মা যশোদা – উদয় নাথ কুমার

মঞ্চ থেকে ঘোষণা হলো এরপর মা সম্পর্কে কিছু বলবে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী কনীনিকা রায়। ধীরে ধীরে মঞ্চে উঠলো কণা। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল….. আজকের অনুষ্ঠানে সবার মা আসলেও আমার মা আসেনি, আমার মা কোনো অনুষ্ঠানে আমার সাথে যেতে চাইনি। কারণ আমার মা আমাদের বাড়ির কাজের মাসি। মুহূর্তেই সবার চোখ চলে গেল বিখ্যাত বিজনেস ম্যান সুশোভন রায়ের দিকে।

ওদিকে তার মেয়ে কণা বলেই চলেছে জানেন আমার মা আমাকে বুকের দুধ না খাওয়ালেও বুকে আগলে বড়ো করে তুলেছে। আমার মা আমার শরীর খারাপ করলে রাতের পর রাত জাগে। আমার খিদা আমি অনুভব করার আগেই আমার মা অনুভব করে। আমার বাবাকে কবে কি বলতে হবে সেটাও আমার মা ঠিক করে দেই। আমার মা হলো আমার জগৎ,  আমার দুনিয়া।  আমি আমার জন্ম দায়িনি মাকে তো দেখিনি কিন্তু যে মাকে দেখছি পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে যেন এই মাকেই মা হিসেবে পাই।

মা আমি হয়তো তোমাকে অনেক কষ্ট দিই কিন্তু বিশ্বাস করো মা আমি বড়ো হয়ে এত ভালো হব যে আর তোমাকে একটুও কষ্ট দিবনা।  নমস্কার। বলে নেমে এলো কণা। বাবার কাছে আসতেই জড়িয়ে ধরলেন সুশোভন বাবু তার একমাত্র মেয়েকে।অনুষ্ঠান শেষ হলো অনুষ্ঠানের থেকেও বেশি চর্চার বিষয় হল সুশোভন বাবু ও তার স্ত্রী। সবার মনে একটায় প্রশ্ন কে এই মহিলা? সুশোভন বাবুর দ্বিতীয় বিবাহের খবর তো কেউ কোনো দিন পাইনি। তাহলে কি ???? ইত্যাদি ইত্যাদি। 


বাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে বসেছে কণা ও তার বাবা। কণা বলল বাবা মা আমাকে সব সময় সত্য কথা বলতে বলেছে। তাই সব সত্যি সত্যি বলে দিলাম। তুমি রাগ করোনি তো বাবা? না রে মা আমি রাগ করব কেন? আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ। কণা বাবার কাছে ঘেঁষে বসল। গাড়ি সামনের দিকে চলতে শুরু করল কিন্তু সুশোভন বাবু নয় দশ বছর পিছনে চলে গেলেন। দীর্ঘ তিন বছরের চিকিৎসার পর ডাক্তার বলেছিলেন এরপর  কল্পনা রায়ের গর্ভে সন্তান আসবে কিন্তু সন্তান প্রসবের সময় মায়ের জীবন নিয়ে টানাটানি হতে পারে। সুশোভন বাবু বলেছিলেন থাক তাহলে।

কল্পনা দেবী বলেছিলেন কিছু হবে না তুমি বেশি ভাবছ শুধু শুধু। অবশেষে কল্পনা দেবীর জেদের কাছে হার মানতে হয়েছিল সুশোভন বাবুকে।       এখন আর চেম্বারে যান না কল্পনা দেবী। ডাক্তার বাবু বাড়িতে এসে চেক আপ করে যান। এবার চেক আপ করে বললেন এরপর একটু বেশি বিশ্রাম নিতে হবে। সুশোভন বাবু তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে মোহিনী কে ডেকে বলেছিলেন এরপর থেকে ভালো করে খেয়াল রাখবে। মোহিনী মাথা নিচু করে বলেছিল সে আপনাকে ভাবতে হবে না দাদাবাবু। 

   মোহিনী ছোটবেলা থেকে এখানে কাজ করে। তারা পাঁচ বোন মোহিনী ছোট। বছর চারেক আগে এক বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে হয়েছিল মোহিনীর। বছর দুই সংসার করার পর একটা দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা গেলে আবার এখানে এসে কাজ করতে শুরু করে।সুশোভন বাবু ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকায় কল্পনা মোহিনীর সাথেই বেশি সময় কাটাই। কল্পনার থেকে মোহিনী মাত্র তিন বছরের ছোট হওয়াই কিছু দিনের মধ্যেই তাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। বেশ ভালো লাগত মোহিনী কে কল্পনার। 

         দেখতে দেখতে প্রসবের সময় পৌঁছে আসে। একদিন দুপুরবেলা মোহিনী কে ডেকে বলল শোন আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার সন্তানের দায়িত্ব তোকেই নিতে হবে। মোহিনী বলেছিল কিছু হবে না দিদি এমন ভাবছ কেন? কল্পনা বলল তুই আমাকে কথা দে যদি আমি না থাকি তুই কোনোদিন আমার সন্তানকে তার মায়ের অভাব বুঝতে দিবি না। মোহিনীর চোখে জল চলে এলো। ছলছল চোখে তার দিদিমণির হাতে হাত রেখে বলল আমি কথা দিলাম আমার মাতৃত্ব আমি তাকে উজাড় করে দিব।

রাতে কল্পনা সুশোভন বাবুকে বলল ওগো আর তো দেরি নেই। আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে মোহিনী আমাদের সন্তানকে মানুষ করবে তুমি আমাদের সন্তানকে শিখিয়ে দিও সে যেন তাকেই মা বলে ডাকে। সুশোভন বাবু বললেন তোমার কিছু হবে না কল্পু, আমি বড় নার্সিং হোমে তোমাকে নিয়ে যাব। কল্পনা আর কিছু বলেনি শুধু নিজের হাতের মধ্যে সুশোভন বাবুর হাতটি চেপে ধরেছিল।
ডাক্তারের কথা সত্যি করে একটি ফুটফুটে মেয়ে জন্ম দিয়ে কল্পনা ইহলোক ত্যাগ করেছিল। তখন থেকেই মোহিনী হয়ে উঠেছে কণার পৃথিবীর সব থেকে ভালো মা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *