বীরভূমের পোড়ামাটির ইতিহাস

STORY AND ARTICLE:

বীরভূমের পোড়ামাটির ইতিহাস
=========================
সৌম্য ঘোষ
————————————————-

অবিভক্ত বাংলার অসংখ্য মন্দির মধ্যযুগীয় ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সমস্ত মন্দির বাংলার বিভিন্ন স্থানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সমকাল অর্থাৎ খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতকের মধ্যে ব্যাপকভাবে নির্মিত হলেও তার অবিচ্ছেদ্য ধারাবাহিকতা বর্তমান কাল পর্যন্ত অব্যাহত আছে। প্রায় কয়েকশো বছর ধরে ইট নির্মিত অসংখ্য মন্দির বর্তমানে ধ্বংস হয়ে গেলেও, যেগুলি অবশিষ্ট আছে তার সংখ্যাও কম নয়।
মধ্যযুগীয় বাংলায় বিভিন্ন মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে, উচ্চ শ্রেণীভূক্ত মানুষের মতো নিন্মশ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরাও যেমন সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করত, তেমনি আবার এই সমস্ত মন্দিরে বিভিন্ন পূজা অর্থাৎ দুর্গাপূজা, কালীপূজা, শিবরাত্রি, দোল প্রভৃতি উপলক্ষে জাতি নির্বিশেষে
মানুষের সমাগম ঘটার ফলে উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে সমন্বয় সাধন হতো। ওইসব পূজা-পার্বণ উপলক্ষে বিভিন্ন জাতির মানুষ মন্দিরের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হতো। যেমন ব্রাহ্মণ পৌরহিত্যের কাজ, মালাকার ঠাকুর সাজানোর কাজ, পুষ্পচয়ন ও মালা গাঁথার কাজে নাপিত ও তাঁতিরা এবং ঢাক ও কাঁসর প্রভৃতি বাদ্য বাজানোর কাজে ডোম। হলে এই মন্দির গুলি ব্যক্তিবিশেষের না হয় সর্বজনীন মন্দির হিসেবে পরিগণিত হতো।

বীরভূম জেলার বিভিন্ন গ্রামের ১৭০০– ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মন্দিরগুলি উল্লেখযোগ্য এই জন্য যে তৎকালীন সমাজে মন্দির প্রতিষ্ঠা একটি সামাজিক ঐতিহ্য হিসেবে পরিগণিত হতো। এই কালখন্ডে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের যুগান্তকারী প্লাবন বাংলার শিল্পকে এক নতুন আলোয় আলোকিত করে। সমাজের তথাকথিত নিন্মশ্রেণীভূক্ত কৃষক, কারিগর এবং ব্যবসায়ীদের আর্থিক অবস্থারও ক্রমোন্নতি ঘটে। তারা সমাজের উচ্চশ্রেণীভূক্ত ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের ন্যায় সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
ফলে স্থানীয় ভূস্বামী, রাজা জমিদার ছাড়াও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যক্তি যেমন বণিক সম্প্রদায়, কোন অন্ত্যজ শ্রেণীর বিত্তশালী ব্যক্তিরাও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই সকল মন্দির নির্মাণের মাধ্যমে মন্দির প্রতিষ্ঠার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি প্রকাশ পেত। এছাড়াও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামদেবতা বা স্থানীয় দেবতার মন্দির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাতার সম্মানও বৃদ্ধি পেত।
এইসকল মন্দিরগাত্রে উৎকৃষ্ট বিভিন্ন অলংকৃত পোড়ামাটির ফলকে পৌরাণিক ও সামাজিক কাহিনীর মাধ্যমে শিল্পীর ভাস্কর্য পরিচয় পাওয়া যায়। এই ইট নির্মিত মন্দিরাদিকে স্থাপত্যের ভিত্তিতে সাধারণত চালা ( চারচালা বা আটচালা), রত্ন ( একরত্ন বা পঞ্চরত্ন), অষ্টকোনাকৃতি, দেউল ( রেখদেউল বা পীড়াদেউল), মাথ ( বর্তমানে যা পূর্ববঙ্গে দেখা যায়) প্রভৃতি ছয়টি ভাগে ভাগ করা যায়। এই একেকটি মন্দিরকে পুনরায় পাঁচটি অংশে বিভক্ত করা হয়, যেমন — ভিত্তি, জংঘা, শিখর, কলস ও পতাকাদন্ড। প্রায় প্রতিটি মন্দিরের জংঘা প্রদেশে কমবেশি পোড়ামাটির ফলক দ্বারা অলংকৃত।
এই ফলকগুলিতে রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি বিভিন্ন ঘটনাবলী শিল্পী সুনিপুণতার সঙ্গে উৎকীর্ণ করেছেন। শিল্পীর হাতের স্পর্শে বিভিন্ন দৃশ্য যেমন রামের বনবাস,অশোক কাননে সীতা, রাম রাবণের যুদ্ধ, মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ,কৃষ্ণলীলা ও দশাবতার প্রভৃতি রূপ পেয়েছে।
এছাড়াও সামাজিক দৈনন্দিন জীবনের চিত্র বিভিন্ন ফলকে প্রতিফলিত হয়েছে। অভিজাত পরিবারের অন্দরমহলের নারী প্রসাধনের দৃশ্য যেমন ধরা হয়েছে, কেমনি হ্যাটবুট পরিহিত বিদেশি সাহেবের হাতে জপমালা ও কমণ্ডলু নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। একটু নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকের মন্দিরগুলিতে বিদেশি প্রভা ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায়; যেমন দুবরাজপুরের একটি শিব মন্দিরের জংঘাপ্রদেশ একজন ইউরোপীয়ান ভদ্রমহিলার আবক্ষ মূর্তি সুনিপুণতার সাথে উৎকীর্ণ করা আছে। আবার অন্য একটি ফলকে নীলকর সাহেবদের নারীর প্রতি আসক্তি ও নির্মম অত্যাচার শিল্পী তাঁর অসাধারণ নিপুণতায় ব্যক্ত করেছেন। দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” নীলকর সাহেবদের অত্যাচার যেমন আমাদের মনে সাহেবদের প্রতি ঘৃণার জন্ম দেয় ঠিক তেমনি এই নির্দিষ্ট ফলকটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং মনে সাহেবদের অত্যাচারের ছবি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। বীরভূমে নীলকর সাহেবদের বহু কুঠির নিদর্শন আজও বর্তমান। এই সুনির্দিষ্ট ফলটিতে স্পষ্টতই বর্ণিত হয়েছে একটি সাহেব একটি নারীর বস্ত্রহরণ করছে এবং তাকে সাহায্য করছে অন্য একটি দাড়িওয়ালা পুরুষ, যাকে ভারতীয় বলে চিহ্নিত করা অতি সহজ এবং অসহায় মহিলাটি প্রাণপণে নিজ লজ্জা নিবারণে সচেষ্ট। তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক ভয়ার্ত দৃষ্টি। এখানে শিল্পী তার সুনিপুণ শৈল্পিক গুনে এই দৃশ্য যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছেন। এই সময় কত যে নিষ্পাপ নারী এই অত্যাচারী সাহেবদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন তার একটি ঐতিহাসিক দলিল এই ফলকটি।
এই রকম বহু ঘটনা বলি এই সকল মন্দিরের ফলক থেকে পাওয়া যায়। যার সাহায্যে তৎকালীন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক সুসজ্জিত মন্দিরগুলি আজও স্ব-মহিমায় বিরাজমান। কিন্তু সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এই মন্দিরগুলি ভগ্নদশায় জর্জরিত। যার দায়ভার বহুলাংশেই আধুনিক সমাজ জীবনকে বহন করতে হবে। বর্তমানে বহু মানুষ তাদের বাসস্থান সুশোভিত করার জন্য মন্দিরের ফলকাদি ব্যবহার করছেন।
যা দীর্ঘকাল চললে আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে কোন ঐতিহাসিক নজির অবশিষ্ট থাকবে না। তাই আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই মন্দির গুলি সংরক্ষণ একান্ত কর্তব্য। যা সহস্রাব্দের প্রজন্মের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে।।

==================================

লেখক •••• সৌম্য ঘোষ। পোঃ চুঁচুড়া। জেলা: হুগলী। পশ্চিমবঙ্গ।

___________________________________________

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *