‘বীরভূম পর্ব : ঊনবিংশতি মিথ’(প্রথম প্রকাশ নভেম্বর ২০২১) রজত পালের লেখা অসাধারণ তথ্যপূর্ণ ঐতিহাসিক ক্ষেত্রসমীক্ষার একটি বিরাট গ্রন্থ। বীরভূম জেলার প্রাচীন ইতিহাস এবং নানা কিংবদন্তির প্রেক্ষাপট ও লোককাহিনির উৎস অনুসন্ধান করেছেন। মঠ-মন্দির, আউল-বাউল, পীর-ফকির, মাজার-কবর, উৎসব ও মেলা সবকিছুরই নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন। বীরভূম জেলার ভৌগোলিক অবস্থান, সংস্কৃতি, জনজীবন, বীরভূম নামের উৎস সন্ধান এবং প্রসঙ্গক্রমে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থগুলিতে বীরভূমের ব্যুৎপত্তি অনুসন্ধান করে সঠিক তথ্যটি পরিবেশন করেছেন। বিতর্কিত বিষয়গুলিও পাশাপাশি উল্লেখ করে তুলনামূলক আলোচনায় সঠিকটি বেছে নিতে সাহায্য করেছেন।
পুরো বইটিতে তিনি মনগড়া বা কাল্পনিক কোনও কিছুই বলেননি। শুধুমাত্র গভীর অনুসন্ধিৎসা নিয়েই অন্বেষণ করেছেন। ভূমিকাতে তিনি উল্লেখ করেছেন: “অজস্র লোককথার মধ্য থেকে ঊনিশটি কাহিনি নিয়ে আমরা সাজিয়েছি এই গ্রন্থ ‘ঊনবিংশতি মিথ: বীরভূম পর্ব’। পাঠকদের সুখপাঠ্য মনে হলে এই ধারায় কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রইলো। বীরভূম জেলায় প্রশাসনিক কর্মসূত্রে প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজে গিয়েছি, স্থানীয় মানুষদের সাথে কথা বলেছি। জানতে চেয়েছি সেখানকার মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের কাহিনিগুলো।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখেছি, স্থানীয় মানুষেরা বিস্মৃত হয়েছে তাদের অতীত। পাশে থাকা শিলালিপির সম্পর্কেও জানে না আজকের প্রজন্ম।” নিজেদের ইতিহাস যখন নিজেরাই ভুলে যায় তখনই মানুষ মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। যে জাতির ইতিহাস নেই, সংস্কৃতির পরিচয় নেই—সে জাতি কালের গর্ভে বিলুপ্ত হতে পারে খুব সহজেই। লেখক এই বিস্মৃতিকেই দূর করতে চেয়েছেন। তাই তিনি জীবনের বহমান কাহিনির মধ্যেই বেঁচে থাকার রসদ খুঁজেছেন। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে প্রবহমান জীবন-ইতিহাসের আলোকে বিচার করতে চেয়েছেন। তাই গ্রন্থখানি একটি অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠেছে।
আমাদের গৌরবময় অতীত ঐতিহ্যকে নিরীক্ষণ করার অবকাশ খুঁজে পাই এই গ্রন্থটিতে। যা প্রতিদিন চোখে দেখি, বাড়ির পাশে যে ধ্বংসাবশেষটি এখনও তার অস্তিত্ব জানান দেয়, যে পথ দিয়ে জৈন তীর্থঙ্কররা হেঁটে গেছেন, যেখানে বসে চণ্ডীদাস পদ রচনা করেছেন, যে স্তম্ভ লিপিতে খোদাই করা আছে বৌদ্ধমন্ত্র, কে ছিলেন বীরভূমের জমিদার, কে নির্মাণ করেছিলেন তারাপীঠ, মৌলীক্ষার মন্দির, আকালীপুর কেন ঐতিহাসিক ক্ষেত্র হয়ে উঠল, সুরথ রাজা কে ছিলেন, বীরভূমের মুরারই থানার কনকপুর গ্রাম কেন বিখ্যাত হয়েছিল, শিয়ান প্রশস্তি কারা রচনা করেছিলেন, রাজনগরের রাজাদের কাহিনি সব মিলিয়েই নিখুঁত পর্যবেক্ষণ।
একই মলাটে ১৬০পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে বীরভূম জেলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সেইসব কিংবদন্তির সত্যতা যাচাই করার এক বাস্তবোচিত দলিল হয়ে উঠেছে। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক প্রমাণ নেই তবু কিছু কিছু নিদর্শন যা সত্যতার নিরিখে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। সহজ-সরল বর্ণনার ক্ষমতায় কোথাও জটিলতার সৃষ্টি হয়নি। সঠিক উদ্ধৃতির ব্যবহারে ও সাবলীল প্রয়োগে যে কোনও শ্রেণির পাঠকের কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। শুধু পাণ্ডিত্য থাকলেই এরকম বই লেখা যায় না, এর জন্য দরদী সংবেদনশীল মনেরও প্রয়োজন হয়। লেখক রজত পালের এ বিষয়ে প্রশ্নাতীত দক্ষতা রয়েছে। বইটির বহুল প্রচার কামনা করি।
রজত পাল