায়না।
ওখানকার স্থানীয় লোকেরা বলে, এই প্রথা নাকি হাজার বছরেরও পুরনো।
মালাউইয়ের দক্ষিণের জেলা নাসানজেতে খোঁজ পাওয়া গেছে একজন হায়নার। মধ্যবয়স্ক সেই লোকটির নাম এরিক আনিভা। তার দুই বউ এবং পাঁচ ছেলেমেয়ে।
তিনি নিজেই বলেছেন, এখানকার চিরাচরিত নিয়ম মেনেই আমি এখন পর্যন্ত মোটামুটি ১০৪ জন কিশোরী এবং বিধবার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছি। তাবে বিধবার চেয়ে কিশোরীর সংখ্যাই বেশি এবং তাদের বেশির ভাগই স্কুলের মেয়ে। কোনও কোনও মেয়ের বয়স তো খুব বেশি হলে ১২ কি ১৩।
তবে, যেহেতু শারীরিক সংসর্গের সময় মেয়েদের চোখ বেঁধে দেওয়া হয়, তাই মেয়েরা জানতেও পারে না কোন হায়নার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক হল।
কোনও মেয়ের প্রথমবার ঋতুস্রাব হওয়ার পর শিশু থেকে তার যৌবনে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রমাণ হিসেবে পর পর তিন দিন তাকে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে হয় হায়নাদের সঙ্গে। কোনও মেয়ে যদি এই কাজে আপত্তি করে, তা হলে ধরে নেওয়া হয়, ওই মেয়েটির পরিবার বা তাদের জনগোষ্ঠী কিংবা তাদের গ্রামের জন্য নির্ঘাত কোনও মহামারী অথবা ভয়ঙ্কর কোনও দুর্যোগ অপেক্ষা করে আছে।
সামাজিক রীতির অজুহাত দিয়ে তাদের যে শুধু এ রকম ভয়ই দেখানো হয় তাই-ই নয়, রাতের অন্ধকারে চুপিসারে তাদের উপরে নেমে আসে সমাজপতিদের নানা অত্যাচারও।
এ প্রসঙ্গে মারিয়া নামের একটি মেয়ে জানিয়েছে, ‘আমার আর কোনও উপায় ছিল না। আমার মা-বাবার কথা ভেবেই আমাকে হায়নার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক মেনে নিতে হয়েছে। আমি যদি রাজি না হতাম, তা হলে সমাজপতিরা আমার পরিবারকে সামাজিক ভাবে বয়কট করত। একঘরে করে দিত। কিংবা যে কোনও মিথ্যে অভিযোগে সালিশি সভা ডেকে আমাদের এমন অর্থ জরিমানা করত, যা আমাদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব না কিংবা আমাকে এবং আমার মাকে ন্যাড়া করে দিত। ওরা এ সবই করে।’
আনিভা জানিয়েছে, তাদের এলাকায় তার মতো আরও জনাদশেক হায়না আছে। প্রতিবার শারীরিক সংসর্গ করার জন্য তাদের রেট চার থেকে সাত ডলার। তবে শুধু শারীরিক সম্পর্কই মেয়েদের শুদ্ধ হওয়ার মূল চাবিকাঠি নয়। এটা এই প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ।
এর আগে আরও অনেকগুলো নিয়মকানুন আছে। প্রথমে সদ্য ঋতুমতী হওয়া মেয়েদেরকে জঙ্গলের মধ্যে একটি ডেরায় নিয়ে যায় গ্রামগুলোর কয়েক জন বয়স্কা নারী। তার মধ্যে ওই মেয়েটির মা, মাসি, পিসিরাও থাকে।
সেখানে একজন পুরুষকে কী ভাবে যৌন আনন্দ দিতে হয়, সে সব কলাকৌশল বেশ কয়েক দিন ধরে তাদের শেখানো হয়। তার পরে আসে একজন হায়নার সঙ্গে তাদের শারীরিক মিলনের ব্যাপার। আর মেয়েদের এই শুদ্ধ হওয়ার পুরো ব্যবস্থাটার আয়োজন করে মেয়েটির পরিবারই।
এ সব করার আগে কিন্তু অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ রোধ কিংবা রোগের সংক্রমণ এড়ানোর জন্য কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয় না। তাই এই উপজাতির সদ্য ঋতুমতী এবং বিধবা মহিলাগুলো হামেশাই ভয়ানক যৌনরোগে আক্রান্ত হয়।
অবশ্য এই প্রথার বিরুদ্ধে বেশ কিছু দিন ধরেই লড়াই করে চলেছেন এক মানবাধিকার কর্মী— নাতাশা অ্যানি টনথলা। তাঁর উদ্যোগেই ২০১২ সালে এই সব প্রথা নিয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তার পরেই নড়েচড়ে ওঠে প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে ধরপাকড় শুরু হয়। এবং তখনই জানা যায় আরেকটি ভয়ংকর তথ্য।
আনিভা এইডস রোগে আক্রান্ত। আর এইডসে আক্রান্ত হওয়ার পরেও এত দিন ধরে কাউকে কিছু না বলে অবাধে ও অসুরক্ষিত অবস্থায় সে শারীরিক সংসর্গ চালিয়ে গেছে।
এই প্রথা যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে তাই কারও একা বা গুটিকতক লোকের পক্ষে এই প্রথাটাকে বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তবে এটা জানাজানি হওয়ার পরে মালাউই সরকার তাদের দেশের এই প্রথার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। স্বয়ং মালাউলের প্রেসিডেন্টের আদেশে আনিভাকে গ্রেফতার করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে এবং বাকি হায়নাদের খোঁজেও চিরুনি তল্লাশি চলছে।