কোলকাতা শহরের বুকে এক মূখার্জী পরিবারের কথা বলি—
মূখার্জী পরিবার এক সম্ভ্রান্ত পরিবার। পরিবারের কর্তা আনন্দ মূখার্জী ও কত্রী অনিন্দিতা মূখার্জী আর তাদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। তাদের একটি পোষ্য বেড়াল আছে; এক শীতের রাতে বিড়ালটি ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মূখার্জী বাবুর বাগানের এক কোণে আশ্রয় নেয়,সেই দৃশ্য দেখে মূখার্জী বাবুর মায়া হয়। আর তার পর থেকেই বিড়ালটিকে তারা তাদের বাড়িতেই রেখে দেন।
বিড়ালটি কিন্তু খুব শান্ত প্রকৃতির আর নিরামিষাশী, অন্যান্য বিড়ালের মতো আমিষ খায় না। মূখার্জীবাবু একটি সরকারি অফিসের কর্মচারী আর তার স্ত্রী গৃহশিক্ষিকা।তাদের বড়ো ছেলে তীর্থঙ্কর এখন কলেজে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আর ছোট ছেলে শুভঙ্কর প্রথম বর্ষের ছাত্র;বড়ো ছেলে একটি সরকারি কলেজের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের ছাত্র আর ছোট ছেলে আইন বিভাগের। ওরা দুজনেই খুব মেধাবী ছাত্র। আর মূখার্জী বাবুর মেয়ে, সে সব থেকে ছোট,সে একাদশ শ্রেণীর কলা বিভাগের ছাত্রী।
মূখার্জী বাবুর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই একটি ইস্কুলে তার মেয়ে পারমিতা পড়ে। পারমিতাও পড়াশোনায় খুবই ভালো , পড়াশোনার পাশাপাশি সে গানেও যথেষ্ট পারদর্শী, পারমিতা গত বছর তার বিদ্যালয়ের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। তাদের বাড়ি থেকে একটু দূরেই পারমিতা একটি গানের স্কুলে গান শেখে। প্রতিদিন সকালে উঠে প্রাতভ্রমন সেরে মূখার্জী বাবু তার বাড়ির বাগানের পরিচর্যা করেন: গাছে জল দেওয়া, ওষুধ দেওয়া, বাগান পরিষ্কার করা,এইসবই তিনি একা হাতে সামলান। তারপর পরিবারের সকলে মিলে প্রাতঃরাশ সেরে মূখার্জী বাবু অফিসে যান আর তার দুই ছেলে তীর্থঙ্কর ও শূভংকর কলেজে যায় বাসে চড়ে।
পারমিতার বিদ্যালয় তো বাড়ি থেকে কাছেই ,তাই সে পায়ে হেঁটেই চলে যায়। ওরা সবাই যে যার মতো চলে যাওয়ার পর অনিন্দিতাদেবী টিউশন পড়ানো শুরু করেন; সকাল দশটা থেকে ছাত্র ছাত্রীরা চলে আসে;দু ঘন্টা পড়ানোর পর তাদের ছুটি দিয়ে দেন। তারপর রান্নাবান্না করতে হয় তাকে। তারপর সবাই বাড়িতে ফিরে এলে পরিবারের সকলে মিলে তারা মধ্যাহ্নভোজ সারেন। এইভাবে বছর কয়েক চলার পর একসময় আনন্দবাবুর দুই ছেলের পড়াশোনা শেষ হয়। বড়ো ছেলে ও ছোট ছেলে দুজনেই পড়াশোনা শেষ করে এখন বিলেতে চাকরি করে।
বড়ো ছেলে তীর্থঙ্কর একটি নামকরা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে ও ছোট ছেলে শুভঙ্কর ওকালতি করে; আর তার মেয়ে পারমিতাও এখন পেশাগত সঙ্গীত শিল্পী। এরপর আনন্দবাবুর মেয়ে পারমিতার বিয়ে হয় দিল্লিতে। পারমিতার শ্বশুরবাড়ি খুবই ভালো। আনন্দবাবু তার মেয়ের বিয়ে খুব ধুমধাম করে দেন ঠিকই কিন্তু বিয়েতে পারমিতার দুই দাদা বিলেতে থাকায় আস্তে পারেনি। পারমিতার শ্বশুরবাড়িতে আছেন তার এক দেওর,এক জা,শ্বশুর ও শাশুড়ি। পারমিতার বর অঞ্জন একটি প্রাইভেট কলেজের অধ্যাপক। যাই হোক, পারমিতা এখন সুখেই সংসার করছে।
এভাবে চলতে থাকে দিন। বিয়ের বছর চারেক পর পারমিতার একটি কন্যাসন্তান হয়। পারমিতার বাড়ির সবাই তো খুব খুশি হয় আর তারা তাদের কন্যাসন্তানের নাম রাখে দেবপ্রিয়া। এইভাবে খুব সুখেই তাদের দিন কাটছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলায় ফোন আসে তার বাবার বাড়ি কোলকাতা থেকে। ফোন তুলতেই পারমিতা তার বাবার করুন কাঁপা কন্ঠস্বর শুনতে পায়। তার বাবা বলে ওঠেন পারমিতার মা আর নেই।
পারমিতা শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে, পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায় পারমিতার। সেই রাতেই মেয়ে দেবপ্রিয়া কে শ্বশুড়বাড়িতে রেখে পারমিতা তার বরকে নিয়ে রওনা দেয় কোলকাতার বাড়িতে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে যখন পারমিতা তার কোলকাতার বাড়িতে পৌঁছায়, তখন দেখে যে বাড়ির সামনে প্রচুর মানুষের ভিড়; ভিড় ঠেলে সামনে এগোতেই দেখে তার মা অসার ভাবে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। ডাক্তার চিকিৎসা করে বলেছেন যে, মানসিক অবসাদে অনেকদিন ধরে ভোগায় ও সর্বক্ষণ অত্যন্ত চিন্তিত থাকায় ঘুমের ঘোরে তিনি হার্ট ফেল করে মারা গেছেন।
পারমিতা তার বাবাকে তার মায়ের অবসাদে ভোগার কারণ জিজ্ঞেস করায় বাবা বলেন যে, পারমিতার দুই দাদা বাড়ির সম্পত্তি তাদের নিজেদের নামে করার জন্য খুব চাপ দিচ্ছিল আর চাইছিল সেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে টাকা নিয়ে বিদেশে জায়গা কিনে ঘরসংসার পাততে। এইসব শুনে শোকে কাতর পারমিতা বাকরুদ্ধ হয়ে যায় আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিছুক্ষণ পর পারমিতার জ্ঞান ফিরে আসে। পারমিতার দাদারা কিন্তু অনিন্দিতা দেবীর মৃত্যুসংবাদ পেয়েও আসেনি কোলকাতায়।যাই হোক, এসব চলতে চলতে সকাল হয়ে যায় , তারপর অনিন্দিতা দেবীর দেহ এগিয়ে চলে শশ্মানযাত্রার দিকে। তারপর চারদিন পালন শেষ হলে পারমিতারা আবার দিল্লীতে ফিরে যায়।
এভাবে বছর ঘোরে, কেটে যায় কয়েক বছর। পারমিতার মেয়ে দেবপ্রিয়া এখন সপ্তম শ্রেণীতে একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়ে।দেবপ্রিয়ার বাবা কলেজ যাওয়ার সময় দেবপ্রিয়াকে নিজের গাড়ি করে বিদ্যালয়ে ছেলে দিয়ে আসেন আবার আসার সময় নিয়েও আসেন। পারমিতার শ্বশুরবাড়ি খুব দয়ালু প্রকৃতির।তারা সময়ে অসময়ে গরীব মানুষদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকেন। একবছর শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় তারা সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন;ঠিক করেন তারা পারমিতার বাবাকেও নিয়ে যাবেন তাদের সঙ্গে।
তাই একদিন এক শীতের সকালে যখন সবাই চায়ের আড্ডায় ব্যস্ত , সেই ব্যস্ততার মাঝে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আনন্দ বাবুকে ফোন করেন; বারবার ফোন করা সত্ত্বেও তিনি ফোন ধরেননা । যথারীতি তারা সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। এমন সময় পারমিতার ছোরদার ফোন আসে, ফোনে জানায় যে, সে বিলেতের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে; শুনে তো পারমিতা যথারীতি হতবাক হয়ে যায়। বিয়েতে শুভঙ্কর তার দাদা তীর্থঙ্কর ও তার বন্ধুবান্ধবদের নিমন্ত্রন করে অথচ তার বাবা ও বোনকে কিছু জানানোর প্রয়োজন-ই বোধ করেনি শুভঙ্কর। শুভঙ্করের বিয়ের ছয় মাস পরেই তীর্থঙ্কর-ও বিয়ে করে,কিন্তু তাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক খুব একটা ভালো না থাকায় বিবাহের দু বছরের মধ্যেই তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়।যাই হোক, পারমিতাদের সেদিন একটি বৃদ্ধাশ্রমে কম্বল বিতরন করার কথা ছিল, সেদিনটা ছিল বৃদ্ধাশ্রমটির প্রতিষ্ঠা দিবস। তাই আর বেশি বিলম্ব না করে তারা সবাই মিলে সেদিন বৃদ্ধাশ্রমে রওনা দেন।
সেখানে প্রথমে বৃদ্ধাশ্রমটির উদ্দেশ্যে কিছু ভাষণ দেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রধান ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিগণ। বৃদ্ধাশ্রমে মোট তিনশো আশি জন সদস্য আছেন। তাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করানো হয়, তারপর কম্বল বিতরণের অনুষ্ঠান শুরু হয়। পারমিতার শ্বশুরবাড়ির সবাই সামিল হন এই কাজে।এক এক করে সবাইকে কম্বল বিতরণ করা হয়, সবাই কে কম্বল বিতরণ করতে করতে লাইন যখন প্রায় শেষের মুখে তখন এক বৃদ্ধ লাইনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়াতেই পারমিতার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়;সে দেখে যে বৃদ্ধাশ্রমের এই লাইনে তার নিজের বাবা দাঁড়িয়ে আছেন।এই দেখে হতবাক পারমিতা চোখের জলে নিজেকে সামলাতে না পেরে ওখান থেকে তার বাবাকে নিয়ে একপাশে চলে যায় ও বাবার এই অবস্থার কথা জিজ্ঞেস করায় আনন্দ বাবু অশ্রু ভরা চোখে বলতে থাকেন তার এই দূরাবস্থার কারণ:ছয় মাস পূর্বে তার বড়ো ছেলে তীর্থঙ্কর ও ছোট ছেলে শুভঙ্কর তাকে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে এই বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে যায় আর বলে যে তারা আর তার বাবাকে কোলকাতার বাড়িতে একা থাকতে দেবে না।
ততদিনে আনন্দ বাবু অবসর নিয়েছেন তার কর্মজীবন থেকে। এই বলে তারা তার বাবাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে সারাজীবনের মতো রেখে দিয়ে বিলেতে চলে যায়, আনন্দবাবুর কাছে যে মোবাইল টা ছিল সেটাও তার ছেলেরা নিয়ে নেয় তার কাছ থেকে। আর আনন্দ বাবুর এখন বয়স হয়েছে, তার স্মৃতিশক্তিও অতটা আর প্রখর নেই,তাই তার মোবাইল নং গুলোও মুখস্থ নেই,যার জন্য তিনি পরিচিত কারুর সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারেননি।এর কিছুদিন পর আনন্দবাবু জানতে পারেন যে, তার ছেলেরা তাদের কোলকাতার বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছে। আর তারপর ছেলেদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি কোনোমতেই আর যোগাযোগ করতে পারেননি।
আর তার ছেলেরাও কোনো খোঁজ নেয়নি। পারমিতার বাবার এই অবস্থা দেখার পর তার শ্বশুরবাড়ির সবাই ঠিক করেন যে, তারা পারমিতার বাবাকে তাদের সাথে দিল্লীর বাড়িতেই রাখবেন। কিন্তু আনন্দবাবু অত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক নন। তিনি দিল্লীতে মেয়ের বাড়ি থাকাকালীন কোর্টে মামলা করেন তার দুই ছেলের বিরুদ্ধে, মামলা চলে দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে। মামলা চলার পর অবশেষে আনন্দ বাবু মামলায় জয়লাভ করেন এবং তিনি আবার নিজের বাড়ি ফিরে পান। তারপর দিল্লী থেকে চলে এসে তিনি আবার কোলকাতার বাড়িতেই বসবাস শুরু করেন।
এখন আনন্দবাবুর অনেক বয়স হয়েছে। খুব আস্তে আস্তে হাঁটা চলা করেন। শরীরে খুব একটা বল না থাকলেও এখনও সেই আগের মতই প্রতিদিন সকালে উঠে বাগান পরিচর্যা করেন। আর বাড়িতে একটা পরিচারক আছেন, তিনিই সব বাড়ির কাজ করে দেন; রান্নাবান্না থেকে শুরু করে বাড়ি পরিষ্কার সবকিছুই। আজ বছরের প্রথম দিন,২০২১ সাল। আজ দিল্লীর একটি পাঁচতারা হোটেলে বিরাট বড় একটি সন্ধানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে নববর্ষ উপলক্ষে। আজ সেখানে পারমিতার সঙ্গীতানুষ্ঠান আছে। প্রচুর মানুষের জমায়েত হয়েছে সেখানে। অন্যান্য অনুষ্ঠান সন্ধে থেকে শুরু হয়ে গেলেও সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরু হতে হতে রাত নটা বেজে যায়।
পারমিতাকে ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার পর শুরু হলো সঙ্গীতানুষ্ঠান। সঙ্গীতানুষ্ঠানে পারমিতার শ্বশুরবাড়ির সবাই আর পারমিতার বাবাও গিয়েছিলেন। পারমিতা মঞ্চে ওঠার কিছুক্ষন পরেই আনন্দবাবু লক্ষ্য করেন যে , তার পিছনের চেয়ারেই মুখে গলায় মাফলার জরানো এক ভদ্রলোক বসে অনুষ্ঠান দেখছেন। না জানি খুব কৌতুহল বশতই আনন্দবাবু ভদ্রলোকটির দিকে চেয়েছিলেন। তিনি মনে মনে যা ভেবেছিলেন সেটাই ঠিক হলো। আসলে সেই ভদ্রলোকটি ছিলেন আনন্দবাবুর নিজের ছোট ছেলে শুভঙ্কর আর শুভঙ্করের পাশেই একটি মহিলা তার কোলে একটা ফুটফুটে কন্যাসন্তান নিয়ে বসে আছে। আনন্দবাবু তার মেয়ে পারমিতার মুখে শুভঙ্করের বিয়ের কথা শুনেছিলেন,তাই তিনি ভাবলেন হয়তো শুভঙ্করেরই স্ত্রী ও মেয়ে হবে ওরা।যাই হোক, শুভংকর কিন্তু এখনো আনন্দবাবুদের লক্ষ্য করেননি।
পারমিতার সঙ্গীতানুষ্ঠান যখন খুব জমে গেছে আর দর্শকদের খুব করতালি পড়ছে ঠিক তখনই আনন্দে মশগুল আনন্দবাবুকে শুভঙ্কর লক্ষ্য করে। এমন সময় তাদের মুখোমুখিও হয়। সেই পরিস্থিতিতে শুভঙ্কর সেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যায় তার স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে ফোনে যেন কার সাথে কথা বলতে বলতে; তার বাবার সঙ্গে একটিও কথা বলে না সে। আনন্দবাবু মনে মনে খুব দুঃখ পান; একদিন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন যে দুই ছেলে ও নাতি নাতনি কে নিয়ে তার ভরা সংসার হবে কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে তা আর হয়ে ওঠেনা।যাই হোক, পারমিতার সঙ্গীতানুষ্ঠান দেখে সবাই খুব খুশি। পারমিতার সঙ্গীত পরিবেশন শেষ হলে সবাই মিলে একসঙ্গে বাড়ি যাওয়ার জন্য এগোতে থাকে। হোটেল থেকে পাঁচ-দশ মিনিটের রাস্তা পারমিতার শ্বশুরবাড়ি। হোটেল থেকে বেরিয়েই বাম দিকে যেতে হয় তাদের।
রাস্তাটির পরপর দুটি ল্যাম্পপোস্ট এই কিছুদিন হলো খারাপ হয়ে গেছে।তাই রাস্তাটা বেশ অন্ধকার। সেই পথ ধরেই পারমিতারা হাঁটতে থাকে। সবাই একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাচ্ছিল, এমন সময় হঠাৎ তিনটে মোটরসাইকেল এসে তাদের পথ আটকায়। এই দেখে পারমিতারা তো যথেষ্ট হতবাক হয়ে যায় আর পথ আটকানোর কারণ জিজ্ঞেস করায় কিছু কথা না বলেই মোটরসাইকেল থেকে নেমে লোকগুলো পারমিতাদের উপর হামলা চালায়; একটি বড় লোহার রড দিয়ে পারমিতার বাবার মাথায় আঘাত করে, আঘাতের সাথে সাথেই আনন্দবাবু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আর জ্ঞান হারায়।পারমিতা দের সবাইকেই দুষ্কৃতীরা খুব মেরেছে।আনন্দবাবুর এই অবস্থা দেখে পারমিতারা তাড়িতাড়ি তাকে উঠিয়ে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেয় মারতি করে। আশেপাশের লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়। হাসপাতালে বাবাকে ভর্তি করে পারমিতারা সবাই সারারাত হাসপাতালে কাটায়। সারারাত তাদের ঘুম নেই চোখে।
সকাল হতেই ডাক্টারবাবু তাদের বলেন আনন্দবাবুর মাথার পেছনের দিকে গুরুতর আঘাত লেগেছে,রক্তপাতও হয়েছে অনেক। হসপিটাল থেকে আনন্দবাবুকে নিয়ে তারা রওনা দেয় বাড়ির দিকে। পারমিতার শ্বশুরবাড়ি থেকে দু পা এগিয়েই একটা চায়ের দোকান আছে, সেখানে চা দোকানের মালিক এই দুষ্কৃতীদের মুখ দেখে নিয়েছিল আর কয়েকটা ছবিও তুলে রেখেছিল তার নিজের মোবাইল এ। সেই ছবি তিনি পারমিতা দের দেখাতেই তাদের তো চক্ষু চড়কগাছ, সেই দুষ্কৃতীদের মধ্যে একটি মুখ ছিল পারমিতার ছোড়দা শুভংকরের।তারা তো প্রচন্ড রেগে যান আর যথেষ্ট ভেঙেও পড়েন। পারমিতা ঘটনাটা পুলিশ কে জানানোর আগ্ৰহ দেখালে পারমিতার বাবা তা বারণ করে; আনন্দবাবুর বক্তব্য তার তো তিনকাল পেরিয়ে এককালে ঠেকতে চলেছে তাই তার শেষ বয়সে এসে এইসব ঝামেলা করার কোন দরকার নেই।
এইভাবে দিন পেরোয়, আনন্দবাবু সুস্থও হয়ে ওঠেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই মাথায় আঘাতের যন্ত্রনাটা নাড়া দিয়ে ওঠে, আবার ঠিকও হয়ে যায়। দেখতে দেখতে গ্ৰীষ্মকাল চলে আসে। অসহ্য গরম পড়েছে।
এই গ্ৰীষ্মেরই এক দুপুরে হঠাৎ করে পারমিতার ফোনে একটি অজানা নাম্বারে ফোন আসে। ফোন তুলতেই এক মহিলার কন্ঠস্বর ভেসে আসে, মহিলাটি ছিলেন আনন্দবাবুর প্রতিবেশী;অত্যন্ত বেদনাদায়ক কন্ঠে তিনি বলেন যে, আনন্দবাবু আর নেই।হাতে ফোন নিয়ে পারমিতা জ্ঞান হারায়। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির লোক পারমিতার কাছে ছুটে আসে। জ্ঞান ফিরলে পারমিতা সব খুলে বলে তাদের।তারা রওনা দেয় কোলকাতার উদ্দেশ্যে। কোলকাতার বাড়িতে পৌঁছালে পারমিতারা দেখে তাদের বাড়ির সামনে প্রচুর মানুষের ভিড়।
পারমিতা দ্রুত বেগে বাড়িতে ঢুকে দেখে রান্নাঘরের মেঝেতে আনন্দবাবুর নিথর দেহ পড়ে আছে। সবাই ভেবেছিল হয়তো হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন আনন্দবাবু; কিন্তু সেই ভুল ভাঙল একটু পরে ডাক্তার আসতেই।ডাক্তার চিকিৎসা করে বললেন যে, তার মাথায় একটা গুরুতর আঘাত রয়েছে। সেই আঘাতের বেদনাদায়ক যন্ত্রনায় তিনি মারা গেছেন। এইসব শুনে তো পারমিতারা সবাই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে।
ভারাক্রান্ত মনে পারমিতারা আনন্দবাবুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করে আবার দিল্লীর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
যে মূখার্জী নিবাস আজ থেকে কয়েক বছর আগে চাঁদের হাট ছিল সেই মূখার্জী নিবাস এখন শশ্মানে পরিণত হয়েছে। শুধু “মূখার্জী নিবাস” লেখাটা এখনও জ্বলজ্বল করছে।
প্রেরণা দাস