মৃত্যুর মনোলোগ- অভি চক্রবর্তী

কোনো কোনো মৃত্যু

একা একা শুয়ে থাকে 

শুয়ে থাকে খই, আগুন 

হরিবোল, মন্ত্রহীন 

আমি চটি খুলে এগিয়েছি 

শুয়েছি নিথর হয়ে 

ভারী হয়েছে চোখের পাতা 

মৃত্যু না ঘুম বুঝিনি 

সকাল হয়ে এসেছে এরপর 

রোজকার মতো,বুঝেছি 

জীবন বলে কিছু নেই 

সবটাই মৃত্যুর দিকে যাওয়া…

এই যেতে যেতেই কোনো এক মহড়াঘরের আলো দেখতে পায়, চাবিআলা। সেখানে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ বিরাজমান। উঁকি দিয়ে দেখে এক বিধ্বস্ত মোমবাতি জলে ভাসতে ভাসতে আলো ছিটিয়ে দিচ্ছে ঘরে। কবরের মতো নিথর মহড়াঘরের পোশাকগুলো মারা গেছে সব। তারা কথা চালাচ্ছে নিজেদের মধ্যে। অস্ফুট কোড ল্যাঙ্গুয়েজে। এসব সংলাপের মানে বোঝে না চাবিআলা। ভাষা বোঝেনা পোশাকের, মৃত মুখোশগুলোও অনর্গল বিড়বিড় করে যায় এই মৃত ভাসতে থাকা পোশাকের লাশেদের সঙ্গে। চাবিআলা ধরতেই পারেনা এসব কথার মানে। সে চেষ্টা করে জল সরিয়ে দিতে, সরিয়ে দিতে জল।

বেঁচে থাকা নির্ভেজাল মৃত্যুর মহড়াঘর 

একলাঘর আর বারোয়ারি উঠোন 

যে যেভাবেই বাঁচুক না কেনো 

সে সেজে উঠছে কবর বা চিতার জন্য 

সাজের রং উপকরণ বদলে যায় 

যেভাবে প্রজাপতি তাকায় না 

তার পূর্বজন্মের দিকে ঠিক সেভাবেই

শুঁয়োপোকা জানেনা তার পরিণতি 

বিষাদ এভাবেই মুখোমুখি বসে 

বিকেলের দিকে, কখনো কখনো 

কেঁদে ফ্যালে সন্ধ্যামালতীও…

আমার বেঁচে থাকা, একাকার মৃত্যুও…

আলো জ্বলে উঠবে কিনা আর মঞ্চে মঞ্চে জানেনা চাবিআলা। সে ঘুরে ঘুরে দেখে শূন্য কাউন্টার, শূন্য চেয়ার, শূন্য গ্যালারি। এতো চেয়ারের মধ্যে দিয়ে সে ট্যাকেল করতে করতে এগিয়ে যায়। অপার শূন্যতা দুর্গম লাগে। মনে হয়ে যেনো প্রতি প্রেক্ষাগৃহে তুষারপাত হয়েছে। আগত হিমযুগের প্রত্যাশায় বসে থাকে যেনো চাবিআলা।

অক্ষর পুড়ে গেলে শান্তি নেমে আসে 

আমি তার নাম দিয়েছি নিস্ক্রমণ…

ছায়া পুড়ে গেলে একা হাঁটতে ভয় লাগে 

আমি তাকে একটা ঘুঘু পাখি দিয়েছি 

উঠোন জুড়ে ঘুঘু পাখির ডাক 

বুকের ভিতর দুই শালিখ খেলে 

এসব নিয়েই উড়ে যায় চিল 

এদেরকে আমি রূপসী বাংলা দিয়েছি 

তারপর ট্রাম ফিরে আসে 

একে একে নামে সেইসব মৃত অক্ষর, ছায়া 

পোস্টমর্টেমের পর ঠান্ডা মর্গ 

সমস্ত ছায়াহীন লোক কথা বলে যায়..

ছায়াহীন লোকজন এবারে মহড়া দেবার উদ্যোগ নেয়। ভেসে যাওয়া জামাকাপড় গায়ে পরে ছায়ামানুষ গুলো জ্যান্ত হয়ে ওঠে। বহুবার ফলো ধরেও চাবিআলা ওদের স্পট করতে পারেনা।কায়াহীন মানুষের ছায়া পড়ে কি? আলোর নিচে যাদের দেখা যায় না তাদের কি পোস্টমর্টেম  হয়?

বহুবার তাকে বলেছি

এইভাবে তারা জমিয়ে রেখো না…

নয় নয় করে এতো আলোকবর্ষ 

দূরত্বে থেকেও সে তারা জমায় 

তার শরীর জ্বলে ওঠে সন্ধেবেলা 

জমানো তারারা মুক্তি পায় 

সে অবিচল সেই ছায়াপথ ধরে হাঁটে 

খেলে বেড়ায়, তারা কুড়োয় 

এভাবেই এক একটা সম্পর্ক 

আকাশ হয়ে ওঠে, ভেসে বেড়ায় 

ভিজিয়ে দ্যায় আজীবনের চাউনি 

এরপর উল্কার গর্তে হারিয়ে যায়…

আমরা সকলে আসলে আজীবন গর্ত খুঁচিয়ে চলেছি। সম্পর্ক রাখার গর্ত। গর্ত খানিক বড় এবং গভীর হলেই সে গর্তে প্রেম সাজিয়েছি, বুনেছি ভালোবাসার সন্ধেবেলা। কিন্তু কেউ ভাবিনি কখনো, সাপের পুরনো অভ্যসে বাসর দেখলেই গর্ত খোঁজা আর অন্যের গর্তেই নিজেকে জিয়ে রাখা। ফলত সম্পর্ক আর ছোবল বেশ কাছাকাছি থাকা দুটি শব্দ। আকাশে যে তারা আঁকে তাকেই আঁকতে হয় কাকের সমাবেশ…চাবিআলা হেঁটে যায় এক পরিত্যক্ত বন্দরের দিকে…যেখানে অনেক মেয়ে লাল ফুল হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

এভাবেই কোনো বন্দর একা হয়ে যায় রোজ। 

এখানে কোনোদিনই আর কোনো জাহাজ 

ফিরে আসবার কথা নয় জেনেও,  সেদিন 

একঝাঁক লাল ফুল হাতে মেয়েটি আসে…

আসে, সে একা…ফুলের সঙ্গী হয়ে, তাকায় 

নিজেই কিনে নেয় যতো ফুল সব, লাল গোলাপ 

ভাসিয়ে দ্যায় জলে, রক্ত অথবা প্রেম ভেসে যায় 

এমনি দিনে পৃথিবীতে শেষ ছবি আঁকেন ভিনসেন্ট…

এরকম এক পরিত্যক্ত বন্দরেই এবারে মহড়ার উদ্যোগ নেয় চাবিআলা। সে লোককে বোঝায় আসলে এখন মানুষের কাছে যাবার সময়। পরিত্যক্ত বন্দর, ভাঙা রেলওয়ে ইয়ার্ড, স্কুলবাড়ির একাকি চাতালেই জমিয়ে দিতে হবে আগামী নাট্যের মহড়াঘর…

অভি চক্রবর্তী –  সম্পাদক -নাট্যমুখ নাট্যপত্র

নির্দেশক- অশোকনগর নাট্যমুখ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *