ভাগ্যের বেড়াজাল — দয়াময় বাগ

রাজু আর লাল্টু রাতে কাজ করে বাড়ি ফিরছিল।রাজু আর লাল্টু একই কাপড়ের দোকানে কাজ করে। দুজনে প্রায় সম বয়সী। ওদের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব। রাস্তাতে গল্প করতে করতে বাড়ি ফেরার পথে রাজু হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়। 

এ লাল্টু লোক টা কে রে, এত রাতে রাস্তাতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। লাল্টু একটু পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা, ছার তো ,মদ খেয়ে শালার হুঁশ নেই, দেখছিস না। চল দশটা বাজছে, সারাদিন খাটাখাটি করে এইসব আর ভালো লাগে না।  দাঁড়া, দাঁড়া, বলে রাজু মোবাইল এর লাইট টা জ্বালিয়ে শুয়ে থাকা মাতালটার একটু কাছে গিয়ে দেখে, আরে লাল্টু এ তো আমাদের বুড়ো দা রে।

বুড়ো দা, লাল্টু কিছু টা অবাক হলো।

রাজু কিছু টা দুঃখ প্রকাশ করে,মানুষ টা কি ছিল আর কি হলো বল লাল্টু।

লাল্টু রা জানে বুড়ো দা কে? সেই ছোট্ট বেলা থেকে ওরা বুড়ো দা কে দেখে আসছে।

এক সময় বুড়ো দা পাড়ার সকলের প্রিয় ছিল।এখন লোক টা সকলের কাছে মাতাল।

তোর মনে আছে লাল্টু,সেই বারের দুর্গা পুজোতে, আরে সেই বারের,যে বারে প্রথম আমাদের পাড়াতে দুর্গা পূজা হল। বুড়ো দা নিজের জীপ গাড়ি টা পাড়াতে ঢুকালেই, আমরা সবাই এক সাথে গাড়িতে চেপে পড়তাম। তারপর বুড়ো দা কে বলতাম চল ঠাকুর দেখতে যাবো। বুড়ো দা কিন্তু না করতো না। সবাই কে একসাথে ঠাকুর দেখাতে গিয়ে গোটা শহর টা কেমন ঘুরাতো বল তো।

চ – বুড়ো দা কে একটু চাতালটাতে উঠিয়ে দিই। ওকে কাঁদে করে তো এতটা রাস্তা নিয়ে যাওয়া যাবে না। কারণ বুড়োদা মুটামটি সত্তর আশি  কিলো তো হবেই। কি বলিস লাল্টু! উঠাবি।

চল চল। নে একটু হাত লাগা রাজু।

রাজু আর লাল্টু কোন রকমে বুড়োদা কে বট গাছের নীচে চাতালটা তে উঠিয়ে দিল। উঠিয়ে দিয়ে বুড়ো দার গায়ে লেগে থাকা ধুলো মাখা গা টা দুই জনে ঝেড়ে দিল।

তারপর লাল্টু বলল চল বাড়ী ফেরার পথে বৌদি কে ডেকে দেব।

রাজু কিছু টা ইতস্ততঃ হয়ে, এত রাতে বৌদি কে ডাকলে কি শোভা পাবে, তার চেয়ে বরং না ডাকাই ভালো। বুড়ো দার নেশা কাটলে ও নিজে নিজেই বাড়ী আসবে।

দুই বন্ধু রাস্তায় কিছু টা পথ চুপ চাপ আসতে আসতে রাজু দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে,বুড়ো দা কেমন হয়ে গেল বল লাল্টু।

হ্যাঁ, মানুষ টা কত ভালো ড্রাইভার ছিল। পাড়ার কত ছেলে কে ড্রাইভিং শিখিয়েছে। ওরা আজকে সবাই প্রতিষ্ঠিত। যে বলেছে আমার ছেলে টা কে একটু ড্রাইভিং শিখিয়ে দেবে, বুড়ো দা কাওকে না করতো না। নিজের গাড়ী ফাঁকা না থাকলেও স্ট্যান্ডের যে কোন গাড়িতে প্লেসমেন্ট করে দিত। আজ তারা বুড়ো দা কে চেনেও চেনে না।বুড়ো দার টার্নিং পয়েন্ট হল ও যে,জীপ গাড়ি ছেড়ে অ্যাম্বুলেন্স চালাতে গেল। এই তো গত বছর আগে

সে দিন ভর্তি দুপুর বেলা, রোগী সহ রোগীর পরিবার কে নিয়ে কলকাতা পি, জি হসপিটাল যেতে হবে বুড়ো দা কে। রোগীর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগবে।তাই রোগীর পরিবার খু্ব তাড়া দিচ্ছিল।

বুড়ো দা কোনো রকমে গোগ্রাসে হোটেলে ভাত কোটা খেয়ে গাড়ীর কাছে এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার টা রেডি করছিলো।

হঠাৎ ধুম করে একটা শব্দ, ব্যাস, বুরোদা চোখে আঙ্গুল দিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল।

স্ট্যান্ডের চার পাশে থাকা সমস্ত ড্রাইভার রা ছুটে এসে কি হল, ওরা এসে দেখে অক্সিজেন সিলান্ডারে কাঁচের বোতল টা বার্স্ট হয়েছে। আর তাতেই একটুকরো কাঁচ বুড়োদার বাম চোখের মনি তে গেঁথে গিয়েছে। কাছে মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, সঙ্গে সঙ্গে জরুরী বিভাগে নিয়ে গেলে,বুড়োদা কে পি. জি তে নিয়ে যেতে বলা হয়। বুড়ো দা সেই মুহুর্তেই বুঝেছিল তার ড্রাইভার লাইন শেষ। কারণ চোখ না থাকলে ড্রাইভার করা যায় না। আর একটা চোখে কী করেই বা গাড়ি চালাবে। বুড়ো দা যা অনুমান করেছিলো বাস্তবে সেটাই ঘটলো।

অনেকে কাঠ খড় পুড়িয়ে কোন লাভ হয় নি তার। শেষ পর্যন্ত বাম চোখ টা নষ্ট হয়ে গেল।

সেই থেকেই বুড়োদের জীবন ব্যাকফুটে চলে এল। এই রকম পরিস্থিতিতে,

ছেলে পিলে নিয়ে কী করবে কিছুই যখন ভেবে পাচ্ছিল না, তখন একটা কানা চোখ নিয়ে গাড়ি চালাতে শুরু করে।কিন্তু রাতের অন্ধকারে বুড়ো দার চোখ যে ঝলসে যেত সেটাও ভাল করেই টের পেত বুড়ো দা। তাই ড্রাইভার লাইন টা নিজে থেকে শেষ করে দিল। যে সময় শুরু করার কথা সেই সময় সব শেষ।

অভাবের টানে বৌ টাও পরের ঘরে কাজে ঢুকতে শুরু করল।

যে সংসার টা এত দিন নিজে সচ্ছল ভাবে চালাতো, নিজের হাতে বাজার, মুদিখানা, সব্জি বাজার, সব করতো।যে বৌ কে এত দিন ঘরে রেখেছিল, বাড়ীর বাইরে হতে দেই নি,সে আজ দুটো পয়সার জন্যে লোকের বাড়ি তে কাজে যাচ্ছে। নিজের ইনকাম জিরো। ছেলে টা কলেজে পড়ছে। এই সব চিন্তাতে

সব যেন একটা এলোমেলো দাগ হয়ে দাঁড়ালো তার জীবনে,

মানুষ টা চিন্তাই ভেঙে পড়ল। শুরু হল আর এক নতুন জীবন।

নতুন জীবন বলতে, এলাকার যে কোন মানুষ, যেটা বলে, সেটাই করে দেওয়ার চেষ্টা করে। তাও আবার কম মজুরিতে। এই যেমন কারোর বাগান পরিষ্কার করে দেওয়া, কারও বাড়ির ড্রেন পরিস্কার করে দেওয়া, কারো মটরসাইকেল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে দেওয়া। কারোর চারচাকা ধুয়ে দেওয়া। পাড়া ঘরে কোন বাড়িতে বিয়ে লেগেছে,তাদের ঘরবাড়ি সব পরিষ্কার করে দেওয়া ঝেড়ে ঝুড়ে দেওয়া। মরা মরেছে, অস্থি নিয়ে যাওয়ার লোক নেই, মরা বাড়ির একজনকে নিয়ে অস্তি দিয়ে আসা।এসব কাজ নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুড়ো দা করে চলে। এসব কাজ এখন আর করতে কষ্ট হয়না তার, সময়ের প্রবাহে সবই তার সোয়ে গেছে। তাইতো মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার জন্য, বুড়ো দা মদ টা এখন বেশি পরিমাণে খেতে ধরে নিয়েছে, আর তাতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার জন্য ঘরে প্রায়ই অশান্তি করে। কিন্তু মদ খেয়ে গালাগালি মন্দ কিছু করলে, লোকে তো মাতাল- ই বলবে না! তার মানসিক কষ্টের কে বা দাম দেবে? দাম তো দেবেই না, উল্টে মাতাল বলে মারধর করবে। এটাই সমাজের রীতি এটাই সমাজের নীতি। কে তার অন্তরে ঢুকবে, কে তার জ্বালা বুঝবে।

কিন্তু মাতাল স্বামী হলেও বৌদি কখনো বুড়ো দা কে অবহেলা করেনি বল লাল্টু।

যা বলেছিস রাজু,

বুড়ো দার বৌ,ব্যাপক পরিশ্রমী, চার পাঁচ ঘরে বাসন মাজার কাজ করে, কোন রকমের সংসার টা চালায়। জাত বংশের ঘরে মেয়ে বলতে হবে। না হলে কি ওই রকম মাতাল স্বামী কে নিয়ে কেও কি ঘর করতে পারে। অবশ্য এই কথা টা পাড়ার সকলেই জানেন।

বুড়োদার দুই ছেলে, এক মেয়ে। মেয়ে টার  কিছু দিন হল বিয়ে দিয়েছে। অভাবের টানে ছোট ছেলে টা পড়াশুনা ছেড়েছে, বড় ছেলে টা পড়াশুনাতে খু্ব আগ্রহী তায় নিজেই টিউশন করে নিজের পড়াশুনা টা চালিয়ে নেয়। আর যতটা পারে উদ্বৃত্ত টাকা মায়ের হাতে দেয়, বড়টা কলেজে সেকেন্ড ইয়ার পড়ে। বাবার এই মাতলামিতে, ছেলেটাও প্রায় একাকী থাকতে শুরু করেছে। বাবার মাতলামির কথা তার কানে আর নিতে ভালো লাগে না। আজ এ বলে কাল ও বলে। এইসব না শুনার জন্যই, আজ সে একা থাকতেই বেশী ভালোবাসে।

বৌদি সারা দিন পরিশ্রম করে কোন রকমে একটা ছোটো মাটির কুড়ে ঘরে শুয়ে থাকে। না আছে ইলেক্ট্রিসিটি, না আছে ফ্যান। গরমে পচে। কোন রকমে দিন কাটাতে হয়। সেই জন্যে সে বৌদি কে উঠাতে চায় না,কারণ একবার ঘুম ভাঙলে গরমে আর ঘুম আসতে চায় না। বুঝলি লাল্টু।

গল্প করতে করতে যখন বুড়ো দার বাড়ির সামনে দিয়ে দুজনের পাস হতে যাবে, তখনই বুড়োদের বউ বাইরে বেরিয়ে দেখে, আমরা দুজন রাস্তা দিয়ে আসছি।

ঘুম চোখে বৌদি আমাদের দিকে হাত তুলে বলছি ও রাজু তোমার দাদাকে দেখলে।

হ্যাঁ বৌদি, ঐ তো বটতলাতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল। আমরা দুজন ঝেড়েঝুড়ে চাতাল টাতে উঠিয়ে দিয়ে এলাম।

দেখেছ কান্ড, সুভাষপল্লীতে কে নাকি ওদের মরেছিল। সেখানে গিয়েছিল। শ্মশানে মনে হয় বেশি খেয়ে নিয়েছে। জানো রাজু ওর বোনের ছেলেটা বলে গেল। ওর কাছে অনেক টাকা আছে। শ্মশানেতে বাউল গানে নাকি লোকগুলোকে মাতিয়ে তুলেছিল। তাই যে যা পেয়েছে ওকে পকটে গুঁজে দিয়েছে।

রাজু লাল্টু দুজনেই জানে, বুড়ো দা ভালো বাউল গান গাইতে পারে, পাড়াতে কোন মরা মরলেই তাই বুড়ো দা কে সবাই খোঁজে।

আচ্ছা বৌদি আমরা চললাম,বুড়ো দা বরং ওই খানেই থাকুক নেশা কাটলে চানটান সেরে নিজেই বাড়ি আসবে।

হ্যাঁ যাও ভাই, যাও।

রাজু লাল্টুরাও জানে ভাগ্যের বেড়াজাল ভাঙলে অসময় তো প্রবেশ করবেই।

বুড়োদার ভাগ্যের বেড়াজাল তো কবে ভেঙে গেছে। কে বা তার অনুভূতির দাম দেবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *