“বিদ্রোহী”— শতাব্দীর যুগবাণী

STORY AND ARTICLE:

 

‘বিদ্রোহী’ — শতাব্দী যুগবাণী
÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷÷
সৌম্য ঘোষ
“”””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””””

 

কবিতা একদিকে যেমন শিল্প তেমনি অন্যদিকে বাস্তবতার নির্যাস। এতে মিশে থাকে জীবন ও সমকালের চেতনা ও যাতনার ফল্গুধারা। একটি কবিতায় যখন একটি যুগকে একাকী ধারণ করে তখন তা হয়ে যায় ‘যুগবাণী’। এরকম যুগবাণী কবিতা বিরল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি যুগের গূঢ়বাণীকে গাঢ়ভাবে ধারন করে।‌ ‘বিদ্রোহী’ নিছক কোন একটি সাদামাটা কবিতা নয়। এটি কোন উচ্চাভিলাষী তরুণের স্বপ্ন সন্দর্শন নয়। ‘বিদ্রোহী’ একটি যুগান্তরের সূচনা। বিদ্রোহী কেবলমাত্র কোন ব্যক্তি মনোরঞ্জনের সাহিত্যও নয়। বিদ্রোহী ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আত্মজাগরণের এক অভূতপূর্ব উপাখ্যান। একজন যুদ্ধ ফেরত কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার মাত্র বাইশ বছর বয়সে যুগান্তরের যুগবাণী লিখে হইচই ফেলে দেবে, একথা কস্মিনকালেও কেউ ভাবেনি। তাও আবার ঔপনিবেশিক যুগে বসে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগের উদ্বোধনের বাঁশি বাজিয়ে দেবে, সে আশা কেউ স্বপ্নেও লালন করেনি। কিন্তু ফকির আহমেদের ক্ষ্যাপা ছেলে, ‘অবেলার ডাক’-এ উতলা করে তোলা মা জাহেদার অভিমানী নজর আলীই যুগবাণী অমরস্রষ্টা হয়ে দাপিয়ে বেড়ালেন উত্তর ঔপনিবেশিক যুগের রন্ধে রন্ধে।

‘বিদ্রোহী’র জন্ম উপাখ্যান চমকপ্রদ না হলেও ঘটনাবহুল। ব্রিটিশ রাজশক্তির পক্ষে 49 নম্বর বাঙালি পল্টনে যুদ্ধ করে নিজের রাজভক্তির পরিচয় দিয়েছেন তাও খুব বেশি দিন হয়নি। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর অন্তর্লোকে যে চেতনার জাগরণ ঘটে গেল, তাঁর ভাবনার জগতে যে আমূল বিপ্লব সাধিত হলো, তাই-ই তাঁকে অবিস্মরনীয় করে রেখেছে। ঊনিশশো একুশের ডিসেম্বরে ভূমিষ্ঠ হওয়া ‘বিদ্রোহী’ প্রায় পঞ্চাশ বছর এগিয়েছিল তাঁর সময়ের চেয়ে। ‘বিদ্রোহী’র সূতিকাগার তিন বাই চার তারাতলা লেনের দ্বিতল বাড়ির নিচতলার একটি আঁধারপ্রমাণ ঘর যা আজও হেরিটেজের মর্যাদা পাইনি, অথচ পাওয়ার অধিকার ছিল। ‌

‘বিদ্রোহী’ দেশমাতৃকার স্বাধীনতা এবং শোষণের নিগড় হতে মুক্তিই অভীষ্ট। কিন্তু একটু মনোযোগ দিলেই বোঝা যায়, এই কবিতা ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এক নব সাংস্কৃতিক চর্চার উদ্গাতা। যদিও নজরুলের বিদ্রোহীর অনেক পরেই ফিলিস্তানী লেখক ও গবেষক এডওয়ার্ড সাঈদের “Orientalism (১৯৭৮)” এবং
ইব্রাহিম ফ্রান্ৎজ ফানোর “Black skin white masks (১৯৫২)” ও “Reched of the earth” (১৯৬১)” উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদের উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়। কাজী নজরুলের এই কবিতার মাধ্যমে উত্তর ঔপনিবেশিকতাবাদের যে বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে তাই এনে দিয়েছে নবজাগরণের এক ভোর। কবির ”বিদ্রোহী’ কবিতাটি তাই কেবলমাত্র ভারতবর্ষের কবিতা হয়ে আটকে থাকেনি, তা একই সাথে আন্তর্জাতিকতাকেও ধারণ করেছে। বিশ্বের তাবৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক শোষিত মানুষের মনের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠেছে বিশ্ব মানুষের কবিতা।

দ্রোহকে শিল্পের পর্যায়ে এনে, ধমকের সমষ্টিকে কবিতায় পরিণত করে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে সাহিত্যের নতুন ভাষা। বিদ্রোহী কবিতাকে নতুন আঙ্গিক দানের পাশাপাশি উত্তম পুরুষের লেখা পৃথিবীর সর্বোত্তম কবিতা হিসাবে উপস্থাপন করে গেছে।
বিদ্রোহী কবিতার আরেকটি অমূল্য সম্পদ নারীকে কবিতায় প্রদত্ত সম্মান। নারীশক্তিকে পূজানীয়া আদ্যাশক্তি দেবী বা যৌবন-ভীতু পল্লীবালার অবয়বে প্রণম্য করেছেন।
একটি কবিতা একশ’ বছর ধরে সমান জনপ্রিয়, ব্রিটিশরাজের ভারতবর্ষ ত্যাগের পরেও
‘বিদ্রোহী’ কেন এত আদৃত? ‘বিদ্রোহী’র মূলভাষ্য যতটা না ব্রিটিশের প্রতি বৈরিতা, তারচেয়েও অধিক স্বনিত হয়েছে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল’-এর প্রশমন। দেশের অঙ্গচ্ছেদের মূল্য দিয়ে ভারত স্বাধীন হয়েছে বটে, গোরা সাহেবদের পরিবর্তে দেশীয় নেতাদের অধীনে দেশের সার্বভৌম কর্তৃত্ব এসেছে বটে, কিন্তু আজও উৎপীড়িতের কান্নার রোল স্তব্ধ হয়নি। আজও
‘Have এবং Have not’ -এর দ্বন্দ্ধ , জাতগত সংরক্ষণের বিশেষ সুবিধার জোগান দিয়ে একটি অংশকে প্রলোভিত করে রাখার দ্বন্ধ মানব সভ্যতার বিকাশকে লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছে।
এই শ্রেণীবৈষম্যে থেকে মুক্তির বার্তা নিয়ে ‘বিদ্রোহী’র প্রয়োজন আজও অক্ষত রয়ে গেছে।
তাই শতবর্ষে এসেও আজ মনে হয়, কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী” আমার পূর্ব পুরুষের কবিতা, “বিদ্রোহী” আমার স্বকালের কবিতা , “বিদ্রোহী” উত্তর প্রজন্মের কবিতা।।

=========================
লেখক •••• সৌম্য ঘোষ। চুঁচুড়া। পশ্চিমবঙ্গ।

______________________________

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *