অতৃপ্ত প্রেম – আরাধনা বিশ্বাস

মনটা বড়ই কু গাইছে। সপ্তাহখানিক হলো পিসতুতো বোন সুমি ফোন করেছিলো।কিছু একটা বলতে গিয়েও কথা আটকে গিয়েছিল তার। শুধু এইটুকুই বললো, আমাকে তার অনেক কিছু বলার আছে, একটু সময় নিয়ে পরে বলবে। আমিও জোর করলাম না। সুমি যেদিন চাইবে বলতে সেই দিনই শুনবো। নিজের কথা গোপন রাখার পূর্ণ অধিকার তার আছে। সংসারের কাজের চাপে আমি সে কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কাল রাত থেকে হঠাৎ করেই সুমির জন্য চিন্তাটা মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে।

আজ পঁচিশে বৈশাখ। সকাল থেকেই মাইকে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে। মনটাও গুণ গুণ করে দুকলি গাইছে ” যে রাতে মোর দুয়ার গুলি ভাঙ্গলো ঝড়ে”। রবীন্দ্রনাথ জুড়ে আছে আমাদের শয়নে,স্বপনে, জাগরণে। সুমি অসাধারণ সুন্দর রবীন্দ্রসংগীত গায়।

তার গান মনের অন্তঃস্থলের গভীরে গিয়ে ধাক্কা দেয়, নাড়া দিয়ে যায় সমস্ত স্বত্তাকে। সেদিন সুমি কি বলতে চেয়েছিল? কোন কষ্টের কথা? না, এমন কোন কথা যা ও বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। আমিও তো আর ফোন করিনি। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হলো।
সুরের তাল কেটে টেবিলে রাখা মুঠোফোন বেজে উঠলো। উপরের স্ক্রিনে মায়ের ছবি ভেসে এলো ।
–হ্যাঁ বলো।

— কি করছিস এখন?

এটা আবার কেমন প্রশ্ন হলো। মা তো জানেই, কিকরি এই সকাল এগারোটার সময়। তাও বললাম,
–রান্নার জোগাড় করছি।

— রান্না সেরে একবার আসতে পারবি এখানে? পিসির বাড়ি যাব।

বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সেখানে কে যেন সজোড়ে ঢাক পিটাচ্ছে। গত কালের কু গাওয়া কথাটা মনে পরে গেল। কাঁপা স্বরে বললাম, ‘সুমি ভালো আছে তো?’ মা জানালো, তিনি নিজেও জানেনা। মা ‘কে পিসি ফোন করে আসতে বলেছে।

মায়ের সাথে পিসির বাড়িতে যখন পৌঁছালাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। গিয়ে যা শুনলাম, তাতে আমার মাথা ঝিমঝিম করছে, এখনি হয়তো অজ্ঞান হয়ে যাবো। সুমি কাল রাত্রে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। সকাল দশটার দিকে পুলিশ এসে বডি নামিয়ে নিয়ে গেছে।

সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেছে। আবার আসবে বলেছে।কেউ জানেনা সুমি কি কারণে এমনটা করলো। কাউকে কিচ্ছু বলেনি। পিসি’তো কান্নায় একেবারে ভেঙে পড়েছে। খুব শান্ত, চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল সুমি, ভারী মিষ্টি সুর ছিলো তার গলায়। কি এমন হলো, যার জন্য সুমি এই রাস্তা বেছে নিল।

সেদিন সুমি কি তাকে মনের সেই গোপন রহস্যটাই জানাতে চেয়েছিলো? নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে, কেন সেদিন জোর করলাম না মেয়েটিকে! হয়তো বলতে চেয়েও পারেনি।
শরীর খারাপ লাগায় কিছু সময় পরেই ফিরে এলাম নিজের বাড়িতে। এই ব্যাপার নিয়ে গৃহকর্তাটির সাথে আলোচনা করতে মন চায়নি।তিনিও আমাকে বিরক্ত করেনি। সারাদিন ডুবে ছিলাম সুমির চিন্তায়।

মানসিক ভাবে ক্লান্ত শরীর রাত্রে বিছানা পেতেই ঘুমকে আলিঙ্গন করে নিয়েছে। রাত্রি তিনটে হবে, ঘুমটা হঠাৎই ভেঙে গেল।পাশের বিছানায় গৃ্হস্বামী গভীর নিদ্রামগ্ন। । অন্ধকার ঘরে কার একটা উপস্থিতি টের পাচ্ছি। কিছুক্ষন পর সেই ছায়ামূর্তি এলো আমার মাথার কাছে।

কপালে হাতের একটা আলতো স্পর্শ অনুভব করলাম। গা ছমছম করে উঠলো। মনে একটু সাহস জুগিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ সুমি এসেছিস? ‘ কোন উত্তর পেলাম না। সারা ঘরে তার চলাফেরা টের পাচ্ছি। আতঙ্কে হাত পা কাঁপছে। তবুও আমায় জানতেই হবে, সুমি কেন এমন করলো?


আমি অনুভব করলাম সে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।ওর পিছু পিছু আমিও বিছানা ছেড়ে উঠে গেলাম। সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে আলো জ্বালাবার চেষ্টা করলাম, আলো জ্বললো না। জানলা দিয়ে ভেসে আসা রাস্তার আলোতে করিডোরে এবার ছায়ামূর্তিটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম। মুখ দেখা যাচ্ছেনা।লাইটের বিপরীতে যেমন ছায়া পড়ে, ঠিক তেমনই। সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘কি হয়েছিলো সুমি? কেন এমন করলি? পিসি, পিসোর কথা একবারও ভাবলি না। ‘

মনে হলো ছায়ামূর্তিটি কান্নায় ভেঙে পরেছে। তারপর তার চোখের জলের ধারা দিয়ে দেওয়ালে লিখলো, ‘সমর’। তারপর হঠাৎই একটা শিশুর কান্নার আওয়াজ পেলাম। আওয়াজটা মনে হলো ছায়ামূর্তির শরীরের ভিতর থেকে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে সে কান্না ভেজা চোখে যেন এবার আগুন জ্বলে উঠলো ।

একটা গোঙানির শব্দ, তাতে মনে হলো খুব রেগে আছে,এরপরেই সে দরজার কাছে গিয়ে মিলিয়ে গেলো। আমি পুনরায় বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম, কিন্তু ঘুম আসছেনা। কি লিখলো ও, সমর! হঠাৎ মনে পড়লো, আরে সমরকে তো আমি চিনি, পিসির পাড়াতেই থাকে। সুমির গানের টিচার। সকালে গিয়ে ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে।

পরদিন পিসির বাড়ি গিয়ে জানতে পারলাম, গতকাল রাত্রে ভোর চারটের দিকে সমর হার্টফেল করেছে। ওর বাড়ির লোক কিছুই বুঝতে পারছেনা, কি করে এসব হলো। সমরের কাকিমা জানালো, ওর ঘর থেকে রাত্রের দিকে একটা অস্পষ্ট চীৎকার শোনা গেছিল, কিন্তু তিনি সেটাকে অত গুরুত্ব দেননি, আজ সকালে উঠে উনি নিজেকে দোষী ভেবে কান্নাকাটি করছেন।

আমি গত রাতের ঘটনাটা কাউকে আর বলিনি। সুমি তার প্রতিশোধ পূর্ণ করেছে, তার আত্মা যদি এতে শান্তি পায় তো পাক। যতটুকু জানতে পারলাম, তাতে বুঝলাম, সামনের মাসে সমরের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। সুমির এক বান্ধবীর কাছ থেকে গোপন ভাবে জানলাম, সুমির সাথে মন্দিরে লুকিয়ে বিয়ে করেছিলো সমর, তারপর ওদের মেলামেশা অনেকটা দূর পর্যন্ত গড়িয়ে ছিল। শেষে সমর সেসব অস্বীকার করেছিল। ওদের দূরত্বও অনেক বেড়ে গিয়েছিল।

সুমির শ্রাদ্ধশান্তি সব মিটে গেছে।ময়নাতদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে সে গর্ভবতী ছিল। পিসির পরিবার লজ্জায়, দু:খে সে কথা কাউকে বলতে চাইনি। আমি পরে মায়ের মুখে শুনেছি।সমর মারা যাওয়ায় পুলিশি ঝামেলা বেশি পোহাতে হয়নি। সুমি তার সন্তানের বাবাকে সাথে করেই নিয়ে গেলো। এখন হয়তো সমরের সাথে সে ভালোই আছে। ইহলোকে যে প্রেম পূর্ণতা পায়নি, পরলোকে সেই মিলন সম্পূর্ণতা পাবে। ‘মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সম। ‘

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *