মিলনের যাত্রাপথে – সুদীপ ঘোষাল। পর্ব – ৫

মিলনের যাত্রাপথে  -  সুদীপ ঘোষাল।   পর্ব  - ৫
১৫
 
যাইহােক ‘রূপা অপেরা’ দেড় বৎসর ব্যাপী রামকৃষ্ণ মিত্রের ‘সােনার সানাই।’ বইয়ের মহড়া দিল। অরিন্দম ছি এক ছদ্মবেশী ভিক্ষুর অভিনয়ের। এবার রূপা অপেরা-র ডাক পড়েছেনদীয়ার একটি শহরে। রূপা অপেরার এখন দশ হাজার টাকা পার নাইট রেট। বাসভর্তি অপেরা পার্টি হাজির ছিল সন্ধ্যা সাত ঘটিকায়। বই শুরু হবে নয় ঘটিকায়। অরিন্দম ও অপরূপা প্রথমত শরহটি একটু দেখার জন্যে বেরিয়েছে। পথমধ্যে এক মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়লাে তারা। একটি মােটর সাইকেল এসে তাদের রিক্সার সঙ্গে সংঘর্ষ বাধায়। এর ফলে অরিন্দম লাফিয়ে নেমে পড়লেও অপরূপা পায়ে ভীষণভাবে আঘাত লাগে। 
অরিন্দম কথা না বাড়িয়ে মােটর সাইকেল আরােহীর সাহায্যে রূপাকে নার্সিংহােমে নিয়ে যায়। ডাক্তারবাবু প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাদের ছেড়ে দেন। | এদিকে গােপালবাবু অরিন্দমকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছেন। বই শুরু হতে আর আধ ঘণ্টা বাকী। কনসার্ট পড়ে গিয়েছে। কিন্তু অরিন্দমের পাত্তা নেই। অরিন্দমের দ্বিতীয় দৃশ্যে প্রবেশ। সুদর্শন সান্যাল এ সুযােগ হাত ছাড়া করলাে না। বারবার গােপালবাবুর কানে কুমন্ত্রণা দিতে থাকলাে গােপালবাবুর উপর দোষ চাপিয়ে বললাে আপনিই ওকে বাড়িয়ে মাথায় তুলেছেন নিজেকে অরিন্দম বড্ড বেশী ?? মনে করে। গােপালবাবু একে প্রেসারের রােগী ক্রমে তার ক্রোধ বেড়ে যাওয়াতে তার প্রেসার বাড়তে থাকলাে। অরিন্দম যখন এলাে তখন গ্রীন রুম সাইলেন্ট। অপরূপা এক পাশে বসে পড়লাে।
 অরিন্দম দ্রুত মেকআপ সেরে নিয়ে মঞ্চে প্রবেশ করেলা। মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকায় অরিন্দম খুবই বিব্রত বােধ করতে থাকলাে, ফলে ?? মিশ করল। সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের মধ্যে গুঞ্জন শােনা গেল। কোনওরকমে অরিন্দম মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এলাে। অপরূপার কাছে এসে দাঁড়ালাে। অপরূপা অভয় দিলাে। উভয়ে তাকিয়ে দেখলাে সুদর্শন সান্যালের মৃদু হাসির ঝিলিক আর তার পার্শ্বে দন্ডায়মান হির এবং ব্যথিত গােপালবাবুকে। পরবর্তী দৃশ্যগুলিতে অরিন্দম মােটামুটি ভালাে অভিনয় করলাে কিন্তু অপরূপার অভিনয় ভালাে হল না। এদিকে সুদর্শন সান্যাল ফাঁকা মাঠে গােল দেওয়ার মতাে সেই রাত্রির শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান পেল। অপরূপা ও অরিন্দম বিষন্ন চিত্তে বাসে উঠে মিনের সীটে বসলাে। সুদর্শন সান্যাল ও গােপালবাবু বসলেন পিছনের সীটে। 
সুদর্শন সান্যালের ভালাে অভিনয়ের জন্যে অরিন্দম এবং অপরূপা কিন্তু তাকে শ্যবাদ দিতে ভুল করলাে না। কিন্তু সুদর্শন সান্যাল প্রত্যুত্তরে কিছুই বললাে না। এমন  মনের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সাধনা লাগলাে। সাত দিন পরে সে গােপালবাবুর বাড়ি গিয়ে দেখে  তিনি আলােচনায় ব্যস্ত।  অপরুপা পাশের ঘরে। অরিন্দম ঘরে প্রবেশের অনুমতি নিয়ে গোপালবাবু পাশের চেয়ারে বসলাে। সুদর্শন সাঁওতাল উঠে তখন পাশের সেই গেল। গোপালবাবু তিরস্কারের সবরে বলে উঠলেন, তামার ছারা আর অভিনয় শেখা হলনা।” গােপালবাবুর এই কথাটি অরিন্দমের বুকে তীব্র মাথা বিদ্ধ হল। অারণ চোখে জল ছলছল করে উঠলাে। গােপালবাবু বলে যেতে লাগলেন অনিয় গেলে দায়িত্ববান হতে হয় এবং অনুশীলন করতে হয়। তােমার মধ্যে এই দুো কোনটাই দেখছি না। 
ভরে গােপালবাবুকে বিছানায় দেখে বলে উঠলাে, কাকাবাবু আপাদন এখন কেমন আছেন তার দেহে হাত দিয়ে দেখলাে অরিন্দম ‘হটবিট’ অনেক বেশ এবং উত্তাপ অহাভাবিক। কোন কথা না বলে অরিন্দম ডাক্তার ডাকতে চলে গেল। এসেই দেখে সুদর্শন সান্যাল ডাক্তার নিয়ে এসেছে এক অপরূপা বিছানার পাশে বসে আছে। অরিন্দম ডাক্তারকে ফি দিয়ে বিদায় দিল। অপরূপা অরিন্দমকে দেখে উঠে এসে তার বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাে। তার কথা ?? অরিন্দম জানতে পারল গােপালবাবু ক্যান্সারে আক্রান্ত এবং তিনি চার মাসের বেশী বাঁচবেন না। | ‘রূপ অপাের পুনরায় চার রাত্রি যাত্রা করার ডাক পেলাে। অরিন্দম কিন্তু গােপালবাবুর শরীরের জন্যে যেতে চাইলেন না। সুদর্শন সান্যাল এখন পার্টির সকল দায়িত্ব নিয়েছে এবং সকল কম দেখাশােনা করছে। গােপালবাবুর পরামর্শে এবং তাদেশে শেষ পর্যন্ত অরিন্দম যেতে রাজী হলাে। কিন্তু সঙ্গে অপরূপা এবং গােপালবাবু যাবেন না, ফলে অরিন্দম ব্যথায় জর্জরিত।
 
১৬
 
অশােক ও শােভন গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর থেকে দুই বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু দুজনের কারাের কোনাে চাকরী হয়নি। শুধুমাত্র তাদের টিউটোরিয়াল হােমের উন্নতি হয়েছে। তাদের এই হােম থেকে অনেক ছাত্র ফাস্ট ডিভিশনে মাধ্যমিক পাশ করেছে এমন কি দুই একজন ছাত্রছাত্রী স্টারও পেয়েছে। ফলে তাদের হােমের’ ছাত্রছাত্রী সংখ্যা এখন অনেক। দুইবেলা তারা হােম খােলে। সকাল সাত ঘটিকা থেকে দশ ঘটিকা এবং সন্ধ্যা সাড়ে ছয় থেকে নয় ঘটিকা পর্যন্ত। প্রত্যেক গ্রুপে তিরিশ জন করে ছাত্রছাত্রী থাকে দুইজনে পনেরজন করে প্রতি সপ্তাহে চারদিন শিক্ষাদান করে। শুধুমাত্র নব এবং দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীই এখন পড়াশুনা করে। 
দুইবেলায় মােট ৬০জন ছাত্রছাত্রী শ টাককরে মােট দেড় হাজার টাকার মতাে মাইনে দেয়। এতে দুজনের মােটামুটি অভিনয় অপেশাদার খুশী। দিন  যায় এবং তাদের পড়াশুনার অভ্যাসও বজায় থাকে। এটাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য।তা হােক দেবিকা এবং অপর্ণা দুইজনেই এখন বারাে ক্লাসের গন্ডী পেরিয়ে কলেজে হয়ারে ভর্তি হয়েছে। অপর্ণা তার দাদা অশােককে দেবীকার কথা এই প্রথম আশেকি অপর্ণার মুখে দেবীকার কথা শুনে বুঝতে পারলাে দেবীকারঅনুতাপের কথা। কিন্তু শুধু মনে পড়ে যায় সেদিনের অপমানের কথা। সেদিন রাস্তায় অশােক যেখানে ছােটো হয়েছিল জীবনে আর কোনদিন সেরূপ অপমানিত সে হয়নি। অতএব মনােবাসনা পূর্ণ হল না।
 
অপর্ণা দেবীকাকে একদিন তার বাড়ী নিয়ে এলাে। দেবীকা বাড়িতে প্রবেশ করেই ম দুচোখ দিয়ে শুধুমাত্র অশােককে খুঁজে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও অশােকের দেখা নেই। শেষে অধৈর্য হয়ে দেবীকা অপর্ণাকে তার দাদার কথা জিজ্ঞাসা করে। অপর্ণা দাদার ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে দেয়। দেবীকা ধীর পদক্ষেপে দৃঢ় চিত্তে জয়ের বাসনা নিয়ে দরজার দিকে এগােতে থাকে। প্রবেশের মুখেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। দেখে বিছানায় অশােক ছটফট করছে আর বীথিকা তার পাশে বসে তার মাথায় হাত দিচ্ছে। দেবীকা আড়ালে সরে গিয়ে সব দেখতে লাগলাে। শুনতে পেল অশােক বলছে। ‘বীথিকা শােভন কেন এল না? ওকে এইসময় আমার বিশেষ দরকার। শােভন আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, আর তুমি তার ভাবী বধু, আমার বােন বীথিকা তুমি কত স্নেহশীলা, তুমি কত সুন্দর। বীথিকা অশােককে চুপ করিয়ে ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ খেতে দেয়। 
ইতিমধ্যে শােভন এসে দেখে দেবীকা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে। সে তাকে হাত ধরে নিয়ে ধরে প্রবেশ করে। অশােক দেবীকাকে দেখে চমকে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বীথিকা ও শোভন তাদের ঘরে বসিয়ে অপর্ণার ঘরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দেবীকা ডুকরে কেঁদে ওঠে। আর হাত জোড় করে ক্ষমা প্রার্থনায় ভঙ্গিতে অশােককে ডাকতে থাকে। অশােক দেবীকার দিকে আজ অনেকদিন পর তাকিয়ে দেখলাে, দেবীকা আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়েছে। দেবীকা একসাথে অনেক কথা বলতে চায় কিন্তু কিছুই। বলতে পারে না। শুধুমাত্র তাদের দুজনের হাত পরস্পরের হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে। ইতিমধ্যে শােভন ও বীথিকা অশােকের কাছে এসেছে। কিন্তু অপর্ণা শােভনের বােন দেবীকাকে কোনমতে এবেলা বাড়ী যেতে দিল না। দেবীকার এই প্রথম অশােকদের বাড়ী থাকা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *