যে প্রেম কালের সীমানা পেরিয়ে মহাকালে
তৈমুর খান
জীবন মন্থনের ভাষাই হলো প্রেম, যে প্রেম জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে কোনো পার্থক্য আনে না। এই বোধ যখন মানুষের মধ্যে জন্মায় তখনই তিনি প্রেমিক হয়ে ওঠেন। আর তখনই তিনি উর্দু কবি মির্জা গালিব খানকে স্পর্শ করতে পারেন। কেননা মির্জা গালিব লিখেছেন:
“Love knows no difference between life and death
The one who gives you a reason to live is also the one who takes your breath away”
অর্থাৎ প্রেম জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে কোনো পার্থক্য জানে না। যিনি আপনার বেঁচে থাকার কারণ, তিনি হলেন তিনিই।যিনি আপনার শ্বাসকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যান। সুতরাং বাঁচা ও মরার মধ্যেই প্রেমের অবস্থান বিরাজ করে। এই প্রেমকেই ঘনীভূত জীবনরসায়নের বার্তা করে তুলেছেন ২১ জন কবি। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতার পর্যবেক্ষণকে সুসম্পাদনায় গ্রন্থিত করেছেন শুভঙ্কর দাস ও শুভ্রাশ্রী মাইতি। সংকলনটির নাম দিয়েছেন “গালিব ছুঁয়ে বলছি”(প্রথম প্রকাশ ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।
প্রেম যে কবিতার একটি মূল উপাদান মির্জা গালিব তাঁর শায়েরীগুলিতে তা বারবার উচ্চারণ করেছেন। বাংলা ভাষার বিভিন্ন বয়সের ২১ জন কবি ১৫ টি করে শায়েরী রচনা করেছেন। প্রতিটি শায়েরী এক চুম্বকীয় অভিনবত্বে ধারণ করেছে জীবনের সেই শ্বাসবায়ুকেই, যার মধ্য দিয়ে প্রেম, বিষাদ, বিরহ ও মৃত্যুর ক্ষরণ ঘটে চলেছে। কবিদের তালিকায় আছেন: শ্যামলকান্তি দাশ, তপনকুমার মাইতি, ভবেশ বসু, বিকাশ চন্দ, প্রাণনাথ শেঠ, আবু রাইহান, মঞ্জীর বাগ, অমৃতা খেটো, অর্থিতা মণ্ডল, বিমল মণ্ডল, অঙ্কন মাইতি, জয়দেব মাইতি, সন্দীপ সাহু, নিমাই জানা, শ্রাবণী বসু, বিথীকা পড়ুয়া মহাপাত্র, কেশবচন্দ্র দাস, মোনালিসা পাহাড়ী, ভগীরথ সর্দার, শুভ্রাশ্রী মাইতি এবং শুভঙ্কর দাস। সংকলনের প্রথম কবি শ্যামলকান্তি দাশ লিখেছেন:
“আপনাকে বুকে নিয়ে আদর করেছি।
আপনাকে মুখে নিয়ে আদর করেছি।
আদরের শেষ কথা কেন-বা আগের থেকে
মুখ ফুটে বলে ফেলতে হবে!”(আদর)
আদরের কথা মুখ ফুটে বলা যায় না, আদরের প্রকাশ আদরেই ঘটে। যেখানে ক্রিয়া সজাগ, সেখানে কথা গৌণ। যেখানে উপলব্ধি তার ক্ষেত্র রচনা করে, সেখানে প্রকাশ তার ভাষা হারায়। অভিজ্ঞ কবি প্রেমের এই রসায়নকে সেভাবেই বললেন। সংকলনের শেষ কবি শুভঙ্কর দাস লিখেছেন:
“কে যে দৃশ্য বানায়
সে জানে না, অথচ সে দৃশ্য কুড়ায় রোজ
কে তুমি অদৃশ্যা?
তাকে দিলে গোপনে বুকের নিভৃত-সরোজ।”(সরোজ)
প্রেম তখনই মহীয়ান হয়ে ওঠে যখন অদৃশ্য থেকেও বুকের সরোজে পূজা গ্রহণ করে। এই প্রেম প্রতিটি হৃদয়ই বহন করে। অদৃশ্য হয়েও দৃশ্য রচনা করে। যাপিত জীবনের বার্তায় উপলব্ধির গভীর স্পন্দন চলতে থাকে। এভাবেই শেষ শ্বাসবায়ু গ্রহণ করে। জীবনকে মৃত্যুর সঙ্গে একসূত্রে বেঁধে দেয়।
প্রতিটি কবিতায় এক মগ্ন প্রেমিক প্রেমিকার জাগরণ টের পাই। মরমী ভাষা এবং নিবেদিত আত্মধ্বনির স্বয়ংক্রিয় প্রকাশ ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রেমের যে বয়স বাড়ে না, বিরহে যে অন্তরাল আসে না, মৃত্যু যে জীবনের সীমানা টেনে দেয় না—প্রেম তা জানে। তাই কবিরা বলেন:
“বিষণ্ণ, প্রহত— অপরাধবোধে ভুগেছি এতোকাল ধরে
নিঃসঙ্গ মনে একাকী—
কোনো সুখ সুখ নয়, কোনো কাজ কাজ নয়—
যতক্ষণ না তোমাকে দেখি।”
(তপনকুমার মাইতি)
“মৃত্যুও কোলে নিয়ে ফেলে দেয় উঠানে
এভাবেই মৈত্রী ভাঙে, কোথাও সামর্থ্য নেই।”
(ভবেশ বসু)
“ভাঙা পাঁজরের আড়ালে থমকে আছে বুক”
(বিকাশ চন্দ)
“দূরে কে যেন হেঁটে যায় অচেনা পথিক
বাতাসে ভাসে বেদনার গান।”
(প্রাণনাথ শেঠ)
“আজন্ম আমি এক স্বপ্নবিলাসী অসুখী বিষণ্ণ বালক
আমাকে মোহমুগ্ধ করে তোমার উদ্ধত দুটি পালক”
(আবু রাইহান)
“যদি আকাঙ্ক্ষা করি কারও
প্রিয়তম মৃত্যু সে তোমার”
(মঞ্জীর বাগ)
“শ্রাবণের অন্ধকারে মন খারাপের
নিঃসঙ্গ সংগীত বেজে ওঠে”
(অমৃতা খেটো)
“নক্ষত্রও ফুল হলে,
প্রতিদিন মৃত্যুর শেষে সঙ্গম গাঢ় হয়”
(অর্থিতা মণ্ডল)
“সন্দেহের শরীর ডোবে সন্দেহের শরীরে”
(বিমল মণ্ডল)
“প্রতিটি প্রশ্বাস আঁকে বিষাদ, মৃত্যুর মাদকতা”
(অঙ্কন মাইতি)
“আজীবন জিততে চাই বলে
নিয়মমতো তোমার কাছে হারি।
কান্না সব মুক্তো হয়ে ঝরে পড়ে।”
(জয়দেব মাইতি)
“ঠিকানাকে হতে হবে ঠিকানাবিহীন!”
(সন্দীপ সাহু)
“পরকীয়া রোদের তলায় শুকিয়ে যায় মৌরিফুল”
(নিমাই জানা)
“কৃপণ হয়ো না সমর্পণে,
জিততে যেও না প্রেমে,
ভালোবাসা—রণাঙ্গন নয়, মন্দির।
অস্ত্র খুলে—হাঁটু গেড়ে বসো কাছে।”
(শ্রাবণী বসু)
“অন্ধ ভিক্ষুক হাত পেতে আছে
বুকের ভেতর তোলপাড়!”
(বিথীকা পড়ুয়া মহাপাত্র)
“শ্যাওলাপড়া হৃদয় পাপড়ি মেলে তোমার সুবাসে…”
(কেশবচন্দ্র দাস)
“মনের ভেতর হাট করে খুলে রেখেছি ছোট্টো এক জানালা”
(মোনালিসা পাহাড়ী)
“গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে
প্রেমে পড়ে গেছি
তোমার নামের ব্রজভাষায়।”
(ভগীরথ সর্দার)
“হাল ধরে বসে আছি রাতদিন।
চোরাস্রোতে তবু টেনে ধরে…”
(শুভ্রাশ্রী মাইতি)
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কবিতাগুলিতে উথলে উঠেছে পর্যাপ্ত জীবনের আবেগ। অনুভূতির চুমকুঁড়িতে দীক্ষিত প্রেমের মুকুলগুলি সংরাগে সলজ্জ পরিভাষা আহরণ করেছে। কিছু ক্ষেত্রে ভাষা ব্যবহারের জড়তা থাকলেও পরিশীলিত বাক্ বিন্যাসের সহজ সাবলীল প্রশ্রয় কবিতাগুলিকে অনন্যতা এনে দিয়েছে। জীবনানন্দ দাশের কথাতেই বলা যায়:
“তবু তোমাকে ভালোবেসে
মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এসে
বুঝেছি অকূলে জেগে রয়
ঘড়ির সময়ে আর মহাকালে
যেখানেই রাখি এ হৃদয় ”
সুতরাং এক হৃদয়ের দেখা পাওয়া যায়, যে হৃদয় কালের সীমানা পেরিয়ে মহাকালে পৌঁছে দেবে।
গালিব ছুঁয়ে বলছি: সম্পাদনা শুভঙ্কর দাস ও শুভ্রাশ্রী মাইতি, প্রেক্ষাপট প্রকাশন, মহিষাদল, পূর্ব মেদিনীপুর, মূল্য ১০০ টাকা।
তৈমুর খান