যদি – শম্পা সাহা

আজকের ইন্টারভিউটা ফেল করলে কিছুতেই চলবে না। বয়স বাড়তে বাড়তে ত্রিশের কোটায় ,প্রথমদিকে হাতে টিউশনের হাজার দশেক টাকা আসাতে প্রশান্ত ভেবেছিল চাকরীর চেষ্টা করার দরকার নেই, বাবার মাইনেটা ছিল। দিদির বিয়েটা বাবা থাকতেই দিয়ে গেছেন। সেজন্য অবশ্য মনে মনে বাবার প্রতি ও কৃতজ্ঞ। কিন্তু বাবা মারা যাবার পর ফ্যামিলি পেনশনটা থাকলেও তাতে সংসার চালানো একটু চাপের । তার ওপর বয়স বাড়ছে ,সঙ্গীতা বারবার বিয়ের জন্য তাগাদা দেয়।টিউশনিটা ভবঘুরে জীবনের সাহারা হতে পারে ,কিন্তু বিবাহিত জীবনের নয়। তবে থেকেই ও চাকরির জন্য মনোযোগী হয়ে ওঠে। 

    ঠিক সকাল ন’টায় খেয়েদেয়ে, ইস্ত্রি করা ফরমাল পোশাকে পা বাড়ায় অফিসের দিকে । ইন্টারভিউটা বেলেঘাটা ফুলবাগান মোড় এ বাটার শোরুম এর ওপরে ,একটা ইলেকট্রনিক্স  কোম্পানির ডেস্ক জব ,স্টার্টিং স্যালারি পনের হাজার দেবে। অ্যাড দেখে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লাই করেছে।এখন অনলাইনে খুব সুবিধে ,সব ঘরে বসেই হয়ে যায় । 

    বাসে উঠে একটা সিট পেয়ে বসে গেল প্রশান্ত। মৌলালী থেকে ফুলবাগান খুব বেশি হলে মিনিট চল্লিশেক। ক্যাবে অনেক ভাড়া আর দূরত্ব ও এমন কিছু নয় । ওর সামনেই শিয়ালদহ থেকে উঠলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক । পোশাক আশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে গ্রাম্য। হাতে একটা প্লাস্টিকের ঢাউস ব্যাগ, ভালো দাঁড়াতেও পারছেন । ঝাঁকুনি  দিলে বারবার হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন ওর ঘাড়ের উপর। 

    হঠাৎই বাসটা বরফ কলের সামনে এসে দাঁড়াতে ভদ্রলোক উপুড় হয়ে পড়লেন প্রশান্তর ওপর। “একটু সোজা হয়ে দাঁড়ান না”,পোষাকের ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠে ও। ইন্টারভিউতে পোশাক একটা ফ্যাক্টর । কিন্তু ভদ্রলোক উঠছেন না কেন? তাড়াতাড়ি  ওনাকে বসিয়ে দেখে, নাঃ, শ্বাস চলছে ,মারা যাননি। মুখে চোখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা হলেও চোখ খুললেন না। একবার তাকিয়ে আবার বুজে ফেললেন ,বোঝা গেল প্রচন্ড যন্ত্রণাতে কষ্ট পাচ্ছেন ,তার  ছাপ মুখে চোখে স্পষ্ট। 

   অফিস টাইম, সবাই সামান্য কৌতূহল, তারপর সহানুভূতি দেখিয়ে যে যার গন্তব্যে নেমে যেতে লাগল। মুখে অনেকেই বলল ,”হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে “,কিন্তু কেউ যেতে রাজি হল না । যেহেতু উনি প্রশান্তর গায়ের উপর পড়েছেন তাই দায় যেন ওর একার । প্রশান্ত দুচারবার চিন্তিত মুখে ঘড়ির দিকে তাকালো তারপর  ত্রি কোণ পার্কের  স্টপেজে  ভদ্রলোককে পাঁজাকোলা করে নিয়ে নেমে গেল বাসস্ট্যান্ডের কাছের নার্সিংহোমে। ওর তখন মাথায় ঘুরছে, ” বাবার তো এই বয়সই ছিল। ওনাকে যদি ট্রেনে স্ট্রোক হবার পর ঠিক সময়ে কেউ হাসপাতালে নিয়ে যেত তাহলে হয়তো উনি আজও আমাদের মধ্যে থাকতেন। “

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *