বিজয়ার প্রনাম – শম্পা সাহা

রহিমের দোকানে হেলপারের কাজ করে সজল। বাবা মারা গেছেন ,ওর বয়স তখন চার আর বোন পিংকি দুই। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। বছর দশ পর্যন্ত পাড়ার প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে। দুপুরে মিড-ডে-মিল, বই খাতা সব পেত। ফাইভে হাই স্কুলে আর পড়া হলো না । সেই থেকে রহিমের মাংসের দোকানে। মাসে দেড় হাজার টাকা আর দশ টাকা টিফিন রোজ হিসেব মত মোট ষাট টাকা পার ডে। 

    ছোট মানুষ তেমন কিছু করতে পারেনা, ওই সিমেন্টের দোকান ধুয়ে রাখা, খাসি কাটার পর তার নাড়িভুঁড়ি আলাদা করা, ছালটাল গুলো সরিয়ে রাখা, এইসব টুকিটাকি । আর দু-তিন বার চা নিয়ে আসা সামনের দোকান থেকে।

   দোকান তুলে যখন রহিম চাচা পাল্লা খুলে রাখে, তারপর মাংস কাটার চপার ,কাঠের পাটাতন পিঁড়ি সব ভালো করে ঝাঁটা দিয়ে ধুয়ে রাখা ,বটিটা পরিষ্কার করা, সামনের কল থেকে জল এনে আর যেখানে ছাগলটাগল থাকে সেখানটাও ঝাড়  দিতে হয় । বাঁধা থাকতে থাকতে ছাগলগুলো যা নাদায়, মনে হয় সব খাবার এখানে এসেই বের করে ।  ছাগলদের কাঁঠাল পাতা ও খাওয়ায়, সেটা অবশ্য করতে সজলের খুব খুব ভালো লাগে। বাড়ির উঠোনের কচি কচি কাঁঠালপাতা রোজ এক বোঝা করে নিয়ে আসে ,সে জন্য অবশ্য রহিম চাচা দু টাকা করে দেয় ওকে।ও ছাগলগুলোর গলায় ঘাড়ে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় ,যত্ন করে পাতা খাওয়ায়, জল খাওয়ায়, জানে একটু বাদে চাচা ওদের একে একে টেনে নিয়ে চপারের এক কোপে  ধড় থেকে মাথাটা আলাদা করে দেবে আর ছাগল টা একবার ব্যা করে ডেকেই চুপ। আসলে বোধহয় ব্যা করে মাকে ডাকে, বিপদের সময় তো সবার আগে মার কথাই মনে পড়ে, যেমন ওর তেমন কিছু হলেই মায়ের কথা মনে পড়ে। ছাগলগুলোর পরিণতির কথা ভেবে ওদের আরো বেশি করে আদর করে সজল । রহিম চাচা হাসে, “আরে পাগল ,এত কি ওদের আদর করছিস! এক্ষুনি তো জবাই হয়ে যাবে।”

   আজ দশমী, পলাশী পাড়া গ্রামের আজ সব বাড়িতে মাংস ,খাসির মাংস বেশিরভাগ ই তবে যারা একেবারে পারে না তাদের মুরগি । কিন্তু এই গ্রামে দশমীর দিন খাসির মাংস খাওয়ার রীতি । 

   করোনার জন্য সজলের মা এর পাঁচ বাড়ির কাজের তিন বাড়িই ছাড়িয়ে দিয়েছে আর দুবাড়ি শুধু বাইরের কাজ ,তাই মাইনে কম। যদিও রহিম চাচার দোকান বন্ধ ছিল যে কদিন ,সে কদিন বাদে দোকান খোলা অবধি বিক্রি হোক না হোক তাকে পঞ্চাশ টাকা করে রোজ হাতে দিয়েছে । যদিও চাচার অবস্থা তেমন ভালো নয়।     

   মানুষের হাতে এত পয়সা কোথায় যে খাসির মাংস খাবে ,যা দাম!এবার মা মাত্র দু বাড়ি থেকে বোনাস পেয়েছ তাতে বোনটার একটা জামা আর সজলের একটা হাফপ্যান্ট, হাফ শার্ট আর মায়ের ছাপা শাড়ি। হাতে আর তেমন পয়সা নেই, হিসেব করে চাল ডাল আলু কিনে রেখেছে । মাসের শেষ কটা দিন ওই দিয়েই তো চালাতে হবে । 

  দশমীর দিন বেশ ভিড় দোকানে মানে লকডাউন এর পর থেকে যা চলছিল তার চেয়ে কিছু বেশি। চুপ করে বসে সজল দেখছিল একে একে খরিদ্দারের বাড়ানো থলেতে চলে যাচ্ছে খাসির মাংস । কতদিন যে খাসির মাংস খায় নি ওরা ,মাংস ই হয়নি কতদিন! যে ভাবে দিন চলছে !’বাবা যদি বেঁচে থাকতো! ‘সজল ভাবে।আজ আর ছাগলগুলোর সঙ্গে খেলে না।

   দোকানের ভিড় পাতলা হলে রহিম চাচা জিজ্ঞাসা করে, “এই সজল ,আজ বাড়িতে কি মাছ নিলি? “, মাছ নিইনি চাচা”, সজল মন খারাপ করে বলে, “তাহলে কি মুরগি? “,”না চাচা ডাল টাল হবে কিছু একটা,ঠিক জানিনা”। 

   বিক্রি-বাট্টা শেষ ,চাচা পাল্লা খুলে রাখে। সজল বালতি করে জল এনে সব ধুয়েধায়ে  তুলে টাকাটা নেবে বলে দাঁড়িয়ে। রহিম বিড়িটা শেষ করে পকেট থেকে ওকে রোজকার মত পঞ্চাশ টাকা করে বার করে দেয়, তারপর পাশে রাখা একটা কালো প্লাস্টিকের প্যাকেট ওর হাতে দেয় ধরিয়ে  । ও অবাক চোখে রহিম চাচার দিকে তাকায়। চাচা বলে, “আজ তো বিজয়া দশমী, আজ তো তোদের মাংস খেতে হয়, গিয়ে মাকে দে।”সজল প্যাকেট খুলে দেখে প্রায় তিন চারশ মাংস হবে। ছাঁটটাট নয়, একেবারে ভালো মাংস !ও রহিম চাচার দিকে চেয়ে বলে, “কিন্তু”, “আরে পাগলা কোন কিন্তু না, যা অনেক বেলা হলো তাড়াতাড়ি  গিয়ে রান্না করতে বল “।

   সজলের চোখ ঝাপসা হয়ে এল, ও ঝপ্ করে নিচু হয়ে রহিম চাচার পা ছুঁয়ে বিজয় দশমীর প্রথম  প্রণামটা সারলো। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *