যে রহস্য উদঘাটন হয়নি আজও – সিদ্ধার্থ সিংহ

প্রচণ্ড তুষারপাত হচ্ছে, তার সঙ্গে হাঁড় কাপানো শীতল বাতাস হু হু করে বইছে। গায়ে যতই গরম পোশাক থাকুক, সে সব ভেদ করে যেন শুধু শরীর নয়, শরীরের ভিতরের হাড়গোড়ও জমিয়ে দিচ্ছে। তাই আর এক পা-ও না এগিয়ে তড়িঘড়ি ‘মৃতদের পাহাড়’-এর ঢালে তাঁবু গেড়েছে ন’জন অভিযাত্রী।

গা ছমছম করা চারিদিক। কারা যেন আশপাশে ঘুরছে। রাতের অন্ধকারে কানে এসে পৌঁছচ্ছে অশুভ আতঙ্কের ফিসফিসানি। হঠাৎ তাঁবু ছিঁড়ে পাগলের মতো বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা।

মৃত্যু তাড়া করেছে তাঁদের। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ওই ভয়ঙ্কর দুর্যোগের মধ্যেই যে যে-দিকে পারলেন প্রাণপণে দৌঁড়তে শুরু করলেন রুদ্ধশ্বাসে। কিন্তু মরণ ঠেকানোর সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হল তাঁদের। কারও মৃত্যু হল ঠাণ্ডায় জমে গিয়ে, কারও বুকের পাঁজর ভেঙে-গুঁড়িয়ে, আবার কারও মাথার খুলি ফেটে গিয়ে।

আজ থেকে প্রায় ছয় দশক আগে, রাশিয়ার বরফঘেরা ‘ডেড মাউন্টেন’ পর্বতে ঘটেছিল এই নির্মম ঘটনা। সময়টা ছিল ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিক।

রাশিয়ার তৎকালীন স্ফের্দোলোভস্ক শহর থেকে ওই অভিযাত্রীরা বেরিয়ে পড়েছিলেন উরাল পর্বতমালার উদ্দেশ্যে। বরফের মধ্যে অভিযানের জন্য স্কি করার সাজসরঞ্জাম-সহ যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েই বেরিয়েছিলেন তাঁরা।

মোট ন’জনের ওই দলে ছিলেন দু’জন নারী আর সাত জন পুরুষ। তাঁদের মধ্যে দু’জন ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ আর বাকি সাত জন শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থী মানে একেবারে আনকোরা নয়, তার আগেও বেশ কয়েকটি পর্বতাভিযানের অভিজ্ঞতা ছিল তাঁদের।

কিন্তু প্রত্যকের ভাগ্যেই সে রাতে অপেক্ষা করে ছিল ভয়ানক এক রহস্যময় মৃত্যু।

তাঁরা নিখোঁজ হওয়ার কয়েক মাস পরে, আবহাওয়া একটু থিতু হলে, বেশ কয়েক দিন ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে তাঁদের মৃতদেহগুলো খুব অদ্ভুত অবস্থায় উদ্ধার করে একটি রেসকিউ দল। ৩ জন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন আর বাকি ছ’জন ১৫ ফুট বরফের নীচে।

তাঁদের যে গর্তে পাওয়া গিয়েছিল, সেটা দেখে অনুমান করা হয়, সেটা তাঁরা নিজেরাই নিজেদের জন্য খুঁড়েছিলেন। তাঁদের গায়ে অনেকগুলো করে আঘাতের চিহ্ন ছিল। পোস্টমর্টেমে ধরা পড়েছিল তাঁদের হাত-পায়ের হাড় ভাঙা। ছিল অভ্যন্তরীণ আঘাতও।

কিছু মৃতদেহের গায়ে কাপড় ছিল, আবার কিছু দেহ ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন। একজনের জিভ আর একজনের চোখ ছিল না। কেউ যেন উপড়ে নিয়েছিল। ওই রকম একটি দুর্গম জায়গায় কেন এবং কী ভাবে তাঁদেরকে এই ভাবে হত্যা করা হয়েছিল সেটি আজও রহস্য।

সেই পাহাড়ের যে গিরিপথ ধরে ওই ন’জন অভিযাত্রী এগিয়ে গিয়েছিলেন মৃত্যুর দিকে, তাঁদের দলনেতা ইগর দিয়াতলোভের নামানুসারেই এখন সেটার নাম দেওয়া হয়েছে— ‘দিয়াতলোভ পাস’ বা ‘দিয়াতলোভ গিরিপথ’।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *