বিরসা মুন্ডা এক অবিসংবাদী সংগ্রামী নায়ক – পুলক মন্ডল

তাঁর জীবন মাত্র ২৫ বছরের। ১৮৭৫ এর ১৫ নভেম্বর থেকে ৯ জুন ১৯০০। এই স্বল্প জীবনের শেষ পাঁচ বছর (২০-২৫) তাঁর ঈশারায়, তাঁর নির্দেশে ব্রিটিশ সরকার থেকে দেশীয় অত‍্যাচারী জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জীবন বাজী রাখতেন লক্ষ লক্ষ আদিবাসী জনতা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর জন্মদিনেই বিহার ভেঙে গঠিত হয় ঝাড়খন্ড রাজ‍্য।

 

সাবেক বিহারের এই ঝাড়খন্ডেরই জেলা রাঁচীর উলিহাটু গ্রামে তাঁর জন্ম। ২০০৪ সালে তাঁর জীবন নিয়ে ‘উলগুলান-এক ক্রান্তি’ নামে একটি হিন্দী সিনেমা প্রকাশিত হয়৷ আবার মহাশ্বেতা দেবী তাঁর জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘অরণ্যের অধিকার’ নামে একটি উপন্যাস, যার জন্য তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ভারতীয় পার্লামেন্ট মিউজিয়ামে একমাত্র আদিবাসী নেতা হিসেবে তাঁর ছবিই সযত্নে রাখা আছে।

 

তাঁর নামে হয়েছে বিরসা মুন্ডা বিমানবন্দর রাঁচি, বিরসা ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি সিন্ড্রি, বিরসা মুন্ডা বনবাসী ছাত্ররাবাস, কানপুর, সিধো কানহো বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া এবং বিরসা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
কৈশোরে তাঁর হাতে থাকত একতারা আর কোমরে গোঁজা থাকত বাঁশি, কিন্তু অধিকারের লড়াইয়ে সেই হাতেই উঠে এল তীর ধনুক। আদিবাসী ভাষায় ‘উলগুলান’ শব্দের অর্থ বিদ্রোহ। অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে আদিবাসী বিদ্রোহের অবিসংবাদী নায়ক তিনি বিরসা মুন্ডা।

 

১৮৮৬ সাল থেকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত বিরসা এবং তার পরিবার চাঁইবাসাতেই বসবাস করত। কিন্তু একসময় জার্মান এবং রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হলে সেই আন্দোলনের রেশ পড়েছিল আদিবাসীদের মধ্যেও। স্বাধীনতা সংগ্রামের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে তাঁর বাবা সুগানা মুন্ডা বিরসাকে স্কুল থেকে সরিয়ে নেন। ১৮৯০ সালে চাঁইবাসা থেকে বিরসাকে নিয়ে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে নিজস্ব উপজাতি ধর্ম গ্রহণ করে গ্রামে ফিরে আসেন তার মা করমি বাহাতু।

বিরসা মুন্ডা ‘মুন্ডা বিদ্রোহে’র নেতা হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন৷ যদিও প্রথমেই তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নেননি৷ কৈশোরে তার হাতে থাকত একতারা আর কোমরে বাঁশি, কিন্তু অধিকারের লড়াইয়ে সেই হাতেই উঠে এল তীর ধনুক। মিশনারি স্কুলে থাকাকালীন বিরসা সরদারি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন৷ বিরসা তার অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলেন আদিবাসীদের দুরাবস্থার জন্য একা দিকু (দিকু কথার অর্থ শত্রু / আদিবাসীরা বহিরাগতদের দিকু বলত) অর্থাৎ বিট্রিশরা দায়ী নয়, দেশীয় দিকুরাও ব্রিটিশদের সঙ্গ দিচ্ছে। তাই হয়ত নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে আছে আদিবাসীরা।

নিজ জাতিকে জাগ্রত করার দায়িত্ব বিরসা দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। বিরসা মুন্ডা আদিবাসীদের মূল ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় ধর্মীয় ব্যবস্থা অনুসরণ করার পরামর্শ দেওয়া শুরু করেন । লোকের মুখে মুখে বিরসা হয়ে উঠেছিলেন ‘ ধরতি আবা ‘ অর্থাৎ ভগবান, জগৎ পিতা৷ মাত্র কুড়ি বছর বয়সে ১৮৯৫ সালে তিনি ঘোষণা করলেন এক নতুন ধর্মের যার মূল ভিত্তি ছিল একেশ্বরবাদী মুন্ডা ধর্ম। দলে দলে মুন্ডা, ওঁরাও, খরাই নরনারীরা নতুন ধর্ম গ্রহণ করে পরিচিত হল ‘বিরসাইত’ নামে।

ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চেয়েছিল। তারা একে একে দখল করতে থাকে অরণ্য জমি। আদিবাসীদের দখলে থাকা জমিগুলি তাদের থেকে অন্যায় ভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হয়। ১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন প্রয়োগ করে, ভারতের বিস্তীর্ণ জঙ্গল মহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিল আদিবাসীদের ৷ হাজার হাজার বছর ধরে যে জঙ্গলের ওপর ভরসা করে জীবনযাপন করতেন আদিবাসীরা, সেই অরণ্যের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল তাদের থেকে৷ যখন ছোটোনাগপুরের সংরক্ষিত বন দখল করার উদ্যোগ নিল ব্রিটিশ সরকার, সেই সময় জেগে ওঠে সমগ্র পাহাড় জঙ্গল ও বিরসাইত বাহিনী। ব্রিটিশের বন্দুকের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে তীর-ধনুক নিয়ে লড়াই শুরু হল৷

পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৮৯৫ সালে জেলা পুলিশ বিরসাকে বন্দী করল এবং দুই বছরের জন্য তার কারাদণ্ডে দণ্ডিত করল । ১৮৯৭ সালের ৩০ নভেম্বর বিরসা মুক্তি পায়। আবার নতুন করে শুরু হয় বিদ্রোহের প্রস্তুতি৷ স্থানে স্থানে সভা হয় ‘ উলগুলান ‘ বা স্বাধীনতা আনার জন্য চলতে থাকে প্রস্তুতি৷ বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ সালে রাঁচির দক্ষিণাঞ্চলে ‘মুন্ডা বিদ্রোহ’ সংগঠিত হয়। এই বিদ্রোহকে মুন্ডারি ভাষায় বলা হয় ‘উলগুলান’।

এই বিদ্রোহের মূল লক্ষ্য ছিল মুন্ডা রাজ ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা অন্যভাবে বলা গেলে অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল তারা। বিরসার প্রধান কেন্দ্র ছিল ডোম্বরি পাহাড়। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিলেন গেরিলা পদ্ধতি। ১৮৯৯ সালের ২৪ শে ডিসেম্বরে রাঁচি ও খুন্তি শহরে বিরসা বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে বেশকিছু পুলিশসহ নিহত হল অনেক মানুষ, অগ্নিদগ্ধ হল শতাধিক ভবন।

এই আক্রমণের জবাবে ব্রিটিশ সরকার ১৫০ সেনা নিয়ে আক্রমণ করল ডমরু পাহাড়৷ কমিশনার ফোর্বস ও ডেপুটি কমিশনার স্ট্রিটফিল্ড নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করলেন চারশত মানুষ। তবে বিরসাকে তারা ধরতে পারলেন না। সরকার ৫০০ টাকা ঘোষণা করলেন বিরসাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য৷

১৯০০ সালের চক্রধরপুরের যমকোপাই বনে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত অবস্থায় বন্দী হলেন বিরসা৷ বিরসাকে ধরিয়ে দেওয়ার ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। বিরসা রোগাতো নামক এক স্থানে সভা শেষ করে সেনেত্রার জঙ্গলে ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছিলেন৷ ডোনকা মুন্ডার স্ত্রী সালি তার জন্য ভাত রাঁধছিল।

 

ভাত রাঁধার ধোঁয়া জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে দূর থেকে দেখা যায়। ব্রিটিশ পুলিশ সেই ধোঁয়া লক্ষ্য করে এগিয়ে আসে এবং অবশেষে মনমারু ও জারকাইল গ্রামের মানুষ কিছু টাকা এবং পেট ভরে দুটো খাওয়ার লোভে বিরসাকে ধরিয়ে দেয়। বিরসাকে বন্দী করা হয় এবং বিচার শুরু হয়, বিরসার সঙ্গে ৫৭১ জনের বিচার চলে।

তাদের মধ্যে তিন জনের ফাঁসি হয় এবং ৭৭ জনের দীপান্তর সহ কারাদন্ড হয়। বিদ্রোহীদের রাঁচি জেলখানায় শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল।

বিরসা মুন্ডার ১৯০০ সালের ৯ জুন রাঁচি জেলে বিষপ্রয়োগের ফলে মৃত্যু হয়। যদিও জেলের রিপোর্টে বলা হয় রক্ত বমি এবং আমাশার কারণে বিরসার মৃত্যু ঘটেছে। মুন্ডাদের কবর দেওয়া হয় অথচ বিরসাকে তড়িঘড়ি করে দাহ করা হয়েছিল৷ উদ্দেশ্য ছিল দুটো, এক তার মৃত্যুর সঠিক কারণ ধামাচাপা দেওয়া ও দুই সকল আদিবাসীদের বোঝানো যে বিরসা ভগবান নয় একজন সাধারণ মানুষ৷ যদিও বিরসা মুন্ডা আদিবাসীদের কাছে আজও ভগবান হিসেবেই বেঁচে আছেন।
তবে বিরসার মূল‍্যায়ন শুধুমাত্র আদিবাসী নেতা হিসেবে করলে তাঁকে যথেষ্ট সম্মান জানানো হয় না। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিসংবাদী নায়ক।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *