মহাশূন্যে জুরান — সিদ্ধার্থ সিংহ – পর্ব – ৯

কিন্তু সে তো কোনও যানে-এ ওঠেনি। তা হলে সে এখানে এল কী করে! তবে কি সেই এক চিলতে মেঘটা তাকে তুলে নিয়ে এসেছে! হতে পারে! আর তাই যদি হয়, তা হলে তো এরা পৃথিবী থেকে অনেক অনেক অনেক বেশি এগিয়ে। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পরে কী ঘটবে, পৃথিবীর অবস্থা তখন কেমন হবে, তা তারা বহু যুগ আগেই চাক্ষুষ করে নিয়েছে। আর সেটা যদি চাক্ষুষ করেই থাকে, তা হলে তো এদের কাছ থেকেই পৃথিবীর ভবিষ্যত্‌ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নেওয়া যায়। এটা মনে হতেই জুরান বলল, আচ্ছা, আমরা যে কিছু দিন পর পরই শুনি, পৃথিবী এই দিন ধ্বংস হবে, ওই দিন ধ্বংস হবে, সত্যিই কি পৃথিবী দশ-বিশ বা পঞ্চাশ-একশো বছরের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যাবে?
সময়-কণা বলল, না।

— তা হলে?

— ধ্বংস হবে না। তবে মানুষও পৃথিবীতে খুব বেশি দিন থাকতে পারবে না।
অবাক হয়ে জুরান জিজ্ঞেস করল, সে কী? কেন?
— কারণ, পৃথিবীটা ধীরে ধীরে বাসের অযোগ্য হয়ে যাবে, তাই।

— কেন?

সময়-কণা বলল, সূর্যের তেজ কমতে কমতে এমন তলানিতে এসে ঠেকবে যে, রোগ-জীবাণুতে পৃথিবীটা একেবারে থিকথিক করবে। জন্মাবার পর থেকেই একটার পর একটা জীবাণুর কবলে পড়বে মানুষ। রোগে ভুগবে। যত দিন বেঁচে থাকবে, ধুঁকে ধুঁকেই থাকবে।
জুরান জিজ্ঞেস করল, সে কী! সেই জীবাণুকে প্রতিরোধ করা যাবে না?
— যাবে। তবে সেই জীবাণুর থেকেও মারাত্মক ভাবে মানুষের ক্ষতি করবে যুগ যুগ ধরে অজ্ঞতার কারণে মানুষেরই তৈরি করা নানান দূষণ।

— দূষণ!

— হ্যাঁ, দূষণ। বিভিন্ন কলকারখানা থেকে বেরোনো বর্জ্য পদার্থে মাটি দূষণ, গাড়ির পেট্রল পোড়া ধোঁয়ায় বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, দৃশ্য দূষণ থেকে শুরু করে স্যাটেলাইট থেকে বিচ্ছুরিত রেডিয়েশন থেকে জীবজগতের শরীর দূষণ এবং এখনও অবধি তোমরা যাকে কোনও দূষণ বলেই মনে করো না, সেই সব দূষণ, সঙ্গে দূষণ তৈরির নিত্যনতুন গজিয়ে ওঠা আরও অনেক ড্রেন ওই পৃথিবীকে শুধু মানুষেরই নয়, সমস্ত প্রাণিজগত্‌ এবং উদ্ভিদজগতেরও বাসের অযোগ্য করে তুলবে।

— তাই? তা হলে যে-যুদ্ধের ভয়ে আমরা সব সময় শঙ্কিত হয়ে থাকি, প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো যাতে আর একটা ভয়ঙ্কর যুদ্ধ না-ঘটে, যে জন্য অত বছর আগেই পৃথিবীর শক্তিশালী বেশ কয়েকটা দেশ মিলে তৈরি করেছিল সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ, আমরা মাঝে মাঝেই ভাবি, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কথা না-হয় বাদই দিলাম, এখন পর্যন্ত শুধু ভারতেই মজুত রয়েছে সব চেয়ে শক্তিশালী যে তিন-তিনটে ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র— হাইড্রোজেন বোম। তার একটা ফাটলেই তো পৃথিবী একেবারে ধূলিসাত্‌ হয়ে যাবে। তা হলে কি সেটা নিয়ে অত ভয় পাওয়ার কিছু নেই?

— না না। কোনও ভয় নেই। ওটা বরং স্বাস্থ্যকর। যে কোনও গ্রহেই মাঝে মাঝে যুদ্ধ হওয়া ভাল।
— যুদ্ধ হওয়া ভাল! জুরান বিস্ময় ভরা চোখে সময়-কণার দিকে তাকাল।
সময়-কণা বলল, অবশ্যই ভাল। তাতে কিছু প্রাণহানি হয় ঠিকই, তবু আমি বলব, ভাল। যেমন গাছের ঝাড় বেড়ে গেলে কিছু কিছু অবাঞ্ছিত ডালপালা ছেঁটে দেওয়া উচিত। যাতে সে নতুন ডালপালা নিয়ে তরতর করে আরও ভাল ভাবে বেড়ে উঠতে পারে। ঠিক সেই রকম।

— কিন্তু যে কোনও যুদ্ধেই তো অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, রেলওয়ে স্টেশন, জমির ফসল…

— হ্যাঁ হ্যাঁ, হয়। আর হয় দেখেই তো নতুন উদ্যোমে ফের তৈরি করা হয়। না-হলে কি হত?
— কিন্তু ওই একটু একটু করে ক্ষতি হতে হতে যদি গোটা পৃথিবীটাই একদিন শেষ হয়ে যায়!
— হবে না। কারণ, পৃথিবীর ক্ষতি করার মতো ক্ষমতা মানুষের নেই। কোনও দিন হবেও না। মানুষ যেটা করতে পারে, সেটা হল— কলুষিত।

— কলুষিত! সেটা আবার কী!

— দেখেছ, কী অবস্থা! তোমাদের ভাষা কেমন হু হু করে পাল্টে যাচ্ছে! তোমাদের ভাষা তোমরাই বুঝতে পারছ না! অবশ্য এটাও হতে পারে, তোমাদের সব ভাষা মিলিয়ে যে জগাখিচুড়ি ভাষা তৈরি হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত এত দ্রুত তা পাল্টে যাচ্ছে যে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের অত্যাধুনিক ‘অটোমেটিক অনুবাদ যন্ত্র’ও সেটা আপ টু ডেট করে উঠতে পারছে না।
— সে নয়, ঠিক আছে। কিন্তু কলুষিত মানে কী?

— কলুষিত মানে কলঙ্কিত করা। নোংরা করা। অন্ধকারে ঢেকে দেওয়া।

— ও… তার মানে, মানুষ একটু-আধটু পৃথিবীর ক্ষতি করতে পারে ঠিকই, কিন্তু কোনও দিনই পৃথিবীকে ধ্বংস করতে পারবে না, তাই তো? আচ্ছা, এই যে মাঝে মাঝেই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়, পৃথিবী তোলপাড় করে দেয় ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, টাইফুন, টর্নেডো, সুনামি, হেরিকেন… লক্ষ লক্ষ লোক মারা যায়। দেশের পর দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নতুন নতুন নামের ওই সব দুর্যোগ কি কোনও দিন আরও বড় আকার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে ?
— না। পারে না। কারণ, ওই প্রাকৃতিক দুর্যোগও তো পৃথিবীরই একটা অংশ। কোনও মানুষ কি নিজের হাতে নিজের গলা টিপে নিজেকে শেষ করে দিতে পারে? পারে না তো? ঠিক তেমনি, পৃথিবীরই একটা অংশ— দুর্যোগ, কখনও পৃথিবীকে ধ্বংস করতে পারে না। আর তার চেয়েও বড় কথা, শুধু নিজের নয়, প্রকৃতি কখনও কারও কোনও ক্ষতি করে না।
— সে কী!
— হ্যাঁ। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতি মনে হলেও জানবে, প্রকৃতি যা ঘটায়, সেটা ভালর জন্যই ঘটায়। মঙ্গলের জন্যই ঘটায়।
— ভালর জন্য ঘটায়! মঙ্গলের জন্য ঘটায়! প্রকৃতি যা ঘটায়, সব কিছু ভালর জন্য! জুরানের চোখ চকচক করে উঠল। মুখ দিয়ে কোনও রা বেরোল না।
ছয়
 
সময় তো প্রকৃতিরই একটা অঙ্গ। তার মানে প্রকৃতি যখন কারও কোনও ক্ষতি করে না। সময়-কণাও করবে না। অর্থাৎ তার ভয়ের কোনও কারণ নেই। মনে মনে এটা ভেবে একটু আশ্বস্ত হল জুরান। আর সেই আশ্বস্ত হওয়ার পাশাপাশি বেশ খুশিও হল, মাঝখান থেকে একেবারে বিনে পয়সায় রকেটের চেয়েও দ্রুতগতিতে একদম নিরাপদে ভবিষ্যত্‌ সফর করার এমন সুবর্ণ সুযোগ পাওয়ার জন্য।

কিন্তু যে সময়-কণার সঙ্গে সে কথা বলছে, সে কোথায়! তার সামনে আসছে না কেন! তাকে দেখতে কেমন! তার পায়ের পাতা কি ইয়া বড় বড়!

বরফে ঢাকা হিমালয়ের গায়ে বিশাল বিশাল পায়ের ছাপ দেখে এক সময় কিছু লোক বলেছিলেন, এরা নিশ্চয়ই ভিন্‌ গ্রহবাসী। পৃথিবীতে নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করতে এসেছিল। ওরা পৃথিবীর মানুষের থেকে হাজার হাজার গুণ বেশি বুদ্ধিমান। ওরা হয়তো এই দুনিয়ার বুকে থাবা বসাতে চায়। এই বিশ্বের মানুষকে দাস বানাতে চায়। তাই খোঁজখবর নিতে এসেছে এখানকার প্রাণীরা কেমন। এখানকার জীবদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কতটা। সহ্যশক্তিই বা কতখানি। আর যেই তারা বুঝতে পারবে, তাদের তুলনায় এই জগতের প্রাণীরা কিছুই নয়। না-বুদ্ধিতে। না-শক্তিতে। না-ক্ষমতায়। তখন তারা পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর মানুষের পক্ষে তখন এই পৃথিবীতে বাস করাই দায় হয়ে দাঁড়াবে।

‘কিন্তু এরা কারা?’ চার দিক থেকে প্রশ্ন উঠতেই অনেক ভেবেচিন্তে পায়ের ছাপ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে সেই লোকগুলি বলেছিলেন, ওরা হল ইয়েতি।

তা হলে কি এরাই সেই ইয়েতি! হতে পারে! কিন্তু এদের দেখতে কেমন! যাদের পায়ের পাতা অত বড় বড়, তাদের চেহারাও নিশ্চয়ই দশাসই হবে। এখন লুপ্ত হয়ে গেলেও, এক সময় এই পৃথিবীতেই বাস করত ডাইনোসরের মতো বিশাল বিশাল প্রাণী। মানুষের চেহারাও এত ছোটখাটো ছিল না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় জাদুঘর কিংবা মিউজিয়ামে গেলে। এক-একটা তলোয়ারই চার-পাঁচ ফুট লম্বা। ওই তলোয়ার কোমরে নিয়ে ঘুরতে গেলে তাঁদের কতটা লম্বা হওয়া দরকার, ভাবতে গেলেই অবাক হতে হয়। হতবাক হতে হয়, তাঁদের বর্ম দেখে। অত বড় ছাতি কারও হয়?
যাঁদের অত বড় ছাতি, না-জানি তাঁদের মনটাও কত বড়!

কোথায় যেন সে পড়েছিল, কে নাকি একবার বলেছিলেন, মানুষ একদিন ছোট হতে হতে এত ছোট হয়ে যাবে যে, যে-গাছ এক-দেড়, খুব বেশি হলে দু’বিঘত লম্বা, সেই গাছ থেকে লঙ্কা পাড়তে গেলেও মানুষকে লগি ব্যবহার করতে হবে।

তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী কি ইতিমধ্যে ফলতে শুরু করেনি! চার দিকে তাকালে ওই রকম দশাসই চেহারার কোনও মানুষ কি আর দেখতে পাওয়া যায়! সবাই কেমন যেন ধীরে ধীরে ছোট হতে হতে একেবারে লিলিপুট হয়ে যাচ্ছে। আর শরীর যত ছোট হচ্ছে, তাঁদের মনও যেন ততই ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে।

সেই দলে কি সেও পড়ে না! পড়ে। তবু সে প্রাণপণ চেষ্টা করবে শরীর যতই ছোট হোক না-কেন, তার মনটা যেন কিছুতেই ছোট না-হয়। তার মানবিকতায় যেন কোনও খামতি দেখা না-যায়।

ছোটবেলায় সে যখন ভিন্‌ গ্রহবাসীদের নিয়ে কোনও সিনেমা দেখত, দেখত— ভিন্‌ গ্রহবাসীদের সারা শরীর জুড়ে শুধু ইলেকট্রিকের তার আর তার। অত তার যে কেন ঝুলত, সে বুঝতে পারত না।

তারা এখন সবেমাত্র চাঁদে পা রেখেছে। মঙ্গলগ্রহে যান পাঠিয়েছে। তাদের গ্যালাক্সির অন্য গ্রহগুলিতে কবে যাবে, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। কেউ জানে না, ক’শো বছর পরে কম করে ছ’হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেট উত্তাপ প্রতিরোধকারী আপাদমস্তক ঢাকা পোশাক তৈরি করে সূর্যের সব চেয়ে কম উষ্ণ জায়গা ফোটোসফেয়ারের বুকে পা রাখবে মানুষ— তাতেই, সেখানে নয়, এই বিশ্বেই তাদের কানে তার উঠেছে। সেই তার কানে গুঁজে মোবাইলে কথা বলছে। গান শুনছে। এর পরে যদি আর দু’-একটা গ্রহে পা রাখে, আরও চমক সৃষ্টিকরী দৈনন্দিন ব্যবহারের অপরিহার্য সরঞ্জাম বাজারে আসে, তা হলে তো কথাই নেই। এই দুনিয়ায় থাকলেও তাদের হাবভাব ওই ভিন্‌ গ্রহবাসীদের মতোই হয়ে যাবে। সারা শরীর তারে তারে ছেয়ে যাবে।
এদের শরীরও কি তেমনই তারে তারে ঢাকা! হতে পারে! সে হোক, তাতে তার কোনও অসুবিধে নেই। সে যখন জেনে গেছে এরা কখনও কারও কোনও ক্ষতি করে না। তখন আর ভাবনা কীসের? ভাবনা শুধু একটাই, এদের চেহারা, পোশাক-আশাক যাই হোক না-কেন, এদের মনটা কেমন? খুব বড় মাপের কী! নিশ্চয়ই বড় মাপের। তা না-হলে এতক্ষণ ধরে তার সঙ্গে এ ভাবে এরা কথা বলত না!

তা, এখনও তার সঙ্গে যখন এরা কথা বলছে, তা হলে তো আরও কিছু এদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যায়, নাকি! তাই জুরান জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, হিমালয়ের গায়ে ওই বিশাল বিশাল পায়ের ছাপ দেখে আমাদের পৃথিবীর অনেকেই তো বলেছিলেন, ওটা কোনও ভিন্‌ গ্রহবাসীর পায়ের ছাপ। কেউ কেউ বলেছিলেন, ভিন্‌ গ্রহবাসী নয়, ওই পায়ের ছাপ ওই পৃথিবীরই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া, এক বিশালাকায় মানব প্রজাতির শেষ বংশধরের। আবার কেউ কেউ বলেছিলেন, না। ও সব কিছুই নয়। হিমালয় তো আসলে স্বর্গ। ওখানে দেবাদিদেব মহাদেব থাকেন।

তাঁর সঙ্গে দেখা করতে অনেক দেবদেবীই সেখানে যান। আর দেবদেবীরা তো যখন তখন যে কোনও রূপ ধারণ করতে পারেন। কখনও ছোট হন তো কখনও বড়। বড় বড় ওই পায়ের ছাপ নির্ঘাত্‌ ওই দেবদেবীদেরই কারও হবে। এত লোক এত যুক্তি দেখিয়েছেন যে, এখনও অনেকে ধন্দে আছেন, কোনটা ঠিক? সত্যিই কি ওগুলো দেবদেবীদের পায়ের ছাপ?

সময়-কণা বলল, দেবদেবী? না না। দেবদেবী বলে কিছু হয় না।
— তা হলে?
চলবে   ………..

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *