ম্যসেঞ্জারে প্রতিদিন গাদাগাদা ছবি, শুভেচ্ছা আসে। কোনটাই দেখি না। স্ক্রল করে এড়িয়ে যাই বড়জোর ঘনিষ্ঠ কেউ হলে একটা অনিচ্ছাকৃত লাইক মেরে দিই।
আজ সকালে একটু ব্যতিক্রম ঘটলো। স্ক্রল করতে গিয়ে দেখলাম এরিনা নামের এক মহিলা টাইপে লিখে সাত লাইনের একটি ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
আবার উপরে বড় বড় করে লেখা- “অতি অবশ্যই পড়বেন”। লেখাটিতে মনোযোগ দিতে বাধ্য হলাম :-
“অতি অবশ্যই পড়বেন ———————————-আমাকে হয়তো মনে নেই। না থাকারই কথা। আপনার বন্ধুর সাথে আমার সঙ্গে তিনবার মাত্র দেখা হয়েছিল, তখনই ফেসবুকে আমি রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম আর আপনি একস্পেটও করেছিলেন। বন্ধু আর নেই। আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন, ঠিকানা দিলাম। আসলে কথা হবে”।
গভীর চিন্তায় পড়ে গেলাম। কে এই নারী —এরিনা? আমার বন্ধু মারফৎ ?মাথা কাজ করছিল না। কিছু মনে করতে পারলাম না। কে এই এরিনা? আর কে আমার এই বন্ধু? যে নেই ?
তাড়াতাড়ি নিজের কাজে লেগে গেলাম।অফিস যেতে হবে। সেভ করে বাথরুমে ঢুকলাম। স্কুলের টিচার একবার বলেছিলেন বড় বাথরুমেই নাকি স্মরণ ভালো আসে। তাই চেষ্টা করলাম। অন্য চিন্তা এলো। ম্যাসেজে তো ঠিকানা দেয়নি!
বাথরুম থেকে বেড়িয়েই মোবাইলটা আবার দেখলাম, হ্যাঁ এবার ঠিকানাটা পাঠিয়েছে। ঠিকানাটা টালিগঞ্জের।
যাহোক অফিস আর নানান কাজে দিনটা কাটালাম কিন্তু মনটা খচখচ করতে থাকলো এরিনা নাম মনে করার জন্য। প্রচন্ড ভিড় ট্রেনে যখন বাড়ি ফিরছি তখন নিউ মার্কেটের এক টেলারিং দোকানের কথা মাথায় এল – এরিনা টেলার্স। নিমেষে বন্ধু সনাতনের নাম চলে এল মগজে। টেলারিং দোকানের মালিকের কথা মনে এল আর মনে পড়ে গেল ওর এক মেয়ে ছিল -যার নাম ছিল রিনা। তা প্রায় ত্রিশ বছর আগের কথা। মনে পড়ে গেল আমি সনাতনের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ওই দোকানে গেছিলাম। মেয়েটি বেশ ফাজিল ছিল -চোখমুখ বেশ কাটাকাটা।যেচে কথা বলতো।ওর বাবা খুব ভাল ছিল তাই দুবার প্যান্ট বানিয়েছিলাম, ভাল হয়নি।
আমি একবার এই দোকানের এরিনা নামটার ব্যাখ্যা চেয়েছিলাম তাতে ওই ভদ্রলোকটি জানিয়েছিল ওর স্ত্রীর নাম অশোকা আর মেয়ে রিনা এই দুই মিলে “এরিনা”।এরপর সনাতন আর আমার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়, আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সনাতন আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুই ছিল, হঠাৎ মহিলাদের প্রতি ওর আকর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় ও আমাকে এড়িয়ে চলে, আমি প্রথম কয়েকবার চেষ্টা চালিয়ে নিরাশ হয়ে ওকে ছেড়ে দিই। আজ ত্রিশ বছর পর ঐ রিনা ফেসবুকে আমায় পেয়ে ম্যাসেঞ্জারে এরিনা নামে আমায় ডাকছে। অবাক কান্ড!
যখন মিলে গেছে তখন আগামীকাল শনিবার অফিস ফেরত একবার টালিগঞ্জে ঢুঁ মারা যেতেই পারে, যখন এক মহিলার গন্ধ আছে। উপেক্ষা করা যাচ্ছে না।
পরদিন পৌচ্ছাতে বিকাল চারটে বেজে গেল।জায়গাটা নামে টালিগঞ্জ আসলে বাঁদিকে ঢুকে গড়িয়া যাওয়ার পথে, তাও অনেক গলির ভিতরে।পুরানো বাড়ি, টোক্কা মারলাম গ্রীলের দরজায়। এক বয়স্ক ক্ষীনজীবি ব্যক্তি লুঙ্গি পরে গামছা গায়ে বেড়িয়ে এল — কাকে চাই?
— এখানে রিনা নামে কেউ থাকে?
লোকটি আমাকে গ্রাহ্য না করে — এই দ্যাখ তোকে কে খোঁজে — বলেই গ্রীল খুলে বেড়িয়ে চলে গেল।
আমি অপেক্ষা করছি। তাঁতের একটা পুরানো শাড়ি পরিহিতা এক মহিলা বেরিয়ে এল, — আচ্ছা আপনিই কি —-?
আমি ঘাড় নাড়লাম। উনি আশ্বস্ত করলেন। — হ্যাঁ, আমিই রিনা মালাকার। আমিই আপনাকে ডেকেছি। আসুন ভিতরে আসুন।
আমি ভিতরে গেলাম। দৈন্যতা প্রকাশিত। আমি অনুভব করার আগেই উনি বললেন — আমাকে চিনতে পারছেন না তো?
আমি সময় নিলাম। পরে জানালাম — অনেক চেষ্টা করে মনে করতে পেরেছি। কারণ আমার বন্ধুর সঙ্গে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। যাক আপনার বাবা কোথায়?
রিনা কিছুক্ষণের জন্য আমাকে দেখলো। একটা প্লাস্টিকের চেয়ার এগিয়ে দিল। আমি বসলাম। ও জানালো — বাবা মারা গেছেন ১৫ বছর আগেই। আর আপনার বন্ধু গেলেন গত মাসে।
আমি চমকে উঠলাম — সে কি? সনাতন মারা গেছে?
হ্যাঁ। ব্রেন টিউমারে।
আমি চুপ করে গেলাম। রিনা বলে চললো — সনাতন আর আমি বিয়ে করি। তা প্রায় বিশ বছর আগে। সন্তান হয় নি। বছর দুই আগে ওর মাথা যন্ত্রনা শুরু হয়। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর রোগ জানা যায়। অনেক চিকিৎসা হয়। সব পয়সা খরচ হয়ে যায় ,তবুও বাঁচানো যায় নি। এখন আমি ভিখারী।
আমি স্তব্ধ। রিনাও চুপ মেরে গেল। ওর চোখে জল।ভাবলাম কি ফ্যাসাদেই না পড়লাম।এখন আমি কি করবো। কেনই বা আমায় ডাকলো?, তার ভয়েই অপেক্ষা করছি।
কিছুপরেই রিনা আঁচলে চোখ মুছে বললো — সনাতন কষ্ট সহ্য না করতে পেরে আত্মহত্যা ও করতে চেয়েছিল ,পারেনি। ইচ্ছামৃত্যু তো আর এদেশে চালু হলো না তাই, উপায় ও ছিল না।
এরই মধ্যে একটু আগেই দেখা বুড়ো লোকটি ভিতরে চলে এল, পরনে লুঙ্গি আর গায়ে গামছা।রিনা একটু নিজেকে সামলে নিল , জানতে চাইল — কি চা খাবেন তো?
এই নিদারুণ অবস্থা দেখে কি করে চা খেতে চাই, তাই না করলাম। রিনা র ইশারায় বুড়ো লোকটি বেড়িয়ে গেল।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম — কে ইনি?
— ওই তো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এই বাড়ির মালিক। বউ মারা গেছে। আমার প্রতি প্রথম থেকেই আকৃষ্ট ছিল, এখন পুরো সুযোগ নিচ্ছে।
— কি বলছেন? এই বুড়ো লোকটি?
— হ্যাঁ, হ্যাঁ বুড়ো হলে কি হবে? ওর প্রচুর পয়সা আর কিছু ক্ষমতা আছে। আমার আর কিছু করার ছিল না, আমি ওর দয়াতেই বেঁচে আছি।
— সে কি? তার মানে?
— বলতে লজ্জা লাগছে, বলতে বাধ্য হচ্ছি পেটের তাগিদে, আদিমতা গ্রাস করেছে শুধুমাত্র জৈবিক ক্ষুধা মেটানোর জন্যই ও আমার সাহায্যদাতা।
আর কিছু বলার নেই। রিনা গ্রাজুয়েট। আমার কাছে আবেদন রাখলো — যদি একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেন ,তাহলে এই নরক যন্ত্রনা থেকে বাঁচি। আপনাকে ডেকেছি এই সব দেখাতে ও বোঝাতে।
কথা দিইনি, কিন্তু সাধ্যমতো চেষ্টা করবো জানিয়ে বেরিয়ে এলাম।
ওদের গলির মুখে আর এক বন্ধু শ্যামলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পুরোনো বন্ধু বহুকাল বাদে দেখা, ও আবার এখানেই বাড়ি করেছে। ও জানতে চাইলো আমার এখানে আসার কারণ। ওকে সব কথা বললাম। সনাতন আর রিনার গল্প। সনাতনের মৃত্যু সংবাদ। ও সনাতনকে চিনতো না। সব শোনার পর দেখি শ্যামল হাসছে।
আমি জানতে চাওয়ায় ও বললো — অবাক হয়ে গেলাম তোর কথা শুনে, ওই মহিলা তোকে মিথ্যা কথা বলেছে। স্বামীর টাকা নয়ছয় করেছে, চিকিৎসার নামে স্বামীকে মেরে ফেলেছে, বাড়িওয়ালা ওর শ্বশুরের বন্ধু,একজন যৌন ব্যবসার দালাল, আসলে ওই মহিলাও এক দুশ্চরিত্রা। স্বামী এইসব জানার পর অসুস্থ হয়ে পড়ে, আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল, শারীরিক অসুস্থতা এতই বেশি ছিল যে সেই ক্ষমতাও ওর ছিল না। আর সেই সুযোগই কাজে লাগায় এরা দুজন। এটা ইচ্ছামৃত্যুও নয় আবার আত্মহত্যাও নয়, স্রেফ একটা সুপরিকল্পিত মার্ডার!
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কতরকমই না ম্যাসেজ আমাদের কাছে আসে, একটা থেকে আরএকটা, ভেবে আর যাচাই করতে জান কয়লা হয়ে যাওয়ার জোগাড়, হয়তো এভাবেই নিজেই কোনদিন ” ম্যাসেজ ” হয়ে যাব।
ফেরার পথ ধরলাম।
প্রদীপ দে
বিরাটী আবাসন
নিমতা -৭০০০৪৯
