ভালো আছি – রথীন্দ্রনাথ রায়

অনিকেত, তোমাকে চিঠি না লিখে আর পারছি না । আর এই চিঠিটা হাতে পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যাবে । আরও আশ্চর্য হয়ে যাবে লেখিকার পরিচয়ে । তবে সে পরিচয় পেতেও এই চিঠির বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা ওল্টাতে হবে । প্রশ্ন জাগতে পারে এতকাল পরে কেন আমি তোমাকে চিঠি লিখতে বসলাম । যখন লেখার দরকার ছিল তখন লিখিনি । যখন ডাকলে সাড়া দিতে পারতে তখন ডাকিনি । আজ এই এতোকাল পরে হিসাবনিকাশের খাতাটা যখন খুললাম, তখন দেখলাম একটা গোলমাল রয়ে গেছে । রয়ে গেছে অনেক কাল আগে থেকে ।হিসাবটা এতোকাল পড়ে রইল তাতে আমার মাথাব্যথা হয়নি । 

অথচ আজ সেটা নিয়ে মেতে উঠলাম । বলতে পারো এটা আমার খেয়াল । আমার খামখেয়ালি চিত্তের বেহিসেবি কার্যকলাপ । দেখো ছেলেরা খেয়ালি হলেও তারা ঠিক মানিয়ে নিতে পারে । কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে খামখেয়ালি হবার উপায় নেই । পদে পদে শাসন-অনুশাসন আমাদেরকে অক্টোপাসের মতো ঘিরে রেখেছে । আমরা হৃদয়টাকে মনে করি রক্ত মাংসের পিণ্ড । এই শব্দটার যে আলাদা একটা তাৎপর্য আছে তা ভেবে দেখারও সময় পাইনা । 

আমরা মানুষ অথচ ‘মানুষ ‘ নই । তবে একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আছে । যে বৈশিষ্ট্য তাকে পশুদের থেকে আলাদা করেছে । এমনকি প্রত্যেক ব্যক্তির একটা আলাদা নিজস্বতা আছে  — তবু প্রত্যেকের চাওয়াপাওয়াগুলোকে একই তূলাদণ্ডে রেখে পরিমাপ করি । আর এর থেকেই আসে ট্রাজেডি । যার শিকার আমরা প্রত্যেকেই । জীবনের কোনও না কোনও সময় আমরা অন্ধকারে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলি । তুমি হয়তো বুঝতে পারছনা কি একটা নিদারুণ অব্যক্ত যণ্ত্রণা আমার শরীরটাকে কুঁকড়ে দিচ্ছে । আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইছি কিন্তু পারছি না । গীতায় কর্মযোগ পড়েছি । 

কিন্তু খুঁজে পাইনি আমাদের কর্মধারার রহস্যটা কোথায় নিহিত রয়েছে । প্লিজ অনিকেত, তুমি কি আমাকে বলে দেবে, এ রহস্যটা আসলে কি  ? 

আচ্ছা অনিকেত, তোমার মনে পড়ে আমাদের সেই প্রথম সাক্ষাতের কথা? কি লাজুক ছিলে তুমি । তেমনি বোকা বোকাও । যখন তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলছিলে তখনই ড্রয়িং রুমে এসেছিলাম আমি । বাবা আমাকে বললেন, মিতা তোমার অখিলকাকাকে মনে পড়ে  ? আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতেন । 

— অখিলকাকা  ?

অনেকক্ষণ স্মৃতি হাতড়ে বললাম, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে । উনি খুব গান ভালোবাসতেন, তাই না বাপি  ?বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত । 

— সম্প্রতি উনি মারা গেছেন । 

— ভেরি স্যাড  ! 

জানো অনিকেত, সত্যি বলতে কি তোমার দুঃখকে সেদিন ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম । ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত তাই না । সত্যি বলছি, সেদিন কিন্তু তোমার প্রেমে পড়িনি । তোমার সব হারানো চোখদুটোর দিকে চেয়ে আমি শুধু করুণা করতে চেয়েছিলাম । জানিনা বাবা আমার নির্বাক অবস্থাটা লক্ষ্য করেছিলেন কিনা । বললেন, মিতা তুমি অনিকেতকে ভিতরে নিয়ে যাও । তোমার মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও । আর হ্যাঁ দক্ষিণ দিকের ঘরখানা তো খালিই আছে । ওটাই অনিকেতের জন্য ঠিক করে দাও । 

তুমি বড্ড সংকোচ করছিলে সেদিন । কি জানি কেন  ? তোমাকে নিয়ে ভেতরে আসলাম । মা বললেন, তুমি অখিলেশের ছেলে ? ও কত্তো বড় হয়ে গেছ । তোমার বয়স যখন ছয় কি সাত হবে তখন আমরা শ্যামনগর থেকে চলে আসি । তারপর নানা কারণে আর যাওয়াই হয়ে ওঠেনি । 

যতদূর মনে পড়ে, মায়ের গলাটা তখন বুঝি  ভারি হয়ে এসেছিল । কান্নাভেজা কণ্ঠে মা সেদিন আরো বলেছিলেন  , জানো অনিকেত তোমার বাবা সত্যিই একজন ভালো লোক ছিলেন । সাধারণ মানুষেরা এরকম মানুষদের সহ্য করতে পারে না । ন্যায় নীতি বিবেকের বশংবদ হয়ে থাকাটা এখানে অন্যায় । 

— মা, তুমি অখিলেশ কাকাকে চিনতে  ? 

— কেন চিনব না  ? 

— না মানে তোমাদের কালের বন্ধু কিনা  ! 

— যাঃ, তুই বড্ড ফাজিল হয়ে গেছিস । 

নাঃ, আমি আর দাঁড়াবার জায়গা পাইনি । কোথায় আমাদের কালের জয়যাত্রার কথা বলে মাকে পুরনো কালের প্রতিনিধি করে দাঁড় করিয়ে দেব– তা নয়  ! জানো মা সবসময় তাল কেটে দিতেন । তাঁর ব্রত ছিল রসভঙ্গ করা । রসভঙ্গ করেই উনি বুঝি আনন্দ পেতেন । হোক না বালির পাহাড় । তবু তো পাহাড় । তার শিখরে উঠে যদি এভারেস্টে ওঠার আনন্দ পাই তো পেতে দোষ কি ?

 আমরা সব জেনেও সুখ নামক আলেয়ার পিছনে ছুটে বেড়াই । জানি আলেয়াকে ধরা যায় না । যায়নি কখনো । ব্যাপারটা হল আমাদের সুখ কিসে হবে তা আমরা নিজেরাই ঠিক করতে পারিনা । অথচ সুখের প্রতি একটা তীব্র আকাঙ্খা আমাদেরকে তাড়া করে বেড়ায় । কি পেলে সবচেয়ে বেশি সুখী হবো শেষপর্যন্ত তা ঠিক করতেই পারিনা । এই না ঠিক করতে পারাটাই আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি অসুখী করে তোলে । 

দেখেছো, প্রসঙ্গ থেকে কতো দূরে চলে গেছি । 

প্রসঙ্গটা ছিল প্রথম দেখা । না, কোনও বিশেষ অর্থে দেখার কথা বলছি না । মায়ের কাছ থেকে তোমার ঘরে তোমাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম আমিই । যখন দেখলাম সেখানেও তুমি সিঁটিয়ে রয়েছো– আমার মনে হয়েছিল তুমি শুধু বাইরেই দুর্বল নও, ভিতরেও । 

কয়েকদিন পরে বাবা বললেন, মিতা  অনিকেত তোমাকে পড়াবে । 

সত্যি বলতে কি– তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না সেদিন । তোমার গেঁয়ো গেঁয়ো ভাব, বোকা বোকা আর লাজুক লাজুক চেহারা দেখে তোমাকে উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস আমাকে পেয়ে বসেছিল । গণিতের সব থেকে শক্ত অঙ্কটা দিয়েছিলাম, ইংরেজির সব থেকে শক্ত পড়াটা দিয়েছিলাম আমাকে বুঝিয়ে দেবার জন্য । কিন্তু যখন তুমি অনায়াসে অতিক্রম করলে তখন আর তোমার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ ছিলনা । 

           #          #          #           #          #

অনেকগুলো বছর কিন্তু ইতিমধ্যে কেটে গেছে । হিসাব করিনি এই দিনগুলো আমার কাছে কি নিয়ে এসেছিল । একটা দিনের কথা আজ বড় বেশি করে মনে পড়ছে । দিনটা চুরাশি সালের ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে হবে । আসলে পড়ানোর  ক্ষেত্রে ভেরি পাঙ্কচুয়াল ছিলে তুমি । আমি আমার ঘরে বই, খাতাপত্র নিয়ে বসে থাকতাম । একসময় তোমার ঘর থেকে চটিজুতার ফটাস ফটাস শব্দ আমার ঘরের দিকে নিকটতর হতো । হয়তো সেদিন থেকেই আমি তোমার প্রেমে পড়েছিলাম ।

 নাহলে একটা অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসত কেন  ? কেনই বা তোমার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে বসে থাকতাম  ? পড়তে বসে বারবার অমনোযোগী হয়ে পড়তাম । কলমের ডগাটা ঠোঁটের ওপর ঘষতে ঘষতে কখন যে ঠোঁটদুটো কালিতে ভরে যেত বুঝতে পারতাম না । সেরকমই একদিন যখন তুমি বললে, কলমের ডগাটা ঠোঁটের ওপর ঘষছ কেন? কালিতে ভরে গেছে । যাও ধুয়ে এস । 

সত্যি বলতে কি আমার গলাটা তখন শুকিয়ে কাঠ । ভিজিয়ে নেওয়ার দরকার হয়েছিল । মুখটা ধুয়ে অনেক জল খেয়ে ছিলাম । কিন্তু পিপাসা মেটেনি । তখন ছবি আঁকার বেশ হাত ছিল তোমার । মাঝে মাঝে তোমার আঁকা ছবির বিষয়বস্তু আমার কল্পনার সঙ্গে বেশ মিলে যেত । তখন এতো ভালো লাগত যে সেটাও প্রকাশ করতে পারতাম না । সেদিন একসময় বললাম, অনিকেতদা আজ থাকনা ।

— কেন  ? 

— ভালো লাগছেনা । 

তুমি গুরুগম্ভীর গলায় বললে  , কিন্তু ভালো না লাগাটাও তো ভালো নয় । 

— তা হোক । আজ কিছুতেই ভালো লাগছে না । 

সেদিন একপ্রকার পালিয়ে বেঁচেছিলাম । তোমাকে কি ভয় পেতাম  ? কখনোই না । তবু কেমন যেন নিজেকে হাল্কা মনে হতো । ব্যাখ্যা করতে পারতাম না । আজও পারিনা । নিজেকে এতো দুর্বল মনে হতো যে শুধু কাঁদতে ইচ্ছে করতো । তাও পারতাম না । তখন তুমি মেয়েদেরকে একদলা রক্তমাংসের পিণ্ড ছাড়া ভাবতে পারতেনা । ধীরে ধীরে একটা প্রতিহিংসা আমায় পেয়ে বসেছিল । সবসময় ভাবতাম কিভাবে তোমার ক্ষতি করা যায়  ? 

কিন্তু সে ভাবনাটাও বেশিদিন বজায় থাকেনি । যেন আমার মধ্যেই আমি পরিবর্তিত হতে শুরু করলাম । তোমার মনে পড়ে কিনা জানিনা  — একদিন মা সকাল সকাল মন্দিরে গেলেন পূজো দিতে । কাজের মাসিও সেদিন আসেনি । তাই আমার ওপর ভার ছিল তোমাকে খেতে দেওয়ার । কেন জানিনা আমি আমার কর্তব্যে অবহেলা করলাম । কেমন যেন একটা অবসন্নতা আমাকে পেয়ে বসল । হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম ।

 এগারোটা বেজে দশ । তুমি তখন না খেয়েই কলেজ চলে গেছো । সত্যি বলছি, তুমি বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি । অহেতুক নিজের সুখদুঃখকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তোমার ওপর অবিচার করলাম । মা ফিরে এসে অনেক বকুনি দিলেন । শুনলাম অনেক জ্ঞানের কথা । ‘ লেখাপড়া শিখছিস বলে কি পরিবারের প্রতি কোনও কর্তব্যবোধ থাকতে নেই ? ছেলেটা না খেয়ে কলেজ চলে গেল আর সেটা তুই কিনা দেখেও দেখলি না । ‘

আরও অনেক কথা । 

না মায়ের খাওয়া হয়নি । হয়নি আমারও । সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ফিরলেন । ভেবেছিলাম তিনিও বকবেন ।পরিবর্তে মাথায় হাত রেখে বললেন, ওঠ মা । যা হবার সে তো হয়েই গেছে । না খেয়ে বসে থাকলেও সে তো আর ফিরবেনা । 

বিছানা থেকে একপ্রকার জোর করেই ওঠালেন । খাওয়ালেন নিজের কাছে বসিয়ে ।  জানো, সংসারে বাপিই একমাত্র আমাকে বুঝতে চাইতেন । আর কেউ না । খেতে বসলাম । কিন্তু খাওয়া হয়নি । সবসময় শুধু তোমার কথা মনে হচ্ছিল । আমার মনে হয়েছিল আমি খেতে বসেছি– আর তুমি ভাবছো আমরা এমনই যান্ত্রিক যে এখানে মানবিক বৃত্তিগুলোর কোনও মূল্য নেই । আমরা যেন ছাঁচে গড়া পুতুল । আমাদের হৃদয়টা বুঝি একতাল মাংসপিণ্ড । 

পরদিন সারাটা দুপুর কাটালাম তোমার ঘরে । কি নোংরাটাই না করে রেখেছিলে ঘরটা । পড়ার টেবিলে ছিল যত রাজ্যের ভালো মন্দের খবর । কি দরকার ছিল এতো ভালো মন্দের খবরে  ? বইয়ের আলমারিতে দেখি কিনা একটা বিড়ালবাচ্চা বেশ ঘুমাচ্ছে । দিলাম ত্রিসীমানার বাইরে বের করে । আর বিছানা  ? সেটা না বলাই ভালো । এতোদিন পরে সেসব কথায় একটু হাসবে নিশ্চয় । 

যাই হোক যথারীতি বিকলেই ফিরে এসেছিলে এবং নিজের ঘরটিতে ঢুকে খুশি হতে পারোনি নিশ্চয় । বিকেলে খাবার নিয়ে এসে দেখলাম তুমি টেবিলেই মাথা রেখে ঘুমাচ্ছ । বিছানাটা যতোটা যত্নে গুছিয়ে ছিলাম, ঠিক ততোটা যত্নেই তুমি আবার সেটা নোংরা করেছ । সবকিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার হয়ে ছিল । আমি কিন্তু তোমার ওপর মোটেও রাগ করতে পারিনি । পরিবর্তে একটা প্রসন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছিল । আমি তোমাকে আঘাত করে আশা করতাম তুমিও আমাকে পাল্টা আঘাত করবে । 

— অনিকেতদা, আপনার খাবার । 

তুমি ফুঁসে উঠে বললে, কেন বিরক্ত করতে এসেছ আমাকে  ? 

আমি সেই মুহূর্তে আর কিছু বলতে পারিনি । বেশ কিছুক্ষণ নখ খোঁটার পর বললাম, আপনি আমাকে ক্ষমা করতে পারেননা  ? 

তুমি শুধু একবার চোখদুটো তুললে তারপর পূর্ববৎ । আমার কথাগুলো তোমার পাথর মনের দেওয়ালে প্রতিহত হয়ে  ফিরে এল । কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মায়ের কথাকে ফিরিয়ে দিতে পারোনি । বাধ্য ছেলের মতো তুমি মাকে অনুসরণ করলে । 

আচ্ছা অনিকেত, আজ এতোকাল পরে একটা প্রশ্ন করতে পারি কি ? সেদিনের যতো রাগ, অভিমান  — শুধু কি আমার জন্য ? হ্যাঁ মানছি, আমি ভুল করেছিলাম । কিন্তু তার জন্য আমি নিজেও কি কষ্ট পাইনি  ? খোঁজ নাওনি । নিতে চাওনি । নিলে বুঝতে পারতে  — ঠিক যতোটা কষ্ট তুমি পেয়েছ তার চেয়ে কোনও অংশেই কম কষ্ট পাইনি আমি । তোমরা ভালো লাগা বা মন্দ লাগাকে প্রকাশ করতে পারো । কিন্তু রা মেয়েরা তা পারিনা । আমাদের সমাজ মেয়েদের সে স্বাধীনতা দেয়নি । বিধিনিষেধটা কোথায় জানো  — সামাজিক নিয়মকানুনের মধ্যে । অবশ্য তোমাকে এ ব্যাপারে বিশেষ কিছু বলার নেই । কেননা তুমি সমাজতত্বেরই ছাত্র ছিলে এবং বর্তমানে সমাজতত্বেরই অধ্যাপক । 

দেখেছো চিঠির কলেবর বেড়েই চলেছে । আমি যেটা বলতে চাইছি কিছুতেই সেটা বলতে পারছিনা । এই বলতে না পাড়াটা মেয়েদেরই একটা নিজস্ব সমস্যা । জানো তো মেয়েদের বুক ফাটলেও মুখ ফোটে না । অবশ্য সবটা কেউই বলতে পারেনা । সে নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন । কিছু কিছু বিষয় সামগ্রিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে অনুমান করে নিতে হয় । এটাও ঠিক যে সবাই সঠিক অনুমান করতে পারে না । কারণ যে যুক্তির ওপর নির্ভর করে তারা অনুমান করে অনেকসময় সে যুক্তিগুলো সংকীর্ণতার দোষে দুষ্ট হতে পারে । 

আজ আরো একটা দিনের কথা বেশি করে মনে পড়ছে । তোমার আমাদের বাড়িতে আসার প্রায় বছরখানেক হয়ে গেছে । প্রথম দিকে তোমার মধ্যে যে সংকোচ ও আড়ষ্টতা ছিল তা অনেকটা অনুপস্থিত । তখন তুমি ধীরে ধীরে হুকুম করতে শুরু করেছ । তোমার যে কিছু দাবী করার আছে  — এটা তুমি প্রকাশ করতে শুরু করেছ । আমার বেশ ভালো লাগত । আর ভালো লাগত বলেই অবাক বিস্ময়ে তোমার দিকে চেয়ে থাকতাম ।

 আর ভাবতাম কি আশ্চর্য বৈসাদৃশ্য তোমার ভিতরের ও বাইরের ব্যক্তিটার মধ্যে । তখন থেকেই বোধহয় তোমাকে অন্যরকম ভাবে ভালো লাগতে শুরু করেছিল । একটু একটু করে তুমি আমার মনের সবটুকু দখল করে নিয়েছিলে । আমি অপেক্ষা করতাম কখন তুমি আমাকে একান্তে কাছে ডাকবে । কিন্তু তুমি ডাকোনি । তোমার সে সাহসও ছিলনা । 

একটা কথা তোমার মনে আছে কিনা জানিনা  — সেদিনটা ছিল শ্রাবণ মাসের কোনও একটা দিন । সকাল থেকেই বৃষ্টি । বাইরেও বেরোনো যায়না । ঘরেও অস্বস্তি । হঠাৎ মনে হয়েছিল তোমাকে কষ্ট দিতে হবে । কিন্তু কিভাবে । যাই হোক ভাবতে ভাবতে একটা উপায় ঠিক করে ফেললাম । বাড়ির কাজের গীতা মাসিকে ডেকে বললাম  , মাস্টারমশাইয়ের প্যাণ্টশার্টগুলো খুব ময়লা হয়েছে । এগুলো কেচে দাওতো । 

— আজ যে বাদলার দিন গো মামনি । 

— তাহোক । বাদল তো কি হয়েছে  ? তোমাকে কাচতে বলা হয়েছে কেচে দেবে ব্যস । 

গীতামাসি কেচে দিয়েছিল । আর কলেজ যাবার সময় একটাও প্যাণ্ট শার্ট না পেয়ে তুমি যা খেপচুরিয়াস হয়েছিলে ; আমার আজও মনে পড়ে । কিন্তু যখন তুমি জানতে পারলে, আমি কাচতে বলেছি তখন একেবারে স্পিকটি নট ।

ভয় না অন্য কিছু  ? 

যাই হোক দুপুরের দিকে তোমার ঘরে আসলাম । ভেবেছিলাম কলেজ যাওয়া হয়নি বলে নিশ্চয় আমার ওপর রেগে থাকবে । কিন্তু না । দেখলাম তুমি দিব্যি আরামে দিবানিদ্রা উপভোগ করছ । তোমার কাছে ফিজিক্সের কয়েকটা প্রবলেম বুঝে নেব বলেছিলাম । কিন্তু সেটা একটা ফিকির ছিল ।

 আসলে তখন যে আমি তোমাকে অন্যভাবে দেখতে শুরু করেছি । বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম তোমার ঘুমন্ত মুখটার দিকে । সবেমাত্র কৈশোরকে অতিক্রম করে যৌবনে প্রবেশ করেছ । তোমার শরীরের সর্বত্র একটা বেপরোয়া পৌরুষের ছোঁয়া । কিন্তু তোমাকে জাগাতেও সাহস হয়নি । একসময় কি মনে করে তোমার ঘরটা গোছাতে শুরু করলাম । এভাবে কিছুটা সময় কাটার পর তোমার ঘুম ভেঙে গেল । 

আর আমি বেশ ভয় পেলাম । কারণ আমি ছিলাম অনধিকার প্রবেশকারি । কয়েকটা ঢোক গিলে বললাম, ফিজিক্সের কয়েকটা প্রবলেম  ? 

— তা আমায় ডাকোনি কেন  ? বসো । 

তুমি পড়াতে শুরু করলে । কিন্তু আমি তো পড়তে যাইনি । কি যে তুমি বললে কিছুই আমার মাথায় ঢোকেনি । আসলে পড়ার ব্যাপারটা আমার কিছুতেই ভালো লাগছিলনা । যে কথাটা বলতে চেয়েছিলাম সেটাও বলতে পারিনি । ভেতরে বাইরে কেমন যেন একটা অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসেছিল । 

একসময় পড়ানো শেষ করে তুমি বললে, প্যান্ট শার্টগুলো কে কাচতে বলেছিল  ? 

— আমি । 

— কেন  ? 

আমি কিছু বলতে পারিনি শুধু হেসেছিলাম । 

তুমি কিন্তু রাগ করোনি । আশ্চর্য শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছিলে তুমি । সেজন্য প্রতিদিন তোমার ওপর শ্রদ্ধা বেড়ে যেত । 

সেদিন বাগানে বড় আমলকি গাছটার তলায় একটু বসলাম । ইচ্ছে ছিল নিভৃতে স্মৃতিচারণ করব । কিন্তু কখন যেন তুমি পিছন থেকে এসে হাতটা ধরে বললে  , এবারে কোথায় পালাবে  ? আমি অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলাম না । একসময় সবটুকু সাহস আর শক্তি জিভের ডগায় নিয়ে এসে বললাম, ইস আপনি আমার হাত ধরেছেন  ? 

ব্যস, তুমি ভয় পেয়ে বললে  , তাতে কি হয়েছে  ? 

— বারে, আমি যে মেয়ে । মেয়েদের হাত ধরতে আছে বুঝি  ? 

আর তখনই তুমি হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলে । কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি চেয়েছিলাম আমার সর্বাঙ্গকে তুমি গভীরভাবে আলিঙ্গন করো । তোমার স্পর্শ যে কি এক আনন্দ এনে দিয়েছিল তা আমি ভাষায় বোঝাতে পারবনা । পরপর বেশ কয়েকদিন তোমার সামনে আসতে পারিনি । আর তুমিও আমার সামনে পড়লে কেমন যেন সিঁটিয়ে যেতে । 

এর ক’দিন পরেই হেতমপুরের মাসিমা তাঁর মেয়ে অনিমাদিকে নিয়ে আসলেন আমাদের বাড়ি । আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । কিন্তু ক’দিন পরেই অনিমাদিকে হিংসে করতে শুরু করলাম । আমার মনে হল কেন আমি অনিমাদির মতো হলাম না । তোমরা যখন অর্থনীতির জটিল তত্ব নিয়ে আলোচনা করতে আমি তখন আড়াল থেকে শুনতাম । কিছু কিছু বিষয় বুঝতাম আবার কিছু কিছু না বোঝাই থেকে যেত । একটা ব্যাপার তুমি ল্ক্ষ্য করোনি  — কয়েকদিনের মধ্যেই অনিমাদির আচরণে একটা পরিবর্তন শুরু হয়েছিল । আসলে অনিমাদি যেন তোমার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল । কিন্তু তাকেও তুমি বোঝোনি । 

মানে বুঝতে চাওনি । মনে পড়ে  — ? একদিন যখন তুমি টেলিগ্রাফের পাতা ওল্টাচ্ছিলে সেসময় আমি এবং অনিমাদি তোমার ঘরে আসলাম । অনিমাদিকে দেখেই তুমি বললে, দেখেছ অনিমা, একদল উগ্রপন্থী কি নিষ্ঠুরভাবে ছিয়াত্তর জন নরনারীকে হত্যা করেছে । আচ্ছা তুমিই বলো এটা কি একটা আন্দোলনের পথ হতে পারে  ? 

অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন এবং অনিমাদি এর জন্য তৈরি ছিলেন না । 

— দেখুন আমরা না চাইলেও এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে এবং ঘটবেও । মানুষের সমাজে ভালো এবং মন্দ পাশাপাশি রয়েছে এবং থাকবেও । 

সেদিন তুমি এমন একটা জুতসই জবাব পেয়ে খুব অবাক হয়েছিলে । বুঝতে পেরেছিলে নিশ্চয় যে অনিমাদির ভাবনাচিন্তা অনেক বেশি সুদূরপ্রসারী ছিল । নিছক কেতাবী ভাবনাচিন্তা ছিলনা । বেশ কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর অনিমাদি বলল , চলুন এই গুমোট আবহাওয়া থেকে বেরিয়ে একটু খোলা হাওয়ায় ঘুরে আসা যাক । 

আর ঠিক তখনই কাগজটা এগিয়ে দিয়ে তুমি বললে, আজ থাকনা । তার চেয়ে বরং এই টপিকসটা পড়ে ফেল । 

— হোপলেস । আমি বললাম কিনা একটু ঘুরে আসার কথা । আর আপনি বলছেন কিনা   —

অনিমাদি আর দাঁড়ায়নি । সটান চলে এসেছিপ্রশস্ত লনের অপর প্রান্তে । বসে পড়েই বলেছিল, অনিকেতদা যেন কেমন  । কিছুই বোঝেনা । বোকা বোকা ! 

কিন্তু আমি বুঝলাম, তুমি পলাতক । ভীরু প্রকৃতির একজন । কেউ রূপে মুগ্ধ হয়, কেউ গুণে । অনিমাদি বোধ হয় তোমার গুণেই মুগ্ধ হয়েছিল । কারণ তোমার রূপের চেয়ে গুণের পাল্লাটাই ছিল বেশি ভারি । আর আমার কোনোটাই ছিলনা । তাই তোমাকে কোনোদিন এক পলকের জন্যও মুগ্ধ করতে পারিনি । 

যাই হোক তার দুদিন পরেই অনিমাদি চলে গিয়েছিল । যাবার সময় তুমি ছিলেনা । থাকলে অনিমাদির কষ্টটা বুঝতে পারতে । প্রথম দিকে অনিমাদিকে হিংসে করতাম । কিন্তু তার কষ্ট দেখে আর পারিনি । জানো অনিমাদি আজ কোথায়  ? 

বিয়ে হয়েছিল এক ধনীর দুলাল তথা ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে । মেসোমশাই ভেবেছিলেন মেয়ে আমার সুপাত্রেই পড়েছে । কিন্তু সেটা যে এমন বাজে লোক হবে কে জানতো  । রাস্কেলটা এখন তার এক কলিগের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে । আর অনিমাদি দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে মেসোমশাইয়ের কাছেই ফিরে এসেছে । 

না, অনিমাদি আদালতে যায়নি । তুমি তো জানো আদালতে খালি হাতে যাওয়া যায় না । কারণ আমাদের দেশে বিচার কিনতে হয়  ( ? ) তুমিই তো বলতে এই মহার্ঘ বিচারব্যবস্থায গরিবদের পক্ষে সুবিচার পাওয়া অসম্ভব । এখানে স্রেফ টাকার জোরেই অনেক সময় অপরাধীরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায় । দোষীরা সব কেটে পড়ে বোকা  ( গরীব  ) সাজা পায় । মেসোমশাই চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ের আগেই । সুতরাং প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুইটি অনেক আগেই শেষ । আর সেই অবস্থায় দুটি বাচ্চা সমেত মেয়ে আসল বাপের কাছে ।

  ওরা প্রমান করেছিল সে দুঃশ্চরিত্রা এবং শ্বশুর শাশুড়িকে নির্যাতন করত । লজ্জায় অপমানে অনিমাদি আত্মহত্যা করতে গিয়েও পারেনি । কারণ সে যে মা । দুটো নিরপরাধ শিশু তারই মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে । অনিমাদি আজ ডোর টু ডোর সেলসের কাজ করে । 

          #           #          #           #           #

অনেক কথা লেখা হয়ে গেল । কিন্তু আমায় যে এখনো অনেক কথা লিখতে হবে । এমন একটা সময় ছিল যখন একটা কম্পোজিশন লিখতেই গলদঘর্ম হয়ে যেতাম । আর আজ কলমটা থামতেই চাইছে না । অবশ্য আমার বিদ্যে বুদ্ধির দৌড় যে কতোটা সে তোমায় বলে দিতে হবেনা । একদিন আমার কথা শোনার জন্য অনেক শ্রোতাই উন্মুখ হয়ে থাকতো । তখন বলতে পারতাম না । আজ আর কেউ তেমন উন্মুখ হয়ে থাকেনা অথচ আজই কিনা আমি বাগ্মী হয়ে পড়েছি । তুমি ভাবছো তোমার কাছে আমি আমার দুঃখের পাঁচালী গাইতে বসেছি । সে অধিকারও আমার নেই । কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি আমার কথা শুনবে । 

আচ্ছা, আমাদের পাশের বাড়ির রমেনকে তোমার মনে আছে  ? সেই যে বীরেনকাকুর ছেলে । ওদের আর্থিক অবস্থা এমন কিছু ভালো ছিলনা । কোনও রকমে দিনপাত হতো । তবে রমেন পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল । ঈর্ষা করার মতো । বিধাতার কেমন নজর দেখেছো ? যত বুদ্ধি ভরে দিলেন ওর মাথায় । আর আমাকে পাঠালেন একটা গোবরগনেশ করে । জানতাম পড়াশোনার প্রতিযোগিতায় ওর সঙ্গে পেরে উঠব না । তাই সন্ধি করতে চাইলাম । 

একটা ঘটনার কথা আজও বেশ মনে আছে । ওদের বাড়ির ঠিক পাশেই ছিল আমাদের ফলের বাগান । নানা ধরনের ফলের গাছ ছিল সেখানে । ওরা যেমন খুশি ফল পেড়েও নিতে পারতো । তাতে কোনও দিন আমার মাথাব্যথা হয়নি । কিন্তু সেদিন বিকেলে ওকে বাগানে দেখতে পেয়েই অন্ধ আক্রোশে বললাম, এই চোর তুই আমাদের বাগানে কেন  ? 

— দেখ, বাগানে এলেই কেউ চোর হয়না । 

— অন্যরা হয়না । কিন্তু তুই চোর । 

— চোর বলবিনা । তাহলে  — 

— কি করবি  ?

আমি বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম ওর সামনে । 

রমেন কিন্তু রাগ সামলাতে পারল না । এগিয়ে এসেই সশব্দে একটা থাপ্পড় কষিয়েছিল আমার প্রতিহিংসার গালে । চাইলাম বন্ধু হতে । হয়ে গেলাম শত্রু । আমি কিন্তু শত্রুতা জিইয়ে রাখিনি । মনে মনে ওর কাছে হার মেনেছিলাম । 

ওই ঘটনার বেশ কিছুদিন পরের আর একটি ঘটনার কথা তোমায় বলি । তখনও তুমি আমাদের বাড়ির অতিথি হওনি । তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্রী । ফাল্গুন মাসের প্রথম দিক হবে । আমরা পাড়ার কয়েকজন মেয়ে  বৌ মিলে পীড়পুরে গেলাম মেলা দেখতে । আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ছমাইল দূরে অজয়ের ধারে একটা পীর বা ফকিরের সমাধিস্থল । 

সেখানেই মেলা । আগে জানতাম না যে মেলায় এতো লোকের ভিড় হবে । ফেরার সময় কিছুতেই বাসে উঠতে পারলাম না । এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে । দলের লোকদের ও হারিয়ে ফেললাম । আর তুমি তো অপরিচিত জায়গায় আমার বয়সী একটা মেয়ের জন্য বিপদ ওৎ পেতে থাকে । মনে মনে পীরবাবাকে ডাকছি । বলছি  , পীরবাবা যাহোক করে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দাও । আমি তোমাকে ষোলো আনার সিন্নি দেবো । পীরবাবা হয়তো আমার কথা শুনেছিলেন । নাহলে সেদিন অপ্রত্যাশিতভাবে পিছন থেকে কে যেন ডাকল । আমি ভয়ে ভয়ে পিছনে তাকিয়ে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি ।

কিন্তু তখন আমার অবস্থা অকূল সমুদ্রে কোনও এক ডুবন্ত যাত্রীর মতো । আর আমার সামনে খড়কুটোর মতো এগিয়ে আসছে রমেন । আমি যারপরনাই আনন্দিত হলাম । আর ও জিজ্ঞাসা করল, কিরে এখনো বাড়ি যাসনি  ? 

— কি করে যাবো  ? বাসে উঠতেই পারলাম না । বন্ধুরাও সব কোথায় চলে গেছে । 

– বেশ হয়েছে । যেমন তুই, আর তোর বন্ধুরাও তেমন । 

তখন জবাব দেওয়ার মতো অবস্থা ছিলনা । তাই হজম করলাম । সেদিন বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললাম, তোর সাইকেলে যদি ক্যারি করিস  ? 

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে রমেন ওর সাইকেলে তুলে নিল । বাড়িতে পৌঁছে ওকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ও সময় পাইনি । সত্যি বলতে কি সেদিন থেকেই রমেনের প্রতি কেমন যেন একটা দুর্বলতা এসেছিল । কিন্তু ওই ঘটনার পরও যে রমেনের আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি তা আমি বেশ কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করেছিলাম । আমি চাইতাম ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে । 

আর ও চাইত আমাকে এড়িয়ে যেতে । অনেকদিন পরে ওকে ধরতে পারলাম বাড়ি থেকে অনেক দূরের একটা রেলস্টেশনে । স্টেশনটার নাম নাই বা জানলে । তবে পাণ্ডববর্জিত । ধূধূ মাঠের মাঝে একা দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্টেশন । ট্রেনটা সবেমাত্র বেরিয়ে গেছে । ইচ্ছে করলেই ধরতে পারতাম । কিন্তু ইচ্ছে করছিল না । কেন ইচ্ছে করছিল না আজ বোধহয় ঠিক বলতে পারবনা । কিন্তু ওয়েটিং রুমে এসে রমেনকে দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি । কোণের দিকে একটা বেঞ্চে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল । আমি ধীরে ধীরে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম । ও কিন্তু টেরই পেলনা । একসময় দুঃসাহসের সঙ্গে ওর কাগজটা টেনে নিলাম । রমেন আমাকে দেখবে আশা করেনি । আশ্চর্য হয়ে বললে  , মিতা তুমি  ? 

–সুন্দরপুর গিয়েছিলাম এক মাসিমার বাড়ি । অল্পের জন্য ট্রেনটা পেলামনা ।কিন্তু তুমি কোথায় চলেছ  ? 

একটা ব্যাপার নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ যে দূরত্ব আর নির্জনতা আমাদেরকে অনেকখানি কাছে এনে দিয়েছে । আমরা দুজনে দুজনকে ‘তুমি ‘বলতে শুরু করেছি । 

কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর রমেন বলল, দিশেরগড় পাওয়ার প্ল্যান্টে গিয়েছিলাম মজুরের কাজ করতে । 

— পড়াশোনাটা শেষ করবে না  ? 

— মায়ের কঠিন অসুখ যে । 

ওর পাশে বসলাম । মজুর হওয়ার বয়স ওর হয়নি । তবু হয়েছে । স্বরটা যথেষ্ট আন্তরিক করে  বললাম, কি হয়েছে মাসিমার  ? 

— ক্যানসার । স্টম্যাকে । এখনো প্রাইমারি স্টেজে । ডাক্তার বলেছে ট্রিটমেন্টেই সেরে যাবে । তুমি তো জানো বাবার রোজগারও ভালো নয় । তাই যতটুকু পারি সাহায্য করি । 

রমেনের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই সেটা আগেই বলেছি । ওর দারিদ্র্য আমাকে পীড়া দেয় । তখন সেই মুহূর্তে আমার ভেতরের  ‘আমি’টা চাইল আমার সবকিছু দিয়ে ওকে সাহায্য করতে । ও যে তথাকথিত ধনীদের ঘৃণা করে তাও জানি । তবু বললাম, আমি যদি তোমাকে সাহায্য করি ?

রমেনের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব করতে চাই সেটা আগেই বলেছি ।ওর দারিদ্র্য আমাকে পীড়া দেয় । তখন সেই মুহূর্তে আমার ভেতরের ‘আমি’টা চাইল আমার সবকিছু দিয়ে ওকে সাহায্য করতে । ও যে তথাকথিত ধনীদের ঘৃণা করে তাও জানি । তবু বললাম  , আমি যদি তোমাকে সাহায্য করি  ? 

— সাহায্য  ? তুমি? তুমি তো এক হাতে সাহায্য করবে অন্য হাতে ফিরিয়ে নেবে । 

— না ; নেব না, নেব না ।

আবেগে ওর ডান হাতটা বুকের মাঝে নিয়ে প্রায় কেঁদে ফেললাম । তারপর আর কোনও শব্দ ছিলনা । পাশের ছাতিম গাছটায় কয়েকটা নাম না জানা পাখি নিজেদের ভাষায় আলাপচারিতা সেরে নিচ্ছিল । আমাকে এড়িয়ে যাওয়া বন্ধুকে পাশে পেয়ে আমার হৃদয় গুনগুনিয়ে উঠল । কিন্তু আমার বাইরের আমিটা পারছিল না । অথচ সেভাবে চুপ করে বসে থাকাও যায় না । তাই একসময় নীরবতা ভেঙে বললাম, রমেন এক কাপ চা খাওয়বে ?

রমেন একবার চোখদুটো তুলে দেখে নিয়ে একটু দূরের দিবানিদ্রারত দোকানদারের কাছ থেকে দুটো চা নিয়ে আসল । চা খেয়ে একসময় বললাম, এখন তো ট্রেনের দেরি আছে, চলো স্টেশনের ওদিকটা ঘুরে আসি । 

রমেন কথা না বলে নীরবে চলতে শুরু করল । 

স্টেশনটা পাণ্ডববর্জিত হলে কিহবে  — আপাত রুক্ষতার মাঝেও একটা নৈসর্গিক আকর্ষণ ছিল , যা আমার বেশ ভালো লাগছিল । রমেন বেশ কিছুটা দূরে দূরে থাকছে দেখে একসময় আমি বললাম, তোমার এতো সংকোচ কেন  ? 

— সংকোচ ঠিক নয়, তবে  — 

— তবে কি  ? 

— কিছু না ।

ছোট্ট একটা ফুলের বাগান । তার পাশে লাল ফুলে ভরা একটা কৃষ্ণচূড়া । আমরা ওই কৃষ্ণচূড়ার তলাতেই বসলাম । রমেন বেশ কিছুটা দূরে বসেছিল । আমি ওর সংকোচ দেখে বললাম  , রমেন তুমি আমাকে ভয় পাও তাই না । 

— দেখতে পাচ্ছি আর পাঁচটা মেয়ের মতোই তোমাকে দেখতে । তবে ভয় পাবো কেন  ? 

— ডোন্ট মাইন্ড । আমি দেখেছি আমার ইচ্ছে থাকলেও তুমি আমাকে এড়িয়ে চলো । 

— এড়িয়ে চলি, একথা ঠিক নয় । তবে এটাও জানি সমতা না থাকলে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেনা । 

— রমেন, আই অ্যাম ভেরি স্যরি । তুমি এতোটা ভেবে বসবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি । তুমি গরীব  — এটা তোমার পরিচয় নয় । তোমার একটা বড় মন আছে । যার জন্য তুমি অনেক বড় । রমেন আর কোনও কথা বলেনি । আসলে ও তর্কবিতর্কের ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলতে চায় । 

সেদিন ঘরে ফিরতে বেশ দেরি হল । আর ট্রেন লেট বলে সামলে নিলাম। 

এরপর দীর্ঘ দিন রমেনের রমেনের প্রসঙ্গ মাথায় আসেনি । কারণ তখন তুমি আমাদের বাড়িতে এসে গেছো । প্রথম দিকের জড়তা কাটিয়ে তুমি তখন অধিকার কায়েম করতে শুরু করেছ । আমার বেশ ভালো লাগত যখন তুমি আমাকে হুকুম করতে । আসলে আমি তোমার হুকুমের জন্যই অপেক্ষা করতাম । কিন্তু তোমার কাছ থেকে উপেক্ষা ছাড়া কিছুই জোটেনি আমার । 

 এরকমই একটা টুকরো ঘটনা আজ স্মৃতিকে বড্ড বেশি দুর্বল করে দিচ্ছে । আর সে ঘটনাটা ছিল তোমার ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার ক’দিন পরে  — তুমি সারাক্ষণ ঘরেই থাকতে । কি যে সব পড়তে আর লিখতে  — কিছুই বুঝতাম না । সেদিন গীতামাসিও আসেনি । তুমি আমাকে বললে প্যাণ্টশার্টগুলো আয়রন করে দিতে । আমি কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে না বললাম । কিন্তু আয়রনটা  ঠিক করে দিলাম । ক’দিন পরেই ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট বের হল । তুমি হলে ইউনিভার্সিটির টপার । সবাই খুশি হল । হলাম আমিও । তাই সেদিন তোমার পড়ার টেবিলে দুটো লালগোলাপ রাখলাম । তোমার অভাবনীয় সাফল্যের স্বীকৃতিতে । তুমি নিশ্চয় খুশি হওনি । যা বেরসিক ছিলে । কিন্তু তার পরেই একটা আশঙ্কা আমায় পেয়ে বসল ।

 মায়ের কাছে শুনলাম তুমি কলকাতায় যাবে এম এ পড়তে । একথা শুনেই খুব হিংসুটে হয়ে উঠলাম । আমার মনে হল তুমি যদি ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষায় পাশ না করতে তাহলে হয়তো এই বিচ্ছেদ সইতে হতোনা । অবশেষে সেই দিনটা ক্রমশই এগিয়ে এল । আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না । তাই তোমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে বই খুলে বসে থাকতাম । কিন্তু কিছু পড়তে পারতাম না । বইয়ের পাতায় বারবার তোমার মুখটাই ভেসে উঠত ।যাবার আগের দিন রাত্রে তুমি আসলে  আমার ঘরে । বললে  , মিতা কি হয়েছে তোমার  ? আর কথাও বলোনা  , পড়াশোনার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাও করোনা  ?

আমি সেদিন কিছু বলতে পারিনি ।

 বুকের মাঝে কতো কথার উথালি পাথালি । শেষমেশ কিছুই বলতে না পেরে বালিশের নিচে মুখ লুকিয়েছিলাম । তুমি তোমার ঘরে ফিরে গেলে । কি মনে করেছিলে কে জানে । কিন্তু সেই রাত্রিটা আমি শুধুই কাঁদলাম । পরদিন সকালে নিজেকে আয়নায় দেখে চমকে উঠলাম । চোখগুলো ফুলে উঠেছে । আমি কেঁদেছিলাম । কিন্তু কার জন্য ? মনে হয় একটা পাথরের জন্য । তোমার পাথুরে হৃদয়ে সাড়া না পেয়ে আমি আবার ফিরে গেলাম রমেনের কাছেই । কিন্তু রমেনও যেন তোমার ডিটো  । এক আশ্চর্য ধাতু দিয়ে তৈরি । 

মেয়েদের ব্যাপারে যেন মহাপুরুষ । কোনও হ্যাংলামি ছিলনা । মেয়েদের ব্যাপারে যে কোনও আকর্ষণ নেই সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম । থাকলে ওকে জয়ের জন্য আমাকে বেগ পেতে হতোনা । কারণ রূপের অভাব আমার ছিলনা । পুরুষ জাতটাকে ঘায়েল করার জন্য এর থেকে বড় অস্ত্র আর মেয়েদের হাতে নেই । ঠিক তখন থেকেই আমি যেন আমার মধ্যেই বদলে যেতে শুরু করলাম । বড্ড বেপরোয়া হয়ে পড়লাম । আমার বয়ফ্রেণ্ডের সংখ্যাও বাড়তে থাকল । এক এক সময় নিজেকে বড্ড ক্লান্ত মনে হতো । ছুটে যেতাম রমেনের কাছে । কিন্তু ওর সাড়া না পেয়ে নিজের প্রতি খুব অত্যাচার শুরু করলাম । 

বাড়িতে ওদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল । তাই শীতেশ,মানিক  , প্রভাত  , রঞ্জন , শ্যামল  — এদেরকে নিয়ে কলেজের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম । ওরা প্রত্যেকেই ভাবত যে সে ছাড়া আমার আর কোনও বন্ধু নেই । প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাদা করে কফির গ্লাসে চুমুক দিতাম । রমেনকে না পাওয়ার যণ্ত্রণা ঢাকতে এভাবে একই রকমের সম্পর্ক বজায় রেখে চলতাম অনেকের সাথে । এভাবে নিজের ওপরে নির্যাতন করে কেমন যেন একটা আনন্দ পেতাম । কিন্তু ওদেরকে খুব বেশি দিন আমার রক্তের লোনা স্বাদ থেকে বঞ্চিত রাখতে পারলাম না । 

  এক বর্ষার দিনের কথা । কলেজ থেকে ফিরছি । হঠাৎ বৃষ্টি নামল । সঙ্গে ছিল শীতেশ । ও বলল ,  ওর বাড়িতে আশ্রয় নিতে । কোনও উপায় না থাকায় বাধ্য হয়েই ওর বাড়িতে আশ্রয় নিলাম । 

আমার উদ্ধত যৌবন সেদিন বৃষ্টিতে ভিজে আরো উদ্ধত হয়ে উঠেছিল । শীতেশের বাড়িটা ফাঁকাই ছিল । ওর মা হয়তো কোনও কাজে বাইরে গিয়ে থাকবেন । আর আমিও ওর মা না থাকার ব্যাপারে তেমন মাথা ঘামাইনি । শীতেশ কিন্তু সুযোগ নিতে ভুল করেনি । ওর মায়ের একটা শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলগুলো ছাড়িয়ে নিচ্ছিলাম । শীতেশ ঘরে আসল । আমি জানতাম আমার বন্ধুত্বের থেকে আমার শরীরের ওপরেই ওর বেশি লোভ । একসময় ও অনেক কাছে সরে এল । আমি ওর চোখের তারায় আমার প্রতিচ্ছবি দেখে শিউড়ে উঠলাম । ওর গরম নিশ্বাস আমার চোখের ওপর । চোখদুটো কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছিল । 

— না, শীতেশ না । 

— আই লাভ ইউ মিতা । আমরা তো বিয়ে করতেই পারি । 

— না, তা হয় না । 

কিন্তু সেদিন সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাধা দিয়েও আমি হেরে গেলাম । একটা ভীষণ রোলার সর্বাঙ্গকে পিষে দিয়ে আমার নারীত্বকে শুষে নিল । একটা অস্ফুট আর্তনাদ ছাড়া আমি কিছুই করতে পারিনি ।  বিপদটা বুঝতে পারলাম মাসখানেক পর । মাথার মধ্যে চিন্তার জট পাকাতে শুরু করল । দিনের পর দিন আমি কেমন যেন হয়ে গেলাম । বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার জড়ায়ুর মধ্যে একটা ভ্রুণ ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে । আমার মনে হল যেন একটা অশুভ পদধ্বনি ক্রমশ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে । 

শেষ পর্যন্ত সব লাজলজ্জার মাথা খেয়ে সেই রমেনেরই স্মরণাপন্ন হলাম । এছাড়া আমার যে আর কোনও উপায় ছিলনা । রমেন কিন্তু এটাকে একটা অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া আর কিছু বলতে চাইলনা । আমার এই বিপদের দিনে রমেনের কাছ থেকে এধরণের সহানুভূতি পাবো আশা করিনি । যার দারিদ্র্য আমার লজ্জার কারণ, যার কোনও সামাজিক কৌলিন্য নেই  , সে যে আমাকে আমাকে এতবড় বিপদে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে ভাবতে পারিনি । তাইলে সেদিন আমার চোখের জল কিছুতেই বাধা মানতে চায়নি । 

— না মিতা, এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে না । জীবনে এর চেয়ে আরো অনেক বড় বিপদের মুখোমুখি হতে হবে । 

তারপর আমার চোখদুটো মুছে দিয়ে বলল, আমি সব ব্যবস্থা করে দেবো । 

আমি যেন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম । শত চেষ্টা করেও আমার মুখের ভাষায় কৃতজ্ঞতা জানাতে পারলাম না । ও যে আমার ভুলকে স্বীকার করে এতখানি অন্তরঙ্গতা নিয়ে এগিয়ে আসবে যেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি । সেটা চোখের সামনে ঘটতে দেখে আমি বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম ।

অ্যাবোরশানের সময়ে প্রচুর রক্তপাত হওয়ায় আমি বেশ ভয় পেয়েছিলাম । ভয় পেলাম এই জন্য যে আমার অবস্থাটা যদি কারোর চোখে ধরা পড়ে যায় । ভাগ্যিস মা সে সময় কয়েকদিনের জন্য মাসিমার বাড়ি গেলেন । তাই রক্ষে । শরীরটা ভালো নেই বলে বাবার কাছে কাটিয়ে নিলাম । নার্সিংহোম থেকে রিকশায় তুলে দিয়ে রমেন বিদায় নিল । তারপর বেশ কয়েকদিন ওর সঙ্গে দেখা হল না । বেশ কিছুদিন পর কলেজ যাওয়ার পথে ওর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হল । 

ও বলল, কলেজ থেকে ফিরছ বুঝি  । 

— হ্যাঁ । কিন্তু কি ব্যাপার বলোতো, আমার সঙ্গে আর দেখাই করোনা যে  ? 

— কি লাভ  ? তোমার তো বন্ধুর অভাব নেই । 

— আছে । সত্যিকারের বন্ধুর অভাব আছে । 

— সে অভাব আমি কি পূরণ করতে পারব  ? 

— পারবে । 

— এতখানি বিশ্বাস  ? একজনকে বিশ্বাস করে ঠকেছো । আবার যদি ঠকতে হয়  ? 

— ভয় তো নারীত্ব হারানোর  ? নতুন করে আর তা হারাবার ভয় নেই । আর তুমি যদি চাও আমি নিজের হাতে আমার শাড়ি খুলে দেব । 

— থামো । 

চিৎকার করে ওঠে রমেন । বলে, তোমার মুখে কোনও কিছু আটকায় না, তাই না  ?

— রমেন আমি তোমাকে ভালোবাসি ।তোমার জন্য আমি সব পারব ।

রমেন কিছু বলতে পারেনি । শুধু নির্নিমেষ চোখে আমার দিকে রইল । আর সেই দিন থেকেই আমি রমেনকে আমার হৃদয় দেবতার আসনে বসিয়ে পূজো করতে শুরু করলাম । 

ইতিমধ্যে বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । হঠাৎ একদিন শুনলাম আমি পাশ করেছি । পরীক্ষার আগেটায় যে ঝামেলা গেছে সে জন্য আমি আশা করিনি যে পাশ করব । বেশ আনন্দ পেলাম । সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেলেন আমার বাবা । সেই উপলক্ষ্যে বাড়িতে ছোটখাটো একটা ভোজসভাও বসে গেল  । আমার ইচ্ছে হল রমেনকে ডেকে আনি । কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম না । তবু সেদিন বারবার রমেনের কথা মনে হচ্ছিল । সন্ধ্যার দিকে যখন বাড়ি ভর্তি অতিথি  — তারই মধ্যে একটু ফাঁক পেয়ে রমেনের বাড়িতে গেলাম কিছু উপহার নিয়ে । অবশ্যই তার মধ্যে একটা লাল গোলাপও ছিল ।মাসিমা রান্না করছিলেন । তাই তাঁকে এড়িয়ে রমেনের ঘরে যেতে কোনও অসুবিধা হয়নি । 

রমেন খুব আশ্চর্য হয়ে বলল  , তুমি  ? 

— আমি পাশ করেছি । 

— সে তো খুব আনন্দের । আমি খুব খুশি হয়েছি ।

প্যাকেট থেকে একটা সন্দেশ নিয়ে ওর মুখে ভরে দিলাম । 

রমেন বললে  , আজ এই আনন্দের দিনে তোমাকে কি যে দিই  ? 

— কিছুই নেই তোমার  ?

তারপর অনেক কাছে সরে এসে ওর ঠোঁটদুটোর ওপরে একটা চুম্বন করে বললাম, তোমাকে দিতে হবেনা আমি নিজেই নিলাম । 

এক অনাস্বাদিত আনন্দের স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম । আর সেদিনের সন্ধ্যাটা আজও আমার মনের মনিকোঠায় সোনার ফ্রেমে বাঁধানো আছে । কিন্তু তারপর থেকে কিছুতেই রমেনের সঙ্গে দেখা হচ্ছিল না । আমাদের বাগানের পিছনেই ওদের বাড়ি । প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এসেছে এমন সময় ওকে বাগানের মধ্যে একা পেয়ে এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করলাম । তারপর উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে একসময় আমিই কেঁদে ফেললাম । 

রমেন এর জন্য মোটেও তৈরি ছিলনা । আমার অনেক কাছে সরে বললে  , এমন পাগলামি শুরু করলে যে  ? 

— আমার সঙ্গে আর দেখা করোনা কেন  ? 

— এর জন্য চোখে জল  ? মোছ । 

তারপর নিজেই মুছিয়ে দিল । আমি সে স্পর্শে শিহরিত হলাম । আর সে শিহরণ ছড়িয়ে পড়েছিল আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গে । রমেন আমার মুখটা ধরে বললে, মিতা তুমি সুন্দরী, ধনীকন্যা  , উচ্চশিক্ষিতা । আমার সঙ্গে তোমাকে মানায় না । তুলনা করে দেখো, আমি কতখানি অযোগ্য তোমার । 

আমি ওর মুখে হাতচাপা দিয়ে বললাম, ফের বললে ভালো হবেনা বলে দিচ্ছি । 

সেসময় রমেন আমার মনের সবটাই দখল করে নিয়েছিল ।আমি দিবারাত্র শুধুই ওর কথা ভাবতাম । কিন্তু সবসময় দেখা করতে পারতাম না । এম এ ভর্তি হবো এই নিয়ে যখন চিন্তা ভাবনা করছি তখন একদিন বাবা বললেন, থাক আর পড়াশোনা করতে হবেনা । চাকরির যখন আমাদের প্রয়োজন নেই তখন এত পড়াশোনায় কাজ কি? 

ব্যাপারটা কয়েকদিন পরেই বুঝতে পেরেছিলাম । বাবার এক বন্ধুর ছেলে । ইঞ্জিনিয়ার, প্রতিষ্ঠিত ।বাবার মতে এমন ছেলে নাকি লাখে একটা মেলে । 

আর আমার অবস্থা তখন বর্ণনা তীত । রমেন ধরাছোঁয়ার বাইরে । কোথায় যেন চলে গেছিল । হয়তো খেয়লি ধনীকন্যার প্রতি একরাশ অভিমান নিয়েই । 

তারপর একদিন অনেক আড়ম্বরের সঙ্গে আমার বিয়ে হল । আমি সুখী হলাম  ? আমার স্বামীর বাড়ি, গাড়ি  , ঝি-চাকর  — কোনোটারই অভাব ছিলনা । টাকার বিনিময়ে তিনি সবকিছু পেতে চেয়েছিলেন । টাকাই যেন তাঁদের জীবনের শেষ কথা । আর এদের চাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমি কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম । একদিন অন্ধকার রাতে বাইরে একটা চাপা গোঙানির শব্দ পেয়ে বেরিয়ে এসে আলো জ্বালতেই দেখি সিঁড়ির পাশে যে একফালি জায়গা আছে সেখানে আমার স্বামী দেবতা বাড়ির ঝি শ্যামাকে বলাৎকার করছে । পৃথিবীটা যেন আমার কাছে দুলে উঠল । আমি যেন এক হিমশীতল অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম । তিনি ছিলেন আমার স্বামী দেবতা । 

যাঁর বুকে মাথা রেখে আমি আমার ফেলে আসা জীবনটাকে ভুলতে চেয়েছিলাম, যাঁকে ঘিরে আমার কল্পনা এবং ভালোলাগা পল্লবিত হতে শুরু করেছিল সেই তাকে এমন অসংলগ্ন অবস্থায় দেখে আমার সারা শরীর ঘেণ্ণায় রি রি করে উঠল । 

তারপর  ? 

আমার স্বামী ড্রিঙ্ক করতেন । একদিন আধখাওয়া একটা বোতলে কয়েকটা মাদক ট্যাবলেট মিশিয়ে দিলাম ।

আমার স্বামী দেবতা মারা গেলেন । আমি অল্প একটু কাঁদলাম । পর্দার অভিনেত্রীদের মতো । সবাই জানল অত্যধিক মদ্যপানের ফলেই উনি মারা গেছেন । বিধবার সাজে বাবার কাছে ফিরে এলাম ।  মা, বাবা  — সবাই কাঁদল সেদিন । কিন্তু আমায় চোখদুটো ছিল বড্ড শুকনো । কিন্তু রমেন যখন সমবেদনা জানাতে এল তখন আমি কিছুতেই আমার অবরুদ্ধ কান্নাকে চেপে রাখতে পারলাম না । 

— মিতা, শান্তনা দেবার ভাষা আমার জানা নেই । তবু বলছি, কেঁদো না । এমন অনেক ঘটনা অনেক মেয়ের জীবনেই ঘটে যাচ্ছে । তবু তারা আশায় বুক বাঁধে । 

আমি জলভরা চোখে ওর দিকে চেয়ে বললাম  , তাহলে তোমার চোখেই বা জল কেন ? 

— আমি যে তোমাকে ভালোবাসতাম । 

— ভালোবাসতে  ? আবার পারোনা  ? 

— সেটা যে খুব অন্যায় হবে ।

— কার কাছে  ? 

কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বললাম  , নিজের ভালোবাসাকে স্বীকার করতেও তোমার এতো ভয়  হয় ? 

— ভয় নয় মিতা । তবে কি জানো 

— কি  ? তুমি আমাকে যেখানে রাখবে  , যেমন করে রাখবে  আমি থাকতে পারব ।

— মিতা  ? 

                 #         #            #            # 

তারপর একগভীর রাতে রমেনের হাত ধরে পথে নামলাম । তখন আর আমি বিধবা ছিলামনা । এয়োতির সাজে সাজলাম । আসানসোলে ওর এক দূর সম্পর্কের দিদির বাড়িতে উঠলাম । প্রথমটা খুব অবাক হয়ে গেছিলেন উনি । তারপর সব শুনে বললেন, মোটেই অন্যায় করোনি তোমরা । ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর কোনো কিছুই বাধা হতে পারেনা । 

রমেনটা বেশ ভেঙে পড়ল । কারণ হঠাৎ করে আমার কথায় বেরিয়ে পড়েছিল । তাই টাকাপয়সা বিশেষ কিছু যোগাড় করতে পারেনি । শুধু ঘরণী হলেই তো আর ঘর বাঁধা যায় না । আরো যে অনেক কিছুর দরকার হয় । 

একদিন খেতে বসে বলল  , জানো মিতা  , আমি একটা অটোরিকশা কিনছি । অবশ্যই সেকেণ্ডহ্যাণ্ড । কিছু টাকা এখন দেব । বাকিটা ইনষ্টলমেন্টে শোধ দেব । 

— তাই  ? 

খুব খুশি হলাম । কতো রাশি রাশি সম্পদ ছিল আমার চারপাশে । তবু এতখানি খুশি হইনি কখনো । আর আজ সামান্য কিছু সুখের মধ্যেও এতো তৃপ্তি– যা অনুভব করিনি কখনো । 

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে । একদিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে সীমাহীন ভালোবাসায় জীবনকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম । ধনীকন্যার অর্থের অভিমান আর আভিজাত্য তখন ছিলনা। আমি তখন অন্য এক মিতা । পাড়ার কল থেকে জল আনি, উনুন ধরাই, রান্না করি, ঘর গোছাই  — আরো কতো কি । আমি যেন তখন সব পেয়েছির জগতে বাস করছি । 

পুরুষ জাতটার কাছে ঠকতে ঠকতে একপ্রকার বিশ্বাস হারিয়ে ছিলাম । মনে হতো এদের কাছে শরীরটা ছাড়া আর কোনো কিছুর মূল্য নেই । আর তাছাড়া আমি নিজেও কম উচ্ছৃঙ্খল ছিলাম না । কিন্তু রমেনের সান্নিধ্যে আমি সেই মিতা একেবারে বদলে গেলাম । তখন আমাদের জীবন যেন এক আধুনিক । কোনো ছন্দ নেই, তাল নেই, লয় নেই, এমনকি কোনও ব্যাকরণও নেই । তবে ছিল এক সীমাহীন ভালোলাগা । 

জানো, রমেনটা না মাঝে মাঝে দুষ্টুমি ও করতো । একদিন সন্ধ্যের সময় হয়েছে কি কারেণ্ট চলে গেছে । আমি মোমবাতি জ্বালাবার জন্য দেশলাই খুঁজছি  — দেখি যথাস্থানে নেই । সেটা যদিবা পেলাম তো মোমবাতিটা উধাও । কি করি! আশঙ্কা মনের মধ্যে । ভুতের পাল্লায় পড়লাম না তো । ভয়ে আমার গলাটাও শুকিয়ে কাঠ । শব্দও করতে পারছিনা । ঘর থেকে আলো জ্বালিয়ে রান্নাঘরে এসে দেখি মোমবাতি জ্বলছে । কিন্তু কে জ্বালালো  ? কাউকে না পেয়ে ছাদে উঠে এলাম । দেখলাম উনি । মানে আমার হৃদয় দেবতা । বললাম, বেশ দুষ্টু হয়েছ তো  । 

— দুষ্টুমি না করলে তুমি ছাদেই আসতে না । এদিকে এস । দেখো  — 

— কি  ? 

— ঐ চাঁদটা । 

রমেন পূব আকাশে চাঁদের দিকে নির্দেশ করে বললে, অপূর্ব তাই না  ! আর ওই দেখো মেঘের সমুদ্র । 

— তুমি কখনো কবিতা লিখেছ  ? 

— কেন  ? চাঁদ দেখাটা বুঝি কবিদেরই সাজে  ? 

— না মানে  — 

— আসলে কি জানো  , কখনো কখনো কবি হতে ইচ্ছে করে যখন তোমার মতো একটা সুন্দরী মেয়ে আমার পাশে থাকে । 

— যাঃ, আমি বুঝি সুন্দরী  ?

— না । এখানে দাঁড়াও তো চুপটি করে । 

রমেন ধীরে ধীরে একটা লাল গোলাপ চুলের মধ্যে গুঁজে দিয়ে আমার মুখটা ধরে বললে, তুমি কতো সুন্দর  —

আমি কিছু বলতে পারিনি । চেয়েছিলাম । কিন্তু শব্দ করতে পারিনি । রমেনের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে কখন যে চোখ দুটো জলে ভরে এসেছিল বুঝতে পারিনি । ও মুছিয়ে দিয়ে বললে, কাঁদছ যে  ? 

— আনন্দে ।

— আচ্ছা মিতা  , নারীপুরুষের মধ্যে এমন করে ভালোবাসার সম্পর্ক কেন গড়ে ওঠে বলতে পারো  ? — জানিনা  , জানিনা । 

সেদিন কান্নায় ভেঙে পড়লাম । প্রেমের এমন স্পর্শ আমার জীবনে বুঝি সেদিনই ছিল প্রথম । আর তার উপস্থিতি আমার সবকিছুকে ছাপিয়ে উপচে পড়তে চাইল । তাই কখন যেন আমার হৃদয় গুনগুনিয়ে উঠল । গান থামলে মুগ্ধ শ্রোতার মতো রমেন বলল , তুমি এত সুন্দর গাইতে পার  ! 

— তোমার স্পর্শে আজ সবকিছুই সুন্দর হয়েছে । তুমি আমার সুর, সৌন্দর্য সবকিছু । তুমি আমার জীবনকে কানায় কানায় ভরে দিয়েছ । 

হয়তো আরও কিছু বলতে চাইলাম  , কিন্তু রমেন আমার কপালের ওপর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল  , কি হয়েছে তোমার  ? 

— তোমাকে পাওয়ার আনন্দে আমি আজ নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি । 

— ভ্যাট  ! কি যা তা বলছ  ? আমি তোমাকে কি দিয়েছি বলোতো? শুধু রাশি রাশি দারিদ্র্য । 

আমি ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বললাম  , তুমি যা দিয়েছ আমি সেটুকুর জন্যই কাঙাল ছিলাম । তুমি আমার অলঙ্কারের অলঙ্কার । 

রমেন এগিয়ে এল অনেক কাছে । আমি ওর দুচোখের তারায় নিজেকে দেখলাম । আমি সেই মিতা  , যে তার সবকিছুর বিনিময়ে একটু সোহাগ স্পর্শের অপেক্ষায় ছিল ।

অথচ সেদিন তা পেয়ে আমার চোখদুটো জলে ভরে উঠল । ওর দুই ভ্রুর মাঝে একটা ছোট্ট চুম্বন করে বললাম  , তুমি আমার অলঙ্কারের অলঙ্কার । 

কিন্তু দিন একরকম যায় না । আমাদেরও যায়নি । রমেন শেষ পর্যন্ত অটোরিকশটা পেলনা । বড্ড আফশোস হচ্ছিল । বাডি থেকে চলে আসবার সময় যদি কিছু গহনা নিয়ে আসতাম তাহলে অল্প কিছু টাকার জন্য রমেনকে হন্যে হয় ঘুরতে হতো না । 

এভাবে বেশ কয়েকমাস কেটে গেল । 

একটা কাজের সন্ধানে রমেন ক্রমাগত ঘুরে বেড়াত । আমার ইচ্ছে হোত ওকে কোনও ভাবে সাহায্য করতে । কিন্তু না পেরে নিজেকেই নিজের কাছে অপরাধী বলে মনে হতো । একদিন পাশের বাড়ির এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হতেই উনি বললেন  , দেখো বৌমা তুমি কিছু মনে কোরোনা । তোমাদের যা আর্থিক অবস্থা তাতে তোমারও কিছু করা উচিত । 

— আমিও বুঝি কিছু করা দরকার । কিন্তু কিভাবে যে করব বুঝে উঠতে পারছিনা । 

— আমি একটা উপায় বলতে পারি । আমার পরিচিত এক ব্যক্তি একজন সারাক্ষণের কাজের লোক চাইছিলেন । মোটেই অসম্মানের কাজ হবেনা । 

— পরের ঘরে কাজ করে বাঁচতে হলে মানসম্মানের কথা ভাবলে চলবে না । মাসিমা আমাদের যা পরিস্থিতি তাতে আমাকে কিছু একটা করতেই হবে । 

সন্ধ্যে নাগাদ রমেন ঘরে ফিরল । অন্যদের মতো নয় । অবসন্ন  , বিধ্বস্ত । ও তখন একজন মিস্ত্রির হেল্পার । আমি ওর হাত থেকে বাজারের থলেটা নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম । ফিরে এসে দেখলাম ও  শুয়ে পড়েছে । 

— কি গো  , শুয়ে পড়লে যে  ? শরীর খারাপ করেনি তো  ? 

কপালে হাত দিয়ে দেখলাম বেশ গরম । 

— না মানে তেমন কিছু নয় । একটু বেশি খাটুনি হয়েছে বলেই হয়তো  ? 

— এতো খাটুনি তোমার পোষাবে না । 

হয়তো আরও কিছু বলতে চাইলাম কিন্তু বলা হল না ওর দুচোখের দিকে তাকিয়ে । এরপর বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে বললাম  , এই জানো পাশের বাড়ির মাসিমা এক ভদ্রমহিলার কথা বললেন । যাঁর একজন সারাক্ষণের কাজের লোকের দরকার । 

রমেন উঠে বসল । বলল, সোজা কথায় বলো একজন ঝিয়ের দরকার । না মিতা, না । দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচার সামর্থ্য আমার আছে । তোমার হয়তো খুব কষ্ট হচ্ছে । তুমি কি পারোনা আজ আমার জন্য কিছুটা কষ্ট করতে  ? 

— আমি তোমার জন্য সব পারব । 

পরদিন আরো বেশি জ্বর নিয়ে রমেন ঘরে ফিরল । আমি বেশ ভয় পেলাম । বললাম  , এই জ্বর নিয়ে আগামীকাল তুমি কাজে যেতে পারবে না ।

— এমন কিছু না । দু একদিনের মধ্যে সব ঠিক হয়ে যাবে । 

কিন্তু হয়নি । ক’দিন পরে এমন অবস্থা হল যে রমেনের বিছানা বিছানা থেকে ওঠার ক্ষমতাও রইল না । ডাক্তার সম্পূর্ণ বেডরেষ্টের কথা বললেন । হাতে যে কটি টাকা ছিল, তা ওষুধ কিনতেই খরচ হয়ে গেল । চারপাশে এমন কোনও উপায় ছিলনা যা দিয়ে ওর শুশ্রুষাটা চালিয়ে যেতে পারব ।প্রাচুর্যের মধ্যে মানুষ হয়েছি । অথচ সেদিন দারিদ্র্য আমাকে শাসন করেছে । নিয়ণ্ত্ণ করেছে আমার প্রতিটি পদক্ষেপকে । ছোটবেলা থেকেই আমি নাকি খুব দৃঢ় ছিলাম ।

হাজার আঘাতে কখনো ভেঙে পড়িনি । কিন্তু যার স্বামী অসুস্থ  , অর্থাভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না  তার সম্মান বা লজ্জা বা দৃঢ়তা নিয়ে ঘরে বসে থাকলে চলবে না ।তাছাড়া সমুদ্রে পেতেছি শয্যা  শিশিরে কিবা ভয়  ? ভাগ্যকে সম্বল করে যেদিন রমেনের হাত ধরে পথে নামলাম সেদিনই  ঠিক হয়ে গেছিল আমার ভবিষ্যত । আমি জেনেছি রমেনই আমার ইহকাল পরকাল । 

রমেনকে না জানিয়ে সেই ভদ্রমহিলার বাড়িতে মাস মাইনের সারাক্ষণের কাজের লোক হয়ে গেলাম । ভদ্রমহিলা বেশ দয়ালু এবং সদাশয় প্রকৃতির । সবকথা শুনে আমার হাতে হাজারটা টাকা দিয়ে বললেন, এটা তোমাকে আগাম দিলাম । পরে পরে শোধ দিলেই চলবে । কিন্তু রমেনকে কিছুতেই বলতে পারিনি যে কিভাবে তার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছি । ক’দিন পরে রমেন ধীরে ধীরে একটু সুস্থ হয়ে উঠলে আমার অপরাধ স্বীকার করে বললাম  , দেখো আর কদিন পরেই কাজটা ছেড়ে দেব । আর দেখ অসময়ে সেন্টিমেন্টাল হয়ে লাভ নেই । এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল বলো  ? 

এতগুলো টাকা আমি কোথায় পেতাম  ? 

রমেন আর কোনও কথা বলেনি । কিন্তু মেনেও নিতে পারেনি । পরের দিন কাজের বাড়িতে এসে আমি অবাক গেলাম । বাড়ির গিন্নিমা বললেন  , কলকাতা থেকে আমার ছেলে বৌ এসেছে । ওদের জন্য আজ একটু বেশি রান্নাবান্নার দরকার আছে । হঠাৎই সেঘরে এল একজন যাকে আমি অনেক কাল আগে চিনতাম । আর যে ছিল আমার ক্লাসমেটদের অন্যতম । আমি পালিয়ে বাঁচতে চাইলাম । চিত্রা আমাকে চিনতে পেরে আশ্চর্য হয়ে বলল  , মিতা তুমি  ? 

— কি হয়েছে বৌমা । ওকে তুমি চেনো নাকি  ? 

— হ্যাঁ মা, আমরা কলেজে একই ক্লাসে পড়তাম । 

— মেয়েটা বড্ড দুঃখী । 

— না মা , আমার মনে হয় কোথাও একটা ভুল হয়ে থাকবে । 

আমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম । এমনভাবে আমার সুসময়ের বন্ধুর কাছে ধরা পড়ে যাব ভাবতে পারিনি । একসময় যে আমার কৃপাপ্রার্থী ছিল এখন তারই ঘরে আমি কাজের লোক ! আমার আগের অবস্থার কথা ভেবে যদি আমাকে কাজ করতে না দেয় তাহলে যে আমি অসুস্থ রমেনকে সুস্থ করে তুলতে পারবনা । এই সব ভেবে আমি ভেতরে ভেতরে খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম ।

চিত্রা দাঁড়িয়ে না থেকে আমার হাত ধরে ওর নিজের ঘরে নিয়ে এল । 

— চিত্রা আমার অনেক কাজ পড়ে আছে । 

— থাক তো । তারপর সামনে দেখলাম এক সৌম্যদর্শন যুবক ।উনিই যে চিত্রার স্বামী তা বুঝে উঠতে দেরি হয়নি । 

— এই শুনছ  । 

উনি খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলেই বললেন  , বলুন কি করতে হবে  ? 

— তুমি না — একটু সিরিয়াস হতে পারোনা । 

এরপর উনি কাগজটা রেখে দিয়ে বললেন, নাউ আই অ্যাম সিরিয়াস । 

চিত্রা আমাকে নির্দেশ করে বললে  , এ আমার ক্লাসমেট মিতা । আর মিতা তুমি তো জানোই  , ইনি  — 

— জীবন মরণের সাথী । অধমের নাম কুন্তল চৌধুরী । এখন বসতে আজ্ঞা হোক । 

— আঃ, তুমি না  ? 

বিরক্ত হল চিত্রা । কুন্তল সেটা দেখে বললে, আই অ্যাম টু মাচ সিরিয়াস  । 

— তোমাকে একটা কাজ করতে হবে । 

— আদেশ করুন হুজুরাইন  ।

— ইয়ার্কি কোরোনা । আমার এই বন্ধুটি খুব বিপদে পডেছে । এর কথা শোনার পরেই তোমাকে ঠিক করতে হবে তুমি কিভাবে ওকে সাহায্য করতে পারবে । 

— না চিত্রা, সে আমি পারবনা । 

— কেন বোনটি  ? আমার সামনে লজ্জা করবে ?

আমি কুন্তলের এমন সহৃদয় সংলাপে আর না করতে পারিনি । আমার ভাই বা দাদা ছিলনা । ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে করত কাউকে ভাই বা দাদা বলে কাছে টেনে নিতে । কিন্তু পারতাম না ।তাই কুন্তলের কথা শোনার পরে দীর্ঘক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলাম । একসময় বলতে শুরু করলাম আনুপূর্বিক সব কথা  । 

শুনে কুন্তল বলল  , নো প্রবলেম । এখন আমাদের প্রথমে রমেনকে সুস্থ করে তুলতে হবে । তারপর কাজের ব্যবস্থাও হয়ে যাবে । 

চিত্রা এবং কুন্তল আমার সঙ্গে এল । কিন্তু ঘরে এসে দেখি রমেন কোথায় যেন বেরিয়ে গেছে । পাশের বাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসা করলাম । তারা কেউ জানেনা। অপেক্ষা করতে করতে অনেক সময় পার হয়ে গেল । এক সময় কুন্তল এবং চিত্রাও ফিরে গেল । ক্রমে সন্ধ্যা হল । তারপর রাত্রি । কিন্তু রমেন ফিরল না । তখন আমি কি যে করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না । অনুশোচনা হচ্ছিল ।

 কেন আমি ওর অবাধ্য হলাম  ? রাত বেড়ে উঠল । একসময় আমি বাড়ি থেকে বের হলাম । কিন্তু কোথায় খুঁজব ? পথঘাট কিছুই তো চিনিনা । কিন্তু মোড়ের মাথায় আসতেই একটা চায়ের দোকানের সামনে জটলা দেখলাম । উৎসুক হয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল  , কে একজন অজ্ঞান হয়ে গেছে । গায়ে খুব জ্বর । 

আমি ভিড় ঠেলে ভিতরে আসলাম । ঐ ব্যক্তিই যে রমেন তাতে কোনো সন্দেহ রইল না । নিমেষের মধ্যে আমার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছিল । রমেন, রমেন আমার প্রিয়তম । অথচ তার মুখটাই আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না । কোনো রকমে চোখের জল সামলে নিয়ে বললাম  , প্লিজ কেউ একটা রিকশা ডেকে দিননা । 

ইতিমধ্যেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেছিল । কৌতূহলী জনতার অনেকেই চলে গেছেন । 

আজকাল এমনতরো ঘটেই থাকে । গরীব লোকগুলো রাস্তা ঘাটে পড়ে মরবে এ আর আশ্চর্য কি । 

বেশ কিছুদিন পরে রমেন ধীরে ধীরে সুস্থ হল । কিন্তু সে রমেন যেন অন্য এক রমেন । আমি এমনটা চাইনি । সারাটা দিন ও যে কোথায় থাকত কিছু বুঝতে পারতাম না । ওর সেই প্রাণোচ্ছল সৌন্দর্য কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল । তার পরিবর্তে একটা পাষাণ যেন চেপে বসেছিল ওর ওপর । আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলাম না । তাই একদিন বললাম  , রমেন তুমি এমন করে থেকোনা । 

দেখো তুমি ছাড়া আমার যে আপনার বলতে কেউ নেই । এখন তুমি যদি মুখ ভার করে থাকো তাহলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বলোতো  ? রমেন কিছু বলেনি । নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে রইল আমার দিকে । আমি ওর চোখের তারায় আমার প্রতিচ্ছবি দেখলাম । আমাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে আবেগভরা কণ্ঠে বলল  , না গো । তোমার ত্যাগের কোনও তুলনা হয়না । হয়তো তোমার মতো স্ত্রী পেয়েছি বলেই এযাত্রা বেঁচে গেলাম । কিন্তু নিজেকে বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছে । আমি তোমাকে কি দিলাম  ? 

রমেনের গলাটা ভারি হয়ে এসেছিল । চোখদুটোও ভিজে গেছিল । আমি আলতো করে মুছে দিয়ে বললাম  , তোমার ভালোবাসা দিয়েছ । সেই তো আমার পরম পাওয়া । আমি যে ভালোবাসার বড্ড কাঙালিনী ছিলাম । তুমি ভালোবাসা দিয়ে কাঙালিনী মিতার সে অভাব পুরণ করেছ । এর চেয়ে তো বেশি কিছু চাইনি কখনো । 

          #          #           #           #          # 

শেষ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা চরিত্র করে এক শ্রমিক নেতার সহযোগিতায় মহাবীরপুর কোলিয়ারিতে কয়লা কাটার কাজ পেল রমেন । একজন ক্যাজুয়াল লেবার হিসেবে । আমরা যারপরনাই খুশি হলাম । যে অনিশ্চয়তা আমাদের পেয়ে বসেছিল তার থেকে মুক্তির একটা ক্ষীণ আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছিলাম । নতুন উদ্যমে আবার শুরু করলাম দিনপ্রতিদিনের লড়াই । অনেক ঘোরাঘুরি করেও ইসিএলের আবাসন পাওয়া গেলনা । তাই শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে আবার সেই বস্তিজীবনের স্যাঁতসেঁতে ঘরে ফিরতে হয়েছিল । কিন্তু তার জন্য আমি কখনো কষ্ট পাইনি । আমাদের মিলিত ভালোবাসার স্পর্শে সজীব হয়ে উঠেছিল সেই প্রায়ান্ধকার ঘরখানি । বেলাশেষে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন কালিঝুলি মাখা আমার তিনি ফিরে আসবেন । 

মাসছয়েক পরে এরকমই একটা দিনের কথা লিখতে গিয়ে আমার কলমটা বারবার থেমে যেতে চাইছে । তবু আমায় শেষ করতেই হবে । তখন বিকেল চারটে এরকম হবে । রান্না ঘরে বিকেলের খাবার তৈরি করছিলাম । জানতাম আমার উনি একপেট ক্ষিধে নিয়ে ঘরে আসবেন । হঠাৎ কে যেন খবর দিল মহাবীরপুর কোলিয়ারির এক নং পিটে কোনো ভাবে জল ঢুকছে । তাই দিক্বিদিক কাঁপিয়ে একটানা সাইরেন বেজে চলেছে । পথে নেমে দেখলাম অসংখ্য কুলিকামিন ছুটে চলেছে খনিমুখের দিকে । 

কারোর স্বামী, কারোর ছেলে আজ  মহাবীরপুর  খাদের মধ্যে বন্দী । সেদিন আমিও তাদের মধ্যে একজন । খনিমুখের কাছে পৌঁছে দেখি পুলিশ ঘিরে রেখেছে চারদিকটা । কাউকেই খাদের কাছে যেতে দেওয়া হচ্ছে না । একজন ওভারসিয়ার নাম লিখে নিয়ে শুধু হদিস বলে দিচ্ছিল । আমি নাম বলতেই বলেছিল, এখনো আটকে আছেন । তবে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে সর্বতো ভাবে । 

সবটা বোধহয় শুনতে পারিনি । তার আগেই আমার সামনেটা বুঝি অন্ধকার হয়ে আসছিল । কোনোরকমে মাথাটা চেপে ধরে বসে পড়লাম । একজন পুলিশ কাছে এসে বললেন, আপনি ঘরে যান । 

— আমার স্বামী খাদের মধ্যে পচে মরবে আর আমি ঘরে যাবো  ? 

আরো বেশ কয়েকজন মহিলার সঙ্গে সেই ফাঁকা মাঠের ওপরে বসে রইলাম । পরদিন সকাল থেকেই লোকজনে ভরে উঠেছিল মহাবীরপুর । টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার, মণ্ত্রী  , কৌতূহলী জনতা– আর তাদের মাঝে আমরা ক’জন ।

 যাদের আপনজনেরা খাদের অন্ধকারে মৃত্যুর প্রহর গুনছিল । আমাদের কতো যে ছবি উঠেছিল আর ক্যামেরার সামনে কতো কথা বলতে হয়েছিল , কতো মহাপুরুষেরা আমাদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেছিলেন তার ইয়ত্বা ছিলনা । 

রাত তখন ক’টা হবে আজ আর ঠিক বলতে পারছিনা । সবে মাত্র তন্দ্রা এসেছিল । এমন সময় কে যেন ডাকল । চোখ খুলতেই কে একজন বললেন  , আপলোগ কুছ খায়েগী নেহি ? 

পাশের এক হিন্দিভাষী মহিলা ফুঁসে উঠলেন । বাঁ হাত নাড়িয়ে বললেন  , তু ক্যায়সা রে ? মেরে আদমি লোগ দানাপানি ছোড়কে রহেগা, ও লোগ মর যায়েগা তো হমলোগ ক্যায়সে জিউঙ্গী? তু বোল ক্যায়সে জিউঙ্গী  ? 

না সেই ভদ্রলোক কোনো জবাব দিতে পারেননি । বাষ্পাচ্ছন্ন চোখে ধীরে ধীরে ক্যাম্পে ফিরে গেছিলেন । 

আমরা, যাদের আপনজনেরা খাদের মধ্যে আটকা পড়ে গেছিল  প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমাদের লোকেরা বাইরে না আসা পর্যন্ত কিছুই খাবোনা । সেই কঠিন প্রতিজ্ঞায় কর্তৃপক্ষ নড়ে চড়ে বসল । বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গেছিল খনিশ্রমিকদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি । আর সেটাকেই ইস্যু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ময়দানে নেমে পড়ল । তাদের হাঁকডাক চিৎকারে আমরাও যেন হাঁপিয়ে উঠলাম । 

সেদিন প্রায় ভোরের দিকে একটু সোরগোল হতেই উন্মুখ হয়ে ছুটে গেলাম খাদের মুখে । ” আছে, আছে  ; ওরা বেঁচে আছে ” খবরটা মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেই আটকে পড়া খনি শ্রমিকদের আত্মীয়েরা খনির মুখে এসে হাজির হল । খাদানের মুখ থেকে প্রায় দুকিমি উত্তরে টানেলের একটা বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছিল ওরা । তীব্র জলস্রোতের মধ্যে দিয়ে আসতে গিয়ে প্রায় খাদানের মুখেই হারিয়ে গেছে ওদের দুই বন্ধু । কে জানে তারা বেঁচে আছে কি নেই ! জল যেভাবে ঢুকছে তাতে ওদের বাঙ্কারটিও যে অনির্দিষ্টকালের জন্য অক্ষত থাকবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ ছিলনা । তখন সেই মুহূর্তে ওদের দরকার ছিল খাবার এবং রক্তচাপ কমানোর ওষুধ । 

সকাল হতেই সারা দেশের খনি বিশেষজ্ঞরা এসে হাজির হলেন । ঠিক হল খাদানের মুখ থেকে প্রায় দুকিমি উত্তরে বাহাত্তর ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ বসানো হবে । পাইপ দিয়েই আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করার লক্ষ্যে দ্রুতগতিতে কাজ শুরু হল । 

ইতিমধ্যে একজন মহিলা ডাক্তার আমাকে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন । বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বললেন  , দেখুন আপনাকে কিছু খেতেই হবে । কারণ আপনি মা হতে চলেছেন । আপনার সন্তানের কথা ভেবেই আপনাকে খেতে হবে । আর আমাদের ইঞ্জিনিয়ার এবং শ্রমিকরা সবসময় কাজ করে চলেছেন । আজ কি কাল আটকে পড়া শ্রমিকরা বাইরে আসবেনই । 

সেই ডাক্তারের সনির্বন্ধ অনুরোধকে আমি উপেক্ষা করতে পারিনি । তাছাড়া আমি মা হতে চলেছি সেই আনন্দেই বুঝি উদ্বেলিত হয়েছিলাম । আমার স্বামী অন্ধকার খাদানের মাঝে আটকে পড়ে বাইরে আসার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, অপরদিকে আমাদের সন্তান জঠরের অন্ধকার থেকে বাইরে আসার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে । অদ্ভুত এক সমাপতন ছিল, তাই না বলো  ? সন্তানের প্রতি মায়ের দায়িত্ববোধ আমাকে নতুন করে বাঁচার প্রেরণা যোগাল সেদিন । 

অনেকদিন আগে এক অবাঞ্ছিত শিশুকে জঠরে ধারণ করে নিজেকে নিজের কাছেই বোঝা মনে হয়েছিল । সেদিন আর এক নিষ্পাপ শিশুকে গর্ভে ধারণ করে নিজেকে গর্বিতা মনে হল । মাতৃত্বের পূর্ণতায় আমার দেহমনে অনরণিত হল এক অনাস্বাদিত আনন্দ । 

আর ঠিক তখনই বিশেষ একটি নিউজ চ্যানেলে মিতা নামের একটি মেয়ের ত্যাগতিতিক্ষার কথা প্রচার করা হচ্ছিল । রাতারাতি আমি বিখ্যাত হয়ে গেলাম । কিন্তু আমি তো সংবাদ হতে চাইনি কখনো । আমি তো কখনো বলিনি স্বামীর জন্য এতখানি ত্যাগ করেছি । আমার মনে হয়েছিল সেসব বুঝি একজন নারী হিসেবে আমার কর্তব্যের মধ্যেই ছিল । আর এসবের মূলে ছিল সেই রিপোর্টার কুন্তল চৌধুরী । যার কথা আগেই লিখেছি । 

বেলা বাড়তেই বোধহয় নিউজচ্যানেল থেকে সংবাদ পেয়ে ছুটে এসেছিলেন আমার মা বাবা , শ্বশুর শাশুড়ি । সেদিন আমি তাদের কারোর চোখের দিকে চেয়ে দেখতে পারিনি । মনে হয়েছিল আমিই বুঝি অপরাধী । আমি ওদের প্রত্যেকের স্বপ্নভঙ্গ করেছি । কিন্তু আমার শাশুড়ি মা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন । যেন হারানিধি খুঁজে পেয়েছেন । তাঁর কান্না দেখে আমি কিছুতেই কাঁদতে পারিনি । মনে হয়েছিল আমি বুঝি পাথর হয়ে গেছি । 

শাশুড়ি মা বললেন  , মা বেহুলা, সাবিত্রিদের দেখিনি । কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তুমি বুঝি তাদেরই একজন । 

তখন আমি আর ঠিক থাকতে পারিনি । কাঁদতে কাঁদতে লুটিয়ে পড়লাম তাঁর বুকে একটুখানি আশ্রয়ের জন্য । বললাম  , মা আমি বেহুলা বা সাবিত্রী হতে চাইনি । আমায় আশীর্বাদ করুন আমি যেন আপনার ছেলেকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি । 

দূরে দাঁড়িয়েছিলেন আমার বাবা মা । কাছে যেতেই তাঁরাও আর ঠিক থাকতে পারেননি । আমি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, মা তোমার অবাধ্য মেয়েটাকে ক্ষমা করেছ তো  ?

— তুই যা করেছিস মেয়ে হিসেবে তাই তো করা উচিত ছিল । তবে আমাদেরকে কেন কষ্ট দিলি মা  ?

বাবা কাছে এসে বললেন, হ্যাঁ রে তোর আমার কথা একবারও মনে হয়নি  ? আমার এত সম্পত্তি কার জন্য  ?  কিসের জন্য  ? কেনই বা আমার জামাই বাবাজীকে কয়লাখাদানের মধ্যে কাজ করতে হবে বেঁচে থাকার জন্য  ? 

তারপর উনি আর ঠিক থাকতে পারেননি । একপ্রকার শিশুর মতোই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন । চারদিকে উৎসুক জনতা । আমার মনে হল এমন একটা বিয়োগান্তক পরিণতির জন্য আমিই দায়ী । ধীরে ধীরে আমার বাবা এগিয়ে গেছিলেন শ্বশুরমশাইয়ের দিকে । ওনার কাছে হাতজোড় করে বললেন, বেয়াইমশায়  —

হয়তো আরও কিছু বলতে চাইছিলেন 

 কিন্তু পারেননি । 

দুই বাবার চোখ থেকেই অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরে যাচ্ছিল । চোখগুলো যেন কোনো ভাবেই বিশ্রাম নিতে চাইছিল না । কোনো রকমে কান্না থামিয়ে শ্বশুরমশাই বললেন, আমার আর কি রইল বলুন  । একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে  — 

— হারায়নি । আর যদি তেমন কিছু একটা হয়ই আমার মেয়ে তো রইল । সেকি আপনার সন্তান হওয়ার যোগ্যতা লাভ করতে পারেনি । 

— একথা বলে আর লজ্জা দিওনা ভাই । আপনার মেয়ে আমার রমেনের স্ত্রী হয়েছিল বলেই কঠিন অসুখ থেকে মুক্তি পেয়েছে সে । মা আমার স্বমর্যাদায় আমার ঘরের লক্ষী হয়েছেন । আড়ালে থেকে বিশ্বনিয়ণ্তা ভগবান এদের দুজনকেই মিলিয়ে দিয়েছেন । 

এরপর কোল ইন্ডিয়ার পদস্থ কর্তারা যখন বাবার পদমর্যাদার কথা জানল তখন নতুন করে উদ্ধারকাজ জোরদার হল । যে কোনও মূল্যে তারা রমেনকে বাইরে আনার ব্যবস্থা করতে রাজি ছিল । ক’দিন আগেও আমি যে সাধারণ ব্যবহার পেয়েছিলাম সেই তারাই শুধুমাত্র আমারই জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল ।ঠিক তখন থেকেই দুজন ডাক্তার এবং একজন নার্স সবসময় আমার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল । 

আমাকে ওরা বারবার অনুরোধ করছিল সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য । কিন্তু যখন আমি বারেবারেই ওদের অনুরোধ উপেক্ষা করে আগস্টের দুপুরের ঠা ঠা রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে রইলাম তখন ওরা বাধ্য হয়েই পিট এর সামনেই একটা তাঁবু খাটিয়ে দিল । সমবেত কুলিকামিনদের মধ্যে আমি যেন বেশি মর্যাদা পাচ্ছিলাম । কিন্তু এমনটা আমি চাইনি । আমি চেয়েছিলাম নিজের মতো করে একটা ছোট্ট সংসার । সম্পদের মোহ আমাকে আটকে রাখতে পারেনি । 

বিত্তশালীদের স্বরূপ আমি দেখেছি । তাদের স্পর্শে থেকে একসময় আমি আমার থেকেই হারিয়ে যাচ্ছিলাম । তারপর আবার যখন রমেনের স্পর্শে এসে আমার আমিকে আবিষ্কার করলাম ঠিক তখনই এমন একটা দুর্ঘটনা আমাকে আবার একটা পরীক্ষার মধ্যে ঠেলে দিল । আমি কোনও দিন কোনও দূরাবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ করিনি । কঠোর ভাবে তার মোকাবিলা করেছি । কিন্তু সেদিন বুঝি আমি আমার সংকল্পে কতখানি অবিচল থাকতে পারি তার পরীক্ষা নেবার জন্য এমনতরো দুর্ঘটনা ঘটেছিল । যাই হোক কর্তৃপক্ষের আমাকে ঘিরে অতিরিক্ত ব্যবস্থা সহ্য করতে পারিনি । 

দুপুরের খাবারের সময় যখন আমার জন্য ফলের রস এল, আমি তখন ফুঁসে উঠলাম । এক ঝটকায় সব ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বললাম, কি পেয়েছেন আমাকে  ? হঠাৎ সব বদলে গেছেন  ? গতরাত্রে একমুঠো ভাত পাইনি । আর আজ ফলের রস  ? পারেন, এই শিশুগুলোর জন্য একটু দুধের ব্যবস্থা করতে  ? 

আবার আমি খবরের শিরোনামে । আমি তেজোদীপ্তা এক অসামান্যা নারী । 

জানোতো, সাংবাদিকেরা এমন সব বিশেষণ যোগ করে দেয় যার জন্য ব্যক্তি শেষমেশ পাগল না হয়ে পারেনা । তবে না  , আমি কিন্তু পাগল হতে পারিনি । অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম সেই চরম মুহূর্তটার জন্য । কখন রমেন খাদের বাইরে আসবে  । আমার মনে হচ্ছিল যেন কতকাল তাকে দেখিনি । 

বোরিং শেষে পাইপের টুকরোগুলোকে যখন ক্রেনের সাহায্যে একটা একটা করে খাদের নিচে নামানো হচ্ছিল তখন আমি কিছুতেই ধৈর্য্য ধরতে পারছিলাম না । আমার মনে হচ্ছিল ইঞ্জিনিয়ার এবং শ্রমিকরা বুঝি আমার অবস্থাটা কিছুতেই বুঝতে পারছেনা তাই তারা অযথা দেরি করছে । এক একটা মিনিটকে সেদিন এক একটা যুগ বলে মনে হচ্ছিল । ধীরে ধীরে সেদিনটাও শেষ হল । কর্মীরা বলল  , আজ আর সম্ভব নয় । 

আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, কেন সম্ভব নয়  ? কিন্তু পারলাম না । একটা হতাশায় ভেঙে পড়লাম ।

 তাহলে কি রমেন  কোনোদিন বাইরে আসতে পারবে না  ? অন্ধকার খাদানের নিচে পচে মরবে  ?

চিৎকার করে উঠলেন এক মহিলা । বললেন, তু আদমি লোগ ক্যা বোল রহে হো? মেরে আদমি বাহার নেহি আয়েগা তো ম্যায় খাদমে চলে যায়েগী । ম্যায় কিসিকে লিয়ে জিন্দা রহুঙ্গী  ? 

ওই মহিলা আর কিছু বলতে পারলনা । প্রচন্ড উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে একসময় অজ্ঞান হয়ে গেলেন । চারদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা । একবিংশ শতকের ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের কাছে সেদিনের খনি দুর্ঘটনা যেন একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল । আর সেই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে তাবড় তাবড় বিশেষজ্ঞরা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন । 

সেই সময় মাইকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসল ।

‘ আমি কোল ইন্ডিয়ার এম ডি বলছি, খনির মধ্যে আটকে পড়া শ্রমিকরা বাইরে আসবেনই । আপনারা কেউ হতাশ হবেননা । দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষজ্ঞরা আসছেন । 

— হমে বিশেষজ্ঞ নেহি চাহিয়ে । হমারে আদমিকো ফিরাদো । 

আবার নিস্তব্ধতা । আর সেই নিস্তব্ধতার মাঝে  একটা কণ্ঠস্বরই বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, ‘ফিরাদো, ফিরাদো । ‘

আবার কাজ শুরু হল । প্রথমেই নাকি কর্মীদের অবস্থানটাকে চিহ্নিত করা যায়নি । তার ফলেই এই বিপত্তি । 

            #            #             #             #

এবারে সেই তার কথা বলি । যে আড়ালে থেকে সমস্ত ঘটনার রিপোর্ট করে যাচ্ছিল । বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছিল ভারতীয় প্রযুক্তিবিদদের নাকানিচোবানি খাওয়ার কথা । নিশ্চয় মনে পড়ছে সে কে  ? হ্যাঁ কুন্তলের কথাই বলছি । সেদিন ও কিছু একটা তথ্য নেওয়ার জন্য আমার কাছে আসতেই বললাম  , এমনটা করার কি দরকার ছিল  ? আমিতো সবার আড়ালেই থাকতে চেয়েছিলাম । 

— আমি একজন রিপোর্টার । রিপোর্টার হিসেবে আমার চ্যানেলের প্রতি কিছু কর্তব্য আছে । 

— কর্তব্য হল আমাকে মহিয়সি করে দেখানো  ? 

— না বোনটি । ঘটনার গুরুত্বটা দর্শকদের কাছে যথাযথ ভাবে তুলে ধরা । 

ইতিমধ্যে চিত্রাও এসেছিল । ইচ্ছে থাকলেও সে চোখের জলকে লুকিয়ে রাখতে পারেনি । আমার মনে পড়েনা ইতিপূর্বে আমরা দুইবন্ধু একসাথে কেঁদেছিলাম কিনা  ?কিন্তু সেদিন আমি চোখের জলকে আড়াল করে বললাম, কাঁদছিস যে  ? 

— কাঁদবনা  ?

— কেন কাঁদবি  ? 

কিন্তু একটা অজানা আশঙ্কা বুকের মাঝে দলা পাকিয়ে বসেছিল । যদি রমেন  ? না, তা কিছুতেই হতে পারেনা । রমেন ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই । সেই রমেনকে ছেড়ে আমি কেমন করে বাঁচব ? চিত্রা চোখের জল মুছে নিয়ে বললে, দেখো , এবারেও তুমি ওকে ফিরিয়ে আনবে ।

আমি শুধু ওর চোখের দিকে চেয়েছিলাম ।কিন্তু কিছু বলতে পারিনি । হঠাৎ আবার সাইরেন বেজেছিল । খনির ভেতর থেকে সংকেত আসছিল । সমবেত জনতা ছুটে গেছিল সেদিকে । মুহূর্তের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল । পাইপ বসানোর যণ্ত্রগুলিও আবার সচল হল । আশায় বুক বাঁধলাম আমি । 

আমার বাবা, মা , শ্বশুর, শাশুড়ি সবাই আমাকে ঘরের আরামে ফিরে যেতে বললেন । কিন্তু আমি পারলামনা ।সবসময় আমার চোখদুটো বুঝি রমেনকেই খুঁজে ফিরছিল । 

পরপর দুদিন কেটে গেল । দিনগুলো যে কিভাবে কেটে গেল– তা এতকাল পরে ঠিক গুছিয়ে লিখতে পারবনা । সবকথা আজ আর মনেও পড়ে না । আবছা মনে আসা একটা ঘটনার কথা বলি । 

প্রচন্ড উত্তেজনার মধ্যে দিয়ে বাহাত্তর ইঞ্চ পাইপ বসানো হলে আমাদের আর ধৈর্য্য ছিলনা । মনে হচ্ছিল আমরা যেন কতকাল ধরে অপেক্ষা করে আছি আমাদের প্রিয়জনের জন্য । চারদিকে সারসার কুলিকামিন । সেদিন তাদের মধ্যে আমিও একজন । উন্মুখ হয়ে চেয়ে আছি বাহাত্তর ইঞ্চ পাইপের প্রবেশ পথে । মনে হচ্ছিল কতকাল দেখিনি ওকে । পরপর ছজন উঠে এল । তাদের কাউকে আমি চিনিনা । 

দেখলাম তাদের স্বজনের উল্লাস । কিন্তু আমি  যার জন্য এক বুক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছি, সে কোথায়  ? একসময় লিফট থেমে গেল । ওভারসিয়ার এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার হতাশ হয়ে জানালেন, গ্যাংলিডারের কথা না শুনে বাইরে আসতে গিয়ে স্রোতের মধ্যে পড়ে কয়লা খাদানের কোথাও হারিয়ে গেছে ওরা । তবে খোঁজ জারি থাকবে । 

— না, না এ হতে পারেনা । 

তারপর একটা আর্তনাদ করে বুঝি আমি জ্ঞান হারালাম । যখন জ্ঞান ফিরল দেখলাম আমি হাসপাতালে । চারপাশে ডাকতার এবং নার্স । আমি কথা বলতে পারিনি । বুঝি বা বোবা হয়ে গেছিলাম । আমার তলপেটটা যেন ভেঙে চুরে একাকার হয়ে যাচ্ছিল । তবে কি আমি  — ? না । একটা আশঙ্কায় চিৎকার করতে চেয়ে আবার জ্ঞান হারালাম । দুদিন পরে জেনেছিলাম আমার জড়ায়ুর মধ্যে একটা ভ্রুণ ক্রমশ বড় হয়ে উঠছিল, সে বাইরে এসেছিল বড্ড অসময়ে । তার ফলে পৃথিবী থেকে তাকে চিরতরে চলে যেতে হয়েছে । আমি পারিনি তাকে রক্ষা করতে । কেন জানিনা আমার একমাত্র অবলম্বন পৃথিবীর আলো দেখার অন্য এক অন্ধকারের জগতে হারিয়ে গেল । এখন আমার চারপাশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার । প্রতিমুহূর্তে হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি ।

 যে ভালোবাসাকে পাথেয় করে একদিন পথে নেমেছিলাম সেই ভালোবাসাকে হারিয়ে আজ আমি একেবারে সর্বহারা । বাবা , মা , শ্বশুর ,শাশুড়ি — সবার অনুরোধ উপরোধকে উপেক্ষা করে আজো আমি অপেক্ষায় রয়েছি যদি সে কখনো ফিরে আসে । কোল ইন্ডিয়াতেই যদিও আমি একটা চাকরি পেয়েছি । তবু মনে হয় কেন আমি বেঁচে রয়েছি? এর উত্তর হয়তো একটাই হতে পারে । 

আমি যে জীবনকে বড্ড বেশি ভালোবাসতাম । অনেক ট্রাজেডি এসেছিল । কিন্তু অনায়াসেই সেগুলো অতিক্রম করেছি । আজ আর বুঝি পারছিনা । আজ বড়ো একা লাগে । পুরুষ জাতটাকে যখন ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম তখনই রমেন এসেছিল আমার জীবনে নতুন আলোর দূত হয়ে । তার ভালোবাসা দিয়ে আমার জীবনের অন্ধকারটাকে মুছে দিতে চেয়েছিল । ওর ভালোবাসার আস্তরণের তলায় আমি নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছিলাম । ফেলে আসা জীবনের অন্যায়বোধ আর আমাকে তাড়া করে ফেরেনি । 

আজ আমার চারপাশে শুধু তারই স্মৃতি । তার ব্যবহার্য জিনিসপত্রে মনে হয় তারই গন্ধ ছডানো ।আমার বুকের মাঝে কে যেন ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে । নীরব নিশীথে মালভূমির ছডানো ছিটানো ছোটো বড় টিলা থেকে তা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে । আমি কাঁদি শুধু কাঁদি । মাঝে মধ্যে খাদেও নেমে যাই । কেউ কিছু বলেনা আমায় । হয়তোআপনজনকে হারানোর জ্বালাতারাও কিছুটা বুঝতে পারে । সেফটি ল্যাম্পের আলোয় আমি তাকে খুঁজতে খুঁজতে কতোদূর চলে যাই । দুপাশে থরেবিথরে সাজানো থাকে কালো পাথর । কানে আসে গাঁইতির শব্দ । অসংখ্য কুলিকামিনের মধ্যেখুঁজতে থাকি । মনে হয় ওদের মাঝেই বুঝি আমার সে লুকিয়ে আছে । একসময় টানেল শেষ হয় । আর কোনো দিকে পথ পাইনা । শুধু কয়লা আর কয়লা । 

এই কয়লা ওপরে উঠে গিয়ে সভ্যতার চাকাটাকে সচল রাখে । অথচ এই কয়লা কাটতে গিয়ে কতো শ্রমিক যে খাদের অন্ধকারে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে তার হিসাব ওপরের পৃথিবী রাখেনা । চারদিকে শুধু কয়লা আর বিস্তীর্ণ অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে ডাকি , রমেন কোথায় তুমি । আমি এসেছি । তুমি তো তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারিনা ।

কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দেয় না । শুধু কথাগুলোই ফিরে ফিরে আসে । আমি কাঁদতে কাঁদতে বসে পড়ি । তারপর একসময় রাতের শিফট শেষ হয় । কে যেন আমাকে ডাকে , বহিনজী আইয়ে । 

— নেহি যাউঙ্গী ম্যায় । এঁহি রহুঙ্গী, ও জরুর আয়েগা । কিন্তু ওরা ছাড়েনা । আমি চিৎকার করে বলতে থাকি, ছোড়দো মুঝে । ভাইয়া মুঝে ছোড়দো ।

আমি কাঁদতে থাকি একসময় ডাক্তার আসেন । কি একটা ইনজেকশন দেন আর আমি ঘুমিয়ে পড়ি । আজ আমি একেবারে সর্বহারা । আর আমার চারপাশের লোকদের মনে হয় নিষ্ঠুর । ওরা কেউ আমাকে বুঝতে চায় না । ওদের হৃদয়ে বুঝি দয়া মায়া মমতা বলে কিছু অবশিষ্ট নেই । ওরা বুঝি কয়লাখনির অন্ধকারে, খাদানের গভীরে সে সব ফেলে এসেছে । 

আর কি লিখব বলো । এই দীর্ঘ চিঠির শেষে জানাই  ‘ভালো আছি ‘ । 

                                    ইতি তোমারই  মিতা ।

#কলমে_রথীন্দ্রনাথ_রায় 

Address   Rathindranath Ray 

Vill  +Po Gidhagram 

Dist  Purba Bardhaman 

Pin  713143

Mob  9064807207

#storyandarticle

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *