বুক রিভিউ

সাতজন কবির কবিতায় মানবসভ্যতার পরিচয়

তৈমুর খান

আমেরিকান দার্শনিক রাল্ফ ওয়াল্ডো এমারসন
বলেছেন:The end of the human race will be that it will eventually die of civilization.
(—Ralph Waldo Emerson, 1803-1884)
অর্থাৎ মানবজাতি শেষ হবে এবং তারা শেষপর্যন্ত সভ্যতায় মারা যাবে। একটি কবিতা সংকলন পাঠ করতে গিয়ে এই কথাটি মনে পড়ল। ভোগবাদী সভ্যতার স্বার্থপর লেলিহান দৃশ্য মানুষকে মানব হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ করছে। মানুষের সীমাহীন লোভ কূটকৌশলী এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম শেষপর্যন্ত এই সভ্যতাকে ধ্বংস করবে বলে মনে করেন কবিরাও। ৭ জন কবি মিলে ১৪-১৫ টি করে কবিতায় ‘সাতটি আলোর ছায়া'(২০২০) কবিতা সংকলন প্রকাশ করেছেন। সংকলনটি সম্পাদনা করেছেন এম এ ওহাব। মুর্শিদাবাদের ডোমকল থেকে প্রকাশিত এ রকম একটি সংকলন কিছুদিন আগেও ভাবা যেত না। কিন্তু বর্তমানে সাহিত্য যে আর কলকাতাকেন্দ্রিক নয় তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন বয়সের সব কবিরাই মুর্শিদাবাদের অধিবাসী। বিশেষ করে ডোমকল ও বহরমপুরে তাঁরা থাকেন। সমসাময়িক রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন এবং অবক্ষয়ী মূল্যবোধহীন সময়ের কণ্ঠস্বরই তাঁদের কবিতায় শোনা যায়। যদিও কবিতাগুলি শিল্পসিদ্ধি অথবা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো অংশেই তাৎপর্যবাহী নয়। কবিদের নিজস্বতাও কোথাও ফুটে ওঠেনি। শুধুমাত্র মানবিক আবেদনেই তাঁদের ভাবনার পরিপূর্তি বলা যায়।
এবাদুল হক লিখেছেন ‘জল ও মৃত্যুর গল্প’। জল যেমন জীবন, তেমনি মৃত্যুর মধ্যেও তার রিরংসা রূপ প্রতিফলিত হয়। তাই কবি বলেছেন: “জল, যেদিন তুমি মরবে, আর তার কতদিন পরে মৃত্যু হবে আমাদের? মানুষের।” জলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এই কথার মধ্য দিয়েই জেগে উঠেছে। অবক্ষয়ী এক চতুর সময়ে আমাদের মুল্যবোধহারা বিবেককে জাগ্রত করতে চেয়েছেন তিনি। তাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন:
“বাংলার হাওয়ায় বারুদগন্ধ ফুলেল বাতাস কই?”
হানাহানির চরম বিপর্যয় মানবহন্তারক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আজ চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে সভ্যতাকে। কবি কখনো কখনো নিজের বিপন্ন জীবন ও একাকিত্বকে কবিতা করে তুলেছেন। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি:
“আমি কেবল বেঁচে আছি
তোমার জন্যই বন্ধু,
কেবল তোমার সুরভিত সুবাসে।”
কবি কতখানি অসহায় তো বোঝা যায় কবিতা নিয়ে বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে।
এস হজরত আলি লিখেছেন ‘দৃশ্যটির জন্য তাকিয়ে আছি’। কোন্ দৃশ্যের প্রতি কবির আকর্ষণ? সেই দৃশ্য যা বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রেমময় দৃশ্য। যে দৃশ্যের মধ্যে শুধু মিলন আছে, বিভেদ বা বিচ্যুতি নেই। শুধু গ্রহন আছে, ঘৃণা বা বর্জন নেই। কবি বলেছেন: “যেখানে চড়ুইভাতি উৎসবে মেতে আছে একটি নতুন বিশ্ব পরিবার…”
দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের মহাসংকটময়তাকে তিনি সারা জীবন অনুধাবন করেছেন। সেই উত্তাপকেই কবিতায় ধারণ করেছেন:
“অভাবের বাঘ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়—
এ কোথায় নিয়ে এলে আমায়?”
তবুও কবি মাঝে মাঝে দার্শনিক হয়ে উঠেছেন, বুঝেছেন:
“এ জগতে একমাত্র মানুষকেই আজীবন
মানুষ হওয়ার সাধনা করে যেতে হয়।”
কবি আশা করেছেন সভ্যতার বর্বরতাকে জয় করে এই পৃথিবী একদিন মানুষের পৃথিবী হয়ে উঠবে।
মাজরুল ইসলাম লিখেছেন ‘দীপ্তিশূন্য উত্তরীয়’। কবি মানবিক সম্পর্কের পবিত্রতাকে খুঁজে পাননি। কবির মনে হয়েছে: “শুভ্রতার রং এতটাই দীপ্তিশূন্য যে, তা যে কাউকে ভাবিয়ে তোলে!” এই ভাবনা থেকেই জীবনের পরিধি রচনা। ইতিহাস আর জীবনের নিরীক্ষায় তাঁর কবিতার এক সমাপতন লক্ষ করা যায়। অন্যায় অবিচারের প্রচ্ছন্ন ধারাবাহিকতাকে তিনি সভ্যতায় কখনো অন্যথা হতে দেখেন না:
“মীরজাফর কিংবা লর্ড ক্লাইভ, কেউ-ই নেই
তবুও সর্বত্র লাশের মিছিল”
‘ধ্বংসের সাতকাহন’ এভাবেই যুগে যুগে পরিবাহিত হয়ে আসছে। অমানবিক কার্যক্রমের এই পর্যাপ্ত রৌরবকে তিনি কবিতা করে তুলেছেন। ঢাকার গুলশান হত্যা, মায়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা হত্যা, ইরাককে ধ্বংসের পরিকল্পনা সবই তাঁর কবিতার বিষয়। আবার কারবালা ও এজিদের রণডঙ্কাকেও সভ্যতার ধ্বংসকামী শক্তি হিসেবে দেখেছেন।
শুকদেব পাল লিখেছেন ‘তুমি নেই তাই’। ব্যক্তিজীবনের নিঃসঙ্গতা থেকে উদযাপিত সময়ের হাহাকারকে উল্লেখ করেছেন কবিতায়: “অদ্ভুত এক ধোঁয়াশায় আছি এখন”। এই ধোঁয়াশা প্রিয়জনের না থাকার শূন্যতা থেকেই। ভোগবাদী সমাজের হাতছানি কবি গ্রহণ করেননি। কবি দেখেছেন:
“সভ্যতার অভিমুখ অন্ধকারের দিকে”
এই অন্ধকার আমাদের অস্তিত্বকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। মানবতার মৃত্যু ঘটাচ্ছে। বিষাদ ও সংশয়পীড়িত জীবনকে তিনি সতর্ক করে বলেছেন:
“পথ চিনে যেতে হয়
পথ নিয়ে পথে
পথে কত বিপদ
শ্বাপদসংকুল
খাদ আছে, ঢিবি আছে
কাঁটা আর মুখোশ
তার মাঝেই যেতে হয়
বর্ণাবৃত সই।”

   এম এ ওহাব লিখেছেন 'মেঘ-রোদ্দুর ও দৃষ্টিহীন বৃক্ষের থিয়েটার'। নিসর্গ ভাষার পরিপ্লুত আবেগ থেকে এক স্বয়ংক্রিয় বোধকে তিনি জাগ্রত করতে চেয়েছেন। লিখেছেন: "মেঘের পায়ে হেঁটে যাচ্ছে বোধ/ প্রতিটি বিকেলের অথবা নিরক্ষীয় বৃষ্টিগুলো/ প্রতিনিয়ত জন্ম দিচ্ছে অবিকল বোধিবৃক্ষের…" এক শূন্যতা থেকে কাল্পনিক অভিযাপনের মেটাফোরিক প্রশ্রয় কিছুটা হলেও আলাদা। আত্মগত সীমানার নিভৃতি থেকে মেটাফোর চিত্রলিপির প্রয়োগ অন্যত্রও দেখতে পাই:

“উড়ে যাচ্ছে একটা বিষণ্ণ বিকেল
উড়ে যাচ্ছে বিকেলের মনখারাপ
উড়ে যাচ্ছে মনখারাপের একটা শহর!”
কিন্তু কবিতার পরবর্তী অংশে অরণ্যবাসীর বিবৃতিতে হারিয়ে গেছে কবির বোধ। সেইসঙ্গে কবিতাও হারিয়ে গেছে। ব্যাঙের মৃত্যুদণ্ড, বাঘকে ফাঁসি দেওয়া, হরিণের গালে অনধিকার চুমু খাওয়া এবং চন্দনবৃক্ষের অর্থনীতি কবিতার ক্ষেত্রে অসমর্থিত বিষয়। কবিতা কি এভাবেই তার সদ্গতি খোঁজে? আরেকটি কবিতায় হিমযুগের যুবতী মেয়েকে আমরা খুঁজে পাই ঠিকই, কিন্তু তখন আর পাঁচশো রঙিন ঘুড়ির প্রয়োজন থাকে না। বরং শালুকের পাতায় দু ফোঁটা জল দেখে ছেঁড়া বৃন্তের আয়ুষ্কালকে মনে পড়ালেও তা কবিতা হয়ে ওঠে।
দিলরুবা খাতুন লিখেছেন ‘ছায়াময় সবুজ দিন’। সবুজ দিনের আলো আঁধারে যৌবনের শরীরী রসদ তাঁর কবিতার মাদকতায় মিশে গেছে। সুর তুলেছে দোতারার ঢঙে ছিন্নবীণায়। খুব প্রাথমিক পর্যায়ের কবিতা। যন্ত্রণা আর অভিমানকে, বিরহ আর অস্থিরতাকে কবিতার পংক্তিতে সাজিয়েছেন। তার ইচ্ছেফড়িং স্মৃতিকাতর জ্যোৎস্নায় কল্পনার উড়ান চেয়েছে। কবি লিখেছেন:
“আলো খুঁজি নিকষকালো ঠিকানায়
স্বপ্ন উড়ায় গোপন ছাদে ইচ্ছেফড়িং…”
এই ইচ্ছেফড়িংকেই প্রেমের পরাগে জড়াতে চেয়েছেন কবি। আকাশ দেখাতে চেয়েছেন:
“এভাবেই তোমার মন আকাশে,
উড়িয়ে দিয়েছি…..
ভালোবাসার নিশান।”
চিত্রা দত্ত লিখেছেন ‘বুকপকেটের ভাঁজে’। কবি যেন বুকপকেটের ভাঁজে তার স্মৃতির গোলাপ খুঁজেছেন। যে গোলাপ আজীবন কবিকে ঘ্রাণ বিলি করে চলেছে। জীবনের গতিপথে পাড়ি দিতে দিতে অতীত প্রেমকে কখনোই কবি ভুলতে পারেননি। তাই নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে নিজের একাত্মতা যেমন উপলব্ধি করেছেন, তেমনি অপেক্ষা করেছেন ‘নতুন ভোরের’। হৃদয়ের সংরাগে তার অপেক্ষা দুপুর ভালো লাগে। অম্লান হয়ে ওঠে সেই টান:
“তোর জন্য খুঁজছি নতুন কোনো ভোর,
যদি ফিরে আসিস খুঁজবো পথের মোড়।”
একমুঠো সোনারোদে স্মৃতির উত্তাপ মিশে আছে। প্রেমের স্রোতধারায় উজানী স্রোতের ভালোবাসাকে এখনো কবি উপলব্ধি করেন:
“তুই আমার উজানী স্রোতের
তপ্ত ভাটিয়ালি গান। বুকের মাঝে
প্রেমিক পুরুষ
থাকবিও চিরকাল।”
এই ‘তুই’ সম্বোধনটাই প্রেমকে আরও গভীর ব্যঞ্জনাবহ করে তোলে। সবুজ বাতায়নে এখনো সেই মুখ খুঁজে ফিরি আমরাও।

সাতজন কবিকে নিয়ে ‘সাতটি আলোর ছায়া’ তেমন ভিন্নধারার না হলেও গ্রামবাংলার কবিদের পাঠকের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই কাজটি করে এম এ ওহাব আমাদের কাছে ধন্যবাদার্হ।

সাতটি আলোর ছায়া: সম্পাদনা এম এ ওহাব, স্রোত পাবলিকেশন, মূল্য 200 টাকা। প্রচ্ছদ অয়ন চৌধুরী।

তৈমুর খান

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *