ভবঘুরে এর গল্প

চিরুনি তল্লাশি

কেউ মাটিতে আছাড় খেলেই যে প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শী দুঃখ প্রকাশ করবে তা নয়, কেউ কেউ হাসেও। এটাই স্বাভাবিক। আমি নিজেও পড়ে যাওয়া লোককে দেখে কত্ত হেসেছি।


সেসময় আমি ফার্স্টইয়ার। বায়ো কেমিস্ট্রি। সিরিয়াস স্টুডেন্ট, তায় কোলকেতার কলেজ। রবিবার ছুটি। গ্রামে এসে পুরানো আতাকেলানে বদমাইশ বিচ্চু ফর্মে ফিরে শয়তানিতে মাঞ্জা দিই, আড্ডা মেরে।


সেদিন ছিলো এমনি এক রবিবার। বাজারে গুরুপদদার সেলুন দোকান। চুল কাটবো প্লাস আড্ডা সারবো। বর্ষার শেষ। মাঠের ফুলকপি, বাঁধা কপি বা অন্যান্য সব্জি সব বাজার মুখী। পরিত্যক্ত পাতা সব্জি আর প্যাচপেচে কাদা পাকা রাস্তাকে বিপজ্জনকভাবে পিচ্ছিল করে রেখেছে।


ঘটনাটা প্রথম ঘটলো বিমল কাকুর সঙ্গে। বাইকে করে আসছিলেন। পিছনে পিন্টু কাকু বসে ছিলেন। সামনে হাবলু ডিমের পেটি নিয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে আসছিল সামনে না তাকিয়ে। বিমল কাকু হাবলুকে বাঁচাতে ব্রেক কষলেন। পচা পাতায় স্লিপ খেয়ে গাড়ি থেমেও থামলো না, জাস্ট হড়কে গেলো। হাবলু ডিম সুদ্ধু ধপাস। সবচেয়ে সমস্যা হলো পিন্টু কাকুকে নিয়ে। উনি ডিগবাজি খেয়ে রাস্তায় পচা পাতার উপর ন্যাত করে পড়লেন। আর ওনার পরণের লুঙ্গি পায়ের দিক থেকে উল্টে মাথায় ঘোমটা মেনকা হয়ে গেলো। সমস্যা হলো কাকু ভিতরে কিছু পরেননি। হে হে। ওপাশে দাঁড়ানো পাগলিটা হাততালি দিয়ে উঠতেই অনেকে হেসে ফেলল।


হাবলু নিজের ডিম বাঁচাতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার হড়কালো। এবার সোজা পিন্টু কাকুর মুখের উপর।


আমি ছুটে গেলাম। মিশন, কাকুর লুঙ্গি। কিন্তু মিশন ইমপসিবলের মতো টার্গেট মিস করলাম। পরনের ক্ষীণতনু চপ্পলের ফিতে ‘ ওরে মারে, আস্তে হাঁট’ বলে ছিঁড়ে যেতেই আমি থপ করে বসে পড়লাম হাবলুর অবশিষ্ট ডিমের উপর। আমার পিছন কতোটা হলুদ হয়েছে তা বোঝার আগেই দেখি গুরুপদদা আর শানু ছুটে আসছে আমাদের বাঁচাতে। বুক কেঁপে উঠলো অজানা আশংকায়। বারণ করার জন্য হাত তুললাম। হলো হিতে বিপরীত। শানু ভাবলো আমি ডাকছি। সে আগে আমার কাছে আসতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। নিখুঁত হড়কানি বানে ভেসে শূন্যে কয়েক সেকেন্ড বিচরণ করে নিজের পা দুটোকে টারবাইন চাকার মতো তীব্র ঘুরিয়ে অবশেষে কারেন্ট উৎপাদন করতে না পেরে মুখ থুবড়ে পচা জৈব সার স্বরূপ সবুজ গোবরে গেঁথে গেল। আর ওদিকে গুরুপদদা গুরুতর ব্যস্ততায় হাতে চিরুনি নিয়ে শানুর পিছন পিছন আসার দরুন শানুর আকস্মিক পতনে ফ্লাইং এনাকোন্ডার মতো তীব্র ইস ইস করে শিস ছুঁড়তে ছুঁড়তে সাঁই করে সোজা পিন্টুকাকুর খোলা পশ্চাতে গিয়ে কিস করলো। এ পর্যন্ত তবুও ঠিক ছিল।  গুরুপদদার মুখের আর মাথার ঝাঁকড়া চুলের জন্য পিন্টু কাকুর পশ্চাত পৃষ্ঠ ঢাকা পড়লো। ইজ্জতে রুমাল ঢাকা পড়লো।


কিন্তু পিন্টু কাকু চেঁচিয়ে যখন বললেন, “ওরে বাবারে, কোন হারামজাদা আমার পোঁ* এ কাঠি গুঁজে দিলি।” তখন বুঝলাম গুরুপদদার হাতের চিরুনি বোধ বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। চিরুনি পথ হারাইয়া পিন্টুকাকুর পশ্চাতে আশ্রয় নিয়েছে। “পথ হারাইয়াছ পথিক?” কিন্তু বলবে কে? কাকুর পিছনে মুখ ল্যাপটানো গুরুপদদা বোধহয় জ্ঞান হারিয়েছে! চিরুনি তল্লাশি মুলতবি রইলো।


পিন্টু কাকুর পিছনে গুরুপদদার চিরুনি। একথা মনে হতেই সিদ্ধান্ত নিলাম আজ আর চুল কাটবই না। কোনো মতেই না। পাগলির হাততালির থেকেও বেশি জোরে সবাই হাসতে লাগলো।
হো হো। হে হে। হি হি।…..

ভবঘুরে – বাবু_রাজা

মা

ফিগার নষ্ট হবে বলে হয়তো সুন্দরী শ্যামল বৌদি বাচ্চা নেন নি। হয়তো ভাইটাল স্ট্যাটেস্টিক নষ্ট হলে সোসাইটিতে আর মুখ দেখানো যাবে না। এটাও বোধহয়। আসল কারণটা তিনিই জানেন।
এলাকার নারী কল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট বলে কথা! মাননীয়া সর্বেশ্বরী রায় ভয়ানক দাপুটে মহিলা।
শ্যামলদা লুকিয়ে লুকিয়ে এলাকার ভিখারিনিকে দেখেন। ফুটফুটে বাচচাটার মুখ আর ভিখারিনি মায়ের খোলা বুক তাঁর মধ্যে একটা চঞ্চলতা জাগায়। একটা লোভ চকিতে উঁকি দেয় মনের নিভৃত কোনে। লোভটা কোনো কাম লালসা না, একটা শুকনো হাহাকার। খুঁজে ফেরা সুপ্ত সুখ!

বৌদি যখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে বুকে টেডিবিয়ার জড়িয়ে টিভিতে বাচচাদের মজার শো দেখেন আর মৃদু হাসেন, হয়তো তখনই ভিখারিনি তার বাচচাটাকে নিজের বুকে উপুড় করিয়ে খিল খিল করে হাসতে থাকে ।

জীবন গনিতের ঠিকঠাক ফর্মুলায় সুরক্ষিত অঙ্ক কষে তবেই স্বামীকে বিছানায় নেন শ্যামল বৌদি । আদিম রিপুকে তিনি সুযোগ দেন না চরম মুহূর্তেও ।
গভীর আশ্লেষে পিঠে নখের আঁচড় আশা করতে করতে স্ত্রীর নগ্ন বুকে শ্যামলদা কিছু একটা খোঁজেন। না পেয়ে শেষে স্বামী স্ত্রী একটা অভ্যাসে পরিণত হয় ।

ঘটনাটা হঠাৎ হল। ভিখারিনির বাচচাটাকে পাওয়া যাচ্ছে না।…
কে নিলো?
ধুরর্। সামান্য ভিখিরির বাচ্চার খবর নেবার বেফালতু সময় কেইবা খরচ করে?
কিন্তু!
কিন্তু এইমুহূর্তে সোসাইটির হাতে তেমন কাজ নেই। তাই কুকুরের জন্মদিনের মতোই ভিখারিনির নিখোঁজ বাচ্চা একটা ক্লিষ্ট গুরুত্ব পেল।
একদিন হইচই । দুদিনের দিন সেই উপলক্ষে জমাটি আড্ডা আর দেদার খাওয়া দাওয়া। বেফিকর খানা পিনা। বিন্দাস লাইফ।

সোসাইটি ঠান্ডা হল। শ্যামল বৌদি আবার টেডিবিয়ারে আর টেলিভিশনে।
ভিখারিনির চোখে ঘুম নেই । তার বুক উপচে সাদা রক্ত । ছেঁড়া বক্ষাবরন গুমরে গুমরে কাঁদছে ।

অবশেষে দুই রমণী মুখোমুখি হলো। লোকের মুখে দিদিমণির কথা শুনে মরিয়া ভিখারিনি নালিশ করতে এসেছে সোসাইটির সর্বেসর্বা শ্যামল বৌদি, অর্থাত্ সর্বেশ্বরীর কাছে ।
নীচুতলা যখন উচুতলার সামনে তার হারানো বাচচা ফেরানোর দাবী জানালো তখন দাম্ভিক এবং বিরক্ত বৌদি বললেন, ” হারায় কীভাবে? অ্যাঁ। ঠিকমতো রাখতে পারিস না? যত্তসব ।”
ভিখারিনি তখনও ছেঁড়া আঁচলে চোখ মুছছে । চোখে অশ্রু নেই । শুকনো খসখসে। তিনদিনে সব বেরিয়ে গেছে ।
সর্বেশ্বরী আবার খেঁকিয়ে উঠে বললেন, ” কোথায় রেখেছিলি তোর বাচচাকে?”
এবার ভিখারিনি ঝলসে উঠল। বুক থেকে ফেলে দিল তার ছেঁড়া আঁচল । একটানে তালি দেওয়া শতছিন্ন ভেজা বক্ষবন্ধনীও ছিঁড়ে ফেলল সে। তারপর নিজের হেরে যাওয়া নগ্ন ঝোলা বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বললে , ” এইখানে রেখেছিনু আমার বাছারে, এই বুকডার মধ্যি। তুমি বুজবা কী? ছাওয়াল হারানোর ব্যাতা তুমি বুজবা না ।”

অবাক হতবিহ্বল সর্বেশ্বরী থরোথরো চোখে দেখলেন ভিখারিনির ভেঙ্গে পড়া খোলা বুক থেকে অঝোরে দুধ ঝরে পড়ছে । কান্নারত চোখের অশ্রুর মতো। খোলা বুকের মধ্যে মায়ের কান্না হয়তো অনুভব করলেন।
সর্বেশ্বরী জ্ঞান হারালেন ।…

সেদিন রাতে আর পরের দিন দুটো অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কাকতালীয় নাকি অন্য কিছু? জানার উপায় নেই।
রাতে বিছানায় দুটো জীবন ভুলভাল অঙ্ক কষল । অনেকক্ষণ ধরে । বারে বারে । গভীর আশ্লেষে । একেবারে সুরক্ষার বাইরে, চরম মুহূর্তেও । হঠাৎ করে অভ্যাসী শ্যামলদা স্ত্রীর বুকে কিছু একটা খুঁজে পেলেন, গভীরে মিশতে মিশতে অস্ফুট গোঙানি শুনতে পেলেন,”আমি মা হতে চাই।”….

পরের দিন ভিখারিনির বাচচা ঘুমন্ত ভিখারিনির ঘুম ভাঙালো। চোর চুপিসারে কখন যেন বাচচাটাকে তার আপন মায়ের পাশে রেখে গেছে সবার অজান্তে।…

গল্প টা যখন শেষ হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে শ্যামল দা আর বৌদি একসাথে ভিখারিনির কাছে বসে তার বাচচার গাল ধরে আদর করছেন।

উঁচুতলা তাঁর সমস্ত মেকি অহংকারের খোলস ভেঙ্গে নীচুতলার কাছে গভীর মমতায় জানতে চাইলেন, ” তোর বাছাকে আমায় দিবি? মানুষ করবো। আমিও তোর মতো মা হবো।”

দুই মায়ের চোখে মুখে তখন নরম রামধনুরা আকাশ বাতাসকে ভালোবাসতে শেখাচ্ছে ।।

(এটাকে নিছক গল্প মনে করার অনুরোধ রইলো। কারোর ভাবাবেগকে আঘাত করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। নারী পুরুষের যৌথ মানবিক উদ্যোগে সংসার সুখের হয়। মেকি অহংকার মাতৃত্বকে ছোটো করতে পারে না। গর্ভধারিণী মা না হয়েও মা হওয়া যায়। সকল নারীকে মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা জানাই। )

 বিপদ যখন অনুঘটক

  (  জনপ্রিয় বিপদ সিরিজের গল্প )

  (১)

খবর বাতাসে ভাসে।
আর মুখরোচক খবর হলে তো কথাই নেই । সেটাকে খাবার বানিয়ে এ কানে ও কানে ঠেসে পেট ফুলিয়ে পাড়া জুড়িয়ে তবেই সবার শান্তি । 

জয় আর শম্পাকে নিয়ে সেটাই হলো।

শম্পা ইলেভেন। জয় সেকেন্ড ইয়ার। দুজনেই এ বছর ধেড়িয়েছে। একজন বিলো টোয়েন্টি পেয়েছে, আর একজন সাপ্লি খেয়েছে। সোজা কথায় ক্লাসে ফেল করেছে।

ফেল করার খবরটা পরে। আগে ওদের প্রেম, যা হাওয়ায় উড়তে উড়তে পাঁচ টাকার মশলা মুড়ির মতো হয়েছে । মিইয়ে যাওয়ার আগেই খেয়ে ফেলেছে পাবলিক।

ফলাফল ?
ভয়ানক। একটা কেলেঙ্কারিয়াস এবং খেপচুরিয়াস ব্যাপার। দুজনের বাড়ি থেকে কারফিউ জারি হয়েছে ।

বিপদ ক্লাসে থাকলে মোবাইল চুপ সাইলেন্ট করে রাখে । পকেটে  । কেউ কল করলে থরোথরো কাঁপে ।
এখন উরুপ্রদেশে সুড়সুড়ি লাগতেই বুঝলো কেউ স্মরণ করেছে তাকে ।

‘কে? কে ? কে ডাকে আমায় ?’ ভাবলো বিপদ ।

যোগেন স্যারের ক্লাস । শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে ।
ডাঃ যোগেন দেবনাথ । লন্ডন ফেরত। একটা চোখ মানুষের, মানে ওনার নিজের,  অন্যটা পাথরের। বিপদ যে দিকেই বসে উনি দেখতে পান। ওকে বেশি স্নেহ করেন কিনা । বাঘ যেমন শিকারকে খুব ভালোবাসে, তেমনি আর কী। এক চোখের বিচার ! একটু তো টেনশন থাকবেই ।

ক্লাস শেষে মোবাইল বের করে অন করতেই ওর দেখনদারি বুকে সুকান্তর নাম ফুটে উঠলো ।  সঙ্গে সঙ্গে  কল ব্যাক।

— ” কী রে ? কী বলছিলি? ” বিপদ নিস্পৃহ ।

— ” ভাই, সব্বোনেশে কান্ড । কী হবে বল্ তো? ” সুকান্ত হড়বড় করে বলল ।

— ” কী আর হবে? তোর মাথা আর আমার মুণ্ডু হবে । স্যাটাসাট কুমড়োর ঘ্যাঁট ।” বিপদ বিরক্ত ।

—- ” তুই ইয়ার্কি মারছিস ? এই সিরিয়াস টাইমে!”

— ” তুই কী করছিস ? কী হয়েছে? কোনো আগা নেই মাথা নেই। শুরুতেই বলে দিলি সব্বোনেশে কান্ড । তা আমি কি জ্যোতিষী ? সব্বোনাশ যদি হয়েই থাকে তাইলে বসে বসে কাঁদ । আমাকে ফোন করেছিস কেন? যত্তসব রুদালির দল, পুরো আতা কেলানে । বেকুব পাবলিক ।”

ও প্রান্ত চুপচাপ আছে দেখে বিপদ বুঝলো ডোজ একটু বেশি হয়ে গেছে। মলম লাগানো কণ্ঠে কথা মুখে সে আবার
বলল,  ” চুপ না থেকে কেসটা কী বল্। আনলিমিটেড টকটাইম থাকলেও প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস আছে । মর্গের লাশ সবসময় পাওয়া যায় না।”

— ” জয় বিষ খেয়েছে। তুই শিগগিরই আয়।”

এবার একটু টাল খেলো বিপদ । যতই হোক সব জিগরি দোস্ত । একসাথে বড় হয়েছে ।

— ” জয় এখন কোথায়? কী অবস্থায়?  কেনো বিষ খেতে গেলো? কাল সন্ধ্যায় তো অতগুলো ফুচকা সাঁটালো !” বিপদ জানতে চাইলো ।

— ” আমরা জয়কে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি । তুই আয় ভাই। ” সুকান্ত ফোন কেটে দিলো।
আর কোনো কথা হলো না। মর্গের লাশ টেবিলেই চিতপাত হয়ে থাকুক । স্যার খুঁজুক । বিপদ কেটে পড়লো । বন্ধুর জীবন তার কাছে ভীষণ দামী ।
তিনতলার চুয়াত্তর নম্বর রুমে কেমিস্ট্রি ক্লাস থেকে শানুকেও ডেকে নিল । নাকের উপর হড়কে যাওয়া চশমাকে স্বস্থানে রাখতে রাখতে শানু বেরিয়ে এলো।
বিপদ বলল, ” চল্ । বেরুতে হবে ।”

শানু জানে বিনা কারনে বিপদ তাকে ক্লাস কাটতে বলবে না। নিশ্চয়ই কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয়েছে ।
দুজনে কেউ ব্যাগ নিলো না। কল্যাণ ঠিক পৌঁছে দেবে । এখন নিলে কেউ চুকলি করতে পারে ।

ক্যাম্পাসের গেট পার হবার সময় পিছু ডাক । নবনীতা ছুটতে ছুটতে এলো । পিছনে মিঠু আর সাথী ।
— ” নে ধর । জানি কোনো কেসে ফেঁসেছিস । মা তোর জন্য ফিস ফ্রাই করেছিলো। ভেবেছিলাম বসে খাওয়াবো । রাস্তায় গিলিস । কাল দেখা হবে ।”
বিপদ কিছু না বলে টিফিন বাক্সটা নিলো। ঠোঁটে মুচকি হাসি ।
মিঠু বলল, ” উঃ মার ডালা। তোর ওই পেটেন্ট হাসি দেখে ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করে মাইরি ।”

শানু হাসছিল ।

মিঠু আবার বলল, ” আজ বিপদ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে থাকছে না । তার মানে একটা মরা লাশ আজ বাঁচলো ।”

বিপদ কোনো কথার উত্তর দিলো না । তার মাথার মধ্যে তখন শুধুই জয় ।

                        । ২ ।

হাসপাতাল । এমারজেন্সি কাউন্টার । বিপদ আর সুকান্তরা ছোটাছুটি করে ক্লান্ত । জয় এখন বিপদমুক্ত ।
জয় হারপিক খেয়েছিল । হারপিক ? বাথরুমের মাল !
কারন ? কারন শম্পা । বিরহী হৃদয় চাপ নিতে পারেনি । তাই । তাবলে হারপিক ! বাথরুমের মাল প্রেমিকের গালে ! ছ্যাঃ, ওয়াক থুঃ ।

দুর্বল সুকান্তকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলো বিপদ । পরের দিন আসবে কথা দিলো । আরো একটা কথা দিলো । জয়ের সমস্যার সমাধান সে করবেই ।

রাস্তায় শানু প্রথম কথা বললো , ” আর কিছু হবে না। তাই না বিপদ ?”

— ” না । ” বিপদের কথা শুনে শানু হাসলো ।

রহিম বললে , ” তুই শিওর ?”

— ” একদম ।”

— ” কীভাবে? “

— ” প্রথম কথা, বিষ খাওয়া রোগী হিসেবে ওকে যে হারে পটাশ জল গেলালো । তারপর উপুড় করে চুলের মুঠি ধরে পিঠে লাথি কিল মেরে যেভাবে বমি করালো তাতে ওর বিষ খাওয়ার বাই মিটে গেছে । আমি বলেই দিয়েছিলাম বেশি করে কেলাতে ।” বিপদ হাসতে হাসতে বলল ।

শানুরাও হাসতে শুরু করলো। বিপদ আবার বলল, ” তার উপর আমি ওর সমস্যার সমাধান করবো বলেছি । সেই বিশ্বাসে খাবে না ।”

— ” তুই পারবি তো ? “

—- ” দেখা যাক ।”

                        ।  ৩  ।

শম্পাদের বাড়ি । বিপদ হাজির । শম্পার মা খুব খুশি বিপদকে দেখে । শম্পার বাবা দাড়ি শেভ করছিলেন । কিছু বললেন না । শম্পা বিপদকে দেখে উসখুস করতে লাগলো ।
— ” কী ব্যাপার বিপদ দা?  কেমন আছো?” শম্পা বলল ।

— ” ভালো আছি ।”

— “বাড়ির খবর সব ভালো বিপু? আয় বস্ ।” কাকীমা জিগ্যেস করলেন ।

— ” তা ভালো । আমার মনটা আবার তেমন ভালো নেই ।”

— ” কেনোরে ? তোর মনে আবার কী সমস্যা হলো?”

— ” আর বলো না। ভোরের বেলা এমন একটা স্বপ্ন দেখলাম যে মনটা খারাপ হয়ে গেল ।” বিপদ নিরীহ মুখে বলল ।

— ” কী স্বপ্ন রে ?”

— ” দেখলাম, তুমি ক্ষিরের পাটি সাপটা তৈরি করে আমাকে খাওয়াতে চাইছো। আমি খাচ্ছি না বলে তোমার সে কী দুঃখ । তোমার দুঃখ দেখে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেলো ।”

— ” অ। এই ব্যাপার । ওগো শুনছো।” শেষ কথাটা শম্পার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন কাকীমা।

—- ” শুনেছি । ব্যাগটা দাও। দোকান থেকে খোয়া ক্ষীর কিনে আনি। তুমি এদিকটা সামলাও । বিপদের দৌলতে তবু আজ পাটিসাপটা খাওয়া যাবে ।” হাসতে হাসতে কাকু চলে গেলেন খোয়া ক্ষীর আনতে ।

— ” তুই শম্পার ঘরে গিয়ে বস বাপ । আমি ততক্ষণে তোর স্বপ্ন তৈরি করি ।” কাকীমা বললেন ।

শম্পা বললে , ” তুমি পারো বটে ।”

ঘন্টা দেড়েক পর ।  প্রথম পাটিসাপটাটা বিপদ চোখ বুজিয়ে খেলো ।
কাকীমা বললেন,  ” কেমন খেতে লাগছে বল দেখি ?”

—- ” ফ্যান্টাফ্যাবুলাস । তোমার হাতে জাদু আছে কাকীমা ।” বিপদ খেতে খেতে বলল।
— ” আর আমার কোনো ক্রেডিট নেই বুঝি? এতো ছোটাছুটি করে ক্ষীর আনলাম । আর সব প্রশংসা তোর কাকীমা পাবে ? কী দিনকাল পড়েছে রে বাবা।”

বিপদ এবার সিরিয়াস । ছ পিস পাটিসাপটা সাঁটার পর । চোখ গোল গোল করে বলল, ” শোনো কাকীমা, পেট ভরে গেছে । এবার কিছু জরুরী কথা বলবো। এর রিএকশন কী হবে জানিনা । সব শোনার পর যদি রাগ হয় তবে চেপে রাখবে না। দমাদম আমার পিঠে ঝাড়বে । এমনিতেই পেটে খেলে পিঠে সয় ।”

কাকীমা হেসে ফেললেন । তিনি জানেন বিপদের স্বভাব । ভয় পান । ভালোও বাসেন ।
—- ” কী বলবি বল্। ” কাকীমার মুখে মৃদু হাসি ।

কাকু পর্যন্ত কৌতুহলী । বিপদ ধীর স্থিরভাবে বলতে লাগলো , ” লোকের কথায় চললে লোক পেয়ে বসবে । একদিন রান্না না করলেও লোকে তোমাদের হাঁড়ির দিকে তাকাবে না, অথচ হাঁড়ির খবর নেবার জন্য উথালি পাথালি খাবে । শম্পাকে আজ হোক কাল হোক বিয়ে দেবে, হয়তো ভালো ছেলে দেখেই দেবে । কিন্তু সে যে ভালো হবেই তার হান্ড্রেট পারসেন্ট গ্যারান্টি নেই । মেয়ের সুখ আর তোমাদের মনের সুখ দুটো সবসময়ই এক হবে তার ঠিক নেই । কিন্তু মেয়েকে যদি সত্যি সত্যি ভালোবাসো তবে সে কী চাইছে তা বুঝতে হবে বৈকি । যাকে চেনো না, জানো না, কিছু লোকের কথায় বিশ্বাস করে তাকে জামাই করবে । অথচ যাকে ছোটো থেকেই দেখে আসছো তাকে বিশ্বাস করতে এতো ইগো হার্ট হচ্ছে কেনো? জয় যদি যোগ্য না হয় তাকে যোগ্য হবার সুযোগ দাও, তাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দাও । কিন্তু বাতিল করো না । সেও তো কারো না কারোর সন্তান । তার মনে আঘাত দিয়ে কাউকে সন্তান হারা করো না । এ আমার অনুরোধ । শুধু লোকের কথায় কাউকে খারাপ হবার রাস্তা দেখিও না । “

সবাই চুপ । আবহাওয়া থমথমে । বিপদ নিঃশব্দে কখন উঠে এসেছে তা কেউ টের পায়নি ।
এখানে আসার আগে জয়দের বাড়ি ঘুরে এসেছিল । জয়ের বাবা মা সদ্য ভীতি প্রাপ্ত । ভয় পাওয়া মানুষকে বোঝানো সহজ হয় । তাদের রাজী করিয়ে তবেই শম্পাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল সে ।

পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত । দুটো পরিবার আলাপ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিলো যে আগামী দেড় বছর পর চার হাত এক হবে ।
দুটো পরিবারই বিপদকে দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করলো ।

আড্ডা খানায় জয় বিপদকে জড়িয়ে ধরে বলল, ” তোকে কী বলবো বুইতে পারছি না।”
বিপদ গম্ভীর গলায় বলল, ” বেশি বুঝে লাভ নেই । হারপিক খাবি না। ওর চেয়ে বেটার অপশন আছে । বাথরুমের পোকা মরার বদলে তোর পোকা মরুক তা আমি চাই না। শুধু তোর জন্য সেদিন মরা লাশ আর ফিস ফ্রাই ঠিকঠাক এনজয় করতে পারিনি ।”

সবাই হেসে উঠলো । জয় ইষৎ লজ্জা পেলেও সেই হাসিতে যোগ দিলো ।

গল্প — বিপদ যখন অনুঘটক
লেখায় — বাবু_রাজা(ভবঘুরে)


ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে বিপদ সিরিজের গল্প গুলি জনপ্রিয় এবং সমাদৃত। মূলত হাস্যরসে ভরপুর গল্পটি তেমনই একটি।
                                                    —– বিপদ জনক ভবঘুরে

কান্নার ধর্ম 

 কান্নার কি কোনো ধর্ম আছে? সম্প্রদায় কিংবা লিঙ্গ ভেদ? কি জানি!

          রাস্তার লাইট পোস্টের নীচে শুয়ে থাকাএকচোখ কানা কুকুরটাকে আমি কাঁদতে দেখেছি। খুব কাছ থেকেই। উবু হয়ে বসে বিস্কুট দেওয়ার পরও যখন না খেয়ে কাঁদে তখন সেই অশ্রু দেখেছি আমি। ঠিক আমারই মতো।      আমার দু চোখের জল আর ওর এক চোখের জল দেখতে একদমই একরকম! কোনো ফারাক নেই। কষ্ট আলাদা। দুঃখ আলাদা। অনুভূতি আলাদা। পদ্ধতি আলাদা। কিন্তু বহিঃপ্রকাশে! মিল আছে আমাদের।

   আমি কুকুরটাকে মনে মনে ভাই ভাবি। তুতো ভাই। চোখের জলের তুতো ভাই।

   এলাকায় আমি নতুন। ব্যবসা বাণিজ্য করার অভিপ্রায়ে দোকান খুলেছি মাস পাঁচেক হলো। স্থানীয় ক্লাবের দাদাগিরি, বাজার কমিটির জুলুম বাজী, পাশের দোকানীদের প্রতিযোগী কপাল কোঁচকানো নিয়ে আধা বদহজমী অনিচ্ছার মলত্যাগী মনোভাবী বেগ চেপে শুরু করেছিলাম শ্রীমতি লক্ষীদেবীর আরাধোনা।
  কপাল দোষ হোক আর নিজের দোষ হোক, আপনজন তো আর জুটলো না। জুটলো একটা কানা ভাই, কালু কুকুর।
   অনলাইনে কাজ করি। বিল জমা, রিচার্জ, সার্চিং, স্টেটাস চেকিং। খদ্দের এলে তার সামনে দন্ত বিকশিত করি। পেট ব্যথা হলেও। ওই যে, খদ্দের লক্ষী, দোকানদার পেঁচা! তাই।

   মাথা নীচু করে কাজ করছিলাম। প্যান কার্ডে আধার লিঙ্ক হচ্ছে। মানে আমি করছি। কে যেন বললে, ” আমার কার্ডটা দেখে দাও না।”
— ” লাইনে দাঁড়ান। ” আমি নীচু মুখেই হেঁড়ে গলায় বললাম।
চুপচাপ। সবাই কাজ শেষ করে চলে গেলো। আমি মুখ তুললাম। পকেটে পয়সা এলে দিল্ বেশ খুশ হয়। আজ দু পয়সা কামাই হয়েছে।
তখনই দেখলাম বৃদ্ধকে। ময়লা ফতুয়া টাইপের কাপড়। হাতে কী যেনো ধরা।
— ” বলুন।”
— ” আমার এই কার্ডটা দেখো না বাবা।”
হাত বাড়িয়ে নিলাম। দেখলাম। এতো ভোটার কার্ড! লালচে সাদা। কিন্তু অরিজিনাল।
— ” কী দেখবো বুড়োবাবা? “
— ” তোমার মেশিনে নাম টা আছে কিনা। ওরা নাকি কেটে দেছে!”
— ” কারা কেটে দেবে?” অবাক আমি।
— ” ওই যে ওরা।”
বুঝলাম পার্টির নেতাদের কথা বলছেন বৃদ্ধ। কার্ডটা নিলাম। কী মনে করে ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। অনলাইনে সাধারণত এপিক নম্বর দেখে ছেড়ে দিই। ঠিকই আছে।
বললাম, ” আছে। নম্বর আছে।”
বৃদ্ধ খুব খুশি হলেন। তারপর কার্ডটা বুকের কাপড়ে মুছতে মুছতে চলে গেলেন। টাকা না দিয়েই। বৃদ্ধর চোখ মুখে ফুটে ওঠা খুশিটাকে ভাঙবোনা বলে পিছু ডাকলাম না। মনে হলো, দশ টাকায় একটু খুশি দেখলাম।
তারপর কাজে অকাজে ব্যাপারটা ভুলে গেলাম।

আবার একদিন। নীচু হয়ে কাজ করতে করতে একটা ভোটার কার্ড এগিয়ে এলো। আবার সার্চিংএর অনুরোধ। মুখ তুলে দেখি সেই বৃদ্ধ। কী মনে করে আবার দেখলাম। আবার একই ঘটনা। কিছু না বলে, কিছু না দিয়ে চোখে মুখে খুশি নিয়ে চলে গেলেন। আমাকে নিরুত্তর রেখেই।
সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার একই ঘটনা ঘটতে আমি বিরক্ত হলাম। তবুও দেখলাম। আবারও নো পেমেন্ট। অনলি খুশি। বৃদ্ধ চলে যেতেই কে যেনো বলল যে বৃদ্ধটি নাকি পাগল। এলাকার না। তবে অনেকে নাকি ভিক্ষে করতে দেখেছে। আমি হোঁচট খেলাম। পাগল! তাই! পাগলের কাছে ভোটার কার্ড!  পাগলে কি ভোট দেয়! নাকি, পাগলেই শুধু ভোট দেয়? আমার কিন্তু বৃদ্ধকে পাগল বলে মনে হলো না। ভিখারি হলেও হতে পারে। তাহলে টাকা না নিয়ে ভালো করেছি। যদিও ভিক্ষে করতে আমি দেখিনি।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। আমি প্রায় ভুলে গেছি।

   আজ শুক্রবার। একদমই বেচাকেনা নেই। পূজো, ভাইফোঁটা কেটে গেছে। তবুও অফ সিজন চলছে। সকাল থেকে মনটাও খারাপ। পকেটে টাকা পয়সা নেই। ক্যাশ বাক্সে খুচরো পয়সা। কদিন ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না। দু মাস বাড়ি ভাড়া বাকি ছিলো। গত পরশু বাড়ি মালিক বিশ্রী কটু কথা বলতেই দুম করে মাথা গরম হয়ে গেলো। সব তন্নতন্ন করে তল্লাশি করে সব একত্র করে ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছি। চাল যা ছিলো কাল পর্যন্ত চলেছে। আজ হাঁড়ি বনধ্। সকাল থেকে এক কাপ চাও জোটেনি। একটা কাস্টমার পর্যন্ত আসেনি এখনও। সত্যি সত্যি আজ আমি পেঁচা। হুতোম পেঁচা। নকশা বোনার জোগাড়।
মন ভালো থাকলে গানটা গাইতাম, ” হতাম যদি হুতোম পেঁচা, তোমায় খুবলে দেখাতাম।”
দুপুর দুটো বাজে। দোকান বন্ধের সময় অতিক্রান্ত হয়েছে এক ঘন্টা আগে। ঘরে গিয়ে কী হবে? চাল নেই যে রাঁধবো। সিস্টেমে ক্যাশ আছে, ট্রান্সফার করতে পারবো, তুলতে পারবো না। এ টিম কার্ড ব্লক হয়ে গেছে জানতে পেরেছি সকালে। অগত্যা খানিক নেট সার্ফিং, ফেসবুকে ঘোরাঘুরি। কিন্তু ভালো লাগছে না। পেটে খিদে থাকলে সানি লিওনেও অরুচি আসে। খিদের লাথি যে খেয়েছে সে বুঝেছে এর কী জ্বালা।
দোকান বন্ধ করবো মনে করে কম্পিউটার সাট ডাউন করতে যাচ্ছি এমন সময় দেখলাম সেই বৃদ্ধকে। হাতে কী যেন আছে। এবার আমি খুব রেগে গেলাম। আজ সত্যি সত্যি বৃদ্ধকে পাগল মনে হচ্ছে। না হলে এভাবে আমাকে বিরক্ত করে? মনের মধ্যে জমা হওয়া বিন্দু বিন্দু রাগ গুলো সিন্ধুসম আগুন হয়ে ফেটে পড়তে চাইলো।
— ” আবার আপনি এসেছেন? মজা করছেন ?”
আমার গনগনে চোখে রাগের চিহ্ন দেখে টিউবলাইটে লোডশেডিং হলো। ম্লান হয়ে গেলো। সেই অবস্থায় করুন স্বরে আর বললেন, ” দেখো না বাবা। আর একবার।”

—“আপনি জানেন না, এখানে ওসব দেখতে গেলে টাকা লাগে!” সব ভদ্রতা ভুলে বললাম।

— ” কতো দিতি হবে বাবা?”

— ” দশ টাকা। আট দিলেও হবে।” ক্যাশ ডিব্বার দিকে চেয়ে খুচরো পয়সা দেখতে দেখতে আর পাঁউরুটি ঘুগনির চিন্তা করতে করতে বললাম।
— ” দোবো বাবা। এট্টু বেশিই দেবো। দেখো না।”
এবার আর কিছু বলার থাকে না। খিদে আমাকে অমাননবিক করে তুললেও পুরোটা কাবু করতে পারেনি।
আবার ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে ঢুকলাম। দেখলাম। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নিরাপদ রায়। নিরাপদেই আছে।
বললাম,  ” এই তো রয়েছে। কেনো বার বার দেখেন বুঝিনা!”

কার্ড ফেরত দিলাম। বৃদ্ধ সেদিকে তাকালেন না। তিনি মুঠো খুললেন। বুঝলাম টাকা দিচ্ছেন।
আমিও হাত বাড়ালাম। কাঁপা কাঁপা হাতে বৃদ্ধ টাকা সহ হাতের মুঠি খুলতেই আমার টেবিলে ঝর ঝর করে টাকা কটা পড়লো। সব কয়েন। টাকা কটা গুনে দেখতেই দেখি একটাকা আর দুটাকা মিলিয়ে মোট বারো টাকা।
—- ” এর বেশি আর নেই গো বাবা। সকাল থেকে এই কটাই ভিক্ষে করে পাইছি। তুমি নাও।”

কে যেনো আমার গালে সপাটে চড় মারলো। ভিক্ষে? ভিক্ষে করে এই বৃদ্ধ আমার টাকা দিতে এসেছেন! হা ঈশ্বর! আমি একজন অসহায় বৃদ্ধের ভিক্ষের টাকা নিয়ে নিচ্ছি। ছি: ছি:।

শিক্ষা পেতে আরো বাকি ছিলো। আজ জীবনের ব্যাটিং পিচে ঈশ্বর বোধকরি আমাকেই বল পেয়ে বেধড়ক পেটানোর ধান্দা নিয়েছেন।
বৃদ্ধ আমার দিকে চেয়ে ম্লান মুখে বলে চললেন, ” তোমার মতো আমার একটা ছাওয়াল ছিলো বাপ। মা মরা বাছাটারে জম্পেস খাটি মানুষ করেছিনু। খুব ভালো ছিনু। গেলো বছর রাস্তা পার হবার সময় গাড়ি চাপা পড়লো। আমি হারালুম তারে। কতো খুঁজি আকাশে বাতাসে। পাইনা ব্যাডারে। শেষে ভোটার বাবুদের কাগজে পাইলুম। একজন বললে ভোট না দিলি ওরা নাম কাইটে দেয়। তোমার মেশিনির মধ্যি নাকি দেখা যায়। তাই আসি ছেলেটারে দেখতি। কোথাও তো পাইনা, শুধু একেনে পাই। আমার নিরাপদ তোমার মেশিনে বেঁচে আছে যে।” বৃদ্ধ থামলেন। হাঁফিয়ে গেছেন।

আমি স্তব্ধ!  মাথাটা হালকা ঘুরছে। কী বলবো আমি? কী বলার আছে আমার!
আমাকে কিছু বলতে হলো না। বৃদ্ধ আবার বলতে লাগলেন, “আজ নিরাপদর জন্ম দিন। কাল রাইতে ভিক্ষে করে আটা দিয়ে রুটি আর সুজির পায়েস করেছিনু। তোমার জন্যি আনিছি। তুমি খেলেই আমার বাছার খাওয়া হবে। তোমার কাছে এলেই তাকে দেখা যায়। এই নে বাপ।”
কথা কটা বলে বৃদ্ধ তাঁর নোংরা ফতুয়ার ডান পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের বাটি বের করলেন। আর বাম পকেট থেকে বেরুলো একটা পলিথিনের ক্যারি প্যাকেট। দেখলাম। বাধ্য হয়েই।

আটটা রুটি। ভাগ করলাম। তিন ভাগ। চারটে, তিনটে আর একটা এই অনুপাতে। বৃদ্ধকে দিলাম চারটে, আমি তিনটে আর এতোক্ষণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতে থাকা অবুঝ আমার এক চোখা কালু ভাই।
পরম মমতায় বৃদ্ধকে বসালাম আমার চেয়ারে। তারপর তিন বাপ বেটায় খুব তৃপ্তি সহকারে জন্মদিনের খাওয়া খেলাম। মনে হলো এক অসহায় বাবা তার ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন। নাহ্, ঈশ্বরও বোধহয় মাঝেমধ্যে হিট উইকেট হ’ন । ইচ্ছে করেই।

খেতে খেতে বৃদ্ধ আর কালুর দিকে তাকালাম। তিন চোখেই জল! আমারও। মনে হলো, কান্নার কোনো ধর্ম নেই।

গল্প : কান্নার ধর্ম
লেখায় : ভবঘুরে
(বাবু রাজা — ফেসবুক লেখক)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *