– – দুই – –
তৃতীয় কেসের সাসপেক্ট তেমন কেউ নেই। মেয়েটি অনাথ। সরকারি হোমে মানুষ হয়েছে। ইদানিং একটা টিউটোরিয়াল হোমে চাকরির জন্য কোচিং নিচ্ছিল মেয়েটি। কোচিং সেরে হোমে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায় । সেদিন সেদিনও কোচিং হতেই ফিরছিল।
এরপর অনেক রাত পর্যন্ত হোমে না ফেরায় হোমসুপার পুলিশে খবর দেন। পুলিশ লাশটা পায় একটা পার্কের মধ্যে। খুনের পদ্ধতি একই। মাথাটাকে একটা প্লাস্টিকে ভরে দম আটকে মারা হয়েছে। তবেসেদিন আশ্রমের সামনে একটা ছেলেকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে।
বিক্রম হোমের সিকিউরিটি গার্ডকে ঈশানের ছবিটা দেখাতেই সিকিউরিটি ছবিটিকে সনাক্ত করে বলল, “হ্যাঁ স্যার, এই ছেলেটাই হোমের সামনে ঘোরাঘুরি করছিল। আমি বার দুয়েক তাড়াও করেছি।”হোম থেকে বেরিয়ে এলাম। অঘোরবাবু এতক্ষণ কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন,এবার সূযোগ পেয়েই তিনি মুখ খুললেন ।
ঈশানের ছবিটার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বললেন, “এই ছেলেটাই অপরাধী মশাই। যেখানেই খুন হয়েছে তার আশেপাশেই একে দেখা গেছে। একে ধরুন, আমি বলছি একে ধরুন, কাজ হবে। দু’বাড়ি লাগালে সব উগলে দেবে মশাই। “
অঘোরবাবুর কথা শুনে বিক্রমের মুখে কেবল একটা হাসির রেখা খেলে গেল। সে নিরুত্তাপ গলায় বলল, “আপনি যখন বলছেন তখন সে চেষ্টা অবশ্যই করা হবে। কিন্তু কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে এই কেসটা অতটা সহজ নয়। এর পেছনে কিছু একটা আছে যা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাচ্ছে। ঈশান খুনগুলো করতেই পারে কিন্তু মোটিভ কি?
“বললাম, “মানসিকভাবে অসুস্থ ও। দেখলে না আমাদের দেখেও একটুও না ঘাবড়ে কেমন ম্যাকবেথ আউড়ে গেল। আমি অঘোরবাবুর সঙ্গে একমত, ওই ছেলেটাই সিরিয়াল কিলার ।”
বিক্রম মাথা দুলিয়ে বলল, “ওকে, দেখাই যাক। এখন চল চতুর্থ কেসটা সম্মন্ধে কি জানা যায় দেখি। ” চতুর্থত ভিকটিম সঞ্চারী সেন। একজন সঙ্গীত শিক্ষিকা। বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা, গান শিখিয়েই সংসার চলত। শত্রু বলতে তেমন কেউ নেই। আর থাকবেই কিভাবে, যে যে কারনে মানুষের শত্রু জন্মায় সেগুলোর একটিও ছিল না সঞ্চারীর। রুপ নেই, সম্পদ নেই, সম্বল বলতে কেবল ওই একটিই, – সঙ্গীত প্রতিভা।
সঞ্চারীর বাবা মা যা যা বললেন তাতে তেমন কিছু ক্লু পাওয়া গেল না। সঞ্চারীর একজন প্রতিবেশী বলল একটা ছেলেকে কিছুদিন যাবৎ এ পাড়ায় সে ঘুরতে দেখেছে। অঘোরবাবু ব্যাগ হতে ঈশানের ছবিটা বের করে বললেন, “এই অপোগণ্ডটা ?”
লোকটা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এই সেই ছেলে। তীর্থের কাকের মতো কিছুদিন ধরেই সঞ্চারীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকত।” “সঞ্চারী বা তার বাবা মা ওকে কিছু বলেনি ?” বিক্রম প্রশ্ন করল। লোকটা চিন্তিত মুখে বলল, “না স্যার। সঞ্চারীর বাবা মা ঘর থেকে বিশেষ একটা বের হন না।
আর সঞ্চারী ব্যস্ত থাকে গানের স্কুল নিয়েই, বাইরে বোমা ফাটলেও বের হয়ে দেখার অভ্যাস ওর ছিল না। ” সন্ধ্যা বেলায় দারোগা এলেন। মুখে যুদ্ধজয়ের হাসি। চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “কেস সলভড । আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না বিক্রমবাবু। অপরাধী কনফেসন করে নিয়েছে।”
“অপরাধী মানে তো ঈশান। তা কি কনফেসন করল ?” বিক্রম দারোগাবাবুর দিকে কটাক্ষপাত করলেন। দারোগাবাবু তখন পকেট হতে মোবাইলখানা বের করে ঈশানের কনফেসনের রেকর্ডিংটা চালু করে দিলেন। স্পষ্ট শোনা গেল ঈশানের গলা। ‘হ্যাঁ আমি মেরেছি ওদের ।
আমি ওদের সহ্য করতে পারতাম না। জাস্ট অসহ্য লাগত ওদের।’ “ব্যাস এটুকু। ” বিক্রম দারোগাবাবু দিকে একটা দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকাল। দারোগাবাবু অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “কনফেসন করেছে এটাই যথেষ্ট, কনফেসনের লেংথ নিয়ে কি হবে। আমার বিনীত নিবেদন বিক্রমবাবু, আপনি আর এ কেস নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।”
“ওকে মিঃ সান্যাল । আপনি এই কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, সুতরাং আপনি যা বলবেন সেটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি।” বিক্রম ল্যাপটপটা খুলে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বিক্রমের মুড সুবিধার নয় বুঝতে পেরে দারোগাবাবুকে চুপচাপ উঠে পড়লেন।
এরপর টুপিটা মাথায় পড়ে দরজার দিকে হাঁটা লাগালেন। দারোগাবাবু বেরিয়ে যেতেই ল্যাপটপ বন্ধ করে মাথা তুলল বিক্রম। বলল,”এ ধরনের অতি সক্রিয়তা ভালো লক্ষণ নয়। আগের করঞ্জয় সান্যাল আর এখনকার করঞ্জয় সান্যালের বেসিকেলি অনেক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এটা অবশ্যই হেলদি নয়। আপনাকে একটা কাজ করতে হবে অঘোরবাবু”
“বলেই ফেলুন মশাই, যে কোনও কাজের জন্য অঘোর বাঁড়ুজ্জে অলওয়েজ রেডি।” অঘোরবাবু সদর্পে ঘোষণা করলেন। বিক্রম অঘোরবাবুর কাছে এগিয়ে এসে কানে কানে কিছু বললেন। অঘোরবাবু একগাল হেসে বললেন,”মার্ভেলাস প্ল্যান। “পরদিন সকাল হতেই অঘোরবাবু আউট অফ স্টেশন।
কোথায় গিয়েছেন তা বিক্রমও জানে না। একমাত্র মাধবদাই কিছুটা হলেও খবর দিতে পারল। মাধবদা বলল, “বুড়োর মাথায় গণ্ডগোল হয়েছে সায়কবাবু। ভোর বেলাতেই এসেছিলেন আমার কাছে। বললেন, – ‘মাধব, ডনের একটা পুরোনো বেল্ট আমায় দে তো।’ আমি বললাম, বেল্ট নিয়ে আপনি কি করবেন ? তা বুড়ো যা বললেন শুনে আমি হে এই খুন।”বললাম, “কি বললেন অঘোরবাবু ?”
“বললেন, গলায় পারবেন। বাঁড়ুজ্জে মশাইয়ের মাথাটাই গেছে সায়কবাবু। “অঘোরবাবু কি পরিমান খামখেয়ালী তা আমি জানি। উনি যে কোনও কাজ যে কোনও সময় করতে পারেন। সুতরাং ডনের বেল্ট যে গলায় পরে একটু কুকুর কুকুর ফিলিংস নেবেন তা বলাই বাহুল্য।
মনের সেই ভাব গোপন রেখে মাধবদাকে বললাম,”অঘোরবাবু যদি জানতে পারেন তাকে তুমি বুড়ো বলেছ তাহলে তোমার বিপদ কেউই আটকাতে পারবে না। বয়স হলেও মনের দিক হতে তিনি নিতান্তই তরুণ।”
আমার কথাটা মাধবদার মনে বেশ ভয়ের সঞ্চার করেছে। মনের ভাব যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল সে। যাওয়ার সময় বলে গেল,”দুপুরে চিংড়ি মাছের মালাইকারি করেছি। অঘোরবাবু খুব পছন্দ করেন। এ বেলা না এলে উনার জন্য রেখে দেবো। আপনি দেরি করবেন না সায়কবাবু ভাত হয়ে গেছে স্নান করে আসুন।”
দুপুরেও অঘোরবাবুর দেখা নেই। খাওয়ার সময় বিক্রমকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলল, “অঘোরবাবু কি আমার পোষা টিয়াপাখি যে খাঁচায় ভরে রাখব ! আসবেন, সময় হলে আসবেন। ” বিক্রম খাওয়ায় মন দিল। এরকম উত্তর পাওয়ার পর আর কোনও কিছু জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছা হল না। বিক্রম নিশ্চয়ই টেনশনে আছে, নাহলে এভাবে কথা বলে না।
সন্ধ্যা বেলায় অঘোরবাবু এলেন। সারা শরীরে কালশিটে দাগ, জামাকাপড় ছেঁড়া, আর গলায় ডনের সেই বেল্ট। এসেই ধপ করে শুয়ে পড়লেন মেঝেতে। তারপরেই অজ্ঞান। ডাক্তার ডাকা হল। ইঞ্জেকশন দিতেই জ্ঞান ফিরল। কিছুক্ষণ ভুলভাল বকে আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন অঘোরবাবু।
চলবে ……